নানার বাড়ি দাদার বাড়ি
একদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরে দেখি–মাকে আজ অন্যরকম লাগছে। তার চেহারায় খুকি-খুকি ভাব চলে এসেছে। কথা বলছেন অনেকটা সুরেলা গলায়। ব্যাপারটা কী?
অসাধারণ ব্যাপার একটা ঘটেছে—আমরা নানার বাড়ি এবং দাদার বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছি। আমার শৈশবের সবচে আনন্দময় সময় হচ্ছে এই দুজায়গায় বেড়াতে যাওয়া। প্রতি দুবছর পরপর একবার তা ঘটত। আমার মনে হত, এত আনন্দ এত উত্তেজনা সহ্য করতে পারব না। অজ্ঞান হয়ে যাব। আমরা দুটিতে যাচ্ছি। ছুটিতে যাচ্ছি। ছুটিতে যাচ্ছি।
ছুটি!
সিলেট মেলে রাতে চড়ব। গভীর রাতে সেই ট্রেন ভৈরবের ব্রিজে উঠবে। আমরা যদি ঘুমিয়ে পড়ি আমাদের ডেকে তোলা হবে। গভীর বিস্ময়ে দেখব ভৈরবের ব্রিজ। ভোরবেলায় ট্রেন পৌঁছবে গৌরীপুর জংশন। ঘুম ভাঙবে চাওয়ালাদের অদ্ভুত গলা চা-গ্রাম চা-গ্রাম শব্দে। মিষ্টি লুচি দিয়ে সকালের নাশতা। চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা গৌরীপুর জংশনে যাত্রাবিরতি। কী আনন্দ! কী আনন্দ! স্টেশনের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় ঘুরে বেড়াও। ওভারব্রিজে উঠে তাকিয়ে দ্যাখো পিপীলিকার সারির মতো ট্রেনের সারি। দূরের দিগন্তে বিস্তৃত ধানের ক্ষেত। সেই ক্ষেতে নেমেছে সাদা বকের দল। তারা উড়ে উড়ে যায় আবার এসে বসছে। আরও অনেক দূরে মেঘের কোলে নীলরঙা গারো পাহাড়। এইগুলি কি এই পৃথিবীর দৃশ্য? না, এই পৃথিবীর দৃশ্য নয়–ধুলোমাটির এই পৃথিবী এত সুন্দর হতে পারে?
নানার বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে নিশুতিরাত। কিন্তু স্টেশন গমগম করছে। নানার বাড়ির এবং তাদের আশেপাশের বাড়ির সব পুরুষ চলে এসেছেন। মহিলারাও এসেছেন। তাঁরা স্টেশনে ঢোকেননি, একটু দূরে হিন্দুবাড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন।
দরজা দিয়ে নামার সুযোগ নেই। তার আগেই আমাকে কেউ হাত বাড়িয়ে জানালা দিয়ে কোলে তুলে নিয়েছেন। একজনের কোল থেকে আরেকজনের কোলে ঘুরছি। মা খুশিতে ক্রমাগত কাঁদছেন। আহা কী আনন্দময় দৃশ্য!
দুটি হ্যাজাকবাতিতে রাস্তা আলো করে আমরা রওনা হলাম। দুপাশে অন্ধকার–করা গাছপালায় রাজ্যের জোনাকি জ্বলছে, নিভছে। ঐ তো দেখা যাচ্ছে কালীবাড়ি। মা কালী জিভ বের করে শিবের বুকে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, নানার বাড়ি পৌঁছতে তা হলে দেরি নেই। অসংখ্য শিয়াল একসঙ্গে ডাকছে-রাত্রির প্রথম প্রহর শেষ হল বোধহয়।
একবার বলেছি, আবার বলি, আমার জীবনের সবচে আনন্দময় সময় কেটেছে নানার বাড়িতে। বাড়িটার তিনটা ভাগ-মূল বসতবাড়ি, মাঝের ঘর, বাংলাঘর।
বাংলাঘরের সামনে প্রকাণ্ড খাল। বর্ষায় সেই খাল কানায়-কানায় ভরা থাকে। ঘাটে বাঁধা থাকে নৌকা। কাউকে বললেই নৌকা নিয়ে খানিকটা ঘুরিয়ে আনে।
মূল বাড়ির পেছনে ঘন জঙ্গল। এমনই ঘন যে গাছের পাতা ভেদ করে আলো আসে না। সেই জঙ্গলের ভেতর সার দেয়াল। সার দেয়াল হল পাঁচিল দিয়ে ঘেরা নানাদের শক্তিমান পূর্বপুরুষদের কবরস্থান। জঙ্গলে কত বিচিত্র ফলের গাছ-লটকান, ডেউয়া, কামরাঙা…..।
চারপাশে কত বিচিত্র চরিত্রের মানুষ। আমাদের মন-ভুলানোর জন্যে সবার সে কী চেষ্টা। আমার এক মামা (নজরুল মামা) কোত্থেকে ভাড়া করে ধোপাদের এক গাধা নিয়ে এলেন। গাধা যে আসলেই গাধা সেটা বোঝা গেল-সাত চড়ে রা নেই। পিঠে চড়ে বসো, পিঠ থেকে নামো-কিছু বলবে না। শুধু পেছনের দিকে যাওয়া নিষেধ। হঠাৎ লাথি বসাতে পারে।
বাচ্চাদের আনন্দ দেয়ার জন্যে ঘুড়ি উড়ানো হবে। সেই ঘুড়ি নৌকার পালের চেয়েও বড়। একবার আকাশে উঠলে প্লেনের মতো আওয়াজ হতে থাকে। ঘড়ি বেঁধে রাখতে হয় গাছের সঙ্গে, নয়তো উড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে।
সন্ধ্যাবেলা লাটিম খেলা। প্রকাও এক লাটিম। লাটিম ঘোরানোর জন্যে লোক লাগে দুজন। লাটিম ঘুরতে থাকে ভোঁ-ভো আওয়াজে। আওয়াজে কানে তালা ধরে যায়।
একটু রাত বাড়লে ফাডার টার (পাঁঠার টক্কর)। দুটি হিংস্র ধরনের বাঁকা শিংয়ের পাঁঠার মধ্যে যুদ্ধ। দুপ্রান্ত থেকে এরা ঘাড় বাঁকিয়ে ছুটে আসবে। প্রচণ্ড শব্দে একজনের শিং-এ অন্যজন আঘাত করবে। আগুনের ফুলকি বের হবে শিং থেকে। শুরু হবে মরণপণ যুদ্ধ, ভয়াবহ দৃশ্য।
মামাদের কেউ গভীর রাতে আমাদের ঘুম থেকে ডেকে তুলবেন। তারা আউল্লা দিতে যাচ্ছেন। সঙ্গে যাব কি না। ব্যাপারটা হল আলো দিয়ে মাছ মারা। অল্প পানিতে হ্যাজাকের তীব্র আলো ফেলা হয়। সেই আলোয় দেখা যায় শিং, মাগুর শুয়ে আছে। আলোতে এদের চোখ ধাধিয়ে যায়-নড়তে চড়তে পারে না। তখন থোর দিয়ে তাদের গেঁথে ফেলা হয়।
খুব ভোরে নানাজানের সঙ্গে ভ্রমণ। নানাজানের হাতে দুনলা বন্দুক। তিনি যাচ্ছেন বিলের দিকে, আমরা পেছনে পেছনে আছি। ছররা গুলিতে তিন-চারটা বক একসঙ্গে মারা পড়ল। মৃত পাখিদের ঝুলিয়ে আমরা এগুচ্ছিনাকে আসছে মাটির গন্ধ, মৃত পাখিদের রক্তের গন্ধ, বারুদের গন্ধ।
সারাদিন পুকুরে ঝাঁপাঝাঁপি, নিশুতিরাতে ঘুম ভেঙে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শোনা-এই আনন্দের যেমন শুরু নেই তেমনি, শেষও নেই। হোটদের শোবার ব্যবস্থা মাঝের ঘরে। ঢালাও বিছানা। বিছানার একপ্রান্তে মা বসে আছেন, পরিচিতজনরা আসছে। গল্প হচ্ছে, পান খাওয়া হচ্ছে, রাত বাড়ছে। কী চমৎকার সব রাত!
নানার বাড়ি ঘিরে আমার অদ্ভুত সব স্মৃতি। মাঝে মাঝে স্বপ্নদৃশ্যের মতো এরা উঠে আসে। জীবনের সঙ্গে মেলাতে পারি না। কয়েকটি স্মৃতি উল্লেখ করছি।
ক) সাপে-কাটা রুগিকে ওঝা চিকিৎসা করছে-এই দৃশ্য নানার বাড়িতেই প্রথম দেখি। রুগি জলচৌকিতে বসে আসে, ওঝা মন্ত্র পড়তে পড়তে হাত ঘোরাচ্ছে। সেই ঘুরন্ত হাত অতি দ্রুত নেমে আসছে রুগির গায়ে। চিকিৎসা শেষ পর্যায়ে কাঁইক্যা মাছের কাঁটা দিয়ে রুগির পা থেকে দৃষিত রক্ত বের হচ্ছে।
খ) মেঘের ডাক শুনে ঝাঁক বেঁধে কইমাছ পানি ছেড়ে ডাঙায় উঠে আসছে এবং প্রাণপণ চেষ্টা করছে শুকনো দিয়ে কোনো-এক গন্তব্যে যেতে। কেন তারা বর্ষার প্রথম মেঘগর্জনে এমন পাগল হয়, কে বলবে!
গ) ভূতে-পাওয়া রুগির চিকিৎসা করতেও দেখলাম। ভূতের ওঝা এসে রুগির সামনে ঘর কেটে সেই ঘরে সরিষা ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে। রুগি যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বলছে আর মারিস না। আর মারিস না।
ঘ) এক হিন্দুবাড়িতে নপুংসক শিশুর জন্ম হল। কোত্থেকে খবর পেয়ে একদল হিজড়া উপস্থিত। শুরু হল নাচানাচি। নাচানাচির এক পর্যায়ে এরা গা থেকে সব কাপড় খুলে ফেলল। ঝুড়ি ভরতি করে ডিম নিয়ে এসেছিল, সেইসব ডিম ছুঁড়ে মারতে লাগল বাড়িতে। একসময় শিশুটি তাদেরকে দিয়ে দেয়া হল। মহানন্দে তারা চলে যাচ্ছে। ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে শিশুটির মা। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় এমন একটি দৃশ্য। আমার নিজের চোখে দেখা।
ঙ) এক সন্ধ্যায় নানার বাড়িতে ঢিল পড়লে লাগল। ছোট ছোট ঢিল নয়-ক্ষেত থেকে উঠিয়ে আনা বিশাল মাটির চাঙড়। নানিজান বললেন, কয়েকটা দুষ্ট জিন আছে। মাঝে মাঝে এরা উপদ্রব করে। তবে ভয়ের কিছু নাই, এইসব ঢিল কখনো গায়ে লাগে না।
ব্যাপারটা পরীক্ষা করবার জন্যে উঠোনে খানিকক্ষণ ছোটাছুটি করলাম। আশেপাশে ঢিল পড়ছে, গায়ে পড়ছে না—বেশ মজার ব্যাপার।
নিশ্চয় এর লৌকিক কোনো ব্যাখ্যা আছে। ব্যাখ্যা থাকলেও আমার জানা। নেই। জানতেও চাই না। নানার বাড়ির অনেক রহস্যময় ঘটনার সঙ্গে এটিও থাকুক। সব রহস্য ভেদ করে ফেলার প্রয়োজনই-বা কী?
এবার দাদার বাড়ি সম্পর্কে বলি।
দাদার বাড়ির এক বিশেষ পরিচিতি ঐ অঞ্চলে ছিল এবং খুব সম্ভব এখনও আছে-মৌলবিবাড়ি। এই বাড়ির নিয়মকানুন অন্যসব বাড়ি থেকে শুধ যে আলাদা তা-ই না-ভীষণ রকম আলাদা। মৌলবিবাড়ির মেয়েদের কেউ কোনোদিন দেখেনি, তাদের গলার স্বর পর্যন্ত শোনেনি। এই বাড়িতে গানবাজনা নিষিদ্ধ। আমরা দেখেছি, ভেতরের বাড়িতেও বড় বড় পর্দা। একই বাড়িতে পুরুষদেরও মেয়েদের সঙ্গে দূরত্ব রক্ষা করে চলতে হত। ভাবের আদানপ্রদান হাত ইশারায় কিংবা হাততালিতে। যেমন, পর্দার এপাশ থেকে দাদাজান একবার কালি দিলেন, তার মানে তিনি পানি চান। দুবার হাততালি-পান-সুপারি। তিনবার হাততালি-মেয়েদের গলার স্বর শোনা যাচ্ছে, আরও নিঃশব্দ হতে হবে।
আমাদের হল পিরবংশ। দাদার বাবা জাঙ্গির মুনশি ছিলেন এই অঞ্চলের পিরসাহেব। তাঁকে নিয়ে প্রচলিত অনেক গল্পগাথার একটি গল্প বলি? জাঙ্গির মুনশি তার মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন। সেই আমলে যানবাহন ছিল না। দশ মাইল পথ হেঁটে যেতে হল। দুপুরে পৌঁছলেন। মেয়ের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করে ফেরার পথে বললেন, মা, আমার পাঞ্জাবির একটা বোতাম খুলে গেছে। তুমি সুই-সুতা দিয়ে একটা বোতাম লাগিয়ে দাও। বোতাম ঘরে আছে তো?
মেয়ে বোতাম লাগিয়ে দিল। তিনি দশ মাইল হেঁটে বাড়ি ফিরলেন। বাড়িতে পা দেয়ামাত্র মনে হল, বিরাট ভুল হয়েছে। তার কন্যা যে বোতাম লাগাল সে কি স্বামীর অনুমতি নিয়েছে? স্বামীর বিনা অনুমতিতে স্বামীর সংসারের জিনিস ব্যবহার করা তো ঠিক না। তিনি আবার রওনা হলেন, অনুমতি নিয়ে আসা যাক। আবার কুড়ি মাইল হাঁটা।
অমি নিজে অবিশ্যি এই গল্প অন্যভাবে ব্যাখ্যা করি। আমার ধারণা, মেয়ের বাড়ি থেকে ফিরে এসে তার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। আবার মেয়েকে দেখার ইচ্ছা হল। একটা অজুহাত তৈরি করে রওনা হলেন।
দাদার বাড়ির কঠিন সব অনুশাসনের নমুনা হিসেবে একটা গল্প বলি। আমার ফুফুরা খুব সুন্দরী। পির পরিবারের বংশধররা সচরাচর রূপবান হয়। তাঁরাও ব্যতিক্রম নন। দুজন ফুপুই পরীর মতো। বড় ফুপুর বিয়ের বয়স হলে বাবা তার জন্যে একজন ছেলে পছন্দ করলেন। ছেলে বাবার বন্ধু। ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ.। ছেলেও অত্যন্ত রূপবান। বাবা তার বন্ধুকে সঙ্গে করে গ্রামের বাড়িতে এলেন। দাদাজানের ছেলে পছন্দ হল। মেয়ে দেখানো হল। কারণ ধমে নাকি বিধান আছে, বিয়ের আগে ছেলে মেয়েকে এবং মেয়ে ছেলেকে অন্তত একবার দেখতে পারবে। ছেলে মেয়ে দেখে মুগ্ধ। সেই রাতের কথা,-বাবা তার বন্ধুকে নিয়ে বেড়াতে বের হয়েছেন। খোলা প্রান্তরে বাবার বন্ধু গান ধরল। রবীন্দ্রনাথের গান তখন শিক্ষিতমহলে গাওয়া শুরু হয়েছে।
গানটি হল-আজি এ বসন্তে…..
গান গাওয়ার খবর দাদাজানের কানে পৌঁছল। তিনি বাবাকে ডেকে নিয়ে বললেন, এই ছেলে যে গান জানে তা তো তুমি বল নাই।
বাবা বললেন, হ্যাঁ, সে গান জানে।
এইখানে মেয়ে বিয়ে দিব না। তুমি জেনেশুনে গান-জানা ছেলে এবাড়ির আনলে কেন?
গান গাওয়া ক্ষতি কী?
লাভ-ক্ষতির ব্যাপার না! আমরা কয়েক পুরুষ ধরে যে-নিয়ম মানছি আমার জীবিত অবস্থায় তার কোনো ব্যতিক্রম হবে না। তুমি যদি রাগ কর আমার কিছুই বলার নাই। রাগ করে বাড়িতে আসা বন্ধ করলেও করতে পার।
দাদাজান তার মেয়েকে নিজে দেখেশুনে পৃথিবী থেকে দূরে সরে থাকা একটি পরিবারে বিয়ে দিয়ে দিলেন।
আমরা যখন দাদার বাড়িতে বেড়াতে যেতাম, খবর পেয়ে বড় ফুপু আসতেন পালকি করে। পালকি অনেক দূরে অপেক্ষা করত। ফুপুর স্বামী খোঁজ নিতে আসতেন—আমরা যে এসেছি আমাদের সঙ্গে কলের গন আছে কি না। যদি জানতেন কলের গান আছে-সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীকে নিয়ে ফিরে যেতেন।
ধীরে ধীরে দাদার বাড়ির মানসিকতার পরিবর্তন হয়। যে-গান এই বাড়িতে নিষিদ্ধ ছিল সেই গানও চালু হয়। দাদার নির্দেশেই হয়। আমার ছোট বোন শেফুর গলায়-তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে গান শোনার পর দাদাজান নির্দেশ দেন—গান চলতে পারে।
দাদার বাড়ি প্রসঙ্গে অদ্ভুত একটা কথা বলি। দাদার বাবা জাঙ্গির মুনশির ইচ্ছামৃত্যু হয়েছিল। দাদাজানেরও ইচ্ছামৃত্যু হয়। মৃত্যুর সাতদিন আগে সবাইকে ডেকে তিনি তাঁর মৃত্যুর সময় বলেন, কেউ মনে কোনো আফসোস রাখবে না। মন শান্ত করো। আমাকে কেউ যদি বিশেষ কোনো সেবাযত্ন করতে চাও করতে পার।
দাদাজানের বলা সময়েই তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যু হয় সজ্ঞানে। মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে আমার ছোট চাচাকে ডেকে বলেন, আমি তা হলে যাই।
পৃথিবী বড়ই রহস্যময়।
দাদাজানদের বাড়িঘর অনেক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম, গোছানো। মানুষগুলি হৈচৈ করে কম, কাজ করে বেশি। দাদার বাড়িতে আমাদের অবাধ স্বাধীনতা ছিল না। দাদাজান আমাদের চোখে-চোখে রাখতেন। আদব-কায়দা, ভদ্রতা শেখাতেন। সন্ধ্যাবেলা নামাজ শেষ করেই গল্প করতে বসতেন। সবই ঈশপের গল্পের মতো। গল্পের শেষে একটা মোরাল থাকত। মোরাল আছে এমন গল্প ভালো লাগার কথা নয়। কিন্তু দাদাজানের গল্প ভালো লাগত। মুগ্ধ হয়ে শুনতাম।
নানার বাড়ি থেকে দাদার বাড়িতে এলে শুরুতে খানিকটা দমবন্ধ দমবন্ধ লাগত। তবে দাদার বাড়িরও আলাদা মজা ছিল। বাড়ির বাংলাঘরে দুটি কাঠের আলমিরায় ছিল অসংখ্য বই। আসলে এই দুটি আলমিরা নিয়েই একটা পাবলিক লাইব্রেরি। আজিমুদ্দিন আহমেদ পাবলিক লাইব্রেরি। আজিমুদ্দিন আহমেদ আমার দাদার নাম। তার জীবদ্দশাতেই তাঁর নামে বাবা এই লাইব্রেরি করেন। লাইবেরির চাদা মাসে এক আনা। এই লাইব্রেরি থেকে কেউ কোনোদিন বই নিয়েছে বলে আমার জানা নেই। আমরা দাদার বাড়িতে উপস্থিত হলেই শুধু চাবি খুলে বই বের করা হত। চাবি চলে আসত আমার হাতে। দাদার বাড়িতে পুকুরপাড়ে বটগাছের মতো বিশাল এক কামরাঙা গাছ ছিল। সেই কামরাঙা গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে বই পড়ার আনন্দের কোনো তুলনা হয় না।
বাবা জায়গায় জায়গায় লোক পাঠিয়ে গ্রাম্য গায়কদের আনতেন। তারা তাদের বাদ্যযন্ত্র-হাতে উপস্থিত হতেন-রোগভোগা, অনাহারক্লিষ্ট মানুষ, কিন্তু তাদের চোখ বড়ই স্বপ্নময়।
দাদার বাড়িতে গানবাজনা হবার কোনো উপায় নেই। অনেকটা দূরে বাবার এক বন্ধুর বাড়ির উঠোনে গানের আসর বসত। হাত উঁচু করে যখন গাতক ঢেউ খেলানো সুরে, মাথার লম্বা বাবড়ি ঝাঁকিয়ে গানে টান দিতেন–
আমার মনে বড় দুষ্ক।
বড় দুঙ্ক আমার মনে গো।
তখন তার মনের দুষ্ক ছড়িয়ে যেত শ্রোতাদের মনে। চোখ ভরে জল আসত। গান চলত গভীর রাত পর্যন্ত। রাত যত গভীর হত গানে ততই আধ্যাত্মিক ভাব প্রাধান্য পেতে থাকত। শেষের দিকে সেগুলি আর গান থাকত না-হয়ে উঠত প্রার্থনা-সংগীত। আমরা ছোটরা অবিশ্যি তার আগেই ঘুমিয়ে পড়েছি। আমাদের কোলে করে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু ঘুমের মধ্যে কোনো-এক অদ্ভুত উপায়ে গান শুনতে পাচ্ছি।