Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » হেতমগড়ের গুপ্তধন || Shirshendu Mukhopadhyay » Page 4

হেতমগড়ের গুপ্তধন || Shirshendu Mukhopadhyay

বিপদ ঘটলে মানুষ

বিপদ ঘটলে মানুষ তখন-তখন যতটা ভয় পায়, তার চেয়ে আরও বেশি ভয় পায় বিপদ কেটে যাওয়ার পর সেই বিপদের কথা ভেবে।

মাধবেরও হয়েছে তাই। ভূতকে চড় মেরেছেন, গাছ থেকে নবতারণের ঘাড়ে পড়েছেন, তারপর অন্ধকারে অনেকটা পথ দৌড়ে গাছ-গাছালির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে, হোঁচট খেয়ে পড়ে, অতি কষ্টে নদীর ধারে পৌঁছে গেছেন। নদীর ধারে বসে জিরোতে জিরোতে গোটা ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে এখন হঠাৎ আতঙ্কে শিউরে উঠে কাঠ হয়ে গেলেন। সাক্ষাৎ পুলিস এবং সাক্ষাৎ ভূতের পাল্লা থেকে কপাল জোরে বেরিয়ে এসেছেন, কিন্তু এখন ভয়ে শরীর আড়ষ্ট হয়ে যাওয়ায় আর এক পাও চলার ক্ষমতা ছিল না।

এমনই গ্রহের ফের যে, কিছুতেই ‘রাম’-নামটাও মনে আসছে না। দশরথ, লক্ষ্মণ, শত্রু, ভরত, এমনকী মন্থর নামও মনে পড়ছে, কিন্তু দশরথের বড় ছেলের নামটা জিবে আসছে না। বসে প্রাণপণে বিড়বিড় করছেন, “আরে ঐ যে দশরথের বড় ছেলেটা…আরে ঐ তো বনবাসে গিয়েছিল…সোনার হরিণের পিছু নিয়েছিল যে ছোঁকর …আহা কী যেন নাম…আরে ঐ তো রাবণরাজার সঙ্গে যুদ্ধ করল …হনুমানের খুব ভক্ত ছিল না না, হনুমানই সেই ছোঁকরার খুব ভক্ত ছিল…আরে দ্যাখো কাণ্ড, হরধনু ভঙ্গ করে সীতাকে বিয়ে করল যে লোকটা…”

ঠিক এই সময়ে কানে কানে কে যেন বলে দিল, “রামের কথা ভাবছ তো! খিকখিক! তা ভাল, খুব কষে রাম-নাম করে যাও, কিন্তু তাতে লাভ নেই।”

মাধব হিম হয়ে গেলেন। তাকিয়ে দেখেন, নাকের ডগায় নন্দ কিশোর মুনসি।

নন্দকিশোর বলে, “ওসব লোকে রটিয়ে বেড়ায়। ভূতের নামে কত যে মিথ্যে কথা রটায় লোকে, তার লেখাজোখা নেই। বলে, রাম-নাম করলে নাকি ভূতে ভয় পায়। খিকখিক।”

মাধবের গলায় কথা সরছিল না। তবু কাঁপা-কাঁপা স্বরে বললেন, “তবে ভূতে কিসে ভয় খায়?”

নন্দকিশোর খুব খিকখিক করে হাসে। বলে, “তোমারও যেমন বুদ্ধি! ভূতে কিসে ভয় খায় সেই গুহ্যকথা আমি তোমাকে বলতে যাব কেন হে!”

“আমার যে ভীষণ ভয় করছে!” মাধব বলেন।

“তুমি মুখ, তাই ভূতকে ভয় খাও! গাছের ওপর তোমাকে কত করে বোঝালাম যে, ভূতের একরত্তি ক্ষমতা নেই, তাই তাকে ভয় খাওয়ারও কিছু নেই। আবার ভূতকে ভয় খাওয়ানোও ভারী শক্ত। ভূতকে মারা যায় না, তা তো নিজেও দেখলে। ভূতের সাপের ভয় নেই, চোরডাকাত বা পুলিসের ভয় নেই, বন্দুক বা তলোয়ারেও ভয় নেই, এমনকী সবচেয়ে বড় কথা কী জানো?”

“কী?”

“সবচেয়ে বড় কথা হল, ভূতের আবার ভূতের ভয়ও নেই। আর রামের মতো ভালমানুষকে আমরা ভয় পেতে যাবই বা কেন? রাম তো আর ভূতের নিদান দিয়ে যাননি। তাঁর আরও অনেক গুরুতর কাজ ছিল।”

মাধব ভয়ে ভয়ে বললেন, “তাহলে রাম-নাম করে লাভ নেই বলছেন?”

“লাভ একেবারে নেই তা বলিনি। রাম-নামে পাপ-তাপ কাটে, মনটা উঁচুতে ওঠে, প্রাণটা বড় হয়, ভক্তিভাব আসে, গায়ে শক্তিবৃদ্ধি হয়, মনোবল বাড়ে। কিন্তু তা বলে রাম-নাম করে আমাকে ভয় খাওয়াতে পারবে না।”

শক্ত পাল্লায় পড়েছেন বুঝতে পেরে মাধব কাঁদো-কাঁদো হয়ে বললেন, “আপনাকে চড় মারাটা আমার ভারী অন্যায় হয়েছিল।”

নন্দকিশোর খিকখিক করে হেসে বলে, “আরে দূর দূর! তুমিও যেমন! তুমি তো চড় মারতে গিয়েছিলে, নবতারণ দারোগা পিস্তল বের করেছিল। খিকখিক! সাধে কি তোমাদের মূর্খ বলি? তোমার চড় আমার লাগলে তো? আমি কিছু মনে করিনি। তবে তোমার মতো চোর-জোচ্চরদের শাস্তি হওয়া উচিত বলেই আমি মনে করি। সেইজন্যই আমি চেয়েছিলাম নবতারণকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসে তোমাকে ধরিয়ে দেব। কিন্তু দারোগা এমন ভয় খেয়ে গেল যে, পালিয়ে বাঁচে না।”

“আজ্ঞে আমি চোর নই। বিশ্বাস করুন।”

নন্দকিশোর গম্ভীর হয়ে বলল, “কোনো চোরই নিজেকে চোর বলে স্বীকার করে না। তুমি চোর কি না তা জানতে হলে আমাকে তোমার ভিতরে ঢুকতে হবে।”

“অ্যাঁ” বলে আঁতকে ওঠেন মাধব।

নন্দকিশোর বলে, “ভয়ের কিছু নেই। যাব আর আসব। দশ মিনিটও লাগবে না।”

নন্দকিশোর ভূত হলেও বিঘত খানেক লম্বা এবং ভাল সাইজের মর্তমান কলার মতোই পুরুষ্ট। মাধব কঁকিয়ে উঠে বললেন, “ভিতরে গিয়ে দেখবেনটা কী?”

“তোমার মগজ দেখব, বিবেক দেখব, তোমার মনটা কেমন তা বিচার করব, তারপর বুঝব তুমি চোর কি না।”

“কোথা দিয়ে ঢুকবেন?”

“নাক কান মুখ সব পথেই ঢোকা যায়। তবে নাক কান হচ্ছে গলিপথ। আমি গলি দিয়ে যাতায়াত পছন্দ করি না। মুখ হল রাজপথ। আমি রাজপথই পছন্দ করি। তুমি হাঁ করে।”

মাধব ইতস্তত করে বলেন, “গলায় যদি আটকে যায়, তাহলে তো বিষম খেয়ে মরব। আমি বলি কী, পুরোটা একসঙ্গে না ঢুকে আমি বরং আপনাকে একটু-একটু করে চিবিয়ে খেয়ে নিই।”

“দূর দূর! তুমিও যেমন! হাঁ করে থাকো, টেরই পাবে না। আমি এমন কায়দায় ঢুকে যাবে।”

অগত্যা মাধবকে হাঁ করতে হল। নন্দকিশোর ডাইভ মেরে ভিতরে ঢুকে গেলেন। মাধব টের পেলেন একটা নরম আইসক্রীমের মতো ঠাণ্ডা জিনিস তার টাগরীয় গোঁত্তা মেরে গলা দিয়ে নেমে গেল। বেশ বড় রকমের একটা ঢেকুর তুললেন মাধব। তারপর কাঠ হয়ে বসে রইলেন।

ছেলেবেলায় হাঁ করে কঁদতে গিয়ে একবার একটা মাছি গিলে ফেলেছিলেন মাধব। দুধ খেতে গিয়ে মাঝে-মাঝে এক-আধটা পিঁপড়েও পেটে গেছে। আহাম্মক মশা অনেক সময় বে-খেয়ালে

মানুষের মুখে ঢুকে গিয়ে পেটসই হয়ে যায়, তাই জীবনে বেশ কয়েকটা মশাও হয়তো মনের ভুলে গিলে ফেলেছেন তিনি। তাছাড়া ওষুধের বড়ি, চিরতার জল, তেতো পাঁচন সবই খেয়েছেন। কিন্তু ভূত-গেল। এই তার প্রথম। নন্দকিশোরকে গিলে ফেলার পর তিনি স্তম্ভিত হয়ে ভাবতে লাগলেন, এ আমি কী করলাম?

ওদিকে নবতারণ হতাশ হয়ে সদলবলে থানায় ফিরেই দেখলেন একজন গোঁফওয়ালা ভারী চেহারার বিশিষ্ট ভ ভদ্রলোক বসে আছেন। গম্ভীর গলায় বললেন, “আমি হচ্ছি বিজয়পুরের জমিদারের নায়েব। খবর পেয়েছি, জমিদারমশাইয়ের ছোট জামাই মাধব চৌধুরীকে এই থানায় আটক রাখা হয়েছে। খবরটা কি সত্যি?”

বিজয়পুরের জমিদারের জমিদারি এখন আর নেই বটে, কিন্তু তাঁরা তিনটে জাহাজের মালিক, তামাকপাতার মস্ত ব্যবসা আছে, আরে হাজার রকমের কারবারে তাদের লাখ-লাখ টাকা খাটছে। তাদের ভয়ে বাঘে-গোরুতে এক ঘাটে জল খায়। সুতরাং নবতারণ মাথা চুলকোতে লাগলেন। এই থানার চার্জ নিয়ে এক দিনেই এই বিপত্তি দেখে তিনি অন্য থানায় বদলি হওয়ার কথাও ভাবলেন। তারপর কাঁচুমাচু মুখে বললেন, “তাকে কি ছেড়ে দেওয়ার হুকুম আছে?”

নায়েবমশাই গম্ভীর হয়ে বললেন, “না। বরং তাকে খুব ভাল করে আটকে রাখবেন। কারণ, লোকটা খুবই খ্যাপাটে আর রাগী। বিয়ের রাতে তাকে শালীরা সুপুরিশুদ্ধ নাড়, খেতে দিয়েছিল বলে তিনি রাগ করে চলে আসেন, আর কখনো শ্বশুরবাড়িতে যাননি। জমিদারমশাইও ওরকম আহাম্মক জামাইয়ের মুখদর্শন করতে চাননি। কিন্তু এখন মেয়ের কান্না-কাটিতে তার মন নরম হয়েছে। কিন্তু জামাইয়ের হাতে-পায়ে ধরে যেচে সেধে তাকে নিয়ে যাওয়ার

মানুষ তিনি নন। তাই জামাইয়ের গ্রেফতারের খবরে তিনি খুশিই হয়েছেন। তিনি বলে পাঠিয়েছেন, কাল সকালের মধ্যেই মাধব চৌধুরীকে পুলিসের পাহারায় গ্রেফতার অবস্থায় শ্বশুরবাড়িতে যেন হাজির করা হয়।”

নবতারণ মাথা চুলকোতে চুলকোতে টাকের ছাল তুলে ফেললেন প্রায়। হেঃ হেঃ করে বিনয়ের হাসি হেসে বললেন, “কিন্তু মুশকিল হল, আমরা যখনই শুনলাম যে, তিনি বিজয়পুরের ছোট জামাই, তক্ষুনি তাকে ছেড়ে দিয়েছি। উনি ত এখন থানায় নেই।”

নায়েব আরো গম্ভীর হয়ে বললেন, “তাহলে আবার এক্ষুনি তাকে গ্রেফতার করে আনুন। কাল সকালে তাকে গ্রেফতার অবস্থায় বিজয়পুরে হাজির না করলে কর্তা খুবই রেগে যাবেন। কারণ, তার ছোট মেয়ে বলে দিয়েছে, তার স্বামীকে আর তিন দিনের মধ্যে হাজির না করতে পারল সে বিষ খাবে বা গলায় দড়ি দেবে। জমি দারেরই মেয়ে তো, ওদের কথার নড়চড় হয় না। আপনি আর দেরি না করে এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ুন। ঠিকমতো জামাইকে হাজির করতে পারলে কর্তা প্রচুর পুরস্কার দেবেন।”

এই বলে নায়েবমশাই উঠে পড়লেন।

নবতারণ বসে বসে টাক চুলকোতে লাগলেন। জীবনেও এমন মুশকিলে পড়েননি। কিন্তু কিছু একটা করতেই হবে। বিজয়পুরের জমিদারের সঙ্গে হর্তাকর্তাদের খুব খাতির। চটে গেলে নবতারণের চাকরি খেয়ে নিতে পারেন।

ওদিকে থানার গারদে ঘটোৎকচ প্রচণ্ড হম্বিতম্বি করছে। তার খাওয়ার সময় পার হয়ে গেছে, ঘুমও পেয়েছে। কিন্তু বাঁদরকে খাবার দেওয়ার কথা কারও মনে পড়েনি। তাছাড়া কুটকুটে কম্বলের

বিছানায় শুয়ে থাকা ঘটোৎকচের অভ্যাস নেই। ফলে সে ঘন ঘন হুঙ্কার ছাড়ছে, গরাদ বেয়ে উঠছে, নামছে। সে একটু মোটাসোটা বলে গরাদের ফাঁক দিয়ে বেরোতেও পারছে না। তবে তার মধ্যেই সে ঠ্যাং বাড়িয়ে একজন সেপাইকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছে। আর একজনের চুল খামচে আচ্ছা করে মাথাটা ঠুকে দিয়েছে লোহার দরজায়। সেপাইরা রেগে গেলেও কিছু বলেনি, কারণ দারোগাবাবুর ছেলের জন্য বাঁদরটাকে নিয়ে যাওয়া হবে।

বাদরের হুপহাপ শুনে নবতারণ হঠাৎ গর্জন করে বললেন, “সব দোষ বেয়াদপ বাঁদরটার। নিয়ে আয় তো ওকে, আচ্ছাসে ঘা কতক দিই।”

সঙ্গে-সঙ্গে সেপাইরা ঘটোৎকচকে আচ্ছাসে দড়ি দিয়ে বেঁধে চ্যাংদোলা করে নিয়ে এল। ঘটোৎকচ জানে, এই অবস্থায় তেড়িমড়ি করা ঠিক নয়। তাই সে খুব লক্ষ্মী ছেলের মতো কোনো গোলমাল করল না। এমনকী, সামনে হাজির হয়ে সে দারোগাবাবুকে হাতজোড় করে একটা নমস্কারও করল।

নবতারণ একটু নরম হয়ে বললেন, “ব্যাটা সহবত জানে দেখছি!” শুনে ঘটোৎকচ নবতারণকে একটা সেলামও দিল। “বাঃ বাঃ!” খুশি হলেন নবতারণ।

উৎসাহ পেয়ে ঘটোৎকচ নিজের কান ধরে জিব বের করে খুব অনুগমনের ভঙ্গি করল।

নবতারণ বহুক্ষণ বাদে মৃদু-মৃদু হাসতে লাগলেন।

ঘটোৎকচ তখন কান ধরে ওঠবোস করল, মাটিতে উবু হয়ে নাকে খত দিল, তারপর লজ্জার ভান করে দুহাতে নিজের মুখ ঢেকে রাখল।

নবতারণ এইসব কাণ্ড দেখে এত মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যে, বড়বাবু তায়েবজি আর অক্ষয় খাজাঞ্চি যে কখন ঘরে ঢুকে পড়েছেন তা টের পাননি।

বড়বাবুও জমিদার ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর তেমন হাকডাক নেই। নরম মানুষ বলে তাঁকে কেউই তেমন ভয়ও খায় না। উল্টে তিনিই বরং অনেক কিছুকে ভয় খান। দারোগা-পুলিসকেও তার ভীষণ ভয়।

তাই ভয়ে-ভয়ে থানায় ঢুকে গলা খাঁকারি দিয়ে অনেকবার দারোগাবাবুর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন। তাতে কাজ হল না দেখে খুব ভয়ে-ভয়ে নবতারণের আর একটু কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন, “ইয়ে, আমার শালা মাধব চৌধুরীকে কি গ্রেফতার করা হয়েছে?”

নবতারণ একটু চমকে উঠে আপাদমস্তক বড়বাবুকে দেখে নিলেন। তারপর ব্যঙ্গ-হাসি হেসে বললেন, “চালাকি করার আর জায়গা পেলেন না? মাধব চৌধুরী আপনার শালা হতে যাবেন কেন? তিনি তো বিজয়পুরের জমিদারের ছোট জামাই।”

বিজয়পুরের জমিদারের জামাই তাঁর শালা হতে পারবে না কোন্ যুক্তিতে তা বুঝতে না-পেরেও বড়বাবু নবতারণকে চটাতে সাহস পেলেন না। বললেন, “সে কথা অবশ্য ঠিক।”

নবতারণ মৃদু হেসে বললেন, “তবেই বুঝুন, চালাকি দিয়ে কোনো মহৎ কাজ সিদ্ধ হয় কিনা।”

“আজ্ঞে না।” বড়বাবু হতাশ হয়ে বললেন।

অক্ষয় খাজাঞ্চি অবশ্য গলায় একটু সন্দেহ রেখেই বললেন, “তবে কিনা অনেকের এমন জামাইও আছে যারা কিনা আবার অন্য কারো শালাও।”

তায়েবজিও খুব বিনয়ের সঙ্গে অক্ষয় খাজাঞ্চিকে সমর্থন করে বলল, “এই তো আমারই এক শালা আছে যে কিনা ঘুরঘুটপুরের ঘুসুরামের জামাই।

নবতারণ কটমট করে তায়েবজির দিকে তাকিয়ে হুঙ্কার দিলেন, “এরকম সব হয় নাকি?”

অক্ষয় খাজাঞ্চি মিনমিন করে বললেন, “কাজটা হয়তো বেআইনি। এরকম হওয়া উচিতও নয়। তবে হচ্ছে, আকছার হচ্ছে।”

কোথাও একটা ভুল হচ্ছে বুঝতে পেরে নবতারণ গর্জন করে বললেন, “দাঁড়ান মশাই, প্যাঁড়ান! ব্যাপারটা একটু বুঝে নিই। মাধব চৌধুরী হলেন বিজয়পুরের বড়কর্তার জামাই, তার মানে উনি বড় কর্তার মেয়েকে বিয়ে করেছেন। তাহলে উনি হলেন বড়কর্তার ছেলেদের সম্পর্কে শালা।”

বড়বাবু জিব কেটে বললেন, “আজ্ঞে না, উনি সেক্ষেত্রে হবেন ভগ্নীপতি।”

“বললেই হল?”

নবতারণ আবার কটমট করে তাকান। তারপর একটু ভেবেচিন্তে বললেন, “না হয় তাই হল। কিন্তু শালাটা তাহলে কী করে হচ্ছেন?”

বড়বাবু গলা খাকারি দিয়ে বললেন, “ওঁর এক দিদি আবার আমার স্ত্রী কিনা।”

“তাতে কী হল? ওঁর দিদি আপনার স্ত্রী মানে আপনি ওঁর কী হলেন?”

“ভগ্নীপতি।”

“তাহলে শালাটা আসছে কোত্থেকে? এ তো ভারী গোলমেলে ব্যাপার দেখছি।”

“আজ্ঞে, ভগ্নীপতিদের শালা থাকেই।” নবতারণ টাক চুলকোতে-চুলকোতে ডাক দিলেন, “দারোয়াজা!”

গেটের সিপাই দৌড়ে এসে সেলাম দিয়ে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়াল।

নবতারণ হুঙ্কার দিলেন, “তুই কার জামাই?”

“জি, আমি সীতারামপুরের দশরথ ওঝার জামাই।”

“তাহলে তুই কার শালা হলি?”

“আমি কারো শালা-উলা নই।”

“তবে?” নবরণ বড়বাবুর দিকে চাইলেন।

বড়বাবু মাথা চুলকে বললেন, “ব্যাপারটা খুবই গোলমেলে। সবচেয়ে ভাল হয় যদি আপনি নিজের ঘাড়ে ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবেন। মানে ধরুন, আপনি নিশ্চয়ই কারো জামাই, আবার হয়তো কারো শালাও।”

নবতারণ হোঃ হোঃ করে হেসে বললেন, “নিজের পরিবার নিয়ে ভাবি নাকি? মনে করেন কী আমাকে? দিন-রাত চোর-জোচ্চোর ধরে বেড়াব না সারা দিন বসে কে কার শালা আর কে কার জামাই তাই নিয়ে ভাবব? তাছাড়া পারিবারিক সম্পর্কগুলোও ভারী গোলমেলে। আমার স্ত্রীর এক বোনকে তো আমি আমার ননদ বলে ফেলেছিলাম, তাইতে স্ত্রী আমাকে এই মারে কি সেই মারে।” বলে নবতারণ আবার গর্জন করে সেপাইকে বললেন, “এই দরোয়াজা, তোর বোন আছে?”

“আজ্ঞে।”

“তার বিয়ে দিয়েছিস?”

“আজ্ঞে।”

“বোনের স্বামীর কি তুই শালা হলি তবে?”

সেপাইটা এতক্ষণে ফটকে দাঁড়িয়ে সবই শুনেছে? সে দারোগা বাবুকে খুশি করতে খুব দৃঢ় স্বরে বলল, “কক্ষনো নয়।”

নবতারণ বিজয়ীর মতো বড়বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তবে?”

বড়বাবু মাথা চুলকে বললেন, “এক্ষেত্রে সম্বন্ধী হবে।”

নবতারণ আবার হক মারলেন, “দরোয়াজা!”

“আজ্ঞে।”

“তুই কি তোর বোনের স্বামীর সম্বন্ধী?”

দরোয়াজা সে কথার জবাব দিল না, শুধু বিকট একটা ডাইভ মেরে দরজার চৌকাঠ বরাবর লম্বা হয়ে মেঝেয় পড়ে চেঁচাতে লাগল, “আহা হা! লেজটা হাতে পেয়েও রাখতে পারলাম না! আঃ হায় রে! একটুর জন্য হাত ফস্কে বেরিয়ে গেল রে!”

নবতারণ লাফিয়ে উঠলেন, “কী হয়েছে, অ্যাঁ? কী হয়েছে?”

ততক্ষণে থানায় হুলস্থুল পড়ে গেছে, সেপাইরা দৌড়োদৌড়ি শুরু করেছে, কুকুররা তারস্বরে চেঁচাচ্ছে।

শালা সম্বন্ধী জামাই নিয়ে কূটকচালির সময় কাঁক বুঝে ঘটোৎকচ সুট করে কেটে পড়েছে।

পাতুগড়ের আমবাগান নিঃঝুম হয়ে আসার পর বনমালী গাছ থেকে নেমে এসে চারটে টু দিল। টু শুনে আর তিনটে গাছ থেকে তার তিন স্যাঙাত নেমে এল।

বনমালী জিজ্ঞেস করল, “ব্যাপারটা কী রে?”

ফুচুলাল বলল, “আজ্ঞে ঠিক ঠাহর পেলাম না। তবে মনে হল গাছ থেকে মাধববাবু পড়ে গেলেন আর তারপর সেপাইরা ভূত-ভূত বলে চেঁচিয়ে পালাল।”

বনমালী গম্ভীর হয়ে বলল, “এক্ষুনি সব কর্তাকে খুজতে লেগে যাও। খুঁজে বের করতেই হবে। হাঁক-ডাক করতে থাকো, শুনতে পেলে কর্তা সাড়া দেবেন।”

সুতরাং বনমালী আর তার স্যাঙাতরা প্রাণপণে মাধবকে ডাকতে-ডাকতে চারদিকে চলে গেল।

কিন্তু নন্দকিশোরকে গিলে ফেলার কিছুক্ষণ বাদেই মাধবের ভীষণ হাই উঠতে লাগল, গায়ে হাতে আড়মোড়া ভাঙতে লাগলেন। তারপর এই প্রচণ্ড শীতেও গাছতলায় শুয়ে ঢলাঢল ঘুমোতে লাগলেন। সে ঘুম ভাঙায় কার সাধ্যি! আর ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে যে জায়গায় শুয়ে ছিলেন, সেখানে তাকে খুঁজে বের করার সাধ্যিও কারও ছিল না।

ভোরের দিকে আলো যখন একটু ফিকে হয়ে এসেছে, তখন গাছ থেকে জাম্বুবান ঘটোৎকচ তাঁকে দেখতে পেয়ে লাফ দিয়ে নামল, এবং প্রচণ্ড কিচিরমিচির শব্দ করে আল্লাদ প্রকাশ করতে লাগল। কখনো চুল টানে, কখনো চিমটি কাটে, কখনো গা ধরে ঝাঁকায়।

মাধব ধীরে-ধীরে চোখ খুললেন। মাধববাবু টের পাচ্ছিলেন, এই পৃথিবীতে তাঁর আপনজন বলে কেউ নেই। শ্বশুরবাড়ি থেকে বিয়ের রাতে রাগ করে চলে এসেছিলেন। সেই থেকে শ্বশুরবাড়ির কোনো প্রাণীও তাঁর খোঁজ নেয় না। এমনকী, বিয়ে-করা বউও নয়। বড়বাবুর বাড়িতে যত্নেই আছেন বটে, কিন্তু সেও তো ভগ্নীপতির বাড়ি, নিজের বাড়ি তো নয়। নিজের বলতে ছিল হেতমগড়ের প্রাসাদ, তা সেও সরস্বতীর গ্রাসে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এইসব ভেবে মনটা বরাবরই তার একটু বিষণ্ণ থাকে। তার ওপর কাল পুলিসের অত্যাচার এবং ভূতের তাড়নায় আরও সাতন হয়ে পড়েছেন মাধব। এই দুঃসময়ে ঘটোৎকচকে পেয়ে বড় ভাল লাগল। আদর করে গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “প্রাণের টান যাবে কোথায়? দুনিয়ায় এখন তুই ছাড়া আমার আর কেউ নেই।”

ঠিক এই সময়ে বনমালী ঝোঁপঝাড় ভেঙে সামনে হাজির হয়ে এক গাল হেসে বলল, “না, আজ্ঞে, আমরাও আছি।”

মাধব বনমালীকে দেখে অকূলে কূল পেলেন। বললেন, “আঃ, বাঁচালি বাবা বনমালী।”

“বাঁচার এখনো একটু কষ্ট আছে কর্তা। পুলিস বাগান ঘিরে ফেলতে আসছে। আলো ফুটবার আগেই আমাদের নদী পেরিয়ে যেতে হবে। এবার ধরা পড়লে আর রক্ষে নেই। উঠে পড়ন।”

পুলিসের নামে মাধব বাধ্য ছেলের মতো উঠে পড়লেন। বললেন, “চল।”

বর্ষাকালে ভয়ঙ্করী হলেও এই শীতে সরস্বতীর জল খুব কম। বড় বড় বালির চর জেগে উঠেছে। চরের এপাশ-ওপাশ দিয়ে ক্ষীণ জলের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। হাঁটুর বেশি জল কোথাও নেই। কাজেই নদী পেরোতে কারোই কষ্ট হল না। ঘটোৎকচ বনমালীর কাঁধে চেপে দিব্যি আরামে পেরিয়ে গেল। পুলিস যখন বাগান ঘিরে কুকুর ছেড়েছে ততক্ষণে নদীর ওপারের জঙ্গলে অনেকখানি সেঁধিয়ে গেছেন মাধব আর তার দলবল।

আগের দিন বিকেল থেকে কারো খাওয়া নেই। খিদেয় পেট চুই চুই করছে। এই শীতে আম কাঁঠাল না হলেও জঙ্গলে বিস্তর পুতির মতো ছোটো-ছোটো বুনো কুল আর বনকরমচা ফলে আছে। মিষ্টি যেন গুড়। কাটাঝোপে সেঁধিয়ে ঘটোৎকচ ধোপ ধোপ সেইসব ফল ছিঁড়ে আনল। কারোই পেট ভরল না তাতে, তবে পিত্তদমন করা গেল।

বড়-সড় একটা শিমূল গাছের তলায় বসে সবাই জিরিয়ে নিচ্ছে। বনমালী আর তার স্যাঙাতরা জিরিয়ে নিতে গিয়ে ঘাসে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘটোৎকচ গাছে উঠে চৌকি দিতে লাগল। মাধব একা বসে তার জীবনটার কথা ভাবছিলেন। তার ধারণা, বিষয়সম্পত্তি না থাকাতেই কেউ তাঁকে খাতির করে না। ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল।

আর দীর্ঘশ্বাসটার সঙ্গেই বেরিয়ে এল নন্দকিশোর। সেই বিঘত খানেক ধোঁয়াটে চেহারা। তার মধ্যেই চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। খুব বিরক্তির সঙ্গে বললেন, “তুমি চোর নও বটে, কিন্তু খুব ভাল লোকও নও বাপু।”

মাধব ধমক দিয়ে বললেন, “এই আপনার দশ মিনিট?”

“তোমাদের দশ মিনিট আর আমাদের দশ মিনিট তো আর এক নয় বাপু। তাছাড়া ভিতরে বেশ নরম-গরম আবহাওয়া, একটু ঝিমুনিও এসে গিয়েছিল।”

“আমি তখন থেকে ভয়ে মরছি।”

নন্দকিশোর গম্ভীর মুখে বলে, “ভিতরে যা দেখলাম তা কহতব্য নয়। তুমি তো মহা পাজি লোক হে! একেই তো ভয়ঙ্কর রাগী, তার ওপর বাতিকগ্রস্ত, বুদ্ধিটাও বেশ ঘোলাটে, ধৈর্য সহ্য ক্ষমা ইত্যাদি গুণ বলে কিছুই নেই তোমার উন্নতি করার ইচ্ছেও তো দেখলাম না।”

এই সব গা-জ্বালানো কথায় কার না হাড়পিত্তি জ্বলে ওঠে? তদুপরি মাধবের ওপর দিয়ে একটা ঝড়ই তো যাচ্ছে। তিনি তেড়িয়া হয়ে বললেন, “মুখ সামলে কথা বলবেন বলে দিচ্ছি!”

নন্দকিশোর খিক করে হেসে বলল,”কেন, আবার মারবে নাকি?”

গত রাত্রির কথা ভেবে মাধব কিছু ধাতস্থ হয়ে বললেন, “আমার মায়াদয়া নেই একথা ঠিক নয়।”

নন্দকিশোর আবার খিক করে হাসে। তারপর বলে, “সে কথা থাক। তোমার ভিতরে ঢুকে আর-একটা নতুন জিনিস আবিষ্কার করলাম। ফোকলা মুখ দেখে তোমাকে আমি বুড়ো মানুষ ভেবে ছিলাম, ভিতরে গিয়ে দেখলাম তুমি মোটেই বুড়ো নও, তরতাজা জোয়ান। তা দাঁতগুলো এই অল্পবয়সে খোয়ালে কী করে? মাজতে বুঝি। হুঁ, দাঁত ছিলো আমার। তোমার মতো বয়সে খাসির মাথা মুড়মুড় করে চিবিয়ে খেয়েছি, ঠিক যেমনভাবে লোকে মুড়ি খায়।”

মাধব বললেন, “আমার মতো আস্ত সুপুরি চিবিয়ে খেতে হলে বুঝতেন। দাঁতের কেরানি বেরিয়ে যেত।”

“সুপুরি খেলে দাঁত পড়ে যায় এই প্রথম শুনলুম। সে যাকগে, তোমার ভিতরটা আমাকে আরো একটু ভাল করে দেখতে হবে।”

মাধব আঁতকে উঠে বললেন, “আবার ঢুকবেন নাকি?”

“আলবত ঢুকব। তোমার মতো অপদার্থকে মানুষ করতে হলে বিস্তর মেহনত দিতে হয়। তোমার মগজটা তো দেখলাম শুকিয়ে ঝুরঝুরে হয়ে আছে। বুকের মধ্যে যে থলিটাতে সাহসের গুড়ো ভরা থাকে সেই থলিটা দেখলাম চুপসে আছে। অর্থাৎ, যতই তড়পাও, আসলে তুমি অতি কাপুরুষ লোক। চোখের বায়োস্কোপের পর্দাটাও বেশ ময়লা, অর্থাৎ তুমি দিনকানা রাতকানা মানুষ। চোখের সামনের জিনিসটা দেখেও দেখতে পাও না। এত যার অগুণ, তার আবার অত দেমাক কিসের?”

মাধব মিনমিন করে বললেন, “এত সব কথা কেউ আমাকে কোনোদিন বলেনি।”

এইসময় হঠাৎ নন্দকিশোর একটু কেঁপে উঠে বলে, “একটা বিটকেল গন্ধ আসছে কোত্থেকে বলো তো? ভারী বিচ্ছিরি গন্ধ।”

বলতে না-বলতেই হঠাৎ গাছের মগডাল থেকে তরতর করে ঘটোৎকচ নেমে এল আর হুপহাপ করে লাফাতে লাগল।

নন্দকিশোর শিউরে উঠে ওরে বাবা বলে চেঁচিয়ে পলকের মধ্যে মাধবের কানের ভিতরে ঢুকে গেল।

“করেন কী, করেন কী!” বলে চেঁচাতে-চেঁচাতে মাধব কানে আঙুল ঢুকিয়ে বিস্তর খোঁচাখুঁচি করলেন। কিন্তু নন্দকিশোরের আর পাত্তা পাওয়া গেল না। ভারী সুড়সুড় করছিল কানটা।

ঘটোৎকচের লাফালাফিতে বনমালী আর তার স্যাঙাতরা উঠে বসেছে। বনমালীর ইঙ্গিতে টিকটিকি-বিগে-জানা লোকটা নিমেষে একটা শিশুগাছ বেয়ে মগডালে উঠে গেল, আবার সরসর করে নেমে এসে বলল, “ভীষণ বিপদ। অন্তত শ-দুই পুলিস নদী পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকে এদিকে আসছে।”

বনমালী চোখ কপালে তুলে বলে, “বলিস কী? আমাদের মতো ছিচকে চোর ধরতে এত পুলিস। মনে হচ্ছে ব্যাপারটা কিছু গুরুচরণ।”

মাধব ভয়ে কাপছিলেন। কানের মধ্যে নন্দকিশোর, পিছনে নবতারণ। বললেন, “তাহলে?”

বনমালী বলে, “কুছ পরোয়া নেই। এ হল হেতমগড়ের জঙ্গল। এর সব ঝোঁপঝাড়, গর্ত, খানাখন্দ আমাদের নখদর্পণে। এমন জায়গায় গা ঢাকা দেব যে, দশ বছর খুঁজেও পুলিস আমাদের পাত্তা পাবে না।”

সামনের বেলে জমিতে অনেকখানি কাশবন। তারপর আরো গহিন জঙ্গল। কাশবন পেরিয়ে সবাই সেই গহিন জঙ্গলের ধারে পৌঁছে গেল। বনমালী বলল, “কর্তা, একটু হুশিয়ার হয়ে চলবেন।”

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress