চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ
অক্ষয়কুমার একবার রুষ্টভাবে নগেন্দ্রনাথের দিকে চাহিয়া মুখ ফিরাইয়া লইলেন। পরে যমুনাকে বলিলেন, “যদি আমার সন্দেহ না ঘুচাইয়া যাইতে চাও, যদি ভয় পাইয়া থাক, তবে যাও।”
যমুনা বিস্মিতভাবে অক্ষয়কুমারের দিকে চাহিয়া বলিল, “আমি ভয় পাইব কেন?” বলিয়া সে ধীরে ধীরে আবার কৌচের উপর বসিল। বসিয়া অতি মৃদুস্বরে বলিল, “বলুন।”
অক্ষয়কুমারের নির্ম্মর্ম ব্যবহারে নগেন্দ্রনাথের ভয়ানক রাগ হইল। তাঁহার ইচ্ছা হইল, একটা মুষ্ট্যাঘাত অক্ষয়কুমারের মস্তকে বসাইয়া দেন, কিন্তু তাহা তিনি করিলেন না। ভাবিলেন, “ডিটেটিভ কাজে যদি এইরূপ নৃশংস হইতে হয়, তাহা হইলে ইহা ভদ্রলোকের কাজ নয়।”
অক্ষয়কুমার কিয়ৎক্ষণ যমুনাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলেন না। তাহাকে প্রকৃতিস্থ হইবার জন্য সময় দিলেন।
যখন তিনি দেখিলেন যে, যমুনা অনেকটা সুস্থ হইতে পারিয়াছে, তখন তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি সিন্দুর-মাখা শিব দেখিয়া মূৰ্চ্ছিত হইলেন কেন?”
যমুনা নতশিরে ধীরে ধীরে বলিল, “ওটা দেখে আমার মেসো মহাশয়ের কথা মনে পড়েছিল, তাই—”
“তাঁর সঙ্গে এর কি সম্বন্ধ আছে?”
“ও রকম একটা তাঁহার কাছে আমি দেখিয়াছিলাম। তিনি আমাকে বলিয়াছিলেন যে, এ একটা ধর্ম্ম-সম্প্রদায়ের চিহ্ন।”
“পঞ্জাবের ধর্ম্মসম্প্রদায়?”
“তা ঠিক জানি না।”
“আপনি ত পঞ্জাব হইতে আসিয়াছেন?”
“কিন্তু সেখানে ইহা দেখি নাই।”
“আপনি এ সম্প্রদায় সম্বন্ধে কিছু জানেন?
“না—কিছুই জানি না।”
“হুজুরীমল এই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন?”
“তা জানি না।”
“যাক্ ও কথা—এখন আপনাদের দাসীর কথাই হউক; এই দাসীর সঙ্গে হুজুরীমলবাবুর কি বড় মেশামিশি ছিল?”
যমুনা বিস্মিতভাবে অক্ষয়কুমারের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, “সে দাসী, তার সঙ্গে মেশামিশি থাকিবে কেন?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “আর কাহারও সঙ্গে ছিল?”
এবার যমুনা ক্রুদ্ধভাবে বলিল, “দাসীদের সকল খবর আমরা জানি না।”
অক্ষয়কুমার একটু অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন, “না—না—তা ত ঠিক। যাক্ সে কথা, গত শনিবার রাত্রে আপনি কি কলিকাতায় হুজুরীমলবাবুর বাড়ীতে গিয়াছিলেন?”
যমুনা বিস্মিত হইয়া বলিল, “আমি—আমি—সেখানে কেন যাইব?”
অক্ষয়কুমার তাহার হাত ভাল করিয়া লক্ষ্য করিয়া দেখিলেন, কিন্তু তাহার আঙ্গুলে কোন আংটী দেখিতে পাইলেন না। তখন তিনি ভাবিলেন, “নিশ্চয়ই এ যায় নাই—অপর কেহ হইবে।”
তিনি কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোন মেয়েমানুষ তাঁহার নিকটে আসিত কি না, তাহা কি আপনি জানেন?”
যমুনা বিরক্তভাবে বলিল, না, আমি জানি না। চাকরেরা জানিলেও জানিতে পারে।” অক্ষয়কুমার সোৎসাহে বলিলেন, “ঠিক কথা, একবার আপনাদের চাকরদের দেখা যাক্।” এই বলিয়া তিনি নগেন্দ্রনাথের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “আপনি এইখানেই বসুন, আমি এখনই আসিতেছি।”
নগেন্দ্রনাথ অক্ষয়কুমারের দুর্ব্যবহারে বিরক্ত হইয়াছিলেন, কোন কথা না কহিয়া বসিয়া রহিলেন। তিনি চিন্তিত মনে বসিয়াছিলেন। সহসা কাহার পদশব্দে তিনি ফিরিলেন। দেখিলেন, একটি ভদ্রলোক একটি স্ত্রীলোকের সহিত সেই কক্ষ মধ্যেই প্রবিষ্ট হইয়াছেন। তিনি যে সেখানে বসিয়া আছেন, তাহা তাঁহারা জানিতেন না। উভয়েই তাঁহাকে দেখিয়া চমকিত হইলেন, এবং তখনই সে কক্ষ পরিত্যাগ করিতে উদ্যত হইলেন। কিন্তু ভদ্রলোকটি তাঁহাকে দেখিয়া বলিয়া উঠিলেন, “নগেন্দ্ৰ না?”
নগেন্দ্রনাথ উঠিয়া দাঁড়াইলেন; বিস্মিতভাবে বলিলেন, “আরে কেও যমুনাদাস!”
তিনি হাসিয়া বলিলেন, “চিনিতে পারিয়াছ, ইহাই আমার সৌভাগ্য।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “অনেকদিন তোমাকে দেখি নাই বটে,কিন্তু তোমার চেহারা ঠিক সেইরূপই আছে।”
যমুনাদাস হাসিয়া বলিলেন, “এটি আমার একটা গুণ বলিতে হইবে।”
নগেন্দ্রনাথ পার্শ্ববর্ত্তিনী রমণীকে দেখিতেছেন দেখিয়া যমুনাদাস হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “ইনি হুজুরীমলবাবুর শালীঝির বিশেষ বন্ধু। এই বাড়ীতেই থাকেন, তবে আর বোধহয়, বেশীদিন থাকিতে হইবে না। যমুনাদাস এ রত্ন লইয়া যাইবে।”
রমণী সলজ্জভাবে ভূন্যস্তদৃষ্টিতে দাঁড়াইয়া রহিল। যমুনাদাস বলিলেন, “তুমি এখানে কেন?”
‘একজন ডিটেক্টিভের সঙ্গে এসেছি।”
“ডিটেক্টিভ! হুজুরীমলবাবুর খুনের বিষয়!”
“হাঁ।”
‘এমন ভাল লোককে কে খুন করিল?”
“তাহারই সন্ধান হইতেছে।”
“তুমিও কি ইহার সন্ধানে আছ?”
“হাঁ, অক্ষয়কুমারবাবু অনুগ্রহ করে আমাকে সঙ্গে লইয়াছেন! জান ত, আমি ডিটেটিভ উপন্যাস লিখিবার চেষ্টা করিয়া থাকি। অক্ষয়বাবু একজন খুব নামজাদা ডিটেক্টিভ।”
“বেশ বেশ—খুব ভাল। ভাই, আমাকেও সঙ্গে লও, আমার এসকল বিষয় সন্ধান করিতে বড় ভাল লাগে; বিশেষতঃ হুজুরীমলবাবু আমাকে বড় ভালবাসিতেন
“অক্ষয়বাবুকে বলিব।”
এই সময়ে অক্ষয়কুমার তথায় উপস্থিত হইলেন। কিন্তু ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া উভয়কে লক্ষ্য করিতে লাগিলেন। সহসা তাঁহার দৃষ্টি রমণীর হাতের দিকে পড়িল। তিনি চমকিত হইলেন।
রমণীর হস্তে সেই আংটী।