পীরবাবার রাত
আমার কর্মজীবন শুরু হয়েছিল রেলের চাকরি দিয়ে। বি. আর. আই. কে. জি. পি’র (ব্রিজ ইনস্পেক্টর, খড়্গপুর) আন্ডারে একটি ছোট পোস্টে চাকরি পেয়েছিলাম। আমাদের কর্মস্থল ছিল শালিমার। তবে মাঝেমধ্যে খড়্গপুর টাটানগর সিনি গিধনি ভদ্রকেও কাজকর্ম নিয়ে যেতে হত। কিন্তু সে যাওয়া নাম কা ওয়াস্তে। গেলুম, প্রচণ্ড গতিতে কাজ করলুম এবং ফিরে এলুম। ঘোরা, বেড়ানো কিছুই হত না। তাই একবার আমরা বন্ধুরা মিলে ঠিক করলাম কিছু না হোক এক রাত খড়্গপুরে সোমসাহেবের বাংলোয় গিয়ে কাটিয়ে আসব।
সাহেব প্রতি শনি-রবিবার কলকাতার বাড়িতে চলে আসতেন। আমরা সাহেবের অনুমতি নিয়ে এক রাত তাঁরই বাংলোতে থাকবার ব্যবস্থা করলাম। সঙ্গী ছিলাম চারজন। হিরু, আমি, রবি এবং মুন্না। তখন পৌষ মাস। কনকন করছে ঠাণ্ডা। আমরা খাওয়াদাওয়া সেরে বেলা দশটা-এগারোটা নাগাদ ট্রেনে চেপে খড়্গপুরের দিকে রওনা হলাম।
সন্ধের আগেই খড়্গপুরে পৌঁছলাম আমরা।
স্টেশন থেকে নেমে হাঁটাপথে আমরা যখন সোমসাহেবের বাংলোর দিকে যাচ্ছি তখন হঠাৎ বিনোদের সঙ্গে দেখা। বিনোদ আর আপ্পারাও ছিল সোমসাহেবের ট্রলিম্যান। এরা দু’জনেই আমাদের পূর্ব পরিচিত।
আমাদের দেখেই বিনোদ বলল, “আরে, কী ব্যাপার! আপনারা?”
আমরা ভেবেছিলাম বিনোদ বোধ হয় আমাদের খাতির করে নিয়ে যাবে বলে আসছে। তার জায়গায় এইরকম প্রশ্নে চমকে উঠলাম। বললাম, “কেন, তুমি জানো না? আমরা তো আজ রাত্রে সাহেবের বাংলোয় থাকব।”
“সাহেবের বাংলোয়? মাথাখারাপ নাকি? সাহেব আজ পর্যন্ত নিজের ছেলেকেই এখানে আসতে দেননি।”
“কিন্তু সাহেবের সঙ্গে তো কথা হয়ে গেছে। উনি অনুমতি দিয়েছেন।”
“ও। তা কই সেরকম কিছু তো উনি বলেননি আমাদের।”
“হয়তো বলতে ভুলে গেছেন।”
বিনোদ একটু চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বলল, “তা হলে তো মুশকিল হল।”
“মুশকিল কীসের? সাহেব চাবি দিয়ে যাননি?”
“না না, তা নয়। ডুপ্লিকেট চাবি তো আমার কাছে থাকে। কিন্তু আপনাদের অসুবিধে হয়ে যাবে খুব। ওখানে কি আপনারা থাকতে পারবেন?”
হিরু বলল, “কেন, কী ব্যাপার! থাকতে পারব না কেন?”
“সাহেব আজ ছুটির পর বাড়ি যাবেন বলে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু একটু আগেই স্টেশন থেকে ফিরে এসেছেন তিনি। সিনিতে ব্লক। জি. এম. আসবেন। তাই ভাবছি সাহেবের সঙ্গে ওই বাংলোয় আপনারা কী করে থাকবেন?”
আমরা চারজনেই লাফিয়ে উঠলাম শুনে, “অসম্ভব।”
কেননা সোমসাহেব অত্যন্ত ভারিক্কি এবং বদমেজাজি লোক। ওঁর স্ত্রী পুত্র পরিজনরাও বাঘের মতো ভয় করে সোমসাহেবকে। আর আমরা, যারা তাঁর অধীনে অনেক ধাপ নিচুতে কাজ করি আমাদের কাছে তো তিনি এক মূর্তিমান বিভীষিকা। বিশেষ করে আমাদের সঙ্গে সাহেবের ফেস টু ফেস কথাও হয়নি। আমাদের সুপারভাইজার বলে কয়ে রাজি করিয়েছিলেন সাহেবকে। এখন কোন সাহসে আমরা তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াব? এবং গেলেও লাভ কি হবে? আশ্রয় তো পাবই না। উলটে হাজার রকম কাজের ফিরিস্তি চেয়ে অপমান করে তাড়িয়ে দেবেন।
আমি বললাম, “না। যে লোকের চোখের দিকে তাকাতে সাহস হয় না, তার সঙ্গে একত্রে এক রাত এক আশ্রয়ে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমরা অনেক আশা নিয়ে এখানে এসেছি। এক রাত একটু আনন্দ করে কাটাতে। কোথায় একটু হইহল্লা করব, এ ওর পেছনে লাগব, গলা ছেড়ে গান গাইব, কিন্তু এখানে আশ্রয় পেলেও সেসব তো হবেই না, উলটে চোরের মতো মুখ বুজে ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে।”
বিনোদ বলল, “আমিও তাই বলি, আপনারা বরং অন্য কোথাও চলে যান।”
মুন্না বলল, “অন্য কোথায় যাব বলুন?”
“হয় হোটেলে উঠুন, নয়তো এখুনি বম্বে এক্সপ্রেস আসবার সময় হয়ে গেছে, গাড়িতে চেপে আপনারা সোজা ঝাড়গ্রামে চলে যান। ঝাড়গ্রাম এর চেয়ে অনেক জায়গা। খুব ভাল লাগবে আপনাদের। ঘুরে বেড়িয়ে শান্তি পাবেন।”
ওই ভাল।
বিনোদের কথায় আমাদের মন কিন্তু সায় দিল না। আমরা যখন কী করব, কী না করব ভাবছি তেমন সময় সাহেবের আর এক ট্রলিম্যান আপ্পারাও এসে হাজির, “এই যে! আপনারা সব এসে গেছেন দেখছি। কতক্ষণ এসেছেন?”
“সবে আসছি। কিন্তু তুমি কী করে জানলে আমাদের আসবার কথা?”
“সাহেবের মুখে এখনই শুনলাম। সাহেব বললেন, আমি সকালে বলতে ভুলে গেছি। ছোঁড়াগুলো এখুনি হয়তো হাজির হবে। ওদের আজ এখানে আসবার কথা। তা আমি যখন এখানে ফিরে এসেছি তখন ও চারটেতে তো এখানে থাকতে পারবে না। তার চেয়ে ওদের ইঁদায় ছেড়ে দিয়ে আয়।”
আমরা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম। ইঁদায় ছেড়ে দিয়ে আয়’ কী রে বাবা!
আপ্পারাও বলল, “চলুন আপনাদের ইঁদায় ছেড়ে দিয়ে আসি। ওখানে সাহেবের বোনের বাড়িতে আপনাদের নেমন্তন্ন। সাহেব ফোনে বলে দিয়েছেন ওঁদের।”
ব্যাপারটা খুবই গোলমেলে ঠেকল আমাদের কাছে। সাহেবের বোনের বাড়িতে নেমন্তন্ন? যাদের কখনও চোখেই দেখিনি তাদের বাড়িতে কোন সুবাদে নেমন্তন্ন খেতে যাব?
বিনোদ বলল, “না না লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। সাহেব এমনিতে বদমেজাজি লোক হলেও সাহেবের মন কিন্তু ভাল। এখানে যখন থাকা হবে না, তখন ইঁদায় আপনাদের যেতেই হবে। কিন্তু ওখানে থাকতে পেলেও খাবেনটা কী? কোনও হোটেল তো নেই। সেইজন্যই ওই ব্যবস্থা। তবে ইঁদায় কি আপনারা থাকতে পারবেন?”
আমি এবার অধৈর্য হয়ে বলাম, “আচ্ছা সেই থেকে যে তোমরা ইঁদা ইঁদা করছ, ইঁদাটা কী?”
“ওমা! সে কী! ইঁদা জানেন না?”
“না। জানলে জিজ্ঞেস করি?”
হিরু বলল, “কোনও বাংলো জাতীয় কিছু নিশ্চয়?”
“উঁহুঁ। বাংলো হতে যাবে কেন? ইঁদা হচ্ছে এখানকার একটা জায়গার নাম। ভাল নাম ইন্দা। এর কাছেই পীরবাবা।”
“তা হলে তাই যাওয়া যাক।”
বিনোদ বলল, “তা তো যাবেন, কিন্তু—।” বলেই বলল, “আচ্ছা আসুন তো আগে। তারপর দেখা যাবে। এখন চলুন ওই দোকানটায় বসে একটু চা খাওয়া যাক।” আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম সেখানে একটি চায়ের দোকান ছিল। বিনোদ আর আপ্পারাও আমাদের সেই দোকানে বসিয়ে চা-বিস্কুটের অর্ডার দিল।
বিনোদ বলল, “আসলে ইঁদায় যেখানে সাহেব আপনাদের পাঠাচ্ছেন সেখানে রাত্রিবাস করবার কথা আমি অন্তত আপনাদের বলতে পারব না।” “সে কী! কেন?”
আপ্পারাও বিনোদকে বলল, “ওই বাড়িতেই যে সাহেব ওদের পাঠাচ্ছেন তার কি মানে? আগে বাড়িটা দেখা হোক। সাহেবের বোনের বাড়িতেও তো থাকতে দিতে পারেন।”
বিনোদ বলল, “না না। অত সস্তা নয়। ওরা সেই লোক নাকি? ওদেরই বলে থাকতে জায়গা কুলোয় না, আবার অন্য লোককে থাকতে দেবে। আর নেমন্তন্নর কথা বলছ? সে তো সাহেবের অনুরোধে। সাহেব নিশ্চয়ই ফোনে বলে দিয়েছেন যা খরচা হয় দিয়ে দেবেন।”
আমরা সব শুনে চা খেতে খেতে বললাম, “আপ্পাদা, আমাদের আর খড়্গপুর বেড়িয়ে কাজ নেই। আমরা পরের ট্রেনেই কাটছি। তুমি গিয়ে বরং সাহেবকে বোলো যে, আমরা আসিনি।”
বিনোদ বলল, “না না। সেটা ঠিক হবে না। অনেকক্ষণ ধরে আমরা এখানে বসে কথাবার্তা বলছি। যদি কেউ দেখে থাকে বা সাহেবের কানে ওঠে, তা হলে কিন্তু মুশকিল হয়ে যাবে। মিথ্যে কথা বলার জন্য আমাদের বকাবকি করবেন সাহেব। তা ছাড়া ওখানে আপনাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। ওসব যদি নষ্ট হয় তা হলে না এসে কথার খেলাপ করার জন্য আপনারাও কি রেহাই পাবেন?”
সত্যি বলতে আমাদের সব আনন্দই তখন মরে গেছে। চা খেয়ে আমরা বিনোদ আর আপ্পারাওকে অনুসরণ করলাম। রাতের অন্ধকারে আমরা লাইন পেরিয়ে গোলবাজার হয়ে পীরবাবা ঘুরে ইঁদায় পৌঁছলাম।
ইঁদায় সাহেবের বোনের বাড়িতে আমাদের পৌঁছে দিয়ে বিনোদ, আপ্পারাও দু’জনেই বিদায় নিল।
সাহেবের বোন, ভগ্নিপতি দু’জনেই যথেষ্ট সমাদর করে বাড়ির বৈঠকখানায় বসালেন আমাদের। তারপর এ-কথা সে-কথার পর বললেন, “দেখো বাবারা, সাহেব তোমাদের এখানে তো পাঠিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু অসুবিধে হচ্ছে এই যে, আমাদের তো ভাড়াবাড়ি নিজেদের থাকতে কুলোয় না। তোমরাও আবার একজন-দু’জন নও, চার-চারজন। কী করে থাকতে দিই বলো তো? তবে মাস ছয়েক হল কাছাকাছি আমরা একটা বাড়ি তৈরি করেছি। কিন্তু বাবা, ওই বাড়িতে গৃহপ্রবেশ করে এক রাতও থাকতে পারিনি আমরা। সে এমনই উপদ্রবের বাড়ি যে, সে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসতে পথ পাইনি। তোমাদের থাকার জন্য সেই বাড়িটা আমরা ছেড়ে দিতে পারি। কিন্তু বাবা, তোমরা কি থাকতে পারবে সেখানে?” আমি বললাম, “সাহেব জানেন, ওটা ভূতের বাড়ি?”
“তা আর জানে না? সবই জানে।”
“তা হলে উনি জেনেশুনে ওই বাড়িতে আমাদের থাকতে পাঠাচ্ছেন কেন?”
“সে-কথা তোমাদের সাহেবকেই জিজ্ঞেস কোরো। তবে বাবা, সাহেবকে তোমরা তো ভাল করেই চেনো? ও আবার ওসব ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করে না। আমরা যেই না বলেছি ওই ভূতের বাড়িতে ছেলেগুলো থাকবে কী করে, অমনই আমাদের একটা তেড়ে ধমক। বলল, ভূতের নিকুচি করেছে। আসলে তোমরা নিজেরাই ভূত। তাই নিজের বাড়ি ফেলে রেখে ভাড়াবাড়িতে বাস করছ।”
রবি বলল, “তা হলে ও বাড়িটা আপনারা বিক্রি করে দেননি কেন?”
“কে কিনবে? সবাই তো জেনে গেছে ও বাড়ির ব্যাপার।”
আমি বললাম, “আমরা চারজন আছি। পারব না একটা রাত ওখানে কাটাতে? কাল সকালেই আমরা ঘর ছেড়ে দেব। তারপর সারাদিন ধরে খড়্গপুরটা ঘুরে দেখে বিকেলের গাড়িতে চলে যাব কলকাতায়।”
“থাকতে পারলে তো ভালই। তবে কিনা যদি ভয় পাও তাই আগে থেকে সাবধান করে দিচ্ছি। পরে যেন বোলো না বাবা, আমরা তোমাদের বিপদে ফেলব বলে ওই ঘরে পাঠিয়েছি।”
আমরা তখন সবাই একমত হয়ে বললাম, “ঠিক আছে। একটা রাত বই তো নয়, আর চারজন যখন আছি তখন থেকেই দেখি না এক রাত। হয়তো একটু ভয়ডর পাব। তাই বলে সত্যি-সত্যিই ভূত এসে তো গলা টিপে মেরে ফেলবে না আমাদের!”
“দেখো বাবা। কী কুক্ষণেই যে জমিটা কিনেছিলুম, কত শান্তি স্বস্ত্যয়ন করালাম। কত কী করলাম, কিছুতেই কিছু হল না।”
“তা না হয় হল। বাড়ির ভেতরে হয়টা কী?”
“সে-কথা আর জিজ্ঞেস কোরো না বাবা। যদি থাকো এক রাত তো বুঝবে।”
হিরু আর মুন্না এতক্ষণ চুপ করে ছিল। সব শুনে বলল, “হল ভাল। কোথায় এলাম একটু আনন্দ করতে, তার জায়গায় ভূতের বাড়িতে থেকে প্রেতের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে? কী ঝকমারি করেই ঘর থেকে বেরিয়েছিলুম আজ!”
“সবই কপাল।”
যাই হোক! আমরা সে রাতে সাহেবের বোনের বাড়িতে ভাজাভুজি ফুলকপির তরকারি লুচি আর ডিমের ডালনা খেয়ে নতুন বাড়িতে শুতে গেলাম। বাড়িটা ঠিক ইঁদায় নয়। পীরবাবায়।
সাহেবের ভগ্নিপতি নিজে গিয়ে আমাদের ঘরের চাবি খুলে ঢুকিয়ে দিয়ে এলেন। চমৎকার বাড়ি। নতুন। একতলা। ঘরে খাট বিছানা মশারি সবকিছুই আছে। জল কল ও বাথরুমের ব্যবস্থাও ভাল। এই বাড়িতে এসেই যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম আমরা। হোক ভূতের বাড়ি, তবু বাড়ি তো! শান্তিতে থাকা যাবে। এই বাড়ি এবং ঘর যেন আমাদের সুখের স্বর্গ বলে মনে হল।
আমরা দরজায় খিল দিয়ে বিছানায় বসে বেশ মনের আনন্দে হইহুল্লোড় আরম্ভ করে দিলাম। মুন্না যতরকম হিন্দি সিনেমা দেখেছিল তার সব গান এক এক করে গাইতে লাগল।
প্রচণ্ড শীতের জন্য জানলা দরজা বন্ধই ছিল সব। এমন সময় মনে হল কে যেন বাইরে থেকে টকটক শব্দ করল জানলায়।
আমরা হট্টগোল থামিয়ে জানলা খুলেই দেখি এক বৃদ্ধ মুসলমান ভদ্রলোকে স্মিত হাসছেন আমাদের দিকে চেয়ে।
“কাকে চাই?”
“কাকে আবার? আপনাদেরকেই। কতক্ষণ এসেছেন আপনারা?”
“এই কিছুক্ষণ। কিন্তু আপনি কে?”
এবার আর আপনি নয়। ‘তুমি’তে নেমে এলেন বৃদ্ধ, “ভাল করে একবার তাকিয়ে দেখো তো আমার মুখের দিকে, আমাকে চিনতে পারো কিনা? আমি তায়জু সারেং।”
আমি আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম, “আরে, তায়জুদা! আসুন আসুন ভেতরে আসুন। আপনি যা দাড়ি রেখেছেন তাতে তো চেনাই যাচ্ছে না আপনাকে।” বলে দরজা খুলে দিলাম।
তায়জুদা আমাদের সিনিয়ার স্টাফ ছিলেন। বছর দুই হল রিটায়ার করেছেন। আমাদের আমন্ত্রণে ঘরের ভেতরে এসে বিছানায় বসে বললেন, “তারপর হঠাৎ কী মনে করে এখানে এসেছ তোমরা?”
“আমরা খড়্গপুর বেড়াতে এসেছিলাম তায়জুদা। কোথাও জায়গা না পেয়ে আজকের রাতটুকুর মতো এই বাড়িতে উঠেছি। কাল সকালেই চলে যাব। কিন্তু আপনি এখানে কেন?”
“আমার বাড়ি তো এখানেই। পীরবাবায়। আজ একটা বিশেষ কাজে লাইনের ওপারে গিয়েছিলাম। এমন সময় সোমসাহেবের সঙ্গে দেখা। ওঁর মুখেই তোমাদের আসার কথা শুনলাম। তোমরা সব কীভাবে আছো না আছো তা একবার দেখেও আসতে বললেন। তবে বাবা এই বাড়িতে তোমরা এক রাত কী করে কাটাবে তা ভেবে পাচ্ছি না। এ বড় দোষাস্ত জায়গা। কবরখানার ওপর বাড়ি তো! ভীষণ উপদ্রব হয় এখানে। আমি সাহেবকে বললুম, এ আপনি ঠিক করেননি স্যার। আপনি জেনেশুনে ওদেরকে ওখানে পাঠালেন কী বলে? তা উনি তো এসব মানেন না। তাই বললেন, আরে ছেড়ে দাও তো। চার-চারটে ছোঁড়া রয়েছে। এক রাতের ব্যাপার। কে কী করবে ওদের? তবু বাবা আমি বুড়োমানুষ। সাহেব এসব না মানলেও আমি তো মানি। তাই বলছিলুম কি, তোমরা এখানে না থেকে বরং আমার বাড়িতে চলে এসো।”
আমি বললাম, “তায়জুদা, বাড়ি যখন আপনার কাছেই তখন আপনি নিজেই যদি এক রাত আমাদের কাছে থেকে যান, তা হলে খুব একটা খারাপ হয় কি? আপনার বাড়ি যখন এখানেই, তখন অসুবিধেরও কিছু নেই। আমরাও আপনাকে পেয়ে বর্তে যাই। না হলে এই শীতের রাতে এমন একটা সুন্দর আস্তানা ছেড়ে কোথাও যেতে মন চাইছে না আমাদের।”
তায়জুদা বললেন, “তোমরা তো বললে ভাল। আমি নিজে যেখানে তোমাদের থাকতে মানা করছি সেখানে আমি কী করে থাকি?”
“তা জানি না। যেভাবেই হোক, আপনি এখানে থেকে যান। প্লিজ।
“তা হলে তো বাড়িতে একটু খবর পাঠাতে হয়।” বলে জানলার পাল্লাটা খুলেই এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখে কাকে যেন চেঁচিয়ে ডাকলেন, “কামাল! এই কামাল!” একটি অল্প বয়সের ছেলে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। এই ভূতের বাড়ির ভেতর থেকে রাত্তিরবেলা তায়জুদাকে তার নাম ধরে ডাকতে দেখেই ভূত দেখার মতো ভয় পেয়ে তেড়ে”
দৌড় লাগাল সে।
এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।
আমরা উঠে গিয়ে দরজা খুলেই অবাক।
“এ কী! স্যার আপনি?”
দেখি না সোমসাহেব নিজেই এসে হাজির হয়েছেন এই রাতদুপুরে। যা আমাদের স্বপ্নেরও অগোচর। বললেন, “এখানে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো তোমাদের? তবে আগেই বলে রাখছি কারও কথায় কান দিয়ো না। ভূতপ্রেত কিছুই নেই এখানে। সব বাজে কথা। আসলে এখানে একটা পুরনো কবরখানা ছিল। এখন সেটা আর ব্যবহার করা হয় না। তার একটা অংশ বিক্রি হওয়ার সময় আমার বোন ভগ্নিপতি খুব জলের দামে কিনে নেয়। তারপর বেশ মনের মতো করে এই বাড়িটাকে তৈরি করে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই স্থানীয় অন্য সম্প্রদায়ের লোকের মনে একটু ক্ষোভ দেখা দেয়। সেইজন্য ওদেরই ভেতর থেকে কিছু লোক নানাভাবে ভয়টয় দেখায়, যাতে এখানে কোনও লোক রাত্রিবাস করতে না পারে। আর এই তায়জুটা হচ্ছে একটা পাক্কা শয়তান। এই হচ্ছে ওদের দলের লিডার। এই সবাইকে উসকিয়ে ডেকে ডুকে আনে।”
তায়জুদা ফিক ফিক করে হেসে হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, “হেঁ হেঁ। কী যে বলেন স্যার। আমি এই বুড়ো বয়সে…। আমার কি আর কোনও কাজ নেই? কেন মিছিমিছি আমার নামে বদনাম দিচ্ছেন?”
“থাক, আর ন্যাকামি করতে হবে না। তুমি কী চিজ তা আমি জানি। ওইজন্যই এদের খবরাখবর নেওয়ার জন্য তোমাকে পাঠালাম। একটু নজরে রেখো এদের। এক রাত থাকবে। যেন ভয়টয় দেখিয়ো না।”
আমি বললাম, “স্যার! তায়জুদাকে আমরা আজকের রাতটুকুর মতো এখানে থাকবার জন্য বলছি।”
“না। তোমরা নিজেরাই থাকো। পরের বাড়িতে বাইরের লোক কখনও থাকতে দিয়ো না। বাড়ি তো আমার নয়। কী ভাবতে কী ভাববে ওরা শেষকালে! তা ছাড়া রাতদুপুরে এই বুড়ো ভাম যখন নাক ডাকাতে শুরু করবে তখন ঘুমের বারোটা তো বাজবেই তোমাদের, উপরন্তু ওকেই হয়তো ভূত ভেবে ভয়ে কাঠ হয়ে যাবে।”
তায়জুদা বললেন, “না না। ঠিক আছে। আমি যাই। কোনও ভয় নেই। সাবধানে থেকো সব। একটা রাত বই তো নয়!” এই বলে চলে গেলেন তায়জুদা। সাহেবও চলে গেলেন।
আমরাও আর বিলম্ব না করে চারজনেই শুয়ে পড়লাম একত্রে। ভূতের বাড়ি তো! তাই অন্ধকার না করে আলো জ্বেলেই শুলাম। আমরা শোওয়ার পর সবে একটু ঘুম ঘুম ভাব এসেছে এমন সময় হঠাৎ সদ্যোজাত শিশুকণ্ঠের এক পরিত্রাহি চিৎকারে ঘোর ছুটে গেল আমাদের। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম চারজনেই। কোথা থেকে আসছে শব্দটা? মনে হচ্ছে বাথরুমের ভেতর থেকে। ছুটে গিয়ে বাথরুমের দরজা খুললাম। দেখলাম কোথায় কী। কিন্তু দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকারটা যেন আরও বেড়ে গেল। সে কী দারুণ কান্না। একটানা চিৎকার যাকে বলে। আমরা কানে হাতচাপা দিলাম। বেশ কিছুক্ষণ কান্নার পরে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল রেশটা।
এমন সময় বাইরে থেকে কে যেন ডাকতে লাগল। “হাসান! হাসান রে! এ হাসান।”
আমরা ছুটে গিয়ে জানলা খুললাম। কিন্তু কই? কোথায় কে? কেউ কোথাও নেই তো। এদিকে ঘরের কোণ থেকেও একটা চাপা আর্তনাদ কানে এল। কে যেন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, “হায় আল্লা! কী কষ্ট! উঃ, মরে গেলাম।”
ঘরের মধ্যে আমরা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও প্রাণী নেই। অথচ ঘরের কোণ থেকে ওইভাবে কার আর্তস্বর ভেসে আসছে? এক সময় দেখলাম ঘরের কোণের মেঝেটা কীরকম ঢিবির মতো উঁচু হয়ে উঠল। আর সেইসঙ্গে—ওরে আমার হাতে খুব লাগছে রে। ও বাবা গো! আমার হাতের ওপর দিয়ে কে দেওয়াল তুলেছে। আমি হাত নাড়তে পারছি না।
ওপাশের দেওয়ালের গা থেকেও ওই একই রকম চাপা কান্না শোনা যেতে লাগল— “ওগো, আমার বুকে ইট গেঁথেছে কে? ওগো তোমাদের পায়ে পড়ি তোমরা এগুলো ভেঙে দাও। এই দেখো আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।”
এই প্রচণ্ড শীতেও আমাদের সর্বাঙ্গে ঘাম ছুটছে তখন। কী যে করব কিছু ঠিক করতে পারছি না। চারদিক থেকে কান্নার স্বর ভেসে আসছে। করুণ ক্রন্দনে ভরে উঠছে গোটা ঘর। আমরা পালাব বলে দরজা খুলে বাইরে বেরোতে গিয়েই দেখি দালানে সিঁড়ির কাছে একটা কফিন কে যেন শুইয়ে রেখে গেছে। কিন্তু কে রাখল? দরজা তো ভেতর থেকেই বন্ধ।
এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।
মুন্না ছুটে গিয়ে খিল খুলতেই দেখা গেল তায়জুদাকে।
আমাদের অবস্থা দেখেই তায়জুদা বললেন, “ভয় নেই। আমি এসে গেছি। তোমাদের আগেই বলেছিলাম এখানে রাত্রিবাস করা যায় না। এ অত্যন্ত খারাপ জায়গা। তবুও তোমরা যেমন শুনলে না তেমনই ফল বোঝো।”
আমরা বললাম, “তায়জুদা, ওই দেখুন একটা কফিন। কে এসে রেখে গেছে ওখানে।” সেদিকে তাকিয়েই রেগে উঠলেন তায়জুদা, “কে! কে এটাকে নিয়ে এসেছে এখানে?” “তা জানি না।”
“এটা তো ও ঘরের মেঝেয় পোঁতা ছিল।”
“তায়জুদা! কী বলছেন আপনি?”
“ঠিকই বলছি। দেখবে এসো।”
আমরা তায়জুদার সঙ্গে পাশের ঘরে গেলাম। গিয়ে দেখলাম সত্যি সত্যিই সেখানে সিমেন্টের মেঝে খুঁড়ে কে যেন বের করে এনেছে কফিনটাকে।
তায়জুদা ছুটে গিয়ে কফিনের ঢাকা খুলে ভেতরটা দেখে নিয়েই বললেন, “হ্যাঁ, ঠিক আছে। চলো ওটাকে ও ঘরে আবার পুঁতে রেখে আসি।”
ততক্ষণে আমরা আর আমাদের মধ্যে নেই। কেননা তায়জুদা কফিনের ঢাকা খুলতেই দেখলাম তায়জুদার মৃতদেহটা কফিনে শোওয়ানো আছে। অবাক কাণ্ড! তা হলে আমাদের সামনে এই যে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন ইনি তবে কে?
এমন সময় হঠাৎ সোমসাহেব এসে পড়লেন তাই রক্ষে!
সোমসাহেব বললেন, “আবার তায়জুদ্দিনটা এইসব আরম্ভ করে দিয়েছে? ওর বদমায়েশি দেখছি এখনও গেল না! থাক। চলে এসো তোমরা। দারুণ ভয় পেয়েছ মনে হচ্ছে। আমার ওইখানেই চলো। এই নাও চাবি। আমি সিনি যাচ্ছি। ওখানে ব্লক আছে। তোমাদের এখানে পাঠানোই আমার ভুল হয়েছিল।”
আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো সোমসাহেবকে অনুসরণ করলাম। স্টেশনের কাছাকাছি এসে সোমসাহেব অন্ধকারে হেঁটেই ইয়ার্ডের দিকে চলে গেলেন।
আমরা সোমসাহেবের বাংলোয় যখন এসে পৌঁছলাম তখন শেষ রাত। সেখানে গিয়েই এক মর্মান্তিক দুঃসংবাদ পেলাম। আজ বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে ট্রেনের মধ্যেই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন সোমসাহেব।