চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ
কিয়ৎক্ষণ পরে অক্ষয়কুমার বলিলেন, “এ কথা ঠিক নহে। নোট বদ্লান হইয়াছে দেখিয়া, গুরুগোবিন্দ সিংহ আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়াছিলেন; তিনি ইহার কিছুই জানিতেন না।”
ললিতাপ্রসাদ বিরক্তভাবে বলিলেন, “আমি তাহা জানি না। হুজুরীমলবাবু খুন হইবার প্রায় তিন সপ্তাহ পূর্ব্বে তিনি একদিন গোপনে লইয়া গিয়া আমাকে একটা কাজ করিবার জন্য বিশেষ অনুরোধ করেন। তিনি আমাদের গদির অংশীদার—আমার পিতৃবন্ধু, আমি তাঁহার অনুরোধ রক্ষা করিতে বাধ্য।”
“নিশ্চয়ই। অনুরোধটা কি শুনিতে পাই না?”
“তিনি বলেন যে, গুরুগোবিন্দ সিংহ পঞ্জাবের একটা সম্প্রদায়ের লোক, তিনিও তাহাই। এই সম্প্রদায়ের দশ হাজার টাকা কি কাজের জন্য গুরুগোবিন্দ সিং কলিকাতায় আনিয়াছেন। এই সম্প্রদায়ের সব কাজই গোপনে হয়—কে এই সম্প্রদায়ে আছে, তাহা কেহ জানিতে পারে না। অনেক বড়লোক এই সম্প্রদায়ভুক্ত, তাঁহারাই টাকা দিয়া থাকেন। কিন্তু তাঁহারা কিছুতেই ইচ্ছা করেন না যে, অপরে ইহা জানিতে পারে। এই সকল নম্বরী নোট তাঁহারাই দিয়াছিলেন; পাছে গুরুগোবিন্দ সিং বা হুজুরীমল ভাঙাইলে কাহাদের নোট লোকে জানিতে পারে, এইজন্য তিনি আমাকে নোটগুলি ভাঙাইয়া দিতে অনুরোধ করেন। এ কি অন্যায় কাজ?”
“নিশ্চয়ই নয়।”
“তাই আমি নোট ভাঙাইয়া অপর নোট আনিয়া তাঁহাকে দিয়াছিলাম—লুকাইয়া গোপনে নোট ভাঙাই নাই।
“এ কথা আগে বলেন নাই কেন?”
“হুজুরীমলবাবু এ কথা প্রকাশ করিতে বিশেষরূপে নিষেধ করিয়াছিলেন। পাছে অপরকে দিয়া ভাঙাইলে প্রকাশ হয় বলিয়াই তিনি আমাকে অনুরোধ করিয়াছিলেন।”
“তিনি খুন হওয়ার পরেও আপনি বলেন নাই কেন?”
“বলিবার ইচ্ছা করিয়াছিলাম, কিন্তু পাছে আপনারা আমাকে সন্দেহ করেন, এই ভয়ে বলি নাই।”
“আপনি কি শুনেন নাই, গুরুগোবিন্দ সিং নোট ফেরৎ পাইয়াছেন?”
“হাঁ শুনিয়াছি।”
“আপনি যে নোটগুলি ভাঙাইয়া আনিয়াছিলেন, ঠিক সেইগুলি নম্বরে মিলিয়াছে?”
“হইতে পারে, যে চুরি করিয়া লইয়াছিল, সে-ই ভয়ে ফেরৎ দিয়াছিল।”
“আপনি স্বচক্ষে দেখিয়াছিলেন যে, যখন হুজুরীমল বাহির হইয়া যান, তখন উমিচাঁদ নোটগুলি
সিন্দুকে রাখিয়াছিল?”
“হাঁ, আমি সেখানে ছিলাম।”
“তাহার পর আর কেহ সেখানে আসে নাই?”
“তা ঠিক বলিতে পারি না। উমিচাঁদ জানে।” এই বলিয়া ললিতাপ্রসাদ উঠিলেন। বলিলেন, “মহাশয়, আমার অনেক কাজ আছে। এখন আপনারা বিদায় হইতে পারেন। ভদ্রলোককে অনর্থক বিপদগ্রস্ত করা আপনাদের স্বভাব। ভদ্রলোকের নামে কখন এরূপ অপবাদ দিবেন না।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “আপনার নামে কোন অপবাদ দেওয়া হয় নাই—কেবল জিজ্ঞাসা করা হইয়াছে, আপনি নোট ভাঙাইয়াছিলেন কি না, আর ভাঙাইয়াছেন—কেন?”
ললিতাপ্রসাদ বলিলেন, “আপনারা এখন যাইতে পারেন।“
নগেন্দ্রনাথ এই যুবকের ব্যবহারে নিজেকে অপমানিত মনে করিয়া ক্রুদ্ধ হইলেন। অক্ষয়কুমার বাহিরে যাইবার সময়ে মস্তকান্দোলন করিয়া বলিলেন, “অতি দর্পে হত লঙ্কা!”
ললিতাপ্রসাদ কথা কহিলেন না। ভ্রূকুটি করিয়া অন্যদিকে চলিয়া গেলেন।
রাস্তায় আসিয়া নগেন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন কি করিবেন?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “একবার গুরুগোবিন্দ সিংহকে জিজ্ঞাসা করিব, সে যথার্থই নোট ভাঙাইবার জন্য অনুরোধ করিয়াছিল কি না।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আমি একবার যমুনার সঙ্গে দেখা করিতে চাই—আপনি কি বলেন?” অক্ষয়কুমার হাসিয়া বলিলেন, “নগেন্দ্রবাবু, দেখিবেন, যেন হঠাৎ প্রেমে পড়িবেন না।”
“আপনার সব সময়ই বিদ্রূপ।”
“বড় বিদ্রূপ নয়।”
“যাক্—এখন আপনি এ বিষয়ে কি বলেন?”
“সে যে এ ব্যাপারে কোন কথা বলিবে বলিয়া আমার বোধ হয় না।”
“আপনাকে পুলিসের লোক বলিয়া না বলিতেও পারে।”
“মহাশয়কেও ঠিক তাহাই স্থির করিবে।”
‘চেষ্টা করিয়া দেখিতে ক্ষতি কি? কেন সে রাত্রে হুজুরীমলের সঙ্গে দেখা করিয়াছিল, যদি সে বলে, তাহা হইলে হয়ত আমরা নূতন কিছু জানিতে পারিব।”
“কেবল হুজুরীমলের সঙ্গে দেখা করা নয়। তাহার একটু আগে উমিচাঁদের সঙ্গে গদিতে দেখা করিয়াছিল।”
“এ কথা কে বলিল? আপনি ত আমাকে এ কথা বলেন নাই?”
“আগে জানিতে পারি নাই।”
“কেন আসিয়াছিল?”
“উমিচাঁদ বলে হুজুরীমল তাহাকে পাঠাইয়াছিল।”
“কেন?”
“টিকিট আনিবার জন্য হুজুরীমল তাহাকে পাঠাইয়াছিল।”
“আশ্চর্য্যের বিষয়—সন্দেহ নাই। টিকিট আনিবার জন্য হুজুরীমল কি আর লোক পায় নাই!”
“যাইতেছেন—দেখুন, যদি কিছু তাহার নিকটে জানিতে পারেন।”
“চেষ্টা করায় ক্ষতি কি?”
নগেন্দ্রনাথ চন্দননগরে যাওয়া স্থির করিয়া রওয়া হইলেন। অক্ষয়কুমার, গুরুগোবিন্দ সিংহের বাসার দিকে চলিলেন।