তৃতীয় খণ্ড : রহস্যোদ্ভেদ চমৎকার – প্রথম পরিচ্ছেদ
কলিকাতায় ফিরিয়া আসিয়া নগেন্দ্রনাথ যমুনার নিকটে যাহা শুনিয়াছিলেন, আদ্যোপান্ত অক্ষয়কুমারকে বলিলেন। শুনিয়া অক্ষয়কুমার অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন; মহোৎসাহে বলিয়া উঠিলেন, “নগেন্দ্রবাবু, এ ডিটেক্টিভ উপন্যাস লেখা নয়—হাতে-নাতে ডিটেক্টিভ হওয়া স্বতন্ত্র ব্যাপার।” নগেন্দ্রনাথ হাসিয়া বলিলেন, “কি অপরাধ করিলাম, বরং আপনাকে কত খবর আনিয়া দিলাম; আপনি ত তাহার কাছে কিছুই জানিতে পারেন নাই।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “তাহা ত আমি, বরাবরই স্বীকার করিয়া আসিতেছি। আপনারা ঔপন্যাসিক—মেয়ে মানুষ সম্বন্ধে আপনাদের খুব জোর খাটে। মিষ্ট কথায় ভুলাইতেও পারেন—দুঃখের বিষয় সে ক্ষমতা আমাদের নাই।”
“সে কথা যাক্, এখন ত স্পষ্টই বুঝিলেন যে, হুজুরীমল সম্প্রদায়ের টাকা লইয়া পলাইতেছিল, তাহাদের লোক শান্তপ্রসাদ তাহাকে খুন করিয়াছে।”
অক্ষয়কুমার উচ্চ হাস্য করিয়া উঠিলেন। তাঁহার হাসি আর থামে না। দেখিয়া নগেন্দ্রনাথ বিরক্ত হইয়া উঠিলেন।
অক্ষয়কুমার সহসা হাসি বন্ধ করিয়া বলিলেন, “কেমন, বলিয়াছিলাম কি না যে, হুজুরীমল যখন খুন হয়, তখন তাহার নিকটে টাকা ছিল।”
নগেন্দ্রনাথ স্বীকার করিলেন। বলিলেন, “হুজুরীমল যেভাবে যমুনাকে দিয়া টাকা বাহির করিয়া লইয়াছিল, তাহা কেহ স্বপ্নেও ভাবিতে পারে না।”
“আমি যমুনার কথা ভাবি নাই, এ কথা স্বীকার করি; কিন্তু আমি জানিতাম, সে কোনরকমে সকলের চোখে ধূলি দিয়া নিজ কাৰ্য্য সাধন করিয়াছিল।”
“নারকী নিজের স্ত্রী পরিবার ফেলিয়া, একটা কুলটা লইয়া পরের টাকা চুরি করিয়া পলাইতেছিল; আর সেই টাকা চুরি করিতে নিজের স্ত্রীর ভগ্নীর মেয়েকে নানা কথায় ভুলাইয়া লাগাইয়াছিল—এরূপ বদলোক ত দেখা যায় না।”
“অনেক আছে।”
“আপনি পুলিসে থাকেন, অনেক দেখিয়া থাকিবেন, কিন্তু আমার এই প্রথম!”
অক্ষয়কুমার হাসিয়া বলিলেন, “আপনি উপন্যাস লিখেন, আপনাদের উপন্যাসে ত অনেক উচ্চশ্রেণীর বদমাইস দেখিতে পাওয়া যায়।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “সে সমস্তই কল্পনা—এখন সে কথা যাক্, এখন খুনী ধরিবার কি করিবেন?” অক্ষয়কুমার গম্ভীরভাবে বলিলেন, “কে খুনী?”
“কেন শান্তপ্রসাদ। এ বিষয়ে কি আপনার এখনও সন্দেহ আছে?”
“শান্তপ্রসাদ বলিয়া কোন লোক জগতে নাই।”
নগেন্দ্ৰনাথ বিস্মিত হইয়া তাঁহার মুখের দিকে চাহিলেন। দেখিয়া অক্ষয়কুমার বলিলেন, “আপনি কি এই শান্তপ্রসাদের কথা বিশ্বাস করিতেছেন?”
“অবিশ্বাসের কারণ কি? বরং এ কথাটা খুব সম্ভব বলিয়াই বোধ হইতেছে।”
“কেন?”
“প্রথমতঃ হুজুরীমলের মৃতদেহের নিকট সিঁদুরমাখা শিব পাওয়া গিয়াছে; সুতরাং সম্প্রদায়ের লোকই যে তাহাকে খুন করিয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই।”
“তার পর?”
“তার পর গুরুগোবিন্দ জানিত যে, টাকা ঠিকই আছে, কেবল এই শান্তপ্রসাদই জানিতে যে, তাহা নাই। তাহাকেই টাকা দিবার কথা। সে যখন দেখিল, হুজুরীমল টাকা লইয়া অপর স্ত্রীলোকের সহিত পলাইতেছে, তখন সে তাহাকে খুন করিয়াছিল।”
“বেশ—সে অপর স্ত্রীলোককেও খুন করে কেন?”
“ঐ রাগে।”
“আর ঐ স্ত্রীলোকটি নিতান্ত ভাল মানুষটির মত তাহার সঙ্গে খুন হইতে চলিল?”
“তা যাবে কেন?”
“আর যাবে কেন? গাড়োয়ান বলিয়াছে, স্ত্রীলোকটি পুরুষের সহিত গাড়ীতে আসিয়া চড়িয়াছিল। রঙ্গিয়া শান্তপ্রসাদের হাতে হুজুরীমলকে খুন হইতে দেখিয়া তাহার সঙ্গে নিজে খুন হইবার জন্য এরূপভাবে যাইতে পারে না।”
“এ কথা ঠিক। আপনি কি তবে মনে করেন না যে, শান্তপ্রসাদ খুন করে নাই?”
“শান্তপ্রসাদ বলিয়া কোন লোক নাই। এ কেবল হুজুরীমলের চালাকী। সরলা যমুনাকে দিয়া কাৰ্য্য হাসিল করিবার ইচ্ছায় সে তাহাকে ভয় দেখাইবার জন্য আপনাদের মত কল্পনা কারুকরীকে দিয়া শান্তপ্রসাদকে গড়িয়াছিল। তাহার আগাগোড়া সবই মিথ্যাকথা। এরূপ বদমাইস ভুলিয়াও কখনও সত্যকথা কয় না।”
“আপনার কথাই ঠিক বলিয়া বোধ হইতেছে।”
“তাহাকে যে খুন করিয়াছে, সে ধরা না পড়িলেই আমি খুসী হইতাম।”
নগেন্দ্ৰনাথ বিস্মিত হইয়া অক্ষয়কুমারের দিকে চাহিলেন। বলিলেন, “তবে কি আপনি খুনীকে ধরিতে পারিয়াছেন?”
অক্ষয়কুমার গম্ভীরভাবে বলিলেন, “মশাই গো, এ উপন্যাস লেখা নয়।”
নগেন্দ্রনাথ যথার্থই আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন। বলিলেন, “কে খুন করিয়াছে?”
অক্ষয়কুমার অতি ধীরে ধীরে পকেট হইতে একখানি কাগজ বাহির করিলেন। নগেন্দ্রনাথ দেখিলেন, সেখানি ওয়ারেন্ট—উমিচাঁদের নামে।