Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » চলো দিকশূন্যপুর || Sunil Gangopadhyay

চলো দিকশূন্যপুর || Sunil Gangopadhyay

বাথরুমের বন্ধ দরজার বাইরে কেউ আমাকে ডাকল, নীলু, নীলু!

আমি উত্তরও দিলুম, অ্যাঁ? কী?

তারপর আর কোনও সাড়াশব্দ নেই। দাঁত মাজা থামিয়ে আমি উৎকর্ণ হয়ে রইলুম কয়েক মুহূর্ত। বউদির সকালে স্কুল, ছ’টার আগে বেরিয়ে যায়। দরজা খুলে উঁকি মারলুম, কেউ নেই।

মুখে টুথপেস্টের ফেনা নিয়েই দেখে এলুম অন্য ঘরগুলো। মা জপে বসেন এই সময়, দেয়ালে আমার বাবা ও শ্রীরামকৃষ্ণের ছবি, তার তলায় একটা ছোট্ট পেতলের সিংহাসনে যুগল রাধা-কৃষ্ণের পিতল মূর্তি। মা চোখ বুজে একটু একটু দুলছেন।

দাদা এই রকম সময়েও বিছানা ছেড়ে ওঠে না, দু’খানা খবরের কাগজ মুখস্থ করে। তৃতীয় কাপ চায়ের পর তার বাথরুমের বেগ আসে।

পরিষ্কার নারী কণ্ঠ, আমাদের বাড়িতে এ সময় অন্য মহিলা কে আসবে? মুমু কখনও সখনও এসে পড়ে বটে, কিন্তু তার গলা চিনতে আমার ভুল হবে কেন? তা ছাড়া মুমু আমাকে নীলু বলে ডাকেও না।

তা হলে আমি ভুল শুনলুম? কিংবা কোনও পাখির ডাক? বাথরুমের জানলা দিয়ে দেখা গেল, রাস্তার উল্টোদিকের কৃষ্ণচূড়া গাছে এক শ্ৰীমান কাক্কেশ্বর কুচকুচে বসে আছে। কলকাতা শহরে ইদানীং কাক-চিল ছাড়া অন্য পাখি প্রায় দেখাই যায় না। চড়ুই পাখিগুলোই বা গেল কোথায়? কাকেরা ‘ক’ অক্ষর ছাড়া আর কোনও অক্ষর উচ্চারণই করতে পারে না।

মনের মধ্যে একটা খটকা রয়ে গেল।

রঘু ছুটি নিয়েছে, আজ আমার বাজার করার পালা। দাদা অর্থ উপার্জনের মতন একটা প্রধান কাজ করে বলে বাড়ির কোনও কাজে তার হাত লাগাবার প্রশ্নই ওঠে না। ঘরের পুরনো বাল্ব লাগাবার সময়েও নীলুর ডাক পড়ে। হোল্ডার এত উঁচুতে, আমি হাত পাই না। একটু টুলের ওপর দাঁড়াতে হয়। টুলটা নড়বড়ে, কেউ সেটা ধরবে তো! আমি বাল্ব লাগাব আর দাদা টুল ধরবে, তার প্রেস্টিজে লাগবে না? দাদা টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে বসে থেকে বলে, তোর বউদিকে ডেকে ধরতে বল!

তা, বাজার করতে আমার ভালই লাগে। আমি লক্ষ করেছি, অনেক বাড়িতেই বাবুরা রোজ ভাত-ডাল-তরকারি-মাছ খায় কিন্তু চালের দাম, আলুর দামের ওঠা-নামা, পেঁয়াজের রাজনীতি এসব কিছুই জানে না। শুধু তারা জানে, চিংড়ি মাছের দাম বেশি, ওটা বিলাসিতা! এক ডজন কুমড়ো ফুলের দাম কত, এই প্রশ্ন নিয়ে যদি একটা সমীক্ষা হয়, তা হলে আমি বাজি ফেলে বলতে পারি, অন্তত শতকরা নব্বইজন শহুরে শিক্ষিত লোক তাতে ফেল করবে।

দাদা যত কম জানে, ততই আমার লাভ।

প্যান্ট-শার্ট পরে তৈরি হয়ে দাদার ঘরে এসে বললুম, টাকা দাও!

মুখ থেকে খবরের কাগজটা সরিয়ে দাদা বলল, পেট্রোলের কত দাম বাড়ল এক লাফে, দেখেছিস?

আমি বললুম, তাই নাকি?

আমাদের গাড়ি নেই, দাদা অফিসের গাড়ি শুধু যাওয়া-আসার জন্য পায়। পেট্রোলের দাম বাড়া-না বাড়া নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে যাব কেন?

দাদা বলল, পেট্রোলের দাম বাড়লে সব জিনিসের দাম বেড়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে। এমনকী দেখবি, কাঁচালঙ্কারও বেশি দাম নেবে।

সকালবেলা বাথরুম সারার আগে বিশেষ কথা বলে না। আজ আরও কিছু বলার জন্য চায়ের কাপে একবার চুমুক দিয়ে নিল।

রঘু না থাকলে দাদাকে বারবার চা বানিয়ে দেবে কে? বউদি যাবার সময় তিন-চার কাপ চা ফ্লাস্কে ভরে দিয়ে গেছে, দাদা তাই ঢেলে ঢেলে খাচ্ছে। বিলাসিতার কোনও ত্রুটি নেই।

সব জিনিসেরই দাম বাড়বে, দাদা শুধু কাঁচালঙ্কার উল্লেখ করল কেন? এ বাড়িতে আমিই একমাত্র ভাত খাওয়ার সময় পাতে দু-একটা কাঁচালঙ্কা নিই! আমার জন্য সংসারের খরচ বাড়বে?

দাদা বলল, টেবিল থেকে সিগারেট-দেশলাইটা দে তো নীলু!

তারপর একটুখানি উঠে, পিঠে বালিশ গুঁজে, আরাম করে সিগারেট ধরাল। আমার মুখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, ব্যাটারা পেট্রোলের দাম বাড়ায়। জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়, কিন্তু মাইনে বাড়ায় না। আমারও মাইনে বাড়বে না, তোর বউদিরও মাইনে বাড়বে না। অথচ সব আগের মতন ঠিকঠাক চালাতে হবে। তাই আমি ভাবছিলুম-

দাদা কী ভাবছে, তা আর বলে দিতে হবে না। ভূমিকাতেও বোঝা গেছে। দাদা আবার বলল, আমাদের এক মাসতুতো ভাইয়ের বিয়ে এ মাসে, তাকে সাতজন্মে দেখিনি, মা বলেছে, সে বিয়েতে সোনার গয়না উপহার দিতে হবে। না হলে নাকি ভালো দেখায় না। কী কাণ্ড বল তো! এই বাজারে সোনার গয়না! তুই কী বলিস?

আমি বললুম, সে বিয়েতে না গেলেই হয়। আমাদের বাড়িসুদ্ধু সবার সেদিন জ্বর হতে পারে, পেট খারাপ হতে পারে। মাকে খুব বেশি করে জোলাপ খাইয়ে দিলে–

দাদা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, না গেলেও, পরে উপহার পাঠাতে হবে। এইরকমই নিয়ম। নইলে, মা যদি কান্নাকাটি করে, তুই সামলাবি? বাবা নেই বলে সব দায়িত্বই যেন আমার! তুই চা খেয়েছিস? আর একটু খাবি?

নিজের চা থেকে আমাকে ভাগ দেবার এই উদার আহ্বান একেবারে অভূতপূর্ব ব্যাপার। আমি তবু প্রত্যাখ্যান করে বললুম, না, আর খাব না!

দাদা বলল, বিহার থেকে অনেক লোক কলকাতায় চাকরি করতে আসে। আমরাই বা যাব না কেন?

হঠাৎ এই প্রসঙ্গ পরিবর্তনে আমি কোনও উত্তর দিতে পারলুম না।

দাদা বলল, আমার বন্ধু অশোক সিন্হাকে তোর মনে আছে? ওই যে সিনেমা করে শত্রুঘ্ন সিন্হা, তার পিসতুতো ভাই। সেই অশোক বিহারের ডাল্টনগঞ্জে ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার হয়েছে। ডাল্টনগঞ্জ খুব সুন্দর জায়গা, কাছাকাছি জঙ্গল টঙ্গল আছে, পাহাড় আছে, জানিস তো?

আমি মাথা নাড়লুম।

ডাল্টনগঞ্জ-পালামৌ অঞ্চলে আমি অন্তত সাত-আটবার গেছি। ও দিক আমার নিজের হাতের পাঞ্জার মতন চেনা।

দাদা বেশ নরম গলায় বলল, অশোক ইচ্ছে করলে তোকে একটা চাকরি দিতে পারে। তুই বেড়াতে টেড়াতে, ভ্রমণ করতে ভালবাসিস, তুই যাবি ওখানে? তা হলে আজই অশোককে টেলিফোন করতে পারি।

দাদা ভ্রমণ কথাটার মানে গুলিয়ে ফেলেছে। কোনও এক জায়গায় মাসের পর মাস, বছরের পর বছর থাকলে তাকে ভ্রমণ বলে নাকি? যারা চাকরির জন্য দার্জিলিং কিংবা সুন্দরবনে যেতে বাধ্য হয়, তারা কি ভ্রমণে যায়?

আমি তবু উৎসাহ দেখিয়ে বললুম, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কেন যাব না?

দাদা তবু বলল, ঠিক যাবি তো? অশোকের সঙ্গে আমার একরকম কথা হয়েই আছে। আজই ফোনে আবার কনফার্ম করতে পারি।

আমি বললুম, যখন বলবে, তখনই চলে যাব।

বালিশের তলা থেকে পার্স বার করে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট দিয়ে দাদা বলল, এখন থেকে একটু কম-সম বাজার করিস!

আজ সন্ধেবেলা আমাদের বাড়ির দৃশ্যটি আমি কল্পনা করতে পারি। দাদার সঙ্গে বউদির তর্ক লেগে গেছে। আমার ডাল্টনগঞ্জে চাকরি করতে যাওয়ার ব্যাপারে দাদার প্রস্তাবটিতে মাও সম্মতি জানাবেন। কিন্তু বউদি ঘোর আপত্তি তুলবে! বউদি আমার বাউণ্ডুলেপনার দারুণ সমর্থক।

সবাইকেই চাকরি করতে হবে কেন? এই সমাজের কিছু লোক গান গাইবে, বাঁশি বাজাবে, ফুটবল খেলবে, কবিতা লিখবে, ছবি আঁকবে, সাধু-সন্ন্যাসী হয়ে যাবে। এসব থেকে টাকা রোজগার না হলেও ক্ষতি নেই। আর কিছু লোক, এসব কিছুই করবে না, সারা দেশ ঘুরে ঘুরে বেড়াবে, কাছের মানুষদের সেই সব ভ্রমণের অভিজ্ঞতার গল্প শোনাবে, তারও কি প্রয়োজন নেই? সবাই চাকরি কিংবা ব্যবসা করবে, এরকম একটা বিকট, বীভৎস, যান্ত্রিক সমাজ চাই না!

দাদা-বউদির ঝগড়ার সময় আমি দাদাকেই সমর্থন করি, তাতে বউদির আরও জেদ বেড়ে যায়। বউদি এমনকী বলবে, তোমাদের মাসতুতো ভাইয়ের বিয়েতে আমার দু’ গাছা চুড়ি দিচ্ছি, তাই ভেঙে কিছু একটা গড়িয়ে দাও, তবু নীলুকে ওই বাজে চাকরিতে পাঠানো চলবে না। বিহারে গিয়ে কেরানিগিরি, ছিঃ!

আমার বউদি হীরের টুকরো মেয়ে!

পেট্রোলের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব এরই মধ্যে পড়া উচিত কি না জানি না, বাজারে আজ জিনিসপত্র খুব কম। মাছের বাজারে আগুন। বর্ষা পড়ে গেছে, তবু ইলিশ ছোঁয়া যায় না। এতকাল ধরে সবাই জানে, বড় মাছের দাম বেশি, ছোট মাছের দাম কম। এখন সব ওলোট-পালোট হয়ে গেছে। একটা আস্ত কাতলা মাছ পঞ্চাশ টাকা কিলো, আর পুঁটি মাছ ষাট টাকা। মৌরলা মাছ আরও বেশি। হায় কাতলা, তোমার কী অপমান!

বউদি ছোট মাছ ভালবাসে। পুঁটি, মৌরলা, কাচকি, বাঁশপাতা, চাপিলা জাতীয় মাছ ভাজা না হলে তার ভাত রোচে না। দাদা রুই-কাতলার ভক্ত। আজ বেশি দাম দিয়েই কুচো মাছ কিনলাম।

আলু-পেঁয়াজের দোকানে দাঁড়িয়েছি, আবার শুনতে পেলাম কেউ আমায় নীলু, নীলু বলে দু’বার ডাকল।

সেই ডাকের মধ্যে ব্যাকুলতা রয়েছে। খুব কাছ থেকে। অথচ কেউ নেই। এ কি অলৌকিক ব্যাপার নাকি? বাজারের এই বারোয়ারি ভিড়ে, খটখটে দিনের আলোয় অলৌকিক কিছু ঘটতে পারে?

তবু আমার সারা শরীরে শিহরন হল।

সাড়ে পাঁচ টাকা আলুর কেজি হলে আড়াই শো গ্রামের দাম কত হয়, এই সামান্য হিসেবটাও গুলিয়ে ফেললুম। দোকানদারটি পয়সার জন্য হাত বাড়িয়ে আছে, আমি স্থিরভাবে অন্যমনস্ক দণ্ডায়মান, যেন কেটে যাচ্ছে অনন্তকাল।

তারপর সম্বিৎ ফিরে ডান পাশে কয়েক পা এগোতেই দেখতে পেলাম এক মহিলাকে। পেছন দিকে ফেরা। তবু ঘাড়ের আকৃতি ও চুলের ধরন দেখেও মানুষ চেনা যায়। অৰ্চনাদি!

আজকাল মহিলারা আকাশে জাম্বো জেট বিমান যেমন চালাতে জানে, তেমনি সমুদ্রে তিমি মাছ শিকার করতেও পারে। পুরুষদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কোনও দিক দিয়েই পিছিয়ে নেই। ভাল, ভাল, খুব ভাল।

কিন্তু সকালবেলা মেয়েদের বাজার করতে আসাটা আমার ঠিক পছন্দ হয় না। এটা যেন শুধু পুরুষদেরই কাজ। অনেক মহিলারা বাধ্য হয়ে আসেন তা জানি, বাড়িতে হয়তো আর কেউ নেই। কিন্তু অর্চনাদির ব্যাপারটা তো তা নয়! ওর বাড়িতে তিনজন কাজের লোক আর দু’টি দেওর রয়েছে, আমি জানি। তবু অৰ্চনাদি গাড়ি চেপে প্রায়ই বাজার করতে আসে।

অর্চনাদির দারুণ টক খাওয়ার ঝোঁক। সারা বছর, প্রতিদিন দুপুরে ভাতের সঙ্গে একটা কিছু টক চাই। শুধু লেবু হলে চলবে না। কাঁচা আম, কাঁচা তেতুল, চালতা, কামরাঙা, আমড়া, করমচা এই সবের টক ঝোল। কাজের লোকদের বাজারে পাঠালে তারা বেশি খোঁজাখুঁজি করে না, কাঁচা আম বা কাঁচা তেঁতুল নিয়ে যায়। তা হলে কি চালতার সিজনে চালতা, কামরাঙার সিনে কামরাঙার টক খাওয়া হবে না? তাই অৰ্চনাদি গাড়ির পেট্রোল পুড়িয়ে ওই সব কিনতে আসে।

অর্চনাদি আমায় ডাকেনি, অতদূর থেকে ডাকা সম্ভব নয়, আমাকে দেখতেও পায়নি। তা ছাড়া অর্চনাদির গলা ভাঙা ভাঙা। ওর মুখে সবসময় একটা দুঃখী দুঃখী ভাব। বেশ বড়লোকদের বউদেরও কিছু একটা দুঃখ থাকে। সেই দুঃখের জন্যই বোধহয় অৰ্চনাদি এত টক খায়। টক খেলে দুঃখ কমে কি না, আমি জানি না, তবে খুব ঝাল খেলে মনখারাপ-টারাপ সব উড়ে যায়!

অর্চনাদি মন দিয়ে করমচা কিনছে। লালচে রঙের করমচা দেখলেই আমার কোনও কিশোরী মেয়ের করতলের কথা মনে পড়ে যায়। সেই থেকে মনে পড়ল রূপসার কথা।

পাশে দাঁড়িয়ে আমি বললাম, বাজারে আর কারুর কাছে করমচা নেই। সব তুমি কিনে নিলে?

চমকে আমার দিকে তাকিয়ে ম্লান মুখে অৰ্চনাদি বলল, ও নীলু! তুমি তো ভুলেই গেছ আমাদের। আর বাড়িতে আসো না।

সত্যি ওদের বাড়ি অনেকদিন যাওয়া হয়নি। এক সময় প্রায় প্রতি সপ্তাহেই যেতুম।

অর্চনাদি বলল, তোমার তপেশদা কালই বলছিল, নীলু ছেলেটার কী হল? চাকরি-টাকরি পেয়ে গেল নাকি? ও পা ভেঙে বেশ কিছুদিন শুয়ে আছে জানো তো?

—তপেশদার পা ভেঙেছে? কী করে?

—বাথরুমে আছাড় খেয়েছে। প্রায়ই তো ড্রিংক করে বাড়ি ফেরে, অনেকেই ভেবেছে, সেই অবস্থায় বুঝি… তা কিন্তু নয়, শুধু শুধু বাথরুমে…কম্পাউন্ড ফ্রাকচার।

—তার মানে দেড় মাসের ধাক্কা।

—এমনিতে তো সদা ব্যস্ত, যখন তখন বম্বে-দিল্লি ঘোরাঘুরি করে। এই ধরনের লোকেরা বাড়িতে শুয়ে থাকলে বাড়ির লোকেরা অস্থির হয়ে যায়। অনবরত এটা চাইছে, ওটা চাইছে, সময় কাটে না যে। এখন আবার দাবা খেলা শুরু করেছে। কিন্তু দাবা একলা খেলা যায় না। দিনের বেলা ওর বন্ধুরাও কেউ আসে না। কে খেলবে ওর সঙ্গে। আমি জানি না। মেয়েদের শিখিয়ে নিয়েছে, তাদেরও ধৈর্য থাকে না।

—শুনেছি কম্পিউটারের সঙ্গে দাবা খেলা যায়।

—আমাদের বাড়িতে সে সব নেই। নীলু, তোমার ঘড়ি আছে?

—ঘড়ি? আমি তো ঘড়ি পরি না। পৃথিবীতে এত লোকের হাতে ঘড়ি থাকে যে, আমার ঘড়ির দরকার হয় না।

—রিস্টওয়াচের কথা বলছি না। টেব্‌ল ক্লক। তোমার দরকার?

—হঠাৎ ঘড়ির কথা জিজ্ঞেস করলেন কেন?

—তোমার তপেশদার কোম্পানি বড় বড় ক্লায়েন্টদের গিফ্ট দেবার জন্য খুব সুন্দর ঘড়ি বানিয়েছে। ওর কাছে সেরকম গোটাকতক ঘড়ি আছে। তুমি ওর সঙ্গে দাবা খেলে সে রকম একটা ঘড়ি পেতে পারো।

—দাবা খেলে তপেশদাকে হারাতে হবে?

—না না না না, তোমাকে আগে থেকে সিক্রেটটা বলে দিচ্ছি। দাবায় হেরে গেলে ও ভয়ঙ্কর রেগে যায়। গালমন্দ শুরু করে। তাতে কিচ্ছু পাবে না। তুমি কেমন দাবা জানো তা জানি না। যদি ভালও খেলতে পারো, তবু ইচ্ছে করে ওর কাছে হারবে। তাতে একটা ঘড়ি প্রাইজ পাবে!

—জিতলে কিচ্ছু না, আর হারলে প্রাইজ? চমৎকার। হারাটা মোটেই শক্ত ব্যাপার নয়।

—যাবে নাকি? এখনই চলো না। গাড়ি আছে।

—তা হলে আমার বাজারটা বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যেতে হবে।

—তাতে কোনও অসুবিধে নেই। ওকে যদি অন্তত ঘণ্টা তিনেক খেলায় আটকে রাখতে পারো, তা হলে আমার খুব উপকার হয়। দুপুরে আমাদের ওখানেই খেয়ে নিয়ো।

একটি ঘড়ি উপহার, সেই সঙ্গে দুপুরের নেমন্তন্ন। তার বদলে কী করতে হবে। দাবা খেলায় হেরে যাওয়া। শরৎচন্দ্রের একটা বৈঠকী গল্প পড়েছিলুম। এক জায়গায় দু’জন লোক চাকরির জন্য গেছে। একজন ম্যাট্রিক পাশ, অন্যজন আই এ ফেল। দ্বিতীয় লোকটিই চাকরিটা পেয়ে গেল। তখন ম্যাট্রিক পাশ লোকটি নিয়োগকর্তাকে জিজ্ঞেস করল, স্যার, ওর যোগ্যতা কী করে বেশি হল? চেষ্টা করলে আমিও কি আই এ-তে ফেল করতে পারতুম না?

চেষ্টায় কী না হয়! খুব চেষ্টা করলে পরীক্ষাতেও ফেল করা যায়, দাবা খেলাতেও অবশ্যই হারা যায়।

আমি কতদিন ভেবেছি, আহা, আমার কেন পা ভাঙে না! বেশ ভালমতন ফ্র্যাকচার। তা হলে বেশ ন্যায়সঙ্গতভাবে, নিজস্ব দাবিতে টানা অনেকদিন বিছানায় শুয়ে থাকার অধিকার পেতুম। কেউ আমাকে বলতে পারত না, যা চাকরি খুঁজতে যা, র‍্যাশনের দোকানে যা, ইলেকট্রিক বিল দিয়ে আয়….। সময় কাটাবার জন্য তপেশদার মতন দাবা খেলায় সঙ্গী খুঁজতে হত না। কত বই পড়া হয়ে যেত। বই পড়তে পড়তে চোখ ব্যথা করলে মনে মনে আকাশ-পাতাল তছনছ করতুম, তাও কম উপভোগ্য নয়!

তপেশদা বই-টই পড়ার ধার ধারে না। চুপ করে শুয়ে থাকতে জানে না। সবসময় কিছু না কিছু কাজ চাই।

বাঁ পায়ের গোড়ালি থেকে উরু পর্যন্ত প্লাস্টার করা, তপেশদা লম্বা হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। একটা ক্যালকুলেটর যন্ত্রে কী সব হিসেব কষছে। জালে একটা পোকা পড়লে মাকড়সা যেমন খুশি হয়। আমাকে দেখে সেরকম উজ্জ্বল মুখে তপেশদা বলল, কি হে নীলুমাস্টার, অনেকদিন দেখা-টেখা নেই, মাঝে মাঝেই উধাও টুধাও হয়ে যাও কোথাও!

আমিও উৎফুল্লভাবে বললুম, আপনার পা ভেঙেছে, খবর দেননি? তা হলে আপনার সঙ্গে দাবা খেলতে আসতাম।

—তুমি আবার দাবা টাবা খেলতে টেলতে শিখলে কখন?

—বাঃ, জানেন না? গোর্কি সদনে `দাবার কমপিটিশানে আমি একবার চ্যাম্পিয়ান হয়েছিলুম!

—বটে বটে! ওসব চ্যাম্পিয়ান টাম্পিয়ান আমি অনেক দেখেছি। লড়ে যাও দেখি এক হাত। বড় জোর পাঁচ চালে মাত করে দেব!

দাবা-টাবা, খেলতে-টেলতে, দেখা-টেখা, চ্যাম্পিয়ান-ট্যাম্পিয়ান! স্বভাবটা আগের মতনই আছে, একটুও বদলায়নি দেখছি। তপেশদা একটা বিশাল মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির বিক্রি বিভাগের কর্তা। জিনিসপত্র বিক্রি করতে হলে সব কথাই দু’বার করে বলতে হয় বোধহয়!

এমন ভাব করতে হবে, যাতে মনে হয় আমি খুব ভাল খেলা জানি। একেবারে আনাড়ি বলে ধরে ফেললে ঘড়িটা নাও দিতে পারে। পাকা দাবাড়ুদের প্ল্যান এলোমেলো করে দেবার ভাল উপায় হচ্ছে প্রথমেই কয়েকটা হাতি-ঘোড়া খেয়ে ফেলা। জ্যান্ত অবস্থায় মন্ত্রীকে খেয়ে ফেলতে পারলে আরও ভাল। নিজেরগুলোও যায় যাক।

খেলার মাঝপথে গিয়েই মনে হল, আমি বোধহয় জিতেও যেতে পারি। তপেশদা এর মধ্যে রাজাকে সরাতে শুরু করেছে। রাজা একবার ঠাঁই নাড়া হলে তাকে বাঁচানো শক্ত। সর্বনাশ, জিতলে তো চলবে না! এবার হারার জন্য বুদ্ধি খাটাতে হবে!

অর্চনাদি এক প্লেট গরম গরম চিংড়ি মাছ ভাজা নিয়ে এল এক সময়।

তপেশদা তপেশদা বলে ডাকি, সেই অনুযায়ী অর্চনাদিকে অর্চনাবউদি বলা উচিত। কিন্তু অৰ্চনাদিকে বিয়ের আগে থেকেই চিনি, তখন থেকেই দিদি বলি। বিয়ের পর অনেকে সম্বোধন বদলায়। বান্ধবীর মাকে অনেকেই বলে মাসিমা, সেই বান্ধবী বউ হয়ে গেলে মাসিমা হয়ে যায় মা। এরকম অনেক কাকা হয়ে যায় বাবা। অনেক মেয়ের পাড়াতুতো দাদা হয়ে যায় ওগো। আমি তো বিয়ে করিনি, আমি এসব বদলাতে যাব কেন?

অৰ্চনাদি বলল, নীলু, তুমি কাল বিকেলে ফ্রি আছ?

তপেশদা বলল, আঃ বিরক্ত কোরো না!

অৰ্চনাদি বলল, একটা কথা বলেনি ওকে!

তপেশদা বলল, দেখছ না। রাজাকে কিস্তি দিয়েছে!

অর্চনাদি বলল, ওসব আমি বুঝি না। নীলু, কাল কলামন্দিরে আমার মেয়েদের একটা নাচের প্রোগ্রাম আছে, তুমি দেখতে যাবে? আমি বললুম, নিশ্চয়ই! আমার কোনও কাজ নেই। অর্চনাদি বলল, তা হলে তোমাকে একটা টিকিট দিয়ে যাচ্ছি। আমি বললুম, একটা? অৰ্চনাদি, দুটো টিকিট পেতে পারি? তপেশদা বলল, কী হে, গার্ল ফ্রেন্ড ট্রেন্ড জুটিয়েছ ফুটিয়েছ নাকি?

আমি সলজ্জভাবে ঘাড় নিচু করে রইলুম। এ বাজারে গার্ল ফ্রেন্ড না থাকলে প্রেস্টিজ থাকে না। এমনকী বেকারদেরও গার্ল ফ্রেন্ড থাকে। ‘বান্ধবী’ কথাটা এখন উঠে গেছে। ‘গার্ল ফ্রেন্ড’ আরও মাখো মাখো শোনায়।

খেতে বসার সময় দেখতে পেলাম ওদের তিন মেয়েকে। বর্ণালী প্রায় যুবতীর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, রূপসা যদিও শ্রাবণীর চেয়ে ছোট, কিন্তু লম্বায় দু’জনেই সমান সমান। মনে মনে হিসেব করলাম, রূপসার বয়েস এখন এগারো। আগের থেকে বেশ রোগা হয়ে গেছে, চোখ দু’টি হরিণীর মতন চঞ্চল।

রূপসাকে দেখে আমার খানিকটা অপরাধ বোধ হল। একজন আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিল, মাঝে মাঝে রূপসার খোঁজখবর নেবার। আমি অনেকদিন সে দায়িত্বপালন করিনি। যাক, ভালই তো আছে, একটু রোগা হলে কিছু আসে যায় না।

তপেশদা বলল, নীলু, আবার কবে আসবে? ডুব-টুব মেরো না। কালই সকালে-টকালে চলে এসো।

আমি বললুম, দেখি!

প্রতিদিন একটা করে ঘড়ি আমার দরকার নেই। তা ছাড়া তপেশদাকে জেতানো খুব শক্ত। খেলতে খেলতে এক একবার আমার জেদ চেপে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, ঘড়ি পাই না পাই, দিই ওর রাজাকে খতম করে।

তৃতীয়বার আমি সেই ডাক শুনতে পেলুম মুমুদের বাড়ির সিঁড়িতে। সন্ধে হয়ে গেছে, সিঁড়ির আলো জ্বালা হয়নি, সেই অন্ধকারের মধ্যে শোনা গেল, নীলু, নীলু!

সঙ্গে সঙ্গে আমি পেছন ফিরে বললুম, বন্দনাদি!

না, সেখানে কেউ নেই, ফাঁকা সিঁড়ি। তবু আমি স্পষ্ট গলার আওয়াজ চিনতে পেরেছি। কোনও সন্দেহ নেই, বন্দনাদি আমাকে ডাকছে, দিকশূন্যপুর আমাকে ডাকছে।

দিকশূন্যপুরে কোনও পোস্ট অফিস নেই, ওখানকার কেউ চিঠি লেখে না, চিঠি পেতেও চায় না। কারুকে ডাক পাঠাতে হলে ওরা ডাক বিভাগের সাহায্য না নিয়ে ইথারে একটা তরঙ্গ তোলে। মনে মনে ডাকলে নাকি ভগবানকেও পাওয়া যায়, তা হলে মানুষকে পাওয়া যাবে না কেন? কেউ যদি খুব তীব্রভাবে কারুর কথা ভাবে, তা হলে তার মনের তরঙ্গ কোনও না কোনও সময়ে অন্যজনকে ছুঁয়ে যাবেই। বন্দনাদি আজ সারাদিন ধরে আমাকে ডাকছে।

এমন দিন শিগগিরই আসবে, যখন মানুষ দূরের মানুষের সঙ্গে মনে মনেই সব কথা বলতে পারবে, সব খবরাখবর জানাতে পারবে। টেলিফোন লাগবে না। যখন তখন টেলিফোন ডেড হয়ে যাওয়া, রং নাম্বার, বিলে বেশি টাকা, এসব ঝঞ্ঝাট থাকবে না আর, টেলিফোন কোম্পানির ব্যবসাই লাটে উঠে যাবে।

ডাকটা চেনার পর মনে খুব স্বস্তি এল। উঠে এলাম ওপরে।

বসবার ঘরে একা বসে আছে লালুদা। টি ভি চলছে। হিন্দি সিনেমার এক নায়ক একখানা পেল্লায় বন্দুক নিয়ে ট্যা-রা-রা-রা করে গুলি চালাচ্ছে, আর পোকামাকড়ের মতন মরে গেল লোকজন। যাঃ, আজকাল আর কেউ বন্দুক দিয়ে গুলি করে না। এটাই বোধহয় এ কে ফরটি সেভেন, কিংবা সাব-মেশিনগান। ছেলেটা কে, সঞ্জয় দত্ত নাকি? সিনেমায় যদি যখন তখন ওকে এ কে ফরটি সেভেন চালাতে হয়, তা হলে বাড়িতে ওই একটা অস্ত্র রাখতে দোষ কী? শুধু শুধু বেচারাকে জেল খাটতে হল।

লালুদা মুখ তুলে বলল, আরে, নীলকণ্ঠ যে! কী আশ্চর্য, তোমার কথাই ভাবছিলাম!

হিন্দি সিনেমার মারামারি দেখতে দেখতে আমার কথা চিন্তা করা? কোনও ক্ষীণতম যোগাযোগও কি থাকতে পারে?

তপনদা-বউদিরা কোথায়? লালুদার ভয়ে ওরা ভেতরে দরজা বন্ধ করে বসে আছে নাকি?

লালুদা বলল, বসো, বসো। তপনটা একটু বাইরে গেছে, আধঘণ্টার মধ্যেই ফিরবে। আমি মুমুকে পাহারা দিচ্ছি।

মুমু লালুদাকে দু’ চক্ষে দেখতে পারে না। তা ছাড়া সে এমন কিছু কচি খুকি নয় যে, তাকে পাহারা দিতে হবে। লালুদা নিজেই নিজেকে দারোয়ানের পদে নিযুক্ত করেছে।

লালুদা জিজ্ঞেস করল, তুমি চাকরি-টাকরি পেলে, নীলমণি? আমি তোমার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। রাজা-ভাত খাওয়াতে কাঠ গুদামের কাজটা একেবারে পাকা হয়ে গিয়েছিল, তোমার তো সেটা পছন্দ হল না। হ্যাঁ, ভাল কথা, তুমি এই মাসটা ফ্রি আছ?

আমি হেসে বললুম, বেকাররা তো সবসময়ই ফ্রি থাকে লালুদা।

—গুড! তোমাকে তা হলে একটা উপকার করতে হবে ভাই।

—পরোপকার তো আপনার ডিপার্টমেন্ট।

—হ্যাঁ মানে, পরোপকারও হবে, তোমার নিজেরও উপকার হবে। ধরো ডেইলি যদি তুমি একটা করে একশোটা টাকা পাও, গ্লাস রাত্তিরের খাবার, অথচ কোনও কাজ করতে হবে না, স্রেফ শুয়ে থাকবে।

শুয়ে থাকার জন্য একশো টাকা? কণ্টক শয্যা নাকি? সাধু-সন্ন্যাসীদের মতন কিছু ম্যাজিক দেখাতে হবে?

—আরে না, না, ভাল বিছানা পাবে। শুধু রাতটা কাটালেই চলবে। ঠিক আঠাশ দিন, মানে ফোর উইকস!

—এটা একটা ধাঁধা?

—শোনো, খুলে বলছি। তুমি পরীক্ষিৎ বোসকে চেনো। তার বউকে চেনো। ওদের বিবাহবার্ষিকীতে তোমার নেমন্তন্ন হয়েছিল। সেদিন তুমি পরীক্ষিতের মাকে দেখেছ। চমৎকার ভদ্রমহিলা, এক সময় ব্রেবোর্ন কলেজে পড়াতেন, এখন রিটায়ার করেছেন। তাঁকে তোমার মনে আছে তো? সেই ভদ্রমহিলার সঙ্গে তোমাকে শুতে হবে!

—অ্যাঁ? কী হচ্ছে কী লালুদা? ওসব শোওয়া-টোওয়া তো আপনার লাইন।

—আরে ছি ছি ছি, এক বিছানায় নয়, এক বিছানায় নয়। তুমি আমাকে এরকম খারাপ ভাবলে, নীলাঞ্জন? আলাদা বিছানা, তবে একই ঘরে। তিনি তোমার মায়ের বয়েসী। পুরো ব্যাপারটি খুলে বলছি। পরীক্ষিৎ সুইজারল্যান্ডের ফ্র্যাঙ্কফুর্ট শহরে একটা লেকচার দেবার নেমন্তন্ন পেয়েছে।

—ফ্র্যাঙ্কফুর্ট শহরটা জার্মানি থেকে কবে এক লাফে সুইজারল্যান্ড চলে গেল?

—ওই একই হল। একই কথা। ধরে নাও দু’ জায়গাতেই যাবে। পরীক্ষিৎ অনেকবার বিলেত-টিলেত গেছে, ওর বউ কখনও যায়নি, এবার সে বায়না ধরেছে, সেও সঙ্গে যাবে। আর কোনও অসুবিধেও নেই, শুধু ওই মা।

—অর্থাৎ মাকে পাহারা দিতে হবে। ও কাজটা তো আপনিই ভাল পারেন!

—না না পাহারা দিতে হবে না। ভদ্রমহিলার দুটো হাঁটুই বাতে পঙ্গু। তিনি পালাবেন কোথায়? পঁয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধারা বাড়ি থেকে পালান, এরকম কোনও রেকর্ড নেই। ব্যাপারটা হল, পরীক্ষিৎদের কলকাতা শহরে আর কোনও আত্মীয় মানে রিলেটিভ নেই। ওরা দু’জনেই যদি বিদেশে চলে যায়, তা হলে মাকে দেখবে কে? বাড়িতে দু’জন কাজের লোক আর একজন রাঁধুনিও আছে। কিন্তু শুধু কাজের লোকের ওপর ছেড়ে দিয়ে চলে যাওয়াটা মোটেই ভাল দেখায় না। ভদ্রমহিলার একবার হার্টেও ব্যথা হয়েছিল। ধরো যদি রাত্তিরবেলা হঠাৎ শরীর খারাপ হয়, তখন কে ডাক্তার ডাকবে, কে ওষুধ দেবে…হয়তো কিছুই হবে না। তুমি শুধু রাত্তিরে ওর ঘরে শুয়ে থাকবে। ও বাড়িতেই খাবে।

—অর্থাৎ পুরুষ-নার্স। সে রকম তো ভাড়া পাওয়া যায়।

—আরে ভাড়া করা লোক আর নিজের লোক কি এক হল?

—আমি কী করে পরীক্ষিৎবাবুর নিজের লোক হলুম?

—তুমি আমাদের সকলের ছোট ভাইয়ের মতন। তোমারও দু’ হাজার আটশো, ধরে নাও রাউন্ড ফিগারে তিন হাজার টাকাই রোজগার হয়ে যাবে।

—ছোটভাই বা নিজের লোককে কেউ এরকমভাবে রোজ হিসেবে টাকা দেয়?

—তুমি ভাই আপত্তি কোরো না! ওদের বিলেত যাওয়াটা ফেঁসে যাবে, এটা কি তুমি চাও? সামনের সোমবার ওরা স্টার্ট করছে, তার আগে তোমার সঙ্গে কথাবার্তা বলিয়ে দেব।

—লালুদা, আমাকে একটু ভেবে দেখতে হবে। প্রতিদিন বাড়ির বাইরে রাত কাটালে আমার বাড়ির লোক কী ভাববে? মায়ের পারমিশন নিতে হবে।

—তোমার মাকে দরকার হয় আমি বুঝিয়ে বলব!

ক্যাঁচ করে একটা শব্দ হল। ডান দিকের কোণের ঘরের দরজা খুলে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে মুমু। সে আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকল।

লালুদাকে বললুম, একটু আসছি, আপনি বসুন।

লালুদা বলল, মুমু এখন পড়ছে, ওকে ডিসটার্ব করতে যেয়ো না। চন্দন বলে গেছে, সামনে মুমুর পরীক্ষা, ও যেন পড়া ছেড়ে না ওঠে।

মুমু এবার চেঁচিয়ে বলল, এই নীলকা, একবার শুনে যাও। তুমি প্রভঞ্জন মানে জানো? আর ইরম্মদ?

আমি লালুদার দিকে তাকিয়ে বললুম, আপনি জানেন নাকি?

লালুদা ব্যস্ত হয়ে বলল, যাও যাও, ওকে একটু পড়া দেখিয়ে দিয়ে এসো। বাংলাটা আবার আমার একদম আসে না।

মুমু পরে আছে একটা দুধ সাদা রঙের ফ্রক। প্রায় ছেলেদের মতন ঘাড়ের কাছে চুল ছাঁটা। টেবিলের ওপর ছড়ানো একগাদা বই খাতা। দেওয়ালে শচীন তেন্ডুলকরের একটা মস্ত বড় পোস্টার। আগে মুমু খুব ইমরান খানের ভক্ত ছিল। ইমরান খান যেই বিয়ে করেছে, তার পর দিনই মুমু ওর দেওয়াল থেকে ইমরান খানের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেছে।

আমি ঘরে ঢোকার পরই দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে মুমু চোখ পাকিয়ে বলল, অ্যাই ব্লু, তুই এতক্ষণ ধরে ওই লেলোটার ভ্যানভ্যানানি শুনছিস কেন রে?

আমি বললুম, কী করব, ছাড়ছিল না যে! তোমার বাবা-মা কোথায় গেছে? মুমু বলল, নেমন্তন্ন বাড়ি। কখন ফিরবে ঠিক নেই। আমার পরশু পরীক্ষা আরম্ভ বলে যাইনি।

—ততক্ষণ লালুদা বসে থাকবে?

—ওকে লাথি মেরে না তাড়ালে ও যায়? আমার মায়ের সঙ্গে প্রেম করতে আসে।

—এই, ছিঃ, আবার ওই সব কথা বলে! বউদি লালুদাকে আজকাল পাত্তাই দেয় না।

—আমার ষোলো বছর আট মাস বয়েস হল, আমি বুঝি এসব বুঝি না?

—তা হলে আরও এক বছর চার মাস বাকি আছে। মনে আছে?

—তোমার মনে থাকাটাই আসল কথা।

—মুমু, তুমি সত্যিই কি প্রভঞ্জন আর ইরম্মদ মানে জানো না?

—জানব না কেন? প্রভঞ্জন মানে ঝড় আর ইরম্মদ মানে মেঘের মধ্যে আগুন। পুরো মেঘনাদবধ কাব্য আমার মুখস্থ।

—ভাগ্যিস বলে দিলে। আমি নিজেই ইরম্মদ মানে জানতুম না।

মুমু কয়েক পলক আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, নীলকা, তুমি হঠাৎ আমাদের বাড়ি এলে কেন? কেউ তোমাকে ডেকেছে?

আমি বললুম, না, কেউ ডাকেনি। এমনি এমনি বুঝি আসা যায় না? আমরা কি সাহেব নাকি যে, অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসতে হবে?

মুমু বলল, তুমি তো এমনি এমনি আসো না। অন্তত দেড় মাস আসোনি। আমি ভাবলুম, মা কিংবা বাবা আমার নামে নালিশ করার জন্য তোমাকে ডেকেছে।

—কেন, নালিশ করার মতন কিছু ঘটেছে নাকি?

—রোজই তো কিছু না কিছু হয়। আমার বাবা মায়ের উচিত ছিল, আর একটা ছেলে বা মেয়ের জন্ম দেওয়া। আমি একমাত্র মেয়ে বলে আমার ওপর বড্ড বেশি নজর দেয়। তুমি ওদের বুঝিয়ে বলো!

—ভ্যাট! ওই সব কথা আমি বলতে পারি নাকি? শোনো, আজ বিকেলবেলা হঠাৎ রম্যাণি ঘোষাল নামে মেয়েটিকে দেখতে খুব ইচ্ছে হল, তাই আমি এসেছি।

—দেখা তো হল। এবার কেটে পড়ো! আমাকে এখন পড়তে হবে। তার আগে একটা সিগারেট ধরাও, আমি দুটো টান দেব!

—আমি তো আজ সকাল থেকে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি!

—আবার বাজে কথা, পকেটে আছে, বার করো, বার করো।

—নেই, সত্যি নেই।

মুমু আমার মুখের কথা বিশ্বাস করবে না। উঠে এল আমার পকেট সার্চ করতে। আমি এলেই মুমু সিগারেট খেতে চায় বলে এ বাড়িতে আসার সময় আমি সিগারেটের প্যাকেট আনিই না। মুমুকে নিরস্ত করার জন্যই এবার বোধহয় আমাকে সত্যিই সিগারেট ছাড়তে হবে।

সিগারেট পেল না বটে, তবু মুমু আমার জামায় নাক ছুঁইয়ে বলল, অ্যাই ব্লু, তোমার গায়ে কীসের যেন গন্ধ পাচ্ছি!

—কীসের গন্ধ?

—সিগারেটের নয়। অন্য রকম। তুমি নিশ্চয়ই কোথাও পালাবার মতলব করেছ। আমি আগেও লক্ষ করেছি, যখনই তুমি বেশ কিছু দিনের জন্য বাইরে চলে যাও, তার আগে তোমার গায়ে এরকম গন্ধ হয়।

মুমুর কথাটা হয়তো খুব অসম্ভব নয়। মানুষের ইচ্ছের একটা গন্ধ থাকতে পারে না? ডাল্টনগঞ্জে একজনকে ধরাধরি করে চাকরি। লালুদা মারফত পুরুষ-নার্সগিরির প্রস্তাব, এসব শুনলেই আমার গা রি রি করে। পালাতে ইচ্ছে হয়। একটু আগে বন্দনাদির গলার আওয়াজ শুনেই ঠিক করে ফেলেছি, আমাকে যেতেই হবে।

মন চলো নিজে নিকেতনে। চলো দিকশূন্যপুর!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8
Pages ( 1 of 8 ): 1 23 ... 8পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *