দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
তখন সেই ব্যক্তি বলিল, “যখন নিজ মূর্খতায় ধরা পড়িয়াছি, তখন পলাইব না; আমাকে উঠিয়া বসিতে দাও।”
দুইজন মহা বলবান্ কনষ্টেবল তাহার বুকের উপরে বসিয়াছিল। অক্ষয়কুমার স্তম্ভিতভাবে দাঁড়াইয়াছিলেন। নগেন্দ্রনাথ জীবনে এরূপ বিস্মিত আর কখনও হন নাই। তাঁহারা যাহাকে এক মুহূর্ত্তের জন্যও সন্দেহ করেন নাই, সেই ব্যক্তি এই ভয়াবহ দুই খুন করিয়াছে। নগেন্দ্রনাথের কন্ঠোরোধ হইয়া গিয়াছিল।
অক্ষয়কুমারের অবস্থাও প্রায় তদ্রূপ। তবে পুলিসের লোক, শীঘ্রই আত্মসংযম করিলেন। কিয়ৎক্ষণ এক দৃষ্টে লোকটার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, মহাশয়ের বিশেষ বাহাদুরী আছে, একথা এই অক্ষয়চন্দ্র দু’ হাজারবার স্বীকার করে।”
লোকটি বলিল, “টাকার লোভেই আমার এ দশা হইল, টাকার অভাবে পড়িয়াই এ কাজ করিয়াছিলাম—টাকার লোভে পড়িয়াই ধরা পড়িলাম; নতুবা আমাকে তোমরা কিছুতেই ধরিতে পারিতে না।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “কতকটা স্বীকার করি।”
ব্যাপার দেখিয়া নগেন্দ্রনাথের এতক্ষণ কথা সরে নাই। তিনি বলিলেন, “যমুনাদাস, তোমার এই কাজ!”
যমুনাদাস কেবলমাত্র বিকট হাস্য করিল। ঘৃণায় দুঃখে ক্রোধে নগেন্দ্রনাথ মুখ অন্যদিকে ফিরাইলেন। অক্ষয়কুমার হাসিয়া বলিলেন, “এতদিনে আমি হার মানিলাম। সত্য কথা বলিতে কি, আমি কখনও তোমাকে সন্দেহ করি নাই।”
যমুনাদাস কোন কথা কহিল না; আবার সেইরূপ বিকট হাস্য করিল।
নগেন্দ্রনাথ আর ক্রোধ সম্বরণ করিতে পারিলেন না। বলিলেন, “নারকী, তোমার লজ্জা হইতেছে না, তুমি আবার হাসিতেছ।”
নগেন্দ্রনাথের রাগ দেখিয়া অক্ষয়কুমার হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “বন্ধুর এ দশা দেখিয়া রাগ করিয়া কি লাভ?”
নগেন্দ্রনাথ ক্রোধে অস্থির হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “বন্ধু? ও কোনকালে আমার বন্ধু নয়—একসময়ে ছেলেবেলায় একসঙ্গে পড়িয়াছিলাম, এইমাত্র।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “যাহাই হউক, বন্ধুবর যমুনাদাস! আপনার যদি আমাদের কাছে আপন কাহিনী বলিতে আপত্তি না থাকে, তাহা হইলে বলিলে বিশেষ বাধিত হইব। তবে ইহাও আপনাকে আমার পূর্ব্বেই বলা কর্ত্তব্য যে, আপনি আমার সম্মুখে এখন যাহা বলিবেন, তাহা আপনার বিরুদ্ধে যাইবে; সুতরাং বলা-না-বলা সে আপনার অভিরুচি।”
যমুনাদাস কিয়ৎক্ষণ নীরবে থাকিয়া বলিল, “আমি খুন করিয়াছি, কে বলিল? ভদ্রলোকের উপর এইরূপ অত্যাচার করিলে কি হয়, তাহা শীঘ্রই দেখিতে পাইবে।”
নগেন্দ্রনাথ গৰ্জ্জন করিয়া বলিলেন, “আবার মিথ্যাকথা! “
অক্ষয়কুমার তাঁহাকে নিরস্ত হইতে বলিয়া উমিচাঁদকে ধীরে ধীরে বলিলেন, “মহাশয়, একটু পূর্ব্বে আমাদের এই পাঁচ মূর্ত্তির সম্মুখে খুন স্বীকার করিয়াছেন।”
যমুনাদাস ক্রুদ্ধস্বরে বলিল, “আমি কিছুই স্বীকার করি নাই—মিথ্যা কথা। তোমরা ঘুস্ পাইবার আশায় আমার উপর এই অত্যাচার করিতেছ, ইহার প্রতিফল পাইবে।”
ক্রোধে নগেন্দ্রনাথের মুখ দিয়া বাক্যস্ফুরণ হইল না। অক্ষয়কুমার মৃদুহাস্য করিয়া বলিলেন, “তবে থানায় চলুন, দিন কত এখন মহারাণীর রাজপ্রাসাদে বাস করুন; পরে ভবিতব্য কে খণ্ডায় আপনাদের মত মহাত্মাগণের জন্যই ফাঁসী-কাষ্ঠের সৃষ্টি হইয়াছে। তবে বোধহয়, আপনার ন্যায় আর একটীও এ পর্য্যন্ত ফাঁসী যায় নাই। রাম সিং, বাবুকে বালা পরাইয়া লইয়া চল।”
রাম সিং হুকুম পাইবামাত্র যমুনাদাসের হাতে হাতকড়ী লাগাইয়া দিল। এবং দুই-একটা মধুরতর সম্পর্ক পাতাইয়া, দুই-একটা ধাক্কা দিয়া তাহাকে টানিয়া তুলিল। রাম সিং ও আর একজন পুলিস কর্ম্মচারী চাদর দিয়া যমুনাদাসের দুই বাহু বন্ধন করিয়া লইয়া চলিল। যমুনাদাস কোন কথা কহিল না।
কিয়দ্দূর আসিয়া অক্ষয়কুমার যমুনাদাসের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “যমুনাদাসবাবু, পূর্ব্বে আর কয়টা এরূপ সরাইয়াছেন?”
যমুনাদাস কোন উত্তর না দিয়া তাহার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে একবার চাহিয়া অন্যদিকে মুখ ফিরাইল। অক্ষয়কুমার বলিলেন, “বাপু, জেলে দু-চারবার না গেলে অমন চোখের কায়দা হয় না। মহাশয়ের কয়বার জেলের প্রতি অনুগ্রহ করা হইয়াছে? না বলেন, উত্তম। সে কার্য্য আমরা সহজেই করিতে পারিব। এটায় একটু কষ্ট দিয়াছেন, স্বীকার করি।”