পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
কেবল যে অক্ষয়কুমার যমুনাকে লইয়া নগেন্দ্রনাথের সহিত রহস্য করিলেন—তাহা নহে, প্রকৃতপক্ষেই যমুনাকে দেখিয়া অবধি নগেন্দ্রনাথের হৃদয়ে তাহার মূর্ত্তি অঙ্কিত হইয়া গিয়াছে; তবে সে হিন্দুস্থানী—তিনি বাঙ্গালী—তবুও তিনি তাহাকে একবার দেখিবেন বলিয়াই চন্দননগরে চলিলেন। তাহার নিকটে যে, তিনি অধিক কিছু জানিতে পারিবেন, এ আশা করেন নাই।
তিনি পুলিস-সংশ্লিষ্ট লোক না হইলে তাঁহার সহিত যমুনার দেখা হইবার আশা ছিল না। তিনি হুজুরীমলের খুন সম্বন্ধে যমুনার সহিত দেখা করিতে চাহেন, এ সংবাদ পাইয়া যমুনা তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিল।
নগেন্দ্রনাথ প্রথমে কি বলিবেন, কিরূপে কথা আরম্ভ করিবেন, কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন। অবশেষে মাথা চুল্কাইতে চুল্কাইতে বলিলেন, “আমি সেই মোকদ্দমার জন্য আসিয়াছি।”
যমুনা মস্তক অবনত করিয়া দাঁড়াইয়াছিল। সে সেইরূপভাবে থাকিয়া মৃদু মধুরস্বরে কহিল, ‘মেসো মহাশয়ের খুনের বিষয়ে কোন সন্ধান পাইলেন?”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আমি খুনের বিষয়ের জন্য এখানে আসি নাই—চুরির জন্য আসিয়াছি।”
“চুরির জন্য?” যমুনা অস্পষ্টস্বরে কহিল।
নগেন্দ্রনাথ দেখিলেন, সহসা তাহার মুখ মলিন হইয়া গেল।
নগেন্দ্রনাথ দেখিয়া বিস্মিত হইলেন। তিনি বলিলেন, “যে দশ হাজার টাকা আপনার মেসো মহাশয়ের সিন্দুক হইতে চুরি গিয়াছিল।”
যমুনা অতি মৃদুস্বরে কহিল, ‘কোন্ টাকা, কি হইয়াছে?”
“গুরুগোবিন্দ সিংহ সে টাকা ফেরৎ পাইয়াছেন।”
“ফেরৎ পাইয়াছেন! “
যমুনা এরূপভাবে এই কথা বলিল যে, বিস্মিত হইয়া নগেন্দ্রনাথ তাহার মুখের দিকে চাহিলেন। যমুনা অস্পষ্টস্বরে কহিল, “না, এ হতে পারে না—নিশ্চয়ই হতে পারে না।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “গুরুগোবিন্দ টাকা পাইয়াছেন।”
যমুনা ব্যগ্রভাবে বলিল, “তবে খুনী ধরা পড়িয়াছে?”
“না—ধরা পড়ে নাই।”
যমুনা অতিশয় বিচলিতভাবে বলিল, “ধরা পড়ে নাই—তবে টাকা ফেরৎ কিরূপে হইল?”
“একজন অজানা লোক গুরুগোবিন্দ সিংহের বাসায় তাঁহার চাকরের নিকটে একখানা পত্র রাখিয়া যায়; সেই পত্রের মধ্যে দশ হাজার টাকার নোট ছিল।”
“তাহা হইলে সেই লোকই খুন করিয়াছিল। সে-ই মেসো মহাশয়ের নিকট হইতে টাকা লইয়াছিল। নিশ্চয়ই সে-ই তাঁহাকে খুন করিয়াছিল। নিশ্চয়ই এ সেই লোক।”
“তাহা কিরূপে হইবে? হুজুরীমলবাবু যখন গদি হইতে যান, তখন উমিচাঁদ টাকা সিন্দুকে বন্ধ করিয়া রাখে। তিনি আর গদিতে ফিরেন নাই, তবে সে রাত্রে তাঁহার সঙ্গে টাকা কিরূপে থাকিবে?” যমুনা নিতান্ত বিচলিত হইল। সে কম্পিতস্বরে অস্পষ্টভাবে বলিল, “তা—ঠিক কথা। আমার ভুল হইয়াছে—”
নগেন্দ্রনাথ স্পষ্ট বুঝিলেন, টাকা সম্বন্ধে যমুনা সকল কথাই জানে, সে কিছুতেই বলিতেছে না। তিনি সেইজন্য বলিলেন, “দেখুন, আপনার কোন কথা গোপন করা উচিত নয়; আপনি সকল কথা না বলিলে একজন নিদোষী লোক জেলে যায়—হয়ত তাহার ফাঁসীও হইবে।”
যমুনার মুখ হইতে কথা সরিল না। সে বংশপত্রের ন্যায় কাঁপিতে লাগিল—তাহার মলিন মুখ আরও মলিন হইয়া গেল। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া যমুনা অন্যদিকে মুখ ফিরাইল।
নগেন্দ্রনাথ কিছুই বুঝিতে না পারিয়া বলিলেন, “আপনি সকল কথা জানা সত্ত্বেও সে কথা প্রকাশ না করায় যদি একজন লোক বিনা দোষে ফাঁসী-কাঠে যায়, তাহা হইলে আপনার এ জীবনে আর শান্তি থাকিবে না।”
যমুনা সভয়ে চারিদিকে চাহিল। তাহার সর্ব্বাঙ্গ কম্পিত হইতে লাগিল। অতি মৃদুস্বরে বলিল, “আমার বলিতে সাহস হয় না।”
নগেন্দ্রনাথ তাহাকে আশ্বস্ত করিবার জন্য বলিলেন, “কে টাকা লইয়াছে, তাহা আমাকে বলুন- কোন ভয় নাই।”
তাঁহার মিষ্ট কথায় বা যেকোন কারণে হউক, যমুনা যেন কতক আশ্বস্ত হইল। ধীরে ধীরে বলিল, “আমি পঞ্জাবের সম্প্রদায়ের ভয়ে বলিতে পারি নাই; শুনিয়াছি, তাহারা খুন করে—
“আপনার কোন ভয় নাই, বলুন।”
“এখন না বলিলে নয়—বিশেষ আপনি ভদ্রলোক—
“আপনি নির্ভয়ে বলুন, কোন ভয় নাই।”
‘কে টাকা লইয়াছে—আমি জানি।”
“কে বলুন।”
যমুনা নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল। তখন নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “কে—উমিচাঁদ?”
যমুনা অস্পষ্টস্বরে বলিল, “না।”
“তবে কে—গুরুগোবিন্দ সিংহ?”
“না—যমুনা।”
“অ্যাঁ—তুমি—তুমি”
“হাঁ, আমি।”