Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » হোস্টেল: ভালোবাসার এক অধ্যায় || Pallav Sanyal

হোস্টেল: ভালোবাসার এক অধ্যায় || Pallav Sanyal

রাতের নিস্তব্ধতা হঠাৎ করেই ভেঙে যায় করিডোরে ছেলেদের চলাফেরা, বিড়ালের ঝগড়ার শব্দ আর পাশের ঘর থেকে ভেসে আসা চাপা হাসিতে। বাইরে ছাদের ওপর দিয়ে প্লেন উড়ে যাওয়ার গগনবিদারী শব্দ, যেন মুহূর্তেই মনে করিয়ে দেয় বড় শহরের ব্যস্ততা। এ এক অন্যরকম জগৎ— হোস্টেল। আর এই হোস্টেল জীবন, বিশেষত ছেলেদের হোস্টেলের গল্প, একসময় আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল।

চারতলার এই পুরনো ভবনটি ছিল আমার দ্বিতীয় বাড়ি। দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে এখানে শুরু হয় নিত্যদিনের কোলাহল। কেউ করিডোরে বসে ফোনে গল্প করছে, কেউ বা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। করিডোরের ধারে ধারে সাজানো দরজাগুলো যেন প্রত্যেকটা নিজস্ব গল্পের গোপন কক্ষ। একটার ভেতর থেকে ভেসে আসে গান— “চান্নি রাতে, চুপিচুপি কথা বলি।” আরেকটা ঘর থেকে শোনা যায় উত্তপ্ত তর্ক— “এবার ম্যাচ জিতবেই ভারত।”

আমি যখন প্রথমবার এই হোস্টেলের ঘরে ঢুকি, তখন হাতে ছিল একটি সুটকেস। দরজার পেছনে ঝুলছিল পুরনো এক টুপি, টেবিলের কোণায় রাখা কয়েকটা শুকিয়ে যাওয়া বই। পূর্ববর্তী বাসিন্দার স্মৃতি যেন আমাকে এক অদেখা বন্ধনের দিকে টেনে নিয়ে যায়। মনে মনে ভাবলাম, কেমন ছিল সে? কীভাবে কাটিয়েছে এই ঘরটায় তার দিনগুলো? এই অজানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মধ্যেই কেটে যায় আমার প্রথম রাত।

প্রথম কয়েকদিন ছিল একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা। ঘরে বসে নুডলস বানানোর সময় পাশের ঘর থেকে আসা বাচ্চাদের মতো শব্দ শুনে বুঝতাম, কেউ নতুন বন্ধু বানাচ্ছে। করিডোরে দেখা হতো একগুচ্ছ নতুন মুখের সঙ্গে। কেউ হাসি দিয়ে এগিয়ে এসে বলত, “কফি খাবে?” কেউ বা স্রেফ গম্ভীর মুখে পাশ কাটিয়ে চলে যেত।

ধীরে ধীরে হোস্টেলের বন্ধুত্ব জমতে শুরু করল। আমাদের মধ্যে কয়েকজন মিলে একটি গ্রুপ হয়ে গেল। সন্ধ্যাবেলায় আমরা ঠেলে সমোসা খেতে যেতাম। রাতভর গল্প হতো পড়াশোনা, রাজনীতি, আর কখনো কখনো প্রেম নিয়ে।

এই হোস্টেলের প্রতিটা মুখ যেন ছিল এক-একটা চরিত্র। শুভম ছিল আমাদের দলের সবচেয়ে মজার ছেলে। সারাক্ষণ হাসিয়ে রাখত। অথচ রাত গভীর হলে, সেই শুভমকে দেখা যেত ফোনে গভীর মনোযোগ দিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলতে। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কী বলিস এত?” মুচকি হেসে বলল, “পড়াশোনার কথা।” কিন্তু তার চোখে-মুখে প্রেমের ছাপ স্পষ্ট ছিল।

অন্যদিকে, দেবের গল্পটা ছিল অন্যরকম। সে প্রেমে পড়েছিল হোস্টেলের পাশের বিল্ডিংয়ের মেয়ের। দেব করিডোরে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকত, আর আমরা ওকে ক্ষেপাতাম। একদিন সাহস করে দেব মেয়েটিকে প্রপোজ করল। উত্তরে কী পেল? মিষ্টি একটা হাসি আর একটা “হয়তো”। সেই “হয়তো” নিয়ে দেবের দিনগুলো কেটে গেল।

রাত গভীর হলে করিডোরের আলো ম্লান হয়ে আসত। তখন প্রায়ই কেউ না কেউ ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকত। সেদিন সুমন করিডোরে হাঁটছিল একা। আমিও তখন চুপচাপ তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। “কী ভাবছিস?” ও বলল, “জীবন।” সুমনের গল্প ছিল বিষণ্ন। সে ভালোবাসত একজনকে, কিন্তু তাদের সম্পর্ক ছিল দূরত্বের বেড়াজালে বন্দি। “মনে হয় ও আমাকে ভুলে যাচ্ছে,” সুমনের কণ্ঠে কান্না মিশে ছিল। আমি তাকে বোঝালাম, “ভালোবাসা কখনো মুছে যায় না। সময় দে।”

হোস্টেল জীবনের সবচেয়ে কঠিন দিন হলো ছাড়ার দিন। সেই দিনগুলো যখন ঘর গুছিয়ে সুটকেসে সব জিনিস পুরে ফেলতে হয়। শেষবারের মতো দরজার দিকে তাকিয়ে থাকা, পরিচিত করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে এক ধরনের শূন্যতা বোধ হয়।

যে ক্যান্টিনে বসে আমরা রাতভর আড্ডা দিয়েছি, যে চায়ের দোকানে এক কাপ চা ভাগাভাগি করে খেয়েছি, সেই জায়গাগুলো ছেড়ে চলে যাওয়া কতটা কঠিন, তা ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়।

আমার সদ্য শেষ হওয়া উপন্যাস শুরু হয়েছিল এই হোস্টেলের গল্প দিয়ে, আর শেষও হয় এখানে। হোস্টেল এক-একটা স্বপ্নীল পৃথিবী। প্রতিদিন নতুন মুখ আসে, নতুন গল্প তৈরি হয়। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই মুখগুলো হারিয়ে যায়, গল্পগুলো শেষ হয়ে যায়।

এই পৃথিবীও তো এক বড় হোস্টেল। পুরনোরা জায়গা ছেড়ে দেয় নতুনদের জন্য। আর আমরা? জীবন শেষ হলে এই হোস্টেল ছেড়ে অজানার পথে পা বাড়াই। কখনোই আর ফিরে আসি না।
এই হোস্টেলের দেওয়ালগুলো আজও দাঁড়িয়ে আছে। আজও এখানে নতুন মুখ আসে, নতুন গল্প তৈরি হয়। হয়তো আমিও সেই গল্পের কোনো এক পাতায় থেকে যাব। কারণ হোস্টেল শুধুমাত্র একটি ভবন নয়, এটি স্মৃতির এক অমূল্য ভাণ্ডার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *