হাওয়ায় ভাসে সবুজ ভালোবাসা
আমি রিমি। বর্তমান বয়স বাইশ। শান্তিনিকেতনে আর্ট কলেজে পড়াশোনা করি। বাবার বয়স তেতাল্লিশ। আমার কাকু, জেঠু, পিসি, মাসি কেউ নেই। বন্ধুরা বলে তোর বাবা কি ছোট!
তোর বাবার কথা বল।কি করে মার সঙ্গে বিয়ে হলো।
আমি বাবার কাছে জিজ্ঞেস করলে ভীষণ বকে।
আমি শান্তিনিকেতন থেকে হঠাৎ কোলকাতার বাড়িতে এসে দেখি বাবা নেই।ফোন করতে বাবা বলেন বন্ধুর বিয়েতে বর্ধমান গেছি। বাবাকে বলি আমার কাছে চাবি আছে চিন্তা করো না আমি ভিতরে ঢুকে গেছি। বাবা ফ্রিজে খাবার আছে বার করে খেয়ে নিতে বলে।আর বকাও দেয় এরকম না বলে এসেছি বলে। আমি বলি কোনো অসুবিধা নেই বাবা।কাল এসো । মজা করো।পারলে একটা বিয়ে করে নিও। কতদিন মায়ের স্মৃতি নিয়ে থাকবে। বাবা বলে রিমি বড্ড পাকা হয়েছ।
বাবার সম্বন্ধে কৌতুহল আর্ট কলেজে পড়বার পর থেকে।এইতো সুযোগ বাবার ডায়েরি লুকিয়ে পড়বার।
পুরো গল্পের মতো বাবার আত্মকথা। বাবা লিখেছে আমার অবর্তমানে রিমি জানবে তার পালক বাবার কথা।
আমার স্মৃতির হাওয়ায় ভাসে সবুজ ভালোবাসা
-/-
বাস চালক সজোরে হর্ণ বাজাতে থাকে, টিকিট যিনি দেন গলা ফাটিয়ে বাসের সামনের মেয়েটিকে চিৎকার করে বলেন সরে যাও মামনি ,বাসের লোকেরা হৈ হৈ শব্দ করে ওঠে।সড়ে যাও বাসের ব্রেক নষ্ট হয়ে গেছে।
স্বর্গ থেকে স্বয়়ং যমরাজ ও সবার আর্তনাদ শুনতে পেয়ে চলে এসেছেন। কেননা বাস দুর্ঘটনায় কতজন যাবে!এত
লোককে একা সামলাতে হবে।চিত্রগুপ্ততো হিসাব মেলাবেন।
তবুও মেয়েটির কোন হেলদোল নেয়। হেঁটেই যাচ্ছে।কানে আবার তার গোঁজা।
রবিবারের সকালবেলা পথচারীরা ও নেয় , তাহলে মেয়েটিকে সতর্ক করার চেষ্টা করত।
ড্রাইভার হঠাৎ গাড়ির স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে আস্তে আস্তে রাস্তার প্লাটফর্মে ধাক্কা দেয়।এমন সময় এক দেবদূত মেয়েটিকে বাঁচাতে চেষ্টা করে।ব্রেক ফেল বাস ততক্ষণে দাঁড়িয়েছে।
মেয়েটি ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে ছেলেটাকে বলে বোবাদের ভাষায় অসভ্য কথাকার।সব আও আও চিৎকার লাগছিল।ইশারায় করে বুঝিয়ে দেয় বাড়িতে মা বোন নেয়।আমাকে
রাস্তাঘাট ফাঁকা দেখে জড়িয়ে ধরছেন।তারপর আও আও বোবার ভাষায় চিৎকার আমাকে সাহায্য করুন। আও আও চিৎকার শুনে বাসের লোকেরা নেমে এসে বলে কি হয়েছে মামনি!!
মামনি আও আও করে বোবা ভাষায় বলে আপনারা তাকিয়ে কি দেখছেন! বুঝতেই পারছেন না এই অসভ্য ছেলেটা আমাকে অসভ্যের মতো হ্যাঁচকা টান মেরে ফুটপাত থেকে সরিয়ে আনল । বাস ড্রাইভার এবার ধমকের সুরে বলে, ব্যাপারটা কি খুকি,
কানে তো শুনতে পাওনা, তখন থেকে গলা ফাটিয়ে যাচ্ছি, । আরেকটু হলেই তো ওই ব্রেকফেল করা বাসটা তোমাকে চাপা দিত।একজন বলে উঠল চোরের মায়ের বড় গলা। তখন মেয়েটি ছেলেটিকে দুঃখ প্রকাশ করে বলে আমার মা খুব অসুস্থ , আমার মতো কানে শোনে না।তাই অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটছিলাম।কানের মেশিনের ব্যাটারিটাও গেছে। তারপর ছেলেটি মেয়েটির লাঠি হয়। আসলে ছেলেটি বোবাদের সাইন লাঙ্গুয়েজ শিখছিল, বোবাদের স্কুলে শিক্ষকতা করবে বলে।এখন যা চাকরির বাজার।
সৌমেন এবার উপদেশ দিয়ে বলে রাস্তায় চলতে গেলে যে সব ইন্দ্রিয় কাজ করে খোলা রাখতে হয়।
মেয়েটি মোবাইল এ লিখে জানায় তার নাম দেবযানী।ফোন নম্বরটা দেয়।
সৌমেন ও এবার পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে নোটবুকে লিখে দেয় তার ফোন নম্বরটা।
দেবযানী মোবাইলে লেখে আমি কথা বলতে পারি না, কানেও শুনি না। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আজ আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন।
সৌমেন মোবাইলে লেখে, সাবধানে চলাফেরা করবেন। আর যদি পারেন, এই নাম্বারটা হোয়াটসঅ্যাপে যোগ করে নেবেন।
তারপর থেকে সারাদিন চলত ফোনে শুধু লেখালিখি। দুজনে কোনো দিন ব্যক্তিগত কথা বলি নি।নানা রকম পড়াশোনার কথা।ভিডিও করে চলত সাইন লাঙ্গুয়েজ শেখা।এরপর সৌমেন ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়ে যায়। এইভাবে চলতে থাকে দিন। এরমধ্যে দেবযানীর মা মারা যান। বন্ধুত্ব হবার বছর দেড়েক বাদে সৌমেন দেখে একটা ফুটফুটে পাঁচ বছরের বাচ্চা মেয়ে।সে বোবা কালা নয়।কলকল করে কথা বলে যাচ্ছে। মেয়েটি বাবার কাছে দেরাদুনে থাকত। বাবা মারা গেছে তাই দেবযানীর কাছে এসেছে। তারপর জানে দেবযানী ডিভোর্সী। বাচ্চাটার মা। সৌমেন খুব ধাক্কা খায়।একটু বন্ধুত্ব শিথিল হয়। তারপর বড় ধাক্কা দেবযানীর হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু। বাচ্চাটার দায়িত্ব সৌমেনকে নিতে হয়।
আজ রিমি বাবার ডায়েরি পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। রিমিরতো ছোট্ট বেলার কথা মনে নেই।বাবাকে কত জিজ্ঞেস করেছে,মা কেমন ছিল। তোমাদের বিয়ের ছবি কোথায়? বাবা শুধু হাসতে থাকে। বিয়ের ছবি সব নষ্ট হয়ে গেছে বলে।
তার মানে বাবারতো মার সাথে বিয়ে হয়নি।আজ বাবা না থাকত , তাহলে রিমির কি হতো!!
বাবার জীবন মাতো নষ্ট করেছে। আমিও পরোক্ষভাবে নষ্ট করেছি।
তখন রাত তিনটে ডায়েরিটা ধরে বসে কাঁদছি , সামনে তাকিয়ে দেখি বাবা দাঁড়িয়ে। বাবা গম্ভীরভাবে বলে অন্যের ডায়েরি পড়তে নেই।
মুখ তুলে রিমি বলে ঠিক বলেছ তুমি আমার অন্য কেউ হও।এক ছুটে বাবাকে জড়িয়ে ধরে । দুজনেই কাঁদতে থাকে।রিমি বলে বাবা এবার একটা মা আনো। বাবা মেয়ের কান মুলে দিয়ে বলে আজও আমার স্মৃতির হাওয়ায় ভাসে সবুজ ভালোবাসা।