Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » হিমু এবং একটি রাশিয়ান পরী (২০১১) || Humayun Ahmed » Page 7

হিমু এবং একটি রাশিয়ান পরী (২০১১) || Humayun Ahmed

এলিতা আমার ঘরে বসে আছে

এলিতা আমার ঘরে বসে আছে। তার চোখ ফোলা, মনে হয় একটু আগে কেঁদেছে। আমেরিকান মেয়েরা আমাদের দেশের মেয়েদের মত অকারণে কাঁদে কি-না তাও জানি না। মাঝে মাঝে ঠোঁট কামড়াচ্ছে। প্ৰচণ্ড রাগ এবং প্রচণ্ড দুঃখে মানুষ ঠোঁট কামড়ায়। মেয়েরা নিচের ঠোঁট, পুরুষরা উপরের। এলিতা দু’টা ঠোঁটই কামড়াচ্ছে।

তার সমস্যা কি?

আমি বললাম, চা খাবে?

এলিতা প্রবলভাবে মাথা ঝাঁকাল। সে চা খাবে না। তার ভাবভঙ্গি থেকে মনে হচ্ছে সে আবারো কান্নার উপক্রম করছে। আমি বললাম, কি সমস্যা?

এলিতা হাহাকার ধ্বনি তুলে বলল, আমার ক্যামেরা পকেটমার হয়েছে।

আমি বললাম, তোমার বাংলা ভুল হয়েছে। পকেট থেকে কিছু চুরি হলে পকেটমার। তোমার এই বিশাল ক্যামেরা কোনো পকেটে আটবে না। হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে?

হুঁ।

তাহলে ছিনতাই হয়েছে। ছিনতাই চোখের সামনে হয়। পকেটমার হয় আড়ালে।

আমি তোমার কাছে বাংলা শিখতে আসি নি।

কি জন্যে এসেছ?

ঘটনাটা জানাতে, আমার সব ছবি এই ক্যামেরায়। কি চমৎকার সব ছবি তুলেছি।

আবার তুলবে।

পাগলের মত কথা বলছি কেন? কোন ছবিই দ্বিতীয়বার তুলা যায় না।

যাবে না কেন?

প্রথম তোলা ছবির লাইট দ্বিতীয়বার ঠিক থাকে না। পৃথিবী ঘুরছে আলো প্রতিমুহূর্তে বদলাচ্ছে।

পৃথিবী স্থির হয়ে থাকলে একই ছবি দ্বিতীয়বার তুলা যেত?

প্লীজ স্টপ ইট। তোমার সঙ্গে বক বক করতে ইচ্ছা করছে না। কাঁদতে ইচ্ছা করছে।

কাঁদো। তোমাকে কাঁদতেতো কেউ নিষেধ করছে না। কেঁদে মন ঠিক কর। কেঁদে কেঁদে বিজ্ঞানী নিউটন হয়ে যাও।

তার মানে কি?

বিজ্ঞানী নিউটন বিশাল এক অংকের বই এর পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন। নাম ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকা’ তার আদরের কুকুর জ্বলন্ত মোমবাতি ফেলে পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে ফেলে। নিউটন বইটা আবার নতুন করে লেখেন। তুমিও নতুন করে ছবি তুলবে।

আমি যে সব মোমেন্ট ক্যামেরায় ধরেছি সেগুলি কোথায় পাব?

নতুন মোমেন্ট তৈরি হবে।

এলিতা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, তোমার কাছে আসাই আমার ভুল হয়েছে। আমাকে শুধু একটা কথা বল, তোমাদের পুলিশ কি আমাকে সাহায্য করতে পারবে?

অবশ্যই পারবে। তারা ছিনতাই এর পুরো ঘটনাটা লিখবো। কোথায় ছিনতাই হয়েছে ক্যামেরার দাম। ছিনতাইকারীর চেহারার বর্ণনা সব লেখা হবে। একে বলে General Diary সংক্ষেপে GD. লেখালেখির পর তুমি চলে আসবে পুলিশ খাতা বন্ধ করে চা খাবে, পা নাচাবে।

তুমি বলতে চাচ্ছি। এইসব লেখালেখি অৰ্থহীন?

সবকিছুইতো অর্থহীন। পৃথিবী যে ঘুরছে এটা অর্থহীন না। না ঘুরলে কি ক্ষতি হত?

এলিতা মুখ কঠিন করে বলল, আমি যাচ্ছি।

আমি বললাম, হোটেলে গিয়ে তো মন খারাপ করেই থাকবে তারচে চল ধোঁয়া বাবা’র কাছে যাই। দেখি তিনি কোনো ব্যবস্থা করতে পারেন কি-না।

ধোঁয়া বাবা মানে?

ইংরেজিতে Smoke Father, একজন আধ্যাত্মিক ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ। জ্বিন পরী এইসব অদৃশ্য প্রাণী পুষেন। তিনি অনেক কিছু বলতে পারেন। এমনও হতে পারে তোমার ক্যামেরা কোথায় আছে তার সন্ধান দিলেন। ক্যামেরা উদ্ধারের ব্যবস্থা করলেন।

এলিতা বলল, দিস ইজ বুলশীট।

আমি বললাম, বুলশীট হোক বা কাউ ডাং হোক চেষ্টা করতে দোষ কি। কবি বলেছেন,

“নাই কোনো শেষটা
করে যা চেষ্টা।”

ডুবন্ত মানুষ খড়খুটা ধরে ভেসে উঠতে চায়। ক্যামেরার শোকে অস্থির তরুণী ধোঁয়া বাবা ধরবে এটাই স্বাভাবিক।

নৌকায় বুড়িগঙ্গা পাড় হচ্ছি। এলিতা নিজেকে কিছুটা সামলেছে, অবাক হয়ে চারপাশ দেখছে। অবাক হবার মত কিছু চারপাশে নেই। ময়লা আবর্জনায় দূষিত এবং বিষাক্ত নদী। লঞ্চ স্টিমার ভোঁ ভোঁ করছে। অসংখ্য নৌকা ভাসছে। দেখে মনে হচ্ছে পানিতে ঘোঁই পাকানো ছাড়া এদের কারোরই কোনো গন্তব্য নেই। নৌকা দুলছে, এলিতা মনে হয় খানিকটা ভয় পাচ্ছে। সে ক্ষীণ গলায় বলল, নৌকা ডুবে যাবে নাতো?

আমি বললাম, ডুবতে পারে। তুমি সাঁতার জানি না?

না।

আমি বললাম, সাঁতার জেনে মরার চেয়ে সাঁতার না জেনে মরে যাওয়া ভাল।

ভাল কেন?

অল্প পরিশ্রমে মৃত্যু। বাঁচার জন্যে হাত পা ছুড়ে ক্লান্ত হতে হবে না। তাছাড়া পানিতে ডুবে মরার জন্যে এই সময়টা বেশ ভাল।

কেন?

পানি গরম। শীতের সময় নদীর পানি থাকে গরম।

তোমার উদ্ভট কথা শোনার মানে হয় না। আর একটি কথাও বলবে না। শুধু যদি কিছু জানতে চাই তার উত্তর দেবে।

আচ্ছা।

আমরা যার কাছে যাচ্ছি, স্মোক ফাদার। তাকে কি টাকা পয়সা দিতে হবে।

খুশি হয়ে কিছু দিলে উনি নেন। না দিলেও অসুবিধা নেই। উনার চাহিদা অল্প। ধোঁয়া খেয়ে বাঁচেন তো। প্রোটিন, কাৰ্বোহাইড্রেটের ঝামেলা নেই। ফ্রেস ধোঁয়া হলেই চলে।

তুমি বলতে চোচ্ছ উনি ধোঁয়া খেয়ে বঁচোন?

সবাই তাই বলে।

আমাকে এইসব তামশা বিশ্বাস করতে বলছ?

বিশ্বাস করা না করা তোমার ব্যাপার। তবে বিশ্বাস করাই নিরাপদ। কারণ কবি বলেছেন, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।

এলিতা বলল, তোমার সঙ্গে আসা ভুল হয়েছে। ক্যামেরার শোকে অস্থির ছিলাম। লজিক কাজ করছিল না। ঠিক করে বল তোমার অন্য কোনো মতলব নেইতো? ভুলিয়ে ভালিয়ে আমাকে নির্জন কোনো জায়গায় নিয়ে যাবার মতলব করবে না। আমি ক্যারাটে জানি। ক্যারাটোতে ব্ল্যাক বেল্ট পাওয়া মেয়ে। তাছাড়া আমার সঙ্গে স্প্রে আছে।

স্প্রেটা কি?

আমেরিকান মেয়েরা নিজেদের প্রটেক্ট করার জন্যে ব্যাগে ম্প্রে রাখে। চোখের উপর স্প্রে দিয়ে দিলে জন্মের মত অন্ধ হয়ে যাবে।

তোমার সঙ্গে স্প্ৰে আছে?

অবশ্যই। আমি স্প্রে ছাড়া চলাফেরা করি না। স্প্রে ব্যাগে আছে।

তোমার সঙ্গেতো ব্যাগ নেই। আমার ধারণা ক্যামেরার সঙ্গে তোমার হ্যান্ডব্যাগও ছিনতাইকারী নিয়ে গেছে। সে এখন মলমপাটি হয়ে গেছে। স্প্রে মেরে পথচারীকে অন্ধ করে টাকা পয়সা নিয়ে যাচ্ছে।

এলিতা কঠিন চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। ডাগর আঁখির কারণে চোখে কাঠিন্য আসছে না।

আমরা ধোঁয়া বাবার আস্তানায় সন্ধ্যা মেলানোর আগে আগে পৌঁছলাম। প্রচুর দর্শনার্থী বাবার জন্যে অপেক্ষা করছে। তবে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ডাক পেলাম।

ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ঘর। এক কোনায় লাল গামছা কোমড়ে জড়িয়ে ধোঁয়া বাবা পদ্মাসনের ভঙ্গিতে বসে আছেন। তার মাথার উপর লাল সালুর চাদর। একপাশে মালশায় ঘনঘনে কয়লার আগুন মাঝে মধ্যে সেখানে ধূপের দানা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। ধূপের গন্ধ, ধোঁয়ার গন্ধ সব মিলিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসার মত পরিবেশ। বাবার মুখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। তিনি মাঝে মাঝে কারণ ছাড়াই বিকট হা করছেন তখন মুখের ভেতরে লাল জিভ দেখা যাচ্ছে মুখের ভেতরটা অন্ধকার। অন্ধকারে লাল জিভ কেন দেখা যাচ্ছে বুঝতে পারছি না। আলো বিশেষজ্ঞ এলিত হয়ত বলতে পারবে।

এলিতা বলল, Oh God. What is this.

ধোঁয়া বাবা বললেন, হিমু ভাই আছেন কেমন?

আমি বললাম, ভাল।

শাদা চামড়ার এই ছেমড়ি কে?

ফটোগ্রাফার। সমস্যায় পড়ে এসেছে।

ছেমড়ি বাংলা বুঝে?

খুব যে বুঝে তা বলা যাবে না।

ধোঁয়া বাবা চিন্তিত গলায় বললেন, আমিতো হালার ইংরেজি জানি না। ছেমড়ির সঙ্গে কথা কমু ক্যামনে?

যা পারেন বলেন। আমি দোভাষির কাজ করব।

ছেমড়িরে বলেন, তার কি সমস্যা যেন বলে।

আমি এলিতাকে বললাম, তোমার কি সমস্যা বাবাকে বুঝিয়ে বল। বাবা শুনতে চাচ্ছেন।

এলিতা বলল (ইংরেজিতে), আমি নিজেকে এইসব বুজরুকির সঙ্গে জড়াতে চাচ্ছি না। ঘরে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

আমি বললাম, শুরু যখন করেছে। শেষটা দেখ। ক্যামেরা হারিয়েছে এটা বল।

এলিত কঠিন গলায় বলল, আমি কিছুই বলব না। নুইসেন্সের সঙ্গে যুক্ত হব না। আমাকে বোকা মনে করার কোন কারণ নেই।

ধোঁয়া বাবা বললেন, ছেমড়ি চিল্লায় কেন?

আমি বললাম, মনের দুঃখে চিৎকার করছে। দামী ক্যামেরা হারিয়ে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছে।

ক্যামেরা গেছে কোন জায়গায়?

ধোঁয়া বাবার এই বাংলা এলিতা বুঝতে পারুল। সে বিরক্ত গলায় বলল, সোনারগাঁ হোটেলের সামনে।

কি ক্যামেরা?

নাইকন। আমি আর কিছু বলব না। আমি বাইরে যাব। আমার চোখ ‘Hot’ হয়েছে। এলিতা চোখ ডলাতে ডালতে ঘর থেকে বের হল। ধোঁয়া বাবা বললেন, হিমুভাই বসেন। অনেক দিন পরে আপনারে দেখে মনে আনন্দ হয়েছে।

আমি বললাম, আনন্দের হাত ধরে আসে নিরানন্দ।

ধোঁয়া বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তাও ঠিক। কানাঘুসা চলতেছে। যে কোনদিন পুলিশের হাতে ধরা খাব।

ক্যামেরা কি পাওয়া যাবে?

সিদ্দিকের এলাকা। পাওয়াতো যাবেই। কতক্ষণে পাওয়া যায় সেটা কথা। আপনি শাদা ছেমড়ি নিয়ে অপেক্ষা করেন। আমি পাত্তা লাগাই। রাতে খাওয়া দাওয়া না করে যাবেন না। দাওয়াত কবুল করেছেন?

করলাম।

শুকরিয়া।

ধোঁয়া বাবার ঘরের ধোঁয়া কমে আসছিল। বাবার নির্দেশে একজন এসে ধোঁয়া বাড়িয়ে দিল। বাবা ক্ষীণ গলায় ডাকলেন, হিমু ভাই।

আমি বললাম, কি বলতে চান বলে ফেলুন।

মৃত্যুভয় ঢুকেছে বুঝেছেন। পেরায় রাতেই স্বপ্ন দেখি ফাঁসির দড়িতে ঝুলতেছি কিন্তু মরণ হচ্ছে না। বিরাট কষ্টের ব্যাপার। কি করি বলেন তো।

ধোঁয়া খেতে থাকুন। আর কি করবেন।

ধোঁয়া বাবার আস্তানায় এলিতাকে নিয়ে রাতের খাবার খেলাম। কাচ্চি বিরিয়ানি, মুরগির রোস্ট, দৈ মিষ্টি। এলিতা বলল, অদ্ভুত রান্না। এত ভাল খাবার কম খেয়েছি।

আমি বললাম, পীর ফকিরদের দরবারে খানা সব সময় ভাল হয়।

ডিনার শেষ হবার আগেই এলিতার ক্যামেরা চলে এল। ক্যামেরার সঙ্গে তার চামড়ার ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর নিশ্চয়ই স্প্রেটাও আছে। চোখ অন্ধ করার স্প্রে।

এলিতা আবারো বলল, Oh God. এটা কিভাবে সম্ভব?

আমি বললাম, এই পৃথিবীতে সবই সম্ভব। আবার সবই অসম্ভব। আমার ধারণা বাবা জ্বীন পরীদের সাহায্যে কাজটা করেছেন।

এলিতা বলল, Holy man ধোঁয়া বাবা যে এত পাওয়ারফুল তা আগে বুঝতে পারি নি। আমি তাঁর Dociple হতে চাই। এটা কি সম্ভব?

আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, এই একটু আগেইতো বলেছি পৃথিবীতে সবই সম্ভব। আবার সবই অসম্ভব। ক্যামেরায় যে সব ছবি তুলেছ সেগুলি ঠিক আছে কি-না। আগে দেখা। ধোঁয়া বাবার শিষ্য হবার চিন্তা বাদ দাও। উনার শিষ্য হলে সমস্যা আছে।

কি সমস্যা?

রাতে দুঃস্বপ্ন দেখবে। ফাঁসিতে ঝুলছ কিন্তু মৃত্যু হচ্ছে না। মৃত্যুর জন্যে একজন ছটফট করছে কিন্তু সে মরতে পারছে না, বিরাট কষ্টের ব্যাপার না?

এলিতা হতাশ গলায় বলল, You are so confusing.

আমি একাতো না। আমরা সবাই confused. প্রাচীন মায়া সভ্যতায় বলা হয়, ঈশ্বর মরছে confused বলেই আমরা সবাই confused.

সোনারগাঁ হোটেলে তাকে নামিয়ে চলে আসছি সে আমাকে চমকে দিয়ে বলল, , হিমু! তুমি আজ থেকে যাও।

আমি বললাম, কোথায় থাকব?

আমার ঘরে থাকবে। আমরা সারারাত গল্প করব।

আমি বললাম, হায় সখা এত স্বৰ্গপুরী নয় পুষ্পে কীট সম হেতা তৃষ্ণা জেগে রয়।

এলিতা বলল, এর মানে কি?

আমি বললাম, কবিতার লাইন। ব্যাখ্যা করা কঠিন।

এলিতা বলল, এর মানে কি এই যে তুমি থাকবে না।

আমি বললাম, ঠিকই ধরেছ। আমি যাই। তুমি আরাম করে ঘুমাও।

আমি হাঁটা ধরেছি। এলিতা তাকিয়ে আছে।

ঢাকা শহরের রাতে আকাশ দেখা যায় না বলে পথচারীদের মাঝে মাঝে খুব সমস্যা হয়। আকাশে হয়ত ঘন মেঘ করেছে, বেচারা বুঝতে পারল না। হুড়মুড়িয়ে নামল বৃষ্টি। শোবার ঘরের নিরাপদ আশ্রয়ে যে আছে সে তখন মনের আনন্দ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বর্ষ যাপন পড়তে পারে। পথে যে নেমেছে তার মহাবিপদ। বৃষ্টি শুরু হলেই রিকশা সিএনজি কিছুই পাওয়া যাবে না। কিছুক্ষণের মধ্যে রাস্তায় পানি উঠে যাবে। সেই পানিতে এক সময় ফুটপাত ঢেকে যাবে। ম্যানহোল সবই ফুটপাতে। এই শহরে ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি করে এমন একদল মানুষই আছে। তারা সেরদরে ম্যানহোলের ঢাকনা বেচে কিংবা কটকটিওয়ালার কাছে ঢাকনার বিনিময়ে কটকটি কিনে খায়। রাতের ঢাকায় বৃষ্টি হচ্ছে আর কেউ ম্যানহোলের ভেতর ঢুকে যায় না। এমন ইতিহাস নেই।

ফুটপাতে পানি উঠে গেছে। কাজেই ফুটপাত ছেড়ে আমি পথে নেমেছি। আমার গা ঘেঁসে একটা প্রাইভেট কার গেল। আমি কাদার পানিতে মাখামাখি। প্রাইভেট কারের জানালা খুলে একজন মাথা বের করে বলল, ‘দাদা! সরি।’ গাড়ির ভেতর থেকে প্রবল হাসির শব্দ ভেসে এল। বিচিত্র কারণে অন্যের দুৰ্দশায় আমরা আনন্দ পাই।

সারাগায়ে কাদাপানি মেখে আমি দাঁড়িয়ে আছি। বিরামহীন বৃষ্টি পড়ছে। গায়ের কাদা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যাবার কথা, তা যাচ্ছে না। আমার ইচ্ছা করছে সোগারগা হোটেলে ফিরে এলিতাকে বলা, “আজ রজনীতে হয়েছে সময় এসেছি বাসবদত্তা।”

আরেকটা গাড়ি এসে আমাকে দ্বিতীয়বার ভিজিয়ে দিল। মজা মন্দ না। আমার ধারণা একের পর এক গাড়ি আসবে অসহায় পথচারীকে ভিজিয়ে আনন্দ পাবে। নিশিরাতে মানুষকে আনন্দ দিতে পারছি এটা খারাপ না।

আমি অপেক্ষা করছি এমন একটা গাড়ির যে দূর থেকে আমাকে দেখে গতি কমিয়ে দেবে। এই গাড়ি আমার গা ঘেঁসে যাবে কিন্তু আমাকে ভিজাবে না। এমন ঘটনা ঘটার পর আমি মেসে ফিরব তার আগে না।

মজার এক খেলা শুরু হয়েছে। দূর থেকে গাড়ির হেড লাইট দেখা মাত্র আমি রোমাঞ্চিত বোধ করছি এই গাড়ি মনে হয় আমাকে ভিজাবে না।

ঝাঁ ঝম। পাজোরা গাড়ি আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে চলে গেল।

এবার আসছে এক চক্ষু গাড়ি। নিশ্চয়ই ট্রাক। ট্রাকের দুটা হেড লাইটের একটা বেশির ভাগ সময় নষ্ট থাকে।

ঝঁ ঝম! ট্রাজকও ভিজিয়ে দিল। দেখা যাক এবার কি আসে। আমার কাজ অপেক্ষা করা আমি অপেক্ষা করছি।

ঝড় বৃষ্টির রাতের জন্যে ঢাকা শহরে বিশেষ এক শ্রেণীর প্রাণী অপেক্ষা করে। এই তথ্য আর কেউ জানুক না জানুক টহল পুলিশরা জানে। এই প্রাণীগুলি দেখতে মানুষের মত। তবে সামান্য লম্বা। এরা রাতের অন্ধকারেও চোখে কালো চশমা পরে থাকে বলে এদের চোখ দেখা যায় না। শীত গ্ৰীষ্ম সব সময় এরা হাতে গ্লাভস পরে থাকে বলে হাতও দেখা যায় না। একা কাউকে পেলেই এরা কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। পাখির মত কিচকিচ করে কথা বলে। হ্যান্ডসেকের জন্যে হাত বাড়ায়।

একবার এদের একজনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। কেন জানি মনে হচ্ছে আজও দেখা হবে। আমি এদের নাম দিয়েছি পক্ষীমানব।

টহল পুলিশরা বলে ‘বেজাত’। এদের কোনো জাত নেই।

একটা প্ৰাইভেট কার শ্লো করে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। পেছনের সীটে বসা আরোহী জানোলা খুলে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ভাই! আপনার কোনো সমস্যা।

কোনো সমস্যা নেই।

মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বাসা কোথায় বলুন। নামিয়ে দিচ্ছি। ভদ্ৰলোকের চোখে কালো চশমা। উনি কি পক্ষীমানবদের কেউ?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *