Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » স্বীকারোক্তি || Samaresh Basu » Page 2

স্বীকারোক্তি || Samaresh Basu

০৭.

কী বললেন, ছুরিটা তেমনই লাগানোই ছিল কি না? হ্যাঁ, তাই ছিল, শুধু কোম্পানির ছাপ দেওয়া কালো রঙের বাঁটটা বেরিয়ে ছিল। ছবিটা আপনি দেখতে পাচ্ছেন বলছেন? অদ্ভুত লাগছে আপনার? বুঝতে পারছি। আপনি মিস্ট্রি অ্যান্ড মার্ডারের একটা রস পাচ্ছেন।

তা পেতে পারেন। এ বিষয়ে আপনাকে আমার আর কিছু বলার নেই। তবে সত্য বলতে কী, আপনাকে সেরকম একটি রস দান করব বলে, এ সব বলিনি। না মশাই, ছুরির হাতলটা মোছার কথা আমার একদম মনে হয়নি। আপনাকে তো আগেই বলেছি, আমার খুনের কোনও প্ল্যান প্রোগ্রাম ছিল, কাউকেই খুন করব বলেও করিনি, করে ফেলেছি। বডি আর কোথায় সরাব, যেখানকার জিনিস, সেখানেই পড়ে রইল।

কী মনে হয়েছিল জিজ্ঞেস করছেন? সেই মুহূর্তে তো হাত বাড়িয়ে একটা বাধা সরানোর মতোই মনে হয়েছিল। পরে অবিশ্যি যখন মনে হয়েছে, তখন ভেবেছি, ব্যাপারটা একটা অনধিকার চর্চা হয়ে গিয়েছে। কী হল, হাসছেন যে? অনধিকার চর্চা শুনে? আচ্ছা, সে বিষয়ে আপনাকে তারপরে আমি বলছি।

হ্যাঁ বলুন? না, তারপরেই আমার প্রেমিকাকে মেরেছি, তা বলা যায় না। অবিশ্যি, আমি আপনাকে পর পর বলে যাচ্ছি বলে ভাববেন না, সত্যি পর পরই মেরেছি। বোধহয় কিছু এদিক ওদিকও হতে পারে। মানে আগে পরেও হতে পারে। সত্যি বলতে কী, আমার স্মৃতিগুলো এখন তেমন আর খেই ধরে চলতে পারে না। একটু আধটু গোলমাল হয়। কী বললেন, এতগুলো খুনের পর মাথার ঠিক না থাকারই কথা? তা হতে পারে। তবে, এটুকু আমি বলতে পারি, কুঁড়িকে, মানে আমার প্রেমিকাকেই শেষ খুন করেছি, তারপরে এই হাত এখন থেমে আছে। ৫১৪

কী বলছেন? জিজ্ঞেস করতেও ভয় পাচ্ছেন? কেন মশাই, ভয় পাবার কী আছে, আমাকে কি একবারও ভয় পাবার মতো আপনার কিছু মনে হয়েছে? তবে? হ্যাঁ হ্যাঁ, বলুন। খুনের তালিকা আরও আছে কিনা? নিশ্চয়ই, এবং হতে পারে সেগুলো খুব মাইনর মার্ডার-মাইনর মানে নাম করার মতো কেউ নেই। কারণ তাদের আমি চিনিই না। এতে অবাক হবার কী আছে স্যার, অচেনা লোক কি কোনও সময় কোনও বাধার সৃষ্টি করে না? কী রকম? এই ধরুন, পথের লোকের কথাই বলছি। পথচারী যাদের বলে। বিশেষ, কলকাতার কোনও কোনও অঞ্চলে, কোনও কারণে আপনাকে যদি তাড়াতাড়ি হেঁটে কোথাও যেতে হয়, তা হলে আপনি কী দেখতে পান? যাকে বলে, একটা অচলায়তন খাড়া হয়ে রয়েছে, তাই নয় কি? আপনার যখন বিশেষ তাড়া, তখন শত শত লোকের কোনও তাড়াই নেই। হয়তো দেখলেন, চার-পাঁচজন পাশাপাশি বেশ আস্তে আস্তে হেঁটে চলেছে, তাদের কোনও তাড়া তো নেই-ই, পিছনের নোকটার কথা তাদের মাথায় একেবারেই নেই, এবং হয়তো শুনবেন, তারা অফিসের কথা বলতে বলতে চলেছে, বড়সাহেব, বড়বাবু, ফাইল ডেসপ্যাঁচ বা গতকাল রাত্রের তাস খেলার ফলাফল নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক কিংবা যে সিনেমাটা তারা দেখেছে, তার ভাল মন্দ ইত্যাদি, এমনকী হতে পারে তারা কোনও মন্ত্রী বা এম-পি-এর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কোনও রসালোচনাই করছে। এরকম একটা আধটা দল নয়, অনেক, চার-পাঁচজন, দুজন-তিনজন। কোনও বুড়ো ভদ্রলোক হয়তো তার নিজের সাংসারিক বা পারিবারিক বিষয় ভাবতে ভাবতে চলেছেন এবং ছাতাটি এমনভাবে বগলে রেখেছেন বা মাথায় মেলে ধরেছেন, হয় আপনাকে পেটে বুকে খোঁচা খেতে হবে নয় তো মাথা নিচু করে তাঁর পাশ দিয়ে যেতে হবে। এর সঙ্গেই ধরুন মেয়েদের ব্যাপারটা, এ ব্যাপারে তাঁদের তো মা লক্ষ্মীই বলতে হবে। তাড়াতাড়ি তাঁরা চলতে পারেন না, সেটা দেখতেও খারাপ লাগে, হলই বা শহর, শহুরে জীবনযাত্রা। কিন্তু তাঁরা তো বঙ্গললনা। তাঁরা হয়তো কেনাকাটা করে ফিরছেন বা সিনেমা দেখে ফিরছেন, কিংবা বেড়িয়ে। ছোট ছেলেমেয়ারাই বা কীসে বাদ যায়? বাজার দোকান র‍্যাশান সিনেমা খেলা, তারা সবকিছুর মধ্যেই আছে, যে কোনও অবস্থাতেই আপনি তাদের দেখতে পাবেন, রাস্তা দিয়ে চলেছে। এটা আপনাকে আমি পেভমেন্ট ফুটপাতের চেহারার কথাই বলছি। এবার রাস্তার মাঝখানটা দেখুন, দু-একটা বড় রাস্তার কথা ভাববেন না, অধিকাংশ রাস্তার কথা ভাবুন, আর তার সঙ্গে লোক্সংখ্যা এবং যানবাহনের চেহারাটা দেখুন, লরি, ঠ্যালা, রিকশা, ট্যাক্সি, প্রাইভেট, বলদের এবং মোষের গাড়ি, খোদাই ষাঁড় বুঝলেন না? মানে ধর্মের ষাঁড়, যাদের পথে পথে চরে খেতে দেওয়া হয়েছে। আর যা দেখে, বিদেশিরা গদগদ হয়ে বলেন, এটা একটা ভারতীয় ঐতিহ্য যে, রোলস রয়েস কিংবা আমপালা-এর পাশাপাশি মানুষে টানা গাড়ি, বলদ-মোষে টানা গাড়ি এবং গোবর বা চোনা ছড়াতে ছড়াতে ভারতীয় শহরের রাস্তা দিয়ে ষণ্ড চলেছে। এ অবস্থায়, আপনি নিজেকে ভেবে দেখুন একবার, আপনি কোনও কারণে খুব তাড়াতাড়ি যেতে চাইছেন। তাই আপনাকে কখনও সোজা, কখনও কাত, কখনও মাথা হেঁট করে চলতে হচ্ছে-কী বললেন, বিচ্ছিরি? আপনাকে অনেকবারই সেরকম অবস্থায় পড়তে হয়েছে? সত্যি, কী বলব আপনাকে, হাসিও পায়, তার থেকে বেশি, ওই যে রাগ। ওঃ কী বলব আপনাকে, চলতে গিয়ে মনে হয়, মাথার দু পাশের শিরাগুলো দপ দপ করছে। তবু তো এর সঙ্গে রাস্তার জঞ্জালগুলোর কথা বলিনি, জঞ্জাল মলমূত্র, এবং পা বাড়াতেই, অসম্ভব নয় যে, আপনার পায়ের কাছেই দেখলেন, একজন ল্যাভেটরির কাজ সারবার জন্যে বেশ করে কাপড়চোপড় গুটিয়ে বসেছে, এবং তার সামনের দেওয়ালটাতেই, কী বলব, আধখোলা বুকের স্ত্রীলোকের ছবি, অস্বাভাবিক যৌবনের বাড়াবাড়ি যাদের শরীরে, যাকে জড়িয়ে ধরে আছে, কপালের কাছে পাহাড় ভেঙে পড়া চুলের গুচ্ছওয়ালা একজন পুরুষ-সিনেমার পোস্টার কী হল, ওরকম নড়েচড়ে বসলেন যে? ভাবতেই মেজাজ খারাপ লাগছে? তা হলেই বুঝুন, ওরকম অবস্থায় একটা খুনটুন যদি হয়েই যায়।

কী হল, অমন চোখ বড় করছেন কেন? সেই জন্যেই আপনাকে আমি বলছিলাম, অচেনা মানুষও মেরে ফেলেছি। না না, মারামারি কিছুই নয়। ঘটনাটা কলকাতারই দক্ষিণে একটা জায়গায় ঘটেছিল, ধরুন না, কাছেপিঠে স্টেশন আছে, আর কী অসম্ভব ভিড়, তার ওপরে আকাশটা মেঘলা, বর্ষার সময়, বৃষ্টিবাদলা কিছুটা আগেই হয়েছিল। আবার যে কোনও মুহূর্তেই আসতে পারে, এরকম একটা অবস্থা, আর তার সঙ্গে রাস্তা ভেজা, প্যাঁচপেচে, খানাখন্দেরও অভাব নেই। তার মধ্যেই দোকানে দোকানে রেডিয়োর চিৎকার। তু নে মুস্কারায়া কিংবা তোমার চাঁদেলি মুখে হায়… জাতীয় প্রিয় গানগুলো বাজছে কী হল, হাসছেন যে? চাঁদেলি মুখ শুনে? কেন আপনি কি এমন অদ্ভুত গানের কথা কখনও শোনেননি? শুনেছেন? তবুও হাসি পায়? আপনার তো হাসি পায়, আর আমি ঠিক সে ধরনের সংগীতপ্রিয় নই, যারা কথায় কথায় দাঁড়িয়ে গান শোনে আর উল্লাসে শব্দ করে ওঠে। আপনার অনুমতি নিয়েই বলছি, সসালা তুলনা নেই এইরকম সব কথা বলে। আমার মাথায় ভাঙা রেকর্ডের মতো বাজতে থাকে। চাঁদেলি-চাঁদেলি-চাঁদেলি বা মুস্কারায়া-মুস্কারায়া-মুস্কারায়া কিংবা শুধু তাই বা কেন মশাই, ডাগর আঁখি যদি অনেক সময় আমার মাথায় ডাগর ডাগর করেই বাজতে থাকে, তখন কী বললেন, আপনার তখন, পাগল ভাল করো মা বলতে ইচ্ছে করে? এবার তা হলে আমার হাসির পালা, এবং এর সঙ্গে আমি একটা কথাও হাত জোড় করে জুড়ে দিতে চাই, পাগলদের যেন আর সাঁকো নাড়া দিতে বারণ করা হয়।

কিন্তু যে কথা বলছিলাম, একদিন ওই রকম অবস্থায়, এক সন্ধ্যায়, আমি কুঁড়ির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলাম। তার আগেই টেলিফোনে ওর সঙ্গে কথা হয়েছিল, ও হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায়, যেখানে আমাদের দেখা হবার কথা ছিল, সেখানে ও আসতে পারবে না, অতএব আমি যেন যাই। সত্যি বলতে কী, সেই যাওয়াটা কখনওই সুখের ছিল না। কারণ ওদের বাড়ির পরিবেশটা আমার কোনওদিনই ভাল লাগেনি। কিন্তু ওকে দেখার মধ্যে যে কী ছিল, সেটা আপনাকে আমি ঠিক বোঝাতে পারব না। না না, সুখ ভাববেন না। কারণ, সুখ বলতে কী বোঝায়, আমি ঠিক জানি না, আমার সমস্ত শরীরের মধ্যে একটা ক্রিয়া শুরু হয়ে যেত, যে ক্রিয়ার মধ্যে স্নায়ুমণ্ডলীতে অত্যধিক মোচড়, চাপ, একই সঙ্গে আশা-নিরাশা, সব মিলিয়ে কী যে সব ঘটত, বুঝিয়ে বলতে পারব না। তবে এটা ঠিক, ওকে দেখলেই, এই সব কিছুর মধ্যে কোথাও, কী বলব, ঠিক যেন একটা একতারার মিঠে আওয়াজ মনের কোথাও বাজতে থাকত। কী বললেন, যেন একটা বৈরাগ্যের গন্ধ পাচ্ছেন? তা বলতে পারেন, অনেক সময় কুঁড়ির ঠোঁটে মুখ ডুবিয়ে-ওঃ, এ কথাটাও আপনাকে বুঝিয়ে বলতে হবে? চুম্বন মশাই চুম্বন। তবে ওই চুম্বন শব্দটা যেন আমার ঠোঁটে মুখ ডোবানোরভাবটা ঠিক ফোঁটাতে পারে না, সেই জন্যেই বলছি, অনেক সময় ওর ঠোঁটে মুখ ডুবিয়ে আমার বুকের কাছে একটা কষ্ট যেন ছুরির ফলার মতোই বিধে যেত। এমনকী, চোখে জল এসে পড়ত এবং তখন আমার মনে হত কী যেন পাই না, কী যেন রয়ে যায়–মাফ করবেন, হয়তো একটু কাব্যি করে ফেলেছি। তবে কী পাইনি বা কী রয়ে গিয়েছে সেটা তো কোনওদিনই জানা হল না। হয়ওনি…কিন্তু সে কথা পরে। আমি সেই সন্ধ্যার কথাই বলি, বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে, আবার আসতে পারে। আর সেই ভিড় এবং দুর্ভাগ্যের কারণ আর কিছুই নয়, আমার পিতৃসম্পত্তি সেই ভক্লটি গড়িয়ার মোড়ে এসেই এমন ভাকু ভাকু করতে করতে গড়াগড়ি খেলেন, বুড়ো মোষটিকে আর নড়ানো গেল না। যান্ত্রিকতার যা স্বভাব, নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেই যে বিপদ হয়, আগে থেকে একটু খেয়াল করলে একটু ঠিকঠাক করে নেওয়া যেত। তার ওপরে, আমার মশাই, মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ এই সব চিন্তাভাবনাগুলো একটু-আধটু কাজ করত, তাই যাকে, সেকেন্ডহ্যান্ড দুটো টায়ার কিনতে দিয়েছিলাম, ভাল দামই দিয়েছিলাম, কিন্তু সে আমাকে এনে দিয়েছিল মান্ধাতা আমলের দুটো রি-সোল করা টায়ার। যার একটার পরমায়ুসাড়ে চারদিনও গেল না, গড়িয়ার মোড়ে এসে সে রিম থেকে বেরিয়ে বিচ্ছিরি শব্দ করতে আরম্ভ করেছিল। সেকেন্ড হ্যান্ড ভাল টায়ার মানেই রি-সোল করা নয়। যাই হোক, সে গাড়ি ঠেলে ঠেলে এক পাশে নিয়ে, চাবি এঁটে বন্ধ করলাম, কারণ যেতে আমাকে হবেই, কুঁড়ির কাছে যেতে হবে। অমনি এক সেপাই এসে হাজির, ট্রাফিক পুলিশ। ওরা তো কর্তব্যে কখনও গাফিলতি করে না, এ ব্যাপারে ওদের সুনাম আপনার অজানা নেই। কিন্তু আমারই বা উপায় কী ছিল, অনেক দুরে সরিয়ে নেওয়া সত্ত্বেও যখন সে নাম্বার নিল, কিছুই বলার ছিল না আমার। আমি তখন হাঁটতে আরম্ভ করেছি, হাঁটতে হাঁটতে ক্রমেই সেই পরিবেশের মধ্যে এসে পড়লাম। আর আমি তখন আসছিলাম পার্টি অফিস থেকে। আমার মনে হচ্ছিল, এক একটা মানুষকে পার হতে, এক এক মুঠো আয়ু ফুরিয়ে যাচ্ছিল। একবার ভেবেছিলাম, পাগলের মতো এমনভাবে ছুটি, যাতে সবাই উল্লুক বলে গালাগাল দেয়, তারপরে পাগল ভেবে হাসে। কিন্তু আমরা নিজেদের কাছেই কী পরিমাণ বাঁধা, আপনি নিশ্চয়ই তা জানেন। আমার মনে হচ্ছিল, আমি ঠিক মাছের মতো চলেছি, কাত হয়ে, উঁচু দিকে গোত্তা মেরে, নীচের দিকে ডাইভ কেটে–এত মানুষ–এত, আর। এত কথা, এত ব্যাপার, এত নিজেদের নিয়ে সবাই ব্যস্ত যে, শেষ পর্যন্ত দেখলাম, এক বুড়ো ভদ্রলোককে কিছুতেই টপকাতে পারছি না। তিনি মদ্যপানই করে থাকুন বা বয়সের ভারে শরীরের টাল সামলাতে পারছেন না, আস্তে আস্তে চলেছেন, একবার ডাইনে হেলেন, একবার বাঁয়ে যান, তার ওপরে মাথায় একটা ভেজা ছাতা, যদি বৃষ্টি ছিল না। কিন্তু শুকোতে শুকোতে চলেছেন। ফুটপাথটাও সরু, আর পাশ দিয়েই চলেছে হাতির মতো মস্ত একটা মালবাহী লরি, যার উলটোদিক থেকেও অনবরত গাড়ি আসছে। তখন হঠাৎ আমার মনে ঠিক আগুন জ্বলে ওঠার মতো একটা কথা যেন ফুঁসে উঠল, কেন এই বুড়ো এখনও বেঁচে আছেন, আমি সহ্য করতে পারছি না, কেন কেন?

এই কথা ভাবতে ভাবতেই, আমি জোর করে এগোলাম, আর বাঁ হাতের কনুই দিয়ে মারলাম একটা খোঁচা, যতটা জোরে সম্ভব, তাই মারলাম। হাঁক করে একটা শব্দ উঠল। কিন্তু ফিরে চেয়েও দেখলাম না কী ঘটল, লরিটার ছায়ার অন্ধকারে এগিয়ে চলে গেলাম। মনে হয়েছিল যেন, পিছনে লোকজনের গলার স্বর শোনা গিয়েছিল, কী হল মশাই ইত্যাদি সব নানানরকম কথা, কিন্তু আমি ততক্ষণে অনেক দূর, এবং একটু পরেই, গলির মধ্যে কুঁড়িদের বাড়িতে।

০৮.

কী বললেন, বুড়ো ভদ্রলোক পড়ে গিয়েছিলেন কিনা? আমি তখন তো চেয়েই দেখিনি, তখন তো আমি কেবল কুঁড়িকেই দেখতে পাচ্ছিলাম, এবং যখন ওর কাছে গিয়ে পৌঁছেছিলাম, দেখেছিলাম, ওর মুখ ভারী। অতটা দেরি হবে, ভাবতে পারেনি, তাই একরকম আশা ছেড়ে দিয়েই বসে ছিল। আর মানুষের মন তো জানেন, তার কষ্টটার কথাই সে আগে ভাবে। তবু আমি যখন প্রায় অপরাধীর মতোই হেসে, আসার ব্যাপারটা সব বলতে গেলাম, ও মুখটা আরও গম্ভীর করে বললে, বুঝেছি, তোমার অনেক কাজ ছিল, এই তো? না এলেই হত, কাজ ফেলে কে আসতে বলেছিল? ইত্যাদি, যা বলা স্বাভাবিক। এবং তারপরেও আমি যখন সব কথা বললাম, কীভাবে এসেছি, গাড়িটার কী অবস্থা, কোথা থেকে এলাম, আর রাস্তার ভিড়, তাতে ও একটা বিষয় অনুমান করেছিল হয়তো, আসতে আমার কষ্টই হয়েছে। তবু আমাদের কারুর মুখ থেকেই ভার নামেনি। সম্ভবত মেজাজটা আমারই বেশি খারাপ হয়েছিল, তাই বেশিক্ষণ আর বসিনি। কারণ, দুজনেই বুঝতে পারছিলাম, সন্ধ্যাবেলার সুরটা কোথায় যেন কেটে গিয়েছে। সত্যি কোথায় যে কী হয়, সব বুঝেও মন বুঝতে চায় না এবং তা নিয়ে, সেই মুহূর্তে আত্মবিশ্লেষণ করতে বসাও বাতুলতা মাত্র, পরে হয়তো বোঝা যায়।

…কী বললেন, ওর কী অসুখ হয়েছিল? অসুখ নয়, ওটা একটা এক্সপেকটেড ব্যাপারই হয়েছিল। হয়তো শরীর খারাপটা পরদিন সকালেও হতে পারত। সেটা সন্ধ্যাবেলাতেই বুঝতে পেরেছেন? ধন্যবাদ! কে কে আছেন ওদের বাড়িতে জিজ্ঞেস করছেন? সকলেই, তবে সে কথা আপনাকে আমি পরে বলছি। আধঘণ্টার মধ্যেই আমি ওদের বাড়ি থেকে চলে এসেছিলাম এবং রাস্তায় এসে দেখেছিলাম, ফুটপাথের এক জায়গায় তখনও ভিড়। কাছে গিয়ে দেখেছিলাম। সেই বুড়ো ভদ্রলোক সেখানেই পড়ে আছেন, অনেকটা উপুড় হয়ে। কোলকুঁজো অবস্থায় এলিয়ে পড়ে আছেন। ছাতাটা পড়েছে রাস্তার ওপরে এবং সেটা খোলাই পড়ে ছিল, কেউ গুটিয়ে রাখেনি। কারণ এ বিষয়ে লোকেরা নাকি আবার খুব সচেতন। কীসের থেকে কী হয়েছে বলা যায় না, অতএব হাতটাত না দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। এ সব ব্যাপারে মানুষের বুদ্ধি কী রকম এক এক সময় খুলে যায়, দেখেছেন নিশ্চয়? পথে হয়তো কোনও দুর্ঘটনা ঘটল, আর কর্তৃপক্ষ হয়তো আপনাকে জিজ্ঞেস করল, ঘটনাটা আপনি কিছু দেখেছেন কি না, কিংবা দুর্ঘটনায় কার দোষ, তা সেটা মারামারিই হোক বা গাড়িচাপাই হোক, যে সব কিছু দেখা এবং জানা থাকা সত্ত্বেও তৎক্ষণাৎ জবাব দেয়, সে কিছুই দেখেনি, জানেও না। কারণ তখন সে মনে মনে নিশ্চয় বলে, হ্যাঁ বলি, তারপরে হ্যাঁপা পোয়াই, অত বোকা আমাকে পাওনি। ব্যাপারটা অবিশ্যি তাই, তবু খুবই হাস্যকর বলে বোধহয় এবং ভাবতে কীরকম লজ্জাই করে। তবু আমরা সকলেই প্রায় তাই করি। সেইরকম একটা মনোভাব নিয়েই, কেউ আর ছাতাতেও হাত দেয়নি, বুড়ো ভদ্রলোককে ঘিরে সবাই নানারকম আলোচনা করছিল। কেউ বলছিল, বোধহয় কোনও অসুখবিসুখ ছিল বা ফিটের রোগ–না না, স্ট্রোক হতে পারে, কিন্তু মশাই মরেছে কি না, সেটা তো কেউ বলতে পারছে না।…এমনি সব নানান কথা বলছিল এবং বুড়ো ভদ্রলোকটির মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল উনি আর জীবিত নেই। আর আমিই একমাত্র জানতাম, কীভাবে ওর স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটেছে। যে কারণে, আমি ওঁর শরীরের লিভারের কাছটা দেখতে চাইছিলাম। কিন্তু সেখানটায় জামার ঢাকা পড়েছিল। দেখলাম, কেউ কেউ আবার ডাকতেও আরম্ভ করেছে, এই যে বুড়ো দাদা, শুনছেন– হাসছেন কেন, এরকমভাবে লোকেরা অপরিচিত বুড়ো ভদ্রলোককে রাস্তায় ডাকে শোনেননি কখনও? শুনেছেন, তবু হাসি পেয়ে যায়, সেটা আমি আপনাকে এখন বলছি বলে, কিন্তু ওভাবে কথা বলতে বা ডাকতে আমরা এমনই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি, আমাদের একেবারেই কানে লাগে না। একজনকে দেখলাম, নিচু হয়ে নাকের কাছে হাত নিয়ে গেল। তারপরে হাতটা তুলে নাড়িটেপার মতো করে দেখল, যদিচ লোকটিকে আমার মোটেই ডাক্তার বলে মনে হয়নি। তারপরেই সে বলে উঠল, লস্ট!

একজন যেন তারই প্রতিধ্বনি করল, গয়া?.ভদ্রলোক যে মারা গিয়েছেন, সে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। চলে আসতে আসতে আমি শুনতে পেলাম, কে যেন বলছে, হাসপাতালে একটা খবর দিতে হয়। কিন্তু আমার দাঁড়াবার উপায় ছিল না, আমিও তখন আর একটি মরা বুড়োর কাছে যাচ্ছিলাম। মানে আমার সেই পিতৃ-সম্পত্তি ভসটির কাছে, তা ছাড়া কুঁড়ির কাছ থেকে যে মন নিয়ে ফিরে আসছিলাম, তাতেই আমি এত আচ্ছন্ন ছিলাম যে, ওখানে দাঁড়িয়ে ও সব দেখা বা ভাবা কী হয়েছে আপনার বলুন তো? আপনি আমার চোখের দিকে এমন করে তাকিয়ে আছেন এবং যে কথাটা ফুটে উঠেছে, তা যেন আমি পরিষ্কারই পড়তে পারছি–আপনি ভাবছেন, এরকম একটা ঘটনা ঘটল, তাতে কি আমার মনে কিছুমাত্র প্রতিক্রিয়া হল না? কিছুই কি ভাবলাম না? হ্যাঁ, মনটা ঠিক সেই মুহূর্তের জন্যেই কেমন যেন একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল, মনে মনে বলেছিলাম, এর কোনও মানে হয় না। হ্যাঁ, ব্যাস, এই পর্যন্তই। তারপরে তো আবার আমি আমাকে নিয়ে, আমার ভক্স নিয়ে, আমার সব কিছু নিয়েই এত ডুবে গিয়েছিলাম যে, আর সেই বুড়ো লোকটির কথা ভাববার অবকাশ পাইনি।

কী বললেন, এরকম অপরিচিত মানুষকে আরও মেরেছি কি না? আপনি যেরকম চোখ মুখ করে জিজ্ঞেস করছেন, তাতে তো আপনাকে বলাই যাবে না দেখছি। আপনাকেও কোনও কারণে মেরে ফেলতে পারি? না না মশাই, ওরকম ভাবছেন কেন, আমি কি আর বিশ্বসুদ্ধ লোককে মারতে যাচ্ছি? তবে আমার ধারণা, আমি থেমেছি, যে কারণে এই প্রথম আমি কথাগুলো আপনাকে বলতে বসেছি এবং ওই যে অপরিচিত আর কাউকে মেরেছি কি না জিজ্ঞেস করছিলেন তার জবাবে বলতে পারি আর একটা এরকম ঘটনা ঘটেছিল। তাতে ঠিক কজনকে মরতে হয়েছিল সঠিক হিসাবটা আমি তখনই পাইনি। পরের দিন খবরের কাগজে দেখেছিলাম, তিনজন।

…ওঃ! আপনি সত্যি এত ভাল লোক, অমনি একেবারে আঁতকে উঠে এমন চোখ বড় করে ফেললেন, যেন এত লোকের মরবার সংবাদ আপনি কখনও শোনেননি। কেন, আমাদের দেশে দুর্ভিক্ষে যে হাজার হাজার লোক কী বললেন, সেগুলো হত্যা নয়? আপনি হাসালেন মশাই। দুর্ভিক্ষ যেখানে তৈরি করা হয়, সেখানে তো জানাই কথা, না খেতে পেয়ে লোকে মরবে। তবে হ্যাঁ, সেটা আমার মতো খুনের ব্যাপার নয়। বরং কিছুটা হয়তো প্ল্যান-প্রোগ্রাম করেই করা হয়ে থাকে, যার ফল হয়, মানুষের মরণ। আর সেখানে খুনিকে ঠিক আমার মতো হাতেনাতে ধরার কিছু নেই।

০৯.

ঘটনাটা কী হয়েছিল? সেই কথাই তো বলছি। আপনাকে আগেই আমি আমার ভক্সলের কথা বলছিলাম, একবার একটা অ্যামবাসাডারকে ঘা মেরেছিলাম–হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক বলছি মশাই, ঘা-ই মেরেছিলাম। হ্যাঁ স্যার, আমার ওই বুড়োটিকে যা তা মনে করবেন না। যদিও উনি প্রায়ই যেখানে সেখানে গোলমাল করে বসেন, তবু জানবেন, উনি খুব শক্ত। একে সেকালের সাহেব, তায় প্রচুর ঘি দুধ খাওয়া শরীর না না, হাসবেন না। এ কলকাতায় যে দ্যাখেন অত অ্যামবাসাডর ইত্যাদি চলছে, তার থেকে অনেক মজবুত আর শক্ত শরীর ও সব বিলেতি গাড়ির। হতে পারে, ফরটি সেভেন-এইটের মডেল, তবু আপনার অনুমতি নিয়ে বলতে পারি, সসলা হারকিউলিস বলে আদর করতে ইচ্ছে করে। তবে হ্যাঁ, এটাই ঠিক, কোনও কোনও সময় মনে হয়, আউটরাম ঘাট থেকে ধাক্কা মেরে গঙ্গায় ফেলে দিই। যাই হোক, যে কথা বলছিলাম, কলকাতার রাস্তায় বা উত্তর দক্ষিণ, যেদিককার শহরতলিতেই হোক, কীরকম গাড়ির ভিড় আপনি দেখেছেন, আর রাস্তার চেহারাটা তার আগেই আপনাকে বলেছি। একদিন সন্ধ্যার পর, আমাকে উত্তর শহরতলিতে যেতে হয়েছিল পার্টির একটা জরুরি কাজে, আর সেটা করতে না পারলে, আমার ওপর একটু শনির কোপ হত, তা ছাড়া, ফিরে আমাকে আবার দক্ষিণে, কুঁড়ির কাছে যেতে হবে, সেই তাড়াও ছিল, অতএব আমি তাড়াতাড়ি যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সাধ্য কী যাই। এক তো মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক সিগনাল, বড় মোড়গুলো বাদ দিলে, ছোট ছোট রাস্তার মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের হাত। তার ওপরে গাড়ির ভিড়। এ সময়টায় এমনিতেই ভিড় থাকে। তখন যদি আবার তাড়া থাকে, তা হলে, সেটা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না, কী জঘন্য অবস্থাটা দাঁড়ায়। কারুর পক্ষে কেঁদে ফেলাটাও আশ্চর্য নয়। কিন্তু কী করবেন, সবদিক থেকেই যে আপনি বাঁধা, আপনার পথ নেই যে এদিকে ওদিকে ছিটকে যাবেন। এর মধ্যেই আপনি দেখতে পাবেন, ড্রাইভিং-এর কতরকম বাঁদরামি থাকতে পারে–হ্যাঁ, ও সবকে আমি বাঁদরামিই বলতে চাই। সে আপনার বাঁদিক মানবে না, ডানদিক মানবে না। হয়তো শুধু হর্ন দিয়ে দিয়েই আপনাকে পাগল করে দেবে পিছন থেকে, কিংবা রাত্রি হলে, অনবরত লাইটের সিগনাল। ভেবে দ্যাখে না, সকলের ক্ষেত্রেই ওটা প্রযোজ্য। হয়তো এমনভাবেই ওভারটেক করল, একমাত্র আপনিই জানেন, আর এক চুলের জন্যে কী বিপদটা ঘটতে পারত। কারণ আপনি হয়তো তখন বাঁয়ের চাপে, একটু ডাইনে সরবার জন্যে সবে স্টিয়ারিংটা ঘোরাতে যাচ্ছেন। গিয়ারটা একটু চড়িয়ে, বেরিয়ে যাবেন ভাবছেন, আর ঠিক তখনই সে বিনা সিগনালে বেরিয়ে গেল। আপনি যদি ভাল ড্রাইভার হন, তা হলে চমকে গাড়ির স্পিড কমিয়ে দেবেন না। সোজাই চলতে থাকবেন। কিন্তু মনে মনে চমকানির জন্যে, নিদেন রাসকেল বলে ফেলবেন। যদিচ, তাতে কিছুই যায় আসে না। কারণ তাকে ধরতেও পারবেন না, নালিশ জানিয়েও লাভ নেই। তা হলে রোজ আপনাকে চৌদ্দগণ্ডা নালিশ করতে হবে, যা কোনওদিক থেকেই সম্ভব নয়। তবু তো, আমার ব্যস্ততা, অপরেরও ব্যস্ততা, যা হোক, একটা মেনে নেওয়া যায় যে সবাই সবাইকে ওভারটেক করার চেষ্টা করছে। কিন্তু যখন দেখা যায়, কেউ কেউ, ওই ভিড়ে ও ব্যস্ততায় দিব্যি গদাইলশকরি চালে চলেছে, আপনি হর্ন দিয়ে, সিগনাল করে প্রায় কেঁদে ফেলার ভাব করলেও, সে তার পনেরো মাইল থেকে উঠতে চাইছে না, রাস্তাও ছাড়ছে না, কিংবা তার ওপরে হয়তো শুনলেন, সে বেশ রেডিয়োটি খুলে দিয়েছে বিচ্ছিরি বলছেন? সিভিক সেনসের অভাব? তখন যদি আপনি কিছু বলতে যান, তা হলে তো আপনি বুদুহয়ে গেলেন, কিংবা বুঢ়বক এবং শুনতে পেলেন হয়তো, গো অ্যাওয়ে ম্যান, বাত ন করোঁ।…

হ্যাঁ, কথাগুলো এই জন্যেই বললাম, ঠিক এরকম পরিস্থিতিতেই আমাকে প্রায় পড়তে হয়েছিল। এক তো এসপ্লানেড থেকে শ্যামবাজারের ব্রিজ পেরিয়ে আসতেই আমার চল্লিশ মিনিটের ওপর লেগেছিল। তারপরেও প্রতি পদে পদে বাধা, অথচ হাতে আমার সময় খুবই কম ছিল। আবার ঠিক সে সময়েই নীল রঙের অ্যামবাসাডর গাড়িটা যেন প্রায় জেদ ধরেই বসল, আমাকে ওভারটেক করতে দেবে না। বি টি রোড এখন খানিকটা চওড়া হয়েছে বটে, গাড়ির ভিড়ও সেইরকমই বেড়েছে। তাই, ডাউন প্যাসেজও এমন অবস্থায় যে ইচ্ছা করলেই, ডাইনে এগিয়ে চট করে কাটানো যায় না। ওদিকে যাঁর কাছে আমাকে যেতে হবে, দেরি হলে তাঁকে আর পাব না। লাইটের সিগনাল আর হর্ন দিয়ে নিজেই প্রায় পাগল হয়ে উঠলাম। কিন্তু সামনের গাড়িটা কিছুতেই জোরেও যাবে না, সাইডও দেবে না। মনে হয়েছিল, গাড়ির মধ্যে মেয়ে পুরুষ দুই-ই আছে। কিন্তু কে তখন অতসব দ্যাখে কী বললেন, রেডিয়ো ছিল কি না সেই গাড়িতে? না, তা আমি লক্ষ করিনি, তখন আমার মাথায় কেবলই এক ভাবনা, ওভারটেকওভারটেক। তারপরেই সামনের গাড়িটা বোধহয় আমাকে বুঝিয়ে দিতে চাইল, সে ইচ্ছা করলে স্পিড় দিয়ে আমার থেকে অনেক আগেই যেতে পারে। যে কারণে সে হঠাৎ স্পিড বাড়িয়ে চলতে আরম্ভ করেছিল। কিন্তু আমার তখন রক্তে রীতিমতো আগুন ধরে গিয়েছে, আমি আমার বুড়োটিকে তার শেষ সীমা পর্যন্ত দৌড় করিয়েছিলাম। তাতে করে, আমার আর আমার বুড়োটির উভয়েরই বিপদের সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু তখন সে কথা ভাববার মতো মনের অবস্থা আর ছিল না। আমি নীল গাড়িটার পাশাপাশি গিয়ে পড়েছিলাম, আরও পাশে, আরও আরও, তারপরে আর কিছুই নয়, স্টিয়ারিং-এ কেবল ডাইনে একটা হ্যাঁচকা, সঙ্গে সঙ্গে, আমার বুড়োর শক্ত থ্যাবড়ানো পশ্চাদ্দেশটি দুম করে নীল গাড়ির সামনে ছুঁইয়ে গেল এবং মুহূর্তে একটা বাস্ট করার শব্দ এবং আগুনের ঝলক। সত্যি বলতে কী মশাই, ছোঁয়াতে আমি খুব ভালই জানি, আর ঠিকমতো ছোঁয়াতে পারলে একেবারে যাকে বলে সোনা।

কী ব্যাপার মশাই, আপনি যেন একেবারে ছেলেমানুষের মতো থ্রিলিং ছবি দেখছেন? কী বললেন, সব শেষ হয়ে গেল কি না? তা ছাড়া আর কী। বাঁ দিকে এবড়ো খেবড়ো গর্ত, ডানদিকে ধাক্কা, দুয়ে মিলে একটা এক্সপ্লোশান, পেট্রল ট্যাঙ্কটি ফটাস। পালালাম কী করে? পিছনের আলো নিবিয়ে দিয়ে, একই স্পিডে বেরিয়ে গেলাম, যাতে নম্বরটা কেউ না দেখতে পায়। তবে রাস্তাটা সেখানে একটু ফাঁকা মতোই ছিল। হঠাৎ কারুর চোখে পড়বার মতো নয়। একমাত্র আগুনের ঝলকে আর শব্দে, আশপাশ থেকে লোক জমবার আগেই আমি অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম। ব্যাপারটা কেউ বুঝতেই পারেনি, কী ঘটেছে বা কী করে ঘটেছে, অবিশ্যি পরে ইনভেস্টিগেশনে নিশ্চয়ই ধরা পড়েছিল যে, ও গাড়িটাকে অন্য কোনও গাড়ি বড়রকমের ধাক্কা মেরেছিল এবং সেটা ইচ্ছাকৃত কিনা, সেটাও নিশ্চয়ই তারা বুঝতে পেরেছিল।

কী বললেন, ইচ্ছা করে ধাক্কা মারা বোঝা যায় কি না? নিশ্চয়ই যায়, তা নইলে আর ইনভেস্টিগেশন কী হল। আমি আবার ওপথ দিয়ে ফিরলাম কী করে? খুব স্বাভাবিকভাবেই, আমার বুড়োটিকে নিয়ে ওই পথ দিয়েই ফিরে এসেছিলাম এবং দেখেছিলাম, পুলিশ আর ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি ও লোকেরা ওখানটা ঘিরে রয়েছে। আশপাশের বাসিন্দারাও ছিল। না, আমি সেখানে যাইনি। আমার বুড়োটিকে নিয়ে, ঘস ঘস করতে করতে চলে গিয়েছিলাম। কেননা, খুনি যেমন তার খুনের জায়গায় একবার ফিরে যায় এবং ধরা পড়ে, আমি সেরকম কিছু করিনি, কারণ জানতাম, তাতে আমার ধরা পড়বার সম্ভাবনাই বেশি। সন্দেহ? না, আমাকে কেউ সন্দেহ করেনি, ফিরেই তাকায়নি, কেননা ওরকম একটি পুরনো ভক্স নিয়ে কাউকে যেতে দেখলেই দৃশ্যটা খুবই নিরীহ বলে মনে হয়। তা ছাড়া, তখনও কেউ এ সন্দেহে পৌঁছুতেই পারেনি যে, গাড়িটাকে কেউ ধাক্কা মেরেছে। হ্যাঁ, আমার গাড়ির পিছনে খানিকটা জায়গা দুমড়ে গিয়েছিল এবং সেই গাড়িটার নীল রংও খানিকটা লেগেছিল। কিন্তু আমাকে কেউ লক্ষই করেনি, বাড়ি ফিরে রংটা বেশ ভাল করেই তুলে ফেলেছিলাম এবং পরের দিন খবরের কাগজে ছবিসহ খবরটা বেরিয়েছিল, দুজন মহিলা এবং একজন পুরুষ গাড়িতে ছিল, পুরুষটি গাড়ি চালাচ্ছিল। যদি পুলিশ তখনও দুর্ঘটনার কারণ জানতে পারেনি, অনুসন্ধান করছে ইত্যাদি।

কী বললেন, হরিবল? টেরিফিক? তা হয়তো হবে, কিন্তু, দোহাই, ওরকম করে তাকাবেন না স্যার, জানি আপনার চোখে খালি সেই তিনটি মেয়েপুরুষের পোড়া শরীর আর পোড়া গাড়িটার ছবিই ভাসছে এবং আমাকে ভাবছেন একটা ভয়ংকর কিছুনা না, আপনার ভাবাটাকে আমি অন্যায় মনে করব কেন, বড় জোর আপনাকে বলতে পারি, আমার অবস্থাটাও একটু চিন্তা করবেন। আপনাকে তো আগেই বলেছি, কোনও সমর্থন আদায়ের চেষ্টাই আমি করছি না। দেখুন, মানুষের সব ব্যাপারটাই তার এত বেশি নিজস্ব, তার সিদ্ধান্ত এবং আচরণগুলোর কথাই বলছি, এর জন্যে কাউকেই দায়ী করা চলে না, আর তার জন্যে সে সমর্থনের কথা মুখে যাই বলুক, মনে মনে সে ওটাকে মানে না। বেশি বললে আপনি পাছে ভাবেন আমি তত্ত্ব কথা আওড়াচ্ছি, তাই এসব কথা থাক, কিন্তু এ কথা ঠিক, মানুষের সবকিছুর জন্যে, অর্থাৎ সেই ব্যক্তিটির সবকিছুর জন্যে সে নিজেই দায়ী। হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, অর্থনৈতিক দুর্গতির কথা যদি বলেন, তা হলেও সেটা তারই দায়, অতএব সে দায়কে নিয়ে সে কী করবে বা কীভাবে চলবে, ওটা তার নিজের সিদ্ধান্তের ওপরেই নির্ভর করে, সে দুর্গতিকে মানবে, না, লড়ে যাবে। কেননা, আপনি যদি মনে করেন, আপনার দুর্গতির কারণ অন্য কেউ আছে, তা হলে সেটাও তারই দায়, আপনাকে দুর্গত করাই তার সিদ্ধান্ত, ও ব্যাপারে সে নিজেই দায়ী। ধরা যাক এ দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা। আপনি মনে করলেন, এই ব্যবস্থা আপনাকে গরিব, আরও গরিব করে দিচ্ছে, কারণ এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বনিয়াদটাই আপনার কাছে সেইরকম মনে হচ্ছে। এই বনিয়াদ যে বা যারা করছে, সেটার জন্যে তারাই দায়ী। আপনিও দায়ী, কারণ আপনি এটা মেনে নিচ্ছেন। আর যদি মেনে নেন, আপনি অন্য কোনও বনিয়াদ তৈরি করতে চান, তা হলে তার জন্যেও আপনিই দায়ী। অতএব অন্যকে দায়ী করতে পারেন না, বরং দেখুন, আপনার সব দায়ের দায়িত্বগুলো পালন করছেন কিনা। ব্যাপারটা কী রকম জানেন, কেবলমাত্র মানবিকতার নামে আপনি যদি বলেন, ইংরেজরা ভারতবর্ষকে পরাধীন করার জন্যে দায়ী ছিল, সেটা খুবই হাস্যকর শোনায় না কি? আমাদের তো মশাই পরাধীন হবার জন্যে কেউ মাথার দিব্যি দেয়নি। অতএব নিজের দায় আপনি কারুর ঘাড়েই চাপিয়ে দিতে পারেন না। আপনি বেশ্যালয়ে গেলেন, আর যৌনরোগের জন্যে দায়ী করবেন সেই অসুস্থ বেশ্যাটিকেই, এর চেয়ে আজগুবি কিছু হতে পারে না। সেজন্যেই বলছি, মানুষের সব কিছুর জন্যে সে নিজেই দায়ী।

কী বললেন, আর কোনও অচেনা মানুষ আমার হাতে খতম হয়েছে কিনা? না, মনে পড়ে না। হ্যাঁ, এবার কুঁড়ির কথাই বলব, আমি সেখানেই থেমেছি, কিন্তু দেখুন সত্যি বলতে কী, সব খুনের পিছনেই আমার সেই মুহূর্তের একটা করে কারণ ছিল, কিন্তু কুঁড়ির বেলায় সে কারণটা আমি খুব স্পষ্ট করে কিছু বুঝতে পারিনি।…হ্যাঁ হ্যাঁ, বলুন কী বলছেন? ও কেমন দেখতে ছিল? আপনার ধারণা, আমার স্ত্রী, অর্থাৎ দীপার থেকে দেখতে সে নিশ্চয়ই সুন্দরী ছিল? কিছু মনে করবেন না, আপনার কথা শুনে না হেসে পারছি না। জানি, আপনি কেন এরকম ধারণা করছেন, কারণ স্ত্রী থাকতেও যখন অন্য মেয়ের সঙ্গে প্রেম হয়েছে, তখন নিশ্চয়ই সে দেখতে আরও রূপসী হবে, এই তো। বুঝেছি আপনার কথা, কিন্তু সত্যিই বলছি, কুঁড়ি দীপার থেকে দেখতে সুন্দর কিনা, এ কথা আমার কখনও ভাববার সুযোগ হয়নি, তবু আপনার জ্ঞাতার্থে এটুকু বলতে পারি, রূপের দিক থেকে দীপারই জিত। শিক্ষার কথা বলছেন? না, সেদিকেও দীপাকেই বিদুষী বলতে হবে, অর্থাৎ লেখাপড়াটা ওরই বেশি। বয়স? বয়সে অবিশ্যি কুঁড়িই ঘোট, এবং এর থেকে আপনি হয়তো এরকম ধারণা করতে চাইবেন, তা হলে অল্প বয়সটাই এক্ষেত্রে কাজ করেছে, মানে আমার টারগেট হল অল্প বয়স, তাই তো? বুঝেছি, আর আপনি যদি তা মনে করেন, আমার কিছুই বলবার নেই। এ ছাড়া আপনি আর কী-ই বা ভাবতে পারেন, কারণ আপনি তো সবকিছুর পেছনেই একটা কারণ না পেলে খুশি হবেন না, এবং সে কারণটা আপনার নিজের মতো, অর্থাৎ সকলের যে রকম ধারণা। এইভাবেই যদি বয়স অল্পের কথাটা ওঠে, তা হলে ধরে নিতে হয়, আপনি সেকস-এর ওপরেই জোর দিচ্ছেন, কারণ সেটাই স্বাভাবিক, তবে আপনি বোধহয় এটা মানবেন, সেক-এর ক্ষেত্রে আমরা যা চাই, যেটা আমাদের প্রার্থিত, সেটা একমাত্র বয়স দিয়েই পাওয়া যায় না, বয়সের কম বেশিতেই পাওনার হিসাব করা যায় না, এবং এটাও ঠিক যে কোনও অল্পবয়সি বালা-র কাছেই আপনি তা আশা করতে পারেন না, যদিচ কুহকের মালা হয়তো ওদের সকলের হাতেই, তবু থোড়ি দরশনে আশা মেটে না, এবং মদন জ্বালা বাড়ে, এমন বলা সবাই নয়, তা হলে তো পারভারশন বলে সমস্ত ব্যাপারটার ইতি সেখানেই টেনে দেওয়া যেত। কিন্তু মনের প্রশ্নটা কি একেবারেই তুলবেন না? তুলবেন? তা হলে তো মিটেই গেল। যেখানে অল্প বয়সটা পারভারশন, সেটা পুরুষের বা মেয়েদের যার বেলাতেই হোক, পারভারশনের নিয়মটা বোধহয় এই রকম, সে সুযোগ পেলেই অল্প বয়স খুঁজে বেড়ায়। সে হিসাবে বলতে পারি, কুঁড়ি আমার কুড়িটা নয়, একটাই এবং আপনাকে আগেই বলেছি, কুঁড়ির সঙ্গে আমার হয়েছে, এবং ব্যাপারটা অনেকদিনের। মেয়েদের কুড়ি-তিরিশের মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে যে তফাতটা আপনি দেখতে পাচ্ছেন, আমি সেকস-এর কথাই বলছি, সেই পাওয়ার তফাতটা অল্প দিনেই আলাদা মনে হতে পারে, তারপরে আর কোনও তফাত নেই, তারপরে তফাতটা একমাত্র মন দিয়েই বোঝা যায়। অতএব মনটা কী বললেন, কুঁড়ির সঙ্গে আমার দৈহিক সম্পর্ক আছে কিনা? নিশ্চয়ই আছে, এ বিষয়ে আপনি যদি প্রেমে কাম-গন্ধ পান, আর তাতে আমাকে কামুক প্রেমিক মনে করেন, কিছু ভাবব না।…আমরা এত বেশি দৈহিক সম্পর্কে দুজনে জড়িয়ে আছি, তার একমাত্র ব্যাখ্যা আপনাকে এইভাবে দিতে পারি; ছোট শিশু যেমন মায়ের বুকের দুধের জন্যে তৃষ্ণায় এবং খিদেয় কাতর হয়ে পড়ে অর্থাৎ তার জীবনধারণের অমৃতই বলা যায় প্রায়, আর মায়ের অবস্থাও সেই রকম, দুধ জমে টনটনিয়ে ওঠে, শিশুকে দেবার জন্যে, শরীর আর মন দুই-ই কাতর হয়ে পড়ে, আমরা সেইরকমই। মা আর শিশুর ব্যাপারটা দৈহিক নিশ্চয়ই, আমাদের সেইরকম দৈহিক, হ্যাঁ আমাদের প্রেম দৈহিকও, পাবার এবং দেবার জন্যে আমরা নিজেদের ওই রকম ভাবেই খুঁজে মরি– কী বললেন, এমন অদ্ভুত তুলনা আপনি কোনওদিন শোনেননি, অথচ ব্যাপারটা অস্বীকার করতেও পারছেন না? আপনি যদি করতেন, তা হলেও আমি নাচার, কেননা আমি আমার দৈহিক সম্পর্ককে যে রকম অনুভব করি, সে রকমই বললাম।

কী বললেন, আপনার খুব আশ্চর্য লাগছে, তা হলে কী দেখে আমি কুঁড়িকে…? আপনি ঘুরে ফিরে সেই পুরনো কথাতেই এলেন। সেই কর্তা ক্রিয়া এবং বাছাবাছি। আপনাকে তো আগেই বলেছি, ব্যাপারটা হয়েছে–ওটা করি নি, আমি এখানে অসহায়। যেমন ধরুন, ওর সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হতে পারত কিনা কখনও, যদি জিজ্ঞেস করেন, তা হলে যা ধরিনি, তা ছাড়ব কেমন করে? যারা ধরে, তারাই একমাত্র ছাড়ে, কারণ ধরলে ছাড়াছাড়ির প্রশ্ন ওঠে এবং এক্ষেত্রে যদি কুঁড়ি ছেড়েও যেত, আমরা যেটাকে ছাড়াছাড়ি বলি, তা হলেও আমার ছাড়ার কোনও প্রশ্নই থাকত না, কারণ আলাদা থাকা বা নিজের ইচ্ছামতো ভিন্ন জীবনযাপনকেই তো আলাদা বলা হচ্ছে, কিন্তু ভিতর থেকে যাকে ছাড়তে পারছি না, তাকে কেবল যোজন মাইল দূরে থাকলেই ছাড়া হয়? ছাড়াছাড়ির প্রশ্নটা যদি এরকম জায়গায় এসে দাঁড়ায়, তা হলে আপনি কাকে কার কাছ থেকে ছাড়াচ্ছেন।…।

সম্ভবত আমি আমার মনের অবস্থাটা আপনাকে বোঝাতে পেরেছি কুঁড়ি সম্পর্কে, অথচ কী বললেন, কীভাবে ওর সঙ্গে আলাপ হল? আপনি দেখছি সত্যি গল্পখোর লোক মশাই, একটি নিটোল কাহিনী না পেলে, আপনার মৌতাত জমতে চায় না। কিন্তু সেরকম কিছু শুনিয়ে আপনাকে খুশি করতে পারব বলে আমার মনে হয় না, কারণ পরিচয়ের ঘটনায় কোনও চমক ছিল না বা রোমান্টিক বলতে যা বোঝায়, তার ছিটেফোঁটাও ছিল না, প্রথম দর্শনের সেই চারি চক্ষের মিলন হইল গোছেরও কিছু ছিল না, কারণ চোখ চেয়ে দেখেছিলাম, তাতে অনুভূতির কোনও জায়গায়, যাকে বলে কলরব কোলাহল, কিছুই লেগে যায়নি। ওদের বাড়িতে ওর বাবার সঙ্গে বসে কথা বলতে বলতে হাত বাড়িয়ে চা নিয়েছিলাম, মনে হয়েছিল, একটি বছর আঠারো কুড়ি বয়সের মেয়ে, দিন চলে যাওয়া আর দশটা মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে যেমন হয়। ও যে ও বাড়ির মেয়ে, বা কোন মেয়ে, বড় না মেজো না সেজো, কী নাম, কোনও পরিচয়ও ওর বাবা দেননি, ভদ্রলোক তখন কথা বলতেই ব্যস্ত। উনি ছিলেন, লাল শাহ-এর কর্মচারী, কাজটা ছিল আমার ডিপার্টমেন্টে, কিছু খবর ওঁর কাছ থেকে আমার জানবার ছিল, কিন্তু ভিতরের খবর উনি আমাকে দিতেন, অর্থাৎ উনি ছিলেন আমার তরফের বড়বাবু। স্বভাবতই আমাদের যে সব কথা হত, তার সবটাই গোপনীয়, ল্যাস বা তার অনুচরেরা কোনওরকমেই জানতে পারবে না, সেই সূত্রেই ওঁর বাড়িতে যাতায়াত, আর তাতেই কুঁড়ির সঙ্গে পরিচয়। ভদ্রলোকের ছেলের থেকে মেয়ে বেশি, মেয়েদের কারুর কারুর বিয়ে হয়েছে, তবে সম্ভবত বিয়েগুলো তেমন সুবিধের হয়নি, যে কারণে বাপের বাড়িতেই প্রায় সকলের অবস্থান। তবে বাড়িটা কী বললেন, কুঁড়িরও বিয়ে হয়েছিল কিনা? না, কুঁড়ি এবং আরও গুটিদুয়েক বোন তখনও বাকি ছিল। তবে বাড়িটা ভদ্রলোকের পৈতৃক, পুরনো, বলতে পারেন, অনেকটা সেকালের চকমেলানো বাড়ির মতোই, এখন যে বাড়িকে অনেকটা ভূতুড়ে বলেই মনে হয়, ড্যাম্প আর নোনা ইটের গন্ধ পাওয়া যায় বাড়িতে ঢুকলেই, কিন্তু তার থেকে ধরে নেবেন না, হাল আমলটা ও বাড়িতে ঢুকতে পায়নি। তবে এ ধরনের পরিবারে যেগুলো প্রচুর পরিমাণে থাকার সম্ভাবনা, ফ্যামিলি প্রাইড আর ইগো, যেগুলো নিতান্তই ফলস, কিছুটা বিবেককে শান্ত করা আর বাকিটা এক ধরনের মুখোশ, সে সব খুবই ছিল। ওর দিদিদের কথাতে সেটা বেশি টের পাওয়া যেত, এবং কুঁড়ির সঙ্গে আমার যোগাযোগটা তাদের পছন্দ ছিল না, অনুমান করেই নিতে পারছেন, কিন্তু আমার মনে হয়, অতটা ডিটেলে যাবার বোধহয় কোনও প্রয়োজন নেই।…

কী বললেন, প্রেম হওয়াটা জানা গেল কী করে? খুবই সহজ, যদি ব্যাপারটাকে অকারণ সাজাবার দরকার না হয় তা হলে, ব্যাপারটা খুবই সহজে জানা গেল, যখন দেখলাম ওর বাবার সঙ্গে দরকার না থাকলেও ওদের বাড়িতে যাই। দেখুন সত্যি বলতে কী, আপনার যে কোনও ব্যাপারই আপনিই একমাত্র প্রথম জানতে পারেন, হয়তো তার ব্যাখ্যাটা তখুনি করতে পারেন না, কারণ তার জন্যে যে ভাববার প্রয়োজন, সেটা ঘটে ওঠে না।…বলুন বলুন, কী বলতে চান, সংকোচের কোনও কারণ নেই। তবু প্রথম দিনের জানাজানিটা কেমন করে হয়েছিল? মানে কীভাবে পরস্পরকে জানানো গেল যে, প্রেম হয়েছে?

সত্যি, আমার ইচ্ছা করছে, আপনার জন্যে এখনি একটা গল্প তৈরি করি, আর তার নাম দিই, প্রথম জানাজানি, আর তারপরে, একটি অপরূপ বিবরণ ও ডায়লগ লিখে দিই। কিন্তু সেরকম যে কিছুই হয়নি। হয়তো বললে অবাক হবেন, তোমাকে ভালবাসি বা তোমাকে চাই ইত্যাদি ধরনের কোনও কথাই আমাদের কখনও হয়নি। তবে হ্যাঁ, সবকিছুরই একটা ব্রেক বা কার্ভ আছে, যখন অচেনা নতুন দিকটা আরও বেশি করে ফুটে ওঠে, দেখা যায়। যেমন ধরুন, একদিন ওর এক দিদি এল হাতে চায়ের কাপ নিয়ে, যেটা আশা করতে পারিনি, যে কারণে আমাকে বলতে হয়েছিল, আপনি এলেন চা নিয়ে?

তাতে ওর দিদি হেসে বলেছিল, কেন মশাই, আমাদের কি চা দিতে নেই?

বলেছিলাম, নিশ্চয়ই আছে, কোনওদিন তো আমার সে সৌভাগ্য হয়নি।

ওর দিদি হেসেছিল। তারপরে আর এক দিদি এসেছিল। তারা যে আমার সঙ্গে কথা বলতে আসে না, তা নয়, নিতান্ত দু-একটা কুশল প্রশ্নাদিতে তার ইতি হত, কিন্তু সেদিনটাতে মনে হয়েছিল, তারাই আমার সঙ্গে কথা বলবে। আশা করেছিলাম, কুঁড়ির কথাটা তারাই বলবে। বলেনি, যে জন্যে আমাকেই জিজ্ঞেস করতে হয়েছিল, আচ্ছা কুঁড়ি কোথায়, ওকে দেখছি না তো?

জবাব পেয়েছিলাম, আছে বাড়িতেই, এদিকে কোথাও।

যেন ব্যাপারটা কিছুই নয়, কিন্তু আমার চোখে একটা চিন্তা এবং উদ্বেগ ফুটে উঠেছিল কী বললেন, আমি যে বিবাহিত, কুঁড়িরা জানত কিনা? আপনি যে মশাই তিরিশের যুগের বাংলা ছোট গল্পের আমদানি করলেন, বিয়ে ভাঁড়িয়ে প্রেম করা বা আবার বিয়ে করা এবং তারপরে রহস্য ক্রমেই ঘনীভূত। আপনি সেই সব চিন্তার মধ্যেই রয়েছেন, কর্তা, ক্রিয়া, ভাবনা-চিন্তা, প্ল্যান-প্রোগ্রাম। সরলতা, সন্দেহ নেই, কিন্তু একটা আবদ্ধতা তাতে থেকে যাচ্ছে, সেটা ক্ষতিকারক। না, আমি যা, তাই সকলে জানত, এবং ওর দিদিরা সেদিনটাতে বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়েই আমার স্ত্রীর কথা জিজ্ঞেস করেছিল, দীপাকে নিয়ে ওদের বাড়িতে যাবার জন্যে অনুরোধ করেছিল কী বললেন, গিয়েছিলাম কিনা? না, কোনওদিন যাইনি, যদিচ কুঁড়িদের পরিচয় বা বাড়ির কথা আমি ওকে বলেছিলাম, যাবার কথাও বলেছিলাম, ও যায়নি। সম্ভবত আমার আর কুঁড়ির বিষয়টা ও জানত না, কারণ জানলে একটা কৌতূহল নিশ্চয় বোধ করত, কিংবা এমনও হতে পারত, জানতে পারলে কখনওই যেত না।..

কিন্তু সেদিনটার কথাই বলি, কুঁড়ির দিদিরা যখন কথা বলছিল, তার একটু পরেই কুঁড়ি এসেছিল, তবে অন্যান্য দিনের মতো, যেন একটা প্রতীক্ষার পরের উচ্ছ্বাস, যে উচ্ছ্বাসটাকে মোটেই কলকলানো ছলছলানো ভাববেন না, তবু সারা শরীরেই, চোখে ঠোঁটে এবং ভঙ্গিতে যে উচ্ছ্বাসটা ফুটে উঠত, সেটা ওঠেনি, বেশ গম্ভীর হয়েই এসেছিল, খুব ধীরে ধীরে এসেছিল, এবং আমার বা কারুর দিকেই তাকায়নি। স্বভাবতই পরিবেশটা অস্বস্তিকর হয়েছিল, আর কারুর না হোক, আমার ভিতরে তখন নানান জিজ্ঞাসা এবং যেটা আগে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার কি শরীর খারাপ? ও গম্ভীরভাবেই জবাব দিয়েছিল, না। হ্যাঁ বললে, তবু ওখানেই সব মিটে যেত। না বলাতে পরিস্থিতি আরও জটিলই হয়েছিল। ইতিমধ্যে আমার যাবার সময় হয়ে গিয়েছিল, আমি একটা অস্বস্তি নিয়ে উঠেছিলাম। কিছু একটা হয়েছে, সন্দেহ ছিল না, এবং মোটামুটি কিছুটা আন্দাজ করারও চেষ্টা করেছিলাম। পরের দিন অফিসেই আমি কুঁড়ির টেলিফোন পেয়েছিলাম। ও ভেবেছিল, আমি হয়তো আর যাব না। যেতাম কিনা জানি না, বোধহয় যেতাম, তবু ওর টেলিফোনটা আমাকে সাহায্য করেছিল, জানিয়েছিল আমাকে নিয়ে দিদিদের সঙ্গে ওর বিবাদ হয়েছে, যে কারণে গতকাল সন্ধ্যাবেলা ওরকম পরিস্থিতি হয়েছিল, কারণ আমি যাবার একটু আগেই ওদের কথা কাটাকাটি হয়েছিল। গতকাল সন্ধ্যায় ওর ব্যবহারের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করেছিল, যদিচ ও তখন এতই উত্তেজিত ছিল যে, চুপ না করে থেকে উপায় ছিল না, তবে ওর বক্তব্য ছিল, নিজের বিষয়ের ব্যাপারে কারুর নাক গলানো ও পছন্দ করে না, অতএব আমি যেন যাই, যেমন যাচ্ছিলাম।…।

গিয়েছিলাম কিনা জিজ্ঞেস করছেন? নিশ্চয়ই গিয়েছিলাম, আর তার জন্যে বুঝতেই পারছেন, বিরাগভাজন বা অপমানিত হওয়াটা অবধারিত হয়ে উঠেছিল, যে কারণে আপনাকে বলেছিলাম, আমি খুবই অসহায়, কারণ ভেবে-চিন্তে, প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে ও সব কেউ ভোগ করতে চায় না। কিন্তু এ সব কথাও আমার মনে হয়, বেশি করেই বলা হচ্ছে, অপ্রয়োজনীয়। আমার বলার ছিল, কুঁড়িকেও খুন করেছি এবং সেটা কী বললেন, দীপার সম্পর্কে কুঁড়ির মনোভাব? যা হওয়া স্বাভাবিক তাই, কারণ যা হয়েছিল, সেটা তো কোনওদিক থেকেই, যাকে বলে নিরঙ্কুশ সুখের ব্যাপার নয়, তার থেকে অনেক বেশি দুঃখেরই, তথাপি হয়েছিল।… হ্যাঁ, আগেই আপনাকে বলছিলাম, কুঁড়িকে খুনের কারণটা আমি যেন সঠিক বুঝতে পারিনি। আরও আগে আপনাকে বলছিলাম না, অনেক সময় ওর ঠোঁটে মুখ ডুবিয়ে আমার বুকের কাছে একটা কষ্ট যেন ছুরির ফলার মতোই বিধে যেত, এমনকী, চোখে জল এসে যেত, মনে হত, তবু কী যেন রয়ে যায়, কী যেন পাই না, আর আপনি তখন বলছিলেন, কোথায় একটা বৈরাগ্যের গন্ধ পাচ্ছেন, যে কারণে আমি বললাম, আমার ভিতরে তখন যেন কোথায় একটা একতারা মিঠে সুরে বাজতে থাকে–ওই সেই, সেই কী যেন রয়ে যায়, কী যেন পাই না–এই যন্ত্রণাটাই সর্বনাশ করেছিল, অথচ সত্যি বলতে কী, আমি তো ব্যাখ্যা করতেও পারি না, কী পাই না, কী রয়ে যায় এবং সেই অবস্থাতেই, যখন আমাদের স্বাদ এবং অনুভূতি জিভ আর ঠোঁটের দ্বারা পরস্পরকে অনুভব করছে আর বুকের কাছে ছুরিটা বিধে যাচ্ছে, তখন–সেইদিন তখন কী হল জানেন, একতারাটার সুরে মিঠে কিছু ছিল না, আগুন জ্বলে উঠল। হ্যাঁ, চোখে জলও এসে পড়েছিল, কিন্তু বৈরাগ্যের থেকে রুদ্র কাঁপালিকই যেন আমার হাতে ভর করেছিল, ওর সেই নরম গলাটি আমি

১০.

দাঁড়ান, আপনি যদি মুখের ভাব ওরকম করেন, আমি বলতে পারব না। অনেকগুলো তো শুনলেন এতক্ষণ ধরে, তবু সামলাতে পারছেন না? কী বললেন, আমি সেই নরম গলাটা টিপে দিলাম কিনা? তাই তো দিয়েছিলাম। কী বলছেন, সাংঘাতিক? আমি স্বাভাবিক নই? সেটা ঠিক, সাংঘাতিক কিনা জানি না, কিন্তু যে সব স্বাভাবিকতা আমার চারপাশে স্বাভাবিকতা বলে চলছে, সেই তুলনায় আমি নিতান্তই অস্বাভাবিক। আমার কষ্ট হয়েছিল কিনা জিজ্ঞেস করছেন? সেই মুহূর্তে তো তা বুঝতে পারিনি, তখন তো একটা ছুরি বেঁধা কষ্টেই ওরকম করেছিলাম। তারপরে কী হল–সে কথা পরে বলছি।

কী বললেন, এর পরেও আমি কেমন করে এই পৃথিবীতে বেশ নিরাপদে ঘুরে বেড়াচ্ছি? হাতে এত রক্ত মেখেও কেমন করে লুকিয়ে ফিরছি? আছে আছে, সে সব কায়দা কানুন আছে, দারুণ অপরাধ করেও সবসময়েই কেমন করে লুকিয়ে ফেরা যায়, সব আপনাকে বুঝিয়ে দেব, দেখবেন, তখন মনে হবে, ব্যাপারটা তেমন মারাত্মক না, বেশ সহজ। কী বললেন, যেন এ সব খুনগুলোর কথা, নানাভাবে আপনি খবরের কাগজে পড়েছেন? অনেককেই চিনতে পারছেন? কিন্তু এগুলো যে একই লোকের হাত দিয়ে হয়েছে, তা বুঝতে পারেননি? তা হতে পারে, তবে বাইরের দিক থেকে দেখলে এরকম ঘটনা তো কতই ঘটছে, কতই খুন হচ্ছে।…আচ্ছা, এবার অনেক রাত হয়েছে, আপনার ছুটি। কিন্তু আগামীকাল সকাল সাতটায় আপনাকে একবার চাই, হ্যাঁ আমার বাড়িতে। আমি জানি, আপনি হচ্ছেন কোটি কোটি মানুষের একজন। আপনি এতই বিশাল আকার যে, নিরাকার ব্রহ্মের মতোই সবখানে রয়েছেন, আপনার চোখ কোথায় নেই। কাল সকাল সাতটায় আসুন, প্লিজ, একেবারে আমার শোবার ঘরে আসুন। এতক্ষণ আটকে রাখার জন্যে দুঃখিত।

অস্বীকার

কী হল, আসুন, ঠিক সময়েই তো এসেছেন, বরং মিনিট দুয়েক আগেই এসেছেন। কী ব্যাপার, অমন ইতিউতি করছেন কেন, আপনাকে তো কেউই দেখতে পাচ্ছে না, আমি ছাড়া, তবে আর এত আড়ষ্টতা কেন? আপনি তো আর সকলের চোখে নিরাকার। কান পেতে কী শুনছেন বলুন তো? পেয়ালা পিরিচ চামচের টুনটুন? তা তো পাবেনই, এখনও বিছানা-চা পাইনি। ও, আপনি দেখছেন, আমার পাশে কে শুয়ে আছে? মেয়েটি কে? এমন বেআবরু অগোছালো, চুল এলানো, নিশ্চিন্ত ঘুমে অবিশ্যি ও নেই এখন আর, জেগেছে, জড়তাটা রয়েছে, তাই পড়ে আছে, এবং স্বাস্থ্য চেহারার যা বিবরণ আপনাকে দিয়েছিলাম, নিশ্চয়ই মিলিয়ে নিতে পারছেন দীপাকে? হ্যাঁ, দীপাই, আমার স্ত্রী। এই যে, চা এসে যাচ্ছে, চাকরটা আসছে, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, তা হলে ওর আঁচলটা আমি একটু টেনে দিচ্ছি, কারণ বুঝতেই পারছেন, চাকরটার কাছে একটা সহবত তো আছে, যদিও জেগেই আছে, কিন্তু হাত পা কাজ করতে চাইছে না, আর স্বামী হয়ে এটা না দিলে পরে ও আমার ওপর রাগ করবে, বলবে, চাকরটা আসছে দেখেও তুমি আমাকে একটু ঢেকে দিলে না?

কী বললেন, তবে যে বলেছিলাম, ওকে আমি খুন করেছি? তা করিনি, দেখতেই পাচ্ছেন, তবু কেন বলেছি, সে জবাব আপনাকে আমি পরে দিচ্ছি, আপাতত, হ্যাঁ, চা-টা আমি নিজে করতেই ভালবাসি যদিচ করা আর কী, পট থেকে ঢেলে নিয়ে দুধ চিনি মিশিয়ে নেওয়া। দাঁড়ান, চা ঢেলেছি, এবার ওকে আমি ডাকি। হ্যাঁ, ওকে আমি এরকম, গায়ে হাত দিয়ে আদর করে দীপু দীপু বলেই ডাকি, আর ও একরকম একটু যেন চমকেই জেগে ওঠে, এবং জিজ্ঞেস করে, ওঃ চা দিয়ে গেছে? আমাকে একটু ঢেকে দিয়েছিলে? এ কী, আমাকে ডাকলে না কেন, নিজেই করে নিয়ে আমাকে ডাকছ, আমি করতে পারতাম না বুঝি…?

ইত্যাদি এ কথাগুলো ও প্রায় রোজই বলে, এবং এই যে দেখছেন, এলোমেলো অবস্থা, আর আমার খালি পিঠে ও গাল ঘষছে, বলতে পারেন, চায়ের আগের মৌতাত এটাই, তারপরে চায়ে চুমুক। কী বললেন, আমাদের ছেলেমেয়ে আছে কিনা? নিশ্চয়ই আছে, ঝিয়ের হেফাজতে তারা অন্য ঘরে আছে, একটু পরেই আসবে, কিন্তু এবার আমাকে বাথরুমে যেতেই হবে। দীপাও এবার সকাল বেলার খাবার তৈরির তদারকে যাবে, কিন্তু তার আগে, আমার এই সিগারেটটা খাবার সময়, ওর কিছু কিছু কথা বলবার থাকে, যেমন, উঃ, এই ওঠা হল, তুমি তো বেরুবে, ফিরবে সেই রাত্রে।

কী করি বলল, এত কাজ।

ভাল লাগে না ছাই! ওহো শোনো, নবনীর ছেলের অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্নপত্র এসেছে, আজই কিছু পাঠিয়ে দেওয়া দরকার। আমার হাত তত খালি, পঞ্চাশটা টাকা দিতে পারবে তো?

তা হয়ে যাবে।

তারপরেই পাশের বাড়ির রেডিয়োর গানটা ভেসে আসছে, শুনতে পাচ্ছেন, আমার মল্লিকা বনে…।

দীপা–বেশ গাইছে, না?

শুনতেই পাচ্ছেন, ও নিজেই গানটা গুনগুন করতে আরম্ভ করেছে, তারপরেই হ্যাঁ গো, টাকার কথা বললাম বলে রাগ করলে নাকি?

আমি কী যে বলো?

এবং স্বভাবতই ওর কাঁধটা চেপে ধরে হেসে একটু ঝাঁকানি দিই। এবার বাথরুম এবং একটু বাদে, শুনতে পাচ্ছেন নিশ্চয়ই, আমিও গুনগুন করতে আরম্ভ করেছি, দিন চলে গেছে খুঁজিতে খুঁজিতে, তারে বুঝিতে পারিনি। একটু অবাক হচ্ছেন, তা বুঝতে পারছি, আমাকে বেশ সুখী গৃহকর্তা এবং স্বামী বলে মনে হচ্ছে না? আরে মশাই, তাই তো। হ্যাঁ দাঁড়ান, জামা কাপড় পরে তৈরি হয়ে নিই। এই যে, আমার ছেলে আর মেয়ে এল। এই একটা ব্যাপারে আপনি আমাকে যা দেখছেন, আমি ঠিক তাই, যে কারণে এদের কথা আপনাকে আমি বলতেই ভুলে গিয়েছিলাম, কারণ আমার স্বীকারোক্তির কোনও জায়গাতেই এরা নেই, এরা অন্য জায়গায়। এরা আমার পিতৃত্বের ছায়াতেই আছে, যদিচ জানি, ধৃতরাষ্ট্র আর দুর্যোধন, দুই সীমান্তের পুরুষ, তবু সংস্কারের যাতনা থেকে কে বা মুক্ত। সেদিক থেকে আমি একেবারেই বাবা। দীপা আগে ওদেরই খাইয়ে দেয়, ওরা পড়তে যায়। এবার আমি আর ও বসি। এবং প্রথম কথাই শুরু হয়, শুনতেই পাচ্ছেন, কাল সন্ধ্যাবেলা খাদু এসেছিল।

খাদু আমার শ্যালকের নাম, যার বিয়ের বিষয়ে দীপার আপত্তির কথা আপনাকে আমি আগেই বলেছি। আচ্ছা শুনুন, ও কী বলছে, এবং ওর মুখে খাবার খেতে থাকা সত্ত্বেও কীরকম একটা দৃঢ়তার ছাপ পড়েছে, দেখতেই পাচ্ছেন, খাদু এসে যা বললে, সে কথা তোমাদের আগেই বলেছিলাম, এখন দ্যাখো।

কী ব্যাপার?

খাদু এখন বিয়ে করে পস্তাচ্ছে। আমি তো আগেই বলেছিলাম, ও মেয়ে ভাল হতে পারে না। এখন খাদু জানতে পেরেছে, ওর বউয়ের নাকি আগে কোথায় একটা প্রেম ছিল।

তাই নাকি? জানল কী করে?

সেখানকার পাড়ার লোকেরাই বলেছে, বউও কিছুটা স্বীকার করেছে যে, হ্যাঁ, হিতুদার সঙ্গে এক সময়ে আমার আলাপ হয়েছিল। তা ও কি সব বলবে নাকি? নেহাত খাদু গিয়ে বউয়ের বাড়িতে নিজের চোখে দেখেছে, বউ তার হিতুদার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে। তখন খাদু ধরেছে, তোমাদের কতখানি গড়িয়েছিল, মানে সবই ওপর ওপর না, আরও কিছু।

কী বললেন, আমার মুখটা এমন বিব্রত হাসিতে কুঁচকে উঠেছে কেন, তার কারণ আমি ওকে না বলে পারছি না, ওরকমভাবে জিজ্ঞেস করে কী লাভ, যা হবার তা তো

কী বলতে চাও তুমি? আমি মনে করি, সব পরিষ্কার হয়ে যাওয়া উচিত, তাকে নিশ্চয়ই বলতে হবে, সে তার হিতুদার সঙ্গে কদ্দূর এগিয়েছিল।

আমি: ধর যদি সে স্বীকার করে হিতুদার সঙ্গে তার সবকিছুই হয়েছিল। মানে যে ব্যাপারটাকে এখানে সবকিছু বলা হচ্ছে।

দীপা: তা হলে বলতে হবে সে একটা নোংরা মেয়ে, খাদুকে ঠকিয়েছে।

আমি: তা ঠিকই অবিশ্যি।

দীপা: কিন্তু ও সব চরিত্রহীন মেয়েকে আমি জানি, পুরোপুরি স্বীকার কখনই করবে না। তা ছাড়া তোমার এখন আবার হিতুদার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলাই বা কেন, এখন তুমি আর একজনের বউ।

আমি: তা তো সত্যিই।

দীপা: আমার মতে, যা ছেড়েছি, তা ছেড়েছি।

আমি: তাই তো উচিত। তুমি একটু খাদুর বউকে বুঝিয়ে বলে দিয়ে।

দীপা: বলব তো বটেই, ছেড়ে দেব ভেবেছ?

কী বললেন, আমাকে যেন চিনতেই পারছেন না? দাঁড়ান, ওমলেটের এই শেষ টুকরোটা মুখে দিই, তারপরে বলছি। কিন্তু হল না, তার আগেই শুনুন দীপা অন্য প্রসঙ্গ তুলছে; আমাদের শকুন্তলার কথা শুনেছ তো, যিনি স্বামীর কাছে ভালবাসার অভাব বোধে, এত কাণ্ড করে ডাইভোর্স নিলেন, তিনি তো এখন আবার আর একজনের হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।.আপনার বোধহয় মনে আছে, আমাদের পরিচিত একটি দম্পতির কথা আপনাকে বলেছিলাম–হ্যাঁ হ্যাঁ, খুনের প্রসঙ্গে যাদের কথা বলেছিলাম, সেই স্ত্রীটির নাম শকুন্তলা।

আমি: তাই নাকি?

দীপা: হ্যাঁ, আবার এই শকুন্তলাকে লোকে কী করে সৎ বলে, সাহসী মেয়ে বলে, বুঝতে পারি না, ছি! হ্যাঁগো, ভালবাসাটা কি এদের কাছে ছেলেখেলা, না কি?

আমি: আশ্চর্য, তাই তো দেখছি।

দীপা: তবে সে ইতরামির জবাব বিভূতিও–

বিভূতি শকুন্তলার স্বামীর নাম,-বিভূতিও ভাল করেই দিয়েছে, কোর্টের ছাপ মেরে দিয়েছে ৫২৬ একেবারে, কেননা, কলঙ্কের ভাগটা তো বিভূতি নেয়নি, শকুন্তলাকেই নিতে হয়েছে।

আমি: অথচ আশ্চর্য, শকুন্তলা তো স্পটলেস মেয়েই ছিল, তবু চলে যাবার জন্যে নিজের কাঁধেই অমন কলঙ্ক নিল।

দীপা: ছিল কি না ছিল, সে খবর কে রাখছে।

আমি: তা অবিশ্যি হতে পারে, কে কার খবর রাখছে।

দীপা: তবে! ভালবাসার অভাববোধ, ন্যাকামি দেখলে গা জ্বালা করে…

ওই দেখুন আবার টেলিফোন বাজছে, হ্যাঁ, আমাকে থামিয়ে দীপাই যায়! ওর মুখটা হাসিতে কী রকম ভরে উঠেছে, কথাগুলো নিশ্চয়ই শুনতে পাচ্ছেন, নন্দকিশোরবাবু? আসবেন আজকে? সন্ধায়? আসুন না, গান গাইতে হবে কিন্তু, বেশ তো, খাওয়াব, যা খেতে চান।…ও থাকবে কি না বলতে পারছি, আপনি…। আচ্ছা, ওদের কথা চলতে থাক, ততক্ষণ আপনাকে বলি, নন্দকিশোর প্রায় সন্ধ্যাতেই আসেন, গানটান করেন, ভদ্রলোকের কথাবার্তাও ভারী সুন্দর, রুচিবান, মার্জিত, এখনও অবিবাহিত কী বললেন? না কোনও প্রতিজ্ঞা নেই বিয়ে না করার, যতদূর জানি, আমার স্ত্রী ওঁর খুব ভক্ত। নামকরা গাইয়ে কিনা জিজ্ঞেস করছেন? এমনিতে কিছু শুনি না, তবে দীপার কাছে শুনি, উনি অনেকটা দ্বিগ্বিজয়ী লোক, বহু গুণের অধিকারী, আর দীপা যখন বলছে-দীপা আসছে। কী বললেন, দীপার মুখে একটা যেন বিরক্তির ছায়া ফুটছে? ওর কথাতেই কারণটা শুনুন : এই এক লোক বাবা, রোজ সন্ধ্যাবেলা জ্বালাতন, তারপরে আজ এটা খাওয়াও, কাল ওটা খাওয়াও, রাত্রি নটা-দশটার আগে উঠবেন না।

আমি: তাতে কী হয়েছে, একটু আসেন, গল্প করেন।

কী বললেন, দীপার চাউনিটা বেশ সন্দিগ্ধ আর তীক্ষ্ণ লাগছে? তা হতে পারে, ও আমাকে বোধহয় কিছু বোঝাতে চাইছে, কিন্তু আমার মুখ দেখে আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কোথাও কিছু নেই।

দীপা: তোমার আর কী, তুমি তো ফিরবে সেই রাত্রে, যত জ্বালাতন আমার।

কিন্তু আমার বসে থাকার সময় নেই, ঘড়ির কাঁটা সাড়ে আটটায়, নটায় আমার পৌঁছুতে হবে। আশা করি গাড়িটা ঠিক আছে, আমার বুড়োটির কথা বলছি, গতকাল রাত্রে তো দেখে রেখেছি, তিনি চলবার মতো অবস্থায় আছেন, অতএব ওকে বলি, আমি চলি, বুঝলে? এবং একটু ওর গায়ে হাত দিই, বিগলিত চোখে চাই। ওর কথা: দেখো চাকরবাকর কেউ এসে পড়বে। ও মনে করেছিল আমি ওকে একটা চুমো খাব। এবং সেরকম ভাবেই আমি ঝুঁকেছিলাম, আপনি দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু ওর কথা শেষ হবার আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে গ্যারেজে ভকসলের লাটু গিয়ারের ডাণ্ডায় আমার হাত। চলুন যাওয়া যাক, আজকের দিনটা আপনি আমার সঙ্গেই থাকুন।

কী বললেন, আমাকে আপনি ঠিক যেন এখনও চিনে উঠতে পারছেন না? কেন, ব্যাপারটা তো খুব সোজা মশাই, তবে হ্যাঁ, দীপাকে কেন মারিনি, আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন, সে কথা আপনাকে আমি পরে বলব। এইবার আসুন এই আমার নিজের চেম্বার, তারপরে চলুন ল্যাস-এর কাছে যাই। কী হল বলুন তো? আমার সমস্ত চেহারা এবং মুখ এখন একেবারে অন্যরকম দেখাচ্ছে? কী রকম বলুন তো? গম্ভীর আর উত্তেজিত? কপালের রগগুলো ফুটে উঠেছে? আপনাকে তো আমি আগেই বলেছি, আমার চাকরির ব্যাপারটা কেমন। এবং সত্যি বলতে কী, আপনাকে আমি চোরাই কাগজপত্র সই করার কথা বলছিলাম, সেটা আমার এখনও রয়েছে, কারণ আমি যখন আজ এখানে এসেছি, তখন বুঝতেই পারছেন, বিষয়টার নিষ্পত্তি করা যায়নি। কী বললেন, ল্যাস মরে গিয়েছে? ল্যাস-এর চেম্বারের দরজা খুলে দিচ্ছি, শীততাপনিয়ন্ত্রিত ঘরে দেখুন সেই জীবটি জীবিতই বসে আছেন। দেখেছেন, যে রকম বর্ণনা দিয়েছিলাম, তার সঙ্গে ঠিক মিলে যাচ্ছে কিনা? একেও জীবিত দেখে অবাক হচ্ছেন? আচ্ছা, কেন একে মারিনি, সে কথাও আপনাকে আমি পরে বলব, কিন্তু ওর চাউনিটা দেখে আপনি বোধহয় ভিতরের অবস্থাটা বুঝতে পারছেন না?

কী হল? ও! আপনি সেই অ্যাবস্ট্রাক্ট মুগুরটি দেখছেন? দেখুন, বোধহয় একটুও ভুল বলিনি। ঠিক ল্যাজ-ফোলানো একটা মাথানিচু, শিকার লক্ষ্য করা নেকড়ের মতো নয়? না স্যার, ওটা আমি জীবনে কোনওদিন স্পর্শই করিনি। তবু আমার মিথ্যাচারণের জন্যে ক্ষমা করবেন। কিন্তু ল্যাস-এর অবস্থাটা দেখুন, টেবিলের এদিককার ফাইলটার দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে, যেন তার কুকুরটাকে জেনে-শুনে সে বিষাক্ত খাদ্য দিয়েছে, এবং লক্ষ করছে, সে খায় কিনা। অতএব আমাকে গিয়ে ওর সামনে বসতেই হয়, আর ওর প্রথম কথাই শুনতে পাচ্ছেন: তোমাকে তো আমি বলেইছি, কর্তৃত্ব যখন আমার, তোমার দায়িত্বও আমার। টোটা চ্যাটার্জি যখন তোমাকে আমার হাতে দিয়েছিল, তখন থেকেই তোমার জানা ছিল কিছু রিসক আছে। যদি তোমাকে পুলিশ ধরেও, তা হলে সেটা ননবেলেবল হবে না, তারপরেও অনেক সময় পাওয়া যাবে কাগজপত্র তৈরি করবার; এখন একমাত্র জানা দরকার, ভেতর থেকে কে ব্যাপারটা ফাঁস করেছে।…

তবু আমি সই করতে পারছি না, উসখুস করছি এবং বলতেই হয়, স্যার, ব্যাপারটা টোটাদার কানে গিয়েছে, আপনি তো জানেন, তাঁকে না জানিয়ে আমি কিছু করলে ভীষণ খাপ্পা হয়ে উঠবেন। তা ছাড়া আপনাকে নিয়েও তাঁর ভাবনা, আপনার মতো একজন লোকের নামে নিন্দা রটলে সেটা পার্টির গায়ে লাগবে।

ল্যাস: সেটা ঠিক, আমি টোটার টেলিফোনের জন্যেই অপেক্ষা করছি, তবু এখানকার কোনও কাজে, তোমাকে আমি যা বলব, তাই তোমাকে করতে হবে, এ কথা তুমি জানো?

কী বললেন, আপনার ভয় লাগছে রীতিমতো লোকটাকে? ঘৃণা হচ্ছে, রাগও হচ্ছে। এ রকম জঘন্য গলার স্বর আপনি কখনও শোনেননি? কিন্তু এই শুনুন, আমি কী বলছিঃ তা তো বটেই স্যার, সে বিষয়ে কোনও কথাই থাকতে পারে না। আপনি যদি বলেন, আমি এখুনি সই করে দিতে পারি, কিন্তু তারপরে টোটাদা হয়তো আপনাকে অন্য কোনও ওয়ে-আউট বলবেন, তখন আপনি নিজেই আবার ব্যাক করবার কথা ভাববেন।

এই শুনুন, কীরকম গরগর করে উঠছে, হোন্ড্রউ থিংক? অ্যাম আই এ ফুল? তুমি নিজেকে ফাঁদের বাইরে রাখতে চাইছ, আর আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না, ইজন্ট? নট এ মিনিট মোর, সাইন, আই স্যে।

কিন্তু যাক, টেলিফোনটা বেজে উঠেছে নিশ্চয়ই টোটাদা কী হল, আপনি অ্যাবস্ট্রাক্ট মুগুরটির দিকে তাকাচ্ছেন যে, কী বললেন, কালকের কথা শুনে আপনার ঠিক এ সময়ের কথাটাই মনে হয়েছিল, আমি লোকটাকে মারতে আরম্ভ করলাম? কী বললেন, আমার মুখটা লাল হয়ে উঠেছে, চোখ দুটোও, তবু মোলায়েম হাসিটা ঠিক বজায় আছে? সত্যি, হাসিই পাচ্ছে আপনার কথা শুনে, আমার মুখটা লাল হয়েছে নার্ভাসনেসে, টেনশনে, আপনি যা ভেবে বলছেন, সেই রাগে নয়। যাই হোক, শোনা যাক, কথা কী হচ্ছে। আবার কী জিজ্ঞেস করছেন? টোটা জীবিত কি না? নিশ্চয়ই, নইলে ফোন করবে কেমন করে? ওহ বুঝেছি, আপনি সেই কাগজ কাটা ছুরি দিয়ে ঘাড় বেঁধানোর কথা ভাবছেন। আচ্ছা, সে জবাব আপনাকে আমি পরে দিচ্ছি। হুম, বোঝাই যাচ্ছে, টোটাদার সঙ্গে কথা হচ্ছে, শুনুন না, বাট টোটা ভাই, কেন বুঝতে পারছ না, ব্যাপারটা তুমি যেভাবে বলছ, সেভাবে সারেন্ডার করলে, এখনি করকরে আড়াই লাখ টাকা আমাকে বের করে দিতে হবে। তাই দিতে বলছ? কিন্তু তাতেও কি প্রেস্টিজ থাকছে? অনেকখানি? তবে টাকাটাই থাক, প্রেস্টিজটা কিছু যদি যায় তার চেয়ে পুরোটাই যাক–আহা, রাগ করছ কেন? আচ্ছা আচ্ছা…।

আপনি বোধহয় বুঝতে পারছেন, খুব কাটে কাটে পড়েছে? দেখুন, ল্যাস-এর মুখটা কী ভয়ংকর হয়ে উঠেছে এবং কোনও কথাই আর বলছে না, কেবল রিসিভারটা কানে লাগিয়ে শুনে যাচ্ছে, যার মানে, নেকস্ট প্রসিডিউরের কথা ভাবছে।

যাক, রিসিভার নামিয়েছে, এইবার দেখা যাক, কী বলে। কী বললেন, আমার মুখটা এখন মোম-গলানো মনে হচ্ছে? কারণ আমি বুঝতে পারছি, আমাকে দিয়ে সই করানোটা এই মুহূর্তে স্থগিত রইল, এই যে শুনুন, কী বলে: আচ্ছা, কাগজপত্রগুলো নিয়ে তুমি তোমার ঘরে যাও, আমি পরে দেখছি, বাট এনি হাউ, আজ লাঞ্চ-এর পরে মীমাংসা আমি করব, তাতে টোটা আমাকে যাই বলুক। এটা ঠিক, পঞ্চাশ লক্ষ টাকা দেড় বছরে লাভ হয়েছে, বাট হু দ্যাট সন অব এ বিচ–আই লাইক টু নো, যে সে কথা ফাঁস করেছে বা টোটাকে বলেছে। তুমি বলেছ টোটাকে?

আমি: না স্যার, আমি তো

ল্যাস: অলরাইট গেটআউট নাউ।

আসুন, এবার আমার চেম্বারে চলুন, ম্যানেজারের চেম্বারে। আমি একজন ম্যানেজার, সে কথা তো আগেই আপনাকে বলেছি না? ওই দেখুন, ঢুকতে না ঢুকতেই আমার ঘরে ফোন বাজছে। মনে হয়, টোটাদাই ফোন করেছেন। রিসিভারটা তুলতেই শুনতে পাচ্ছি, আমি টোটা চ্যাটার্জি, ভাকুর সঙ্গে কথা বলতে চাই।

আমি: বলুন টোটাদা, আমি বলছি।

ওপার থেকে, টোটাদা: শোনো, তোমার এ লাইনটা তো ডাইরেক্ট, কোনওরকম ট্যাপ করার পসিবিলিটি নেই?

আমি: না, আপনি নিশ্চিন্তে বলতে পারেন।

আমি টোটাদার কথাগুলো সবই শুনলাম। আমাকে বললেন, আমি যেন সমস্ত কাগজপত্রগুলো, যেগুলোতে চুরি ধরা পড়ার সম্ভাবনা, সেগুলি সহ এখুনি টোটাদার কাছে চলে যাই, তার মানে ল্যাস-এর এই কাগজগুলো আমাকে চুরি করতে বলা হচ্ছে। বুঝতেই পারছেন, আমি কীরকম শাঁখের করাতের তলায় পড়েছি। আমি যার চাকরি করি সেও আমাকে হুকুম করছে, আমার লিডারও হুকুম করছে, আর আপনি জানেন, এরা দুজনেই আমাকে একেবারে হেল করে দিতে পারে। কিন্তু উপায় নেই, তবু আমাকে টোটাদার কাছেই এখন যেতে হবে, কেননা, আমি বুঝতে পারছি, সে-ই আমাকে এখন উদ্ধার করতে পারে। কারণ ল্যাস যে টোটাকে একেবারে এড়িয়ে যেতে পারছেনা, সেটা বুঝতে পারছেন আশা করি। টোটাদা আমাকে বলল, আমি যেন এখুনি আমার বুড়োটিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি, সে আমার জন্যই অপেক্ষা করছে। অতএব, অফিসের ইন্টার কানেক্ট ফোনে ডায়াল করে আমাকে সে কথাটাও ল্যাসকে বলতে হয় কী বললেন? না না, চুরির কথাটা বলব কেন? টোটাদা আমাকে ডেকেছে, সেটা বলতে হবে, তা নইলে খোঁজাখুঁজি করবে। হ্যাঁ, রিসিভারের ভিতর দিয়ে যেন লোকটা আমাকে রিভলবারের গুলি ছুড়ছে, আপনিও নিশ্চয় শুনতে পাচ্ছেন, জানি না টোটা তোমাকে কী বলতে চায়। যাই হোক, শুনেই তুমি চলে আসবে।

আমি: অবকোর্স স্যার।

কী বললেন, আপনি পর্যন্ত নার্ভাস হয়ে পড়ছেন? চলুন দেখি, টোটাদা আবার কী টোটকা দেয় শুনে আসি। এখন যে জড়িবুটিই পাওয়া যাক, উদ্ধার পাওয়া দরকার। বুঝতেই পারছেন, আড়াই লক্ষ টাকা এখুনি দিতে হবে বলে, ল্যাস খেপে উঠেছে। অথচ সত্যি পঞ্চাশ লক্ষ টাকা সে অন্যায়ভাবে রোজগার করেছে, যেটা কিছুতেই জানতে দিতে চাইছে না।…

কেমন লাগছে আমার বুড়োটিকে? বড্ড শব্দ হচ্ছে? তা মশাই বয়স হলে, ওরকম সকলেরই একটু হাঁপ ধরা আর কাশি হয়। ভয় পাচ্ছেন, যে কোনও মুহূর্তেই থেমে যেতে পারে? তার মানে নেমে ঠেলতে হবে বলে ভয় পাচ্ছেন? না, অভয় দিচ্ছি, এখন সেরকম কিছু হবে না, কারণ গতকালই একবার চেক করা হয়েছে। আসুন নামা যাকনা, ওদিকে নয়, এদিকে, হ্যাঁ এই সিঁড়ি দিয়ে উঠব আমরা। কী বললেন, কোনও রাজনৈতিক অফিসে আসেননি? আপনি তো দেখছি পৃথিবীর মধ্যে এখনও একমাত্র নিঝঞ্ঝাটের সুখী লোক। হ্যাঁ, তা অবিশ্যি বলতে পারেন, কটা সাধারণ লোকই বা আর এ সব অফিস-টফিসে আসে। এই যে, এই ঘরনা, তেমন সাজানো গোছানো নয়, মামুলি ঘর, দেখতেই পাচ্ছেন। মশাই, দশজনের পয়সায় কি বেশি কিছু দেখানো যায়? হ্যাঁ, এই-ই টোটাদা এবং আপনি নিজেই দেখতে পাচ্ছেন, লোকটা আমাকে বসতে বলতে পর্যন্ত ভুলে গিয়েছে, যার অর্থ হল মাথার ঠিক নেই। তবে, নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, টোটা চাটুয্যের মাথা এত সহজে খারাপ হবার নয়, টেবিলের ওপর হাতের মুঠি ঘষা খোলা এবং মুঠি পাকানো দেখেই বোঝা যাচ্ছে, প্ল্যান যা ভাঁজা হয়েছে, তা কীভাবে কার্যকরী করা যাবে সেটাই আসল ভাবনা। এবার শুনুন, টোটাদা কী বলছে?

যে দলিলগুলো আনতে বলেছিলাম, এনেছ?

আমি: এনেছি।

টোটা: আচ্ছা, তোমার সঙ্গে শাহ-এর কত বছরের সার্ভিস কনট্রাক্ট হয়েছিল?

হ্যাঁ, প্রশ্নটা শুনে আপনার মতো আমিও একটু অবাক হচ্ছি। বললাম, কুড়ি বছরের।

টোটা: কত বছর হয়েছে আজ পর্যন্ত?

আমি: ন বছর দু মাস।

কী বললেন, আমার চাকরিটা কনট্রাক্টে কেন? ল্যাস-এর ফার্মে যারাই অফিসার হিসাবে আছে, তাদের সকলেরই তাই এবং বেসরকারি, এমনকী সরকারি ফার্মেও বিদেশিদের জন্যে এরকম ব্যবস্থা আপনি দেখতে পাবেন। এতে সুবিধা অসুবিধা দুই-ই আছে। পুরোপুরি সুবিধা আর কীসে কোনও বিষয়েই বা আছে বলুন। শুনুন, টোটা আবার কী বলছে: এখন তুমি কত করে ড্র করছ?

আমি: দেড়হাজার।

টোটা: বছরে কত টাকা করে বাড়ে?

আমি: পঞ্চাশ ফিকসড।

দেখুন, টোটাদা কীরকম হিসেব করতে আরম্ভ করে দিয়েছে, এবং শুনুন, কী বলছে, তার মানে তোমাকে যদি ওর ওখানে আর না রাখে তা হলেও কনট্রাক্ট অনুযায়ী লাখ দুয়েক টাকা নিশ্চিত তোমাকে দিতে হবে। নট এ ব্যাড অ্যামাউন্ট। আমি ভাবছি, যদি ও কোনওরকম গোলমাল করে, তা হলে এর জন্যে তোমাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। আশা করি অমত করবে না?..

টোটাদা ভালই জানে, আমি অমত করব না, অর্থাৎ অমত করার কোনও উপায় নেই আমার, এবং আপনার কি মনে হচ্ছে, লাখ দুয়েক যদি একসঙ্গে পাওয়া যায়, মন্দ কী, না? কিন্তু আপনি একটা বাংলা কথা বোধহয় শুনেছেন, গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল, কারণ বর্তমানে এ সিদ্ধান্তটা টোটা চাটুয্যের, ল্যাস-এর নয়, এবং দু লক্ষ টাকা দিতে হলে, তার আগে ল্যাস আমাকে দু লক্ষ বার ল্যাটরিন ঘুরিয়ে ছাড়বে। আপনি হাসছেন? বড় দুঃখে হাসছেন? তা ঠিক, এ ছাড়া আপনার আর কীই বা করবার আছে। অতএব আমাকে বলতে হয়, অমত করব কেন টোটাদা, আপনি যা বলবেন, আমি তাই করব।

কী বললেন, আমি যেভাবে ল্যাস-এর সঙ্গে কথা বলছিলাম, এখানেও সেভাবেই বলছি? তা ছাড়া আর কীভাবে বলতে পারি বলুন, কারণ আমি এদের হাতেই–আচ্ছা শুনুন, টোটা আবার কী বলছে: শাহ ভেবেছে, ব্যাপারটা থেকে ও ছাড়ান পেয়ে যেতে পারে, একটা গ্রিডি পিগ, জানে না ওকে পর্ক চপ করে ছেড়ে দেওয়া যায়। ইওরোপের যে সব দেশের সঙ্গে বিজনেস করার ব্যাপারে ও আমাদের পার্টির ঘাড়ে চেপেছে, সেগুলো আমরা সব নষ্ট করে দেব, তবে তারপরেও শাহ অন্য কোনও পার্টিতে যাবে, কারণ তা ছাড়া আজকের দিনে আর বিজনেস করা যায় না, সে ব্যাপারেও আমাদের লক্ষ রাখতে হবে। আমাদের কথা ও যখন শুনবে না, কিন্তু কথাটা সেখানে নয়, কথাটা

দেখছেন, টোটা কীরকম থাবা মুঠি করেছে, খুলছে আর টেবলের মোটা কাচের ওপর ঘষছে? তার মানে, আমাকে যে কথাটা বলার, তা এখনও বলা হয়নি, এবং আমার সঙ্গে টোটার সেটাই আসল কথা। অবিশ্যি যে কথা বলবে, তা আপনিও জানেন–হ্যাঁ, ল্যাস-এর স্ক্যান্ডালটা প্রকাশ হয়ে পড়ার পর পার্টির ঘাড়ে যে দুর্নামটা আসবে, এবার সেটা ফেস করতে হবে। আর পার্টির ঘাড়ে দুর্নাম আসা মানেই, পার্টির টোটা-চক্রের বিরুদ্ধে দল এখুনি টোটাকে ছিঁড়ে খাবার জন্যে দাঁত শানিয়ে ছুটে আসবে, কারণ ল্যাস টোটার লোক। এখন টোটার উদ্ধার পাবার সাঁকো একমাত্র আমি, এ জন্যেই সে আমাকে বহুকাল থেকে তৈরি করেছে, যাতে আমি যে সব খানাখন্দগুলোর ওপরে আছি, সেগুলো সে অনায়াসে পেরিয়ে যেতে পারে এবং আপনি শুনতেই পাচ্ছেন টোটাদার আসল কথাটা কী, যা আপনাকে আমি গতকালই বলেছিলাম: পার্টিকে আমার নিজের থেকে কৈফিয়ত দিতে হবে, আমিই ল্যাসকে দলে এনেছিলাম, আমার নিজের দায়িত্বে ও অভিজ্ঞতায় তার মেম্বারশিপ আমি রেকমেন্ড করেছিলাম, যার অর্থ, শুধু পার্টি না, লোকেও জানবে, ল্যাস-স্ক্যান্ডালের মধ্যে আমিও জড়ানো, কারণ পার্টিকে একটা স্টেটমেন্ট তো দিতেই হবে। অর্থাৎ টোটা চাটুয্যে পার্টির ভিতর তার ইজ্জত বাঁচাতে যাচ্ছে, আমার ইজ্জত আর পলেটিকাল কেরিয়ারের মূল্যে।

কী বললেন, আমাকে কাঁদো কাঁদো দেখাচ্ছে? আমাকে ঠিক জাঁতাকলে পড়া ইঁদুরের মতো লাগছে? আপনার কষ্ট হচ্ছে আমার জন্যে! তবু দেখুন, আমি কী রকম হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করছি টোটাদাকে এবং রাজনৈতিক আদর্শের কথা জিজ্ঞেস করায় শুনতে পাচ্ছেন সেই কথা, রাজনৈতিক আদর্শ আর দলের আদর্শ জোড় খাওয়ানো নাকি খুবই কঠিন, যেন রাজনীতি আর রাজনৈতিক দল, দুটো আলাদা, অনেকটা যেন এরকম লাগছে আমার কাছে, ঈশ্বর উপাসনা আর ধর্মীয় অনুষ্ঠান দুটো যেন আলাদা।

কী বললেন, আমার চোখে সত্যি জল এসে পড়েছে? আর আপনি দেখছেন সেই কাগজ কাটা ছুরিটা, আপনার বুকের মধ্যে যেন একটা ভয়ংকর প্রত্যাশা দুরু দুরু করছে? কিন্তু দেখুন, টোটা চাটুয্যে পার্টির কাছে ল্যাস সম্পর্কে আমার বক্তব্যটা নিজেই কেমন টাইপ করে ফেলেছে, এবং কলমসুদ্ধ আমাকে সই করতে দিচ্ছে। কী হল আপনার, অমন করে তাকিয়ে আছেন যে? সই করব কিনা ভাবছেন? নাকি ছুরিটাই তুলব? না, আমি কলমটাই তুললাম, সই করলাম, আর দেখুন, টোটা চাটুয্যে আমাকে কী রকম আদর করছে, এবং বলছে: পার্টি যাতে তোমার ক্রাইসিসটা বোঝে, আমি সেটা নিশ্চয়ই দেখব, তোমাকে যাতে বের করে না দেওয়া হয়, সে দায়িত্ব আমার, আর শাহ যাতে তোমাকে ফাঁকি দিতে না পারে, সেটাও আমি দেখছি। তুমি জেনে রেখে দাও, চাকরি তোমার থাকবেই, যদি না থাকে, কনট্রাক্টের টাকাটা দিতে ওকে আমরা বাধ্য করব। তুমি এখন অফিসে চলে যাও, শাহকে গিয়ে সব বলো, তোমার এই চিঠিটার কথাও বলবে, আর বলবে, কাগজপত্রগুলো আমি রেখে দিলাম, দেখবার জন্যে। তুমি দেখবে, ও ঠিক আড়াই লক্ষ টাকা দিয়ে দেবে, যাতে স্ক্যান্ডালটা অল্পের ওপর দিয়ে যায়, কিন্তু সই তুমি কিছুতেই করবে না…।

ইত্যাদি প্রভৃতি এই কথাগুলো আর শোনার কোনও অর্থ হয় না, কারণ বুঝতেই পারছেন, ল্যাস সম্পর্কে যা বলবার তা আমি এক জায়গায় ইতিমধ্যেই সই করে দিয়েছি, অতএব আর আমার সই করার কিছু নেই। তার চেয়ে চলুন, ল্যাস কী বলে, তাই গিয়ে দেখা যাক।

না না, ও কথাটা আর বলবেন না, আমি বুঝতে পারছি, আমাকে করুণা করা ছাড়া আপনার আর কিছুই থাকছে না, এমনকী আপনি আর আমাকে চিনতেও পারছেন না। যে লোকটাকে কাল আপনি দেখেছিলেন, যার কথা শুনেছিলেন, আমি যেন সে লোকটা নয়। তা ঠিক। একটু ভেবে দেখবেন, অনেক সময় আপনাকেও আপনি চিনতে পারেন না। সত্যি বলতে কী, এখন আমাকে যা দেখছেন, এটাই যে সত্যি, তাই কি বলা যায়? নিজেকে আইডেনটিফাই করা কঠিন ব্যাপার…।

কী বললেন, আমি ড্রাইভিং-এ অত্যন্ত সোবার? তার মানে, আপনি বলতে চাইছেন, কারুকেই ওভারটেক করতে দিতে আমি একটুও এদিক ওদিক করছি না, যেন আমি একটা চোরের মতো গাড়ি চালাচ্ছি। কিন্তু চোর বলবেন না, বলুন, অত্যন্ত নিরীহ ঠাণ্ডা-মাথা-ভদ্রলোকের মতো চালাচ্ছি। দেখছেন তো, আমার সামনের গাড়িটা কী রকম করে চলছে, যেন লোকটা ময়দানের ওপর দিয়ে গাড়িটা চালাচ্ছে, আর গাড়িটা পাগলা হাতির মতো এদিক ওদিক টলছে যেন, ওই দেখুন, পুলিশের হাত উঠে যেতে যেতেই কীভাবে সোঁ করে চলে গেল! কী বললেন, আমিও তো যেতে পারতাম। কিন্তু সেটা ট্রাফিক অ্যান্ড সিভিক সেন্স-এর অভাব হত না? অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে বলছেন? এভাবে ধৈর্যের পরিচয় না দিলে আপনি কী করে গাড়ি নিয়ে শহরে বাস করবেন মশাই। মানছি আপনার কথা, ব্যাপারটা খুবই বিরক্তিকর, বিশেষ করে উদ্বেগের মধ্যে যদি থাকতে হয়–আর আমার তো ধারণা, আমি প্রায় সবসময়েই যেন একটা উদ্বেগের মধ্যে রয়েছি, যে-কোনও বিষয়ে হোক, সবসময়েই যেন একটা টেনশন–তবু কী করব বলুন, সিটিলাইফের একটা নীতি-নিয়ম আছে তো। টেনশন না থাকলে, ভাবনা-চিন্তা না থাকলে, রাস্তার কিছু না হোক, আপনার অনুমতি নিয়ে বলছি, মহিলাদের দিকেও একটু তাকিয়ে দেখা যায়। আপনি তাই দেখতে আরম্ভ করেছেন? কোন মহিলাটিকে? ওই যে যাচ্ছেন? বেশ লাগছে আপনার? তা হ্যাঁ মন্দ কী! কী বললেন, দোলানি–মানে আপনি বোধহয় নিতম্বের কথা–হ্যাঁ হ্যাঁ মশাই জানি, আপনি যাকে পাছা বলছেন, আমি তাকে নিতম্ব বলতে চেয়েছি। ভাতকে অন্ন, বউকে স্ত্রী। তা হ্যাঁ, দোলানি বলতে যা আপনি বোঝাতে চাইছেন, সেই রকম ভাবটা খুবই রয়েছে, তবে ল্যাস-এর মুখটা কী বললেন, মহিলাটি ইচ্ছে করেই ওরকম শোক, পুলিশের হাতটা নেমেছে। দোহাই বাবা, আমার বুড়োটি যেন গোলমাল না করে।…যাক, এসে পড়া গিয়েছে, কিন্তু আমার বুকটা এত দুরু দুরু করছে, ল্যাস হয়তো আমাকে খুঁজছে, কারণ লাঞ্চ আওয়ার পেরিয়ে গিয়েছে।

কী বললেন, আমি বাড়িতে লাঞ্চ খেতে যাব? মাথা খারাপ হয়েছে আপনার? আমাদের অফিসারদের লাঞ্চ অফিসেই দেওয়া হয়, তার জন্যে কনসেশন রেটেই আড়াইশো টাকা কেটে নেওয়া হয়। তা এখন ধরুন প্রায় আড়াইটে বাজে, আর আধঘণ্টার মধ্যে গেলে, লাঞ্চ দেবে, তা নইলে, এক কাপ কফি আর দু পিস স্যান্ডউইচেই আপনাকে সারতে হবে। আমাদের আবার সবই বড় সাহেবি কেতা।…কিন্তু এ কী, বেয়ারাটা দরজায় এভাবে বসে কেন, আমার ঘরের দরজাটাও খোলা। কী ব্যাপার? সর্বনাশ, স্বয়ং ল্যাস আমার ঘরে বসে আছে? চোখ দুটো দেখছেন? এখুনি ঝাঁপিয়ে পড়বে বোধহয় আমার ওপর। কিন্তু না, লোকটা তো দেখছি, মাথা নিচু করে বসেই আছে, হার্টফেলটেল করল না তো? না না, ওই শুনুন, গলার স্বর শোনা যাচ্ছে: তুমি সমস্ত কাগজগুলো টোটার কাছে নিয়ে গেছলে?

দেখুন, আমার চেহারা কী রকম অপরাধী কুকুরের মতো হয়ে গিয়েছে, প্রভুর সামনে দোষ করে ফেলা কুকুরের চেহারা ঠিক এমনিই হয়। আমি না বলে পারি না, আপনি স্যার আমার ওপর।

কিন্তু দেখুন, ল্যাস আমার কথাই শুনতে চাইছে না, অথচ লোকটা চিৎকারও করছে না–যেটা আরও ভয়ের বলে মনে হচ্ছে আমার। একে কী বলে, গ্লোনিং? শুনুন, গোঙানো স্বরে কী রকম বলছে, টোটা আমাকে বললে আমিই দিতে পারতাম, তোমাকে দিয়ে এভাবে চুরি না করালেও পারত।

আমি: স্যার, আমার কথা একটু শুনুন।

ল্যাস: তুমি আমাকে কথা বলতে দাও। তুমি যাই করে থাক, তার আর এখন কোনও এক্সপ্লানেশন চলে না, বিকজ ইট হ্যাঁজ বিন ডান!

উঃ লোকটা কীরকম ভীষণ ঠাণ্ডা গলায় কথা বলছে, সত্যি আমার যেন শিরদাঁড়া কেঁপে গুড়গুঁড়িয়ে উঠছে।

আবার শুনুন: ব্যাঙ্কের সঙ্গে আমার কথা হয়ে গিয়েছে, টাকা রেডি, আড়াই লক্ষ টাকা কোম্পানি থেকে এখনই জমা দাও, আর কাগজপত্রগুলো টোটার কাছ থেকে নিয়ে নতুন করে সব তৈরি করতে বসে যাও, মোটামুটি যা করলে তুমি আমি দুজনেই সই করতে পারি। তারপর তুমি বিকেলে একবার ফ্যাক্টরিতে যাবে, ফ্যাক্টরি ছুটির আগেই, কারণ সেখানে ওয়ার্কারদের কেউ এজিটেট করবার চেষ্টা করছে, আমাদের ডিপার্টমেন্ট নাকি চুরির দায়ে ধরা পড়েছে, অতএব এই সুযোগে তাদের নিয়েও একটা গোলমাল পাকাবার তাল হচ্ছে। আড়াই লক্ষ টাকা জমা পড়লেও মোট বিষয়টা আগামীকাল খবরের কাগজে বেরিয়ে যাচ্ছে, কেননা, কারুরই চেপে যাবার ইচ্ছা নেই দেখছি, কোনও দলের পেপারই আমাকে মদত দেবে না। দেখছি রাতারাতি সবাই ভীষণ দলাদলি ভুলে এক হয়ে গেছে। ঠিক আছে।…তুমি লেগে যাও। তুমি বেরিয়ে আসতেই টোটার সঙ্গে আমার ফোনে সব কথা হয়েছে, তুমি কী লিখে দিয়ে এসেছ, তাও জানি–এনি হাউ, ফেস করতেই হবে।

আপনি দেখতে পাচ্ছেন, ল্যাস আমার দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত, আর কথাগুলো কীরকম গুঙিয়ে গুঙিয়ে ঠাণ্ডাভাবে বলে যাচ্ছে। এ আবার আর একটা টেনশন।

কী বললেন, আপনার মনে হচ্ছে, ল্যাস যেন ভেঙে পড়েছে? এখানেই আপনার সঙ্গে আমার বোঝবার তফাত, কারণ আমার মনে হচ্ছে, বাঘটা তার শিকার ধরবার চক্রটা খুব নিঃশব্দে ঘুরছে, এবং এই চক্র দেবার সময় যদি আর কোনও শিকার তার সামনে পড়ে, তা হলে জানবেন, তাদের সে ছোঁবেও না, একমাত্র আক্রান্ত না হলে। আমার মনে হচ্ছে, ল্যাস ইতিমধ্যে বসে তার টার্গেট ঠিক করেছে, কাকে সে ধরবে। বাঘেদের যেমন জানেন তো, চার-পাঁচজন একসঙ্গে থাকলে, সে সবাইকে একসঙ্গে ধরে না, একজনকে ধরে–যাকে সে আগে থেকেই লক্ষ্য করে, এবং এবার আপনি ভাবুন, বাঘটা যে পিছু নিয়েছে, তা সকলেই জানল, অথচ তারা নিরস্ত্র, এখন কার ওপরে এসে পড়বে, কেউ বলতে পারে না। তার মানে প্রতিটি দিনেই নতুন নতুন উদ্বেগ তৈরি হতে থাকবে।

কী বলছেন, ঘরটা তছনছ হয়ে আছে কেন? কাগজপত্র সব ছড়ানো, আর ডেস্ক খোলা কেন? ল্যাস সব লণ্ডভণ্ড করেছে, কাগজপত্রগুলো সব খুঁজেছে–কিন্তু আমার আর সময় নেই, এখনি ব্যাঙ্কে চলে যেতে হবে। লাঞ্চ? ওটা কখন হয়, পরে দেখতে হবে, আপাতত সময় নেই, চলুন বেরিয়ে পড়া যাক। আপনি তো আজ নিরাকার ব্রহ্ম, সময়ের কাঁটায় বা ক্ষুধা তৃষ্ণা, কোনও কিছুতেই আপনি বাঁধা নেই, অতএব আমাকেই দেখুন।…না, ব্যাঙ্কের ব্যাপারে বা সরকারি অফিসের ব্যাপারে আমার তেমন দুশ্চিন্তার কিছু নেই, এটা অনেকটা কেরানির কাজের মতোই আমি করে যাব। তবে আমি এখন প্রতিনিধি হিসাবেই সবকিছু করে যাব, কারণ ব্যাপারটা গোলমেলে, জটিল আর অনেক টাকার বিষয়।

আসুন, আমরা ব্যাঙ্কে এসে গিয়েছিনা, ওদিকে যাবার কোনও দরকার নেই, সবই বন্ধ হয়ে গিয়েছে, আমাকে এজেন্টের ঘরেই যেতে হবে এবং সেখানেই সব ব্যবস্থা হয়ে আছে। আঃ কী ভাগ্যি দেখেছেন, আমরাও ঢুকলাম, বৃষ্টিও নামল, রাস্তায় আর বৃষ্টিটা পেতে হয়নি। হ্যাঁ, এই যে এজেন্টের ঘর, কিন্তু এখন আর আপনার সঙ্গে আমার কোনও কথা নেই…।

হ্যাঁ, সরকারি অফিসের ব্যাপারটা শেষ হল, এবার আমরা আবার বেরোতে পারি। উঃ চারটে বাজে, তবু এখনও কত কাজ বাকি। কী বললেন? কেন? ভুলে গেলেন, আমাকে এখুনি একবার ফ্যাক্টরিতে যেতে হবে, আর সে ঠিকানাটা কুঁড়ির ঠিক উলটো দিকে, অর্থাৎ আমাকে এখন যেতে হবে, উত্তরের শহরতলিতে। এদিকে রাস্তাটার কী চেহারা হয়েছে দেখেছেন? একেই বোধ হয় দধিকর্দমাক্ত বলে, আর আমার–মাফ করবেন–মনে হয় এই কালো রঙের কাদা মাখানো রাস্তাগুলো ঠিক যেন নর্দমার পাঁকে ডোবা শুয়োরের মতো। তার ওপরে আপনি ভিড়টা দেখছেন তো, গাড়ি আর মানুষের ভিড়, যদি মানুষের ভিড়ের কথা আমি বাদই দিচ্ছি, দেখুন–সাড়ে চার হয়ে গেল আমি এখনও মাত্র বৌবাজারের সিগনালে এসে দাঁড়িয়েছি। আকাশটার অবস্থাও ভাল নয়, মুখ থমথমিয়ে আছে, যে কোনও সময় ঢাললেই হল। কী বললেন, গাড়ির এত ভিড় কেন? নাঃ আপনি দেখছি, সত্যি, এখনও বেশ আছেন–হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনার বক্তব্য আমি বুঝেছি যে, এখনও তো অফিসগুলো সব ছুটি হয়নি, তবু এর মধ্যেই এত গাড়ি আর লোকজনের ভিড় হয়েছে কেন? এই কেনর আপনি কোনও জবাবই পাবেন না, আর যদি তবু আপনি ভাবতে চান, তা হলে দেখবেন, কোনও থই পাচ্ছেন না। এটা কলকাতা মশাই, কলকাতা, সেটা ভুলে যাচ্ছেন। ভুলে যাচ্ছেন, এই শহরের লোকসংখ্যা কত, কত লোক দৈনিক বাইরে থেকে আসছে আর যাচ্ছে এবং এর পরেও আমি জানি না, আপনি হয়তো এ শহরের স্বাস্থ্য সৌষ্ঠব। ইত্যাদির কথাও বলতে আরম্ভ করবেন।….

কী হল, অমন চমকে উঠলেন কেন? ওই গাড়িটার ওভারটেক করার ব্যাপারটা দেখে? এতক্ষণের মধ্যে এই প্রথম দেখলেন নাকি? কী বললেন, আমাকে আপনার সত্যি খুব শান্ত আর ধৈর্যবান বলে মনে হচ্ছে? কী করব বলুন, ট্র্যাফিক সেন্সটা আমাকে ছাড়ছে না শুধু নয়, আমার বুড়োটির কথাও ভাবতে হবে, যদিচ ওর হিম্মতের কোনও তুলনাই নেই, প্রায় মিরাকল করে দিতে পারে, তবু আমি শৃঙ্খলা মেনে চলতেই চাই। এই যে দেখুন না, তিন চাকার টেম্পোটা, যেন আমাকে ধাক্কা মেরেই যেতে চাইছে না কী বললেন? সসালা? সত্যি আপনি খুব সহজ লোক, কিন্তু ওভাবে ওর দিকে কটমট করে তাকাবেন, কারণ হেসে উঠে এমন কিছু আপনাকে বলে উঠতে পারে যে, তাতে আপনি অপমানবোধে ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন। কী বলবে জিজ্ঞেস করছেন? হয়তো আপনার কটমটে চোখ দেখে বলবে, কা সাব, তবিয়ত খারাপ হো গয়া কি লাল পানি পিয়া? হ্যাঁ, লাল পানি মানে মদ, হ্যাঁ, মানে আপনাকে মাতাল বলবে। মনে হচ্ছে, খুবই অসহায় বোধ করছেন। টেম্পোর শব্দটা সহ্য করতে পারছেন না? কলিজায় শিক বেঁধানো শুয়োরের মতো চিৎকার করছে? অনেক দুঃখেও আপনার কথা শুনে না হেসে পারছি না। আপনার বাঁ দিকে, আগে যে বাসটা চলেছে, তার শব্দই বা আপনার কেমন লাগছে। টেম্পোর থেকে ভাল নয় আশা করি। কী হল, নাকে কাপড় দিয়ে আছেন কেন, বাসটার কালো ধোঁয়ার জন্যে? যেন গোটা রাস্তাটা কালো করে দিয়েছে, এবং আমিই বা চালিয়ে যাচ্ছি কেমন করে অনবরত এই ধোঁয়া নাকে নিয়ে? যেতে হবে বলে স্যার, স্রেফ যেতে হবে বলে।

হ্যাঁ, শ্যামবাজারের মোড় এল, পাঁচটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি আছে আর। সাড়ে পাঁচটায় কারখানা ছুটি, আমাকে তার মধ্যেই পৌঁছুতে হবে। তা হলেই বুঝতে পারছেন, এ পর্যন্ত আসতে কতক্ষণ লাগল। কী বলছেন, এবার রাস্তা ফাঁকা পাব, কারণ শহরটা প্রায় পার হয়ে এসেছি বলে? এ রাস্তায় বোধহয় আপনার তেমন চলাফেরা নেই, চলুন, দেখবেন। এই তো দেখুন, ব্রিজ পেরিয়ে এলাম, ফাঁকা দেখছেন কি? চিড়িয়া পেরিয়ে গেলে ফাঁকা পাওয়া যাবে? দেখা যাক।…এই তো আপনার চিড়িয়া মোড়, ফাঁকা দেখতে পাচ্ছেন? কী বললেন, সামনের গাড়িটা কোনওরকমে ওভারটেক করতে পারলেই হয়? বেশ, লাগানো যাক হর্ন। হর্ন-হর্ন–হর্ন…। লোকটাকে কালা ভাবছেন? কিন্তু কানা তো নয়, সামনে একটা আয়না তো আছে। কোনদিকে দিয়ে যাব বলুন, ডান দিক দিয়ে তো অনবরতই গাড়ি আসছে। কী বললেন, সামনের গাড়িটার ওপর আপনার রাগ হচ্ছে, সাইড দিচ্ছে না বলে? গান শুনতে পাচ্ছেন, মানে সামনের গাড়িটায় ট্রানজিস্টারে বাজছে? কী শুনতে পাচ্ছেন, ইউ মাই লাভ মাই বিমবো!? বা চমৎকার! বিমবো মানে জানেন না? আপনাকে নিয়ে আর পারা যাবে না, ল্যাস–মশাইনা না, ওরকম চমকাবেন না, আমার বস নয়, বিমবো মানে খুবসুরত ছুকরি, যদি মাফ করেন, তা হলে সঠিক বাংলা করলে বোধ হয় মাল বলা যায়। খুব হাসছেন যে মশাই, বেশ ভাল লেগেছে, না? আপনি সত্যি বড় ভাল মানুষ।…তবু রাগ হচ্ছে বলছেন? দেখুন হর্ন তত দিচ্ছি। গাড়িতে মেয়ে রয়েছে? তা হবে, কিন্তু পাঁচটা কুড়ি হয়ে গিয়েছে, হর্ন–হর্ন হর্ননাঃ কী করা যায়। লোকে মশাই বোঝে না, বুঝতে চায়। কী বললেন, আমি ঘেমে গিয়েছি খুব? কিন্তু আমার উদ্বেগ তার থেকে অনেক বেশি, ঘামের মতো যদি তা দেখতে পাওয়া যেত, দেখতেন, বানের মতো তা ছুটছে, কারণ পাঁচটা কুড়ি হয়ে গিয়েছে, আর আমার উপায় নেই। দাঁড়ান, একটা চান্স পেয়েছি, ডাইনের ডাউনে লরিটা এখনও একটু দূরে আছে, আমাকে বাধ্য হয়েই রিসক করতে হচ্ছে। কী হল, ভয় পাচ্ছেন নাকি? এত স্পিডে, ভাবছেন, আমার বুড়োটি ভেঙে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়বে? না মশাই, ভয় পাবেন না, ওরকম চোখ করবেন না, আমি ঠিক পার হয়ে যাব। কী হল, আপনার দম বন্ধ হয়ে আসছে কেন, এই তো দেখুন, আমি আমার আগের গাড়িটার সমান সমান এসেছি, দুজনেই সমান চলেছি, কিন্তু আপনার মুখে ঘাম কেন, ভয় কেন এত? এই তো, এই তো পার হয়ে গেলাম…।

ইস! আপনি যেন জীবন ফিরে পেলেন মনে হচ্ছে। কী বললেন, আমি ও গাড়িটাকে ধাক্কা মারব ভেবেছিলেন? আপনি সেই রকম প্রত্যাশাও করেছিলেন? তা অবিশ্যি আমি পারতাম, একটু ছুঁইয়ে দেওয়া মাত্র, এবং আপনাকে আমি গতকাল সেরকম বলেছিলাম, কিন্তু কেন দিলাম না, সে কথা পরে বলছি।…আপাতত ফ্যাক্টরি এসে গেছে, শ্রমিকরা কারখানা ঘর থেকে বেরিয়ে আসবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। ওই দেখুন, ইতিমধ্যেই গোটা কয়েক পোস্টার পড়ে গিয়েছে, কোম্পানিকে গালাগাল দিয়ে, তার মানে আগামীকাল থেকেই একটা গোলমাল পাকাবার সম্ভাবনা আছে। গাড়ি থামিয়ে আমি সোজা কারখানা ঘরেই যাব এবং সেখানেই সবাইকে দাঁড় করিয়ে, ল্যাস এবং কোম্পানি যে একটি বোয়া বেলপাতা, এটা পাঁচ-সাত মিনিটেই বুঝিয়ে বলে আসব। শত হলেও, আমি ম্যানেজার সাহেব, ল্যাস-এর একটা রাজনৈতিক আদর্শ আছে, নিতান্ত শত্রুপক্ষের ষড়যন্ত্রেই এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে, সুতরাং তারা যেন মনে না করে, কোম্পানি কোনও প্যাঁচে পড়েছে, অতএব এই তালে নিজেদের আন্দোলন শুরু করবে। তাদের বোঝা উচিত, এটা একটা টাকাখোরের কোম্পানি নয়–ইত্যাদি এ সব বলেই আমি আসছি, আপনি একটু ধৈর্য ধরে বসুন।

যাক, এ পর্যন্ত মিটল, মনে হয় তোকগুলো কনভিন্সড, কেননা শত হলেও জানে তো, আমিও একজন রাজনীতি করা লোক। কী বললেন, আগামীকাল যখন খবরের কাগজে সব বেরোবে? আবার আগামীকাল এসে সব বলব, এবং বোঝাব, কারণ আমাকে সবকিছুই করতে হয়। কিন্তু পার্টি এবং ল্যাস-এর দিক থেকে আসলে কোনও উদ্বেগই আমার কাটল না, নতুন করে সব বাড়বেই, কারণ নতুন নতুন সমস্যা দেখা দিচ্ছে। কী বললেন, তবু আমাকে যেন খানিকটা রিলিভড মনে হচ্ছে? বোধহয় এই মুহূর্তের কাজটা সেরে ফেলতে পারার জন্যে, কিন্তু দেখুন, আকাশটা, তার সঙ্গে এই ঘনিয়ে আসা রাত্রি, এবং ভিড়, অথচ আমাকে এখন যেতে হবে অনেকখানি রাস্তা। আমার বুড়োটির জান আছে, কী বলেন। মনে হয় আদর করি। হ্যাঁ, চলুন, এবার সার্কুলার রোড ধরে যাই। কটা বেজেছে বলুন তো? সাড়ে ছটা?..আমাকে হঠাৎ খুব ব্যস্ত বলে মনে হচ্ছে? কী বললেন, শুধু ব্যস্ত নয়, আরও কিছু? কী বলুন তো? বোঝাতে পারছেন না, অথচ মনে হচ্ছে, আমার এখনকার ছোটার চেহারাটা যেন অন্যরকম? আপনি আমার ঠোঁট নড়ে উঠতে দেখেছেন, যেন আপন মনে কথা বলছি। কিন্তু একী, একী বুড়ো! আমার বুড়ো একী করছে দেখুন তো, কী রকম একটা অদ্ভুত শব্দ করছে। যাক, সত্যি আপাতত বুড়ো বসে পড়ল। ইস! দেখি নেমে একটু ঠেলি। না না, খুলে দেখে কিছুই হবে না, তেলটেল সবই আছে, আসলে আজকের ধকলটা একটু বেশি গিয়েছে। ওই দেখুন, খাতা হাতে ট্রাফিক পুলিশ এসে উপস্থিত, গাড়ি এখানে রাখতে দেবে না, কিন্তু এখন আমার উপায় নেই যে এক মুহূর্ত দাঁড়াই হ্যাঁ, যদি বলেন, মরবার মতো একটা যন্ত্রণা যেন আমাকে গ্রাস করতে আসছে, আর আমি বাঁচবার জন্যে যেন অস্থির হয়ে উঠেছি, তা হলে বলতে হয়, আমার অবস্থা এখন সেই রকমই।

কী বললেন, কী গুঁজে দিলাম আমি পুলিশটার হাতে? মানে আপনি ঘুষের কথা বলছেন, যাতে পয়সা নিয়ে সে আমার গাড়িটার নাম্বার না নেয়? ছি ছি, এরা কি কখনও মশাই ঘুষ খায়, কী যে বলেন। আসলে আমি ওর হাত ধরে অনুরোধ করেছিলাম–আরে মশাই হাসছেন কেন, পকেটে হাত ঢোকাতে দেখেছেন? সে তো মশাই রুমালে হাতটা মুছে নেবার জন্যে, যাতে ময়লা হাতটা না মেলাতে হয়, এদের সম্পর্কে ওরকম ভাববেন না।

কী বলছেন, ছুটছি কেন? আপাতত তো বলেই দিয়েছি আপনাকে, যেন বাঁচতে, যেন বাঁচতে, হ্যাঁ প্রায় মরবার মতোই একটা কষ্ট বোধ করছি, তাই-উঃ দেখেছেন কী ভিড়। জলকাদা, খানা-খন্দ, কম আলো, তার ওপরে ভিড়। কী বললেন, আমি যেন কাত হয়ে কুঁজো হয়ে অনেকটা হাস্যকর ভাবে চলেছি? হাসতে পারেন, জানি আমি যখন এভাবে ছুটি তখন আমাকে হাস্যকরই দেখায়, তবু-আঃ দেখেছেন, এইসব মহিলার কাণ্ড, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেনা ঝাঁটা চুপড়ির গল্প করছেন, আর এই শ্রীমানেরা দেখুন, এই ভিড়ের মধ্যেই ওই ফুটের মেয়েটির শরীর নিয়ে আলোচনা করছে, আবার দেখুন গানও ধরেছে, সেই এই চাঁদেলি রাতে হাসছেন, হাসুন, কিন্তু আমাকে দেখে আবার করুণাও হচ্ছে? ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ। দেখুন দেখুন, দুরস্ত ভদ্রলোকটি কী রকম নাক ঝাড়তে ঝাড়তে চলেছেন। আমার গায়ে যে সিকনি লাগতে পারে, সে খেয়াল নেই, যেন গোটা রাস্তাটা ওর বাড়ির বাথরুম। কিন্তু এই বুড়ো ভদ্রলোকটি কি সত্যি আমাকে যেতে দেবেন না? ছাতাটা গোটাচ্ছেন না কেন? কেন কেন– একী, আবার আপনার চোখে সেই দমবন্ধ ভয় ফুটে উঠেছে, আপনার চোখে প্রত্যাশা। না ভয় নেই, এই দেখুন ফুটপাতের নীচেই এক হাঁটু অবধি কাদায় পা ডুবিয়ে বুড়ো ভদ্রলোকের পাশ দিয়ে চলে এসেছি। তবু ওঁর গায়ে একটুও লাগেনি। যদিচ গতকাল আপনাকে বলেছিলাম, আমি এভাবে চলতে গিয়ে এক অজানা লোককে মেরে ফেলেছি। ফেলিনি, বা ফেলি না, দেখতেই পাচ্ছেন। কেন মেরে ফেলিনি, সে কথা আপনাকে আমি পরে বলছি। আমার পা-টা খুব নোংরা হয়ে গিয়েছে বলছেন? কী করব বলুন, তা ছাড়া আর আমার কী উপায় ছিল।

কী হল, দাঁড়ালেন কেন, বাড়িটা অচেনা লাগছে? অন্ধকার গলির মধ্যে এই ধূসর রঙের বাড়িটাকে আপনার কীরকম যেন অশুভ ছায়ায় ভরা আর নিরানন্দময় মনে হচ্ছে?…হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিকই দেখেছেন, বাড়িটার রং গাঢ় ধূসর বর্ণেরই। কারণ একটু সস্তাতেই প্রলেপটা দিতে হয়েছে। যে কারণে একটা বর্ষাতেই অনেকখানি ধুয়ে গিয়েছে এবং পুরনো ইট বেরিয়ে পড়েছে। আর পুরনো ইটের শ্যাওলাও ফুটে উঠেছে। হয়তো তাই, বাড়িটাকে দেখে অশুভ ছায়ায় ঘেরা নিরানন্দময় বলেই মনে হচ্ছে এবং হ্যাঁ, সত্যি এখানে আসবার জন্যেই আমি বাঁচবার মতো ছুটে এসেছি। আসুন, এই দিক দিয়ে আসুন, দেখবেন, অন্ধকারে পড়ে যাবেন না। বাড়িটার মধ্যে অনেকগুলো গলিখুঁজি আছে, সেকালের পুরনো বাড়ি কিনা। না, এই অংশটা প্রায় ব্যবহার করাই হয় না। এদিকটাকে বাইরের বাড়িই বলা যায়। যদিচ, আগেকার দিনে বাইরের বাড়ি যেভাবে ব্যবহার করা হত, এখন আর সে সব আদবকায়দা অবস্থা কোনওটাই এ বাড়ির নেই। সময়ের সঙ্গে এ বাড়িরও অনেক বদল হয়েছে।

এইবার আলো, এদিকেই পরিবারের লোকজন থাকে। এই যে দুজন তিরিশের ঘরের মহিলাকে দেখছেন, এরা এ বাড়ির মেয়ে আর হ্যাঁ, ওই ইজিচেয়ারে বসে নিভে যাওয়া সিগার মুখে দিয়ে বসে আছেন প্রৌঢ় ভদ্রলোক, উনি বাড়ির কর্তা। আর কাউকে বিশেষ দেখা পাবার আশা করবেন না, বাকি তিনজন নিশ্চয় এখন বাড়ির বাইরে কী বললেন, বুঝতে পারছেন কাদের বাড়িটা কুঁড়িদের? ঠিকই বুঝেছেন কী হল, অমন করে তাকিয়ে আছেন কেন। ভাবছেন কুঁড়ি কোথায়। আর এ পরিবেশটাই বা কেমন যেন ছন্নছাড়া এবং আপনার চোখে এমন একটা সন্দেহ দেখতে পাচ্ছি, যেন শেষ মুহূর্তে আপনাকে আমি সত্যি একটা খুনের বাস্তব সংবাদ শোনাব?…আচ্ছা সে কথাটা বলছি। তার আগে, এরা কুঁড়ির দিদি, বুঝতেই পারছেন। যাদের হাসির মধ্যে কোনও অভ্যর্থনা দূরে থাক, একটা যেন অ্যাসিডিটিই আছে, অবিশ্যি যদি হাসির মধ্যেও অ্যাসিডিটি থাকা সম্ভব হয়, কারণ এরা যে আমাকে পছন্দ করে না, তা আপনাকে আগেই বলেছি। গৃহকর্তা আমার সঙ্গেই চাকরি করেন। তাও আপনাকে বলেছি এবং তিনি আমাকে বিশ্বাস করেন, যেটা বলতে গেলে, একদিক থেকে মর্মন্তুদ। কারণ আমি কুঁড়ির কথা ভেবেই বলছি, কুঁড়ির সঙ্গে আমার প্রেম হওয়ার কথাই বলছি, যে ব্যাপারে আমি অত্যন্ত অসহায়ভাবেই ওঁর বিশ্বাসের অমর্যাদা করেছি–অথচ হওয়ার বিষয়ের একটা অমোঘ নিয়তির কথাও আপনাকে আমি বলেছি-কী বললেন? বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে, আমি তো ত্যাগ করলেই পারি? আপনি সেই সহজ কথাটাই বললেন, করা আর ছাড়া বা ধরা আর ছাড়া, কিন্তু আপনাকে তো আমি আগেই বলেছি। সমাজের এই সহজ নিয়মটাই আমার মুখে পদাঘাত করেছে, সে আমাকে কিছুতেই তা আয়ত্তে আনতে দিল না এবং এর পরে আপনি আমাকে আত্মসুখবাদী বলবেন। অর্থাৎ, আমার ওই সব, হওয়া বা অসহায়তা বা অমোঘ নিয়তি এ সবই আপনার একটি খোঁচায় ভাসিয়ে দিতে চাইবেন কী বললেন, চাইবেন না? আহা, তবু আমাকে বলতেই দিন না, কেননা আপনার চোখের দৃষ্টিতে আমি স্পষ্টতা দেখতে পাইনি। যদিচ আগেই বলেছি, কোনও বিষয়েই আপনার সমর্থন আদায়ের চেষ্টাই আমি করব না। কারণ জানি, সমর্থন কখনও আদায় করা যায় না, ওটা কাজের দ্বারাই একমাত্র পাওয়া যায়। আপনাকে আমি আগেই বলেছিলাম, কুঁড়ির সঙ্গে এই প্রেম হওয়াটা কোনও সুখের বিষয় নয়, আমরা সমাজের মানুষেরা যাকে সুখ বলি, কারণ ব্যক্তিগতভাবে আমি সুখে বিশ্বাসী নই। কারণ সুখ কী, আমি আজও তা অনুভব করতে পারিনি। বরং যারা ধরা ছাড়ার মধ্যে থাকে, তাদেরই সুখ আছে। কারণ তারা সুখের কথা ভেবেই সেটা করে, সংকটকে পার হবার জন্যেই করে। তারা বলে, সুখে থাকতে ভূতে কিলোয় যে কারণে তারা অসহায়তাকে বিশ্বাস করতে চায় না, তাদের ধারণা, তারা সবই পারে। এখনও পর্যন্ত আমাদের এ কথাগুলো সামাজিক দিক থেকেই হচ্ছে এবং মানুষ দুজনের কথা আগেই আপনাকে বলেছি। অর্থাৎ আমার আর কুঁড়ির কথা এবং সেই মানুষের দিক থেকেই আপনাকে আমি একটা জবাবই দিতে পারি যেখানে এসে ঠেকেছি, সেখান থেকে এই মনে হয়। আমার হওয়ার মধ্যে কোথায় একটা জমাট আর ছড়ানো পাথরের মধ্যে চোঁয়ানো জলের ধারা আছে। কিংবা ধরুন, যে অন্ধকারের কোনও শেষ নেই বলে মনে হয়, তার মধ্যে কোথাও একটা জোনাকির সামান্য আলো–হ্যাঁ, মুক্তি বলবেন কিনা জানি না, কারণ মুক্তিই বা কাকে বলে, তা বুঝি না। তবু, এই যে ব্যক্তি আর সমাজের মাঝখানে গোলমালটার কথা আপনাকে আমি বলছি, জানবেন, এটা আমাকে সবসময়েই খোঁচাচ্ছে, যে কারণে কুঁড়ির বাবার বিশ্বাসের অমর্যাদাটা আমাকে বিধে থাকে।

কী বললেন, অনেকটা যেন বুঝতে পারলেন? ধরুন না কেন, আপনার স্ত্রীর কথা, সেই ডাগর চোখ, পবিত্র মুখ…না না, ঠাট্টা করে বলছি না, বা আপনাকে কষ্ট দেবার জন্যেও নয়। আমি বলছি, সমাজ তো আপনাকে ত্যাগ করতেই বলবে আপনার স্ত্রীকে। আর সেটাই তো সবথেকে সহজ। তবু আপনি তা পারছেন না। কারণ আপনার মনটা সমাজ নয়। ব্যক্তি এখানে এমনই অসহায়-না না, মুখখানি ওরকম ভার করবেন না, তা হলে আমি সে প্রসঙ্গ ত্যাগ করছি। আসলে এই যে আপনার মুখখানি, এই মুখখানিই ব্যক্তি, সমাজের নির্দেশ সে মানতে পারছে না, কারণ আপনি সব জেনেও স্ত্রীটিকে বেবাক দিয়ে বসে আছেন, আর সেই বেবাকের এক কণাও সমাজ দিতে পারে না। সে কেবল ফতোয়া দেয়। আঃ, আবার আপনার মুখটা কেমন হয়ে যাচ্ছে। তার চেয়ে কুঁড়ির বাবার সঙ্গে অফিসের বিষয় একটু কথা বলে নিই–আর একটুই বাকি আছে।

কী হল, কাকে দেখছেন আপনি? হ্যাঁ হ্যাঁ, এই মেয়েটিই কুঁড়ি। মোটেই ইমপ্রেসড হলেন না দেখছি। কিন্তু সে কথা আপনাকে আগেই বলেছি, বাছাবাছির বিচারটা এখানে আনবেন না কী বললেন, এর খুনের বিষয়টাও মিথ্যা? হ্যাঁ, ওকে যখন দেখতে পাচ্ছেন, জীবিতই বেরিয়ে এল, আমার দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেল তার মানে রাগ-হয়েছে, কারণ আমার আসতে দেরি হয়েছে, অবিশ্যি যদিচ ওটা রাগ নয়, আপনি জানেন, আমরা কেবল রাগই দেখি, নিজের বেলায় বিচার করলেই দেখা যায়, ওটা একটা কষ্টই হোক, ওকে আমি খুন করিনি কেন সে কথা আপনাকে আমি পরে বলছি।

আসুন, কোটির প্রতিভূ, নিরাকার ব্রহ্ম–হাসবেন না–আমরা কুঁড়ির কাছে যাই।…না, এ ঘরে না, ও ঘরে না, সে ঘরে না, এই অশুভ ছায়াঘেরা নিরানন্দময় বাড়িটার মধ্যে আরও দু-একটা অন্ধকার স্তর আপনাকে পার হতে হবে–হ্যাঁ এই ভাঙা এবড়োখেবড়ো চত্বরটা, এককালে বাগান ছিল। এখন হয়তো সাপেরাই আছে কী হল? ভয় পেলেন? সাপ কি খালি এখানেই থাকে মশাই, আমাদের জীবনের আর ক্ষেত্রগুলো বুঝি সব একেবারে ভয়ডরহীন পরিষ্কার? আসুন, ভয় নেই, ওই বাড়িটায় আমরা যাব, ওটাও এ বাড়িরই একটা অংশ, কুঁড়ি ওখানেই কোনও ঘরে আছে। এই যে, এ ঘরে আছে, আলো অল্প হলেও, নিশ্চয়ই কুঁড়িকে দেখতে পাচ্ছেন, ও এখন আমার দিকে তাকিয়ে বসে আছে।

কী বললেন, অভিমান দেখতে পাচ্ছেন? কী বললেন, অভিমান চলে গিয়ে, একটা যেন জিজ্ঞাসা মাত্র ওর ভুরুতে ফুটে উঠতে দেখছেন? তাও আর দেখছেন না? কেবল চোখ দুটো টলটলিয়ে উঠতে দেখছেন এবং তার সঙ্গে একটু হাসিও? কী বলছেন, আমরা কেউ কথা বলছি না কেন? কী কথা বলব বলুন তো। কী দেখছেন অমন করে আমার দিকে। আমার মুখের চেহারা একেবারে বদলে গিয়েছে। বলছেন, না? আমাকে যেন আর চিনতেই পারছেন না? সারাদিনের কোনও ছায়াই আর আমার মুখে নেই? আপনার যেন মনে হচ্ছে, আমরা দুজনে অনেক কথা বলে চলেছি, অথচ তা শোনা যাচ্ছে না?…

আপনার অনুমতি নিয়ে আমি ওর কাছে হাঁটু গেড়ে একটু বসছি, এবং আমি যে চোখ নামাতে পারছি, তার জন্যে মাফ করবেন। হ্যাঁ, এভাবেই ও আমার মাথায় হাত রাখে এবং আমি ওর কোলে হাত রাখি। তারপরে আপনি যাকে চুম্বন বলতে ভালবাসেন, আমি যাকে মুখ ডোবানো বলতে চাই কী বললেন, আপনি যেন একটা একতারার শব্দ শুনতে পাচ্ছেন এখন, আর আমাকে দেখে আপনার ভীষণ করুণ বোধ হচ্ছে। কী বললেন, কেন আমার চোখে জল আসছে? আপনি জানতে চান, কী আমি পাই না, কী যেন রয়ে যায়? আমার মধ্যে একটা অবুঝ শিশুকে আপনি দেখতে পাচ্ছেন, যে অস্থির হয়ে উঠছে, যেন সে কী পেতে চায়, জানে না।…

কী হল, আপনার চোখে এত ভয় কীসের? ওর গলায় আমার হাত পড়েছে, আর হাত দুটো যেন সাঁড়াশি হয়ে উঠতে চাইছে বলে আপনার মনে হচ্ছে, অথচ জিজ্ঞেস করছেন, কেন, কেন, কী পাই না, কী হয়ে যায়? আমি বলতে পারছি না, বিশ্বাস করুন–বিশ্বাস করুন–আমি বলতে পারছি না, তবু আপনি ভয় পাচ্ছেন–অথচ আমাদের যাকে বলে আত্মহারা অবস্থাটা যেন আপনার কাছে স্বপ্নের মতো লাগছে। কিন্তু ভয় পাবেন না। হে নিরাকার ব্রহ্ম, আপনার দৃষ্টি সর্বত্রই অবারিত, অতএব আমাদের দুজনের এই নগ্নতা নিশ্চয়ই আপনাকে কোনওরকম বিচলিত করছে না। না, কাজ মেটাবার জন্যে যেখানে যতটুকু খোলা দরকার, সেরকম একটা বিনা টিকিটের যাত্রীর মতো, কোনওরকমে পাদানিতে ঝুলে গন্তব্যে যেতে আমি অভ্যস্ত নই। এখন এই নগ্নতাই কি আপনার কাছে সব থেকে স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না? এ সময়ে আমার কী মনে হয় জানেন? মনে হয়, এখনও আমরা সব সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হইনি, এখনও আমরা জীবের মতো আচরণ করতে পারি, মানুষের মধ্যে যে জীব বাস করে, সেটা আমরা এখনও ভুলিনি। কখনও কখনও আমরা স্বভাবের মধ্যেই থাকি। নিশ্চয়ই এ কথা বলবেন, সারাদিন আমাকে যা করতে দেখেছেন, যেভাবে দেখেছেন, সে সবই মানুষিক, আর এ সময়ে এই আমি অমানুষিক। কী বললেন, সকাল থেকে সমস্ত ব্যাপারটা বরং আপনার কাছে কপটতা প্রবঞ্চনা ইতরতা অমানুষিক মনে হয়েছে? তার জন্যে এ কথা নিশ্চয়ই বলবেন না, এই দুজন উলঙ্গ নারী-পুরুষই একমাত্র স্বাভাবিক। হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি, আপনি বলতে চাইছেন, এই লোকটাই সহজ, এতক্ষণে এই একটিমাত্র আচরণকেই আপনার স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। তবু তবু বলব, আমাদের এই শৃঙ্গারের আচরণগুলোর কথা ছেড়ে দিন, এর দ্বারা সঠিক কিছুই বিচার করা যায় না, একটা কান্না না রাগ, কিছু একটা আমার মধ্যে ঘোলাচ্ছে। কী বললেন, আপনার চোখে আমাদের দুজনকেই যেন করুণ মনে হচ্ছে? দুটো অভিশপ্ত আর অসহায় প্রাণী যেন পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আছে? অথচ এ দৃশ্যে আপনার তো বেশ রসিয়ে উলসে ওঠারই কথা, তা আপনার হচ্ছে না। তার মানে, আপনি এখানেও সুখের সন্ধান পেলেন না। সে কথা তত আপনাকে আমি আগেই বলেছি, সুখ কাকে বলে আমি জানি না। অথচ কাউকে জিজ্ঞেস করুন, সে এই সুখের মাপকাঠিতেই আপনাকে বিচার করবে। এবং জেনে রাখুন, আমাদের সবাইকেই এ সময়ে এরকমই দেখায়।…কী হল, তবু ভয় পাচ্ছেন, কুঁড়ির গলায় আমার হাত চেপে বসবে? দেখুন, আমার হাত এখন ওর বুকে এলিয়ে পড়ে আছে, একতারায় আগুনের ঝংকার বাজেনি– বাজেনি।

অস্বীকার

রাতটা ভেজা ভেজা লাগছে বটে। তবু দেখুন, আকাশে তারা ফুটেছে, আর তারাগুলোকে যেন জীবন্ত মনে হচ্ছে। তাই না! যেন ধোয়া আকাশে তারারা, অনেকটা বর্ষায় ভেজা দুর্গত মানুষদের মতোই, শুকনো জায়গায় এসে বেশ হাসিখুশি করে জটলা করছে। পুবের বাতাস কিছুটা আসছে, হয়তো আবার শেষরাত্রে জল আসবে, তবু এখন যেন অনেকটা ঝরঝরে লাগছে। রাস্তায় তেমন লোকজন নেই, সকলেই সমাজে সংসারে ফিরে গিয়েছে। আপনি কিন্তু অনেকক্ষণ কোনও কথাই বলছেন নাকী বললেন, কী বলবেন ভাবছেন? আপাতত কোথায় যাচ্ছি জিজ্ঞেস করছেন? মোটরের কারখানায়। ওদের চাবিটা দিয়ে আসি, বলে আসি, ওরা যেন কাল সকালে গাড়িটা ওখান থেকে লোজন দিয়ে নিয়ে এসে সারায়।

এই তো এসে গিয়েছে সেই কারখানা।…চলুন এবার। আপনার যদি আপত্তি না থাকে, চলুন না, হাঁটতে থাকি এবং হাঁটতে হাঁটতে আমরা পশ্চিমে, গঙ্গার ধার অবধি চলে যেতে পারি। লেকের দিকে যেতে চান? তাই চলুন, গঙ্গা একটু দুরেই পড়বে, তবে কেন জানি না, মনে হচ্ছে, রাত্রি যতই হোক, এবার একটু ঘাসে যাওয়া যাক সবুজে এবং জলের ধারে।…শরৎকাল তো এল বলে, গাছ আর তার পাতাগুলো দেখে এখনও বোঝা যায় না, সামনে শুকনোর সময়। কী ভেবে বললাম কথাটা? কিছু না ভেবেই, কিংবা হয়তো ধরুন, লেকের ধারে এই সব ম্যাসিভ, পাতায় ভরা গাছগুলোকে দেখে, তাদের ন্যাড়া ছবিটা আমার চোখে ভেসে উঠেছে। কিন্তু, আপনি এতটা চুপচাপ কেন? কী বললেন, একটা অদ্ভুত কথা আপনার বলতে ইচ্ছা করছে? বলুন না, শুনি।

কী কী বললেন, আপনার যেন মনে হয়েছে, আপনি যেন আপনার স্ত্রীকে অনেকবার মেরে ফেলেছেন? এবং আরও অনেককে? এ কথা আপনার কেন মনে হয়েছে, তা আপনি জানেন না?

আমার ধারণা, সেটা তো খুব সহজ কথা, কারণ আপনি ক্রুদ্ধ, অসুখী এবং বঞ্চিত এবং যে পাপের জন্যে এই সব অবস্থা আপনার ঘটেছে, সেই পাপকে আপনি খুঁজে দেখতে চান না। আসলে, আমার কথাগুলো তাই-ই। আপনাকে যা বলছি, আমিও তাই এবং পাপের বিবরে বাসা বাঁধার রীতিই এই যাকে পরাজিত আর পরাধীন বলতে চাই আমি, সে কেবলি অপরের গলায় হাত দিতে যায়, কারণ নিজের গলাটাকেই সে একমাত্র গলা মনে করেছে, সেখানে সে হাত দিতে চায় না।

কী বললেন, ব্যাপারটা ঠিক পরিষ্কার হল না? আমি বলতে চাইছি, কাউকে কাউকে হত্যা করলেই, পাপের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। কারণ আমিও সমানভাবেই পাপের অংশীদার এবং সমানভাবেই দায়িত্বজ্ঞানহীনও বটে। আমি আপনাকে স্বীকারোক্তির নাম করে প্রথমেই যে কথাগুলো বলেছি, সেগুলো নিশ্চয়ই পাপের কথা, এবং আমি কখনও হাত চালিয়ে, ডাণ্ডা মেরে বা ছুরি মেরে বা ধাক্কা মেরে সেইসব পাপের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে চেয়েছি। কিন্তু আপনি সারাদিন ধরে আমাকে দেখলেন, আর তাতে পরিষ্কারই দেখা যাচ্ছে, আমিও সেই পাপের মধ্যেই বাস করি, আমি তার সমান অংশীদার, পাপ সাম্যবাদী বলতে পারেন, আমরা সকলেই সমানভাবে পাপকে ভাগ করে নিয়েছি। যে কারণে আমার মনে হয়, আমরা যখন কাউকে পাপী বলে আঙুল তুলে দেখাই যে, এই পাপীটার জন্যেই এত অশুভ ঘটনা ঘটছে, তখন ভেবে দেখি না, এতে আমার পাপও আছে, কারণ পাপ দূর করার জন্যে আমি দায়িত্ব পালন করিনি। অবিশ্যি আমি জানি না, দায়িত্বকেই শেষ কথা বলব কি না।

কী বললেন, সেই দায়িত্বটার চেহারা কেমন? তা যদি বলতে পারতাম, এই রাত্রে এভাবে লেকের ধারে এসে বসতাম না, কারণ আপনার বুঝতে পারা উচিত, আমি কী রকম ভীরু আর অসহায়ের মতো জীবনধারণ করি, যেটা আর যাই হোক দায়িত্ববোধের জন্যে যে লড়াইটা করা দরকার, স্বাধীনতার লড়াই যাকে বলে, দয়া করে মিছিলের কথা ভাববেন না, আমি বলছি আমার নিজের পরাধীনতার সঙ্গে যে লড়াই, যার উলটো দিকেই আমি মাথা ঢুকিয়ে এই জীবনটা যাপন করছি, অতএব আমি কেমন করেই বা আপনাকে সেই দায়িত্ববোধের ওষুধটা বলে দেব।

আচ্ছা, আমি বরং আপনাকে আমার অবস্থা দিয়েই বলি, এত কথার পর আপনি নিশ্চয়ই আমাকে একটি ন্যাকা মনে করেননি, অতএব ল্যাস কিংবা টোটা, এদের সঙ্গে যে সব ক্রাইসিসের মধ্যে আমি জড়িয়ে পড়েছি, তার কারণগুলো কী বলে আপনার মনে হয়? আমি কি সত্যি জনসাধারণের জন্যে রাজনীতি করতে চেয়েছিলাম, না দল এবং ব্যক্তির চিন্তা আমার মাথায় ছিল?

না না, আমি বুঝতে পারিনি বা ঠকেছি, ও সব কথা ছেড়ে দিন, তা হলে আজ অবধি, সারাদিন আমি যা করেছি, তা করতাম না, এমনকী টোটার কাগজেও সই করতাম না। আর যদি এ কথাই আমি বলি, ওহো, আমি বুঝতে পারিনি, তা হলে তার একমাত্র জবাব তা হলে মরো। বুঝতে পারব না, মরবও না, তা তো হতে পারে না। তবে আমি সে কথা বলব না, আমি বলব, এই পৃথিবীতে বাস করার জন্যে আর এই পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে, এই রাজনীতিতেই এসেছিলাম, যার পরিণাম হল, আমিও পাপের অংশীদার এবং তা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত, এখনও। প্রথম যখন রাজনীতি করতে এসেছিলাম, তখন তো এসেছিলাম, একটা রোমান্টিক আইডিয়া নিয়ে। তখন জনতার জন্যে, জীবন বিসর্জন দেব, এইসব ধারণা ছিল। কিন্তু নিজের কথাটা তো একবারও ভাবিনি। যতই নিজের কথা ভাবতে লাগলাম, অর্থাৎ ভাবতেই হল, তখন দেখলাম, জনসাধারণ থেকে আমি অনেক দুরে, যদিচ রাজনীতি করতে হলে জনসাধারণের কথাটা আপনাকে সবসময়ে মুখের বুলি করে রাখতে হবে। আসলে আমি তখন একটা মেশিনারির মধ্যে, একটা বিশেষ পার্টস হিসেবে কাজ করে চলেছি। জনতার দুর্ভোগ সমানই থাকছে, কিন্তু আমি গাল-ভারী কথা বলে যাচ্ছি, মূল গানের ধুয়ার মতো ব্যাপারটা। আমার মুখের বুলি দিয়ে নিশ্চয় আমার বিচার হবে না, কাজকর্ম দেখেই বলতে হবে, আমি প্রতিক্রিয়াশীল কি না। সেই হিসাবে বলতে পারি, আমি একটি বিশেষ ঘুঘু। জনসাধারণের জন্যে কাজ করতে গেলে যে সব দুঃখ আর যন্ত্রণা পেতে হবে, সে সম্বন্ধে আমি ভয় পাই, তাই ও সব আমি সযত্নেই এড়িয়ে গিয়েছি। আমার মতো অনেক ভীরু মিথ্যুকদের কথা আপনি প্রায়ই খবরের কাগজে দেখতে পাবেন। তারা যা বিশ্বাস করে না, তাই বলছে, লিখছে, আর ভাঁওতা মারছে, আর জনসাধারণকে উপদেশ দিচ্ছে, যুবক-যুবতীদের দোষারোপ করছে। এরা অনেকটা কী রকম জানেন, উইথ ইওর পারমিশন, বাংলায় যাকে ঘুসকি বলে, সেইরকম। দরজায় দাঁড়িয়ে যে মেয়ে নিজেকে বিক্রি করে, তাকে তো আপনি দেখতেই পাচ্ছেন, চিনতে পারছেন। কিন্তু যে বিক্রি করে অথচ চেনা যায় না, সেটাই মারাত্মক। অবিশ্যি এ সব ক্ষেত্রে নেতা বা সাহিত্যিক ইত্যাদিদের কথাই বলতে চাইছি। এরকম আপনি অনেক দেখতে পাবেন, এর সঙ্গেই জুড়ে দিন শিক্ষাবিদ সংস্কৃতিবিদদের, হয়তো অনেক নামকরা লোকের চেহারা এই মুহূর্তেই আপনার চোখে ফুটে উঠবে। কী বললেন, উঠছে? না না, দয়া করে নাম করবেন না, ওটা উহ্যই রাখুন।…আমি বাইরে পরিচিত সেরকম একটা কেউকেটা নই, কিন্তু এদেরই সগোত্র, যে কারণে আমি শেষ পর্যন্ত নোংরা রাজনীতির অন্ধকারে গিয়ে পড়েছি। অতএব, শাস্তি আমার প্রাপ্য। মনের দিক থেকে আমি একটু সেকেলে, পাপের শাস্তি সবাইকে পেতেই হবে, এ সব কথা আমি বিশ্বাস করি। নিজের অবস্থা থেকেই বিশ্বাস করছি। আর শাস্তিটা সবসময়েই যে বাইরের থেকে আসে, তা নয়, আপনার নিজের ভিতরেই সেই অমোঘ অস্ত্র থাকতে পারে, যা উদ্যত হয়ে উঠেছে, যা হঠাৎ আপনাকেই কেটে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো..আহ। …না না, গলা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কারণ আমার বুকের ভিতর থেকে কিছু একটা উঠে আসতে চাইছে–হ্যাঁ, চোখ শুকনো রাখা আমারই দায় হয়ে উঠছে। যাই হোক, আমার তো ধারণা, আমি কী রকম রাজনীতি করেছি, তা এদেশের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। আমার পাপের ছায়া সর্বত্রই।

আর রুজিরোজগারের বেলায়ও তাই, যত ভাল দেশসেবার কথা বলতে পারি, ঠিক তত ভালই, আসলে নিজের সেবা করতে চেয়েছি–যদিচ ওটাকে আপনি আত্মার সেবা ধরে নেবেন না। তার মানে, আমিও ভেবেছিলাম, ন্যায়ের কথা বলব, তবু পাপের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলব, যেটা এখন আমার চারপাশের চেহারায় প্রকট হয়ে উঠতে দেখছি, তারই গুণ সব ফুটছে, আমি, সত্যি বলতে কী, আমার গায়ে গর্তের দুর্গন্ধ পাচ্ছি, এবং এই যে আপনাকে সব বলা, তা বোধ হয় এই দুর্গন্ধেরই জ্বালায়।

কী বললেন, মনে মনে খাঁটি থাকা যায় কিনা? তার মানে, আহা, ওরা যদি ভালভাবে খেতে পরতে পেত, ওই সব রাস্তার গরিবগুলো। এইরকম? কিংবা যে কোনও ভাবেরই, মনে মনে খাঁটি থাকার কথা বলছেন? থাকুনগে না, তাতে কার কী, আসলে তো বোঝাই যাচ্ছে, বালির ঝড়ে উটপাখির অবস্থা আপনার। মাথা ঢুকিয়ে বসে আছেন, কিন্তু গরম বালির যে পাপের হলকা, তা কি আপনার মনে মনে খাঁটি শরীরটিকে ছেড়ে যাবে? এটা কী রকম হল জানেন? জলে দাঁড়িয়ে তর্পণ করে মৃত পিতৃপুরুষের আত্মাকে জল পাঠাবার মতো। সে জন্যেই বাউলের গানে আছে ঠাকুর এই করে যদি স্বর্গে জল পাঠাতে পার, তবে ওই যে চাষা জলের অভাবে মাঠে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে, তাকেও পাঠিয়ে দাও না। মনে মনে খাঁটি থাকা বলে কোনও কথা থাকতে পারে না। আপনার সামনে এসে কেউ একটা অসহায় মেয়েকে রেপ করে গেল, আর আপনি মনে মনে বললেন, ছি, খুব খারাপ কিংবা ভাবলেন, আমি তো করিনি, এটাকে মনে মনে খাঁটি থাকা বলে না। ময়দানে আসতে হবে মশাই, ময়দানে, কাজ আর আচরণ দিয়ে বোঝাতে হবে।

যাই হোক, আমি বলি, দীপার কথাই ধরুন, আসলে ওর মধ্যে যে মানুষটা আছে, অর্থাৎ মেয়েটা, তার ভিতরে যে সব সমাজ প্রবর্তিত সুখের ইন্ধনগুলো আছে, আমি কি তা থেকে মুক্ত? চুক্তি + একনিষ্ঠতা = ভালবাসার যে কথা বলেছিলাম, যেটা অর্থহীন, আসলে চুক্তির কাছে কোনও মনই একনিষ্ঠতার খত্ লিখে দিতে পারে না এবং ওর যে মনটাকে আমি চিনি, এবং ওর অসহায়তাটাও বুঝতে পারি, এরকম ক্ষেত্রে মনের ভিতরের সেই পাপগুলোর মধ্যে আমিও কিলবিল করছি। আমার মনের মধ্যে যেটা ওর বিষয়ে কাজ করেছে, সেটা ভালবাসার প্রশ্নেই। আমার নিজেকে জিজ্ঞেস করা উচিত, আমি কি ওকে ভালবেসেছিলাম? ওর না হয় আমার সঙ্গে হয়নি, আমার কি হয়েছিল। তা যদি হত, তবে আর ভবিষ্যতে কুঁড়ি এল কোথা দিয়ে। আমিও তো অজস্র মিথ্যা দিয়েই সবকিছু ঢেকে চলেছি। স্বাধীনতার থেকে পরাধীনতার সুখেই যে বাস করা সহজ, অন্যথায় দুঃখ ও দুর্দশাকে বাড়িয়ে ফেলতে হয়, এটা ও যেমন দেখেছে, আমিও তো তেমনি দেখেছি, যে কারণে আপনাকে আমি এও বলেছিলাম, কুঁড়ির সঙ্গে আমার হওয়ার পর থেকেই দীপাকে আমি দেখতে আর বুঝতে শিখেছিলাম। অতএব ওর গলা কেন, নিজের গলাটা কি আমি দেখতে পাই না।

আচ্ছা, সেই রেডিয়ো বাজানো গাড়িটার কথাই ধরুন না, যে আমাকে ক্রুদ্ধ করে তুলেছিল, আমার মুখের চেহারা বদলে গিয়েছিল, দরদর করে ঘামতে আরম্ভ করেছিলাম হ্যাঁ হ্যাঁ সেটা ঠিক, তাকে সমর্থন করা যায় না, আমাকেই কি করা যায়? আসলে আমরা যে যার নিজের সংকট বা সুখের চিন্তার মধ্যেই ডুবেছিলাম, কারণ আমরা কেউই কারুর দায়িত্ব পালন করতে চাই না। এ পাপের বোঝা আমি ওর ঘাড়েই কেবল চাপিয়ে দিতে পারি না, বা ধরুন সেই পথের ভিড়ের বুড়ো মানুষটির কথা, সত্যি বলতে কী, তাঁর সেই পড়ে থাকা শরীরের কল্পনা আমার গায়ে চাবুক মারে। উনি অথর্ব, সেটাই হয়তো ওঁর অপরাধ এবং রাস্তাটাকে উনি আর রাস্তা মনে করতে পারেন না, উনি যেভাবে খুশি চলবেন, এটাই হয়তো ওঁর এই বয়সের দাবি, তাতে আর কার কী হল, উনি এখন আর তা জানতেও চান না, প্রবৃত্তিও নেই। কিন্তু আমার কথাটা ভাবুন, আমি আমার কথা ছাড়া ওঁর কথা কি একবারও ভেবেছিলাম। আমি আমার প্রয়োজনের কথা ছাড়া কখনও কিছুই ভাবিনি। আমার তখন কুঁড়ির কাছে যাওয়াটাই প্রধান, হয়তো রাস্তায় যারা ভিড় করেছিল, যাদের আমি ক্যালাস মনে করছি, তারাও আমাকে তাই মনে করতে পারে। এই যে আত্মসুখের অন্ধকার, আমরা সেই জঘন্য অন্ধকারে একটা জোনাকির আলো, কিংবা পাথরের গায়ে চোঁয়ানো একটু জলের তৃষ্ণায় এতই কাতর, আমি কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। আলো বা চোঁয়ানো জল কুঁড়িকেই বলছি। এই দায়িত্বহীনতাকে কী বলা যায়।

হ্যাঁ হ্যাঁ, কুঁড়ির কথাও বলব, যদিচ কী বলব, সঠিক জানি না, সে কথা আপনাকে আগেই বলেছি। সত্যি, কী রয়ে গিয়েছে, কী পাই না এটাই যদি না জানতে পারি যে কারণে, আমার ধারণা, কুঁড়ির অবস্থাও তাই কী বললেন, আপনার মনে হয়েছিল, আমাদের দুজনের অবস্থাই যেন এক রকম মনে হচ্ছিল, যেন দুজনেরই কী রয়ে যায়, কী পাওয়া যায় না? তা হলেই বলুন, ব্যাধি না জানলে কার প্রতিষেধকের কথা ভাববেন আপনি। তবু আমার কী মনে হয় জানেন–অবিশ্যি জানি না, সভ্যতার শুরুটা একদিকে যেতে গিয়ে, আর একদিকে দৌডুতে আরম্ভ করেছিল কি না, কিংবা আর একবার যাত্রা করতে হবে কি না, তবে এটা ঠিক, আমরা কোথাও একটা কিছুর খোঁজে বেরিয়েছিলাম, সেই আদিকাল থেকেই, সেটাকে কী জানি, সত্য বলবেন কিনা, তর্কাতীত সত্য, আপাতবিরোধ ইত্যাদি কথাগুলো একেবারেই বাদ দিন, কারণ সেটা আমাদেরই সৃষ্ট, সত্যের কোনও তর্ক থাকতে পারে না, এটা জেনেই তর্কও হয়, তবু সেই সত্যের যার কোনও পরিচয়ই আমার জানা নেই, হয়তো তাই রয়ে যায়, তাই পাই না, কারণ পেতেই জানি না, দুজনের কেউই না, কারণ আমরা দুজনেই যা পেতে চাই, তার থেকে আমরা অনেক দূরে। তবু যন্ত্রণাটা যায় না। এই অন্ধত্বের পাপ আমাকে ঘিরে রয়েছে, আর তার জন্যে আমি কুঁড়ির গলায় হাত দিতে পারি না।

বেশ লাগছে, জলে পা ডুবিয়ে এই ঘাসে বসতে, না? কী হল, আমার গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন। কী বলছেন, আমার গলার স্বর আপনার অন্যরকম লাগছে? গায়ে হাত রাখতেও ভয় পাচ্ছেন? এমনকী আমার দিকে তাকাতেও আপনার ভয় করছে, অথচ গায়ে হাত রাখতে চাইছেন। এর কোনওটারই অর্থ হয় না। করুণা করতে চান করতে পারেন, করবেন না? ভয়টাই বেশি হচ্ছে? কেন বলুন তো?

হ্যাঁ, সেটা ঠিক আমার পাপগুলো আমার কাছে ধরা পড়তে আরম্ভ করেছে এবং তার জন্যেই আপনাকে এই কথাগুলো বলতে পারলাম, আর এর পরেই কী বললেন, এর পরেই আমাকে ভীষণ বীভৎস দেখাবে? হাসব কিনা আপনার কথা শুনে, বুঝতে পারছি না। কী বললেন, এর চেয়ে আমার একটার পর একটা খুন করাও ভাল, তবু যেন আমি আমার সবকিছু ছেড়ে বাইরে এসে না দাঁড়াই? সেটা আরও ভয়ংকর বলছেন?

আপনার কথাটা ভাববার মতো, কিন্তু দেখুন, আমার মনে হয়, আপনার ভয় পাওয়া সেই ভয়ংকর দিকেই আমি চলেছিনা না, আমার চোখ ভিজতে পারে, কিন্তু সত্যি বলছি, অসহায়তাকে আমি আর ভয় পাচ্ছি না। এমনকী, পাতাঝরা ন্যাড়া অবস্থার কথা ভেবেও নয়।

হ্যাঁ, এবার আপনার বিদায়। মুখটা ওরকম ভার করে যাবেন না। একটু হেসে যান, কারণ আপনাকে আমি এতক্ষণ ধরে যা বলেছি, তার সবটাই ছুটে বেরিয়ে আসবার কথা। হ্যাঁ, কোনও নোংরা গর্ত থেকে বেরিয়ে এলে, আপনার গায়ে কিছু ময়লা আর রক্তের দাগ থাকতে পারে। যেটাকে আপনি ভয়ংকর বীভৎস মনে করছেন। আসলে তা তো সত্যি নয়, আসলে তো মুক্তিস্নান আসন্ন, অতএব হাসাই তো আপনার উচিত। আপনিও চেষ্টা করুন না বেরিয়ে আসবার। না হলে কী হচ্ছে জানেন, আমরা সকলেই সকলের পাপের অংশীদার হয়ে পড়ছি। বুঝলেন, আসলে লড়ে যাওয়াই ভালনা না, আমি ভেঙে পড়ছি না, নিচু হয়ে মুখ দিয়ে একটু মাটি ছুঁতে চাইছি। মনে হচ্ছে, আমি যেন মাটি থেকে অনেক দূরে রয়েছি, মাটির গন্ধও ভুলে গিয়েছি। তাই তাই…আহ!…

Pages: 1 2

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress