রমাপ্রসাদ রায়
হুতোমের পাঠক! আমরা আপনাদের পূর্ব্বেই বলে এসেছি যে, সময় কাহারও হাত ধরা নয়, সময় নদীর জলের ন্যায়, বেশ্যার যৌবনের ন্যায়, জীবনের পরমায়ুর ন্যায়; কারুরই অপেক্ষা করে না। দেখতে দেখতে আমরা বড় হচ্চি, দেখতে দেখতে বছর ফিরে যাচ্চে; কিন্তু আমাদের প্রায় মনে পড়ে না যে, ‘কোন্ দিন যে, মত্তে হবে তার স্থিরতা নাই।’ বরং যত বয়স হচ্চে ততই, জীবিতাশা বশবর্তী হচ্চে; শরীর তোয়াজে রাখচি, আরসি ধরে শোননুটীর মত পাকা গোঁপে কলপ দিচ্চি, সিমলের কালাপেন্ডের বেহ বাহারে বঞ্চিত হতে প্রাণ কেঁদে উঠচে। শরীর ত্রিভঙ্গ হয়ে গিয়েছে, চশমা ভিন্ন দেখতে পাইনে, কিন্তু আশা ও তৃষ্ণা তেমনি রয়েচে, বরং ক্রমে বাড়ছে বই কমছে না। এমন কি, অমর বর পেয়ে প্রকৃতির সঙ্গে চিরজীবী হলেও মনের সাধ মেটে কি না সন্দেহ। প্রচণ্ড রৌদ্রক্লান্ত পথিক অভীষ্ট প্রদেশে শীঘ্র পৌঁছিবার জন্য একমনে হন হন করে চলেছেন, এমন সময় হঠাৎ যদি একটা গেঁড়ি-ভাঙ্গা কেউটে রাস্তায় শুয়ে আছে দেখতে পান, তা হলে তিনি যেমন চমকে ওঠেন, এই সংসারে আমরাও কখন কখন মহাবিপদে ঐ রকম অবস্থায় পড়ে থাকি। তখন এই হৃদয়ের চৈতন্য হয়। উল্লিখিত পথিকের হাতে সে সময় এক গাছ মোটা লাঠি থাকলে তিনি যেমন সাপটাকে মেরে পুনরায় চলতে আরম্ভ করেন, আমরাও মহাবিপদে প্রিয়বন্ধুদের পরামর্শ ও সাহায্যের তরে যেতে পারি; কিন্তু যে হতভাগ্যের এ জগতে বন্ধু বলে আহ্বান করবার একজনও নাই, বিপৎপাতে তার কি দুর্দশাই না হয়। তখন তার এ জগতে ঈশ্বরই একমাত্র অনন্যগতি হয়ে পড়েন। ধৰ্ম্মের এমনি বিশুদ্ধ জ্যোতি-এমনি গম্ভীর ভাব যে, তার প্রভা-প্রভাবে ভয়ে ভণ্ডামো, নাস্তিকতা বজ্জাতি সরে পলায়—চারিদিকে স্বর্গীয় বিশুদ্ধ প্রেমের স্রোত বহিতে থাকে—তখন বিপদসাগর জননীর স্নেহময় কোল হতেও কোমল বোধ হয়। হায়! সেই ধন্য, যে নিজ বিপদ সময়ে এই বিমল আনন্দ উপভোগ করবার অবসর পেয়ে, আপনা আপনি ধন্য ও চরিতার্থ হয়েছে। কারণ, প্রবল আঘাতে একবার পাষাণের মর্ম ভেদ কত্তে পাল্লে চিরকালেও মিলিয়ে যায় না।
ক্রমে ক্রমে আমরাও বড় হয়ে উঠলেম–ছলনা কু-আশায় আবৃত, আশার পরিসরশূন্য, সংসার সাগরের ভয়ানক শব্দ শোনা যেতে লাগলো। একদিন আমরা কতকগুলি সমবয়সী একত্র হয়ে, একটা সামান্য বিষয় নিয়ে তর্কবিতর্ক কচ্চি, এমন সময়ে আমাদের দলের একজন বলে উঠলেন, “আরে আর শুনেছ? রমাপ্রসাদবাবুর মার সপিণ্ডীকরণের বড় ধূম। এক লক্ষ টাকা বরাদ্দ; সহরের সমস্ত দলে, উদিকে কাশী-কৰ্ণাট পর্য্যন্ত পত্র দেওয়া হবে।” ক্রমে আমরা অনেকের মুখেই শ্রাদ্ধের নানা রকম হুজুক শুনতে লাগলেম। রমাপ্রসাদবাবুর বাপ ব্রাহ্মধর্ম্মপ্রচারক, তিনি স্বয়ং ব্রাহ্মসমাজের ট্রাষ্টি; মার সপিণ্ডীকরণে পৌত্তলিকতার দাস হয়ে শ্রাদ্ধ করবেন শুলে কার না কৌতূহল বাড়ে; সুতরাং আমরা শ্রাদ্ধের আনুপূৰ্ব্বিক নক্সা নিতে লাগলো।
ক্রমে সপিগুনের দিন সংক্ষেপ হয়ে আসতে লাগলো। ক্রিয়াবাড়ীতে স্যা্করা বসে গেল–ফলারে বামুনেরা এপ্রেনটিস নিতে লাগলেন—সংস্কৃত কলেজের ফলারের প্রফেসর রকমারী ফলারের লেকচার দিতে আরম্ভ কল্লেন—বৈদিক ছাত্রেরা ভলমনস নোট লিখে ফেল্লেন। এদিকে চতুষ্পাষ্ঠীওয়ালা ভট্টাচার্য্যের চলিত ও অর্দ্ধ পত্র পেতে লাগলেন। অনাহূত চতুষ্পাঠীহীন ভট্টাচার্য্যের সুপারিশ ও নগদ অর্দ্ধ বিদায়ের জন্য রমাপ্রসাদবাবুর বাড়ী, নিমতলা ও কাশী-মিত্তিরের ঘাট হতেও বাড়িয়ে তুল্লেন–সেথায় বা কটা শুকুনি আছে। এঁদের মধ্যে অনেকের চতুষ্পাঠীতে সংবৎসর ষাঁড় হাগে, সরস্বতী পুজার সময়ে ব্রাহ্মণী ও কোলের মেয়েটি বঙ্গদেশীয় ছাত্র সাজেন, সোলার পদ্ম ও রাংতার সাজওয়ালা ক্ষুদে ক্ষুদে মেটে সরস্বতী অধিষ্ঠান হন; জানিত ভদ্দরলোকদের নেলিয়ে দিয়ে কিছু কিছু পেটে।
ভট্টচার্য্যি মশাইদের ছেলেব্যালা যে কদিন আসল সরস্বতীর সঙ্গে সাক্ষাৎ, তারপর এ জন্মে আর তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় না; কেবল সংবচ্ছর অন্তর একদিন মেটে সরস্বতীর সঙ্গে সাক্ষাৎ। সেও কেবল, যৎকিঞ্চিৎ কাঞ্চনমূল্যের জন্য।
পাঠকগণ! এই যে উর্দ্দি ও তকমাওয়ালা বিদ্যালঙ্কার, ন্যায়লঙ্কার, বিদ্যাভূষণ ও বিদ্যাবাচস্পতিদের দেখচেন, এঁরা বড় ফ্যালা যান না। এঁরা পয়সা পেলে না করেন, হ্যান কৰ্ম্মই নাই! সংস্কৃত ভাষা এই মহাপুরুষদের হাতে পড়েই ভেবে ভেবে মিলিয়ে যাচ্চেন। পয়সা দিলে বানরওয়ালা নিজ বানরকে নাচায়, পোষাক পরায়, ছাগলের উপর দাঁড় করায়; কিন্তু এর পয়লা পেলে নিজে বানর পর্য্যন্ত সেজে নাচেন! যত ভয়ানক দুষ্কৰ্ম্ম, এই দলের ভিতর থেকে বেরোবে, দায়মালী জেল তন্ন তন্ন কল্লেও তত পাবে না।
আগামী কল্য সপিণ্ডন। আজকাল হিরে দলপতিদের অনকেই কুলপনা-চক্করের দলে পড়েছেন; নামটা ঢাকের মত, কিন্তু ভিতরটা ফাঁকা!–রমাপ্রসাদবাবু হবে প্রধান উকীল, সাহেব সুবোদের বাবুর প্রতি যেরূপ অনুগ্রহ, তাহাতে আর ও কত কি হয়ে পড়বেন; সুতরাং রমাপ্রসাদবাবু দলস্থ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদিগের পত্র দিলে ফিরিয়ে দেওয়াটাও ভাল হয় না, কিন্তু প্রসাদবাবু ও *** প্রভৃতি নানা প্রকার তর্ক-বির্ক চলতে লাগলো। দুই এক টাটকা দলপতি (জোর কলমে মান-অপমানের ভয় নাই) রমাপ্রসাদবাবুর তোয়াক্কা না রেখে আপন দলে আপন প্রোক্লেমেশন দিলেন, প্রোক্লেমেশন দলস্থ ভট্টাচাৰ্য দলে বিতরণ হতে লাগলো। অনেকে দু নৌকায় পা দিয়ে বিষম বিপদে পড়লেন–শানকীর ইয়ারেরা ‘বারে বারে মুরগী তুমি’ দলে ছিলেন, চিরকাল মুখ পুঁচে চলেচে, এইবার মহাবিপদে পড়তে হলো। সুতরাং মিত্তির খুড়ো লিভ নিয়ে হাওয়া খেতে চান। চাটুয্যে শয্যাগত হয়ে পড়েন। দলপতির প্রোক্লেমেশন জুরির শমন ও সফিনে হতেও ভয়ানক হয়ে পড়লো। সে এই–
“শ্রী শ্রীহরি
শরণং।
অসেস শাস্ত্ররত্নাকরপারবরপরম পূজনীয়—
শ্রীল
ভট্টাচাৰ্য মহাশয়গণ–শ্রীচরণেষু।
সেবক শ্রী * চন্দর দাস ঘোষ ধৰ্ম্ম–
সাষ্টাঙ্গে শত সহস্র প্রণীপাত পুরঃসর নিবেদন কার্য্যাণঞ্চাগে শ্ৰীশ্ৰীভট্টাচার্য্য মহাশয়দিগের আশীর্ব্বাদে এ সেবকের প্রাণগতীক কুসল। পরে যে হেতুক ঁরামমোহন রায়ের পুত্র বাবু রমাপ্রসাদ রায় স্বীয় মাতাঠাকুরাণীর একোর্দ্দিষ্ট শ্রাদ্ধে মহাসমারোহ করিতেছে। এই দলের বিখ্যাত কুলীন ও আমার ভগ্নিপতি বাবু ধিনিকৃষ্ট মিত্ৰজা মজকুর সম্যক প্রতিয়মাণ হইয়া জানিয়াছেন যে উক্ত রায় বাবু সহরের সমস্ত দলেই পত্র দিবেন সুতরাং এ দল ও পত্র পাঠাইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। কিন্তু আমাদের শ্রীশ্রী ঁ সভার দলের অনুগত দলের সহিত রায় মজকুবের আহার ব্যাভার চলিত নাই। সুতরাং তিনি পত্র পাঠাইলেও আপনারা তথায় সভাস্থ হইবেন না।
সম্মতঃ
শ্রীহবীস্বর ন্যায়লঙ্কারোপাধীক
কাব্য সভাপণ্ডিতঃ।
শ্রী * চন্দর দাস ঘোষ।
সাং–নুড়িঘাটা।
প্রক্লেমেশন পেয়ে ভট্টচার্য্যি ও ফলারের ডুব মাল্লেন; কেউ কেউ কন্তু নদীর মত অন্তঃশীলে বইতে লাগলেন; ডুবে জল খেলে শিবের বাবার সাধ্যি নাই যে টের পান; তবুও অনেক জায়গায় চৌকি, থানা ও পাহারা বসে গেল। কিছুতেই কেহ কিছু কোত্তে পাল্লেন না; টাকার খুসবো পাঁজ রসুনের গন্ধ চেকে তুল্লে—শ্ৰাদ্ধসভা পবিত্র হয়ে উঠলো। বাগবাজারের মদনমোহন ও শ্রীপাট খড়দর শ্যামসুন্দর পর্য্যন্ত ব্ৰজের রসে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। শ্রাদ্ধের দিন সকাল বেলা রমাপ্রসাদবাবুর বাড়ী লোকারণ্য হয়ে গেলো গাড়ীবারেণ্ডা থেকে বাবুর্চ্চিখানা পর্য্যন্ত ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের ঠেল ধরলো; এমন কি, শ্রীক্ষেত্রে রথযাত্রায় জগন্নাথের চাঁদমুখ দেখতেও এত লোকারণ্য হয় না।
সপিণ্ডনের দিন সকালে রমাপ্রসাদবাবু বারাণসী গরদের জোড় পরে ভক্তি ও শ্রদ্ধার আধার হয়ে পড়লেন। ব্যালার সঙ্গে সভার জনতা বাড়তে লাগলো। এক দিকে রাজভাটেরা সুর করে বল্লালের গুণগরিমা ও আদিশূরের গুণকীর্ত্তন কত্তে লাগলো; একদিকে ভট্টাচার্য্যদের তর্ক লেগে গেল, দু দশ জন ভেরতমুখো কুলীন-দলপতিরা ভয় ও লজ্জায় সোয়ার হয়ে সভাস্থ হতে লাগলেন। দল দল কেত্তন আরম্ভ হলো, খোলের চাঁটিতে ও হরিবোলের শব্দে ডাইনিং রুমের কাচের গ্লাস ও ডিশের যেন ভয়ে কাঁপতে লাগলো; বৈমাত্রভাই ধূম করে মার শ্রাদ্ধ কচ্চেন দেখে জাতিত্বনিবন্ধন হিংসাতেই ব্ৰহ্মধৰ্ম্ম কাঁদতে লাগলেন; দেখে—আমিবিশন হাসতে লাগলেন।
ক্রমে মাল চন্দন ও দানসামগ্রী উচ্ছুগগু হলে সভঙ্গ হলো। কলকেতার ব্রাহ্মণভোজন দেখতে বেশ—হুজুরেরা আঁতুরের ক্ষুদ মেয়েটিকেও বাড়ীতে রেখে ফলার কত্তে আসেন না—যার যে কটি ছেলেপুলে আছে, ফলারের নি সেগুলি বেরোবে! এক এক জন ফল রিমুখো বামুলকে ক্রিয়বাড়ীতে ঢুকতে দেখলে হঠাৎ বোধ হয়, যেন গুরুমশাই পাঠশালা তুলে চলেছেন। কিন্তু বেরোবার সময় বোধ হয়, এক একটা সর্দার ধোপা,লুচি মোণ্ডার মোটটি একটা গাধায় বইতে পারে না। ব্রাহ্মণরা সিকি, দুয়ানি ও আধুলি দক্ষিণা পেয়ে, বিদেয় হলেন, দই-মাখন এঁটো কলাপাত, ভাঙ্গা খুরী ও আঁবের আঁটীর নীলগিরি হয়ে গেল। মাছিরা ভ্যান ভ্যান করে উড়তে লাগলো—কাক ও কুকুরেরা টাঁকতে লাগলো। সামিয়ানায় হাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং জল সপসপানি ও লুচি, মণ্ডা, দই ও আঁবের চপটে একরকম ভেপ্সো গন্ধ বা মাতিয়ে তুলে–সে?হ্ম ক্রিস্মেবীর ফেরত লোক ভিন্ন অন্যে হঠাৎ আঁচতে পারবেন না।
এদিকে বৈকালে রাস্তায় কাঙ্গালী জমতে লাগলো, যত সন্ধতা হতে লাগলো, তই অন্ধকারের সঙ্গে কাঙ্গালী বাড়তে লাগলো। ভারী, কোনদার, উড়ে ও বেহার, রেয়ো ও গুলিখোরেরা কাঙ্গালীর দলে মিশতে লাগলো, জনতার ও! ও! রো! রো। শব্দে বাড়ী প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। রাত্তির সাতটার সময়ে ক ঙ্গালীদের বিদেয় করবার জন্য প্রতিবাসী ও বড় বড় উঠানওরলি লোকেদের বাড়ী পোরা হলো; শ্রাদ্ধের অধ্যক্ষের থলে থলো সিকি, আধুলি, দুয়ানি ও পয়সা নিয়ে দরজায় দাঁড়ালেন; চলতি মশাল, লণ্ঠন ও ‘আও! অও। রাস্তায় রাস্তায় কাঙ্গালী ডেকে বেড়াতে লাগলো; রাত্তির তিনটে পৰ্যন্ত কাঙ্গালী বিদেয় হলো! প্রায় ত্রিশ হাজার কাঙ্গালী জমেছিলো, এর ভিতর অনেকগুলি গর্ভবতী কাঙ্গালীও ছিল, তারা বিদেয়ের সময় প্রসব হয়ে পড়াতে নম্বরে বিস্তর বাড়ে।
কাঙ্গালী বিদেয়ের দিন দলস্থ নবশাখ, কায়স্থ ও বৈদ্যদের জলপান, ফলারে কেউ ফ্যালা যায় না, বামুন ও রেয়োদর মধ্যে যেমন তুখোড় ফুলারে আছে, কায়েত, নবশাক ও বদ্যিদের মধ্যেও ততোধিক। বরং কতক বিষয়ে এদের কাছে সার্টিফিকেটওয়ালা ফলারের কল্কে পায় না।
সহরের কাবু বাড়ী কোন ক্ৰিয়ে-কৰ্ম্ম উপস্থিত হলে বাড়ীয় ক্ষুদে ক্ষুদে ছেলেরা চাপকান, পায়জামা, টুপি ও পেটি পরে হাতে লাল রুমাল ঝুলিয়ে ঠিক যাত্রার নকীব সেজে, দলস্থ ও আত্মীয় কুটুম্বদের নেমস্তোর কত্তে বেরোন। এর মধ্যে বড় মানুষ বা শাসে-জলে হলে সঙ্গে পেশাদার নেমুন্তন্নে বামুন থাকে। অনেকের বাড়ীর সরকার বা দাদাঠাকুর গোছর পূজারী বামুনেও চলে। নেমন্তন্নে বামুন বা সরকার রামগোছের এক ফর্দ হাতে করে, কানে উডেন পেন্সিল গুঁজে পান চিবুতে চিবুতে নেমেন্তোনো বেরে যান—ছেলেটি কেবল “টু, কাপির” সইয়ের মতন সঙ্গে থাকে।
আজকাল ইংরিজি কেতার প্রাদুর্ভাবে অনেকে সাপ্টা ফলার বা জোজে যেতে “লাইক” করেন না! কেউ ছেলে পুলে পাঠিয়ে সারেন, কেউ স্বয়ং বাগানে যাবার সময়ে ক্রিয়েবাড়ী হয়ে বেড়িয়ে যান। কিছু আহার কত্তে অনুরোধ কল্লে, ভয়ানক রোগের ভাণ করে কাটিয়ে দ্যান; অথচ বাড়ীতে এক ঝোড়া কুম্ভকর্ণের আহার তল পেয়ে যায়–হাতিশালের হাতী ও ঘোড়াশালের ঘোড়া খেয়ে ও পেট ভরে না।
পাঠক! আমরা প্রকৃত ফলার দাম। লোহার সঙ্গে চুম্বকপাথরের যে সম্পর্ক, আমাদের সহিত লুচিরও সেইরূপ। তোমার বাড়ীতে ফলারটা আসটা জলে অনুগ্রহ করে আমাদের ভুলে না; আমরা মুনকে রঘুর ভাই। ফুলারের নাম শুনে, আমরা নরক ও জেলে পৰ্যন্ত যাই। সেবার মৌলুবী হালুম হোসেন খাঁ বাহাদুরের ছেলের সুন্নতে ফলার করে এসেছি। হিন্দুধৰ্ম্ম ছাড়া কাণ্ড বিধবা-বিয়েতে ৪ পাত পাতা গিয়েছে। আর কলকেতার ব্রাহ্মসমাজের জন্মতিথি উপলক্ষে ১১ই মাঘ পোপ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর দি ফাষ্টের বাড়ীতে যে বছর বছর একটা অনুক্ষেত্তর হয়, তাতেও প্রসাদ পেয়েচি। লল কথা ঐ ব্রাহ্মভোজের দিন ঠাকুরবাবুর মাঠের মত চণ্ডীমণ্ডপে ব্রাহ্ম ধরে না, কিন্তু প্রতি বুধবারে উপাসনার সময়ে সমাজে ন দশ বারোকে চক্ষু বুজে ঘাড় নাড়তে ও সুর করে সংস্কৃত মজিয়া পড়তে দেখতে পাই। বাকিরা কোথায়? তারা বোধ হয় পোষাকী ব্রাহ্ম। না আমাদের মত যজ্ঞির বিড়াল?
এ সওয়ায় আমাদের ফলারের বিস্তর ডিপ্লোমা ও সার্টিফিকেট আছে; যদি ইউনিভার্সিটিতে বি এ, ও বিএলের মত ফলারের ডিগ্রী স্থির হয়, তা হলে, আমরা তার প্রথম ক্যান্ডিডেট।
রমাপ্রসাদবাবুর মার সপিণ্ডনের জলপানে আড়ম্বর খিলক্ষণ হয়েছিল—উপচারও উত্তম রকম অহরণ হয়। সহরের জলপান দেখতে বড় মন্দ নয়; এক তো মধ্যাহ্নভোজন বা জলপান রাত্তির দুই প্রহর পর্য্যন্ত ঠেল মারে; তাতে নানা রকম জানোয়ারের একত্রে সমাগম। যারা আহার কত্তে বসেন, সেগুলির পা, প্রথম ঘোড়ার মত লাল বাঁধান বোধ হবে; ক্রমে সমীচীনরূপে দেখলে বুঝতে পারবেন যে, কর্ম্মকর্ত্তা ও ফলারের সঙ্গীদের প্রতি এমনি বিশ্বাস যে জুতো জোড়াটি খুলে খেতে বসতে ভরসা হয় না।
শেষে কায়স্থের ভোজ মগডম্বরে সম্পন্ন হলো। কুলীনেরা পর্য্যায় মত রুই মাছের মুড়ো মুণ্ডী পেলেন—এক একটা আধবুড়ো আফিমখোর কুলীনের মাছের বুড়ো চিবানো দেখে ক্ষুদে ক্ষুদে ছেলেরা ভয় পেতে লাগলো। এক এক সুনের পাত গো-ভাগারকে হারিয়ে দিলে! এই প্রকারে প্রায় পেনের দিন সমারোহের পর রমাপ্রসাদের মার সপিণ্ডনের ধুম চুলো-হুজুকদারেরা জিরতে লাগলেন!
যে সকল মহাপুরুষ দলপতিরা সভাস্থ হন নাই, তারা আপনার আপনার দলে ঘোঁট পাড়িয়ে দিলেন–অনেক ভট্টাচাৰ্য বিদেয় নিয়ে ফলার মেরে এসেও শেষে শ্ৰীশ্ৰী ঁধৰ্ম্মসভার উমেদার প্রপৌত্রদের দলের দলপতির কাছে গঙ্গাজল ছুঁয়ে শলিগেরামে সান্নে দিব্বি কোত্তে লাগলেন যে, তিনি অ্যাদ্দিন শহরে আচেন, কিন্তু রমাপ্রসাদ রায় যে কে, তাও তিনি জানেন না; তিনি শুদ্ধ বাবুকেই জানেন। আর তার ঠাকুর (স্বর্গীয় তর্কবাচস্পতি খুড়ো) মরবার সময়ে বলে গিয়েছেন যে, “ধৰ্ম্ম অবতার! আপনার মত লোক অর জগতে নাই।” এ সওয়ায় অনেক শূন্য-উপাধিধারী হজুরেরা ধরা পড়লেন, গোবর খেলেন, শ্রীবিষ্ণু স্মরণ কল্লেন ও ভুরু কামালেন।
কলকেতার প্রথম বিধবা বিবাহের দিন, বালি, উতেরপাড়া, অশ্বিকে ও রাজপুর অঞ্চলের বিস্তর ভট্টাচাৰ্য্য সভাস্থ হন—ফলার ও বিদেয় মাবেন। তার পর ক্রমে গা-ঢাকা হতে আরম্ভ হন; অনেকে গোবর খান, অনেকে সভাস্থ হয়েও বলে, আমি সের্দিন শয্যাগত ছিলাম।
যতদিন এই মহাপুরুষদের প্রাদুর্ভাব থাক্বে, তত দিন বাঙ্গালীর ভদ্রস্থ নাই; গোঁসাইরা হাড়ি মুচি মুফরাস নিয়ে বেঁচে আছেন; এই মহাপুরুষের গোটকক হতভাগা গোমূখ কায়স্থ ব্রাহ্মণ দলপতির জোরে আজও টিকে আছেন, এরা এক এক জন হারামজাদকী ও বজ্জাতীর প্রতিমূর্ত্তি, এদিকে এমনি সজ্জা গজ্জা করে বেড়া যে, হঠাৎ কার সাধ্যি, অন্তরে প্রবেশ করে, হঠাৎ দেখলে বোধ হয়, অতি নিরীহ ভদ্রলোক; বাস্তবিক সে কেবল ভড়ং ও ভণ্ডামম!