রাত সাড়ে দশটা নাগাদ
রাত সাড়ে দশটা নাগাদও যখন বাড়িতে কেউ ঘুমোতে গেল না, তখন রতন বাঁড়ুজ্যে তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সবাইকে ডেকে বললেন, “তোমরা যে যার ঘরে গিয়ে দোর দিয়ে শুয়ে পড়ো। সাড়াশব্দ কোরো না। সব বাতি নিবিয়ে দাও। আজ রাতে আমার কাছে বিশেষ দু’জন অতিথি আসবে, তাদের সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে। তা ছাড়া আর একজন বিশেষ অতিথি বাড়িতে আছেন, তিনি যেন ঘুণাক্ষরেও কিছু টের পান।”
রতন বাঁড়ুজ্যের আদেশ অমান্য করার সাধ্য কারও নেই। সকলেই ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল।
আস্তে-আস্তে অমাবস্যার রাত গম্ভীর হতে লাগল। নিজের ঘরে রতন বাঁড়ুজ্যে আর পাঁচু জেগে অপেক্ষা করতে লাগল।
রাত একটু গাঢ় হল, অন্ধকার আরও ঘুটঘুটি। শেয়াল, এক প্রহরের জানান দিল। রতন বাঁড়ুজ্যের বাড়ির বাগানে কোনও নড়াচড়া নেই কোথাও। শুধু জোনাকি জ্বলে আর ঝিঝি ডাকে অবিরাম।
হঠাৎ আমবাগানের দিক থেকে বেড়ালের মতো একটা ছায়া লাফিয়ে উঠল দেয়ালের ওপর। তারপর আরও একজন। দেয়ালের ওপর উঠে কিছুক্ষণ নিস্পন্দ রইল দুটি ছায়া। চারদিকটা ভাল করে অনুভব করে নিল। তারপর নিঃশব্দে ঝুল খেয়ে নেমে পড়ল বাগানে।
কুকুরটার ডেকে ওঠার কথা। ডাকল না। তেড়েও এল না।
দু’জনে গাছপালার ফাঁক দিয়ে নিঃশব্দে এগোতে লাগল।
উত্তরের ঘরের জানালা খোলা। জানালার নীচে কলাবতীর মস্ত-মস্ত ঝোঁপ। দুটি ছায়া নিঃসাড়ে সেই ঝোঁপের মধ্যে ডুবে গেল।
একটু বাদে অত্যন্ত আস্তে একজন মাথা তুলল। কান পেতে শুনল, ঘরের মধ্যে খাসের আওয়াজ কীরকম হচ্ছে। ঘুমন্ত মানুষের স্বাসের আওয়াজ অন্যরকম হয়।
নিশ্চিন্ত হয়ে লোকটা একটা স্প্রে-গান তুলে ঘরের মধ্যে তীব্র ঘুমের ওষুধ ছড়িয়ে দিল। শ্বাসের শব্দ আস্তে-আস্তে আরও. গাঢ় হয়ে গেল।
জানালায় লোহার শিক, এবং তা বেশ মজবুত। স্প্রে-গান ঝোলার মধ্যে রেখে লোকটা একটা অ্যাসিডের শিশি বের করে দুটো শিকের গোড়ায় ঢেলে দিল একটু-একটু করে। কয়েক মিনিট পর দ্বিতীয় লোকটা দু’হাতের চাপে দুটো শিক দু’দিকে সরিয়ে অনেকটা ফাঁক করে ফেলল।
নিঃশব্দে ঘরে ঢুকল দুজন। একজন একটা কমজোরি টর্চ জ্বেলে বিছানায় আলো ফেলল। বলল, “ওই তো।”
অন্যজন একটু ঝুঁকে গন্ধর্বের আঙুল থেকে আংটিটা খুলে নিল। চোখের পলকে সেটা ট্যাঁকে খুঁজে সে ঘরের অন্যান্য জিনিসে মন দিল।
ঘরে খুব বেশি কিছু নেই। একটা কাঁসার গ্লাসে জল ঢাকা ছিল। সেটা ঝোলায় পুরল লোকটা।
দ্বিতীয়জন কোমর থেকে একটা ভোজালি বের করে বলল, “বলিস তো এবার খুনটা করে ফেলি।”
ষষ্ঠী চাপা গলায় বলল, “থাকগে, যেতে দাও।”
“তার মানে?”
“চুরি এক জিনিস, খুন অন্য। খুনের আর কোনও দরকারও নেই। আসল জিনিস পেয়ে গেছি।”
“কিন্তু আমার টাকাটা?”
ষষ্ঠী মৃদু একটু হেসে চাপা স্বরে বলল, “পাবে। ও সামান্য টাকা তোমার মারব না। এখন চলো, জায়গামতো জিনিসটা পৌঁছে দিতে হবে।”
দ্বিতীয় লোকটা আর আপত্তি করল না। দু’জনে আবার জানালা দিয়ে বেরিয়ে বাগান পেরিয়ে দেয়াল ডিঙিয়ে বাইরে চলে এল।
ষষ্ঠী হঠাৎ বলল, “কুকুরটা ডাকল না কেন বলো তো! তাজ্জব!”
টিকে বলল, “সেটাই ভাবছিলাম। ওরকম বদমেজাজি কুকুর একদম চুপ মেরে রইল?”
দু’জনে আমবাগানের ছায়ায় গা ঢাকা দিয়ে হেঁটে বাঁশবনের অন্ধকারে ঢুকল। এ-পথে শর্টকাট হয়, রাস্তাও নিরাপদ।
বাঁশবনে একটু গভীরে ঢুকেই টিকে ডাকল, “ষষ্ঠী।”
“চলো টিকেদা।”
“আংটিটা দে।”
“আংটি! আংটি তোমাকে দেব কেন? ও তো বখরার মাল নয়। তোমাকে থোক টাকা দেব বলেছি, ঠিক দেব।”
“আংটি বখরার জিনিস নয় কে বলল? আলবাত বখরার জিনিস। দে।”
ষষ্ঠী দু’পা পিছিয়ে গিয়ে হিংস্র গলায় বলল, “না।”
টিকে এক হাতে ষষ্ঠীর গলাটা টিপে ঘরে অন্য হাতে তাকে একটা পাঁচ কিলো ওজনের চড় কষাল। তারপর তার ট্যাঁক থেকে আংটিটা খুলে নিয়ে নিজের ট্যাঁকে রেখে বলল, “এবার চল।”
ষষ্ঠী আর গাঁইগুঁই করল না। গালে হাত বোলাতে-বোলাতে টিকের পিছু-পিছু হাঁটতে লাগল।
কালী স্যাকরা জেগে বসে থাকবে, এরকম কথা ছিল। আংটিটা পেলেই সে হিরে খুলে নিয়ে সোনা গলিয়ে ফেলবে।
কিন্তু কার্যত দেখা গেল, কালী স্যাকরা জেগে নেই। ঘর অন্ধকার, দরজাও বন্ধ।
ষষ্ঠী আর টিকে চাপা স্বরে ডাকল, “কালীদা! ও কালীদা!” জবাব নেই। ষষ্ঠী দরজায় ধাক্কা দিল। অমনি কপাট খুলে গেল ঝড়াত করে। ভিতরে ঢুকে দৃশ্য দেখে দুজনেই হাঁ। কালী স্যাকরা উপুড় হয়ে পড়ে আছে। তার সিন্দুক খোলা, আলমারি হাঁ-হাঁ করছে। কী হয়েছে তা বুঝতে দু’জনের এক লহমা লাগল।
মুখে-চোখে জলের ছিটে দিতেই কালী স্যাকরা অবশ্য চোখ মেলল। ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, “ষষ্ঠী, তোর মনে কি এই ছিল রে?”
ষষ্ঠী বিরক্ত হয়ে বলল, “কী হয়েছে বলবে তো?”
“হওয়ার আর বাকি কী রাখলি বাপ? চেয়ে দ্যাখ, আমার এতকাল ধরে তিল তিল করে জমানো টাকা-পয়সা সোনা-দানা সব পাঁচ মিনিটের মধ্যে লোপাট।”
টিকে ধমক দিয়ে বলল, “কী করে লোপাট হল সেটা বলো।”
কাঁদতে কাঁদতে কালী স্যাকরা বলল, “মিনিট দশ-পনেরো আগে ষষ্ঠীর গলা শুনলুম বাইরে থেকে কালীদা, কালীদা’ করে ডাকছে।
উঠে দরজা খুলে দিতেই একটা লোক ঘরে ঢুকে পড়ল। টু শব্দটি করার সময় পেলাম না, একটা রদ্দা বসিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। তারপর আর কিছু মনে নেই। উঠে দেখছি সব ফসা।”
টিকে ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে বলল, “ষষ্ঠী লোকটা যে এক নম্বরের বদমাশ সেটা কে না জানে। সুযোগ পেলে নিজের মায়ের গয়নাও ও চুরি করবে। কিন্তু কালীদা, গত দু’ঘন্টায় ষষ্ঠী তোমার দোকানে আসেনি। কারণ ও আমার সঙ্গে ছিল।”
কালী স্যাকরা নিজের কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলল, “তা হলে সে ষষ্ঠীরই মাসতুতো ভাই হবে। কিন্তু আমি যে ধনেপ্রাণে গেলুম রে!”
ষষ্ঠী হঠাৎ বলল, “না, একেবারে যাওনি। সেই আংটিটা পাওয়া গেছে। যা চুরি গেল, তা সুদে-আসলে তুলে নিতে পারবে।”
দিশেহারা হয়ে কালী স্যাকরা বলল, “আংটি! কই, দেখি!” টিকে ট্যাঁকে হাত রেখে বলল, “কিন্তু ভাগ-বাঁটোয়ারা কেমন হবে সেটা আগে শুনি।”
কালী বলল, “কত চাস?”
“পঞ্চাশ হাজার।”
“ও বাবা, বলিস কী রে ডাকাত? আমার কত গেছে জানিস? লাখ টাকার ওপর। তার ওপর চারশো টাকা আজ সন্ধেতেই ছেলেটার হাতে গুনে দিয়েছি।”
টিকে মাথা নেড়ে বলল, “তোমার যা গেছে তা উসুল করেও আংটির দৌলতে তোমার অনেক থাকবে। আমি পঞ্চাশ হাজার আর ষষ্ঠী পাঁচশো।”
“পাঁচশো!” বলে ষষ্ঠী চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেল।
টিকে গম্ভীর ভাবে বলল, “পাঁচশো টাকায় আমাকে দিয়ে খুন করাতে চেয়েছিলি। টিকে তোর কাছে খুব শস্তা হয়েছে, না? পাঁচশো যে তোকে দেওয়া হচ্ছে এই ঢের।”
কালী স্যাকরা হাত বাড়িয়ে বলল, “আংটি যদি খাঁটি হয়, তবে পাঁচ হাজার পাবি, ষষ্ঠী পাবে ওই পাঁচশো। রাজি থাকলে দে।”
দু’পক্ষে তুমুল দরাদরি শুরু হয়ে গেল। আধঘন্টা বাদে সিদ্ধান্ত হল, ষষ্টী পাঁচ শো পাবে, টিকে পাবে দশ হাজার।
টিকে ট্যাঁক থেকে আংটিটা বের করে কালী স্যাকরার হাতে দিয়ে বলল, “এবার দ্যাখো, জিনিস খাঁটি তো?”
কালী স্যাকরা চোখে ঠুলির মতো একটা আতস কাঁচ লাগিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আংটিটা দেখে বলল, “সেইটেই। সন্দেহ নেই। কিন্তু আজ রাতে তো টাকা দিতে পারছি না। আমার যা ছিল এখানে, সব গেছে। তার ওপর এই ঘোর অমাবস্যায় ঘরের টাকা বের করাও পাপ। কাল সকালে এসে টাকা নিয়ে যাস।”
টিকে মাথা নেড়ে বলল, “ও বাবা, তা হবে না। টাকা না পেলে আংটি তোমার কাছে গচ্ছিত রাখে কোন্ মুখ!”
বেজার মুখে উঠে কালী স্যাকরা দেয়ালে লাগানো গুপ্ত সিন্দুক খুলে টাকা বের করে দিয়ে বলল, “এখন বিদেয় হ। আমার অনেক কাজ।”
ষষ্ঠী আর টিকে বেরিয়ে এল। টিকের মুখে হাসি। ষষ্ঠী ধুতির খুঁটে চোখ মুছছে।
আগে-আগে টিকে, পিছনে ষষ্ঠী। সরু অন্ধকার গলিটার মুখে দেয়ালে পিঠ দিয়ে একটা পাগল-গোছের লোক দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছিল। তাকে বিশেষ নজর না করে পেরিয়ে যাচ্ছিল দুজনে।
কিন্তু ঘটনাটি ঘটল বিদ্যুতের বেগে। দুজনে ঠাহরই করতে পারল না যে, কী হল।
টিকে নিশ্চিন্ত মনে হাঁটছিল। তার গায়ে অসুরের জোর, কোমরে ভোজালি, বুকে দুর্জয় সাহস, ট্যাঁকে দশ হাজার গা-গরম করা টাকা। এ-তল্লাটে তাকে ঘাঁটানোর সাহস কারও নেই।
কিন্তু পাগলটা হঠাৎ ঠ্যাং বাড়িয়ে ছোট্ট একটা ল্যাং মারল তাকে। আর সঙ্গে-সঙ্গেই ঘাড়ের ওপর এসে পড়ল হাতের চেটোর একটা দুর্জয় কোপ টিকে–দশাসই টিকে একবার মাত্র ‘কোঁক’ শব্দ করে উপুড় হয়ে পড়ে গেল। আর নড়ল না।
ষষ্ঠী ঘটনাটা বুঝতেই পারেনি। আচমকা টিকে ওরকম গদাম করে পড়ে যাওয়ায় সে বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। পাগলটা খুব ধীরেসুস্থে হিসেব-নিকেশ করে তার কপালে একটা ছোট্ট গাঁট্টা মারল। ষষ্ঠী খুব অমায়িকভাবে বসে পড়ল মাটিতে। তারপর চোখ উল্টে গোঁ-গোঁ করতে লাগল।
পাগলটা নিচু হয়ে টিকের ট্যাঁক থেকে দশ হাজার আর ষষ্ঠীর ট্যাঁক থেকে পাঁচশো টাকা বের করে নিল।
জানালা দরজা বন্ধ করে কালী স্যাকরা বাতি জ্বেলে আংটিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল। হিরেটা খুলে সোনা গলিয়ে ফেলতে হবে। নইলে
চোরাই জিনিস, ধরা পড়তে কতক্ষণ?
ঠিক এই সময়ে বাইরে থেকে টিকে ডাকল, “কালীদা।”
কালী বিরক্ত হয়ে বলে, “আবার কী চাস?”
টিকে চাপা গলায় বলল, “বলছিলাম কী, আমার বউটা তো ভীষণ দজ্জাল, তুমি জানো।”
“তা জানি।”
“আমি এত রাতে বাড়ি ফিরলে বউ আমার ট্যাঁক হাতিয়ে দেখবে। টাকাটা পেলে নিয়ে নেবে। তাই বলছিলাম, টাকাটা আজ রাতের মতো তোমার কাছে থাক। কাল এক ফাঁকে যখন বউ বাড়িতে থাকবে না, তখন এসে নিয়ে যাব।”
একথায় কালী স্যাকরা খুশি হল। টাকা তার প্রাণ। যতক্ষণ কাছে থাকে, ততক্ষণই মনটা ভাল থাকে। দশ হাজার টাকা হাতছাড়া হওয়ায় মনটা খিচড়ে ছিল এতক্ষণ।
“দাঁড়া, দরজাটা আজ রাতে আর খুলব না। জানালাটা ফাঁক করছি, হাত গলিয়ে দিয়ে দে।”
“তাই নাও কালীদা। টাকাটা সাবধানে রেখো। ফের যেন চুরি-ডাকাতি হয়।”
কালী স্যাকরা জানালার ছিটকিনি খুলে পাল্লা ধরে অনেক ঠেলাঠেলি করল। কিন্তু পাল্লা এমন এটে গেছে যে, খুলল না। হতাশ হয়ে কালা বলল, “এ যে খুলছে না রে।”
টিকে বিরক্ত হয়ে বলল, “এইভাবে রাত কাবার করে দেবে নাকি? জানালা খুলছে না তো দরজাটাই একটু ফাঁক করো, টাকাটা দিয়ে চলে যাই। আমার অত সময় নেই।”
কালী অগত্যা দরজাটার হুড়কো খুলে একটু ফাঁক করল।
তারপর যে কী ঘটল, তা কালী স্যাকরা নিজেও বলতে পারবে না। একটুখানি ফাঁক হওয়া দরজাটা দিয়ে যেন একটা বিকট ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল।
কালী স্যাকরা চিতপাত হয়ে পড়ে গেল মেঝেয়।
পাগলটা কালী স্যাকরার দিকে একটুক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর খুব ধীরেসুস্থে শিস দিতে দিতে কালীর কাজ করার জলচৌকিটার ওপর থেকে এখনও অক্ষত আংটিটা তুলে নিয়ে আলোয় একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে আঙুলে পরে নিল। তারপর দেয়াল হাতড়ে-হাতড়ে বের করে ফেলল গুপ্ত সিন্দুক। কালীর কোমরের কষি থেকে চাবি খুলে নিয়ে সিন্দুক থেকে সোনাদানা আর টাকাপয়সা বের করে একটা লম্বা গেজেয় ভরে ফেলল। বেরিয়ে এসে দরজাটা ভেজিয়ে দিল, সাবধানে। দ্রুত পায়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। তার হাবভাবে আর পাগলামির চিহ্নও ছিল না।
গোটা ঘটনাটা ঘটতে দশ মিনিটের বেশি লাগেনি।