ষোড়শ পরিচ্ছেদ
যমুনার কথা শুনিয়া নগেন্দ্রনাথের মস্তক বিঘূর্ণিত হইল। তিনি যাহাকে মানবীরূপে দেবী মনে করিয়াছিলেন, যাহার অপরূপরূপলাবণ্যে তিনি মুগ্ধ হইয়াছিলেন, নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও যাহার মূৰ্ত্তি সর্ব্বদাই তাঁহার হৃদয়ে উদিত হইতেছিল, প্রকৃতপক্ষে যাহাকে একবার দেখিতে পাইবেন বলিয়াই তিনি আজ চন্দননগরে আসিয়াছিলেন, সে এই খুনের ব্যাপারে জড়িত। সে কেবল খুনী নহে—চোর পর্য্যন্ত। তাঁহার মস্তক বিঘূর্ণিত হইল—তিনি স্তম্ভিতভাবে কিয়ৎক্ষণ ব্যাকুলভাবে যমুনার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
যমুনা তাঁহার মনের ভাব বুঝিল। সে সগৰ্ব্বে মাথা তুলিয়া, গ্রীবা বাঁকাইয়া দাঁড়াইল। তাহার সেই ভাবে, তাহার সৌন্দর্য্য শতগুণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইল। নগেন্দ্রনাথ যমুনার সেই মনোমোহন ভঙ্গীতে আবার মুগ্ধ হইলেন।
যমুনা বলিল, “ভাল করিয়াছি, কি মন্দ করিয়াছি—জানি না। যাহা করিয়াছি, মেসো মহাশয়ের হুকুমে, তাঁহারই জন্য করিয়াছি। কাহাকে এ কথা বলি নাই—তাঁহারই অনুরোধে প্রকাশ করি নাই- কিন্তু এখন প্রকাশ না করিলে নয়, তাহাই বলিতেছি।”
নগেন্দ্রনাথ কেবলমাত্র বলিলেন, “বলুন।” তাহার কি বলিবার আছে, শুনিবার জন্য নগেন্দ্ৰনাথ ব্যগ্র হইয়াছিলেন। সে কি কোন কুকার্য্য করিতে পারে, তাহা তাঁহার মন লইতে ছিল না; এ চিন্তাতেও তাঁহার হৃদয়ে কষ্ট হইতেছিল। তিনি বলিলেন, “বলুন।“
যমুনা বলিল, “মৃত্যুর দিন সকালে মেসো মহাশয় আমাকে ডাকিয়া গোপনে বলিলেন, ‘দেখ যমুনা, তোমায় আমি বড় ভালবাসি; আমি জানি, তুমিও আমাকে বড় ভালবাস, সেইজন্য তোমাকেই বলিতেছি, দেখিয়ো যেন কিছুতেই এ কথা কাহারও নিকটে প্রকাশ করিয়ো না।’ আমি মেসো মহাশয়কে বড় ভালবাসিতাম, আমি তাঁহার নিকটে অঙ্গীকার করিলাম। আমি প্রাণ থাকিতে সে অঙ্গ কার কখনও ভাঙিতাম না; কিন্তু এখন প্রকাশ না করিলে হয়ত একজন নির্দোষী লোক ফাঁসী যায়, তাহাই বলিতেছি। একদিন মেসো মহাশয়ের নিকটে শুনিয়াছিলাম, তিনি যখন পঞ্জাবে মাসীমাকে বিবাহ করিতে যান, তখন এক সম্প্রদায়ের মধ্যে যাইয়া পড়েন।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “সম্প্রদায়ের কথা আমরা শুনিয়াছি, সে সম্প্রদায়ের চিহ্ন সিঁদুর মাখা শিব।”
“হাঁ, যে এই সম্প্রদায়ভুক্ত হয়, সে আর কখনও এ সম্প্রদায় ত্যাগ করিতে পারে না, প্রাণপণে এই সম্প্রদায়কে সাহায্য করিতে সে বাধ্য থাকে—না করিলে তাহার প্রাণদণ্ড হয়, যেকোন উপায়ে এই সম্প্রদায় তাহাকে খুন করে।”
“ইহাও আমরা শুনিয়াছি।”
“মাস কয়েক হইল, গুরুগোবিন্দ সিংহ আসিয়া মেসো মহাশয়কে এই সম্প্রদায়ের দশ হাজার টাকা রাখিতে দেয়। গুরুগোবিন্দ সিংহও এই সম্প্রদায়ের একজন।”
“তাহাও আমরা জানি। সম্প্রদায়ের টাকা যে চুরি গিয়াছিল, তাহা আমরা জানি।“
“মেসো মহাশয়ের খুনের এক সপ্তাহ আগে তিনি তাঁহার বিছানায় একদিন হঠাৎ একটা সিঁদুরমাখা শিব দেখিতে পান।”
“সিঁদুরমাখা শিব!”
“হাঁ, সম্প্রদায় যাহাকে কোন কাজ করিতে হুকুম করে, তাহাকে কোনরূপে একটা সিঁদুর মাখা শিব পাঠাইয়া দেয়। ইহার অর্থ এই যে, যদি সে সম্প্রদায়ের হুকুম না শুনে, তবে তাহাকে সম্প্রদায় খুন করে এবং তাহার কাছে একটা সিঁদুরমাখা শিব রাখিয়া দেয়।”
“এ সবও আমরা শুনিয়াছি।”
“সেই শিবের সঙ্গে মেসো মহাশয় একখানা পত্রও পান। ঐ পত্রে লেখা ছিল;—তোমাকে হুকুম করা যায়, তুমি পত্র পাইবামাত্র বড়বাজারের রাণীর গলিতে শনিবার রাত্রি বারটার সময়ে তোমার নিকটে যে সম্প্রদায়ের দশ হাজার টাকা আছে, তাহা সম্প্রদায়ের অন্যতম সভ্য শান্তপ্রসাদকে দিবে। যেন কোন মতে অন্যথা না হয়—সাবধান! “
“আপনি এ পত্র দেখিয়াছিলেন?”
“হাঁ, মেসো মহাশয় আমাকে দেখাইয়াছিলেন।”
“তাহার পর তিনি কি করিবেন, স্থির করিলেন।”
“তিনি সম্প্রদায়ের হুকুম অমান্য করিতে সাহস করিলেন না। তিনি জানিতেন, “নিশ্চয়ই গোপনে সম্প্রদায় তাঁহাকে খুন করিবে। তিনি টাকা শান্তপ্রসাদকে পৌঁছাইয়া দেওয়াই স্থির করিলেন। অথচ তিনি এ কথা গুরুগোবিন্দ সিংহকে প্রকাশ করিতে সাহস করিলেন না; কারণ তিনি জানিতেন, এ কথা গুরুগোবিন্দ সিংহের নিকটে প্রকাশ করিলেও সম্প্রদায় তাঁহাকে খুন করিবে।”
“এরূপ ভয়ানক সম্প্রদায় ত দেখা যায় না।”
“হাঁ, আমিও সম্প্রদায়ের ভয়ে এতদিন কোন কথা প্রকাশ করিতে সাহস করি নাই। আপনি অতিশয় ভদ্রলোক, তাহাই বলিতেছি।”
যমুনার মুখে নিজের প্রশংসা শুনিয়া নগেন্দ্রনাথ মনে মনে বড় সন্তুষ্ট হইলেন। বলিলেন, “তারপর তিনি কি করিলেন?”
যমুনা বলিল, “এইজন্য তিনি গোপনে টাকা রাত্রি মধ্যে শান্তপ্রসাদকে পৌঁছাইয়া দেওয়া স্থির করিলেন।”
“গুরুগোবিন্দ টাকা চাহিলে কি করিতেন?”
“তিনি সেইদিনই আগ্রায় যাইতেছিলেন। ভাবিয়াছিলেন, গুরুগোবিন্দ শীঘ্র টাকা চাহিবে না, চাহিলেও টাকা চুরি গিয়াছে ভাবিবে, তাঁহাকে সন্দেহ করিবে না। এইজন্য তিনি টাকা লইয়া উমিচাঁদকে গদির সিন্দুকে রাখিতে দেন।”
“তাহা ত আমরা জানি। তিনি উমিচাঁদকে টাকা রাখিতে দিলে সে ললিতাপ্রসাদের সম্মুখে টাকা বন্ধ করিয়া রাখে। পরে তিনি আর গদিতে যান নাই; তিনি টাকা পাইলেন, কোথা হইতে?”
“তাহাই বলিতেছি, মেসো মহাশয় এইসকল কথা আমাকে বলিয়া আমার দুই হাত ধরিয়া বলিলেন, ‘যমুনা, কেবল তুই আমাকে রক্ষা করিতে পারিস্, নতুবা সম্প্রদায়ের হাত হইতে আমার রক্ষার উপায় নাই।”আমি প্রাণ দিয়াও তিনি যাহা বলিবেন তাহা করিব, স্বীকার করিলাম। তখন তিনি বলিলেন, ‘তুই সন্ধ্যার পর গদিতে যাইবি—আমার রেলের টিকিট আমি সেখানে ফেলিয়া আসিব সিন্দুকের ঘরে উমিচাঁদ ছাড়া আর কেহ থাকে না, তাহাকে কোনরকমে অন্যত্র পাঠাইয়া সিন্দুক হইতে টাকা বাহির করিয়া আনিয়া আমায় দিবি।”
“আপনি সিন্দুক খুলিলেন, কিরূপে?”
“সিন্দুকের একটা চাবি উমিচাদের কাছে—আর একটা মেসো মহাশয়ের কাছে থাকিত, তিনি সেই চাবিটা আমাকে দিলেন।”
“আপনি এ কাজ করিতে স্বীকার করিলেন?”
“কি করি, এ অবস্থায় পড়িলে আপনিও করিতেন। আমি এ কাজ না করিলে সম্প্রদায় মেসো মহাশয়কে খুন করে—“
“এই কলিকাতা সহরে খুন করা সহজ নয়।”
“সম্প্রদায়ই ত তাঁহাকে খুন করিয়াছে।”
“কেমন করিয়া জানিলেন?”
“নিশ্চয়ই—তাঁহার মৃতদেহের নিকটে একটা সিঁদুরমাখা শিব পাওয়া গিয়াছে—ঐ শিব সম্প্রদায়ের চিহ্ন।”
“এ বিষয়ে পরে আলোচনা করিব। তাহার পরে আপনি কি করিলেন?”
“আমি তাঁহার কথামত সন্ধ্যার পর গদিতে গিয়াছিলাম। সিন্দুকের ঘরে উমিচাঁদ ছাড়া আর কেহ ছিল না। আমি তাহাকে টিকিটের কথা বলিলাম। সে আমাকে টিকিট দিল। তাহার পর আমি জল খাইতে চাহিলে, সে জল আনিতে ছুটিল। সেই অবসরে আমি সিন্দুক খুলিয়া টাকা বাহির করিয়া লইলাম। উমিচাঁদ ফিরিয়া আসিলে আমি মেসো মহাশয়ের বাড়ীতে গিয়া তাঁহার সঙ্গে দেখা করিলাম। তিনি আমাকে ঘোমটা দিয়া যাইতে বলিয়াছিলেন, আমি সেইরূপেই গিয়াছিলাম; সেজন্য কেহ আমাকে চিনিতে পারে নাই। তাঁহার সঙ্গে দেখা হইলে তিনি আমায় বলেন যে, একটু আগে গুরুগোবিন্দ সিংহ আসিয়াছিল।”
“তিনি গুরুগোবিন্দ সিংহকে কিরূপে ঠাণ্ডা করিবেন, ভাবিয়াছিলেন?”
“তিনি ভাবিয়াছিলেন, এখানে থাকিবেন না, সুতরাং টাকা গিয়াছে শুনিয়া গুরুগোবিন্দ হঠাৎ তাঁহার কিছুই করিতে পারিবে না। সময়ে সম্প্রদায় নিশ্চয়ই টাকার সংবাদ দিবে, তখন তাহার আর কোন ভয় থাকিবে না।”
“হুজুরীমলবাবু খুব সাবধানী লোক ছিলেন, সন্দেহ নাই।”
“সাবধানী হইয়া আর ফল কি? সম্প্রদায়ই শেষ তাঁহাকে খুন করিল।”
“এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।”
“কেন? তবে কে তাঁহাকে খুন করিল? যদি সম্প্রদায় খুন না করিয়া থাকে, তবে তাঁহার নিকটে সিঁদুরমাখা শিব পাওয়া যাইবে কেন?”
“সম্প্রদায় যদি খুন করিবে, তবে সেই খুনের পর টাকা লইয়া সম্প্রদায় আবার গুরুগোবিন্দ সিংহকে ফেরৎ দিবে কেন?”
“আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।”
“আপনি দুখানা রেলের টিকিট উমিচাদের নিকট হইতে আনিয়া মেসো মহাশয়কে দিয়াছিলেন?”
“হাঁ, আপনি এসব কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন?”
“হুজুরীমল দুইখানা টিকিট কিনিয়াছিলেন, তার একখানা গঙ্গার জন্য। তিনি সেই রাত্রে গঙ্গাকে লইয়া বোম্বে পলাইতেছিলেন।”
যমুনা কোন কথা কহিল না। নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল।
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “হুজুরীমল ভাল লোক ছিলেন না। তিনি সম্প্রদায়ের দশ হাজার টাকা আপনার দ্বারা চুরি করাইয়া, নিজের স্ত্রী পরিবার ফেলিয়া একটা কুলটাকে লইয়া পলাইতেছিলেন। তিনি আপনাকে যাহা বলিয়াছেন, তাহা সর্ব্বৈব মিথ্যা।”
যমুনা মৃদুস্বরে বলিল, “তবে কে তাঁহাকে খুন করিল?”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, তাহারই সন্ধান হইতেছে। সম্ভবতঃ হুজুরীমল যে শান্তপ্রসাদের কথা বলিয়াছিলেন, সে কোন গতিকে ভিতরের কথা জানিতে পারিয়া সম্প্রদায়ের টাকাচোর হুজুরীমলকে খুন করিয়াছিল। এরূপ পাষণ্ডের মৃত্যু হইয়াছে, ভালই হইয়াছে।”
যমুনা ব্যাকুলভাবে নগেন্দ্রনাথের দিকে চাহিল। তাহার দুইটি চক্ষু জলে পূর্ণ হইয়া আসিল। সে সত্বর সেখান হইতে উঠিয়া গেল।