ষোড়শ পরিচ্ছেদ
দূর হইতে রঙ্গিয়া সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখিল। তাহার কণ্ঠরোধ হইল, এবং সে ভয়ে অত্যন্ত কাঁপিতে লাগিল। মুহূৰ্ত্ত মধ্যে যমুনাদাস তাহার নিকটে আসিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, “আয়।” রঙ্গিয়া দেখিল, অন্ধকারে তাহার চক্ষু নক্ষত্রের ন্যায় জ্বলিতেছে, তাহার হস্ত রক্তে রঞ্জিত, সে অর্দ্ধস্ফুটস্বরে বলিল, “কি করিলে?”
রুষ্ট হইয়া গৰ্জ্জিয়া যমুনাদাস বলিল, “আয়।”
তবুও রঙ্গিয়া সেখান হইতে নড়ে না দেখিয়া যমুনাদাস তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া চলিল। এক স্থানে একখানা ভাড়াটিয়া গাড়ী দাঁড়াইয়াছিল। উভয়ে সেই গাড়ীতে আসিয়া উঠে কোচম্যানকে হাওড়া ষ্টেশনে যাইতে বলিল। গাড়ী চলিল।
তখন যমুনাদাস রঙ্গিয়ার দাড়ি খুলিয়া লইয়া নিজে পরিল। রঙ্গিয়াকে পরিহিত কোণ-ছেঁড়া শাড়ীখানা ছাড়িয়া দিল। বলিল, “পর।” রঙ্গিয়া নীরবে পরিল। ভয়ে রঙ্গিয়ার প্রাণ উড়িয়া গিয়াছিল; সে ভয়ে একটা কথাও মুখ ফুটিয়া বলিতে সাহস করিল না।
যমুনাদাস রঙ্গিয়ার কানের কাছে মুখ লইয়া শাসাইল, কহিল, “যদি একথা কাহারও নিকট প্রকাশ কর, তবে তোমারও দশা হুজুরীমলের মত করিব।”
এই বলিয়া যমুনাদাস সেই রক্তাক্ত ছোরা তাহার বুকের নিকট ধরিল। রঙ্গিয়া ভয়ে চক্ষু মুদিত করিল—তাহার সংজ্ঞা বিলুপ্ত হইল।
হাওড়ায় আসিয়া যমুনাদাস কোচম্যানকে ভাড়া চুকাইয়া দিয়া রঙ্গিয়াকে বলিল, “যা, এখনই চন্দননগরে চলে যা। গঙ্গা জিজ্ঞাসা করিলে বলিস্, হুজুরীমল আসে নাই। অন্য কথা সব আমি নিজে গিয়া বলিব।”
এই বলিয়া যমুনাদাস মুহূৰ্ত্ত মধ্যে তথা হইতে অন্তর্হিত হইল।
রঙ্গিয়া মুহূর্তের জন্য কিংকৰ্ত্তব্যবিমূঢ়া হইয়া দাঁড়াইল। যমুনাদাস চলিয়া যাওয়ায় তাহার হৃদয়ে সাহস দেখা দিল। অঞ্চল ভারী বোধ হওয়াতে হাত দিয়া দেখিল, তাহাতে কি বাঁধা আছে। সে খুলিয়া দেখিল, এক তাড়া নোট। সে তখনই বুঝিল, কাপড় বদলাইবার সময়ে যমুনাদাস তাড়াতাড়িতে নোট ভুলিয়া রাখিয়া গিয়াছে।
সে তীরবেগে কলিকাতার দিকে ছুটিল। সৌভাগ্যের বিষয় তখন পথে লোক ছিল না, নতুবা তাহাকে পাগল বলিয়া ধরিত। গঙ্গার ধারে উমিচাঁদ তাহার জন্য অপেক্ষা করিবে, এইরূপ কথা ছিল। সে হিতাহিত জ্ঞানশূন্যা হইয়া সেইদিকে চলিল।
তাহাকে ছুটিয়া আসিতে দেখিয়া উমিচাঁদ সত্বর পদে তাহার দিকে অগ্রসর হইল। সে তাহার হাতে নোটের তাড়া দিয়া বলিল, “সর্বনাশ হয়েছে—হুজুরীমল খুন! “
সহসা কে আসিয়া রঙ্গিয়াকে আক্রমণ করিল। রঙ্গিয়া পড়িয়া গেল—লোকটাও সেই সঙ্গে সঙ্গে পড়িয়া গেল। উমিচাঁদ দেখিল, এক শাণিত ছোরা শূন্যে উত্থিত হইল। সে আর কিছু দেখিল না- দেখিতে সাহস হইল না, প্রাণভয়ে ছুটিয়া মূহূৰ্ত্ত মধ্যে বহির্ভূত হইয়া গেল।
যমুনাদাস কিছুদূর গিয়াই নিজের ভ্রম বুঝিতে পারিল, সে নোটের তাড়া কাপড়ে বাঁধিয়াছিল। কাপড় যখন রঙ্গিয়াকে পরিবার জন্য দিয়াছিল, তখন তাড়াতাড়িতে সে নোট খুলিয়া লইতে ভুলিয়া গিয়াছিল। রঙ্গিয়াকে ষ্টেশন ছাড়িয়া আসিবামাত্র নোটের কথা মনে পড়িল। তখন সে উন্মত্তের ন্যায় রঙ্গি যার অনুসন্ধানে ছুটিল। যেখানে সে রঙ্গিয়াকে ছাড়িয়া আসিয়াছিল, সেখানে আসিয়া দেখিল, রঙ্গিয়া নাই। সে তাহার জন্য চারিদিকে পাগলের ন্যায় ছুটিল।
সহসা সে দেখিল, রঙ্গিয়া দূরে ছুটিয়া যাইতেছে—দেখিয়াই ছুটিল। রঙ্গিয়া উমিচাদের সহিত দেখা করিতে-না-করিতে যমুনাদাস আসিয়া তাহার উপর পড়িল।
যমুনাদাস এখন উন্মত্ত—হিতাহিত বিবেচনাশূন্য। সে উমিচাঁদকে দেখিয়া ভাবিল, রঙ্গিয়া তাহা হইলে এই লোকটাকে হুজুরীমলের খুনের কথাই বলিতেছে—সে রঙ্গিয়ার পৃষ্ঠে আমূল ছোরা বসাইল। ছোরা বক্ষঃস্থল ভেদ করিয়া বাহির হইয়া পড়িল। উমিচাঁদ একবার অব্যক্ত চীৎকার করিয়া সশঙ্কভাবে দশ হাত তফাতে হটিয়া গেল, এবং তখনই ছুটিয়া পলাইল। যমুনাদাস দ্রুত হস্তে রঙ্গি য়ার ভূলুণ্ঠিত দেহ অনুসন্ধান করিয়া নোট না পাইয়া উমিচাদের পশ্চাতে ছুটিতেছিল, কিন্তু কি ভাবিয়া দাঁড়াইল। রঙ্গিয়ার দেহ জলে ভাসাইয়া দিবার জন্য টানিয়া লইয়া চলিল। এমন সময়ে দূরে পদশব্দ শুনিয়া রঙ্গিয়াকে সেইখানে ফেলিয়া ছুটিয়া পলাইয়া গেল।
উমিচাদের সৌভাগ্য—যমুনাদাস তাহাকে চিনিতে পারে নাই। আরও সৌভাগ্য যে, সে তাহার অনুসরণ করিতে পারিল না।