তৃতীয় পরিচ্ছেদ
অক্ষয়কুমার বহুক্ষণ এইরূপভাবে পরিক্রমণ করিতে লাগিলেন। ক্ষণপরে সহসা সেই চেয়ারখানা টানিয়া বসিয়া বলিলেন, “ভাবিয়া দেখিলাম, যাহা বলিলেন, তাহাও ঠিক–প্রমাণ সংগ্রহ করা কঠিন–আর সিঁদুরমাখা শিবের কথাটাও একটা কথা বটে—এই পাথুরে শিবই আমাকে পাগল করিবে দেখিতেছি। তবে ইহাও ঠিক, উমিচাদ এই খুনের বিষয় জানে, নতুবা সে শিব দেখিয়া অজ্ঞান হইবে কেন?”
“ইহার কারণ ত সে বলিয়াছে।”
“যাহা বলিয়াছে, মিথ্যাকথা; তবে তাহাকে এখানে ডাকিয়া পাঠাইয়াছি, আজ আসিলে দেখা যাক্, সে কি বলে। তাহার পেটের কথা এখনই যদি বাহির না করি, তবে আমার নাম অক্ষয়ই নয়।”
“কখন সে আসিবে?”
অক্ষয়কুমার পকেট হইতে ঘড়ী বাহির করিয়া বলিলেন, “এখনই আসিবে—ঐ বুঝি আসিয়াছে।” সত্যসত্যই উমিচাদ আসিয়াছে। ভৃত্য আসিয়া সংবাদ দিল। অক্ষয়কুমার তাহাকে সেই গৃহে আসিতে আজ্ঞা করিলেন।
আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, উমিচাদের সাহসটা বড় কম, তাহাকে দেখিলেই বোধ হইত, যেন সতত সশঙ্ক, কি যেন একটা পাপ সে করিয়াছে, কি যেন লুকাইবার চেষ্টা করিতেছে, সকলের সহিত সে ভাল করিয়া কথা কহিতে পারিত না। ক্ষণপরে উমিচাঁদ ধীরে ধীরে সশঙ্কভাবে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল। অক্ষয়কুমার তাহাকে বসিতে ইঙ্গিত করিলেন। সে চোরের ন্যায় এক পার্শ্বে বসিল। ভীতভাবে কম্পিতকণ্ঠে বলিল, “আপনি আমাকে আসিতে লিখিয়াছিলেন?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “হ্যাঁ।”
“নূতন কিছু সংবাদ পাইয়াছেন?”
“হাঁ।”
“চুরি সম্বন্ধে?”
“খুন সম্বন্ধে।”
উমিচাঁদ চমকিত হইয়া বলিল, “খুন সম্বন্ধে!
অক্ষয়কুমার অতি গম্ভীরভাবে বলিলেন, “হাঁ, কে খুন করিয়াছে, আমরা জানিতে পারিয়াছি।” উমিচাঁদ ভয় পাইয়া বলিল, “গুরুগোবিন্দ সিংহ।”
অক্ষয়কুমার ওয়ারেন্টখানি বাহির করিয়া উমিচাদের সম্মুখে রাখিয়া বলিলেন, “যার নামে এই ওয়ারেন্ট আছে, সেই খুন করিয়াছে।”
উমিচাদ মুহূর্ত্তের জন্য ওয়ারেন্টের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করিল; তাহার আপাদমস্তক কম্পিত হইতে লাগিল। অস্পষ্টভাবে বলিল, “ওয়ারেন্ট।”
অক্ষয়কুমার স্বর উচ্চে তুলিয়া বলিলেন, “হাঁ ওয়ারেন্ট—আর তোমারই নামে।”
উমিচাদের মুখ বিবর্ণ হইল। তাহার সর্ব্বাঙ্গে স্বেদশ্রুতি হইতে লাগিল। সভয়ে বলিল, “আমার নামে! “ অক্ষয়কুমার আরও কঠোর স্বরে বলিলেন, “হাঁ, তোমার নামে—উমিচাদের নামে—তুমি তোমার মনিব হুজুরীমলকে খুন করিয়াছ—তোমার উপপত্নী রঙ্গিয়াকে খুন করিয়াছ, সেই উভয় অপরাধের ফল এ ওয়ারেন্ট।”
উমিচাঁদ কাঁপিতে কাঁপিতে উঠিয়া দাঁড়াইল। কপালের ঘাম মুছিতে মুছিতে বলিল, “আমি খুন করি নাই।”
“তুমিই দুইজনকে খুন করিয়াছ—আমি এখনই তোমাকে গ্রেপ্তার করিব।”
“আমি খুন করি নাই—আমি নিৰ্দ্দোষী।” জড়িতকণ্ঠে উমিচাঁদ এই কথা বলিয়া তথা হইতে যাইতে উদ্যত হইল। অক্ষয়কুমার উঠিয়া তাহার হাত ধরিলেন। উমিচাঁদ কাতরভাবে বলিল, “আমি সব কথা বলিতেছি—আমি খুন করি নাই—আমি শপথ করিয়া বলিতেছি।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “কেবল তুমি নয়—ফাঁসী হইতে রক্ষা পাইবার জন্য অনেকেই শপথ করিয়া থাকে। বাপু, কথা কহিয়ো না, আমাদের অনেক কষ্ট দিয়াছ। এখন হাত দুইখানি একবার বাড়াইয়া দাও দেখি, বাপু।”
এই বলিয়া অক্ষয়কুমার বস্ত্রমধ্য হইতে একজোড়া হাতকড়ী বাহির করিলেন। হাতকড়ী দেখিয়া উমিচাদ বালকের ন্যায় কাঁদিয়া উঠিল। নগেন্দ্রনাথের পদতলে পড়িয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, “আপনি আমাকে রক্ষা করুন। আমি শপথ করিয়া বলিতেছি, আমি খুন করি নাই। আমি কিছুই জানি না।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আমি কি করিতে পারি। আমার কোন হাত নাই। যদি খুন করিয়া থাক, তাহার উপযুক্ত দণ্ড পাইবে
উমিচাঁদ তাঁহার পা জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, “আমি নিদোষী—আমি খুন করি নাই।” অক্ষয়কুমার একটু নরমভাবে বলিলেন, “বেশ, ভাল কথা বাপু’ আমাকে বুঝাইয়া দাও যে তুমি নিদোষী, আমি এখনই তোমায় ছাড়িয়া দিব।”
উমিচাঁদ দুই হাতে মাথা চাপিয়া বলিল, “আমার বলিবার উপায় নাই।“
অক্ষয়কুমার ক্রুদ্ধভাবে বলিলেন, “তবে ফাঁসী যাও।”
উমিচাঁদ তাঁহার পা জড়াইয়া ধরিতে আসিল। অক্ষয়কুমার সরিয়া দাঁড়াইলেন। রুষ্টভাবে বলিলেন, “বেশী চালাকী করিয়ো না। ভাল মানুষটীর মত সব কথা খুলিয়া বল।”
নিরুপায় হইয়া উমিচাঁদ অবশেষে উঠিয়া দাঁড়াইল। দুই হাতে চোখের জল মুছিল। বলিল, “আমাকে একটু জল দিন।”
অক্ষয়কুমার নগেন্দ্রনাথকে ইঙ্গিত করিলেন। তিনি জল আনিলে উমিচাঁদ জলপান করিয়া বলিল, “আমি সত্যকথাই বলিব—সব কথা খুলিয়া বলিতেছি।”
অক্ষয়কুমার গম্ভীরভাবে বলিলেন, “তোমার পক্ষে এখন তাহাই সৎ-পরামর্শ।”