হারামজাদি
‘ওই হারামজাদিটা কে টেনে বের করতে পারছিস না কেউ তোরা !’ অগ্নিগর্ভ লাল নেশা চোখে , পান চিবোতে চিবোতে পল্টুর দিকে তীব্র ক্ষোভ নিয়ে কথাটা ছুঁড়ে দিলো তেওয়ারী ।
পাল্টা কিছু একটা বলতে উদ্যত হতে গিয়েও থামলো পল্টু । বড়ো মুখ খারাপ ,এই চাল আড়তে আসা ওদের ব্ন্ধুটির । একটু পিক ফেলে আবার ভ্রু কুঁচকে শুরু করলো “রাখ,যত্ত ন্যাখড়া বাজি তোদের , বেড়াল কে মাছ দেখিয়েছিস , আর এবার সামলা!”-বলে কাঁচ ঠেলে ভেতরে আসা ভয়ে ,ওই জড়োসড়ো, এক রক্ত মাংসহীন, কত কাল না খেতে পাওয়া,শীর্ণকায় সাহায্যপ্রার্থী মহিলার মুখের ওপর দু টাকা ছুঁড়ে দিয়ে রীতিমতো শাসিয়ে বললো “এই হারামি শোন,আর কোনদিন এখানে এসেছিস তো ন্যাংটা করে বেঁধে রাখবো”।
শুনে একবার প্রতিবাদ করতে গিয়েও ইচ্ছে হলো না , আর করবেই বা কাকে, যে বলছে তার নিজের চরিত্র কি আদৌ ঠিক আছে ! কাজের মেয়ে , প্রতিবেশী কেউই নিরাপদ নয় এই হারামখোর তেওয়ারীর কাছে ! মেয়ে সে ভিখারিনী হোক আর বাচ্চা শিশু কন্যা একা পেলে যেন জিভ লকলক করে এমন বহু প্রমান তার এই ক বছরে যথেষ্ঠ পেয়েছে।
অমিত ততক্ষনে শশব্যস্ত হয়ে, কাঁচের দরজাটা খুলে ওনাকে বাইরে বের করে দিতে পারলে বাঁচে ।চোখের সামনে কোনো মহিলাকে এই ভাবে অপমানিত হতে দেখা,তার কাছে খুবই অস্বস্তির ও তাকে খুব কষ্ট দেয়। বেরিয়েই লুকিয়ে দশ টাকা তার হাতে গুঁজে চাপা স্বরে বলে ‘দিদি , বাচ্ছা টা কে একটু দুধ কিনে দিও , আর এসো না গো, বড়ো মুখ খারাপ ওই লোকটার ।’ পল্টু ঠিক লক্ষ্য করেছে মহিলার চোখ বেয়ে,নোনা জলের চকচকে দু চার বিন্দু অশ্রু। অমিত ভেতরে ঢুকতেই বুঝতে বাকি রইলো না , শালা তেওয়ারী শকুন চোখে ঠিক দেখেছে আড়ালে টাকা দেওয়া ! তেলে বেগুনে জ্বলে ওমনি আবার বাজখাঁই গলায় দু চারটে কাঁচা খিস্তি ঝেড়ে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে শান্ত হলো!
ও যে এদের বস ,সেটাও নয় , তবু দুনিয়ায় কিছু কিছু লোক আছে, স্বভাবটাই অন্যদের ওপর খবর দারি করা! সপ্তাহের দুদিন করে পল্টু , অমিত , রমেশ রা আসে এই ছোট্ট এক কামড়ার অফিসটাতে বর্ধমানে এলে।চালের বাজারদর , হাবিজাবি খবরের সাথে নিখাদ আড্ডা চলে একটু আধটু ।
বরাবরই অমিত একটু অন্য ধাঁচের মানুষ।প্রতিদিন স্টেশনে এসে ট্রেনের লেট হলে, সরোজমিনে এই গরীব ,অনাথ মানুষ,ভিখারী গুলোর গতিবিধি দূর থেকে দেখে । কখনও, কেমন নিজের পুরনো জামাকাপড় এনে,ওদের দিয়ে দেয় । অন্যদেরও দিতে,অসহায়দের জন্য কিছু করতে উৎসাহ দেয়।সমমনস্ক পল্টুও চেস্টা করে এটা বোঝাতে যে, নিজের ক্ষতি না করে যতটা পারো হাত বাড়াও আসে পাশের অসহায়দের দিকে।। এতে কেউ সাড়া না দিলেও কিছু যায় আসে না ,অন্তত এই মানসিকতায় নিজের মতো করে পথ হাঁটা জরুরী।
ঘটনার সূত্রপাত হয় কিছুদিন আগে থেকেই।একদিন পল্টু,চাল গদি অফিসে যাবার পথে দেখতে পায়, এই শতছিন্ন শাড়ি পড়া, মহিলাটি, কোলে বাচ্ছাকে নিয়ে কেমন অসহায় ভাবে উদাসদৃষ্টিতে। সেদিনই, বাইক দাঁড় করিয়ে কিছু দিতে যেই উদ্যত , পেছন থেকে এক বুড়ি ঠাকুমা জানায় কাল থেকেই ভীষণ জ্বর ছেলেটার । কথা টা শুনে কাল বিলম্ব না করে একটু তফাতে ওষুধের দোকান থেকে দুটো প্যারাসিটামল এনে খাইয়ে দিতে অনুরোধ করে । সে যাত্রায় ভাগ্য সাথ দেওয়ায় অল্প ওষুধে,বাচ্ছা টা সুস্থ হয়ে উঠে ছিলো জলদি।মহিলা দিদিটি কোনোদিন খুব বিপদে পড়লে হাত পাততে আড়ত অফিসে চলে আসতো ,হয়তো পল্টুকে যদি দেখতে পায় এই ভরসায়।
অনেক বছর পার । একদিন সেটা ছিলো গরম কাল , দুই প্রাণের বন্ধু পল্টু আর অমিত নাইট শোতে সিনেমা দেখে ফিরছিল।কিছুটা এগুতেই তুমুল হই হট্টগোলের আওয়াজ খাল পাড়ের বস্তি থেকে।কারা যেন কাউকে ধরেছে,বিরাট চিৎকার,হম্বি তম্বি।’চল যাবিরে,দেখবি নাকি’,অমিতের কৌতূহলী ইশারায় পল্টু আর না করতে পারে নি। কিছুটা এগুতেই চক্ষু চরক গাছ ওদের। কিছু পাড়ার মস্তান গোছের ছেলে কাকে যেন ঘিরে ধরে, বেধড়ক পেটাচ্ছে! আর খুব চেনা একটা কণ্ঠস্বর ,”আর আসবো না,এ বারের মতো ক্ষমা করে দাও “শুনে অমিত বিস্ময় কণ্ঠে “এ কিরে পল্টু ,ওরে বাবা এ যে সেই শালা তেওয়ারী!’ অস্ফুটে কথাটা মুখ দিয়ে বেরুতেই কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে,অমিত ও পল্টু হাঁ করে পরস্পরকে দেখছে।
সাহসে ভর করে,একটু এগিয়ে ,”কি হয়েছে কি,মারছো কেন কি করেছে ” বলতেই জনগণের রোষ এসে পড়লো এদের ওপর।কয়েকজনতো আবার বলে উঠলো,”এরাও মেয়ে পাচারের সঙ্গে যুক্ত বোধ হয়,সাগরেদ ধরা পড়তেই!বাঁধ ব্যাটা দের,গরীব ঘরের মেয়েদের নিয়ে ফষ্টিনষ্টি করা বের করছি “শুনে তো ভয়ে, অমিতদের দফা রফা । জোড় হাত করে ,’না না আমরা চিনি না,এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, হটাৎ হই হই শুনে দেখতে এলাম।” ।কিন্তু শুনবে কেন উত্তেজিত জনতা,এই অস্থির পরিস্থিতিতে যুক্তিবোধ কমই কাজ করে । ঠিক এই মুহূর্তে সবাই কে অবাক করে যে হাজির হলো,পল্টুরা তো বিস্ময় চোখে হতবাক।সেই হতদরিদ্র ভিখারি মহিলা,যাকে সেই কয়েক বছর আগে ,সেদিন তেওয়ারী ” হারামজাদী, দূর হ বলে”অপমানে বের করে দিয়েছিল,কিন্তু সেদিনের ওই রংচটা হতদরিদ্র ভিখারির আজ একি পরিবর্তন!সে আসতেই সবাই ভিড় পাতলা করে সরে দাঁড়াল।মুহূর্তে অন্যান্যদের হাবে ভাবে অমিতদের বুঝতে বাকি রইলো না ,যে ওই ভিখারি দিদি আজ এই খেটে খাওয়া বস্তির মানুষ গুলোর খুব আপন ও দেখভাল করার নেত্রী গোছের হয়ে গেছে। এর পর তেওয়ারীর সামনে এসে উনি বললেন,”শালা হারামজাদা,লজ্জা করে না,ভদ্র পোশাকের ভদ্র লোক সেজে,বস্তির কচি কাঁচা মেয়েগুলোর দিকেও নজর পড়েছে!আর যদি এদিকে দেখি,কচু কাটা করে খালের জলে ভাসিয়ে দেব ” অমিত, পল্টু সব দেখে শুনে লজ্জায়,ঘেন্নায়,ভয়ে ভিড়ের মাঝ থেকে চুপ চাপ কেটে পড়লো পাছে তেওয়ারী, না ওদের ছায়াও মাড়াতে পারে।