লালা রাজাদের বাড়ী দাঙ্গা
আমরা স্কুলে আর এক কেলাস উঠলেম। রাধুনি বামুন পণ্ডিতের হাত এড়ানো গেল। একদিন আমরা পড়া বলতে না পারায় জল খাবার ছুটীর সময়ে গাধার টুপী মাথার দিয়ে, বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে কন্ফাইন্ হয়ে রয়েছি, মাষ্টার মশাই তামাক খাবার ঘরে জল খেতে গেছেন (তাঁর ক্ষিদে বরদাস্ত হয় না, কিন্তু ছেলেদের হয়); একজন বামুন বাবুদের বাড়ীর ছোটবাবুর মুখে শ্যামা পাখীর বোল—“বক্ বকম্ বক বকম্” করে পায়রার ডাক ডেকে বেড়াচ্চেন ও পনি টাট্টু সেজে কদম দেখাচ্ছেন; এমন সময়ে কাশীপুর অঞ্চলের একজন ছোকরা বল্লে, “কাল বৈকালে পাকপাড়ায় লালাবাবুদের (শ্রী বিষ্ণু! আজকাল রাজা) লালা রাজাদের বাড়ী—এক দল গোরা মাতাল হয়ে এসে চার-পাঁচ জন দারোয়ানকে বর্শায় বিঁধে গিয়েছে, রাজারা ভয়ে হাসন হোসেনের মত একটা পুরোণো পাতকোর ভিতর লুকিয়ে প্রাণরক্ষা করেছেন।” (বোধ হয় কেবল গিরগিটের অপ্রতুল ছিল)। আর একজন ছোকরা বলে উঠলো “আরে তা নয়, আমরা দাদার কাছে শুনেছি, রাজাদের বাড়ীর সামনের গাছে একটা কাগ মেরেছিল বলে রাজাদের জমাদার, সাহেবদের মাত্তে এসে”; আর একজন ছোকরা দাঁড়িয়ে উঠে আমাদের মুখের কাছে হাত নেড়ে বল্লে, “আ রে না হে না, ও সব বাজে কথা! আমারও বাড়ী টালাতে, রাজাদের বাড়ীর পেছনে যে সেই বড় পগারটা আছে জান? তার পাশে যে পচা পুকুর সেই আমাদের খিড়কি। রাজাদের এক জন আমলার ভাই ঠিক বানরের মত মুখ; তাই দেখে একজন সাহেব ভেংচে ছিল, তাতে আমলাও ভেংচায়; তাতেই সাহেবরা বন্দুক পিস্তল নিয়ে দলবল সমেত এসে গুলী করে”। এইরূপে অনেক রকম কথা চলেছে, এমন সময়ে মাষ্টার বাবু তামাক খাবার ঘর থেকে এলেন, ছোটবাবুর পনি টাটুর কদম ও ‘বক বকম্’ বন্ধ হয়ে গেল, রাজারা বাঁচলেন—ঢং ঢং করে দুটো বাজলে কেলাস বসে গেল, আমরাও জল খেতে ছুটী পেলেম। আমরা বাড়ী গিয়ে রাজাদের ব্যাপার অনেকের কাছে আরও ভয়ানক রকম শুনলেম; বাঙ্গালা কাগজওয়ালারা, “এক দল গোরা বাজনা বাজিয়ে যাইতেছিল, দলের মধ্যে একজনের জলতৃষ্ণা পেয়েছিল, রাজাদের বাড়ী যেমন জল খেতে যাবে, জমাদার গলা ধাক্কা মারিয়া বাহির করিয়া দেয়, তাহাতে সঙ্গের কর্ণেল গুলী কত্তে হুকুম দেন” প্রভৃতি নানা আজগুবী কথায় কাগজ পোড়াতে লাগলেন। সহরের পূর্ব্বের বাঙ্গালা খবরের কাগজ বড় চমৎকার ছিল, ‘অমুক বাবুর মত দাতা কে!” “অমুক বাবুর মার শ্রাদ্ধে জোর টাকা ব্যয়, (বাবু মুচ্ছুদী মাত্র); “অমুক মাতাল জলে ডুবে মরে গেচে” “অমুক বেশ্রার নত খোয়া গিয়েছে, সন্ধান করে দিতে পাল্লে সম্পাদক তার পুরস্কারস্বরূপ তারে নিজ সহকারী করবেন” প্রভৃতি আল্ত কথাতেই পত্র পুরুতেন; কেউ গাল দিয়ে পয়সা আদায় কত্তেন, কেউ পয়সার প্রত্যাশায় প্রশংসা কত্তেন;–আজকালও অনেক কাগজে চোর গোপ্তান চলে!
শেষে সঠিক শোনা গেল যে, এক জন দরওয়ানকে এক জন ফিরিঙ্গি শিকারী বাকবিতণ্ডায় ঝকড়া করে গুলী করে।
কৃশ্চানি হুজুক
পাক্পাড়ার রাজাদের হাঙ্গামা চুকতে চুকতে হুজুর উঠলো, “রণজিৎসিংহের পুত্র দলিপ–ইসুমন্ত্রে দীক্ষিত হয়েচেন; তাঁর সঙ্গে সমুদায় শিকেরা কৃষ্ণান হয়েচেন ও ভাটপাড়ার জনকতক ঠাকুরও কৃশ্চান হবেন!” ভাটপাড়ার গুরুগুষ্টিরে প্রকৃত হিন্দু; তাঁরা কৃশ্চান হবেন শুনে, অনেকে চমকে উঠলেন, শেষে ভাটপাড়ার বদলে পাতুরেঘাটার শ্রীযুক্তবাবু প্রসন্নকুমার ঠাকুরের পুত্র বাবু জ্ঞানেন্দ্রমোহন বেরিয়ে পড়লেন। সমধৰ্ম্মা কৃষ্ণমোহন কন্যা উচ্ছুগ্গু করে দিলেন, এয়োরও অভাব রইলো না। সহরে যখন যে পড়ত পড়ে, শীগগির তার শেষ হয় না; সেই হিড়িকে একজন স্কুলমাষ্টার, কালীঘেটে হালদার, একজন বেণে ও কায়স্থ কৃশান দলে বাড়লো–দু-চার জন বড় বড় ঘরের মেয়েমানুষও অন্ধকার থেকে আলোয় এলেন। শেষে অনেকের চালফুঁড়ে আলো বেরতে লাগলো, কেউ বিষয়ে বঞ্চিত হলে, কেউ কেউ অনুতাপ ও দুরবস্থার সেবা কত্তে লাগলেন। কৃশ্চানি হুজুক রাস্তার চলতি লণ্ঠনের মত প্রথমে আসপাশ আলো করে শেষে অন্ধকার করে চলে গেল। আমরাও ক্রমে বড় হয়ে উঠলেম–স্কুল আর ভাল লাগে না!
মিউটীনি
পাঠকগণ! একদিন আমরা মিছেমিছি ঘুরে বেড়াচ্চি, এমন সময় শুনলেম, পশ্চিমের সেপাইরে খেপে উঠেচে, নানা সাহেবকে চাঁই করে ইংরেজদের রাজত্ব নেবে, দিল্লীর ন্যেড়ে চীফ আবার “দিল্লীশ্বরো বা জগদীশ্বরো বা” হবেন ভারি বিপদ! সহরে ক্রমে হুলস্থুল পড়ে গেল, চুনোগলি ও কসাইটোলার মেটে ইদ্রুস পিদ্রু স, গমিস ডিস প্রভৃতি ফিরিঙ্গিরে খাবার লোভে ভলিনটিয়ার হলেন, মাথালো মাথালো বাড়ীতে গোরা পাহারা বসলো, নানা রকম অদ্ভুত হুজুক উঠতে লাগল—আজ দিল্লী গেল—কাল কানপুর হারানো হলো, ক্রমে পাশাখেলার হার কেতের মত ইংরাজেরা উত্তরপশ্চিমের প্রায় সমুদয় অংশেই বেদখল হলেন—বিবি, ক্ষুদে ক্ষুদে ছেলে ও মেয়েরা মারা গেল, ‘শ্রীবৃদ্ধিকারী’ সাহেবেরা (হিন্দু দেবতা পঞ্চানন্দের মত) বড় ছেলের কিছু কত্তে পাল্লেন না, ছোট ছেলের ঘাড় ভাঙ্গবার উজ্জুগ পেলেন–সেপাইদের রাগ বাঙ্গালীর উপর ঝাড়তে লাগলেন। লর্ড ক্যানিংকে বাঙ্গালীদের অস্ত্র-শস্ত্র (বঁটি ও কাঁটারিমাত্র) কেড়ে নিতে অনুরোধ কল্লেন! বাঙ্গালীরা বড় বড় রাজকৰ্ম্ম না পায়, তারও তদ্বির হতে লাগলো; ডাকঘরের কতকগুলি নেড়ে প্যায়দার অন্ন গেল, নীলকরেরা অনরেরী মেজেষ্টর হয়ে মিউটীনি উপলক্ষ করে (চোর চায় ভাঙ্গা ব্যাড়া) দাদন, গাদন ও শ্যামচাঁদ খেলাতে লাগলেন। শ্যামচাঁদ সামান্নি নন, তাঁর কাছে আইন এগুতে পারে না—সেপাইতো কোন ছার। লক্ষ্ণৌয়ের বাদশাকে কেল্লায় পোরা হলো, গোরারা সময় পেয়ে দু-চার বড় বড় ঘরে লুটতরাজ অরম্ভ কল্লে, মার্শাল ল জারি হলো, যে ছাপা যন্ত্রের কল্যাণে হুতোম নির্ভয়ে এত কথা অক্লেশে কইতে পাচ্ছেন, সে ছাপা-যন্ত্র কি রাজা, কি প্রজা, কি সেপাই পাহারা–কি খেলার ঘর, সকলকে একরকম দেখে, ব্রিটিশকলের সেই চিরপরিচিত ছাপা-যন্ত্রের স্বাধীনতা মিউটীনি উপলক্ষে, কিছুকাল শিকলি পরলেন। বাঙ্গালীরে ক্রমে বেগতিক দেখে গোপাল মল্লিকের বাড়ীতে সভা করে, সাহেবদের বুঝিয়ে দিলেন যে–“যদিও একশ বছর হয়ে গেল, তবু তারা আজও সেই হতভাগা ম্যাড়া বাঙ্গালীই আছেন—বহু দিন ব্রিটিশ সহবাসে, ব্রিটিশ শিক্ষায় ও ব্যবহারে আমেরিকানদের মত হতে পারেন নি। (পারবেন কি না তারও বড় সন্দেহ)। তাঁদের বড়মানুষদের মধ্যে অনেকে তুফানের ভয়ে গঙ্গায় নৌকো চড়েন না—রাত্তিরে প্রস্রাব কৰ্তে উঠতে হলে স্ত্রীর বা চাকর চাকরাণীর হাত ধরে ঘরের বাইরে যান, অন্দরের মধ্যে টেবিল ও পেননাইফ ব্যবহার করে থাকেন; যাঁরা আপনার ছায়া দেখে ভয় পান–তাঁরা যে লড়াই করবেন, এ কথা নিতান্ত অসম্ভব। বলতে কি, কেবল আহার ও গুটিকতক বাছালো বাছালো আচারে তাঁরা ইংরাজদের স্কেচমাত্র করে নিয়েছেন। যদি গভর্ণমেন্টের হুকুম হয়, তা হলে সেগুলিও চেয়ে পরা কাপড়ের মত এখনই ফিরিয়ে দেন—রায় মহাশয়ের মগ বার্চ্চিকে জবাব দেওয়া হয়—বিলিতী বাবুরা ফিরতি ফলারে বসেন ও ঘোষজা গাঁজা ধরেন, আর বাগাম্বর মিত্র বনাতের প্যাণ্টুলন ও বিলিতী বদমাইসি থেকে স্বতন্ত্র হন।
ইংরাজের মাগ, ছেলে ও স্বজাতির শোকে একেবারে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন, সুতরাং তাতেও ঠাণ্ডা হলেন না–লর্ড ক্যানিংয়ের রিকলের জন্য পার্লিয়ামেণ্টে দরখাস্ত কল্লেন, সহরে হুজুকের একশেষ হয়ে গেল। বিলেত থেকে জাহাজ জাহাজ গোরা আসতে লাগলো—সেই সময়ে বাজারে এই গান উঠলো–
গান
“বিলাত থেকে এলো গোরা,
মাথার পর কুরতি পরা,
পদভরে কাঁপে ধরা, হাইল্যাণ্ডনিবাসী তারা।
টামটিয়া টোপীর মান
হবে এবে খর্ব্বমান,
সুখে দিল্লী দখল হবে,
নানা সাহেব পড়বে ধরা॥”
বাঙ্গালী ঝোপ বুঝে কোপ ফেলতে বড় পটু; খাঁটি হিন্দু (অনেকেই দিনের বেলার খাঁটি হিন্দু) দলে রটিয়ে দিলে যে, “বিধবাবিবাহের আইনই পাশ ও বিধবাবিবাহ হওয়াতেই সেপাইরে খেপেচে। গবর্ণমেণ্ট বিধবাবিবাহের আইন তুলে দিয়েছেন—বিদ্যাসাগরের কৰ্ম্ম গিয়েছে—প্রথম বিধবাবিবাহের বর শিরিশের ফাঁসি হবে।”
কোথাও হুজুক উঠলো, “দলিপ সিংকে কৃশ্চান করাতে, নাগপুরের রাণীদের স্ত্রীধন কেড়ে নেওয়াতে ও লক্ষ্ণৌয়ের বাদশাই যাওয়াতে মিউটীনি হলো।”
নানা মুনির নানা মত! কেউ বল্লেন, সাহেবেরা হিন্দুর ধৰ্ম্মে হাত দেন, তাতেই এই মিউটীনি হয়েচে। তারকেশ্বরের মোহেন্তের রক্ষিতা, কাশীর বিশ্বেশ্বরের পাণ্ডার স্ত্রী ও কালীঘাটের বড় হালদারের বাড়ীর গিন্নীরে স্বপ্নে দেখেচেন, ইংরেজদের রাজত্ব থাকবে না! দুই এক জন ভটচাৰ্য্যি ভবিষ্যৎ পুরান খুলে তারই নজর দেখালেন!
ক্রমে সেপাইয়ের হুজুকের বাড়তি কমে গ্যালো–আজ দিল্লী দখল হলো–নানা পালালেন–জং বাহাদুরের সাহায্যে লক্ষ্ণৌ পাওয়া হলো। মিউটীনি প্রায় সমুদায় সেপাইরে ফাঁসিতে, তোপেতে ও তলওয়ারের মুখেতে শেষ হোলেন—অবশিষ্টেরা ক্যানিংয়ের পলিসিতে ক্ষমা প্রার্থনা করে বেঁচে গ্যালেন।
ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী পুরোণো বছরের মত বিদেয় হলেন—কুইন স্বরাজ্য খাস প্রক্লেম কল্লেন; বাজী, তোপ ও আলোর সঙ্গে মায়াবিনী আশা ‘কুইনের খাসে প্রজার দুঃখ রবে না’ বাড়ী বাড়ী গেয়ে বেড়াতে লাগলেন; গর্ভবতীর যত দিন একটা না হয়ে যায়, তত দিন যেমন ‘ছেলে কি মেয়ে’ লোকের মনে সংশয় থাকে, সংসার কুইনের প্রোক্লেমেশনে সেইরূপ অবস্থায় স্থাপিত হলো।
মিউটীনির হুজুক শেষ হলো–বাঙ্গালীর ফাঁসী-ছেঁড়া অপরাধীর মত সে যাত্রা প্রাণে প্রাণে মান বাঁচালেন; কারু নিরপরাধে প্রাণদণ্ড হলো, কেউ অপরাধী থেকেও জায়গীর পেলেন। অনেক বামুনে-কপাল ফলে উঠলো; যখন যার কপাল ধরে—ইত্যাদি কথার সার্থকতা হলো। রোগ, শোক ও বিপদে যেমন লোকে পতিগত স্ত্রীর মুল্য জানতে পারে, সেইরূপ মিউটীনির উপলক্ষে গবর্ণমেণ্টও বাঙ্গালী শব্দের কথঞ্চিৎ পদার্থ জানতে অবসর পেলেন; ‘শ্রীবৃদ্ধিকারীরা’ আশা ও মানভঙ্গে অন্তরে বিষম জ্বালায় জ্বলিতেছিলেন, এক্ষণে পোড়া চক্ষে বাঙ্গালীদের দেখতে লাগলেন–আমরাও স্কুল ছাড়লেম। আঃ! বাঁচলেম—গায়ে বাতাস লাগলো।