ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
যমুনাদাস বিচারকালে যেসকল ঘটনা প্রকাশ পাইয়াছিল, তাহাই এক্ষণে আমরা বলিব। যমুনাদাসের পিতা একজন ধনী বণিক ছিলেন। যখন যমুনাদাসের বয়স পঁচিশ বৎসর, সেই সময়ে তাহার পিতার মৃত্যু হয়। তখন হইতে যমুনাদাস কুসঙ্গে মিলিত হয়। এবং এক বৎসরের মধ্যে তাহার পিতার সমস্ত সম্পত্তি উড়াইয়া দেয়। তখন নানা জাল জুয়াচুরি করিয়া শেষে এদেশ ছাড়িয়া পলাইয়া যায়। সেই পর্য্যন্ত আর পাঁচ-ছয় বৎসর সে এদেশে আসে নাই। কেহ তাহার সংবাদ বলিতে পারিত না। নানা স্থানে নানা নাম লইয়া নানা জুয়াচুরি করিয়া বাবুগিরি চালাইত।
এইরূপে জুয়াচুরির জন্য আগ্রায় তাহার তিন মাস জেল হয়। জেল হইতে বাহির হইয়া আসিয়া সে আরও ভয়ানক হইয়া উঠিল; কিন্তু আবার ধরা পড়িল। সেইবার তাহার এক বৎসর জেল হইল। কিন্তু ইহাতেও তাহার শিক্ষা হইল না। কিছুদিন পরে সে আবার তিন বৎসরের জন্য জেলে প্রেরিত হইল।
জেল হইতে বাহির হইয়া সে লাহোরে যায়। সেখানেই সেই জুয়াচুরি। এই সময়ে লাহোরে তাহার সহিত গঙ্গার আলাপ হয়—সমানে সমানে মিলিল। গঙ্গার সহিত তাহার অবৈধ প্রণয় জন্মিল, বিবাহের কথাও হইল।
গঙ্গার মা-বাপ ছিল না। হুজুরীমলের শ্বশুর তাহাকে আশ্রয় দিয়াছিলেন। তাহার স্বভাব যে কিরূপ তাহা তিনি জানিতেন না।
যমুনাদাস পঞ্জাবে থাকিতে সিঁদুরমাখা শিবলিঙ্গের সম্প্রদায়ের কথা জানিতে পারে; দিন কয়েকের জন্য তাহাদের দলে মিশিয়া পড়ে; তাহাদের ঠকাইয়াও অনেক টাকা লইয়াছিল। এই সম্প্রদায়ের লোক যে খুন করে, এ সর্বৈব মিথ্যা—তাহারা একরূপ তান্ত্রিক প্রক্রিয়া গোপনে করিত এই মাত্র। এই সম্প্রদায়ে প্রবেশ করিয়াই এ কয়েকটা শিবলিঙ্গ সংগ্রহ করে। লোককে ভয় দেখাইয়া টাকা আদায়ের সুবিধা হয় দেখিয়া যমুনাদাসই প্রকাশ করিয়া দেয় যে, এই সম্প্রদায় যাহার উপর ক্রুদ্ধ হয়, তাহাকে গোপনে খুন করে। সে নানা কৌশলে অনেকের মনে বিশ্বাও জন্মাইয়া ছিল; পরে সিঁদুরমাখা শিবের ভয় দেখাইয়া অনেকের নিকটেই টাকা আদায় করিয়াছিল।
এইরূপ নানা জুয়াচুরি করিয়া সে চালাইতেছিল। যখন গঙ্গা হুজুরীমলের স্ত্রীর নিকট যমুনার সঙ্গে আসিল, তখন যমুনাদাসও কলিকাতায় আসিল। পাঁচ-সাত বৎসর সে এদেশে ছিল না, সুতরাং সকলেই তাহাকে একরকম ভুলিয়া গিয়াছিল। তাহার আর কোন ভয় করিবার কারণ ছিল না। এখানে আসিয়াও সে নিজের ব্যবসা ভুলিল না। গঙ্গার সাহায্যে বৃদ্ধ হুজুরীমলকে ভুলাইয়া তাহার নিকট হইতে মধ্যে মধ্যে টাকা সংগ্রহ করিত। গঙ্গা ললিতাপ্রসাদের মাথা খাইয়াও তাহার সর্ব্বনাশ করিতেছিল। তাহার নিকটেও অনেক টাকা আদায় করিতেছিল। এইরূপে উভয়ে খুব জোরে ব্যবসা চালাইতেছিল।।
এইরূপ সময়ে হুজুরীমল সৰ্ব্বস্বান্ত হইয়া কি করিবে, তাহাই ভাবিতেছিল। হঠাৎ গুরুগোবিন্দ সিং আসিয়া তাহার নিকটে দশ হাজার টাকা জমা রাখিল। বৃদ্ধ লম্পট জুয়াড়ী লোভ সম্বরণ করিতে পারিল না। সেই টাকা লইয়া এদেশ হইতে পলাইবার ইচ্ছা করিল।
কিন্তু সে প্রাণ ধরিয়া গঙ্গাকে ছাড়িয়া যাইতে পারে না, সে গঙ্গাকে এ প্রস্তাব করিল। দশ হাজার টাকা দিলে গঙ্গা তাহার সহিত পলাইতে স্বীকার করিল। বলা বাহুল্য যে, পূর্ব্বে এবিষয়ে সে যমুনাদাসের সহিত পরামর্শ করিয়াছিল।
তখন হুজুরীমল টাকা হস্তগত করিবার চেষ্টায় রহিল। সে সুকৌশলে ললিতাপ্রসাদকে দিয়া নোটগুলি বদ্লাইল। তৎপরে শিব-সম্প্রদায়ের সর্ব্বপ্রকার মিথ্যা গল্প বলিয়া সরলচিত্ত যমুনাকে ভুলাইয়া তাহারই দ্বারা সিন্দুক হইতে নোট সরাইল। এদিকে সব স্থির—রেল টিকিট পর্যন্ত কেনা হইল, গঙ্গাও তাহার সহিত যাইতে সম্মত হইয়াছে, মূর্খ বৃদ্ধ হুজুরীমল বিন্দুমাত্রও বুঝিতে পারিল না যে, গঙ্গা কেবল তাহাকে ভুলাইয়া দশ হাজার টাকা হস্তগত করিবার চেষ্টায় আছে।
এই সময়ে এক মহা বিঘ্ন ঘটিল। গঙ্গা কোন কাজে কখনও ভয় করে নাই। আজ হুজুরীমলের সঙ্গে রাত্রে রাণীর গলিতে দেখা করিতে তাহার ভয় হইল। সে যাইতে অসম্মত হইল। যমুনাদাস বিপদে পড়িল।