দারোগার কাছে করালীকে শনাক্ত
দারোগার কাছে করালীকে শনাক্ত করে দিয়ে সে বড়বাবুদের কাছারি হয়ে বাড়ি ফিরল। বেলা তখন দুপুর গড়িয়েছে। ঘোষের বাকি দু আনা পয়সায়—ছ পয়সার মুড়ি, দু পয়সার পাটালি কিনে গামছায় বেঁধে বাবুদের কেষ্ট দিঘির জলে ভিজিয়ে আমগাছের ছায়ায় বসে খেয়ে নিয়েছে, আঁজলা ভরে জল খেয়েছে। সিধুর পকী মদের বোতলটিতে নেহাত কম ‘দব্য ছিল না, জিনিসটাও ছিল। খ্ৰীটি এখনও পর্যন্ত অল্প-অল্প নেশায় বেশ ফুর্তি রয়েছে বনওয়ারীর। তার উপর মনটাও খুব খুশি রয়েছে। দিনমানটা আজ ভালই বলতে হবে। সেদিন পুজোটি কর্তা প্রসন্ন হয়েই নিয়েছেন মনে হচ্ছে তার। করালীর ব্যাপারটা মিটে গিয়েছে, ভালই হয়েছে। তার মনের মধ্যে ভারি একটা অশান্তি ছিল। ‘কোধ’ অবশ্য খুবই হয়েছিল তার। গুরুবলে খুব সামলে গিয়েছে। নইলে হয়ত কাণ্ডটা একটা বেপৰ্য্যয় ঘটিয়ে ফেলত। ছোঁড়াটার গায়ে ক্ষমতা হয়েছে, হা, তা হয়েছে, মানতেই হবে বনওয়ারীকে। বাঁশবনে সে তার নিচে পড়েছিল—এজন্য বলছে না, ওটা বেকায়দায় পড়ে হয়ে গেল, ঝরা বাঁশপাতার গাদায় পাতা সরে গিয়ে পিছলে পড়ে গিয়েছিল সে। কিন্তু বনওয়ারীর বুকে যখন উঠে বসেছিল করালী, তখন তার ক্ষমতার আঁচটা পেয়েছে সে। ‘সঁটো মরদ হবে ঘোড়া। তবে মদেবদখেয়ালীতে না মাটি হয়ে যায়। সেই জন্যই তো বনওয়ারী তাকে নষ্ট হতে দেবে না। এ কদিন কয়েকবারই তার মনে হয়েছে, ছোঁড়াকে ফেলে বুকে চেপে বসে। বসলে হয়ত মেরে ফেলত তাকে। তা, তা থেকে রক্ষে করেছেন গুরু আর কর্তা। আজ ওই সিধুকে দেখে পাখীর জন্য তার মন কদল করালী আর পাখীকে ফিরিয়ে আনাই ‘কৰ্ত্তব্য মনে হল। তার মত লোকের কি ওই ছেলেমেয়ের উপর রাগ করা ভাল দেখায়? রাম, রাম, লোকের কাছে সে মুখ দেখাত কি করে? যাক, ঘোড়াটাও শেষটা বুঝতে পেরেছে, পাখীকে নিয়ে ফিরে যাবে বলেছে। থানায় ছোঁড়া পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে। হতভাগা, বদমাশ কোথাকার! হতভাগা যে শেষে বুঝেছে, এতেই বনওয়ারী খুব খুশি। নিমতেলে পানু প্ৰহ্লাদ নয়ান এরা খানিকটা মাথা নাড়বে, তা নাড়ানাড়ি করুক। বুঝিয়ে দিতে হবে। বড় ঝঞাটের কাজ এই মাতব্বরের কাজ। দশজনের মাথার উপর বসার ভারি আরাম—এই ভাবে সবাই। ওরে বাবা, এ দশের মাথায় বসা নয়—এ হল লোহার গজাল-বসানো গাজনের পাটায় গজালগুলোর সুচালো মাথায় বসে থাকা। হে ভগবান! মতি ঠিক রেখে বাবা, মতিভ্ৰম হলেই ওই গজালে চেপে বিধে মারবে দশে। বুকের ভিতর রাগ অশান্তি হলেই বুঝতে হবে-গজাল বিধছে। করালীর ব্যাপারটা নিয়ে মনে যখন অশান্তি ছিল, তখন ওই গজালই বিধছিল। মিটে গেল—যাক। ভারি আনন্দ।
চন্দনপুরের বাবুদের ওখানেও সে সুফল পেয়েছে। জয় বাবাঠাকুর! বারু শুনছেন তার কথা-বাবুর সেরেস্তার কর্মচারী—কোপাইয়ের অপর পারের গোপের পাড়ার দাসজী মহাশয়ের ছেলে-বনওয়ারীর খুব সুখ্যাতি করলে বাবুর কাছে। পরমের নিন্দেই করলে। বললেওই তো আসল মাতব্বর কাহারপাড়ায়। পরম তো আটপৌরে-পাড়ার। আটপৌরেরা মোটে ছ-সাত ঘর। তাও সকলে পরমকে মানে না। তা ছাড়া পরম লোকও ভাল নয়। ডাকাতিতে জেল খেটেছে। এবং যত কুঁড়ে তত মাতাল। বনওয়ারীর স্বভাব-চরিত্র খুব ভাল।
বাবু মন দিয়ে শুনলেন সব। বললেন–আচ্ছা, দেব তোমাকে জমি।
চন্দনপুরের বড়বাবুর চার মহলা বাড়ি, গাড়ি ঘোড়া লোকলস্কর, যাকে বলে—‘চার চৌকস’ কপাল। ওঁর বাড়ির মা-লক্ষ্মী—সাক্ষাৎ ‘আজলক্ষ্মী’। ওই মায়ের পায়ের পাজের ধুলো যদি বনওয়ারী পায়, তবে কি আর দেখতে আছে! আর ওই রকম মনিৰ নইলে কি মনিব! ওই মনিবের চাকর হলে এক হাত ছাতি দশ হাত হয়ে ওঠে। লোকের কাছে বলে সুখ কত? তা ছাড়া কত দুর্লভ জিনিস তার আশেপাশে? মেলাখেলায় ঝকমকে আলোর তলায় সারারাত বসে নয়ন ভরে দেখে যে সুখ, ওই রাজবাড়িতে চাকর হয়ে ঠিক সেই সুখ। বনওয়ারীর মন কল্পনায় পুলকিত হয়ে উঠল।
হঠাৎ দাঁড়াল বনওয়ারী। ডাইনে জাঙল—সামনে বাঁশবাদি। বয়ে পুবে মা-কোপাইয়ের ‘পলেনের’ অর্থাৎ পলি-পড়া মাঠে রাখাল ছোঁড়ারা গরু ছাগল ভেড়া ছেড়েছে। সকলে দিব্যি। নিশ্চিন্ত হয়ে গাছতলায় কড়ি খেলছে। এদিকে ওই একটা আলোর পাশে একটা শেয়াল মুখ বাড়িয়েছে দেখা যাচ্ছে; ছাগলগুলো চিৎকার করে ছুটছে, দেখেছে তারা; কিন্তু ভেড়াগুলো এক জায়গায় জমাট হয়ে গায়ে গায়ে বেঁধে দাঁড়িয়েছে। আচ্ছা জাত! চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়েছে। নিলে বোধহয় একটা। বনওয়ারী হাঁকলে—লিলে রেলিলে রে! এই ছোঁড়ারা!
রাখালেরা চকিত হয়ে খেলা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই শেয়ালটাকে দেখতে পেলে, সঙ্গে সঙ্গে তারা হইহই করে ছুটল।—লে—লে—লে—লে। বনওয়ারী ভারি বিরক্ত হল। বেকুবের দল! সব একদিকে ছুটল। কাহারের ছেলে হয়ে ধুত্ত্ব শেয়ালের ফন্দি জানে না হতভাগারা! হায় হায় হায়! কালীর আড্ডায় দিনরাত গিয়ে গিয়ে ওদের এই দশা, সেখানে দিনরাত দ্যাশ-বিদেশের আজা-উজিরের গল্প। এসব কুলকর্মের কথা তো হয় না, শিখবে কি করে? ওই একটা শেয়াল ছুটে পালাচ্ছে। তা হলে আসল শিকারি পিছন দিকে কোথাও আছে নিশ্চয়। এই ফাঁকে সে এসে একটা ভেড়ার বাচ্চা নিয়ে পালাবে। আচ্ছা ধূর্তের জাত! রাখাল থাকলে ধূর্তেরা এইভাবে একটা এক দিকে দেখা দেবেউলটো দিকে লুকিয়ে থাকবে আর একটা কি দুটো। রাখালেরা যেমনই ছুটবে দেখা-দেওয়া ধূৰ্তটার দিকে, অমনিই পিছন দিক থেকে সেটা বার হয়ে ঝপ করে ভেড়া ছাগল যা সামনে পাবে মেরে টেনে নিয়ে পালাবে। সাধে “পণ্ডিত মহাশয়’ বলে শেয়ালকে! কিন্তু এদিকের ধূর্ত পণ্ডিতটি কই? কোথায়? যেখানেই থাক, বনওয়ারী ভেড়ার পালের দিকে ছুটতে লাগল।
সামনে একটা নালা। প্রচণ্ড এক লাফ দিয়ে সশব্দে পার হল বনওয়ারী। সঙ্গে সঙ্গে একটা ‘খ্যা’ করে শব্দ হল, তারপরই নালার কুল-ঝোপ থেকে সড়াৎ করে বেরিয়ে পালাল একটা শেয়াল। ছুট ছুট-উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে শেয়ালটা। হরি হরি, পণ্ডিত মহাশয় এইখানেই নালাকে পেছনে রেখে কুলবনের ঝোপে ঝোপে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ভেড়াগুলোর দিকে! বনওয়ারী ঠিক হাত পাঁচেক দূরে লা। ফয়ে পড়েছে। ঘাড়ে পড়লে ঠিক হত। ওঃ-ওঃ—এখন ছুটছে পণ্ডিত! ধর্— ধরধর, ধূৰ্তকে ধ! পণ্ডিতকে ধর!
খুব একচোট হেসে ঘোড়াগুলোকে পণ্ডিতদের ধূর্ত বুদ্ধির কৌশল বুঝিয়ে দিয়ে বললে— খবরদার, সবাই মিলে কখনও ছুটে যাবি না, একজনা থাকবি ছাগলভেড়ার কাছে—বড় দেখে একজনা থাকবি। তা লইলে পণ্ডিত দাঁত মেলে খ্যাখ্যা করে তেড়ে এসে ছেলেমানুষকে ভয় দেখিয়ে কাজ হাসিল করে পালাবে। তারপর বললে—ককেটায় আগুন আছে? ট্যাক থেকে বিড়ি বার করলে সে। ধরিয়ে নিলে।
ওই কত্তার ‘থান’ দেখা যাচ্ছে। প্রণাম করলে বনওয়ারী। বাড়ি ফিরতে গিয়ে গায়ের ধারে এসে মনে পড়ল-বড় ভুল হয়ে গিয়েছে। বউ বলেছিল—“চার পয়সার পোস্তদানা আনতে। ভুলে গিয়েছে। জাঙলে পানার মনিবের দোকান থেকে নিয়ে গেলে হত। কিন্তু না, থাক্। ধার সে নেবে। না। চার আনা পয়সার দু আনা নিজে খেয়েছে, দু আনা দিয়েছে সিধুকে। এতে তার মন খুশি হয়েছে—সিধুকে পয়সা দিয়েছে, এতে তার মন ভারি খুশি। আহা, ‘দুভাগ’ মেয়ে! সিধু এখন আঁস্তাকুড়ের অন্নের সমান। আঁস্তাকুড়ে যে অন্ন পড়ে, সে অন্ন আর তুলে নেবার উপায় নাই। কিন্তু সে অন্নও তো লক্ষ্মী! তার জন্য মন না কেঁদে তো পারে না।
এর কয়েকদিন পরেই হাঁসুলী বাঁকে কাহারপাড়া বাঁশবাঁদিতে আবার একবার বাদ্যি বেজে উঠল। এবার বাজল ঢোল কাঁসি সানাই –কুরুতাক-কুরুতাক-কুরুম-কুরুম। বায়েন এসেছিল একদল, ঢোল কাঁসি সানাই। মেয়েরা এবার দিচ্ছে উলু-উলু-উলু-লু-লু-লু। তারই সঙ্গে ঢুলী বাজাচ্ছে—কুরুর—কুরুর–কুরুর—তাক—তাক–তাক। কাসিতে বাজল কাঁই—কাঁই-কাঁই। সানায়ে সুর উঠল—আহা মরি মরি মরি রে মরি, শ্যামের পাশে রাইকিশোরী। বাঁশবাঁদির বাঁশবনে-বনে চঞ্চল হয়ে উঠল পাখির কঁক; তলায় আদ্যিকালের পচা এবং শুকনো। পাতার মধ্যে থেকে দু-চারটা খরগোশ বার হয়ে ছুটে পালাল নদীর ধারের জঙ্গলের দিকে। শিয়ালগুলি এত ভীরু নয়, তারা প্রথমটা একবার চঞ্চল হয়েই স্থির হল। সাহেবডাঙার দিকে বুনো শুয়োরগুলো নিজেদের আড্ডায় বার কয়েক গো-গোঁ করে উঠল। শীতকালের আমেজ এখনও আছে, সাপেরা এখনও মাটির তলায় না-খেয়ে ‘ছ-মেসে দম নিয়ে অসাড় হয়ে ঘুমুচ্ছে—তারা মাথা তুলতে চেষ্টা করলে; কিন্তু পারলে না। পাখী ও করালীর বিয়ে।
কাহারপাড়ায় মাত লাগল। তেল হলুদ রঙ নিয়ে মাতামাতি। করালীর সঙ্গে পাখীর সাঙা, অর্থাৎ দ্বিতীয় বিবাহ। নসুরাম–করালীর নসুদিদি–গাছকোমর বেঁধে তেল-হলুদ মেখে, কাপড়ে রঙ নিয়ে হা-হা করে আসছে আর গাইছে— ‘আমার বিয়ে যেমন তেমন—দাদার বিয়ের আয়বেঁশে-আয় ঢকাঢক্ মদ খেসে।”
প্রচুর মদ, বড় বড় হাঁড়ি থেকে বাটি ভরে তুলে ঢেলে দিচ্ছে একজন, সকলে আকণ্ঠ পান। করছে। করালী দরাজ হাতে খরচ করছে। তার সঙ্গে কাহারপাড়ার কার সঙ্গ? সে হ্যাট হ্যাট করে তাড়িয়ে লাঙ্গল চষে না, হিম্-প্লো হাঁক হেঁকে পালকি বয়ে খায় না, সে ‘অ্যাল’ কোম্পানিতে চাকরি করে, নগদ ‘ওজকার’। সে সেটা দেখিয়ে দিতে চায়, বুঝিয়ে দিতে চায় এই সুযোগে। সে দেড় কুড়ি টাকা নগদ খরচ করেছে। খাসি কিনেছে, ছোলার ডাল কিনেছে— জ্ঞাতিভোজনে সে চুনোপ্টির অম্বল আর কাচা কলাইয়ের ডাল দিয়ে ভাত দেবে না। পাখীকে শাখা-শাড়ি-সিঁদুর-নোয়া ছাড়াও দেবে অনেক জিনিস, অনেক গয়না; রুপদস্তার নয়, রুপোর গয়না। হাতে চারগাছা করে আটগাছা চুড়ি, গলায় দড়ি-হার, কোমরে এ ছাড়া একপ্রস্থ গিলটির গয়না—সুতহার, পার্শী মাকড়ি, হাতে বাজু অনন্ত বালা। পাড়ার ঝিউড়ী-বউড়ীরা ধন্য ধন্য করেছে করালীকে। ছেলে-ছোকরারাও বাহবা দিচ্ছে। মনে মনে ঠিক করছে, রেল কোম্পানির ওই আজব কারখানায় চাকরির চেষ্টা ওরাও অতঃপর করবে। পরক্ষণেই দমে যাচ্ছে। যে মাতব্বর। আছে, সে কি ও-মুখে কাউকে হাঁটতে দেবে? করালীর মত বুকের পাটা তাদের নয়, তারা বনওয়ারী মাতব্বরকে অমান্য করে রেল কোম্পানিতে খাটতে যেতে পারবে না। সঙ্গে সঙ্গে মনের সামনে ভেসে ওঠে বনওয়ারীর মূর্তি। চোখ বড় করে হাত তুলে বলছে, পিতি নুরুষের বারণ। সাবোধান।
কিন্তু বনওয়ারী মাতব্বর হয়ত করালীকেও এবার কায়দা করলে। তাকে বার বার প্রতিজ্ঞা। করিয়ে নিয়েছে, পঞ্চায়েতের হুকুম অমান্য করা চলবে না। দেবতা-গোঁসাইকে মানতে হবে, অনাচার অধৰ্ম করবে না। পাকাচুলের কথা না-শোন না-ই শুনবে, কিন্তু প্ৰবীণ মুরুরি ‘রপমান’ কখনও করবে না; করালী সে প্রতিজ্ঞা করেছে।
এই বিয়ের খরচ নিয়েও বনওয়ারী তাকে বলেছিল—এত ভাল লয় করালী। যা রয় সয় তা করতে হয়। এত খরচ করতে তু পাবি কোথা?
করালী অন্য সময় হলে বলত—আজারা মানিক কোথা পায়? নিশ্চয় বলত এ কথা এবং মুখ টিপে হেসে ঠোট বেঁকিয়ে বলত কথাটা। কিন্তু এবার সে হাত জোড় করে বনওয়ারীকে বললে— হেই কাকা, তোমাকে জোড় হাত করে এবার বোলছি, এবার কিছু বোলো না। বিয়ে আমার পাখীর সঙ্গে।
বনওয়ারী পরিতুষ্ট হয়ে হেসে বললে—আচ্ছা আচ্ছা। তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে করালীকে একটু আড়ালে ডেকে প্রশ্ন করলে, কিন্তুক বাবা, একটি কথা বল দেখি নি, এত টাকা তু পেলি কোথা? কোম্পানির কিছু চুরিচামারি করিস নাই তো? দেখ? ফেসাদ হবে না তো ইয়ের পরে?
করালী তার গায়ে হাত দিয়ে বললে—এই তোমার গায়ে হাত দিয়ে বলছি। সেসব ভেবো না তুমি। মাইরি বলছি।
বনওয়ারী চলে গেল বসনের বাড়ির দিকে। করালীর কাকা, পাখীর মামা সে, পাড়ার মাতব্বর, তার দায়িত্ব কত!
করালী হলুদ তেল মেখে স্নান করে টেরি কাটতে বসল। নতুন আয়না চিরুনি কিনেছে। গোলাপী রঙের বুকে-ফুল-কাটা গেঞ্জি গায়ে দেবে। নতুন একখানা মিহি ধুতি হলুদ রঙে রাঙিয়েছে; সেগুলো নসুদিদি সামনে রাখলে পাট করে। আর রাখলে একখানা বাহারের ‘থইলো অর্থাৎ তোয়ালে; করালী বলে—তইলা, নসু বলে থইলা। কাহারপাড়ার উপকথায় বরের সাজসজ্জায়—করালী কলিযুগ এনেছে, কলিযুগের ছেলেছোকরা ঝিউড়ী-বউড়ীরা এ সব দেখে মোহিত হলেও প্রবীণেরা এটা বরদাশত করতে পারছে না। তারা সবাই একটু ভুরু কুঁচকে। এড়িয়ে চলছে। আপনাদের মধ্যে বলছে, এতটা ভাল নয়। মদের গন্ধেও তাদের মন খুব সরস হয়ে উঠছে না। অবশ্য দু-এক পাত্র করে সবাই খেয়েছে; কিন্তু ছোকরা এবং মেয়েদের মত মাতনে মন মেতে উঠতে চাচ্ছে না তাদের। তবে বড় সুন্দর দেখাচ্ছে করালীকে। যেমন জোয়ান, তেমনই সুন্দর, তেমনই পোশাক। কাহারপাড়ায় ও যেন মোহন সাজে এক নতুন নটবর এসেছে।
প্ৰহ্লাদ হল বনওয়ারীর পরের মান্যের লোক। সে সবচেয়ে বেশি বিরক্ত। সে বললেই মুখ খুলে কাজটা ভাল করলে না বনওয়ারী ভাই। মাতব্বরের মতন কাজ হল না। করালীকে শাসন না। করে তার দণ্ড না করে এই ‘পেকার’ ‘আসকারা’ দিলে, এর ফল ভাল হবে না। তাও একজনার ঘর ভেঙে
গুপী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে—ভাই রে, ওই নয়ানের বাপের ‘পেতাপ’ কত ভেবে দেখ। ‘মানুষের দশ দশা, কখনও হাতি কখনও মশা’। মাতব্বরের এ বিচার ভাল হল না।
রতন–লটবরের বাপ; অবাধ্য ছেলে লটবর, করালীর অনুরক্ত ভক্ত। অবাধ্য ছেলের দায়ে। রতনকে করালীর অর্থাৎ লটবরের দলের টান টানতে হয়, সে বললে—তা ছোকরা বাহাদুর বটে। করলে খুব।
নিমতেলে পানু অল্পবয়সী হলেও প্রবীণদের দলেই চলে ফেরে, সে ফুট কাটতে অদ্বিতীয়, সে বললে লুট লুটলুটের পয়সা বুঝলে? আমাদের মত চাষে খেটে মাথার ঘাম পায়ে ফেলায়ে এই ধুম করতে পারত, তবে বুঝতাম। বুল্লে কিনা, অ্যালের পুরানো ‘সিপাট’ কাঠ। চুরি করে চন্ননপুরে কতজনাকে বিক্রি করেছে—সে আমি জানি।
বনওয়ারী চুপ করে ভাবছে। মনে পড়েছে আগুনের আঁচে-ভরা বাঁশতলা, মনে পড়েছে। বটতলায় কালোবউয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা।
করালী এসে দাঁড়াল তাদের সামনে। তার বগলে দুটো পাকী মদের বোতল। নামিয়ে দিলে প্ৰহ্লাদ-রতনের সামনে।—নাও কাকা, আরম্ভ কর, আরও আছে।
ওদিকে গাল দিচ্ছে নয়ানের মা।
নয়ান চুপ করে বসে আছে নিজের দাওয়ায়। বুকটা ‘দুঁপছে’, পাজরাগুলো উঠছে, নামছে, কালো কঙ্কালসার বেড়ানো মুখের মধ্যে সাদা চোখ দুটো হাঁসুলী বাঁকের মাথায় কত্তাবাবার থানের দিকে চেয়ে রয়েছে—স্থির নিম্পলক হয়ে। সে মনে মনে বাবাকে ডাকছে। আর কল্পনা করছে ভীষণ কল্পনা।
নয়ানের মা তারস্বরে গালাগাল দিচ্ছে, অভিসম্পাত দিচ্ছে করালীকে এবং পাখীকে। কত্তাবাবাকে, কালরুদ্রকে ডাকছে বিচার করবার জন্য। সমস্ত সমাজের প্রবীণদের উদ্দেশে বনওয়ারীর আচরণের প্রতিবাদ করবার জন্য বলছে—মঈল নাই, মঙ্গল নাই, এমন মাতব্বর যেখানে। মধ্যে মধ্যে তাদের অর্থাৎ ঘরভাঙাদের পূর্বগৌরব স্মরণ করে বিলাপ করছে। বনওয়ারী মাতব্বর। মাতব্বরের এই কি বিচার? এমন মাতব্বর যেখানে, সেখানের মঙ্গল নাই। একজনের ঘর ভেঙে দিয়ে আর একজনের ঘর গড়ার নাম মাতব্বরি? শত্ৰুর, চিরকালের শত্রুর ওই কোশকেঁধেরা এই ঘরভাঙাদের বাড়ির। এই বাড়ি ছিল একদিন মাতব্বরের বাড়ি, এই বাড়ির উঠানে উবু হয়ে বসে লোকের বাপ-ঠাকুরের হাঁটুতে পাছায় কড়া পড়েছে। তারপর অনাথা ছেলের কালে উড়ে এসে জুড়ে বসল। হালে উঠতি ঘোষবাবুদের দেমাকে বড়কে বড় মানলে না, ‘গায়ে মানে না আপনি মোড়ল’ হয়ে পড়ল। বিধেতা এর বিচার করবেন।
নয়ন বসে বসে ওই ন্যাড়ামাথা, গলায় রুদ্রাক্ষ, ধবধবে পৈতে, পরনে গেরুয়া, পায়ে খড়ম-কত্তাঠাকুরকে যেন মনশ্চক্ষে দেখছে। বেলগাছতলায় দাঁড়িয়ে আছেন—একটি কুটিল চোখের তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে। চেয়ে আছেন তিনি করালীর ঘরের দিকে। পায়ের তলায় পড়ে আছে সেই বিরাট চন্দ্রবোড়া–করালী যাকে মেরে বাহাদুরি নিয়েছে। সে কি মরে? বাবার সাপ সে! কত্তার বাহন। সে বেঁচে উঠেছে। কলক করে জিব নাড়ছে। বাসরঘরে ওই সাপ ঢুকবে।
বসনের বাড়িতেও অনেক মদ, অনেক নেশা, অনেক নাচ, অনেক গান। সুচাঁদ বলে—সিঁদুরের মত ‘অঙ’ লাগবে চোখে, তবে তো বিয়ের মাতন। চারিদিকে ‘আতদিন’ অক্তসন্ধে নেগে থাকবে।
সুচাঁদের সে রঙ চোখে লেগেছে।
প্রথমটায় সে কিছুটা মদ্যপান করে বসে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেছে; তারপর একটা বাটিতে মদ আর আঁচলে মুড়ি লঙ্কা নিয়ে বাঁশবনের ধারে বসে কেঁদেছে। কেঁদেছে তার মরা বাপের জন্য, মরা জামাই অর্থাৎ পাখীর বাপের জন্য আঃ, এমন দিনে তারা বেঁচে নাই। মধ্যে মধ্যে চোখ মুছে কান্না বন্ধ করে মুখে মুড়ি চিবিয়ে লঙ্কার ঝাল জিবে ঠেকিয়ে মদ খেয়ে নিচ্ছিল।
তাকে ডেকে নিয়ে গেল বসন। তখন সুচাঁদ কাঁদছিল মরা জামাইয়ের জন্য। বসনও। কাদলে। সে কাঁদলে শুধু মৃত স্বামীর জন্য নয়, জাঙলের চৌধুরী-বাড়ির ছেলের জন্য, কাঁদলে। ‘তিনি’ যদি আজ বেঁচে থাকত। পাখীর মুখ অবিকল তার মত। তেমনিই তারই মত গোরা রঙ। রঙ-কালো বসনের কোলে ছেলেবেলার ফরসা-রঙ পাখীকে যা চমৎকার মানাত! যেন সবুজ গাঁদা গাছে হলুদ রঙের গাঁদা ফুল ফুটেছে। এই কথাটি বলত চৌধুরীবাবুর ছেলে নিজে। তিনি থাকলে কত ধুম করত বসন।
সুচাঁদ উঠে আবার মদ্যপান করে এবার উঠানে বসেই হঠাৎ কাঁদতে লাগল। মেয়েরা গান করছিল। রঙের গান। কান্না শুনে সকলে স্তব্ধ হয়ে গেল; সুচাঁদ এবার ভয়ঙ্কর নাম ধরে কাঁদছে। বাবার নাম ধরে।
–ওগো কত্তাবাবা গো, ওগো কত্তাঠাকুর গো! মতিচ্ছন্ন ধরেছে। সবার মতিচ্ছন্ন ঘটেছে। বাবা; তোমার বাহন মারার পিতিবিধেন হল না বাবা। তোমার মহিমে তুমি পেচার কর বাবা। তোমার বাহনকে বাচাও তুমি বাবা।
বাবার বাহন; সেই চন্দ্রবোড়া সাপটি। বসন থরথর করে কেঁপে উঠল। পাখী চমকে উঠল।
বনওয়ারী বসনদের বাড়ি থেকে ফিরে যাবার পথে একটা গাছতলায় থমকে দাঁড়িয়ে শুনছিল নয়ানের মায়ের গালিগালাজ। ওই সঙ্গে সুচাঁদের বিলাপ তার কানে যেতেই সে বিস্ফারিত চোখে ঘুরে দাঁড়াল। করালী সাপটিকে মেরেছে। এ বিরাট অজগর তার প্রথম অস্তিত্ব জানিয়েছিল ওই বাবার ‘খান’ থেকে। সে যে বাবার বাহন, তাতে তো তারও সন্দেহ নাই। সেও থরথর করে কেঁপে উঠল।
—হে বাবা! হে কত্তাঠাকুর! হে কাহারদের মা-বাপ! মাৰ্জ্জনা কর বাবা, মাৰ্জ্জনা কর। অবোধ মুখ করালীকে মাৰ্জ্জনা কর। বনওয়ারীকে মাৰ্জ্জনা কর। পুজো দোব বাবা, আবার পুজো দোব।
সন্ধ্যার আঁধার তখন ঘনিয়ে আসছে। বাঁশবনের তলায় জমেছে অপদেবতার ছোঁয়াচ-লাগা থমথমে ভর-সনজের মুখ আঁধারি। সেই অন্ধকারের মধ্যে চুপি চুপি বনওয়ারী এসে উঠল বাবার থানে। বেলগাছতলায় হাঁটু গেড়ে বসে হাত জোড় করে চোখ বুজে মনে মনে বাবাকে প্ৰাৰ্থনা জানাতে লাগল। বনওয়ারী একজন অতিসাহসী। কতবার কত অপদেবতার অস্তিত্ব সে অনুভব করেছে, কিন্তু ভয় পায় নাই। একবার মনে আছে-সন্ধ্যার পর মাছ নিয়ে আসছিল ওপারের মহিষডহরির বিল থেকে। দুপাশে দুজন এল শেয়ালের রূপ ধরে। এপাশে ওপাশে ঘুরে ঘুরে কত ফাদই তারা পেতেছিল। বনওয়ারী কৌতুক অনুভব করেছিল। কত সন্ধ্যায় বাবার থানে এসে প্রণাম করেছে। রাতদুপুরেও এসেছে। গা কঁপে নাই। আজ চোখ বুজতেই মনে হচ্ছে, বাবা যদি ক্রুদ্ধ হয়ে থাকেন। করালী মেরেছে বাবার বাহনকে, সেই করালীকে সে ফিরিয়ে এনেছে। স্নেহ-সমাদর করে। বাবার ক্রুদ্ধ মূর্তি তার মুদিত চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সেই চিত্ৰবিচিত্র শিস-দেওয়া চন্দ্রবোড়া দেখতে দেখতে ফুলে ফুলে মাথা তুলে উঠতে থাকে মাথা ওঠে তালগাছের ডগায়, চোখের দৃষ্টিতে ধকধক করে আগুন, গায়ের চিত্ৰবিচিত্র দাগগুলি বাড়তে থাকে, জিব ওঠে কলকিয়ে-কামারের আগুনে তাতানো অগ্নি-‘বন’ ইস্পাতের মত; সেই অজগরের মাথায় খড়ম পায়ে দিয়ে, গেরুয়া পরে, ন্যাড়ামাথা বাবাঠাকুর ভেসে ওঠেন। বাবার গলার রুদ্রাক্ষগুলি হয়ে ওঠে মড়ার মাথা, বুকের ধবধবে পৈতে হয়ে ওঠে দুধে-গোখরোর পৈতে।
বনওয়ারী থরথর করে কাঁপতে থাকে।
বহুক্ষণ পর সে কোনোক্রমে শান্ত হয়ে মনে মনে বলে—বাবা, পুজো দোব, মাজ্জনা কর তুমি। তারপর বলে যদি মাজ্জনা না কর বাবা, জানিয়ে দাও। পড়ুক, তোমার গাছ থেকে একটি বেল খসে পড়ুক। আমি মনে মনে পাঁচ কুড়ি গুনছি।
সে গুনতে থাকে। এক দুই তিন চার…এক কুড়ি। আবার এক দুই তিন চার পাঁচ ছয় সাত আট–
পাঁচ কুড়ি শেষ হল।
বেল পড়ল না। বনওয়ারী এবার উঠল সেখান থেকে।
পাড়ায় তখন পরিপূর্ণ মাতন। মুরব্বিরা ভরপেটে পাকী খেয়েছে, টলছে। মেয়েরা নাচছে। আঁধার রাত্রিতেও চারিদিকে যেন রক্তসন্ধ্যার রঙ লেগে রয়েছে। সুচাঁদের উর্ধ্ব অঙ্গে কাপড় নাই। সে নাচছে। কাপড় ধুলোয় লুটুচ্ছে। সেও নাচবে।
বসন করালীও ঠিক করেছে, পুজো দেবে। বনওয়ারী খুশি হল। পুরো বোতল পাকী মদ নিয়ে সে বসল। খেতে খেতে হঠাৎ উঠল। বায়েনদের বাজনা ঠিক হচ্ছে না। হাতে তাল দিয়ে সে বললে—বাজাও বাবা বাজাও—বর আসিল বর আসিল, ও বউ, তুমি অঙ্গ তোল। হা, এ্যা, বাবা, বর নামিল বউ নামিল, ও বর, বউয়ের সান্টি খোল।
কাঁসি-বাজিয়ে ছোকরা নিজেই বলছিল—কাঁই-কঁই-কাঁই—কিটি–কিটি-কাঁই-কাঁই।
বনওয়ারী তাকে বাহবা দিলে—আচ্ছা, আচ্ছা! সঙ্গে সঙ্গে কে চাপা হাসি হেসে উঠল। কে রে? কে? কোন মেয়ে? কার এত বাড়? বনওয়ারী ঘোর-লাগা চোখ তুলে চাইলে। চোখ তুলেই কিন্তু তার রাগ পড়ে গেল।-ওরে বাপ রে! তুমি কখন হে? কি ভাগ্যি আমাদের কি ভাগ্যি! আটপৌরে-পাড়ার মাতব্বরের গিন্নি-কালোবউ! কালোশশী! কালোবউয়ের চোখ যেন কোপাই নদীর দহ। তলাতে কিছু যেন খেলা করছে, উপরে তার ঝিলিক দেখা যায়, কিন্তু ঠিক কিছু বুঝতে পারা যায় না।
কালোবউ তাকাচ্ছে; কোন দিকে? বনওয়ারী চারিদিক চেয়ে দেখলে, চারিদিকে মাতন।
শেষরাত্রে মাতন স্তব্ধ হল। ভোরবেলা কাহারপাড়ায় সেদিন অগাধ ঘুম। বনওয়ারীকে কে। ঠেলে জাগিয়ে দিলে। বনওয়ারী উঠে বসল। বটগাছতলায় ঘুম ভাঙল তার। সামনে রোদের চিকচিকে ছটা যেন হাসছে। বনওয়ারীও হাসলে। কালোবউ নাই।