স্মৃতিসৌধ
অনেকদিন আগেকার কথা। দয়া নদীর ধারে ধৌলি পাহাড়ের নিকট এক সওদাগর বাস করতেন। নাম তার সদানন্দ বণিক। স্ত্রীর নাম ছিল শালিনী। তাদের কোন সন্তান ছিল না। ফলে তাদের মনে খুব দুঃখ ছিল। স্ত্রীকে একা ঘরে রেখে দূরে বানিজ্য করতে যেতে সদানন্দর মন চাইত না। তবুও বাধ্য হয়ে তাকে মাঝে মাঝে যেতে হত বানিজ্যের কাজে বাইরে।
বাড়ির সামনে বনের ধারে একটি শমিবৃক্ষ ছিল। নিজের জন্মদিনে পয়লা বৈশাখ সকালে বৃক্ষটির নীচে দাঁড়িয়ে শালিনী সূর্য প্রণাম সেরে সূর্যের কাছে একটি সন্তানের জন্য বর প্রার্থনা করেছিল।
প্রভু, আমার মনোবাসনা পূর্ণ কর। আমাকে একটি সন্তান দাও। সে সময় সেই শমি বৃক্ষের নীচে পড়ে থাকা একটি কাঁটা তার পায়ে ফুটে যায়। তিনি মুখে আহ্ শব্দ করে উঠে সেই কাঁটাটি পা থেকে তুলে দেখেন পা থেকে একফোঁটা রক্ত বেরিয়েছে। রক্তের দিকে তাকিয়ে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে শালিনী ভাবলেন যদি আমার এমন লাল টুকটুকে একটি ছোট্ট শিশু থাকত? এই ভেবে তিনি রক্তের ফোঁটাটি ডান হাতের তর্জনি দিয়ে মুছে নিয়ে, তা দিয়ে কপালে ফোঁটা পরলেন। শমিবৃক্ষটি তার শাখা-প্রশাখা দুলিয়ে শীতল হাওয়া বইয়ে দিয়ে মধুর কন্ঠে যেন বলে উঠল, ‘তোমার বাসনা পূরণ হবে।’
তারপরে গ্রীষ্ম চলে গিয়ে বর্ষা শুরু হতেই মাঠগুলো সবুজ ঘাসে ভরে উঠতে শুরু করল। বনভূমি সবুজ পাতায় সেজে উঠল। ফুলে ফুলে ভরে উঠল গাছপালা। গাছের সবুজ পাতারা নেচে উঠতে শুরু করল সওদাগর দম্পতিদের দেখে। সদানন্দ গাছ থেকে একটি পারিজাত ফুল তুলে এনে স্ত্রীর খোঁপায় পরিয়ে দিলেন। শালিনী রাঙা মুখে খুশি হয়ে লজ্জাবতীর মতো কুঁকড়ে গেলেন।
ছোট পাখিরা তা দেখে গাছের ডালে বসে গান গাইতে শুরু করল। শালিনীর হৃদয় আনন্দে ভরে উঠল। এইভাবে তাদের দিনগুলি বেশ আনন্দে মজায় কাটছিল। দেখতে দেখতে ধরণীতে বসন্ত কালের আগমন ঘটল।
একদিন সওদাগরের স্ত্রী অনুভব করলেন যে তিনি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছেন। সে কথা লাজুক ভাবে স্বামীকে জানালেন তিনি। সওদাগর খুশিতে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে নিবিড়ভাবে চুমু খেলেন তার কপালে। গাছের ফুলগুলি তা দেখে এ ওর গায়ে ঢলে গড়িয়ে পড়ল খুশিতে।
এরপর দিনগুলি মন্থরভাবে গড়াতে লাগল। তারপর একদিন স্ত্রীর প্রসব বেদনা উঠলে কুন্তি ধাইকে ডেকে আনা হল। সেসময় সওদাগরের স্ত্রী শালিনী স্বামীকে তার কাছে ডেকে বললেন, “আমি যদি মরে যাই তাহলে দাহ কোরো ওই শমিবৃক্ষের নীচে।”
তার শুনে গভীর দুঃখের সঙ্গে সদানন্দ তাকে বললেল, তুমি এসব বলছো কেন এসময়?
স্ত্রী তখন তার হাতটা মুঠোর মধ্যে টেনে নিয়ে বলল, তুমি রাগ কোরো না সখা। আমি যদি সন্তান প্রসব করতে গিয়ে, হঠাৎ যদি মরে যাই। একথা মনে হল বলে, বললাম।
– না, তুমি একথা আর বলবে না। সদানন্দ বলল।
স্ত্রী তখন হেসে বলল, আচ্ছা বাবা আর বলব না।
ঠিক আছে? একটু হাসো এবার।
সদানন্দ করুণভাবে হাসলেন। কিন্তু কথাটা তার মনে ভিতর খটকার মতো বিঁধে রইল।
কুন্তি ধাইয়ের হাতে সন্তান প্রসবের সময় সদানন্দর স্ত্রী শালিনী অজ্ঞান হয়ে সত্যি সত্যিই মারা গেলেন। সদানন্দ ভাবল, মানুষ কি আগে থেকে বুঝতে পারে, তার মৃত্যুর কথা? কোন সদুত্তর পেলেন না। শালিনী মারা গেলেও কিন্তু তার পুত্র-সন্তানটি বেঁচে গেল। পুত্র-সন্তানটি দেখতে হয়েছে একবারে একটি ডল পুতুলের মতো। গায়ের রঙ রক্তের মতো লাল। ফলে তার নাম রাখা হল লালকমল।
শালিনীর ইচ্ছে অনুযায়ী শমিবৃক্ষের নীচে তাকে দাহ করা হল। আর সেখানে শ্বেত-পাথর দিয়ে একটি বেদি তৈরী করে দেওয়া হল।
সদানন্দ তার জন্য খুব কাঁদলেন, তার শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়লেন। নবজাতক শিশু সন্তানটি পালনের দায়িত্ব গিয়ে পড়ল ধাই কুন্তির উপর।
কুন্তি ধাইয়ের কাছে লালকমল মানুষের মতো মানুষ হবে না ভেবেই, তাকে মানুষ করে গড়ে তোলার জন্য সদানন্দ তিন বছর পর, নতুন একজন নারীকে বিয়ে করলেন। মেয়েটির নাম লীলাবতী। বিয়ের দিন রাতেই তাকে বুঝিয়ে বললেন, দুধকুমারকে মানুষের মতো মানুষ করে তোলাই তার একমাত্র কাজ, আর সেজন্যই জন্যই সদানন্দ তাকে বিয়ে করেছেন। লালকমলের যেন কোন রকম অবহেলা না হয়।
কিন্তু তার প্রথম স্ত্রীর সন্তান, লালকমল অবহেলিতভাবে কুন্তি ধাইয়ের কাছে মানুষ হতে লাগল। সওদাগরের নতুন স্ত্রী লীলাবতী দেবী ছোট ছেলেটিকে মোটেই ভাল চোখে দেখত না। হিংসা করত মনে মনে। তাই তাকে কোনদিন ভালবাসত না। সুনজরে দেখত না। বরং তাকে অবহেলা ঘৃণা করত সব সময়। এইভাবে দিন কাটছিল বেশ। সওদাগর ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকয়, এসব খবর তার কানে পৌঁছাত না।
দু’বছর পর নতুন বউ লীলাবতীর একটি কন্যা সন্তান হল। কন্যা সন্তানটির গায়ের রঙ দুধের মতো সাদা হওয়ায় তার নাম রাখা হল দুধকুমারী। নিজের মেয়েকে লীলাবতী খুব ভালবাসতেন। সে তাকে ডাকত আদুরী বলে। সে অনেক আদর যত্নে বড় হয়ে উঠতে লাগল। আর এদিকে কুন্তি ধাইমার কাছে অনাদরে বড় হতে লাগল লালকমল।
নতুন বউ লীলাবতী তার নিজের কন্যা সন্তান দুধকুমারীর জন্য স্বামীর টাকা অকাতরে খরচ করতে লাগলেন। কিন্তু লালকমলের জন্য কিছু খরচ করতে হলেই তিনি কার্পণ্য করতেন। খরচ করতে চাইতেন না। অভাগা লালকমলের খুব কষ্টে, অযত্নে, অবহেলায় দিন কাটতে লাগল। কুন্তি ধাইমা তাকে নিয়ে সিঁড়ির নীচে একটি কুঠরিতে থাকত।
লালকমলকে প্রায়ই বাড়ির এক কোণে একা একা পড়ে থাকতে হত। কুন্তি ধাইমা নিজের কাজ সেরে তাকে নিয়ে বিকেলবেলা শমিবৃক্ষের নীচে, পাথরের বাঁধানো বেদিতে গিয়ে বসত।
দুধকুমারী কিন্তু মোটেও তার মায়ের মতো ছিল না। সে সত্যিকারের ভালবাসতো তার দাদাকে। মা তাকে কিছু খেতে দিলেই তার দাদার কথা মনে পড়ত। সে মার কাছে জানতে চাইত, দাদা খেয়েছে কিনা?
একদিন লীলাবতী দুধকুমারীকে একটা আপেল খেতে দিল। দুধকুমারী বলল, দাদা খেয়েছে মা?
– তুমি এখন এটা খেয়ে নাও, সে যখন বাইরে থেকে ঘরে ফিরবে, তখন সে খাবে।
যখন তারা কথা বলছিল, তখন জানালার বাইরে তাকিয়ে দুধকুমারী তার দাদাকে আসতে দেখল। তাই সে আপেলটি মায়ের কাছ থেকে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে দাদার হাতে দিল।
লালকমল ভয়ে ভয়ে তার হাত থেকে আপেলটি নিয়ে দেখতে পেল, জানলা দিয়ে নতুন মা তা দেখতে পেয়েছে। সে তখন দুধকুমারীকে জিজ্ঞাসা করল, মা কি এটা আমায় খেতে দিয়েছে?
দুধকুমারী বলল, হ্যাঁ।
– আমি খেলে আবার রাগ করবে না তো? বকবে না তো আমাকে?
– কেন বকবে?
-সেদিন তুমি আমায় যে আঙুরগুলি খেতে দিয়েছিলে, তা আমাকে খেতে দেখে মা আমায় খুব বকেছিল। বলেছিল, হ্যাংলা কোথাকার, দুধকুমারীর আঙুর তুই চেয়ে চেয়ে খাস।
– তাই নাকি, তুমি আমায় বলনি তো?
– কি বলব?
– এই কথা
– এটা কি আর বলার মতো কোন কথা হল?
শুনে, দুধকুমারী আর কিছু বলল না তাকে।
কথা বলতে বলতে ওরা ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। তাকে দেখে, লীলাবতী সদয় কণ্ঠে বললেন, ভিতরে এসো লালকমল। আমি তোমায় একটা নতুন আপেল দেব। তুমি ওটা আদুরীকে দিয়ে দাও।
মায়ের কথা মতো লালকমল আপেলটি দুধকুমারীকে দিয়ে দিল।
তিনি তখন তাকে বললেন, আমার সাথে ভিতরে এসো। বলে, সে তাকে স্টোর-রুমে নিয়ে গেল এবং সেখান থেকে বেছে একটি পোকা- ধরা আপেল তার হাতে তুলে দিল। লালকমল সেটা নিয়ে নীচে নেমে গেল। নেমে গিয়ে শমীবৃক্ষের নীচে বেদির উপর বসল। কোথা থেকে একটি টিয়াপাখি এসে হঠাৎ ছোঁ-মেরে তার হাত থেকে আপলেটি নিয়ে উড়ে চলে গেল। তা দেখে লালকমলের মনে খুব দুঃখ হল।
তার মনেহল বেদির ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, দুঃখ কোরো না বাছা, আমি তোমার মা বলছি, আমার আত্মা টিয়াপাখি হয়ে আপেলটা তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। ওটা খেলে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়তে। তুমি এই বাড়ি থেকে যত তাড়াতাড়ি পার সরে পড়। না হলে তোমার খুব বিপদ হতে পারে। এই কথা শুনে তার খুব ভয় করতে লাগল। সে ঘরে ফিরে কুন্তি ধাইমাকে সব কথা খুলে বলল। ধাইমা তার কাছে সব শুনে ঠিক করলেন, এখানে আর থাকা নয়। তাকে এবার বাড়ি ছাড়তে হবে।
ধৌলি পাহাড়ের পাদদেশে কুন্তি ধাইয়ের একটি ছোট পর্ণকুটির ছিল। পরদিন সকালে কাউকে কিছু না জানিয়ে লালকমলকে নিয়ে কুন্তি ধাইমা সেখানে চলে গেল।
একটু পরে দাদাকে খুঁজতে এসে দুধকুমারী তাকে না দেখতে পেয়ে মাকে বলল, দাদাকে তুমি কোথায় পাঠিয়েছো।
– আমি তো তাকে কোথায়ও পাঠাইনি।
– তবে? সে তো ঘরে নেই।
– দেখ, হয়তো সে গিয়ে শমিবৃক্ষের নীচে বেদিটার উপর বসে আছে।
দুধকুমারী সেখানে গিয়ে তাকে খুঁজে না পেয়ে, ঘরে ফিরে এসে একা একা সারাক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
সেই সময় সদানন্দ বাসায় ফিরে এলেন। পোষাক ছেড়ে, স্নান করে খাবার খেতে বসে বললেন, আমার লালকমল কোথায়?”
তার স্ত্রী তাকে কিছুই বলল না, শুধু তার জন্য খাবারের বড় থালাটা টেবিলের উপর রাখল।
সদানন্দ আবার বললেন, লালকমলকে দেখছি না তো?
লীলাবতী এবার বললেন, সে হয়তো কোথায়ও আছে।
সওদাগর খেতে খেতে বলল, জানি তো সে কোথায়ও আছে। একবার এখানে ডাকো তাকে। আমার খুব দেখতে ইচ্ছা করছে তাকে।
দুধকুমারী তখন তার কাছে এসে, কেঁদে ফেলে, বলে উঠল, বাবা, দাদা আমাদের কিছু না জানিয়ে কোথায় চলে গেছে। আমি তাকে অনেক খুঁজেছি কোথায়ও খুঁজে পাইনি।
সদানন্দ খাওয়া থামিয়ে বলল, মানে?
তখন তাকে খুব বিষন্ন ও বিমর্ষ দেখাচ্ছিল।
– তোমার ভাই আবার ফিরে আসবে, আশা করি। তুমি কেঁদো না আদুরী, বললেন লীলাবতী।
সদানন্দ থালায় জল ঢেলে, খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়লেন।
দুধকুমারীও কাঁদতে কাঁদতে সেখান থেকে উঠে তার নিজের ঘরে চলে গেল।
কুন্তি ধাইও বাসায় নেই দেখে, পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই কুন্তি ধাইয়ের বাড়ি খোঁজ করে, সেখানে গিয়ে হাজির হলেন সদানন্দ। গিয়ে দেখলেন, সেখনে কেউ নেই, ঘর বন্ধ। কুন্তি ধাইমা আর লালকমল তখন বনে গেছিল, রান্নার জ্বালানির জন্য কাঠ-পাতা সংগ্রহ করতে। সদানন্দ তাদের না পেয়ে, হতাশ মনে বাড়ি ফিরে এসে, শমিবৃক্ষের নীচে বাঁধানো বেদিটায় উপর গিয়ে বসলেন। মনে মনে ভাবতে লাগলেন, শালিনীর কথা। তাঁর চোখ দিয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল বেদিটার উপর। সদানন্দর মনে হল, বেদিটা যেন একবার কেঁপে উঠল। পরক্ষণেই ভাবলেন, এটা হয়তো তার অবচেতন মনের ভুল। অন্যমনস্ক হয়ে ভাবছিলেন পুরনো দিনগুলির কথা। কী মজায় কেটেছে শালিনীকে নিয়ে সেসব দিনগুলি । শুধু দুঃখ ছিল একটাই, তাদের সন্তান না থাকার জন্য।
যখন লালকমলকে পেল, তখন হারাতে হল শালিনীকে। তার কপাল মন্দ ছাড়া, এটাকে আর কী ভাববে সদানন্দ ! ভাবতে ভাবতে সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। মেয়ে দুধকুমারীর কথায় তার সম্বিত ফিরল।
– বাবা ঘরে চলো।
দেখলো মেয়ে কখন এসে পিছনে দাঁড়িয়েছে তার।
বেদি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মেয়ের হাত ধরে তিনি বলরেন, হ্যাঁ মা চলো।
কুন্তি ধাইমার কাছে লালকমল বড় হতে লাগল। কুন্তি ধাইমার দূর সম্পর্কের এক ভাই দশরথ দয়া নদীতে নৌকা চালাত, মাছ ধরত। দুধকুমার তার কাছে নৌকা চালানো আর মাছ ধরা শিখতে লাগল। এইভাবে দিন মাস বছর গড়াতে লাগল। কয়েক বছরের মধ্যেই সে সেসব শিখে নিল। এর মধ্যেই লালকমলের গায়ের রঙ রোদে পুড়ে, তামাটে হয়ে উঠেছে। সে এখন নদীতে একাই নৌকা বাইতে পারে। জাল দিয়ে মাছ ধরতে পারে ।
এদিকে লালকমলকে হারিয়ে সদানন্দ একেবারে ভেঙে মুষড়ে পড়লেন। ব্যবসা বাণিজ্যে তার আর মন নেই কোন। ভাবেন অর্থ সম্পদ দিয়ে আর কী হবে? কী কাজে লাগবে সে সব? দুশ্চিন্তায় দিন দিন তার শরীর ভেঙে পড়তে লাগল। ভাল করে খেতে পারেন না, ঘুমোতে পারেন না। কবিরাজ বদ্যি ডেকে, তাদের দেখিয়ে কোন লাভ হল না। দিন দিন শরীর আরও খারাপের দিকে যেতে লাগল সদানন্দের।
বিকেল থেকেই আকাশ মেঘলা ছিল। রাতের দিকে বেশ বৃষ্টি হয়েছে। সকাল বেলা মেঘ উধাও। আকাশে সোনালি রোদ উঠেছে। ঝকঝকে একখানা সোনালি সকাল চোখের সামনে উপস্থিত। এমন দিনে নদীতে মাছেদের আমদানি বাড়ে। সকাল বেলাই লালকমল বড় জাল আর নৌকাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল নদীর উদ্দেশ্যে। নদিতে নৌকা নামিয়ে সে লগি দিয়ে তা ঠেলে নৌকা নিয়ে গেল গভীর জলের দিকে। বড় জালটা অনেকটা জায়গা জুড়ে পেতে সে বসে রইল নৌকার উপর। সকাল গড়িয়ে সূর্য মাথার উপর উঠে আসছে, এমন সময় জালে একটা হ্যাচকা টান পড়ল। টানের বহর দেখে লালকমলের বুঝতে বাকি রইল না, বড় কিছু জালে পড়েছে। সে জাল টানতে গিয়ে দেখল, ভীষণ ভারি জালটা। একা তার পক্ষে টেনে তোলা সম্ভব নয় বুঝেই সে একটা লোককে দিয়ে খবর পাঠাল ধাইমার ভাই দশরথ মামার কাছে। দশরথ মাঝি তখন উঠোনে বসে একটা ছেঁড়া জাল সারাই করছিল। লোকটার কথা শুনে, সে জালটা গুটিয়ে ঘরে তুলে রেখে এসে নদির পাড়ে দাঁড়াল। তারপর নৌকায় লালকমলকে দেখতে পেয়ে, নৌকায় উঠে এসে দশরথ মাঝি জালে হাত দিয়ে, টান দিতে গিয়েই বুঝল, এই জাল এইভাবে টেনে এ মাছ তোলা যাবে না। জাল ছিঁড়ে মাছ বেরিয়ে যাবে। নদীর গভীরে ডুব দিয়ে নামতে হবে জালের সীমানা ছুঁয়ে ছুঁয়ে। তারপর জালের মধ্যেই রশি দিয়ে মাছটাকে শক্ত করে বেঁধে ফেলতে হবে। তারপর ধীরে ধীরে রশি সমেত জাল ধরে একটু একটু করে টেনে তুলতে হবে। নৌকার উপর জালের দড়িটা ধরে বসে রইল লালকমল। দশরথ মাঝি শক্ত রশি কোমড়ে বেঁধে নিয়ে জলে নেমে, দম নিয়ে ডুব দিল। তারপর জালের প্রান্ত ছুঁয়ে ছুঁয়ে জলের গভীরে নেমে গেল। সেখানে গিয়ে মাছটাকে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা একবারে সম্ভব হল না। তিন-চার বার তাকে জলে ডুব দিতে হল। সে কি ঝাটকানি মাছের। মাছের লেজের একটা ঝাপট দশরথ মাঝির হাতে লেগে, হাতটা যেন তার অবশ হয়ে আসছিল। দশরথও তাতে হার মানার পাত্র ছিল না। মাছটাকে রশি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে তবে তার কাজ শেষ হল, মনে শান্তি এল। তারপর নৌকায় উঠে এল দশরথ মাঝি। লালকমল আর দশরথ মাঝি মিলে ধীরে ধীরে উপরে টেনে তুলতে লাগল জালটা। বাঁধা অবস্থায়ও মাছটা এক ঝটকা মারল। আচমকা মাছটার ঝাটকা মারায় তা সামলাতে না পেরে লালকমল নৌকা থেকে ছিটকে জলে পড়ে গেল। নৌকায় আর সে উঠল না , জলে দাঁড়িয়ে সেখান থেকেই দশরথ মামার সঙ্গে একই লয়ে জাল টানতে লাগল। জাল তুলে দেখা গেল। বড় একটা বোয়াল মাঝ ধরা পড়েছে জালে। যাকে বলে রাঘব বোয়াল। জাল টেনে তুলতে তুলতে দুপুর গড়িয়ে সূর্য কিছুটা পশ্চিমে হেল পড়েছে। দশরথ মাঝি বুঝল, এত বড় মাছ কেনার লোক এ অঞ্চলে পাওয়া মুসকিল। তাই দশরথ মাঝি তার বোন কুন্তিকে ডেকে বলল, যদি সদানন্দ সওদাগরের বাড়িতে এই মাছ নিয়ে যাওয়া যায়, তবে ভাল দাম পাওয়া যেতে পারে, এই রাঘব বোয়ালের। শেষপর্যন্ত তাই ঠিক হল। কুন্তি ধাই আর দশরথ মাঝি মাছটা নিয়ে সদানন্দ বাবুর বাড়িতে পৌঁছে গেল।
জানলা দিয়ে ধাইকে আসতে দেখে সদানন্দ খুব খুশি হলেন। বিছানায় উঠে বসলেন। তারপর ধীরে ধীরে পা ফেলে দরজার দিকে এগোলেন। কুন্তি ধাইকে আপ্যায়ন করে এনে ঘরের ভিতরে বসালেন। কিন্তু ধাইকে দেখে মোটেও খুশি হলেন না লীলাদেবী। মুখ ঝামটা দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন তিনি।
মাছটার জন্য দশরথ মাঝিকে ভাল দাম দিয়ে বিদায় করে দিলেন সদানন্দ বণিক। তারপর কুন্তি ধাইয়ে কাছে লালকমলের কথা জানতে চাইলেন। কুন্তি বিনীত ভাবে স্বীকার করলেন যে, লালকমল তার কাছেই আছে। তারপর কুন্তি বলল, অভয় দেন তো একটা কথা বলি মালিক।
সদানন্দ তাকে অভয় দিয়ে বললেন, কোন ভয় নেই তোমার, নিশ্চিন্তে বল আমাকে।
দুধকুমারের সাথে মালকিনের দুর্ব্যবহার। তাকে সর্বদা হিংসা অবহেলা করার কথা। তার ক্ষতি করার চেষ্টার কথা। পুরো বৃত্তান্ত খুলে বললেন কুন্তি ধাই সদানন্দ বণিকের কাছে।
এমন কি লালকমলের কাছে শোনা, সেই বেদি থেকে উঠে আসা মায়ের সাবধান বাণী পর্যন্ত।
সব শুনে মর্মাহত হলেন সওদাগর। খুব ক্ষুব্ধ হলেন লীলাদেবীর উপর। কিন্তু তাকে মুখে তাকে কিছু বললেন না।
পরদিন সকালে উঠে সদানন্দ কুন্তি ধাইয়ের বাড়িতে গেল লালকমলকে ফিরিয়ে আনার জন্য।
এতদিন লালকমল কুন্তি ধাইয়ের কাছে ছিল। কুন্তির খুব কষ্ট হল, লালকমলকে ছেড়ে দিতে। বড় মায়ায় পড়ে গেছেন কুন্তি ধাই তার। কুন্তির চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। তা দেখে সদানন্দ জানতে চাইল, তুমি কাঁদছো কেন? বল আমাকে।
সে চোখের জল সামলে নিয়ে বলল, লালকমলকেকে ছেড়ে আমার থাকতে বড় কষ্ট হবে মালিক। এবার ব্যপারটা বোধগম্য হল সদানন্দ বণিকের। সে যেন মনে মনে অদেখা এক নাড়ির টান অনুভব করল কুন্তি ধাইয়ের।
সদানন্দ সহাস্যে বলল, তুমিও আমাদের সঙ্গে যাবে। লালকমলের সঙ্গে থাকবে। প্রস্তুত হয়ে নাও শীগগির।
জানলা দিয়ে তাদের একসঙ্গে আসতে দেখে, লীলাবতী মুখটা পোড়া হাড়ির মতো কালো হয়ে উঠল। কিন্তু দুধকুমারী আনন্দে লাফিয়ে উঠল।
– দাদা আসছে, দাদা আসছে বলে সে খুশিতে লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল। তারপর একছুটে সে লালকমলের কাছে গিয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। লালকমল তাকে কোলে তুলে নিয়ে, বুকে চেপে ধরল। দুধকুমারী এবার লালকমলের মুখের দিকে তাকিয়ে অভিমানের সুরে বলল, তুমি এতদিন আমায় ছেড়ে কোথায় গেছিলে?
লালকমল তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
ধাইমার বাড়ি।
– আর যাবে না তো আমাকে ছেড়ে?
– না। আমরা এবার এখানেই থাকব।
উপরে দোতলার একটি ঘরে তাদের তাদের থাকার আলাদা ব্যবস্থা করা হল। ঘরটা লীলাবতীর ঘরের পিছন দিকে হওয়ায়, সেটা তাদের সম্পর্কের পক্ষে ভালই হল। সচরাচর পরস্পরের মুখোমুখি হতে হয় না, তাই রক্ষে। তবুও লীলাবতী ভিতরে ভিতরে একটা অহেতুক জ্বালা অনুভব করে। কারণ আদরী মাঝে মাঝেই দুধকুমারের খোঁজে সেখানে গিয়ে হাজির হয়, লীলাবতীর বারণ সত্ত্বেও। লীলাবতীর কথা মানে না আদুরী।
এদিকে সদানন্দ বণিক আজকাল খাবার খেতে পারেন , ভাল ঘুমও হয় তার। ধীরে ধীরে তিনি সুস্থ হয়ে উঠতে থাকেন। বিকেলের দিকে কোন কোন দিন, লালকমলকে নিয়ে গিয়ে বসেন শমিবৃক্ষের নীচে সেই বাঁধানো বেদিটার উপর। বসে ভাবেন শালিনীর কথা। ভাবতে ভাবতে তার চোখে জল এসে যায়। তা দেখে, লালকমল বলে ওঠে, বাবা তুমি কি কাঁদছো?
– নারে, চোখে বোধহয় একটা কিছু পড়েছে, তাই জল এসে গেছে, বলে সে নিজের চোখদুটি আলগোছে মুছে নেয়।
ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠার পর সদানন্দ বণিক ভাবলেন, আর ঘরে বসে থাকা যায় না। ঘরে বসে থাকতে থাকতে শরীর মনে মর্চে ধরে জড়তা এসে যাচ্ছে যেন। ফলে আমাকে আবার বাণিজ্যের কাজে বেরোতে হবে। এবার তিনি রাখাইন (বর্তমান নাম মায়ানমার) যাবেন। মনে মনে ঠিক করলেন সঙ্গে এবার তিনি লালকমলকে নিয়ে যাবেন।
লীলাবতী দেবীর মনে সুখ নেই। সে মাঝে মাঝেই মন খারাপ করে বসে থাকে। কোন কাজ কর্মে তার মন নেই। একা একা বসে কী যেন ভাবে। যা ভাবে তা কাউকে বলতে পারে না।
সেদিন রাত্রে তিনি একটা দুঃস্বপ্ন দেখে বিচলিত হয়ে পড়েন।
স্বপ্নে দেখেন লালকমল আর কুন্তুি ধাইকে বাড়িতে ফিরিযে নিয়ে আসার জন্য তার সঙ্গে সদান্দের গভীর মনোমালিন্য ও অশান্তি সৃষ্টি হওয়ায় ফলে, সদানন্দ বিষম রেগে গিয়ে, তাকে একটা নৌকা করে নিয়ে গিয়ে, একটা গভীর বনে ছেড়ে দিয়ে আসেন। লীলাবতী দেবী তাকে কত আকুতি মিনতি করেন বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সে কথায় কোন কান না দিয়ে সদানন্দ তাকে বনে ছেড়ে দিয়ে একাই ফিরে যান বাড়ি। যেন সীতার মতো তাকে বনবাসে রেখে যান নির্জনে। এখন কী করবেন লীলাবতী দেবী, কোথায় থাকবেন, কী খাবেন কিছুই ভাবতে পারেন না। নিরুপায় হয়ে কাঁদতে থাকেন। এদিকে দিন ফুরিযে অন্ধকার নেমে আসতে থাকে নদীর ধারে বনের ভিতর। মনের ভিতর ভয় জমতে থাকে। বনে কত রকমের হিংস্র পশু আছে। তাকে যদি মেরে খেয়ে ফেলে? কেউ তার কোন খোঁজ পাবে না। এমন সময় দেখেন দূর থেকে একটা নৌকা এদিকেই আসছে। তিনি একটু আশার আলো দেখতে পান। নৌকাটা এসে বনের ধারে তীরভূমিতে থামে। সেখান থেকে নেমে এসে লালকমল তাকে বলে, মা তুমি এসো আমার সঙ্গে, চলো বলে হাত ধরে তাকে নৌকায় তুলে নেয়। নৌকা এগিয়ে যেতে থাকে ওপারে বাড়ির দিকে। হঠাৎ লীলাবতী দেবী ঘুমটা ভেঙে যায়। ভয় কেটে গিয়ে মনে স্বস্থি ফিরে আসে। কিন্তু একটা অপরাধ বোধ তার মনে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অনুশোচনা ও গ্লানি বোধ করেন তিনি মনে মনে। ভাবেন, লালকমলে তিনি মনে মনে এত হিংসা করেন, দুর-ছাই করেন, অথচ লালকমলই তাকে এই বিপদের সময় তার সহায় হয়ে তাকে বাঁচাতে ছুটে এসেছে। নিজেকে বড় অকৃতজ্ঞ মনে হয় লীলাবতী দেবীর।
দিন ক্ষণ তিথি নক্ষত্র দেখে একটা ভাল দিন নির্বাচন করে সদানন্দ বাণিজ্য যাত্র শুরু করবেন নির্ধারণ করলেন। আগের দিন লীলাবতী দেবী ধুমধাম করে বাড়িতে মহালক্ষ্মী পূজার আয়োজন করলেন, উপবাস করে নিষ্ঠা ভরে।
পরদিন সকালে তারা বের হবার সময়, পুজোর উপকরণে দেওয়া চন্দনের বাটা থেকে চন্দন তুলে লীলাবতী দেবী সদানন্দ এবং লালকমলকে যত্ন সহকারে কপালে ফোঁটা দিয়ে, মহালক্ষ্মীকে প্রণাম করে, পুজোর আসন থেকে তুলসী পাতা, জবাফুল ও বেলপাতা তুলে এনে তাদের জামার পকেটে ভরে দিল। তারপর সূর্যদেবকে প্রণাম করে বললো, যাত্রা শুভ হোক তোমাদের।
একটা বড় বজরায় চন্দন কাঠ, বনৌষধি, সুতি ও রেশমের বস্ত্র, মশলা (গোলমরিচ, লঙ্কা, তালচিনি), মূল্যবান পাথর, বিভিন্ন ধরনের প্রসাধন সামগ্রী, পূর্ণ করে নিয়ে তারা যাত্রা শুরু করল, দয়া নদী পেরিয়ে বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে রাখাইেরন (বর্তমান নাম মায়ানমার) উদ্দেশ্যে।
শান্ত সমুদ্রের বুকের উপর দিয়ে চলেছে একটা পণ্যবোঝাই বড় বজরা। যতদূর চোখ যায় শুধু জল আর জল সীমাহীন সমুদ্র।
বিকেলের পড়ন্ত রোদে পশ্চিমের আকাশটা যেন স্বপ্নময় হয়ে উঠেছে। বজরায় দাঁড়িয়ে সেইদিকে তাকিয়ে ছিলেন সদানন্দ। কিন্তু আবিরে রাঙানো পশ্চিমের লাল আকাশ সদানন্দ দেখছিলেন না। তিনি ছিলেন নিজের চিন্তায় মগ্ন। বজরায পায়চারি করতে করতে মাঝে-মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ছিলেন। ভুরু কুঁচকে তাকাচ্ছিল, কখনো আকাশের দিকে, কখনো সমুদ্রের দিকে। তার মাথায় শুধু একটাই চিন্তা–জলদস্যুদের হাতে যেন আবার না পড়েন তারা। বণিকরা প্রায়ই এই অঞ্চলে এসে জলদস্যুদের কবলে পড়ে একেবারে নিঃম্ব হয়ে কোন রকমে জীবন মুঠোয় করে তারা পালিয়ে প্রাণে বেঁচেছেন।
পরের দু’দিন তাদের বেশ আনন্দেই কাটলো। পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশ। জোর বাতাস। বজরার পালগুলি হাওয়ার তোড়ে বেলুনেরমত ফুলে উঠল। জাহাজ চলল তীরবেগে। দাঁড়টানার হাড়ভাঙ্গা খাটুনি থেকে মাঝিরা এই দু’দিন রেহাই পেল। কিন্তু বজরার ভিতর পরিষ্কার করা, সদানন্দর ফাইফরমাস খাটা, এসব করতে হল। তবু মাঝিরা সময় পেল–ছক্কা-পাঞ্জা খেলার, অনেক রাত পর্যন্ত গল্পগুজব করার।
জলদস্যুদের কথা ভাবতে-ভাবতে কখন ঘুমে চোখ জড়িয়ে এসেছিল, সদানন্দ জানেন না। হঠাৎ মাঝিদের দৌড়োদৌড়ি উচ্চ স্বরে ডাকাডাকি-হাঁকাহাঁকি শুনে তার ঘুম ভেঙে গেল। ভোর হয়ে গেছে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু হল কি? এদের এত উত্তেজনার কারণ কি? এমন সময় লালকমল ছুটতে ছুটতে সদানন্দর কাছে এল।
–সাংঘাতিক কাণ্ড। লালকমল তখনও হাঁপাচ্ছে।
–কি হয়েছে?
– বাইরে চল–দেখবে’খন।
দ্রুতপায়ে সদানন্দ বিছানা ছেড়ে বাইরে উঠে এল। বজরার সবাই এক জায়গায় এসে জড়ো হয়েছে। সদানন্দ বজরার চারপাশে সমুদ্র ও আকাশের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। গ্রীষ্মকাল, বেলা আরও বেড়েছে। অথচ চারদিকে কুয়াশার ঘন আস্তরণ। সূর্য ঢাকা পড়ে গেছে। চারদিকে কেমন একটা ঘোলাটে আলো। এক ফোঁটা বাতাস নেই। বজরাটা স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে আছে একজায়গায়। সকলের মুখেই দুশ্চিন্তার ছাপ। এই অসময়ে এতো কুয়াশা কেন? কোন অমঙ্গলের চিহ্ন নয় তো এটা? ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েন সদানন্দ।
হঠাৎ তার চোখে পড়ল, কুয়াশা ভেদ করে একটা ছিপ নৌকা তাদের বজরার দিকেই দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে। সেটা একটু কাছে আসতেই বোঝা গেল, তাতে পাঁচ জনের মতো লোক আছে। সদানন্দের বুঝতে বাকী রইল না, ছিপ নৌকাটা জলদস্যুদের।
তখনই কান ফাটানো কড়-কড়াৎ আওয়াজ করে আকাশ ভেদ করে একটা বাজ এসে পড়ল ছিপ-নৌকাটার উপর। মুহূতে নৌকাটা জ্বলে উঠল। জলের উপর আগুনের গোলার মতো নৌকাটা জ্বলতে জ্বলতে পুড়ে জলে ডুবে গেল।
হঠাৎ একটা প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়ার ঝাঁপটায় সমস্ত বজরাটা ভীষণভাবে কেঁপে উঠল। কে কোথায় ছিটকে পড়ল, তার ঠিক নেই। পরক্ষণেই প্রবল বৃষ্টিধারা আর হাওয়ার উন্মত্ত মাতন। তালগাছসমান উঁচু-উঁচু ঢেউ বজরার গায়ে এসে আছড়ে পড়তে লাগল। নৌকাটা কলার মোচার মত ঢেউয়ের আঘাতে দুলতে লাগল। এই একবার নৌকাটা ঢেউের গভীর ফাটলের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে, আবার পরক্ষণেই প্রচণ্ড ধাক্কায় উঠে আসছে ঢেউয়ের মাথায়।
ঝড়ের প্রথম ধাক্কায় লালকমল মুখ থুবড়ে পড়েছিল। তবে সামনে নিয়েছিল খুব। কারণ পরিবেশ পরিস্থিতি দেখেই ও বুঝতে পড়েছিল, ঝড় একটা আসবেই। আর সবাই এদিক-ওদিক ছিটকে পড়েছিল। হামাগুড়ি দিয়ে কাঠের পাটাতন ধরে ধরে অনেকেই নিজের জায়গায় ফিরে এল। এল না শুধু সদানন্দ বণিক। ঝড়ের ধাক্কায় টাল সামলাতে না পেরে পাটাতনের কোণায় জোর ধাক্কা খেয়ে ও অজ্ঞানের মত পড়েছিল বজরার বাইরে। লালকমল কয়েকবার ডাকল বাবাকে। ঝড়ের গোঙানির মধ্যে সেই ডাক কারও কানে পৌঁছল না। ললকমল হামাগুড়ি দিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে বাবাকে খুঁজতে লাগল। কিন্তু কোথায় সদানন্দ? আর খোঁজা সম্ভব নয়। প্রচণ্ড দুলুনির মধ্যে টাল সামলাতে না পেরে বারবার হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল সে বজরার উপর।
ভোর হয় হয়। পূর্বদিকে সমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায় আকাশটায় লালচে রঙ ধরেছে। সূর্য উঠতে দেরি নেই। সাদা-সাদা সমুদ্রের পাখীগুলো উড়ছে আকাশে। বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ির মধ্যে সমুদ্রের জলের ধার ঘেঁষে সদানন্দ পড়ে আছে মড়ার মতো। কোন সাড়া নেই। ঢেউগুলো বালিয়ারির ওপর দিয়ে গড়িয়ে ওর গা পর্যন্ত চলে আসছে।
সমুদ্র-পাখীর ডাক সদানন্দর কানে গেল। অনেক দূরে পাখীগুলো ডাকছে। আস্তে আস্তে পাখীর ডাক স্পষ্ট হল। চেতনা ফিরে পেল সে। বেশ কষ্ট করেই চোখ খুলতে হল তাকে। চোখের পাতায় নুনের সাদাটে আস্তরণ লেগে গেছে। মাথার ওপর আকাশটা দেখলও। অন্ধকার কেটে গেছে। অনেক কষ্টে আড়ষ্ট ঘাড়টা ফেরাল। দেখলো সূর্য উঠছে। মস্তবড় থালার মতো টকটকে লাল সূর্য। আস্তে-আস্তে সূর্যটা ঢেউয়ের গা লাগিয়ে উঠতে লাগল। সবটা উঠল না বড় বিন্দুর মত একটা অংশ লেগে রইল জলের সঙ্গে। তারপর টুপ করে উঠে ওপরের লাল থালাটার সঙ্গে মিশে গেল। সমুদ্রে এই সূর্য ওঠার দৃশ্য সদানন্দর কাছে খুবই মনোরম লাগল। বড় ভাল লাগল। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছে সে।
সদানন্দ জোরে শ্বাস ফেলল–আঃ কি সুন্দর এই পৃথিবী!
বেশ কষ্ট করে শরীরটা টেনে তুলল সে। হাতে ভর রেখে একবার চারদিকে তাকাল। ভরসা-যদি বজরার আর কেউ ওর মত ভাসতে ভাসতে এখানে এসে উঠে থাকে। কিন্তু বিস্তীর্ণ বালিয়াড়িতে যতদূর চোখ যায় ও কাউকেই দেখতে পেল না। ওদের বজরার কেউ বোধহয় বাঁচেনি। লালকমলের কথা মনে পড়ল। মনটা ওর বড় খারাপ হয়ে গেল তার। গা থেকে বালি ঝেড়ে ফেলে সদানন্দ উঠে দাঁড়াল। হাঁটুদুটো কাঁপছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে। শরীর অসম্ভব দুর্বল লাগছে। তবু উপায় নেই। চলতে তাকে হবেই। লোকালয় খুঁজতে হবে। খাদ্য চাই, কিন্তু কোন দিকে মানুষের বসতি?
সূর্যের আলো প্রখর হতে শুরু করেছে। সদানন্দ চোখে হাত দিয়ে রোদ আড়াল করে চারদিকে দেখতে লাগল। একদিকে শান্ত সমুদ্র। অন্যদিকে ধুধু বালি আর বালি। জনপ্রাণীর চিহ্নমাত্র নেই। এ কোথায় এলাম? আর ভেবে কি হবে। সদানন্দ পা টেনে সেই ধুধু বালির মধ্যে দিয়ে চলতে লাগল।
মাথার ওপর সূর্য উঠে এল। কি প্রচণ্ড তেজ সূর্যের আলোর। তৃষ্ণায় জিভ পর্যন্ত শুকিয়ে আসছে। হু-হু হাওয়ায় বইছে বালি উড়ছে। শরীর আর চলছে না। মাথা ঘুরছে। মাথার ওপর আগুন ঝরানো সূর্য। বালির দিগন্ত দুলে-দুলে উঠছে। শরীর টলছে। তবু হাঁটতেই হবে। একবার থেমে পড়লে, বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে গেলে মৃত্যু অনিবার্য। জোরে শ্বাস নিল সদানন্দ। অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে তার ! তবু থামা চলবে না। তাকে চলতে হবে। চরৈবেতি।
সমস্ত মনোবল একসঙ্গে করে নিয়ে, মনের জোরে সে চলতে শুরু করল উষ্ণ বালুরাশি মাড়িয়ে তীরভূমি ধরে সামনের দিকে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর তার মনে হল, সমুদ্রের শান্ত জলের উপর দিয়ে একটা বজরা নৌকা তীরভূমি ছুঁয়ে এই দিকেই আসছে। সে মনে আশার আলো সঞ্চয় করে নিজের গায়ের জামাটা খুলে, আকাশের দিকে উড়িয়ে নৌকাটির দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করতে লাগল। বজরার লোকদের সেটা চোখে পড়েছে কিনা, প্রথমটায় বোঝা গেল না। পরে সেটা বোঝা গেল, বজরাটা এসে নিকটবর্তী তীরভূমিতে থামায়। এবার বজরাটা দেখে সদানন্দর চিনতে অসুবিধা হল না যে এটা তাদেরই বজরা। বজরা থেকে লালকমল বেরিয়ে এসে তার কাছে গিয়ে , তার হাত ধরে নিয়ে তাকে বজরার উপরে তুললো। বজরাটা ঠিকই আছে, সদানন্দ দেখল, বজরার তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। শুধু জিনিষপত্রগুলি এদিকে সেদিকে ছিটকে পড়ে আছে। লালকমল একা যতটা পেরেছে, মাঝি মাল্লাদের দিয়ে সেগুলি তুলে এক জায়গায় জড়ো করে রেখে। সদানন্দ লালকমলকে বলল, আমার খিদে পেয়েছ। লালকমল খাবার এনে দিলে, সে খেয়ে তৃপ্তি বোধ করল। তারপর বজরা আবার চলতে শুরু করল। খুব ক্লান্ত ও দুর্বল থাকায় সদানন্দ তখন ঘুমিয়ে পড়ল। তার ঘুম যখন ভাঙল সূর্য তখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে। সে দেখল বজরা এখন মাঝ সমুদ্রে। বজরা এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। পথে আর কোন বিপদ হল না। এভাবে আরও দু’দিন চলার পর বজরা এসে পৌঁছাল রাখাইেরন বন্দরে। সেখানেই বজরায় তাদের রাতটা কাটল। পরদিন সকালে মালপত্র নীচে নামিয়ে আনা হল। বজরাটাকে বন্দরের একপাশে নোঙর করা হল।
সাতদিনে সমস্ত পণ্য বাজারে বেশ চড়া দামে বিক্রি হয়ে গেল। অনেক লাভ হয়েছে এবার। শূন্য বজরায় শুটকি মাছ, আদা, পেঁয়াজ, লাল মরিচ এবং নারকেল বোঝাই করল খুব সস্তা দামে কিনে। দেশে এগুলি বেশ ভাল দামে বিক্রি হবে। এবার ফেরার পালা তাদের।
লীলাবতী দেবীর সকাল বেলাটা, ঘরের কাজ-কর্ম, রান্না নিয়ে কাটে। সে সমযটা দুধকুমারী ধাইমার ঘরে চলে যায়। সেখানে গিয়ে তার কাছে পুরাণের গল্প শোনে। তার খুব ভাল লাগে, সে সব গল্প শুনতে। একদিন লীলাবতী দেবী ঘরের কাজ-করতে করতে ভাবল, দেখি তো আদুরী ধাইয়ের কাছে গিয়ে কি করে? তাই সে তার ঘরের উল্টো দিকে ধাইয়ের ঘরে গিয়ে নীরবে উঁকি দিল। দেখল ধাই তাকে সীতার বনবাসের গল্প বলছে। আদুরী খুব মগ্ন হয়ে তা শুনছে। সে আর কিছু না বলে নীরবে চলে এল নিজের ঘরে। ঘরের বাকী কাজ-কর্ম সারল। কাজ সারতে সারতে তার মনে হল ধাইকে যতটা সে খারাপ ভেবেছিল। ধাই ততটা খারাপ নয়। সে আদুরীকে বেশ ভালই ভাসে। তার ধারণা ছিল, লালকমলকেই ধাই ভালবাসে, আদুরীকে একদম ভালবাসে না। সে ভাবনা তার ঠিক নয়। আদুরীর প্রতিও তার ভালবাসা কম নয়। ফলে, কিছুদিনের মধ্যেই ধাইয়ের সঙ্গে তার সম্পর্কের উন্নতি ঘটল। এখন আর লীলাবতী দেবী ধাইয়ের সঙ্গে আগের মতো রূঢ় ব্যবহার করেন না। বেশ মিষ্টি স্বরে তার সঙ্গে কথা বলেন। কুন্তি ধাইয়ের মনও নরম হলে এল, লীলাবতী দেবী ব্যবহার দেখে। তারও মনে আগের মতো আর শত্রুতার মনোভাব নেই। লীলাবতী তাকে বলল, তুমি আর আলাদা করে রান্না কোরো না, এখন থেকে আমাদের সঙ্গেই খাবে।
শুনে কুন্তি মনে মনে বিগলিত হয়ে পড়ল। তারপর থেকে কুন্তিই রান্নাঘর সমলাবার দায়িত্ব নিল। লীলাবতী দেবীও অনেকটা অবসর পেয়ে আরাম বোধ করলেন।
ফেরার পথে সদানন্দদের আর তেমন কোন সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হল না। সমুদ্রের জলতরঙ্গও অনুকুল ছিল। সাতদিনের মধ্যে তারা নিরাপদে দেশে ফিরে এলেন। বাড়িতে খুশির হাওয়া বইতে লাগল। দুধকুমারী “দাদা এসেছে, দাদা এসেছে”, বলে লালকমলের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। লালকমল তাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করল। তারপর গিয়ে লীলাবতী দেবীকে প্রণাম করল। লীলাবতী দেবী তার হাত ধরে তুলে, চিবুক ছুঁয়ে তাকে চুম্বন করে বললেন, বেঁচে থাকো বাছা।
তারপর লালকমল গিয়ে ধাইমাকে প্রণাম করতেই, ধাইমা তাকে কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,আমার যাদু সোনা বেঁচে থাকো চিরদিন।
ধাইয়ের সঙ্গে লীলাবতী দেবীর এই কয়েকদিনের মধ্যেই এমন গাঢ় ভাব হয়ে গেছে দেখে সদানন্দ বণিক ভারি আশ্চর্য হলেন। এবার লালকমলকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে, বাণিজ্যে অনেক লাভ হয়েছে শুনে, লীলাবতী দেবী বললেন, তাহলে এবার দিদির নামে একটা সৌধ গড়ে দাও, দিদির ওই সমাধি বেদিটার উপর। এটা শুনে পরম আশ্চর্য হলেন সদানন্দ বণিক। তিনি উৎসাহিত হয়ে বলে উঠলেন, বেশ তো, তোমার যখন ইচ্ছে, তখন তাই হবে।
শ্বেতপাথর দিয়ে দ্রুত গতিতে নির্মাণের কাজ শুরু হল। ত্রিশফুট উচ্চতা বিশিষ্ট ‘শালিনী স্মৃতিসৌধ’ নির্মাণ করতে দু’শো দিনের বেশি সময় লাগল। শালিনীর জন্মদিন ১লা বৈশাখ স্মৃতিসৌধের উদ্বোধন হল। গ্রামের সকলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। গ্রামবাসী সকলেই প্রায় এসেছিল।
সদানন্দ, লীলাবতী, লালকমল, দুধকুমারী, কুন্তি ধাই কালের নিয়মে আজ আর কেউ বেঁচে নেই। তবু, স্মৃতি সৌধে শুধু, শালিনী আজও বেঁচে আছেন।
আজও সেখানে প্রতিবছর ১লা বৈশাখ উৎসব ও মেলার আয়োজন করা হয় এক সপ্তাহব্যাপী, নাম ‘বৈশাখী মেলা’। এই স্মৃতিসৌধ পরিচালনার একটি কমিটি আছে। সেই কমিটিতে গ্রামবাসীদের মধ্য থেকে নির্বাচিত বিশিষ্ট জনেরা থাকেন। তারাই আয়োজন করেন ‘বৈশাখী মেলা’-র। মেলা শুরুর আগে, চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই সৌধ ও সৌধ সংলগ্ন মাঠ ধোয়া পোছা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার কাজ শুরু হয়।
পবিচালন কমিটি বারো বছর অন্তর সৌধটি সংস্কারের কাজও করেন। ফলে, স্মৃতিসৌধটি আজও খুব আকর্ষণীয় মানুষের কাছে।