অষ্টম পরিচ্ছেদ
নগেন্দ্রনাথ একথায় সন্তুষ্ট হইলেন না। আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “আজ রাত্রিতে খুনীই যে ধরা পড়িবে, আপনার ইহা কিরূপে বিশ্বাস হইল? যে পত্র লিখিয়াছে, সে খুনের সম্বন্ধে কোন কথা জানিতে পারে——কেবল শুনিয়াছে মাত্র—অথবা উমিচাঁদ যে খুনের সহিত জড়িত আছে, তাহা কোন গতিকে জানিতে পারিয়াছে, তাহাই তাহার নিকটে টাকা আদায় করিবার জন্য ডাকিয়াছে।”
অক্ষয়কুমার গম্ভীরভাবে বলিলেন, “আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা হইলেও হইতে পারে—কিন্তু তাহা নহে। এই ব্যাপারের ভিতরের খবর বাহিরের কোন লোক জানে না। উমিচাঁদ যে খুনের সময়ে উপস্থিত ছিল, তাহা কেবল তিনজনের জানা সম্ভব।”
“নাম করুন।”
“প্রথম রঙ্গিয়া—সে নাই। দ্বিতীয় উমিচাঁদ—সে প্রথম এ কথা আমাদের নিকট স্বীকার করিয়াছে। ইহা কখনই সম্ভব নহে যে, সে এ কথা অপর কাহারও নিকটে বলিবে। তৃতীয়—যে খুন করিয়াছিল।”
“আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা ঠিক।”
“তাহা হইলে উমিচাঁদ যে খুনের সহিত জড়িত, তাহা যে খুন করিয়াছিল, সে ব্যতীত আর দ্বিতীয় ব্যক্তির জানিবার কোনরূপ সম্ভাবনা নাই।”
“তাহাই যদি হয়, তবে সে উমিচাঁদকে এরূপভাবে ডাকিবে কেন?”
“টাকার লোভে। আমি আপনাকে পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি যে, খুনী হুজুরীমলকে টাকার জন্যই খুন করিয়াছিল। কিন্তু সে খুন করিয়া টাকা পায় নাই। হুজুরীমল টাকা রঙ্গিয়ার হাতে দিয়াছিল। রঙ্গিয়া হঠাৎ হুজুরীমলকে খুন হইতে দেখিয়া হতবুদ্ধি হইয়া পড়িয়াছিল; সেইজন্য খুনীর সঙ্গে গাড়ীতে আসিয়া উঠিয়াছিল। পরে সুবিধা পাইবামাত্র ছুটিয়া পলাইয়া আসিয়া উমিচাঁদের হাতে টাকা দিয়াছিল। তখন সেই ব্যক্তি টাকা এইরূপে বে-হাত হওয়ায় উন্মত্তপ্রায় হইয়া তাহার পিছনে ছুটিতে থাকে। উমিচাঁদের সঙ্গে রঙ্গিয়াকে কথা কহিতে দেখিয়া উন্মত্তের ন্যায় তাহার বুকে ছোরা বসাইয়া দেয়। তাহার পর রঙ্গিয়ার কাপড়ের ভিতর টাকা খুঁজিতে থাকে। না পাইয়া উমিচাঁদের পিছনে ছুটিতে থাকে। তাহাকে ধরিতে পারিলে দুইটা খুনের জায়গায় তিনটা হইত। আর একটা বদমাইস পৃথিবীতে কম পড়িত।”
“কথাটা খুব সম্ভব বটে; কিন্তু এই লোকটা কে, আপনি মনে করেন?”
“আপনি কাহাকে করেন?”
“আমি ত কাহাকেও ভাবিয়া পাইতেছি না। আপনি কি কাহাকেও সন্দেহ করেন?”
“হাঁ, ললিতাপ্রসাদকে।“
নগেন্দ্রনাথ অতিশয় বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “ললিতাপ্রসাদ! তাহাকে সন্দেহ করিবার কারণ কি?”
“কারণ অনেক আছে। আমি আপনাকে বলিতেছি, আজ রাত্রে ললিতাপ্রসাদ ধরা পড়িবে—কাল সে জেলে যাইবে, এক মাসের মধ্যে তাহার ফাঁসী হইবে।”
নগেন্দ্রনাথ শিহরিয়া উঠিলেন। অক্ষয়কুমারের এসকল দেখিয়া দেখিয়া হৃদয় কঠিন হইয়া গিয়াছিল, তিনি অতি গম্ভীরভাবে এসকল আলোচনা করিতে পারিতেন। নগেন্দ্রনাথের এই প্রথম। তিনি বলিলেন, “আপনার ললিতাপ্রসাদকে সন্দেহ করিবার কারণ কি?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “আমি এই ছোক্বা সম্বন্ধে কিছু সন্ধান লইয়াছি। এ যেরূপ দেখায় সেরূপ নহে—বাহিরে খুব ভাল মানুষের মত থাকে, ভিতরে ভিতরে মদ, জুয়া, মেয়েমানুষ আছে, আর দুই হাতে টাকাও উড়ায়। সম্প্রতি ইহার টাকার নিতান্ত দরকার হইয়াছিল, এরূপ অবস্থায় মানুষ সব করে।”
“কিন্তু হুজুরীমলের কাছে যে সে রাত্রে টাকা ছিল, তাহা সে কিরূপে জানিবে?”
“গঙ্গার অনুগ্রহে।”
“কেন?”
“কেন? গঙ্গার সঙ্গে তাহার গুপ্তপ্রণয় আছে। যদি গঙ্গা কাহাকেও একটু ভালবাসে, তাহা হইলে ললিতাপ্রসাদকেই বাসে। সে জানিত, ললিতাপ্রসাদ হুজুরীমলকে সে রাত্রে কি করিবে—তাহাই ভয়ে নিজে না গিয়া রঙ্গিয়াকে পাঠাইয়াছিল।”
“আপনার কথা শুনিয়া আমি স্তম্ভিত হইলাম।”
“স্তম্ভিত হইবার কিছুই নাই। প্রত্যহ এরূপ হইতেছে।”
নগেন্দ্রনাথের প্রকৃতই সংসারের—মানুষমাত্রেরই উপর ঘোর বীতরাগ জন্মিল। সন্ধ্যার সময়ে আসিবেন বলিয়া তিনি গৃহাভিমুখে নিতান্ত ক্ষুণ্ণ ও বিষণ্ণচিত্তে চলিলেন।