দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
উমিচাঁদ অতিশয় ব্যগ্রভাবে বলিল, “এ কখনই হইতে পারে না।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “আমি কেবল অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া একথা বলিতেছি। হুজুরীমল যদি টাকা লইয়া না থাকেন তবে লইল কে? অন্য কেহ চাবি লইয়া তবে সিন্দুক খুলিয়াছিল?”
উমিচাঁদ ক্রুদ্ধ হইয়া বলিল, “তবে কি আপনি মনে করেন, আমি টাকা লইয়াছি?”
“এ কথা আমি বলি নাই।”
“আমি এরূপ মূর্খ নই যে নোট লইব। সমস্তই নম্বরী নোট। সব নোটের নম্বরই গুরুগোবিন্দ সিংহের নিকটে আছে। এ নোট লইলে ভাঙ্গাইবার কোন সম্ভাবনা নাই।”
“আপনার দ্বারা একাজ হয় নাই, তাহা নিশ্চয়। তবে কথা হইতেছে যে, যদি আপনি লইলেন না, হুজুরীমল লইলেন না, তবে লইল কে? কেহ ত চাবি চুরি করে নাই?”
উমিচাঁদ নিজ কোমর হইতে সিন্দুকের চাবি বাহির করিয়া অক্ষয়কুমারকে দেখাইয়া বলিল, “এই চাবী আমার কাছে রহিয়াছে। সর্ব্বদাই থাকে। এ চাবি কাহারও পাইবার সম্ভাবনা নাই।”
“হুজুরীমলের চাবি চুরি যাইতে পারে?”
“না, তিনি সর্বদা চাবি নিজের কাছে রাখিতেন।”
“তাঁহার কাছে কোন চাবি ছিল না।”
উমিচাদ আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া বলিল, “সে চাবি নিশ্চয়ই কেহ লইয়াছিল।” তৎপরে একটু চিন্তিত ভাবে বলিল, “কিন্তু অপর কেহ গদিতে আসিয়া সিন্দুক খুলিলে নিশ্চয়ই ধরা পড়িত। গদিতে সর্বদাই লোক পাহারায় থাকে।”
অক্ষয়কুমার উঠিলেন। বলিলেন, “দেখা যাক্, কতদূর কি হয়।” তিনি ললিতাপ্রসাদ ও উমিচাঁদকে থানায় লাস সনাক্ত করিবার জন্য পাঠাইয়া দিয়া নগেন্দ্রনাথের সহিত হাওড়া স্টেশনের দিকে চলিলেন।
সত্যকথা বলিতে কি, নগেন্দ্রনাথ এ খুনের যে কোনকালে কোনরূপ কিনারা হইবে, এ বিষয়ে হতাশ্বাস হইতেছিলেন। কিন্তু অক্ষয়কুমার হতাশ হন নাই; তিনি নগেন্দ্রনাথের মনের ভাব বুঝিয়া বলিলেন, “ইহারই মধ্যে হাল ছাড়িয়া দিলে চলিবে কেন? আমাদের হতাশ হইবার কারণ নাই। আমরা অনেক বিষয় জানিতে পারিয়াছি।”
“আমি ত মনে করিতেছি, আমরা কিছুই জানিতে পারি নাই।”
“কেন? এই প্রথম—আমরা একটা লাসের পরিচয় পাইয়াছি। জানিয়াছি, তিনি আমাদের বিখ্যাত গদিয়ান হুজুরীমলবাবু—মহাশয় লোক, ধাৰ্ম্মিক ও দানশীল। আরও জানিয়াছি যে, এই সদাশয় ধাৰ্ম্মিক দানশীল ধনী গদিয়ান পরের দশ হাজার টাকা আত্মসাৎ করিয়া একটা স্ত্রীলোকের সঙ্গে বোম্বে পলাইতেছিলেন। আমরা আরও জানিয়াছি যে, এই টাকা পঞ্জাবের এক সম্প্রদায়ের, সেই সম্প্রদায়ের চিহ্ন সিন্দূরমাখা শিব।”
“হাঁ, এ সব প্রমাণ হয়ত—কথা বটে; কিন্তু হুজুরীমল খুন হইয়াছেন ব্যতীত আর কিছুই সপ্রমাণ হয় নাই।”
“ক্রমে সবই সপ্রমাণ হইবে—ভয় নাই। উপস্থিত এখন একবার হুজুরীমলের চন্দননগরের বাড়ীটা দেখা যাক।”
এইরূপ কথা কহিতে কহিতে উভয়ে হাওড়ায় আসিয়া ট্রেনে উঠিলেন।
চন্দননগরে আসিয়া দেখিলেন যে, হুজুরীমল যে বাড়ীতে থাকিতেন, সেটি একটি সুন্দর বাগানবেষ্টিত বড় বাড়ী। অনেক লোকজন দাস দাসী আছে। হুজুরীমল খুনি বড়লোকের ন্যায়ই এখানে বাস করিতেন। অক্ষয়কুমার হুজুরীমলের স্ত্রীর সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য জনৈক ভৃত্য দ্বারা বাড়ীর ভিতরে সংবাদ পাঠাইলেন। কিন্তু ভৃত্য ক্ষণপরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “তাঁহার শরীর ভাল নয়—তিনি কাহারও সহিত দেখা করিবেন না।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “…তাঁহার অসুখ হইয়া থাকে—বিরক্ত করিতে চাই না; তাঁহার কোন বাঁদীর সহিত দেখা হইলেই আমাদের কাজ হইবে। বল, আমরা পুলিসের লোক—দেখা করাই চাই।”
ভৃত্য আবার বাটীর ভিতরে চলিয়া গেল। এই সময়ে তাঁহারা উভয়ে দ্বারপথে চাহিয়া দেখিলেন একটি ভদ্রলোক একটি স্ত্রীলোকের সহিত কথা কহিতেছেন। দেখিয়া অক্ষয়কুমার বলিলেন, “বোধহয় ঐটিই যমুনা।”
ঠিক সেই সময়ে কে তাঁহার পশ্চাৎ হইতে বলিল, “আমার নাম যমুনা।”
উভয়ে চমকিত হইয়া ফিরিলেন, দেখিলেন, তাঁহাদের সম্মুখে দাঁড়াইয়া একটি পরম রূপবতী যুবতী, তাহার মুখ ম্লান—বিষণ্ণ। যমুনা অতি বিষণ্ণ স্বরে বলিল, “আপনারা কি চান?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “এ সময়ে আপনাদিগকে বিরক্ত করা আমাদের উচিত ছিল না; কর্তব্যের দায়ে আসিতে হইয়াছে।”
যমুনা কোন কথা না কহিয়া নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল।
অক্ষয়কুমার মৃতা স্ত্রীলোকের পরিধানে যে কাপড়খানি ছিল তাহা বাহির করিয়া বলিলেন, “এ কাপড়খানিতে আপনাদের ধোপার চিহ্ন আছে; এ কাপড়খানি কি চিনিতে পারেন?”
যমুনা কাপড়খানি ভাল করিয়া দেখিয়া বলিল, “হাঁ, এ কাপড়খানি আমার মাসীর ছিল, কিন্তু এ কাপড়খানি একজন দাসীকে তিনি দিয়াছিলেন।”
“সে দাসীর নাম কি?”
“রঙ্গিয়া।”
“বেশ নামটি—এখন সে কোথায় গিয়াছে।”
“সে সাত-আটদিন হইল, দেশে গিয়াছে।”
“ঠিক দেশেই গিয়াছে কি?”
“হাঁ। কেন এ কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন?”
“সে দেশে যায় নাই—সে খুন হইয়াছে।”
“খুন হইয়াছে।” বলিয়া যমুনা শিহরিয়া উঠিল। তাহার ম্লান মুখ আরও ম্লান হইয়া গেল, এবং সে পড়িয়া যাইতেছিল, কিন্তু প্রাচীর ধরিয়া দাঁড়াইল। নিকটে একখানি কোচ ছিল, সে তাহাতে তাড়াতাড়ি বসিয়া পড়িল।
অক্ষয়কুমার মনে মনে হাসিয়া বলিলেন, “তুমি বাপু, ভিতরের অনেক কথাই জান।” কিন্তু ঔপনাসিক নগেন্দ্রনাথ যমুনার নিরুপম রূপলাবণ্যে একেবারে বিমুগ্ধ হইয়া গিয়াছিলেন; তিনি অক্ষয়কুমারের এইরূপ নির্ম্মর্ম ব্যবহারে মনে মনে বিশেষ ক্রুদ্ধ হইলেন। কিন্তু কোন কথা কহিলেন না—নীরবে তাহা সহ্য করিলেন।