তৃতীয় পরিচ্ছেদ
তখন নগেন্দ্রনাথ ও সেই কোচম্যান দ্রুতপদে গলির মুখে আসিয়া, “পাহারাওয়ালা, পাহারাওয়ালা”, বলিয়া চীৎকার করিতে লাগিলেন, সত্বর দুই দিক হইতে দুইজন পাহারাওয়ালা ছুটিয়া আসিল।
এসকল ব্যাপারে যাহা হয়, তাহাই হইল। একজন লাস এবং নগেন্দ্রনাথ ও কোচম্যানের পাহারায় রহিল। আর একজন থানায় সংবাদ দিতে ছুটিল।
অর্দ্ধ ঘটিকার মধ্যেই ইনস্পেক্টর প্রভৃতি অনেক পুলিস-কৰ্ম্মচারী উপস্থিত হইলেন। লাস লইয়া তাঁহারা থানায় চলিলেন; নগেন্দ্রনাথ ও কোচম্যানকেও থানায় যাইতে বাধ্য হইতে হইল। সেখানে তাহাদের নাম ঠিকানা লইয়া ছাড়িয়া দেওয়া হইল। রাত্রিশেষে নগেন্দ্রনাথ গৃহে ফিরিলেন।
রাত্রির ঘটনায় তাঁহার নিদ্রা হইল না। তিনি ভাবিলেন “যেমন করিয়া হয় কে এই লোকটিকে খুন করিয়াছে তাহা অনুসন্ধান করিব। ইহাতে আমার উপন্যাস লিখিবার পক্ষে সুবিধা হইবে।”
পরদিন সকালে তিনি নিজের বহির্ব্বাটীতে বসিয়া এই বিষয় লইয়াই মনে মনে আলোচনা করিতেছিলেন, এমন সময়ে এক ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত হইলেন।
তাঁহার বয়স প্রায় চল্লিশ বৎসর হইবে। দেখিলেন বোধহয়, শরীরে যথেষ্ট বল আছে; হঠাৎ দেখিলে তাঁহাকে বড় দয়ালু সদাশয় লোক বলিয়া বোধহয়; কিন্তু তাঁহার চক্ষুর দিকে চাহিলে অতি কঠোর ও অতিশয় বুদ্ধিমান চতুর লোক বলিয়া বেশ প্রতীয়মান হয়।
নগেন্দ্রনাথ সন্দিগ্ধভাবে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। তখন নবাগত ব্যক্তি বলিলেন, “রাণীর গলির খুন সম্বন্ধে দুই একটা কথা জিজ্ঞাসা করিবার জন্য আপনার নিকটে আসিয়াছি।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আপনি কি পুলিস হইতে আসিতেছেন?”
তিনি বলিলেন, “হাঁ অধীনের নাম অক্ষয়কুমার—ডিটেটিভ ইনস্পেক্টর। এই খুনের ব্যাপারে অনুসন্ধান করিবার ভার আমার উপর পড়িয়াছে।”
অক্ষয়কুমারের নাম নগেন্দ্রনাথ পূর্ব্বে শুনিয়াছিলেন। ডিটেটিভগিরিতে, তিনি একজন সুদক্ষ লোক বলিয়াই সকলে জানিত। নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “অক্ষয়বাবু, আপনার সঙ্গে পরিচিত হইয়া বড়ই প্রীত হইলাম। আপনার নিকটে আমার একটা অনুরোধ আছে।”
“অনুরোধ কি বলুন? আমি আপনার অনুরোধ রক্ষার জন্য সাধ্যানুসারে চেষ্টা করিব।”
“এই খুনের অনুসন্ধান করিবার জন্য অনুগ্রহ করিয়া আমাকে আপনার সঙ্গে লউন।”
অক্ষয়কুমার চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বিস্মিত ভাব প্রকাশ করিয়া বলিলেন, “কেন?”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আমি দুই-একখানা উপন্যাস লিখিয়াছি—আরও খানকতক লিখিতে ইচ্ছা আছে—ডিটেক্টিভ উপন্যাসও দুই-একখানা লিখিয়াছি; এই খুনের অনুসন্ধানে আপনি যদি আমাকে সঙ্গে রাখেন, তবে আমি আপনার নিকট বিশেষ উপকৃত হই।”
অক্ষয়কুমারবাবু বলিলেন “হাঁ বেশ ত;—তবে একটা কথা আছে।”
নগেন্দ্রনাথ ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “বলুন কি?”
“আমি যাহা বলিব, আপনাকে তাহাই করিতে হইবে। কোনমতে আমার কথার অন্যথাচরণ করিতে পারিবেন না।”
“আপনি যাহা বলিবেন, আমি তাহাই করিব।”
“উত্তম। আসুন,–সেকেণ্ড করুন। আমাদের এগ্রিমেন্ট পাকা হইয়া গেল। আজ হইতে আপনি আমার এ কার্য্যে অংশীদার হইলেন।”
এই বলিয়া অক্ষয়কুমার সজোরে নগেন্দ্রনাথের করমর্দন করিলেন। অক্ষয়কুমার তাঁহার সহিত উপহাস করিতেছেন কি না, এ বিষয়ে নগেন্দ্রনাথের সন্দেহ হইল কিন্তু তিনি সে-বিষয়ে কোন কথা উত্থাপন করিলেন না।
তখন অক্ষয়কুমার প্রাচীরে ঠেস দিয়া ভাল হইয়া বসিলেন। নগেন্দ্ৰনাথ বলিলেন, “এখন এই ছদ্মবেশী লোককে কে খুন করিয়াছে, তাহাই অনুসন্ধান করিয়া বাহির করা আমাদের কাৰ্য্য।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “ঠিক তাহা নহে। যে তাহাকে খুন করিয়াছে, তাহা আমি জানি।”
নগেন্দ্রনাথ সন্দেহ প্রকাশ করিয়া বলিলেন, “তাহা আপনি জানেন?’
“হাঁ, একজন স্ত্রীলোক তাহাকে খুন করিয়াছে।”
“আপনি ইহা নিশ্চিত জানিতে পারিয়াছেন?”
“অবস্থাগত প্রমাণে যতদূর জানা যায়।”
“আপনি কিরূপে জানিলেন? খুনী কি ধরা পড়িয়াছে?”
“ধরিবার বাহিরে গিয়াছে।”
“ধরিবার বাহিরে গিয়াছে?—সে কি?”
“খুনীও খুন হইয়াছে।’
“খুন?”
“হাঁ,—সে-ও খুন হইয়াছে।”
নগেন্দ্রনাথ নিতান্ত বিস্মিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “ওঃ একেবারে ডবল খুন?”
অক্ষয়কুমার নিতান্ত গম্ভীরভাবে বলিলেন, “হাঁ, দ্বরওয়ানের বেশধারী লোকটা সম্ভবতঃ রাত্রি বারটা
হইতে একটার মধ্যে খুন হইয়াছিল। স্ত্রীলোকটি সম্ভবতঃ খুন হইয়াছে, একটা হইতে দুইটার মধ্যে।”
“কোথায় স্ত্রীলোকটিকে পাওয়া গিয়াছে?”
“অধিক দূরে নহে—গঙ্গার ধারের রাস্তার উপর, প্রায় গঙ্গার ধারে।”
“তাহা হইলে বোধ হইতেছে, খুনী লাসটা জলে ফেলিয়া দিবার চেষ্টা পাইয়াছিল?”
“নিশ্চয়ই। কাহারও পায়ের শব্দ শুনিয়া লাস ফেলিয়া পলাইয়া গিয়াছে।”
“কে প্রথম লাস দেখিতে পায়?”
“একটা হিন্দুস্থানী—সে ভোরে গঙ্গাস্নান করিতে গিয়া লাস দেখিতে পাইয়া পুলিসে খবর দেয়। আমিও সংবাদ পাইয়া তখনই লাস দেখিতে যাই।”
“আপনার এত তাড়াতাড়ি যাইবার কি কোন কারণ ছিল?”
“হাঁ—একটু ছিল বই কি? এইটা দেখুন দেখি।” এই বলিয়া অক্ষয়কুমার নগেন্দ্রনাথের হাতে এক টুকরা ছিন্ন বস্ত্র দিলেন। তিনি দেখিলেন, সেটি কোন হিন্দুস্থানী স্ত্রীলোকের সুরঞ্জিত বস্ত্রের কিয়দংশ।
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “এই কাপড়ের টুকরা মৃত দ্বরওয়ানের ডান হাতের মুঠার ভিতরে ছিল। নিশ্চয়ই যখন সে খুন হয়, তখন সে আত্মরক্ষার জন্য তাহার খুনীর কাপড় টানিয়া ধরিয়াছিল, সে ছোরার আঘাতে পড়িয়া গেলে, তখন খুনী কাপড় ছিনাইয়া লইয়া পলাইযা যায়। মৃত ব্যক্তি কাপড়ের কতকাংশ এমনই জোরে ধরিয়াছিল যে সে অংশ তাহার হাতেই রহিয়া যায়, সুতরাং আমি বুঝিলাম যে খুন করিয়াছিল সে স্ত্রীলোক; পুরুষে এরূপ রঙিন শাড়ী পরে না। রঙিন শাড়ী দেখিয়া বুঝিলাম স্ত্রীলোকটি বাঙ্গালী নহে—হিন্দুস্থানী।“
“আপনার অনুমান ঠিক—তবে যে স্ত্রীলোকটি খুন হইয়াছে সেই যে ইহাকে খুন করিয়াছে তাহা আপনি কিরূপে জানিলেন?”
“ক্রমশঃ—ব্যস্ত হইবেন না—স্ত্রীলোক খুন হইয়াছে শুনিয়া আমি তখনই এই কাপড়ের টুকরা লইয়া গঙ্গার দিকে ছুটিলাম। যাহা ভাবিয়াছিলাম তাহাই—সেখানে যে স্ত্রীলোকটি খুন হইয়াছিল, তাহার পরিহিত শাড়ীর একদিক ছেঁড়া। এটা তাহার সহিত জোড়া দিয়া দেখিলাম যে, ঠিক জোড় মিলিয়া গেল। কাজেই এটা স্থির যে, এই স্ত্রীলোকই সেই দ্বরওয়ানের মত লোকটাকে খুন করিয়াছিল।”
“কিন্তু স্ত্রীলোকটিকে খুন করিল কে?”
“এইটি হইতেছে কথা—তাহাই আমাদিগকে এখন অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিতে হইবে। স্ত্রীলোকটির কাপড় বা অন্য কোন চিহ্ন নাই যে, সে কে তাহা সপ্রমাণ হয়। দ্বারওয়ান ও স্ত্রীলোক এ-দু’জনের লাসের এখনও সনাক্ত হয় নাই। ফটোগ্রাফ তোলা হইয়াছে,—শীঘ্রই সনাক্ত হইবে, সন্দেহ নাই।”
“পুরুষটির কাপড়ে কোন চিহ্ন নাই?”
“আছে, এই লোকটি ছদ্মবেশে ছিল, এর গায়ে যে জামা ছিল তাহা সাধারণ দ্বারওয়ানের মত; কিন্তু ঐ জামার নীচে একটা ভাল জামা ছিল, ঐ জামায় ‘বসু এণ্ড কোং’ লেখা আছে। ‘বসু কোম্পানী’ জোড়াসাঁকোর পোষাক বিক্রেতা; তাহাদের নিকট সংবাদ লইলে এই লোকের সন্ধান পাওয়া যাইবে। লোকটির মৃতদেহ দেখিলে স্পষ্টই বোধ হয় যে, তিনি ধনী লোক ছিলেন। সম্ভবতঃ কোন ধনী হিন্দুস্থানী সওদাগর, এই লোকের পরিচয় পাওয়া কঠিন হইবে না, তবে স্ত্রীলোকটির পরিচয় সহজে পাওয়া যাইবে না।”
“স্ত্রীলোকটি কেন এই লোককে খুন করিল, জানিতে পারিলে সে কে জানাও কঠিন হইবে না, সুতরাং বসু কোম্পানীর সূত্র ধরিয়া পুরুষের সন্ধান হইলে স্ত্রীলোকটিরও পরিচয় পাওয়া যাইবে।”
“হাঁ—যদি এই সূত্র ধরে কিছু না হয়, তবে আর একটা সূত্র আছে।”
“সেটা কি?”
“সেটা এই।”
এই বলিয়া অক্ষয়কুমার পকেট হইতে একটী কৃষ্ণপ্রস্তর নির্ম্মিত সিন্দূর রঞ্জিত ছোট শিবলিঙ্গ বাহির করিয়া টেবিলের উপরে রাখিলেন।
নগেন্দ্রনাথের বিস্ময় আরও বাড়িল।