Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শেষ দেখা হয়নি || Sunil Gangopadhyay

শেষ দেখা হয়নি || Sunil Gangopadhyay

কলকাতা থেকে যে বাসে চড়েই রাঁচি চলে যাওয়া যায়, সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। খুব ছোটবেলায় একবার বাবা–মায়ের সঙ্গে রাঁচি বেড়াতে গিয়েছিলুম, তখন মনে হয়েছিল রাঁচি কত দূরের জায়গা, সারা রাত ধরে চলল ট্রেন, ভোরবেলা মুড়ি জংশনে নেমে শীতে কাঁপতে কাঁপতে ট্রেন বদলে, সেই ছোট ট্রেন খেলনাগাড়ির মতন ঘুরে ঘুরে উঠছিল পাহাড়ের গা দিয়ে, পাহাড়ের গায়ে–মাখা ঘন জঙ্গল, হঠাৎ কখন একটা নেকড়ে কিংবা ভাল্লুক দেখা যাবে সেই অধীর প্রতীক্ষায় জানলা দিয়ে চেয়ে থাকতে থাকতে চোখ প্রায় ব্যথা হয়ে যাবার জোগাড়।

তারপর আর আমার একবারও রাঁচি যাওয়া হয়নি, সেইজন্য আমার কাছে রাঁচি খুব দূরের জায়গাই রয়ে গিয়েছিল।

বন্ধুবান্ধবদের কাছে শুনছিলুম, রাঁচি এখন খুব কাছে এসে গেছে, প্লেনে পঁয়তিরিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছোনো যায়, ট্রেনে গেলেও মাঝখানে বদল করার ঝামেলা নেই, হাওড়া স্টেশনে উঠে ঘুমিয়ে পড়ার পর ভোরে চোখ মেললেই রাঁচি স্টেশন। ট্রেনের টিকিট কাটার সময় না থাকলেও কিচ্ছু আসে যায় না, ময়দানে মনুমেন্টের পায়ের কাছ থেকে ছাড়ে রাঁচির বাস।

প্লেনে যাবার তো প্রশ্নই ওঠে না, ময়দান থেকেই যদি বাস ছাড়ে তা হলে আর হাওড়া ব্রিজ পেরিয়ে ট্রেনে ওঠার দরকার কী! চেপে বসলুম একটা বাসে। ‘ আমার দ্বিতীয়বার রাঁচি যাত্রা, বিশেষ একটি দায়িত্ব নিয়ে। দারুণ সৌভাগ্যের ব্যাপার এই যে আমার সীটটি জানলার ধারে। তপনের দেওয়া, পলিথিনের প্যাকেটে মোড়া চৌকো কাশ্মীরী কাঠের বাক্সটি আমার কোলের ওপরে।

আমার পাশের সীটে বসেছেন একজন দক্ষিণ ভারতীয় ভদ্রলোক। এই গরমেও নস্যি রঙের সুট পরা। ইংরেজিতে ছাড়া এঁর সঙ্গে কথা বলা যাবে না। দীর্ঘ আট ন’ ঘণ্টা ধরে কারুর সঙ্গে ইংরিজিতে আড্ডা মারতে গেলে আমার একখানা দাঁতও আস্ত থাকবে না। সে প্রশ্নই ওঠে না। ভদ্রলোক তাঁর মাতৃভাষার একটি ম্যাগাজিন পড়ায় মন দিলেন, আমি সঙ্গে বই পত্রপত্রিকা কিছুই আনিনি, সুতরাং প্রকৃতি দেখা ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই।

আমার ঠিক সামনের সীটে বসেছে এক তরুণ–তরুণী। জানলার পাশে বসা তরুণীটির ঘন কালো চুল, লাল রঙের ব্লাউজ পরা ডান বাহু ও গালের কিছুটা অংশ ছাড়া আর কিছু দেখতে পাইনি। কোনো মেয়ের পেছন দিকটা দেখলেই তার মুখখানা দেখার একটা অদম্য বাসনা কেন যে জাগে কে জানে! মেয়েদেরও কি পুরুষদের সম্পর্কে এরকম হয়?

সকালের রোদ চচ্চড় করছে বাইরে, বাসটা কলকাতা শহরের মধ্য দিয়ে অনেকখানি এসে এখন ছুটছে দক্ষিণেশ্বরের দিকে, এখনও প্রকৃতি দেখার মতন কিছু নেই। আমি মনে মনে বললুম, দেখব, মেয়েটির মুখ ঠিকই দেখব এক সময়, বাসটা তো মাঝে বেশ কয়েকবার থামবে!

এটা সরকারি বাস, এ বাসে কোনো দাঁড়ানো–যাত্রী নেই। এইসব দূরপাল্লার বাসে খুব গরিব লোকেরা চাপে না। ট্রেনের কামরায় মেঝেতেও অনেক লোক বসে থাকে, কারুর কারুর মুখে টিকিট ফাঁকি দেবার চঞ্চলতা, আমি নিজেই একবার টিকিট চেকারকে দেখে বাথরুমে লুকিয়েছিলুম দেড় ঘণ্টা…চলন্ত ট্রেনে নানা রকম নাটক ও ছোটগল্প হয়, সেই তুলনায় বাসযাত্রাটা বড় বেশি গম্ভীর আর কেজো ধরনের।

প্রত্যেকবারই ট্রেনে ওঠার আগে আমার একটা ব্যাপার বেশ মজার লাগে। আগে থেকে সীট রিজার্ভ করে টিকিট কেটে রাখা আমার ধাতে নেই, আমার বাইরে যাওয়া মানেই তো ‘উঠল বাই তো কটক যাই’ ধরনের, যখন তখন একটি টুথ ব্রাশ সম্বল করে বেরিয়ে পড়া, স্টেশনে এসে যে–কোনো একটা বারোয়ারি কামরায় উঠে বসা। কোন্ কামরায় একটু কম ভিড় তা দেখার জন্য আগে ছোটাছুটি করি, সেই সময় খানিকটা জুয়া খেলার মতন হয়। আমি যে–কামরায় উঠি, সে– কামরায় এক ধরনের মানুষ, পাশের কামরায় আর এক সেট মানুষ। দু’ কামরায় দু’ রকম গল্প, আমি এই গল্পের বদলে ঐ গল্পেও চলে যেতে পারতুম অনায়াসে। যে–কামরায় উঠলুম, সেখানে তিন চারজন লোকের সঙ্গে আলাপ হলো, ভাব হলো, একজনের সঙ্গে এত ভাব যে তুই তুই সম্পর্ক দাঁড়াল শেষ পর্যন্ত, কিন্তু আমি অন্য কামরায় উঠলে হয়ত এদের সঙ্গে জীবনে দেখাই হতো না। এ কামরায় একটা ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো, অন্য কামরায় হয়তো একটি সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে প্রেম হয়ে যেতে পারত। আমার সব সময়েই ধারণা, আমি যে–কামরাতেই উঠি না, সেই কামরাতেই এক সুন্দরী–শ্রেষ্ঠা লুকিয়ে থাকে!

এরকম দূরপাল্লার বাসযাত্রার অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম। বাসেও কি সহযাত্রীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়? নিছক ভাষার ব্যবধানের জন্যই আমার পাশের লোকটির সঙ্গে ভাব হবে না। লোকটিকে খুব একটা আলাপি বলেও মনে হয় না।

পেছন দিকে অনেকে মিলে হৈ হৈ করে কথাবার্তা বলছে, ওরা বোধহয় একটি দল। চার–পাঁচজন মাঝবয়েসী লোক, দুটি প্রৌঢ়া, একটি যুবতী, দু’তিনটি বাচ্চা। গ্রীষ্মকালেও কি কেউ রাঁচি বেড়াতে যায়? সামনের দিকে, একেবারে দরজার পাশের সীটে বসেছেন দু’জন বিবাহিতা মহিলা, আমি ওঠবার সময়েই ওঁদের দেখেছি, কিন্তু ওঁদের স্বামীরা কোথায়? এ পর্যন্ত ওঁদের সঙ্গে আর কেউ কথা বলেনি। সামনের দিকে বাকি সব সীটগুলিতেই পুরুষ, কিন্তু একটি তিন–চার বছরের ফুটফুটে মেয়ে যে একটা বল নিয়ে বাসের মধ্যে ছুটে বেড়াচ্ছে, তার মা কে? একটি যুবক তাকে মাঝে মাঝেই এই রুমি, এই রুমি বলে ডাকাডাকি করে সামলাবার চেষ্টা করছে, কিন্তু বিবাহিতা মহিলাদুটির কাছে মেয়েটি একবারও যায়নি। ঐটুকু মেয়ে কি তার মাকে ছাড়াই যাচ্ছে?

বালি ব্রিজ পার হয়ে বাসটি এবারে এসেছে দিল্লি রোডে। নামে দিল্লি রোড হলেও এই রাস্তাটা খানিক দূরে গিয়েই আগেকার গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোডের সঙ্গে মিলে গেছে। সেই শেরশাহের আমলের রাস্তার পর দিল্লি যাবার কোনো দ্বিতীয় পথ আজও তৈরি হয়নি। দিল্লির রাস্তা দিয়েই কি রাঁচি যাওয়া যায়? আমার অত ভূগোলের জ্ঞান নেই। দেখাই যাক না।

সামনের সীটের লাল–রঙা ব্লাউজ পরা তরুণীটির চুল উড়ছে হাওয়ায়। তরুণী? আমার ডবল বয়েসী যে নয়, তা কে বলল? বেশি বয়েসের মেয়েরা কি লাল ব্লাউজ পরে? আজকাল সবই চলে, মাথার চুল বব ছাঁট দেওয়া, লিপস্টিক মাখা, ষাট–পঁয়ষট্টি বছরের মহিলা দেখা যায় না? আহা, যতক্ষণ ওর মুখ না দেখা যাচ্ছে, ততক্ষণ তরুণী বলেই ধরে নিতে ক্ষতি কী?

অনেক মেয়েই চুল–ওড়া পছন্দ করে না। চলন্ত গাড়িতে আমি কোনো কোনো মেয়েকে হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে থাকতে দেখেছি। এই মেয়েটি যদি হাওয়া কিংবা রোদ্দুরের ছুতোয় জানলা বন্ধ করতে বলে? রোদ আসছে ঠিকই, এদেশের ফর্সা মেয়েরা রোদকে খুব ভয় পায়। মেমসাহেবরা শুনেছি রোদ দেখলেই খুব আদেখলাপনা করে। যে–কোনো চলন্ত যানের জানলা বন্ধ থাকলে আমার আদ্ধেক আনন্দ নষ্ট হয়ে যায়। খোলা জানলায় কনুই রাখার মজাই আলাদা। রোদ তো দূরের কথা, বৃষ্টিতেও আমার জানলা বন্ধ করতে ইচ্ছে করে না।

আমি একটা সিগারেট ধরাতেই আমার পাশের লোকটি ম্যাগাজিন পাঠের জ্ঞান সঞ্চয় বন্ধ করে আমার দিকে তাকাল। এই রে, এই লোকটি ধূমপান বিরোধী আন্দোলনের নেতা নাকি? ইংরিজিতে আদেশ করলে আমাকে সিগারেট ফেলে দিতেই হবে। কিন্তু অনেকটা রাস্তা।

আমি সভয়ে জিজ্ঞেস করলুম, ডু ইউ মাইণ্ড?

লোকটি চার–পাঁচবার মাথা দুলিয়ে বলল, নো, নো, নো, নো!

তারপর মিস্টি হেসে বলল, ইউ সি, আই ফরগট টু বাই…মে আই বরো ওয়ান ফ্রম ইউ?

তাকে একটি সিগারেট দিয়ে আমি ধন্য হয়ে গেলুম। এরকম উপকারী সিগারেট খরচ আগে কখনো করিনি।

লোকটির নাম এ টি শিবরামকৃষ্ণন। মিলিটারি অডিট অ্যাকাউন্টসে চাকরি করে। অফিসের কাজেই রাঁচি যাচ্ছে। সংক্ষিপ্ত পরিচয় বিনিময়ের পর সে আবার পাঠে মন দিল।

আমি মনে মনে ভদ্রলোকের বাবাকে খুব তারিফ করলুম। তিনি তাঁর ছেলের নামের সঙ্গে তিন–তিনখানা ঠাকুরদেবতার নাম জুড়ে দিয়েছেন। আবার সামনে আছে এ টি, তার মধ্যেও কোন্ ঠাকুর দেবতা আছেন কে জানে! একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, এ রকম নামের লোক যে–বাসের যাত্রী, সে–বাসে আর যাই হোক, অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে না।

বাঁ দিকের রো থেকে উঠে এসে একজন লম্বামতন, সাফারি সুট পরা লোক আমার সামনের সীট ধরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলল, রমেন, তুমি কোথায় চললে? তখন থেকে ভাবছি, ঠিক রমেনের মতন দেখতে, অথচ ঠিক ধরতে পারছি না, আগে কি তোমার চশমা ছিল?

লম্বা লোকটির বয়েস বছর পঞ্চাশেক, মাথায় কাঁচা–পাকা চুল, চোখে পুরু ফ্রেমের চশমা। সে যাকে রমেন বলে ডাকল, সে বলল, জীবনদা, আপনাকে দেখতে পাইনি তো। আমি যাচ্ছি ঘাটশিলায়।

হ্যাঁ, তোমাদের তো ঘাটশিলায় একটা বাড়ি আছে, অনেকদিন আগে আমি একবার গেসলাম, তখন তোমার বাবা…

—জীবনদা, আপনি কতদূর যাচ্ছেন?

—রাঁচি, আমার ছেলে তো সেখানে পড়ে…কী রকম পড়াশুনো করছে কে জানে, মাঝে মাঝে একটু খবর না নিলে…আজকাল যা ড্রাগের উৎপাত…

আমি মনে মনে হাততালি দিয়ে উঠলুম। যেন নিজের কাছে একটা বাজি জিতেছি। রমেন যখন জীবনদা বলে ডাকছে, তখন রমেনের বয়েস বেশি নয়, তা হলে তার স্ত্রী তরুণী হতে বাধ্য। ঠিক ধরেছিলাম!

জীবন নামের ব্যক্তিটি কিন্তু রমেনের পাশের তরুণীটির সঙ্গে একটা কথাও বলল না এ পর্যন্ত। সে কি রমেনের স্ত্রীকে চেনে না? রমেনও আলাপ করিয়ে দেয়নি।…রমেন বলল, আমি যাচ্ছি ঘাটশিলায়, আমরা যাচ্ছি বলেনি, তবে কি ঐ মেয়েটি রমেনের স্ত্রী নয়! ওরা দু’জন আলাদা, অচেনা? কিংবা, রমেন কোনো পরস্ত্রী বা বান্ধবীকে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছে ঘাটশিলায়, পিতৃবন্ধুকে দেখে লজ্জা পেয়েছে?

কত রকম গল্পের সম্ভাবনাই যে সব সময় ছড়িয়ে থাকে খুব কাছাকাছি!

লাল ব্লাউজ পরা তরুণীটি পাশের সংলাপ শুনছে না, সে জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে। মুখটা আড়াল করতে চায়?

বাসটা দিল্লি রোড ছেড়ে বাঁ দিকে বেঁকে অন্য একটা রাস্তা ধরল। জীবন বাইরে তাকিয়ে বলল, এবারে বম্বে রোডে পড়বে, এটা কানেকটিং রোড, আমি আগেরবার যখন গেসলুম, তখনও মাঝখানের ব্রিজটা হয়নি।

রমেন জিজ্ঞেস করল, লাঞ্চ ব্রেক কোথায় দেবে?

—বোধহয় কোলাঘাটে। কিংবা দেউলাবাজারও হতে পারে। বেলা তো বেশি হয়নি, এখন মোটে সাড়ে দশটা। কোলাঘাট পৌঁছে যাবে সাড়ে এগারোটার মধ্যে!

তা অবশ্য হলো না, কানেকটিং রোড ধরে কিছুটা যেতেই বাসটা জ্যামে আটকে গেল। একেবারে নিথর নয়, কচ্ছপগতি। পাঞ্জাবি কণ্ডাক্টর হলে এসময় নিচে নেমে গিয়ে চ্যাঁচামেচি করত, বাসের গা চাপড়াত, অন্য গাড়িগুলোর উদ্দেশে দুর্বোধ্য গালাগালি ছুঁড়ে বেশ জমিয়ে তুলত ব্যাপারটা। কিন্তু স্টেট বাসের ড্রাইভার– কণ্ডাক্টররা বাঙালি। তাদের প্রায় প্রত্যেকের মুখে এমন একটা ভাব, যেন তারা ভুল চাকরি করছে, তাদের রাষ্ট্রপতির সেক্রেটারি হবার কথা ছিল। আমাদের এই বাসের কণ্ডাক্টরটির মুখখানা বিশেষ গোমড়া, কিংবা মুখের গড়নটাই এরকম। সেই যে কথা আছে না, ‘হাসছ কেন মামনি, ওমা, আমার মুখখানাই যে এমনি!

কণ্ডাক্টরটি দরজা খুলে দূরের মাঠ দেখছে। রুমি নামের বাচ্চা মেয়েটি সেই দরজা দিয়ে একবার নেমে যাবার চেষ্টা করতেই, দু’তিনজন লোক একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, আরে আরে আরে, ধর ধর ধর, কন্ট্রাক্টরটি তবু নিরুত্তাপ। আহা, ও বোধহয় আজ বাড়িতে বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে এসেছে।

বম্বে রোডে পৌঁছতে এক ঘণ্টা লেগে গেল। ততক্ষণে ঘামে আমার জামা ভিজে গেছে। নতুন টিনের মতন চোখ–ধাঁধানো রোদ। আকাশে মেঘও নেই আবার ঝকঝকে নীল রংও দেখা যায় না, কবিরা সম্ভবত একেই বলে ‘বারুদ রঙের আকাশ’। এ বছর গ্রীষ্ম অতি কঠোর, এর মধ্যেই শোনা যাচ্ছে খরার আশঙ্কা, উড়িষ্যার কালাহাণ্ডিতে মানুষ না খেয়ে মরছে। মানুষ মরে গেলে তবু খবরের কাগজে কিছু বেরোয়, আর গ্রামেগঞ্জে যে–সব লক্ষ লক্ষ মানুষ আধমরা হয়ে থাকে, তাদের কোনো খবর নেই। এবারে একদিনও ভালো করে কালবৈশাখী হলো না, বৃষ্টির নামগন্ধ নেই, বঙ্গোপসাগরের মেঘ কি এদিকের রাস্তা ভুলে গেল? বাঁকুড়া পুরুলিয়ায় শুরু হয়ে গেছে নিদারুণ জলকষ্ট…টি ভি–তে দেখাচ্ছিল কঙ্কালসার মানুষদের লাইন…

আমার নিজের বেশ খিদে পেয়ে গেছে বলেই কি ক্ষুধার্ত মানুষদের কথা মনে পড়ছে? তেষ্টাও পেয়েছে খুব। সঙ্গে একটা জলের বোতল আনা উচিত ছিল। দূরপাল্লার যাত্রায় চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে খিদে পেয়ে যায়। কিছু বাদাম– বিস্কুট–ফলমূল নিয়ে আসা যেত অনায়াসে। কিন্তু প্রত্যেকবারই আমার এই ভুল হয়, আগে কিছু মনে পড়ে না।

পেছনদিকের দলটি স্যাণ্ডুইচ খাচ্ছে, তাদের কাছে জলের বোতলও আছে। আমার গলা শুকিয়ে কাঠ, ওদের কাছে একটু জল চাইলে কি দেবে? যদি না দেয়! জল চাইলে কেউ কি প্রত্যাখ্যান করে? এদেশের লোকেরা এখনো জল দেওয়াটা পুণ্য কাজ মনে করে। না, ঠিক তাও তো নয়, বিহারের হরিজনদের কুয়ো থেকে জল তুলতে দেওয়া হয় না, জল চাওয়ার মতন বেয়াদপি করলে হরিজনদের বস্তি পুড়িয়ে দেওয়া হয় যখন তখন। অবশ্য, আমাকে দেখে ওরা হরিজন ভাববে না নিশ্চিত। কিন্তু আমি চাইবার পর ওরা জল দিলেও যদি মুখটা ব্যাজার করে থাকে?

এইসব ভাবতে ভাবতে আমার আর জল চাওয়া হয় না।

দিল্লি রোডের তুলনায় বম্বে রোড বেশ সবুজ। দু’দিকে বড় বড় গাছ। চাষের জমিতে এখনও ধান রোওয়া হয়নি, ধূ ধূ করছে মাঠ। এদিকে ভালো ডাব পাওয়া যায়। এক একটা রাস্তার মোড়ে বাচ্চা ছেলেরা ডাব বিক্রি করছে, কিন্তু আমাদের বাস কোথাও থামে না। ডাবগুলো দেখে তেষ্টা আরও বাড়ে।

রুমি নামের মেয়েটির বলটি চলে এসেছে আমার পায়ের কাছে। এই ছটফটে মেয়েটি একটুক্ষণও চুপ করে বসে থাকতে পারে না। এই গরমেও সে একটুও দমে যায়নি। তার মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল, টলটলে দুটি চোখ, বলটা নেবার জন্য সে দাঁড়াল আমাদের কাছে এসে। তার গাল টিপে আদর করতে ইচ্ছে করে, আবার ভয়ও হয়। বাচ্চাদের মোটেই বিশ্বাস নেই, ওদের পছন্দ–অপছন্দ অতি অদ্ভুত, কাকে যে কখন অপছন্দ করে বসবে তার ঠিক নেই। ওকে আদর করতে গেলে ও যদি আমাকে মহিষাসুর ভেবে বসে?

আমি বলটি ওর হাতে তুলে দিতেই ও বলল, থ্যাঙ্ক ইউ! বাপরে, ঐটুকু মেয়ের মুখেও ইংরিজি। আজকাল থ্যাঙ্ক ইউ–র চাট্টি চলন হয়েছে বটে! একজন নামকরা গায়ক আমাকে একদিন বলেছিলেন, আজকাল স্কুলের ছেলেমেয়েদের অটোগ্রাফ দিতে ইচ্ছে করে না কেন জানো, দিলেই তারা থ্যাঙ্ক ইউ বলে। শুনলেই কেমন যেন গা গুলিয়ে ওঠে। আমি তর্ক করার ঝোঁকে বলেছিলুম, থ্যাঙ্ক ইউ–র বদলে কি ধন্যবাদ বলবে? সেটাও কেমন যেন পাকা পাকা শোনাবে না? তিনি বলেছিলেন, তারই বা দরকার কী। আগে অল্পবয়েসীরা লাজুক লাজুক ভাবে মিষ্টি করে হাসত, সেটাই তো যথেষ্ট ছিল। এখন মা–বাবারাই বাচ্চাদের শিখিয়ে দেয়, থ্যাঙ্ক ইউ বলো, থ্যাঙ্ক ইউ বলো! ইংলিশ মিডিয়ামের শ্রাদ্ধ!

রাস্তার পাশে দেউলটি নাম লেখা দেখেই আমার মন উৎফুল্ল হয়ে উঠল। কোলাঘাট আর বেশি দূর নয়, সামনেই ব্রিজ। রূপনারায়ণ নদীটি আমার বড় প্রিয় গত বছরেই এখানে শরৎচন্দ্রের বাড়িতে একটা রাত কাটিয়ে গেছি। কোলাঘাটের ইলিশ…তবে এখনো বর্ষা নামেনি, ইলিশের স্বাদ হয়নি….

ব্রিজে ওঠার আগেই বাসের গতি শ্লথ হয়ে এলো, জানলা দিয়ে দেখলুম, সামনে প্রচুর গাড়ি। উল্টো দিক থেকে কোনো গাড়ি আসছে না। আবার জ্যাম? এই ড্রাইভারগুলো এত পাজি, ব্রিজের ওপর ওভারটেক করা নিষিদ্ধ, তাও মানবে না? রাঁচি পৌঁছবার কথা সন্ধেবেলা, এই রকম বাধা পড়লে তো মাঝরাত্তির হয়ে যাবে। তখন যে–বাড়িতে আমার ওঠার কথা, সেই বাড়ি খুঁজে পাব কী করে?

শরৎ সেতুর সিকি ভাগ ক্রস করেই আমাদের বাস থেমে গেল একেবারে, স্টার্ট বন্ধ করে ড্রাইভার নেমে পড়ল। আমিও নামলুম। ঐ স্টিলের বাক্সের মধ্যে বসে থাকার বদলে নদীর হাওয়া খাওয়া ভালো। তার চেয়েও আগে দেখা দরকার, জ্যামটা কিসের জন্য। চৌকো বাক্সটি সঙ্গে নিয়ে নামতে হয়েছে। তপন বলে দিয়েছে, ঐ বাক্সটি কোনো সময়েই, কোনোক্রমেই হাতছাড়া করা চলবে না।

বাক্সটিতে একটি ছোট্ট পেতলের তালা লাগানো। এর মধ্যে কী আছে, তা আমাকে বলা হয়নি। তা বলে গয়নাটয়না বা টাকাপয়সা আছে বলে মনে হয় না। খুব বেশি দামি জিনিস হলে তপন বিশ্বাস করে দিত না আমার হাতে। না– না, তপন আমাকে চোর মনে করে না মোটেই, আবার খুব বেশি দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ বলেও মানতে চায় না। সম্ভবত এর মধ্যে দরকারি কাগজপত্র আছে কিছু। আজকাল ডাক বিভাগের ওপর লোকের ভরসা কমে গেছে। দিকে দিকে চালু হয়েছে কুরিয়ার সার্ভিস। আমিও সেইরকম একজন কুরিয়ার, এই বাক্সটা রাঁচিতে তপনের বড়মামার হাতে পৌঁছে দিতে হবে আমাকে, তার বদলে রাঁচি যাওয়া– আসার ভাড়া ও আড়াই শো টাকা হাত খরচা। এই বাজারে এতটাই বা কে দেয়! আমারও ফোকটে রাঁচি বেড়ানো হয়ে যাবে!

অনেক গাড়ি থেকেই লোকজন নেমে পড়েছে, একটা জনস্রোত চলেছে অকুস্থলের দিকে। অধিকাংশ মুখগুলোই ভুরু কোঁচকানো। রূপনারায়ণ নদীর মাঝখানে মাঝখানে চড়া পড়ে গেছে, আমি এই নদীটিকে আগে প্রত্যেকবারই ভরপুর দেখেছি। তবে এখনও এক পাশ দিয়ে নৌকো চলাচলের মতন জলস্রোত আছে।

ব্রিজের ঠিক মাঝামাঝি ঘটেছে কাণ্ডটি।

বড় বড় হাইওয়ের পাশে এক আধটা লরি উল্টে পড়ে থাকার দৃশ্য তো জল–ভাত। একঘেয়ে দূরপাল্লার যাত্রায় ট্রাক ড্রাইভাররা ঘুমিয়ে পড়ে, অনেক সময় নাকি তারা অ্যাকসিলারেটরের ওপর থেকে পা তুলে নিয়ে একটা ইঁট চাপা দিয়ে রাখে। সুতরাং ট্রাক অ্যাকসিডেন্ট দেখলে আমরা খুব একটা শিউরে উঠি না, মনে করি, ও তো হবেই।

কিন্তু এখানে যে দেখছি একটি ত্রিকোণ প্রেমের রক্তারক্তি কাহিনী। একটি ট্রাক, একটি ঝকঝকে নতুন মারুতি জিপসি ও একটি ফিয়াট গাড়ি তিন দিকে মুখ করে আছে, এর মধ্যে ফিয়াট গাড়িটাই জখম হয়েছে বেশি, ট্রাকটি ধাক্কা মেরেছে ব্রিজের পাঁচিলে, পাঁচিল ভেঙে একেবারে নদীতে পড়ে যাওয়াও আশ্চর্য কিছু ছিল না। বেশ বড় রকমের দুর্ঘটনা এবং ঘটেছে মাত্র আধ ঘণ্টা আগে।

আমি একটু উঁকি মেরেই সেখান থেকে সরে এলুম। সেখানে রক্তের গন্ধ। আমি মৃতদেহ দেখতে চাই না। তার চেয়ে নদী দেখে চোখ জুড়োনো অনেক ভালো। এমন মাথা–পোড়া রোদ না থাকলে নদীর দৃশ্য আরও ভালো করে উপভোগ করা যেত। পাল–তোলা নৌকোর মধ্যে একটা চিরন্তনতার ছবি আছে। গৌতম বুদ্ধের আমলেও নদী দিয়ে বয়ে যেত এই রকমই নৌকো।

খিদেটা এখন বেশ জানান দিচ্ছে। ওপারে কোলাঘাটে ভালো হোটেল আছে। অন্তত এক–দেড় ঘণ্টা আগে এই সেতুপথ মুক্ত হবার আশা নেই। এখনও পুলিশের গাড়ি এসে পৌঁছোয়নি। দু’দিকে অসংখ্য গাড়ি জমে যাচ্ছে। দুর্ঘটনায় আহত বা নিহতদের জন্য কারুর মনে কোনো রকম সহানুভূতি নেই, অন্য গাড়ির লোকজন নেমে পড়ে শুরু করেছে বিরক্তির চ্যাঁচামেচি। একেবারে প্যাণ্ডিমোনিয়াম যাকে বলে!

হঠাৎ প্যাণ্ডিমোনিয়াম শব্দটা মাথায় আসার জন্য আমার একটু হাসি পেল। কথাটা আমরা যখন তখন বলি। কেন যে একটা বাংলা–দৃশ্য বোঝাবার জন্য আমাদের ইংরিজি শব্দ আমদানি করতে হয়! প্যাণ্ডিমোনিয়াম কথাটার আসল মানে তো দানবদের সভাকক্ষ! মিলটনের প্যারাডাইজ লস্টে আছে না, স্বর্গচ্যুত দৈত্যগুলো এক জায়গায় মিটিং করার নামে বিরাট হৈ–হল্লা শুরু করেছিল….

—কী দাদা, কী বুঝলেন, কতক্ষণ লাগবে?

বিপদ–আপদের সময় মানুষের মধ্যে তাড়াতাড়ি ঘনিষ্ঠতা হয়। রুমি নামের বাচ্চা মেয়েটির হাত ধরে এগিয়ে আসছেন যে ভদ্রলোক, তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় না হলেও পরস্পরের মুখ–চেনা হয়ে গেছে।

আমি বললুম, লরিটাকে সরাতে না পারলে…লরিটা চালের বস্তায় ভর্তি, অত ভারি লরি কী করে যে সরানো হবে…

–এই সময়টায় আমরা খেয়ে নিতে পারি না?

—হ্যাঁ। তা নেওয়া যায়। কিন্তু যদি হঠাৎ রাস্তা ক্লিয়ার হয়ে যায়?

বাসের অন্য যাত্রী–যাত্রিনীরাও নেমে পড়েছে সবাই। রমেনের পাশের লাল ব্লাউজ পরা মহিলাটি শুধু তরুণীই নয়, রীতিমত ধারালো চেহারার সুন্দরী, তবে মুখখানি গাম্ভীর্যমাখা, তার মধ্যে যেন সামান্য বিষাদের ছোঁয়াও রয়েছে। তার গলায় ঝুলছে একটি হার, সেটি সোনার না গিল্টির তা কে জানে, লকেটটা প্রায় মুরগির ডিমের সাইজের।

বেশ কয়েকজন যাত্রীই খাওয়া বিষয়ে আলোচনা শুরু করে দিল। কেউ বলল, বাসের ড্রাইভারকে বলা হোক; এক ঘণ্টার মধ্যে রাস্তা পরিষ্কার হয়ে গেলেও যেন বাসটা সাইড করে রাখা হয়। কেউ বলল, বাসে মালপত্র পড়ে থাকবে, যদি চুরি যায়। কেউ বলল, আর দেরি করলে কোলাঘাটের হোটেলগুলোতেও খাবার ফুরিয়ে যাবে।

রমেন ও তার সঙ্গিনী দাঁড়িয়ে রইল একটু দূরে, তারা কোনো আলোচনায় অংশ নিচ্ছে না।

কেউ যখন সঠিক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, তখন দেখা গেল আমাদের বাসের উদাসীন কণ্ডাক্টরটি হেঁটে আসছে এইদিকেই। একজন তাকে জিজ্ঞেস করল, দাদা, কোথায় যাচ্ছেন?

কণ্ডাক্টরটি সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল, আমি খেতে যাচ্ছি।

ব্যাস, আর কোনো আলোচনার অবকাশ রইল না। কণ্ডাক্টরকে ফেলে রেখে বাস চলে যাবে না। সুতরাং আমরাও অনুসরণ করলুম তাকে।

প্রায় সবাই গেল, শুধু রমেন ও তার সঙ্গিনীটি দাঁড়িয়ে রইল একই জায়গায়। ওরা সাধারণ জনতার অংশ হতে চায় না, সাধারণ মানুষের মতন ওদের খিদে– তেষ্টাও পায় না। জীবনলাল নামে প্রৌঢ়টি একবার ওদের দূর থেকে ডাকল, রমেন হাত নেড়ে ইঙ্গিতে জানাল, সে যাবে না। আমার ধারণা হলো, জীবনলালের সঙ্গে বকবক করতে হবে এই ভয়েই ওরা গেল না।

কোলাঘাটের হোটেলে প্রচণ্ড ভিড়, আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হলো বেশ কিছুক্ষণ। বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। একদল লোক খাচ্ছে, তাদের পেছনে পেছনে একজন করে দাঁড়িয়ে আছে। একজন উঠলেই অন্যজন সেই জায়গা দখল করবে। খাওয়ার সময় যদি পিঠের কাছে একজন অচেনা লোক দাঁড়িয়ে থাকে, যে–লোকটি মনে মনে বলছে, তাড়াতাড়ি খেয়ে নে, তাড়াতাড়ি খেয়ে নে, আর ট্যাংরা মাছের মুড়ো চিবোতে হবে না, এবার ওঠ…

শেষ পর্যন্ত আমাদের বাস ছাড়ল তিনটের সময়। প্রকৃতি ফ্রকৃতি দেখার ইচ্ছে পুরো হাওয়া হয়ে গেছে, আমি এবারে টানা একখানা ঘুম দিলুম। ট্রেনে– ট্রামে–বাসে–স্টিমারে ঘুমোতে আমার কোনো অসুবিধে নেই। একমাত্র সাইকেল চালাবার সময় ঘুমোবার চেষ্টা করে দেখিনি কখনো। আমার ঘুম স্বপ্নবহুল। একটা স্বপ্নে দেখলুম, আমি ঘোড়ায় চড়ে লাদাখ যাচ্ছি, দু’পাশে বরফ–মাখা পাহাড়, এক জায়গায় ঘোড়া থামিয়ে আগুন জ্বালা হলো, সেই আগুনে ঝলসানো হলো একটা আস্ত হরিণ…

যখন চোখ মেললুম, তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। বাসটা পেট্রল কিংবা ডিজেল নেবার জন্য থেমেছে এক জায়গায়। টিমটিম করে জ্বলছে কয়েকটা আলো, বাইরের লোকজনের মুখ ভালো করে দেখা যায় না। আমার মনে যে প্রশ্নটা জাগল ঠিক সেইটাই অন্য একজন চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, দাদা, এটা কী জায়গা?

দরজার কাছ থেকে একজন উত্তর দিল, লোধাশুলি।

–ওরেঃ বাবা, এখনো যে অনেক রাস্তা বাকি!

— মাঝখানে বাসটার স্টার্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তো টেরও পাননি!

–দাদা, এখানে চা পাওয়া যাবে? বাসটা থেমেছে যখন, একটু চা খেতাম!

—এখানে চা ভালো হবে না। বাহারাগোড়াতে আবার থামবে!

–বাহারাগোড়া, না ঝাড়গ্রাম?

এরপর কয়েকজন তর্ক শুরু করে দিল, বাসটা আগে বাহারাগোড়া যাবে না বেঁকে যাবে এই বিষয়ে। রমেনের কাঁধে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে তার সঙ্গিনীটি। আমার পাশের লোকটি এখনো ম্যাগাজিন পড়ছে। রুমি নামের মেয়েটি রিনরিনি গলায় বলে উঠল, বাপি, আমি বাথরুম করব!

না, বাসের থেকে ট্রেন অনেক ভালো। এমন রসকষহীন ভ্রমণ আমার ভাগ্যে আগে কখনো ঘটেনি। এখনো একজনের সঙ্গেও আলাপ হলো না!

আমি একটা সিগারেট ধরাতে যেতেই পাশের লোকটি বলল, প্লিজ, প্লিজ, হ্যাভ ওয়ান ফ্রম মি….

লোকটি এর মধ্যে কখন সিগারেটের প্যাকেট কিনেছে, আমার ধার শোধ করতে চায়।

এরপর বাস ছাড়ার দশ বারো মিনিটের মধ্যেই ঘটনাটি ঘটল।

হেড লাইটের আলোয় দেখা গেল রাস্তার ওপর কুড়ি–পঁচিশজন নারী পুরুষ দাঁড়িয়ে হাত উঁচু করে বাসটা থামাতে বলছে। এখানেও আবার অ্যাকসিডেন্ট? কিংবা আগের বাস খারাপ হওয়ায় তার যাত্রীরা এই বাসে উঠতে চায়?

বাস থামাতেই হলো। কিছু লোক দাঁড়িয়ে রইল বাসটার ঠিক নাকের ডগায়। দু’জন পুরুষ ও একজন স্ত্রীলোক উঠল সামনের দরজা দিয়ে। পুরুষ দু’জনের একজনের খালি গা, অন্যজনের গায়ে একটি ছেড়া গেঞ্জি। স্ত্রীলোকটি ময়লা লাল পাড়ের শাড়ি পরা। তারা সকলের দিকে মুখ করে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়ল, খালি গায়ের প্রৌঢ়টি হাত জোড় করে বলল, নমস্কার। আমাদের একটা নিবেদন আছে, সার। আপনাদের একটু কষ্ট দিচ্ছি, সার। আমাদের এই অঞ্চলে বড় সাঙ্ঘাতিক খরা হয়েছে, এক ফোঁটা বৃষ্টি নাই, গত বৎসরেও পেরায় এই একই দশা হয়েছিল। এইবারে, সার, আমাদের আর বাঁচার পথ নাই, কারুর ঘরে একদানা খাদ্য নাই, তাই আপনাদের কাছে নিবেদন, যদি আমাদের কিছু কিছু সাহায্য করেন, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও না খেয়ে রয়েছে।

একেবারে পেছনের সীট থেকে একজন কেউ ক্রোধ–মাখানো বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, জোর করে বাস থামিয়ে ভিক্ষে, এ কি মামদোবাজি নাকি? নেমে যাও! এবারে গেঞ্জি পরা লোকটি বলল, বাবুরা, আমরা ভিক্ষুক না, আমরা গ্রামের গেরস্থ মানুষ। পেটের জ্বালাতেই আপনাদের কাছে হাত পেতেছি। দয়া করে আমাদের কিছু কিছু সাহায্য করেন, ভগবান আপনাদের আরও অনেক দেবেন।

পেছনের সীটের সেই তেজি লোকটি আবার বলল, কণ্ডাক্টর, আপনি এদের নামিয়ে দিন? এদের উঠতে অ্যালাউ করলেন কেন? একেই তো চার ঘণ্টা লেট হয়ে গেছে…। বেশ কিছু গুঞ্জন তার কথায় সায় দিল। কিন্তু কণ্ডাক্টর কোনো সাড়াশব্দ করল না।

স্ত্রীলোকটি বলল, সকলে কিছু কিছু দিয়ে যান। আমরা নিরূপায় হয়ে এসেছি। বিশ্বাস করেন, আমরা ভিক্ষা চাই না, আপনাদের কাছে দয়ার দান চাই, ছোট ছেলেমেয়েগুলোর কষ্ট চক্ষে দেখতে পারি না।…

গেঞ্জি পরা লোকটির হাতে একটি থলি, সে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, দ্যান সার, কিছু কিছু দ্যান…

আমার পাশের লোকটি বাংলা না বুঝলেও বিষয়টি ঠিক আঁচ করেছে, পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করে সে খুচরো পয়সা খুঁজতে লাগল। পেছন থেকে সেই একই ব্যক্তি বলল, কেউ কিচ্ছু দেবেন না, ডোন্ট গিভ দেম এ সিঙ্গল পয়সা। দিস ইজ কোয়ার্সার্ন, জোর করে বাস থামিয়ে…দিন দিন কী হচ্ছে দেশের অবস্থা, গভর্নমেন্ট কোনো স্টেপ নেবে না…

সামনের দিক থেকে দু’জন তাকে সমর্থন জানাল। একজন বলল, এদের মোটেই লাই দেওয়া উচিত নয়। এরপর মাথায় চড়বে…এক পয়সা কেউ দেবে না, যাও, নামো, নামো…

গেঞ্জি পরা লোকটি বলল, প্রত্যেকে অন্তত দশটা টাকা করেও যদি দ্যান…কয়েকটা দিন চালাতে পারি…

কয়েকজন একসঙ্গে বলে উঠল, দশ টাকা…ভিক্ষে?

এরই মধ্যে একজন রসিকতা করে বলল, এরপর ভিখিরিরা বাড়িতে এসে বলবে, পোলাউ খাব, রাজভোগ খাব!

এবার হুড়মুড় করে আরও পাঁচজন লোক উঠল, তাদের হাতে কুড়ল ও টাঙ্গি, একজনের হাতে একটা রামদা। অস্ত্র হিসেবে রামদা হয়তো এমন কিছু সাঙ্ঘাতিক নয়, কিন্তু চেহারাটাই বেশ ভয়াবহ। যার হাতে রামদা, তার চেহারাটাও বেশ লম্বা–চওড়া, মাথায় একটা গামছা ফেট্টি করে বাঁধা। সে রামদাটা উঁচুতে তুলে বলল, আরে দূর দূর। ওসব ভালো কথায় চিঁড়ে ভিজবে না…অ্যাই, কেউ টু শব্দটি করবে না। যার যা মালকড়ি আছে ছাড়ো, যদি প্রাণে বাঁচতে চাও…এ দুনিয়ায় ভিক্ষে করে কিছু পাওয়া যায় না, কেড়ে নিতে হয়।

ওদের মধ্যে একজন রোগা পাতলা লোক হাতের টাঙ্গি দিয়ে অকারণে বাসের একটি জানলার কাচ ভেঙে ফেলে তারপর চেঁচিয়ে উঠল, যার যা গয়নাগাঁটি, টাকাকড়ি আছে সব এই থলিতে ঢালো, ভালোয় ভালোয় দিয়ে দিলে কাউর ক্ষতি করব না।

কয়েকজন মহিলা ভয়ের আর্তরব করে উঠল। পুরুষরা সব চুপ

তা হলে এটা সত্যি ডাকাতি? আমার এখনো যেন ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। ঘোর অন্ধকার মধ্যরাত্রি হলে তবু একটা মানে বোঝা যেত, এখন মাত্র সন্ধে সাতটা দশ! রাস্তা দিয়ে আরও দু’একটা গাড়ি যাচ্ছে, কিন্তু কোনোটাই থামছে না, যদিও একটু আগেই লোধাশুলি ছেড়ে এসেছি, সেখানে নিশ্চয়ই থানা–পুলিশ আছে। অনেক বাসে বা ট্রেনেও আজকাল আর্মড গার্ড থাকে, অবশ্য এই বাসটার দিনে দিনেই রাঁচি পৌঁছে যাবার কথা ছিল।

রামদাওয়ালা লোকটা বাসের ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে বলল, কেউ চ্যাচালেই ঘাড়ে কোপ মারব, যার যা আছে দিয়ে দাও।

রমেনের সঙ্গিনী ঘুম ভেঙে সিধে হয়ে বসেছে। এই প্রথম তার গলার আওয়াজ শোনা গেল, সে রমেনকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, তুমি ওটা আনোনি?

রমেন বলল, সুটকেসে রেখেছি…ইস….

রামদাওয়ালার হুমকি সত্ত্বেও সামনের দিকে মহিলারা কান্নাকাটি শুরু করেছে। তাদের গা থেকে জোর করে খোলা হচ্ছে গয়না। একজন কেউ হিন্দীতে বলে উঠল, আউর কিছু নেহি, সাচ বাত…তার পেটে ক্যাক করে একটা লাথি মারার শব্দ হলো।

আমার মানিব্যাগের বালাই নেই। সব সম্পত্তি বুক পকেটে।

এই মুহূর্তে আমি তপনের প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করলুম। প্রতিশ্রুত আড়াই শো টাকার মধ্যে মাত্র পঞ্চাশটা টাকা আমার হাতে দিয়েছে তপন, বাকি দুশো টাকা মালটা ডেলিভারি হলে ওর বড়মামা আমাকে দেবে! সুতরাং আমার ক্ষতি মোটেই বেশি নয়। মাত্র পঞ্চাশ টাকায় একটা জলজ্যান্ত সত্যি সত্যি ডাকাতির দৃশ্য দেখে নেওয়া গেল, এতে আমারই বরং লাভ হলো বলা যায়।

একজন টাঙ্গিওয়ালা রমেন ও তার সঙ্গিনীর টাকাপয়সা নিয়েই সন্তুষ্ট হলো না, সে যুবতীটির দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, এই শালী, তোর কানের দুল দুটো দে!

রমেন একটু উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে যেতেই লোকটা তার গালে মারল একটা চড়। এবার আমারও রক্ত গরম হয়ে গেল। কে বলে বাঙালির রক্ত ডিপ ফ্রিজে জমিয়ে রাখা হয়েছে? আমি বললুম, এই যে, আপনারা মারধোর করছেন কেন? সব তো দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

ততক্ষণে আর একজন এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের সীটের পাশে। সে আমার গায়ে একটা ঠ্যালা মেরে বলল, এই শুয়োরের বাচ্চা, তোরটা দে!

আমি বিনা বাক্যব্যয়ে বুক পকেট থেকে একচল্লিশটা টাকা (দুপুরে ভাত ও ইলিশ মাছ নিয়েছে ন’টাকা) বার করে দিলুম তার হাতে।

তবু সে বলল, তোর কোলে ঐ বাক্সটা কী? দে, দে, ওটা দে! আমি এবারে খানিকটা কেঁপে উঠে বললুম, এটার মধ্যে কিছু নেই। শুধু কয়েকটা কাগজ আছে, বিশ্বাস করুন, শুধু কাগজ…

–সুয়োরের বাচ্চা, হারামির ছেলে, বাক্সটা দিবি, না ঝাড় খাবি?

সেই মুহূর্তে আমি করে ফেললুম আমার জীবনের সর্ব বৃহৎ ভুল। আমি এমনিতে এতটা বোকা বোধহয় নই। কিন্তু হঠাৎ এরকম পরিস্থিতিতে আমার মাথায় গোলমাল হয়ে গেল। অস্ত্রধারীদের দেখার সঙ্গে সঙ্গে এই ছোট বাক্সটা সীটের তলায়–টলায় লুকিয়ে ফেলা উচিত ছিল। কিন্তু আমার নিজেরই যেহেতু দৃঢ়বিশ্বাস যে ওতে টাকাপয়সা বা গয়নাগাঁটি জাতীয় মূল্যবান কিছু জিনিস নেই, সেইজন্যই বাক্সটার প্রতি অত গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু এরকম চৌকো সাইজের ছোট বাক্স ডাকাতদের কাছে লোভনীয় মনে হতেই পারে। এই বাক্সটা ওরা কেড়ে নিলে আমি রাঁচিতে গিয়ে তপনের বড়মামাকে মুখ দেখাতে পারব না। বাকি দুশো টাকাও তাঁর কাছে চাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না! বাক্সটা চলে গেলে আমি প্রকৃতই সর্বস্বান্ত হবো!

এই অবস্থায় লুণ্ঠনকারীর মুখের গড়ন ও গলার আওয়াজ, বিশেষত গলার আওয়াজ আমার চেনা চেনা মনে হওয়ায় আমি যেন অন্ধকারে এক ঝলকের জন্য দেখতে পেলুম হারানো মানিক।

আমি ব্যাকুলভাবে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললুম, গোবিন্দ না? এই গোবিন্দ, আমি নীলুদা, চিনতে পারছিস না?

প্রতিক্রিয়া হলো তাৎক্ষণিক। আমি আশা করেছিলুম আমার নাম শুনেই এক কুড়ুলধারী দুর্ধর্ষ দস্যু লজ্জায় কুঁকড়ে যাবে, বিগলিত হয়ে আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবে। কিন্তু তার বদলে সে সঙ্গে সঙ্গে খপ করে চেপে ধরল আমার মাথার চুল। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, হারামজাদা, নেমে আয়, নেমে আয়।

কেন যে আড়াই মাস নাপিতদের বঞ্চিত করেছি। আমার মাথায় এত বড় বড় চুল মুঠো করে ধরা খুব সুবিধে। আমার চুল ধরে টানলে বড্ড লাগে, বিশেষত গ্রীষ্মকালে। কেউ যদি আমায় কখনো মারতে চায়, আমি তাকে অনুরোধ করব, শরৎকালে মেরো ভাই! স্বয়ং মৃত্যুর কাছেও আমার এই অনুরোধ জানানো আছে।

কিন্তু আমার বর্তমান আততায়ীর কাছে আমি দয়া ভিক্ষে করারও কোনো সুযোগ পেলুম না। গোবিন্দ আমার চুল ধরে টেনে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে দরজার কাছে নিয়ে এসে, পেছনে এক লাথি মেরে ফেলে দিল নীচে। একজন কাকে যেন বলল, এই শুয়োরের বাচ্চাটাকে ধরে রাখ।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9
Pages ( 1 of 9 ): 1 23 ... 9পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress