চতুর্থ পরিচ্ছেদ
উমিচাঁদ স্থির হইয়া বসিলে অক্ষয়কুমার জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিরকমে হুজুরীমলকে খুন করিয়াছিলে, তাহাই এখন খুলিয়া বল।
উমিচাঁদ মাথা নাড়িয়া বলিল, “আমি খুন করি নাই।”
“কি ভয়ানক মিথ্যাবাদী!”
“দোহাই আপনার—আমি খুন করি নাই।” আমি মিথ্যাবাদী নই, আগে সকল কথা শুনুন শুনিলে সকলই জানিতে পারিবেন।”
“বেশ ভাল কথা, বল।”
“হুজুরীমলের নিকটে কাজ করায়, আমাকে সর্ব্বদাই তাঁহার বাড়ীতে যাইতে হইত—আর আমি স্বীকার করিতেছি, রঙ্গিয়ার সঙ্গে আমার ভালবাসা হইয়াছিল।”
অক্ষয়কুমার মুখভঙ্গি করিয়া বলিলেন, “এ কথা তুমি অনুগ্রহ করিয়া না বলিলেও আমরা জানিতে পারিয়াছি।”
উমিচাঁদ বলিতে লাগিল, “আমি সত্য ভিন্ন মিথ্যা কথা বলিব না। রঙ্গিয়া হুজুরীমলের বাড়ীর সকল কথাই জানিত। তাহার কাছেই জানিতে পারি যে, হুজুরীমল বুড়ো বয়সে গঙ্গার জন্য পাগল। তাহারই কাছে শুনিলাম যে, হুজুরীমল গঙ্গাকে দশ হাজার টাকা দিবে বলিয়াছে, টাকা পাইলে গঙ্গা তাহার সহিত যাইতে স্বীকার করিয়াছে।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “এসব কথাও আমরা জানি।”
উমিচাঁদ বলিল, “আমি হুজুরীমলের ভিতরের সকল কথাই জানিতাম। আমি জানিতাম, জুয়া খেলিয়া সে সৰ্ব্বস্বান্ত হইয়াছে, তাহার দেউলিয়া হইবার আর বিলম্ব নাই; তাহাই ভাবিলাম, হুজুরীমল দশ হাজার টাকা কোথায় পাইবে।”
“গুরুগোবিন্দ সিংহের টাকার বিষয় কবে জানিলে?”
“শুনুন বলিতেছি, একদিন হুজুরীমল আমাকে দশ হাজার টাকার নোট দেখাইয়া সম্প্রদায়ের সম্বন্ধে সকল কথা বলে। তাহারা কোনরূপে বিরক্ত হইলে যে গোপনে খুন করে, তাহাও তার মুখে শুনিয়াছিলাম।”
“এ সকল আমরা জানি। তাহার পর।”
“ললিতাপ্রসাদকে দিয়া হুজুরীমল নোট বদ্লাইয়া লয়। গুরুগোবিন্দ সিংহের কাছে তাহার নোটের সকল নম্বর ছিল, নোট হারাইলে গুরুগোবিন্দ সিং সব নোট বন্ধ করিয়া দিত, তখন আর নোট ভাঙাইবার উপায় হইবে না। এইজন্য আগে হইতে কৌশলে ললিতপ্রসাদকে দিয়া নোট ভাঙাইয়া লইয়াছিল।”
“আর একদিন তুমি এই লোককে একজন মহাত্মা মহাশয় লোক বলিয়া আমাদের নিকটে পরিচয় দিয়াছিলে।”
“রাণীর গলিতে গঙ্গা হুজুরীমলের জন্য অপেক্ষা করিবে। সেইখানে হুজুরীমল ছদ্মবেশে যাইবে, গঙ্গার হাতে দশ হাজার টাকা দিলে সে তাহার সঙ্গে সেই রাত্রেই বোম্বাই পলাইবে।”
“বেশ পাকা বন্দোবস্ত।”
‘এইরকম সব ঠিক হয়, রঙ্গিয়া আমাকে এইসব কথা বলে। আমি পূৰ্ব্ব হইতেই জানিতাম যে, হুজুরীমল পলাইবে।”
“গঙ্গা না গিয়া রঙ্গিয়া গেল কেন?”
“যেদিন গঙ্গার রাণীর গলিতে যাইবার কথা, সেইদিনের আগের দিন গঙ্গার ভয় হইল; সে যাইবার জন্য ইতস্ততঃ করিতে লাগিল; আবার টাকার লোভও সহজে ছাড়িতে পারে না—
“তাহা হইলে গঙ্গার হুজুরীমলের সহিত যাইবার ইচ্ছা ছিল না?”
“না, অমন বুড়োর সঙ্গে কি কেউ কখনও যায়। তাহার মতলব ছিল, দশ হাজার টাকা ঠকাইয়া লইয়া বুড়োকে তফাৎ করিয়া দিবে।”
“রতনে রতন মিলিয়াছিল, আর কি?”
“কিন্তু নিশ্চয়ই হুজুরীমলকে খুন করিবার তাহার ইচ্ছা ছিল না।’
“গঙ্গার বদলে রঙ্গিয়া যাইতে স্বীকার করিল কেন?”
উমিচাঁদ ইতস্ততঃ করিতে লাগিল দেখিয়া অক্ষয়কুমার রুষ্টভাবে বলিলেন, “বাপু, যদি বাঁচিতে চাও, কোন কথা গোপন করিয়ো না।”
উমিচাঁদ ধীরে ধীরে বলিল, “আমার জন্য।”
“তোমার জন্য! কেন?”
“সকল কথাই খুলিয়া বলিতেছি, কিছু গোপন করিব না।”
“তোমার বাঁচিবার একমাত্র উপায় এখন তাহাই।”
“সকল কথা বলিলে আমাকে রক্ষা করিবেন?”
“যদি তুমি যথার্থ খুন না করিয়া থাক, তোমার কোন ভয় নাই।”
“তবে শুনুন, আমি জানিতাম, হুজুরীমলের আর বেশী দিন নাই; আমারও আর চাকরীর বেশী দিন নাই। আমি এক পয়সাও জমাইতে পারি নাই, এই দশ হাজার টাকার কথা শুনিয়া আমার লোভ হইল; আমি ভাবিলাম, এ টাকাটা আমি যদি পাই, তবে আমি রঙ্গিয়াকে অন্য কোন দেশে লইয়া গিয়া সুখে বাকী জীবনটা কাটাইয়া দিতে পারিব।”
“তখন তুমি চোরের উপর বাটপাড়ী করিবার চেষ্টা আরম্ভ করিলে। কি আশ্চর্য্য, কয়টী কি মহাত্মা লোকেরই একত্র সমাবেশ হইয়াছিল!”
“সকল কথা শুনুন, পরে গালাগালি দিবেন।”