স্মরণ
আমি একটু অবুঝ ছোট থেকে। বায়না করতাম খুব।এটা দাও , ওটা দাও।বুঝতে চেষ্টা করতাম না যে আমার বাবা নেই।
ঠাকুমা , দাদু ও মার কাছে নানান আবদার করতেন।মা প্রাইমারি স্কুলে পড়াতেন,তারপর টিউশনি করে রাতে ফিরতেন।
এতগুলো মানুষের খাওয়া, ওষুধ,কয়লা, ঘুঁটে,বাজার সামলে বাড়তি টাকা থাকত না। তারমধ্যে আমি এতটাই অবুঝ মাকে বলতাম
নববর্ষে সবার নুতন জামাকাপড় হয়,ও মা আমার কেন হয় না!!!
সবাই বলে বর্ষবরণ ও নাকি একটা পার্বণ।
মা সারা রাত ধরে পুরানো জামাতে চুমকি লাগিয়ে ঝলমলে করে আমায় নববর্ষের সকালে বলে কি রে নুতন লাগছে তো!!
দাদু , ঠাকুমা বলে বৌমা হলো মা দুর্গা।সব দিক কেমন সামলাচ্ছে।
আবেগের সুরে বলে বৌমা এনে দিবিরে আমাদের ছেলেকে ।
মা বলে সবচেয়ে ভালো আপনারা তার কাছে চলে যান।
আমি মাকে বলি মা আমার বাবা আছেন???
এটাতো জানতাম না!!
ছোট থেকে শুনেছি বাবা নেই। ভেবেছিলাম বাবা হয়তো….।তার আগে মা আমার মুখটা চেপে ধরে।
ঠাকুমা চিৎকার করে কেঁদে বলে আমার দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো। আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে সবার কথা শুনছি। একটু বুঝতে পারলাম বাবা আছে তবে অন্যত্র থাকে।
এবার আমি বলি আজকেই বাবা চাই। বাবা – মার সাথে সবাই বর্ষবরণ করে সেরকম আমিও করতে চাই।
বেচারী মা কোথা থেকে আনবে
বাবাকে!!
তারপর ঠাকুমার কাছ থেকে বাবা কোথায় থাকে জেনে নিই।এরপর চারবছর কেটে গেছে , আমিও মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি।
এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই। একদিন না বলে সোজা খুঁজতে খুঁজতে ট্রেনে করে বাবার বাড়িতে আসি।তখন চৈত্র মাসের প্রখর তাপ।
দরজায় ঠকঠক করতেই একটি ছোট মেয়ে , অবিকল আমি যেন, দরজা খুলে বলে কাকে চাই! তারপর সোজাসুজি বাবার মুখোমুখি।পরিচয় দিইনি। আপনার জন্য আপনার মা -বাবা কাঁদছেন। বাবা কেঁদে বললেন যাকে ছেড়ে আরেকজনকে বিয়ে করলাম সেও দশবছর হল মারা গেছে।
তখন থেকেই এই মেয়েকে নিয়ে কষ্টে আছি।
আমিও তো বাবাকে দেখিনি। বাবা কি তাই জানি না।
আমি বাবা সম্বোধন করে বলিতুমি ফিরে গেলে না কেন??
বাবা মেয়েকে বলে তুই আমার মেয়ে!!
জানিস তোর মাকে আমি আজও ভালোবাসি। মাঝে কি মতিভ্রম হয়েছিল তোর মাকে ছেড়ে পুনরায় বিয়ে করি।
তুমি মার কাছে যাবে বাবা??
বাবা চলো আজ আমাকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে আসবে।কাল নববর্ষে তোমার কিন্তু আমাদের বাড়িতে আসা চাই।
এবার থেকে আমরা এক সাথেই থাকব। তোমার মা – বাবার প্রতি কর্তব্য তো আছেই!!
তারপর বাড়ি যাই।মার কাছে খুব মার জোটে। কোথায় গেছিলাম,মার খেয়েও বলিনি।
রাতে মা একটা নতুন জামা দেয় ,কাল পরিস।মা বলে তোর বাবা চায়।
আমি আনন্দে বলি কালকেই চাই।মা হেসে বলে ঠিক আছে
কালকেই বাবা পাবি।
আমি ভাবছি মা কি বুঝে গেছে বাবার কাছে গেছিলাম।চুপ করে ভাবি তাহলে মা মারল কেন!!
ঠাকমা দাদু না খেয়ে শুয়ে পড়েছে।ডাকলাম অনেক করে।বলল ক্ষিদে নেই।
সকাল থেকে মা নেই, বাবা আসবে মনে খুব আনন্দ হচ্ছিল। হঠাৎ দেখি পরপর দুটি রিক্সা। একটা থেকে একটা লোক ও নুতন বৌ সেজে মা।
আরেকটি রিক্সা থেকে বাবা ও বোন বিশাল একটা ব্যাগ নিয়ে নামছে।
ঠাকুমা – দাদু বাবাকে বলছে বড় দেরি করে ফেললিরে বাপ।আজ আমি ব্যস্ত আমার মেয়ে – জামাই আসবে। ঠাকুমা বরণ থালা নিয়ে লাল শাড়ি পরা মা ও ওই অজানা লোকটাকে বরণ করছে।
ঘটনাটি এত তাড়াতাড়ি চোখের সামনে পরপর আসল আমি চিৎকার করে বলি আমিতো নববর্ষে আমার নিজের বাবা চেয়েছিলাম।তাইতো আমার বাবা এসেছেন। ঠাকুমা বলল তোমার ইচ্ছে হলে বাবার সাথে চলে যেতে পারো। আমি মেয়ে – জামাই নিয়ে সুখে থাকব। বাবা চলে গেল।যাবার আগে বলল মাঝে মাঝে যাস আমার কাছে। তারপর আর বাবা ও বোনকে খুঁজে পাইনি।
জানি মা ভুল হয় তো করেনি। আমি যদি আরেকটু আগে বড় হোতাম।
মাকে বাবার সাথে মিলিয়ে দিতাম।
বিশ বছর পর বরের অফিস কলিগের বাড়িতে গনেশ পুজোয় নিমন্ত্রিত হয়ে যায়। সবাই বলছে আমাকে ওই কলিগের স্ত্রী হুবহু এক দেখতে। তারপর কলিগের স্ত্রীর বাবাকে দেখে চমকে গিয়ে বাবা বলে ডাকি। বাবা ও মেয়ের পুনর্মিলন হয়।
আজকের দিনে আমার তিনটে বাবার আদরে নাজেহাল অবস্থা।