তৃতীয় পরিচ্ছেদ
যেসময়ে নগেন্দ্রনাথের বাড়ীতে যমুনাদাস আসিয়াছিলেন, ঠিক সেই সময়ে এদিকে ডিটেক্টিভ- ইনস্পেক্টর অক্ষয়কুমারের বাড়ীতে আর একজন আসিয়াছিলেন।
অক্ষয়কুমার কখন ভাবেন নাই যে, তিনি সন্ধান করিয়া তাঁহার বাড়ীতে আসিবেন। তাঁহার আগমনে খুন সম্বন্ধে নিজের যে ধারণা হইয়াছিল, তাহা সমস্তই উল্টাইয়া গেল। তিনি নিজ গৃহে বসিয়া কতকগুলি কাগজ-পত্র দেখিতেছিলেন। এই সময়ে তাঁহার ভৃত্য আসিয়া বলিল, “দুইজন স্ত্রীলোক দেখা করিতে চান্।”
‘স্ত্রীলোক!” বলিয়া অক্ষয়কুমার মাথা তুলিলেন। বলিলেন, “কোথা হইতে আসিতেছেন?” ভৃত্য বলিল, “তাহা জানি না। তারা আপনার সঙ্গে দেখা করিতে চান। গাড়ী করে এসেছে।” অক্ষয়কুমার সেই স্ত্রীলোক দুটিকে সেখানে আনিবার অনুমতি দিয়া নিজের কাগজ-পত্র গুছাইতে লাগিলেন। ভৃত্য চলিয়া গেল। কিয়ৎক্ষণ পরে দুইটি স্ত্রীলোককে সঙ্গে করিয়া লইয়া সে ফিরিয়া আসিল।
অক্ষয়কুমার দেখিলেন, দুইটিই হিন্দুস্থানী স্ত্রীলোক। একটিকে দেখিলে অপরটির দাসী বলিয়া স্পষ্টই বুঝিতে পারা যায়। দাসীর বয়স হইয়াছে, তাহার অবগুন্ঠন নাই; কিন্তু অপরের মুখ অবগুন্ঠনে আবৃত। দেখিলেই সম্ভ্রান্ত মহিলা বুঝা যায়।
অক্ষয়কুমার অতি সম্মানের সহিত কর্ত্রী ঠাকুরাণীকে বলিলেন, “আপনারা কি কাজের জন্য আমার নিকট আসিয়াছেন—সাধ্য হইলে নিশ্চয়ই সম্পন্ন করিব।”
রমণী অবগুন্ঠনের ভিতর হইতে অতি মৃদুস্বরে বলিলেন, “আমার স্বামীই সেদিন খুন হইয়াছেন।” অক্ষয়কুমার নিতান্ত বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “আপনি কি হুজুরীমল বাবুর স্ত্রী?” রমণী গ্রীবা হেলাইয়া নিম্নস্বরে বলিলেন, “হ্যাঁ।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “আপনার স্বামীর খুনের তদন্তই আমি করিতেছি।”
রমণী তাঁহার কথার কোন উত্তর না দিয়া দাসীকে কি বলিলেন; সে বাহিরে চলিয়া গেল। তখন রমণী অক্ষয়কুমারের আরও নিকটে আসিলেন। অক্ষয়কুমার একটু সরিয়া দাঁড়াইলেন।
রমণী বলিলেন, “আপনি আমাদের ওখানে গিয়াছিলেন—অসুখের জন্য আপনার সঙ্গে সেদিন দেখা করিতে পারি নাই। অনেক অনুসন্ধান করিয়া আপনার বাড়ীর ঠিকানা জানিয়া এখানে আসিয়াছি।”
“কিজন্য আসিয়াছেন, বলুন।”
“যে খুন করিয়াছে—তাহাকে কি পাইয়াছেন?
“না—তাহাকে এখনও পাই নাই।”
“কে খুন করেছে, আমি জানি—তাহা বলিতে এসেছি।”
অক্ষয়কুমার বিস্মিতভাবে তাঁহার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “কে খুন করিয়াছে, আপনি মনে করেন?” রমণী বলিলেন, “গঙ্গা।”
“গঙ্গা!” বলিয়া অক্ষয়কুমার বিস্ময়াবেগে দাঁড়াইয়া উঠিলেন। রমণীর দিকে কিয়ৎক্ষণ চাহিয়া রহিলেন। তৎপরে বলিলেন, “আপনি কেমন করিয়া জানিলেন?”
রমণী অতি বিচলিতভাবে বলিলেন, “আমি জানি—আমি শপথ করিতে পারি। সে ডাকিনী- সে সয়তানী।”
অক্ষয়কুমার ধীরে ধীরে বলিলেন, “কেবল জানি বলিলে খুন সপ্রমাণ হয় না; কিরূপে জানিলেন, সেটাও বলুন।”
রমণী ব্যগ্রভাবে বলিতে লাগিলেন, “যতদিন এই সয়তানী আমাদের বাড়ীতে আসে নাই, ততদিন আমি স্বামীর সঙ্গে বড় সুখে ছিলাম। এই ডাকিনী আসিয়া আমার স্বামীর মন ভাঙাইয়া লয়। আমি জানিতাম—অনেকদিন হইতে জানিয়াছি, সে লুকিয়ে আমার স্বামীর সঙ্গে কলিকাতায় দেখা করিত- সেই আমার স্বামীকে চুরি করিয়া লইয়াছিল।”
“যখন সে আপনার স্বামীকে আত্মসাৎ করিবার চেষ্টা করিতেছিল, তখনই আপনি তাহাকে তাড়াইয়া দেন নাই কেন?”
“আমি তাড়াইবার কে? আমি কিছু বলিলে তিনি কোন কথা শুনিতেন না, ঐ সয়তানীই তাঁহার মন ভুলাইয়া লইয়াছিল। আমি জানিতে পারিয়াছিলাম—পরেও জানিয়াছি, এই সয়তানী তাঁহার সঙ্গে সেদিন রাত্রে এদেশ ছাড়িয়া পলাইবার বন্দোবস্ত করিয়াছিল। সে তাঁহাকে ভালবাসিত না, তাঁহার টাকা ভুলাইয়া লইবার ফন্দীতে ছিল। টাকার লোভেই সে তাহার কোন ভালবাসার লোক দিয়ে তাঁকে খুন করেছে, আমি শপথ করিয়া এ কথা বলিতে পারি।”
“আপনি কি মনে করেন যে, তবে যমুনাদাসই হুজুরীমলবাবুকে খুন করিয়াছে?”
রমণী তীক্ষ্ণকন্ঠে বলিয়া উঠিলেন, “সে সয়তানী, বেইমানী, সে মুখে যমুনাদাসকে ভালবাসা দেখায়, তাকে বে করিবে বলিয়াছে—সেই মূর্খও তাই বিশ্বাস করিয়াছে; আমি সে সয়তানীকে খুব চিনি। যমুনাদাস খুন করে নাই।”
“তবে কাহাকে দিয়া খুন করাইয়াছে মনে করেন?”
“ললিতাপ্রসাদ—ললিতাপ্রসাদ—তাকেই সয়তানী ভালবাসে, তার জন্যে প্রাণ দিতে পারে; আমি জানি, তাহার দ্বারাই সে আমার স্বামীকে খুন করিয়াছে।”
রমণীর কথায় অক্ষয়কুমারের বিস্ময় চরমসীমায় উঠিয়াছিল। তিনি অবাঙ্মুখে রমণীর দিকে চাহিয়া রহিলেন। রমণী কিয়ৎক্ষণ পরে বলিলেন, “আমি চলিলাম, সয়তানী যদি পালায়, তবে আমার স্বামীর রক্ত তোমার উপর—আমার শাপ তোমার উপর।”
অক্ষয়কুমার কথা কহিবার পূর্ব্বেই তিনি চঞ্চলচরণে সে কক্ষ হইতে বাহির হইয়া গেলেন হুজুরীমলের স্ত্রীর কথা শুনিয়া অক্ষয়কুমার কেবল যে বিস্মিত হইলেন, এরূপ নহে—তিনি স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। ভাবিলেন, সংসারে লোকে যাহা ভাবে, তাহা প্রায়ই হয় না, এই হুজুরীমল সহরে খুব বড়লোক বলিয়া গণ্য ছিল। তাহাকে ধাৰ্ম্মিক, দানশীল—অতি বদান্য লোক বলিয়া সকলে জানিত। কিন্তু কি আশ্চৰ্য্য, এই বুড়ি বদমাইস সকলের চোখে ধূলি দিয়া ভিতরে ভিতরে কি ভয়ানক কাজই না করিতেছিল? দাসী গঙ্গার সঙ্গে তাহার প্রণয়—কি ঘৃণা! আবার তাহাকে লইয়া দেশ ছাড়িয়া পলাইতেছিল? পরের টাকা লইয়াও চম্পট দিতেছিল, কি ভয়ানক! আমি যাহা ভাবিতেছিলাম, এই মাগীর কথায় একদম সব উল্টাইয়া গেল, দেখিতেছি। যাহা হউক, সহজে ইহার কথাও বিশ্বাস করা যায় না। স্ত্রীলোকের রাগ হইলে সব করিতে পারে, সব বলিতে পারে। দেখা যাক্, কতদূর কি হয়।