নবম পরিচ্ছেদ
অনিচ্ছাসত্ত্বেও নগেন্দ্রনাথ এই খুনের বিষয় মনে মনে আলোচনা না করিয়া থাকিতে পারিলেন না। যেদিন হইতে এই খুন হইয়াছে, সেইদিন হইতে তাঁহার আহার নিদ্রা গিয়াছে—তাঁহার লেখা পড়া বন্ধ হইয়াছে; তিনি দিন রাত্রি এই বিষয় লইয়াই আলোচনা করেন। তিনিও দুই-তিনখানা ডিটেক্টিভ উপন্যাস লিখিয়াছেন, কিন্তু এরূপ রহস্যপূর্ণ একখানাও লিখিতে পারেন নাই। তিনি ভাবিলেন, এই পৰ্য্যন্ত লিখিয়া যদি কেহ তাঁহাকে এই উপন্যাসের উপসংহার লিখিতে বলে, তাহা হইলেই চক্ষুঃস্থির। কিরূপভাবে উপসংহার করিলে ইহা হৃদয়গ্রাহী হইতে পারে, কল্পনা-রাজ্যে তেমন কিছুই খুঁজিয়া পাইলেন না। এ খুনের রহস্য যে কখন প্রকাশ পাইবে, সে বিষয়ে তিনি হতাশ হইয়াছিলেন।
অদ্য রাত্রে খুনী নিশ্চয়ই ধরা পড়িবে, অক্ষয়কুমার সে বিষয়ে নিশ্চিত হইয়াছেন; কিন্তু নগেন্দ্ৰনাথ এই কয়দিনে দেখিয়াছেন যে, তিনি খুব বিচক্ষণ ডিটেক্টিভ হইয়াও প্রতিপদে বিলক্ষণ ভুল করিয়াছেন, এ পর্যন্ত তাঁহার অনুমান একটাও সত্য হয় নাই। তিনি যখন যেটা ঠিক মনে করিয়াছেন, পরে দেখা গিয়াছে, সেটা ঠিক নহে—তাঁহার ভুল হইয়াছে।
অদ্যও তিনি বলিতেছেন যে, খুনীই উমিচাঁদকে পত্র লিখিয়াছে, খুনীই উমিচাঁদের সহিত দেখা করিতে আসিবে; কিন্তু যে দুই-দুইটা খুন করিয়া এতদিন সকলের চোখে ধূলি দিয়া নিরাপদে আছে, সে কি সহসা এমনই উন্মত্ত হইয়া উঠিল যে, উমিচাদের সহিত এরূপভাবে দেখা করিতে প্রস্তুত হইবে? তাহার কি ধরা পড়িবার ভয় নাই? টাকার লোভে উমিচাদের সঙ্গে দেখা করিতে পারে, কিন্তু উমিচাঁদ যে তাহাকে ধরাইয়া দিতে পারে, এ বিষয় কি সে একবারও মনে করে নাই? তবে ইহাও সম্ভব যে, সে ভাবিতে পারে উমিচাঁদ নিজের প্রাণের ভয়ে একথা প্রকাশ করিবে না। তাহার সহিত টাকার একটা অংশ করিয়া লইলে সে পরে নিজের রক্ষার জন্যই একথা গোপন করিবে। আর যদি ললিতাপ্রসাদই খুনী হয়, তবে সে ভাবিয়াছে, উমিচাঁদ কখনই তাহার বিরুদ্ধে যাইতে সাহস করিবে না—তাহা হইলে সে অনায়াসেই উমিচাঁদকে খুনী বলিয়া ধরাইয়া দিতে পারিবে। এ লোক যে-ই হউক, সে জানে না যে, উমিচাঁদ অনুতাপের জন্যই হউক, আর ভয়েই হউক, টাকা গুরুগোবিন্দ সিংহকে ফেরৎ দিয়াছে, তাহার নিকটে টাকা নাই। তাহার নিকটে টাকা নাই জানিলে সে কখনও তাহার সহিত এরূপভাবে দেখা করিতে চাহিত না। আর এ সমস্তই উমিচাঁদের চাতুরীও হইতে পারে। উমিচাঁদ এ পৰ্য্যন্ত যাহা বলিয়াছে, সমস্তই মিথ্যা—তাহার একটা কথাও সত্য নহে। কেবল অক্ষয়বাবুর চোখে ধূলি দেওয়াই তাহার উদ্দেশ্য। লোকটা যে ঘোরতর বদমাইস, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই, সম্ভবতঃ বেটা নিজেই বা কোন গুণ্ডা দিয়া টাকার লোভে হুজুরীমলকে খুন করিয়াছিল, কারণ সে হুজুরীমলের সকল কথাই জানিত। তাহার পর রঙ্গি য়া হুজুরীমলকে খুন হইতে দেখিয়াছিল; সে স্ত্রীলোক, পাছে কোন সময়ে এ কথা আত্মপ্রকাশ করিয়া ফেলে—সেই ভয়ে তাহাকেও খুন করিয়াছিল। আমাদের সম্মুখে সে যাহা বলিয়াছে, তাহা গল্পমাত্র—সকলই মিথ্যা। এ চিঠিও তাহারই চাতুরী, আজ যে এই রাত্রে বীডন গার্ডেনের ব্যাপার ঘটাইয়াছে, ইহাও তাহারই সৃষ্টি। অক্ষয়কুমার সুদক্ষ ডিটেটিভ হইতে পারেন, কিন্তু তিনি এ পর্য্যন্ত যে যে বিষয়ে স্থির নিশ্চিত হইয়াছেন, তাহার একটাও সত্য বলিয়া সপ্রমাণ হয় নাই। সম্ভবতঃ আজও সেইরূপ হইবে। এতদিন কাটিয়া গেল, কই তিনি এ খুনের কিছুই করিয়া উঠিতে পারিলেন না।
সমস্ত দিবস নগেন্দ্রনাথ গৃহে বসিয়া, কাজ-কৰ্ম্ম ছাড়িয়া এই খুন সম্বন্ধেই আলোচনা করিলেন; কিন্তু কোনক্রমে একটা স্থির-সিদ্ধান্তে আসিতে পারিলেন না। বলিলেন, “আজ ইহার একটা শেষ যাহা হয় কিছু হইলে আমি রক্ষা পাই। ডিটেটিভগিরির সাধ আমার একেবারে মিটিয়া গিয়াছে। ইহাপেক্ষা মনে মনে গড়িয়া লইয়া কল্পনার সাহায্যে ডিটেক্টিভ উপন্যাস লেখাই সহস্রগুণে ভাল। প্রকৃত ঘটনায় অনেক বিড়ম্বনা।”
সন্ধ্যার একটু পরেই আহারাদি শেষ করিয়া নগেন্দ্রনাথ অক্ষয়কুমারের সহিত সাক্ষাৎ করিতে চলিলেন। তিনি উপস্থিত হইলে অক্ষয়কুমার আহারাদি করিতে গমন করিলেন।
রাত্রি দশটার সময়ে তাঁহারা উভয়ে বীডন-গার্ডেনের দিকে চলিলেন। অক্ষয়কুমার দুইজন বলবান্ কনষ্টেবল সঙ্গে লইলেন। তাঁহারা পুলিসের পোষাক না পরিয়া ভদ্রলোকের বেশ ধারণ করিয়া চলিলেন। অক্ষয়কুমার পকেটে একটা পিস্তল রাখিয়া বলিলেন, “সাবধানের বিনাশ নাই—অপঘাত মৃত্যুটা ভাল নয়।”