স্বামী হওয়া
মহুয়া মিলন থেকে আসা ট্রেনটা টোরী স্টেশনে ঢুকছিল। স্মিতা এবং আমি নীচু প্ল্যাটফর্মের উপর দাঁড়িয়ে ছিলাম। আজ হাটবার। খুব ভিড় প্ল্যাটফর্মে নানা জায়গা থেকে হাট করতে এসেছিল ওরাঁও-মুণ্ডা, ভোগতা-কোল-হো-রা।
সুমন স্যুটকেসটা হাতে করে নামল। নেমেই দৌড়ে এলো আমাদের দিকে এসে স্মিতাকে বলল, কেমন আছো বউদি?
স্মিতা বলল, কেমন করে ভালো থাকি বল? তুমি এত্তদিন কাছে ছিলে না!
সুমন হাসল। আমিও হাসলাম।
এর পর সুমন আমাকে বলল, রোলস রয়েসটা এনেছো তো?
বললাম, এনেছি।
তবে চল।
স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে আমার লজঝড় অস্টিন গাড়িটার পিছনের দরজা খুলে সুমন উঠে বসল। পাশে স্মিতা। আমি ড্রাইভিং সিটে আসীন হলাম।
বসন্তের দিন হু-হু করে হাওয়া আসছিল। পড়ন্ত রোদুর সেগুন গাছের বড় বড় হাতির কানের মতো পাতার পেছনে পড়াতে সিঁদুরে-রঙা দেখাচ্ছিল পাতাগুলোকে। মহুয়ার গন্ধ ভাসছিল। ঠোঁট-মুখ চড় চড় করছিল রুখু বাতাসে।
স্মিতা বলল, তারপর?মা-বাবা বিয়ের কথা কী বললেন?
সুমন বলল, ধ্যত! সে মা-বাবাই জানেন।
আহা! লজ্জায় যেন মরে গেলে তুমি।
ওকে গালে টুশকি মেরে বলল স্মিতা।
আমি লাতেহারের দিকে মোড় নিলাম। কিন্তু লাতেহারে যাবো না।
চাঁদোয়ারই এক প্রান্তে আমার কোয়ার্টার। সুমনেরও। পাশাপাশি সরকারী চাকরিতে এই রকম জঙ্গুলে জায়গায় যেমন কোয়ার্টার হতে পারে, তেমনই।
কোয়ার্টারে পৌঁছে গাড়িটা খাপরার চালের একচালা গ্যারেজ ঢুকিয়ে দিলাম।
স্মিতা সুমনকে বলল, তোমার বাহন ছোটুয়াকে বলে দিয়েছি কাল ভোরে চলে আসততা আজ সকালেও একবার এসে ঘর-দোর ধুয়ে-মুছে গেছে। চানুকে টুল পেতে সামনে বসিয়ে রেখেছিলাম সব সময় পাছে কিছু খোয়া যায় তোমারা
সুমন উত্তেজিত হয়ে বলল, চানু কোথায়? চানু?
ততক্ষণে সুমনের গলা শুনতে পেয়ে চানু টালমাটাল পায়ে দৌড়ে এল বুধাই-এর মায়ের হেপাজত থেকে ছাড়া পেয়ে বলল, সুমন কাকু, তোমার সঙ্গে আড়ি।
সুমন স্যুটকেসটা নামিয়ে রেখেই চানুকে এক ঝটকায় কোলে তুলে নিয়ে বলল, তা হলে আমি মরেই যাবা তোমার সঙ্গে আড়ি করে কী আমি বাঁচতে পারি? তোমার মা-বাবা পারলেও বা পারতে পারে। আমি কখনও পারব না।
চানু অত বোঝে না। চার বছর বয়স তার মোটে। সে বলল, আড়ি, আড়ি, আড়ি।
স্মিতা, সুমন এবং আমিও হেসে উঠলাম।
স্মিতা বলল সুমনকে, জামা কাপড় ছেড়ে মুখ হাত ধুয়ে নাও। দুপুরে খেয়েছিলে কোথায়?
দুপুরে আবার কোথায় খাব! যা হতচ্ছাড়া লাইন! এ সব জঙ্গলের জায়গা তোমাদের মত কবি কবি লোকের পক্ষেই ভালো লাগার। সাতসকালে বাড়কাকানাতে খাওয়ার খেয়েছিলাম। পথে ম্যাকলাস্কিগঞ্জে চা, কার্নি মেমসাহেবের দোকানের আলুর চপ কালাপাত্তি জর্দা দেওয়া পান গোটা আষ্টেক। সারা পথে।
স্মিতা বিরক্তির গলায় বলল, তাই-ই। ঠোঁট দুটোর অবস্থা দেখেছ কী হয়েছে! এখানের গরমে ফাটা লাল মাটির মত
সুমন বলল, কথা না বলে শিগগিরি খেতে দাও তো!
আমি আমার ঘরে গেলাম আমার প্রিয় ইজিচেয়ারটাতে বসলাম আমার সাম্রাজ্যে আমার বই, বইয়ের আলমারি গড়া। ছুটির দিনে গেঞ্জি আর পাজামা পরে সারা দিন বই পড়েই কাটে আমার। আমি বড় কুঁড়ে লোক। স্মার্ট, এনার্জেটিক, সামাজিক বলতে যে সব গুণ বোঝানো হয় তার কোনো গুণই আমার নেই। আক্ষেপও নেই না-থাকার জন্যে।
তবে এই চাঁদোয়া-টোরীতে সরকারী কাজে বদলি হয়ে এসে পড়ার পরই বেশ নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম স্মিতার জন্যে আমি তো সারাদিন কাজকর্ম নিয়ে থাকবা অবসর সময় বই পড়ব। কিন্তু আমার চেয়ে দশবছরের ছোট সম্বন্ধ করে বিয়ে করা স্ত্রী স্মিতা? তার সময় কী করে কাটবে? ভাগ্যিস চালু হয়েছিল। এখানে যখন আসি তখন চানুর বয়স পনেরো মাস। তবুও একটা নরম খেলনা ছিল স্মিতার। যে খেলনাকে খাইয়ে-দাইয়ে, ঘুম পারিয়ে, চোখ রাঙিয়ে ওর সময় কেটে যেত।
সময় তবুও কাটততা কী না জানি না, যদি সুমন এখানে বদলি হয়ে না আসত। বয়সে সুমন আর স্মিতা সমানই হবে। পাশের কোয়ার্টারে ও একা একা এসে উঠল। প্রথম প্রথম হাত পুড়িয়ে খাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু অভ্যেস ছিল না রান্না করার। অচিরে স্মিতার সঙ্গে ওর একটা প্রগাঢ় সখ্যতা গড়ে উঠল। যদিও বউদি বলে ডাকত সুমন স্মিতাকে কিন্তু ওরা যে কত বড় বন্ধু একে অন্যের তা আমার মত কেউই জানত না। সুমনকে পেয়ে স্মিতার যত ছেলেমানুষী শখ ছিল সব মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে লাগল। পলাশ গাছে উঠে ফুল পাড়ত স্মিতা কোমরে শাড়ি জড়িয়ে সুমনের সঙ্গে। কুরুর পথে আমঝরিয়ার বাংলায় মুনলাইট পিকনিক করত। লাহোরের কাছে বহু বছর আগে পরিত্যক্ত কলিয়ারির আশেপাশে ঘুরে ঘুরে শীতের দুপুরে ছেলেমানুষী প্রত্নতাত্বিক পর্যবেক্ষণ চালাতো।
কখনও আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেত ওরা পীড়াপীড়ি করে। আমি না গেলে নিজেরাই যেত। আমিও নিশ্চিন্ত মনে কলকেতে ডালটনগঞ্জের সাপ্লায়ারের দেওয়া অম্বুরী তামাক সেজে গড়ার নল হাতে একটা বই নিয়ে আরাম করে ইজিচেয়ারে বসতাম। ওদের সঙ্গে যেতে যে হতো না এ কথা ভেবে আশ্বস্ত হতাম।
খাওয়ার টেবিলে ডাক দিলো স্মিতা আমিও এসে বসলাম। শিঙারা বানিয়েছে ও। ক্ষীরের পুলি। লাতেহারের পণ্ডিতজির দোকান থেকে সেওই আর কালাজামুন আনিয়েছে।
গবগব করে খেতে খেতে সুমন বলল, আরো দাও, আরো দাও বউদি! তুমি এমন কিপটে হয়ে গেলে কী করে এক মাসের মধ্যে?
স্মিতা কপট রাগের সঙ্গে বলল, কিপটে আমি? মালখাঁনগরের বোসের ঘরের মেয়ে। ঐসব পাবে না আমার কাছে।
সুমন আমাকে বলল, দেখছো রবিদা! ঐ শুরু হল সর্বক্ষণ এমন এনিমি-ক্যাম্পে থেকে থেকে আমার হাওড়া জেলার ওরিজিনালিটিটাই মাঠে মারা গেল। বাড়ি গিয়ে ভাত খেতে বসে পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা ছাড়া খেতে পারি না দেখে মা আর দিদির তো চক্ষুস্থির। তোমাদের গল্প করতাম সব সময়। দিদিমা বললেন, সুমন তোকে শেষে ঐ রেফিউজিগুলোর আদিখ্যেতায় পেল! ছিঃ ছিঃ!
কি বললে?
স্মিতা এবার সত্যিই বোধ হয় রেগে উঠল।
সুমন বলল, আহা রাগছ কেন, কী বললাম তাই-ই শোন। আমি বললাম, বাঙালদের মন খুব ভালো হয় দিদিমা। খোলামেলা জায়গায় থাকত তো, আকাশ-জোড়া মাঠ, আদিগন্ত নদী, কত মাছ, কত ঘি, কত কী…
দিদিমা বললেন, থাক, থাক। সব রেফিউজিই জমিদার ছেল। ওসব গল্প আমাকে আর শোনাসনি। বহু শুনেছি।
বলেই সুমন হাসতে লাগল।
ও ছেলেমানুষ। ওর মনে কোনো জটিলতা নেই। কিন্তু ও এ কথাটা না বললেই ভালো করত। সকলেরই জমিদারি সচ্ছল অবস্থা না থাকলেও যাদের ছিল এ রকম কথা শুনলে তাদের বড়ই লাগে।
এখন বোধ হয় লাগে না আর। প্রথম প্রথম লাগত। এখন ব্যথার স্থান অবশ হয়ে গেছে। ক্ষত হয়েছে পুরোনো।
আমি অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম…
…বরিশালে আমাদের দোতলা বাড়ির চওড়া বারান্দায় পূর্ণিমার রাতে বসে আছি ইজিচেয়ারে। থামের ছায়াগুলো পড়েছে বারান্দাতে কালো হয়ে। দীঘির পাড়ের সার সার নারকোলগাছের পাতায় চাঁদের আলো চকচক করছে। সেরেস্তার দরজা জানালা বন্ধ কুন্দনলালজী তাঁর ঘরের সামনে চৌপায়ায় বসে দিলরুবাতে বাহারে সুর তুলেছেন গ্রামের লক্ষ্মীরা সন্ধ্যারতি শেষ করে শাঁখ বাজাচ্ছে। বাতাসে নারকোল পাতার নড়াচড়ার শব্দ। আরো কত কী গাছ। জামরুল গাছ, আমবাগান, লিচু গাছ, জলপাই গাছ, নিচে হাসনুহানা কাঠটগরের ঝোপা পাশে পাশে হরেক রকমের চাঁপা। আমার দোতলার ঘরের জানালা অবধি উঠে এসেছে একটা কনকচাঁপা গাছ। গাড়ি ঢোকার পথের পাশে ছিল ম্যাগনোলিয়া গ্রান্ডিফ্লোরার সারি।
আমি অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম।
স্মিতা বলল, কী হল? তোমার চা যে ঠাণ্ডা হয়ে গেল!
সুমন বলল, রবিদাদা রাগ করলে নাকি?
আমি হাসলামা বললাম, না রে পাগল।
স্মিতা সুমনকে বলল, আর দুটো শিঙারা খাবে?
সুমন বলল, দাও। কত্তোদিন পর তোমার হাতের খাবার খাচ্ছি। তারপর বলল, আসলে কলকাতায় গিয়ে তোমাদের গল্প, বিশেষ করে বউদির গল্প সকলের কাছে এতই করেছি যে তোমাদের সকলেই হিংসে করতে আরম্ভ করেছে। বউদিকে তো বেশী করে।
স্মিতা চায়ের কাপটা মুখের কাছে ধরে ছিল। দেখলাম, কাপের উপর ওর দুটি টানাটানা কালো চোখ সুমনের ঐ কথার সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠেই নিথর হয়ে গেল।
চা খাওয়ার পর আমি আমার ঘরে ফিরে গেলাম।
সুমন চানুকে কাঁধে করে স্মিতার সঙ্গে ওর কোয়ার্টারে গেল। স্মিতা সব গুছিয়েগাছিয়ে দিয়ে আসবে। অগোছালো, একা লোকের সংসার।
যাওয়ার সময় স্মিতা বলে গেল বুধাই-এর মাকে যে, একটু পর এসে যেন চানুকে নিয়ে যায়। খাওয়ার সময় হয়ে যাবে চানুরা
ওরা দুজনে যখন ফিরল সুমনের কোয়ার্টার থেকে তখন রাত গভীর। আমি এডওয়ার্ড জোস্টিং-এর লেখা হাওয়াই-এর ইতিহাস পড়ছিলাম। ইতিহাস পড়তে পড়তে হাজার বছরের ব্যবধান এত সামান্য মনে হয় যে ঘণ্টার খবর রাখতে তখন আর ইচ্ছে করে না।
দুপুরেই রান্না সেরে রেখেছিল স্মিতা। বুধাই-এর মা গরম করে দিলো খাওয়ার-দাওয়ার।
স্মিতা খাবার সাজিয়ে ও এগিয়ে দিতে দিতে বলল, দ্যাখো, সুমন কত কী এনেছে আমাদের জন্যো এইটা আমার শাড়ি। বলেই চেয়ারের উপর থেকে শাড়িটা তুলে দু হাতে মেলে ধরে দেখালো। তারপর বলল, এরকম একটাও শাড়ি তুমি আমাকে দাও নি।
আমি বললাম, এ তো দারুণ দামী শাড়ি।
সুমন বলল, বউদি কী আমার কম দামী?
স্মিতা আবার আমাকে বলল, এই যে, তোমার পাঞ্জাবি ও পায়জামা। এই চানুর জামা প্যান্ট।
আমি রুটি ছিড়তে ছিড়তে বললাম, করেছো কী সুমন, এই রকম নকশা কাটা চিকনের পাঞ্জাবি কি আমাকে মানায়? এ তো ছেলেমানুষদের জন্যে!
সুমন বলল, আপনি তো প্রায় তিন বছর কলকাতা যান না। এখন তো এই-ই ক্রেজা ঘাটের মড়ারা পর্যন্ত পরছে আর আপনি তো কিশলয় এখনও।
স্মিতা নরম গলায় বলল, এই যে শুনছ, দ্যাখো।
আমি বললাম, কি?
অ্যাই দ্যাখো, আমার জন্যে আরো কী এনেছে?
বলেই ছোট দুটো প্যাকেট খুলে আমার দিকে এগিয়ে দিলো। দেখি, এক জোড়া বেদানার দানার মত রুবির দুল, আর একটা ইন্টিমেট পারফুম। ছোট্টা।
আমি সুমনকে বকলাম বললাম, তুমি একটা স্পেন্ডগ্রিপট হয়ে গেছো। দিস ইজ ভেরি ব্যাড সারা জীবন পড়ে আছে সামনে বিয়ে করবে দুদিন পর এমন বেহিসাবীর মত খরচ করে কেউ?
স্মিতা বলল, দ্যাখো না, বেশী বেশী বড়লোক হয়েছেন!
সুমন বলল, বড়লোকদের জন্যে বড়লোকি না করলে কী চলে?
খেতে খেতে আমি ভাবছিলাম সুমন বেশ সুন্দর সপ্রতিভ কথা বলে, যা আমি কখনোই পারিনি। পারবো না। স্মিতার যে ওকে এত ভালো লাগে তার কারণ অনেক। চিঠিও নিশ্চয়ই ভালোই লেখো আমার তো এক লাইন লিখতেই গায়ে জ্বর আসে আমাকে অবশ্য কখনও লেখেনি ও অফিসিয়াল ব্যাপারের চিঠি ছাড়া। তবে স্মিতাকে প্রায় তিন-চারটে করে চিঠি লিখত প্রতি সপ্তাহে। যতদিন ছিলো না এখানে। এখানে ডাকপিওন চিঠি বিলি করে না। আমার অফিসের পিওন ছেদীলাল মাস্টার মশাইয়ের কাছ থেকে ডাক নিয়ে আসে রোজা ভারি ভারি চিঠি আসত পুরু খামে। সুমনের সুন্দর হাতের লেখায় স্মিতার নাম লেখা থাকতা কোনোদিন ছেদীলাল পোস্ট অফিসে যেতে দেরি করলে বুধাই-এর মাকে পাঠাতো স্মিতা আমাকে মনে করিয়ে দিতে চিঠি আনার জন্যে।
যে ক’দিন সুমন ছিলো না, লক্ষ্য করলাম স্মিতা কেমন মনমরা হয়ে থাকতা বেলা পড়ে এলে, গা-টা ধুয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে, শালজঙ্গল ও পাহাড়ের দিকে চেয়ে স্মিতা বাইরের সিঁড়ির উপর বসে থাকত। শেষ বিকেলের আলোর মতো নরম হয়ে আসত ওর মুখের ভাব সুমনের চিঠি পড়তে পড়তো ঘর থেকে আমি ডাকতাম ওকে, ও শুনতে পেতো না। কোথায়, যেন কত দূরে। চলে যেত ও মনে মনে
২.
সুমন শিগগিরি কলকাতা যাবে। ওর বিয়ে ঠিক করেছেন মা-বাবা। সকালে রাঁচি গেছে ও নতুন স্কুটার ডেলিভারী নিতে
অফিস থেকে ফিরছিলাম হেঁটেই। আমাদের অফিসটা কোয়ার্টারের কাছেই। দু ফার্লং মত। অফিস যাতায়াতের জন্যে গাড়ি কখনোই নিই না এক বর্ষাবাদলের দিন ছাড়া। আকাশে তখনও আলো আছে। জঙ্গল থেকে শালফুলের গন্ধ ভেসে আসছে হাওয়ায় তার সঙ্গে মহুয়া এবং করৌঞ্জের গন্ধ। পথের পাশে, জঙ্গলের শাড়ির পাড়ে ফুলদাওয়াই-এর লাল ঝাড়ে মিনি-লঙ্কার মত লাল লাল ফুল এসেছে। মাঝে মাঝে কিশোরীর নরম স্বপ্নের মত ফিকে বেগুনী জীরহুলের ঝোপা।
লাতেহারের দিক থেকে একটা ট্রাক জোরে চলে গেল চাঁদোয়ার দিকে লাল ধুলো উড়ল, মেঘ হল ধুলোর তারপর আলতো হয়ে ভাসতে ভাসতে পথের দু পাশের পাতায় গাছে ফিসফিস করে চেপে বসলা।
মিশিরজী আসছিলেন সাইকেল নিয়ে বস্তির দিক থেকে। হাওয়াতে তাঁর টিকি উড়ছিল দেহাতী খদ্দরের নীল পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে। দূর থেকেই আমাকে দেখে বললেন, পরনাম বাবু।
আমি বললাম, প্রণাম।
হিন্দীটা আমি তখনও যথেষ্ট রপ্ত করতে পারিনি। সেদিকে সুমন পটু। পানের দোকানের সামনে সাইকেলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে জর্দা পান খেতে খেতে ওর সমবয়সী স্থানীয় ছেলেদের সঙ্গে এমন ঠেট হিন্দীতে গল্প করে অথবা হিন্দী সিনেমার গান গায় যে, কে বলবে ও স্থানীয় লোক নয়! সব মানুষকে আপন করে নেওয়ার একটা আশ্চর্য সহজাত ক্ষমতা আছে সুমনের। ওর মধ্যে অনেক কিছু ভালো জিনিসই আছে যা আমার মধ্যে নেই।
মিশিরজী সাইকেলের টায়ারে কিরকির শব্দ করে নামলেন। বললেন, হালচাল সব ঠিক্কে বা?
আমি বললাম, ঠিক্কেই হ্যায়।
সুমনবাবু কি কোলকাত্তাসে শাদী করিয়ে আসলেন এবার?
আমি অবাক হয়ে বললাম, না তো!
মিশিরজী অবাক হয়ে বললেন, আভভি যাত্তে দেখা উনকা-স্কুটারমে। পিছুমে কই খাবসুরত আওরত থী। বড়ী প্যায়ার সে সুমনবাবুকা পাকড়কে বৈঠী হুয়ী থী
আমি অবাক হলাম। বললাম, নেহী তো বিয়ে তো করেনি।
তাজ্জব কি বাত। তব সুমনবাবুকা সাথমে উও কওন থী?
আমার মুখ ফসকে হঠাৎ বেরিয়ে গেল, মেরা বিবি ভি হেনে সকতি। দুজনের মধ্যে খুব দোস্তী।
মিশিরজী বললেন, অজীব আদমী হ্যায় আপ বড়াবাবু। দোস্তী উর পেয়ার কখনও এক হয়? আর মরদ ঔর আওরতের মধ্যে কি দোস্তী হয় বড়াবাবু? খালি পেয়ারই হোবো।
তারপরই হো হো করে হেসে বললেন, আপ বড়ী হিউমারাস আদমী হেঁ। নেহী তো, নিজের ধরম পত্নী কি বারেমে অ্যায়সী মজাক কেউ করতে পারে কভভী?
আমার মুখ থেকে প্রায় বেরিয়ে এসেছিল যে, মজাক করিনি আমি।
কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল, স্মিতা সব সময় আমাকে বলে তুমি খুব বোকা। কোথায় কী বলতে হয় জানোনা।
সত্যিই বড় বোকা আমি।
বাড়ি ফিরেই জানতে পেলাম যে, সত্যিই আমি মজাকী করিনি। রাঁচি থেকে নতুন স্কুটার ডেলিভারী নিয়ে এসেই সুমন তার বউদিকে পিছনে চড়িয়ে টোড়ী থেকে বাঘড়া মোড়ে যে পথটা চলে গেছে তার মাঝামাঝি জায়গায় গভীর জঙ্গলের মাঝে বড়হা-দেওতার থানে পুজো চড়াতে গেছে।
চানুটা কান্নাকাটি করছিল। আমাকে বলল বল খেলতে আমি এসব পারি না। তবুও চা-টা খেয়ে বুধাই-এর মাকে বাড়ির কাজ করতে বলে আদর্শ বাবার মত চানুর সঙ্গে ওর লাল রবারের বল নিয়ে কোয়ার্টারের পিছনের মাঠে বল খেলতে লাগলাম।
আমার মন পড়েছিল হাওয়াই-এর রাজা কামেহামেহার রাজত্বে। অন্যমনস্ক থাকায় অচিরে বলটা লাফাতে লাফাতে কুঁয়োয় গিয়ে পড়ল। বালতি নামিয়ে অনেক চেষ্টা করেও উঠোতে পারলাম না বলটাকে। চানু কাঁদতে কাঁদতে বলল, সুমনকাকা তুলে দিয়েছিল, তুমি পারলে না। তুমি কিছু পারো না, বাবা।
আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলামা বললাম, সুমনকাকা এসেই তুলে দেবে।
তারপর চানুকে আবার বুধাই-এর মার জিম্মাতে দিয়ে আমি আমার ইজিচেয়ারে শায়িত হয়ে রাজা কামেহামেহার কাছে ফিরে গেলাম।
ওদের ফিরতে বেশ রাত হল। স্মিতার শাড়ি এলোমেলো, ধুলোলাগা বিস্রস্ত চুল। খোঁপায় দলিত জংলী ফুল আর মুখে কী এক গভীর আনন্দের ছাপ।
সুমন বলল, স্কুটারটা খারাপ হয়ে গেছিল বাঘের জঙ্গলে। কী ভয় যে করছিল, কী বলব।
বাঘের জন্যে নয়, পরস্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এত রাত হল বলে।
আমি বললাম, ফাজিল।
চানু বলল, এক্ষুনি আমার বল তুলে দাও সুমনকাকু। বাবাটা কিছু পারে না। বল পড়ে গেছে কুঁয়োর মধ্যে।
সুমন ঐ অন্ধকারেই টর্চ হাতে করে কুঁয়ো-পাড়ে গিয়ে চানুর বল তুলে নিয়ে এলো। তারপর রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে চলে গেল।
সে রাতে স্মিতাকে আদর করতে যেতেই ও বলল, আজ থাক লক্ষ্মীটি। আজ ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। ওর সুন্দর, ছিপছিপে এলানো শরীর, গভীর নিঃশ্বাস, ওর বুকের ভাঁজে সুমনের দেওয়া ইন্টিমেট পারফুমের গন্ধ সব মিলেমিশে ওকে বিয়ের রাতের স্মিতার মতো মনে হচ্ছিল।
আমি আর কিছু বলার আগেই স্মিতা ঘুমিয়ে পড়ল। চাঁদের আলোর একফালি জানালা দিয়ে বিছানায় এসে পড়েছিল। স্মিতার মুখে বড় প্রশান্তি দেখলাম। খুব, খুব খুউব আদর খাওয়ার পর, আদরে পরম পরিতৃপ্ত হবার পর মেয়েদের মুখে যেমন দেখা যায়।
আমার ঘুম আসছিল না। মিশিরজীর দাঁতগুলো ফাঁক ফাঁকা পান খেয়ে খেয়ে কালো হয়ে গেছে সেগুলো। গায়ে দেহাতি ঘামের পুরুষালী গন্ধ। হঠাৎ মিশিরজীর উপর খুব রাগ হল আমার। আমি ইজিচেয়ারে শুয়ে টেবল-লাইট জ্বালিয়ে রাতের অন্ধকারে প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে হাওয়াই-এর রাজা কামেহামেহার ও রানী কাহুমানুর কাছে ফিরে গেলামা খুব প্রশান্তি।
ইতিহাসের মতো আনন্দের, শান্তির আর কিছুই নেই।
পরদিন চা খেতে খেতে স্মিতা বলল, সুমনের বিয়ের কথা লিখে আবার চিঠি দিয়েছেন ওর বাবা কাল-পরশু ওর এক কাকা আসবেন রাঁচি হয়ে, ওর কাছে ঐ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করতে আমি কিন্তু খেতে বলে দিয়েছি তাঁকে। যেদিন আসবেন, সেদিন রাতে
আমি বললাম, বেশ করেছে। না বললেই অন্যায় করতে।
৩.
সুমনের কাকার চেহারাটা আমার একটুও ভালো লাগল না। ভদ্রলোক ট্রেন থেকে নেমেই সকালের বাসে এসে নাকি এখানের নানা লোকের সঙ্গে দেখা করেছেন সুমনের কাছে যখন অফিসে এসে পৌঁছন, তখন বিকেল চারটো রাতে যখন খেতে এলেন আমাদের বাড়ি, তখনই তাঁকে দেখলাম অশিক্ষিত বড়লোকদের চোখেমুখে যেমন একটা উদ্ধত নোংরা ভাব থাকে, এই ভদ্রলোকের মুখেও তেমন। বালিতে থাকেন। লোহা-লক্কড়ের ব্যবসা করেন কালোয়ার ভদ্রলোক কেবলই স্মিতাকে লক্ষ্য করছিলেন। বেশ অভব্যভাবে
আমার মনে হল, উনি আসলে সুমনের বিয়ের কারণে আসেননি। এসেছেন স্মিতাকে দেখতে
খেতে খেতে অসম্মান ও অপমানে আমার কান লাল হয়ে উঠল।
সেই রাতেই আমি প্রথম স্মিতাকে কথাটা বললাম না বলে পারলাম না। মিশিরজীর কথা বললাম সুমনের কাকার কথা বললাম। বললাম, ছোট জায়গা, অশিক্ষিত অনুদার সব লোকের বাস, বাড়ির বাইরে একটু বুঝে শুনে চলাফেরা করতে।
স্মিতা চুপ করে আমার কথা শুনল। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কিন্তু কিছুই বলল না।
আমি বললাম, তোমার ব্যবহারে সুমনকে যদি তোমার স্বামী বা প্রেমিক বলে ভুল করে বাইরের লোকে, তাহলে আমার পক্ষে তা কী খুব সম্মানের?
স্মিতা রেগে উঠল। বলল, আচ্ছা তুমি কী? স্কুটারে বসলে যে চালায় তাকে না জড়িয়ে ধরে কেউ বসতে পারে?
তারপর বললে, মিশিরজী বা কে কী বলল, তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। তুমি কী বলো সেইটেই বড় কথা।
আমি বললাম, আমি কি কখনও কিছু বলেছি? কিন্তু নিজের সম্মানের কারণে না বলেও তো উপায় দেখছি না এখন তোমাকে যদি লোকে খারাপ বলে তা কি আমার ভালো লাগবে?
স্মিতা বলল, নিজের মনের কথাও যে ঐ, তা তো বললেই পারো। অনেকদিন আগে বললেই পারতো নিজের কথা অন্যের মুখের বলে চালাচ্ছো কেন?
আমি স্মিতার কথায় ব্যথিত হলাম। কিছু না বলে ইজিচেয়ারের নিরুপদ্রব রাজত্বে ফিরে গেলাম।
কয়েক দিন পরেই সুমনের খুব জ্বর হল। আমি বলেছিলাম ও আমাদের বাড়িতেই এসে থাকুক ছেলেমানুষ, বিদেশে বেহুশ অবস্থায় একা বাড়িতে থাকবে কি করে? তা ছাড়া, ক’দিন পরেই ওর বিয়ে। কী অসুখ থেকে কোন অসুখে গড়ায় তা কে বলতে পারে?
স্মিতা জেদ ধরে বলেছিল, না। আমাদের বাড়িতে ও মোটেই থাকবে না।
বলেছিলাম, তাহলে ওর সেবা-শুশ্রষা করো। রাতে না হয় আমিই গিয়ে থাকব। তুমিও থাকতে পারো ইচ্ছে করলো।
স্মিতা বলল, থাক, এত ঔদার্য নাই-ই বা দেখালে। তোমার মিশিরজীরা কী তাহলে চুপ করে থাকবে?
সারাদিন স্মিতাই দেখাশোনা
করল রাতে আমিই গেলাম সুমনের বাড়ি। ওর শোবার ঘরে ক্যাম্পখাট পেতে থার্মোমিটার, ওষুধ, ওডিকোলন সব ঠিকঠাক করে দিয়ে গেল স্মিতা।
নতুন জায়গায় ঘুম আসছিল না আমার। অনেকক্ষণ জেগে বসে বসে সিগারেট খেলাম। তারপর পাশের ঘরে গেলাম সুমন তখন ঘুমোচ্ছিল। পাশের ঘরের টেবিলে একটা চিঠি পড়েছিলা ইনল্যান্ড লেটারে লেখা সুমনের নামের সুমনের মার লেখা চিঠি
কেন জানি না, ঐ নিস্তব্ধ রাতে, ঝিঝির ডাকের মধ্যে আমার মন বলল, এই চিঠির ভিতরে এমন কিছু আছে যা স্মিতা ও সুমনের সম্পর্ক নিয়ে লেখা টেবল-লাইটের সামনে চিঠির ভিতরে আঙুল দিয়ে চিঠিটা গোল করে ধরে পড়তে লাগলাম চিঠিটা। যতটুকু পড়তে পারলাম, তাই-ই যথেষ্ট ছিলা।
সুমনের মা লিখেছেন, সুমনের কাকার চিঠিতে জানতে পেরেছেন তিনি যে, সুমন একটি ডাইনির পাল্লায় পড়েছে। এক ভেড়ুয়ার বউ সো সুমন জানে না যে, সুমনের কত বড় সর্বনাশ সেই মেয়ে করছে ও করতে চলেছে। সুমন ছেলেমানুষ মেয়েদের পক্ষে কী করা সম্ভব আর কি অসম্ভব সে সম্বন্ধে ওর কোনো ধারণাই নেই। সুমনের ভাবী শ্বশুরবাড়ীর লোকদের কোনো আত্মীয়ের কাঠের ব্যবসা আছে লাতেহারে। তাঁরাও খোঁজ নিয়ে জেনেছেন যে, সুমনের কাকা যা জানিয়েছে, তা সত্যি পাত্রীপক্ষ বেঁকে বসেছে যে, ঐ বজ্জাত স্ত্রীলোকের সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করলে এবং বিয়ের পরেই ওখান থেকে ট্রান্সফার নিয়ে চলে আসার চেষ্টা না করলে এ বিয়ে হবে না। এত সুন্দরী ও বড়লোকের মেয়েও আর পাওয়া যাবে না। তাদের দেয় পণের টাকাতেই সুমনের বোন মিনুর বিয়ে হয়ে যাবে। যদি সুমনের তার বাবা, মা, বোন, তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য এবং তার নিজের সম্বন্ধেও কোনো মমত্ব থাকে তাহলে এই রেফিউজি ডাইনির সঙ্গে সব সম্পর্ক এক্ষুনি ত্যাগ করতে হবে। সুমনের ট্রান্সফারের জন্যে অথবা সেই ডাইনির ভেড়া স্বামীর ট্রান্সফারের জন্যেও পাটনাতে তাঁরা মুরুব্বি লাগিয়েছেন সুমনের সমস্ত ভবিষ্যৎ ও তার কচি মাথা ঐ ডাইনি কাঁচা চিবিয়ে খাচ্ছে। অমন ছেনাল মেয়েছেলের কথা ওঁরা জন্মে শোনেননি।
বড় ভুল হয়ে গিয়েছিল আমার। হাওয়াই-এর ইতিহাসটা বাড়িতে রেখে এসেছিলাম। আমার ঘুম হবে না। কামেহামেহার সঙ্গে থাকলেই ভালো করতাম।
পরে মনে হল, এ চিঠিটা স্মিতাকে দেখানো উচিত। আমার মতো স্বামী বলে কী আমার চোখের সামনে যা নয় তাই করে বেড়াবে। ওদের মধ্যে সম্পর্ক কতদূর গড়িয়েছে তা কে জানে? এই সম্পর্কে সুমনের উৎসাহই বেশী ছিল, না স্মিতার নিজের, তা ভগবানই জানেন। এ সংসারে ভালোমানুষির শাস্তি এইভাবেই পেতে হয়। ভালোমানুষ মানেই বোকা মানুষ। যে নিজের জরু গরু শক্ত হাতে পাহারা দিয়ে রাখতে না পারে তার মান-সম্মান এমনি করেই ধুলোয় লুটোয়। বড় বিশ্বাসঘাতক, অকৃতজ্ঞ, কৃতঘ্ন এই পৃথিবী এই মেয়েছেলের জাত এরা কার ছেলে কখন কোলে করে বড় করে ফেলে তা আমার মতো ভেড়া স্বামীর জানার কথা নয়।
দা ল্যাম্ব। মেড়া। সত্যি সত্যিই আমি একটা ভেড়া!
৪.
সুমনের জ্বর যেদিন ছাড়ল সেদিনও লিকুইডের ওপর রাখল স্মিতা ওকে। পরদিন সুমন যা যা খেতে ভালোবাসে—সুজির খিচুড়ি, মুচমুচে বেগুনী, কড়কড়ে করে আলুভাজা, হট-কেসে ভরে খাওয়ার নিয়ে গিয়ে খাইয়ে এল স্মিতা।
জ্বর ভালো হতেই সুমন একদিন বলল, রোজ রোজ আমাদের বাড়ি এসে খাওয়া-দাওয়া করতে ওর অসুবিধা হয় এবার থেকে ছোটুয়াই বেঁধে-বেড়ে দেবে ওকে। তা ছাড়া, সাতদিন পর তো ও চলেই যাচ্ছে। বলল, স্মিতার কষ্ট এবার শেষ হবে।
সুমনের বিয়েতে সুমন আমাদের কাউকেই কলকাতায় যেতে বলল না। আমাদের নামে ওদের বাড়ি থেকে কোনো কার্ডও এল না। সুমনই একটা কার্ডে কালো কালি দিয়ে আমাদের নাম লিখে পাঠিয়ে দিল ছোটুয়ার হাতে।
স্মিতা আমাকে বলল, বিয়ে করতে যাচ্ছেন, ভারী লজ্জা হয়েছে বাবুর। বিয়ে যেন আর কেউ করে না। নিজে হাতে কার্ড দিতেও লজ্জা!
সুমন যেদিন যায়, রাঁচি হয়ে গেল ও। আমরা বাস স্ট্যান্ডে ওকে তুলে দিয়ে এলাম। চালু বলল, কাকীমাকে নিয়ে এসো কিন্তু সুমনকাকু, আমরা খুব বল খেলব।
স্মিতা হেসে বলল, তোমার ঘর ফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখব, স্টেশনে তোমাদের আনতে যাব আমরা। সেদিন তোমার বাড়িতে রান্নাবান্নার পাট রেখো না। আমাদের বাড়িতেই খাওয়া-দাওয়া করবে থাকবে সারা দিন।
সুমন জবাব দিলো না কোনো।
শুধু বলল, চলি।
বাসটা ছেড়ে দিলো।
সুমন চলে যাওয়ার পরই আমাদের বাড়িটাতে আশ্চর্য এক বিষাদ নেমে এল সুমন এর আগেও অনেকবার ছুটিতে গেছে। কিন্তু এবারের যাওয়াটা অন্যরকম। যে সুমন বাসে উঠে চলে গেল সেই সুমন আর ফিরবে না এই টোড়িতে আমি সে কথা জানতাম। স্মিতাও জানতো। যদিও ভিন্নভাবে
এবারে গিয়ে অবধি একটাও চিঠি দিলো না সুমন স্মিতাকে। আমাকে না জানিয়ে ছেদীলালকে পোস্টাপিসে পাঠাতে স্মিতা চিঠির খোঁজে। স্মিতার মানসিক কষ্ট দেখে আমি এক পরম পরিতৃপ্তি পেতাম। যে নিজে কাউকে আঘাত দিতে শেখেনি, দুঃখ দিতে জানেনি, তার অদেয় আঘাত ও দুঃখ যে অন্যজনকে অন্য কোণ থেকে এসে বাজে এই জানাটা জেনে ভারী ভালো লাগছিল। আমার।
মনে মনে বললাম, শাস্তি সকলকেই পেতে হয়। তোমাকেও পেতে হবে, স্মিতা।
স্মিতা আমার সঙ্গে কোনোদিনও সুমনের এই হঠাৎ পরিবর্তন সম্বন্ধে আলোচনা করেনি। সুমনের সঙ্গেও করেছিল বলে জানি না করলেও তা আমার জানার কথা নয়। ওদের সম্পর্কটা গভীর ছিল বলেই সুমনের হঠাৎ পরিবর্তনের আঘাতটা স্বাভাবিক কারণেই বড় গভীরভাবে বেজেছিল ওর বুকে।
এ কথা বুঝতাম।
স্মিতা মুখ বুজে সংসারের সব কর্তব্যই করত। আমাকে খেতে দিত। জামা-কাপড় এগিয়ে দিতা লেখাপড়ার টেবিল গুছিয়ে রাখত। শোওয়ার সময় মশারি খুঁজে দিত তারপর নিজে বারান্দায় গিয়ে বসে থাকত। মাঝরাতে উঠে বাথরুমে যেতে গিয়েও দেখতাম স্মিতা বারান্দায় বসে আছে অন্ধকারে।
বলতাম, শোবে না?
পরে। অস্ফুটে বলত ও।
শুধোতাম, মশা কামড়াচ্ছে না?
ও বলত, নাঃ।
আমি মনে মনে বলতাম, পোড়ো, নিজের কৃতকর্মের আগুনে পুড়ে মরো নিজে।
ব্যাটারীতে-চলা একটা রেকর্ড প্লেয়ার ছিল আমাদের বাড়িতে বিয়ের সময় কে যেন দিয়েছিল। তাতে ঐ সময় একটা গান প্রায়ই চাপাত স্মিতা। রবিঠাকুরের গান ‘মোরা ভোরের বেলায় ফুল তুলেছি দুলেছি দোলায়, বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায়…’ ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রথম লাইন পুরানো সেই দিনের কথা…
রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্বন্ধে আমার কোনো আসক্তি নেই। খুব বেশী শুনিও নি। কিন্তু ঐ গানটার মধ্যে একটা চাপা দুঃখ ছিল। সেটা আমার অসহ্য লাগতা।
একদিন স্মিতা সন্ধ্যাবেলায় পাণ্ডে সাহেবের বাড়িতে গিয়েছিল চানুকে নিয়ে তাঁর মেয়ের জন্মদিনে। সেই সময় তাক থেকে বই নামাতে গিয়ে আমার হাতের ধাক্কা লেগে রেকর্ডটা মেঝেয় পড়ে ভেঙে গেল।
আমি কী অবচেতন মনে রেকর্ডটাকে ভাঙতেই চেয়েছিলাম? জানি না।
বুধাই-এর মা শব্দ শুনে দৌড়ে এল। আমি বললাম, বই নামাতে গিয়ে পড়ে গেল। এগুলো তুলে রাখো বউদি এলে দেখে যে কী করবে, বউদিই জানে।
স্মিতা ফিরে এসে শুনলা ও ভাঙা টুকরোগুলোকে ফেলে না দিয়ে যত্ন করে তুলে রাখল। আমাকে কিছুই বলল না। জবাবদিহিও চাইল না।
‘আরেকটি বার আয়রে সখা প্রাণের মাঝে আয়,
মোরা সুখের দুখের কথা কব প্রাণ জুড়াবে তায়’…
খেতে দাও বলে চেঁচিয়ে উঠলাম। কখনওই চেঁচাই না আমি। কিন্তু সে রাতে চেঁচালাম। কি জানি, কেন?
স্মিতা আমাকে খেতে দিলো। চানুকে খাওয়ালো।
আমি বললাম, খাবে না?
নিরুত্তাপ নৈর্ব্যক্তিক গলায় বলল, তোমরা খাও। এই-ই তো খেলাম খিদে নেই। পরে খাবো।
আমি বুঝতে পারছিলাম স্মিতা আমার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে।
বুধাই-এর মা বলল, তুমি বিমার পড়বে, মাঈজী। কিছুই খাওয়া-দাওয়া করছো না তুমি!
স্মিতা ওকে ধমকে বলল, তুমি চুপ করো তো! অনেক খাই।।
আমি আঁচাতে আঁচাতে ভাবছিলাম সুমন চলে যাবার পর সত্যিই অনেক রোগা হয়ে গেছে স্মিতা। কিন্তু কী বলব, কেমন করে বলব ভেবে পেলাম না। শুধু বললাম, নিজের শরীরের অযত্ন করলে নিজেই ঠকবে।
স্মিতা আমার কথার কোনো জবাব দিলো না আমার হাতে লবঙ্গ দিলো। রোজ যেমন দেয়া। তারপর আমার সামনে থেকে নিঃশব্দে চলে গেল।
কাল সুমনরা আসবে।
স্মিতা আর আমি দুজনেই গাড়ি নিয়ে রাঁচী গিয়ে ফিরায়েলালের দোকান থেকে সুমন আর সুমনের স্ত্রী অলকার জন্যে আমাদের সাধ্যাতীত প্রেজেন্ট কিনে এনেছি। ফুলের অর্ডার দিয়ে এসেছি কাল সকালের বাসে টাটকা মাছ, ফুল, রাবড়ি, সন্দেশ সব নিয়ে আসবে বলে বাসের ড্রাইভারকে টাকা এবং বকশিশও দিয়ে এসেছি।
স্মিতার ভাই নেই আমারও নেই। বেশ ভাইয়ের বিয়ে, ভাইয়ের বিয়ে মনে হচ্ছে আমাদের।
ভোর পাঁচটা থেকে উঠে পড়েছে স্মিতা এ ক’দিনে অনেক রোগা হয়ে গেছে ও সত্যিই। কিন্তু চেহারাটা যেন আরও সুন্দর হয়েছে। চোখ দুটি আরও বড় বড় কালো কাজল টানা বিরহ। মানুষকে সুন্দর করে চোখের সামনেই দেখছি।
অন্যান্য রান্না করতে-না-করতেই মাছ এসে গেল। দই-মাছ করেছে কাতলা মাছেরা খুব ভালোবাসে সুমনা মুড়িঘণ্টা মাছের টক। মুরগীর কারি। পোলাটা সঙ্গে তো মিষ্টি ও রাবড়ি আছেই। রাতের জন্য আরও বিশেষ বিশেষ পদ। ফিশ-রোল।
আমি অফিসে একবার বুড়ি-ছুঁয়েই চলে এসেছি। অফিসে সুমনের সব সহকর্মীরাও উৎসুক হয়ে কখন ওরা এসে পৌঁছায়, তার প্রতীক্ষায় ছিল। আমার এখানেই চলে আসতে বলেছি। সক্কলকে সুমনের ‘বড়ো-ভাই’ হিসেবে। ওদের সকলের জন্যে মিষ্টি-টিষ্টিও এনে রেখেছি। বউ দেখে মিষ্টিমুখ করে যাবে বলে।
স্মিতা রান্না-বান্না এগিয়ে নিয়েই সুমনের কোয়ার্টারে গেল ফুলশয্যার ঘর সাজাতে নিজের আলমারী খুলে নতুন ডাবল-বেডশীট, বেডকভার, ডানলোপিলো বালিশ, মায় আমার সাধের কোলবালিশটাকে পর্যন্ত ধোপাবাড়ির ওয়াড় টোয়ার পরিয়ে ভদ্রস্থ করে নিয়ে চলে গেছে।
এমনই ভাব যে, সুমন নতুন বউ-এর সঙ্গে শোবে না তো যেন স্মিতার সঙ্গেই শোবে।
মেয়েদের ভালোবাসার রকমটাই অদ্ভুত।
যে সময়ে ওদের আসবার কথা, সে সময়ে ওরা এলো না। আমি দুবার খোঁজ নিলাম অফিসে কোনো ফোন এসেছে কি না রাঁচী থেকে তা জানার জন্যে রাঁচী এক্সপ্রেস ভোরেই পৌঁছয়া রাঁচী থেকে আসা সব বাসও চলে গেল।
দুপুরের খাওয়ার-দাওয়ার সব তৈরী, এমন সময় আমাদের অফিসের চৌধুরী এসে বলল যে, তার কাছে সুমন চিঠি লিখেছে যে, প্লেনে আসছে কোলকাতা থেকে। এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা আসবে এখানে। বিকেল বিকেল পৌঁছবো রাঁচীর মেইন রোডের কোয়ালিটিতে লাঞ্চ করো আমাকে কিছুই জানায়নি শুনে চৌধুরীও খুব অবাক হল।
স্মিতাকে জানালাম। বললাম, চলো, তাহলে বসে থেকে আর লাভ কী হবে? আমরা খেয়েই
নিই।
স্মিতা আমাকে খেতে দিলো। কিন্তু নিজে খেলো না। বলল, সারাদিন রান্নাঘরে ছিলাম, গা বমি-বমি লাগছে।
স্মিতা এই খবর শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলা ওর আনত চোখে বড় ব্যথা দেখলাম
সন্ধ্যের মুখে মুখে সুমন আর অলকা এল ট্যাক্সিতে করে সঙ্গে কোয়ালিটির খাবারের প্যাকেটা রাঁচীর কোয়ালিটি থেকে তন্দুরী চিকেন আর নান নিয়ে এসেছে রাতের খাওয়ার জন্যে
এ খবরটা আমি আর স্মিতাকে দিলাম না।
ওরা যেহেতু আমাদের বাড়িতে এলোই না, অফিসের সকলে ওখানেই গেল। বু
ধাই-এর মা এবং আমি নিজে মিষ্টি-টিষ্টি সব বয়ে নিয়ে গেলাম ওর কোয়ার্টারে। সুমনের দাদা হিসাবে সকলকে যত্ন-আত্তি করলাম।
সকলে বলল, বউদি কোথায়? ভাবিজী কোথায়?
আমি বললাম, আসছে।
তারপর আমি নিজেই স্মিতাকে নিতে এলাম। দেখলাম, স্মিতা চান করে সুমনের কোলকাতা থেকে আনা সেই সুন্দর লাল আর কালো সিল্কের শাড়িটা পরেছে। কানে সুমনের দেওয়া বেদানার দানার মত রুবির দুল। গায়ে সুমনেরই ইন্টিমেট পারফুমের গন্ধ।
আমি বললাম, চলো স্মিতা।
স্মিতা বলল, সুমনের স্ত্রী কেমন দেখলে?
আমি বললাম, দেখিনি এখনও।
চানু আগেই বুধাই-এর মায়ের সঙ্গে চলে গিয়েছিল আমি আর স্মিতা এগোলাম।
আমাদের দেখে সুমন উঠে দাঁড়াল। স্ত্রীকে বলল, এই যে রবিদা আর বউদি।
সুমনের স্ত্রী উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে আমাকে নমস্কার করল। স্মিতার দিকে ফিরেও তাকাল না।
সুমন ঠাণ্ডা, নৈর্ব্যক্তিক গলায় বলল, বউদি, কেমন হয়েছে আমার বউ?
স্মিতা মুখ নীচু করে বলল, ভালো খুব ভালো।
বলেই বলল, তোমরা খেতে রাতে আমাদের ওখানে যাবে তো?
অলকা কাঠ-কাঠ গলায় সুমনের দিকে তাকিয়ে বলল, রাতের খাওয়ার তো নিয়ে এসেছি রাঁচী থেকে! কষ্ট করার কী দরকার ওঁদের?
স্মিতা কিছুই বলতে পারল না।
আমি বললাম, তোমরা যা ভালো মনে করো, করবে।
অফিসের সহকর্মীরা হই হই করে উঠলো। বলল, ইয়ার্কি নাকি? দাদা বউদি কাল রাঁচী থেকে বাজার করে আনলেন, সারা দিন ধরে রান্না করলেন বউদি, আর তোমরা খাবে না মানে? এ কেমন কথা?
অলকা আমাকে বলল, তাহলে এখানেই যদি পাঠিয়ে দ্যান। আমরা বড় টায়ার্ড।
চানু কিছুক্ষণ সুমনের কোলের কাছে ঘেঁষাঘেঁষি করে বুঝলো যে, সুমনের ওপর তার যে নিরঙ্কুশ দাবি ছিল তা আর নেই। শাড়ি-পরা একজন নতুন মহিলা এখন তার সুমনকাকুর অনেকখানি নিয়ে নিয়েছে। সুমনকাকু বল খেললো না, তাকে কাঁধে চড়াল না, তাকে তেমন আদরও করল না দেখে সে তার মায়ের আঁচলের কাছে সরে গেল। শিশুরা আদর যেমন বোঝে, অনাদরও।
স্মিতা সুমনকে বলল, তাহলে তাই-ই হবে। খাওয়ার সব এখানে পাঠিয়ে দেবো। ক’টায়। পাঠাবো?ন’টা নাগাদ?
সুমন এই প্রথমবার চোখ তুলে তাকাল। স্মিতাকে দেখল ওর ভালোবাসায় মোড়া শাড়িতে, ওর আদরে দেওয়া রুবির দুল পরা স্মিতা। কিন্তু স্মিতা যে খুব রোগা হয়ে গেছে তাও নিশ্চয়ই ওর চোখে পড়ল। সুমনের চোখ দুটি এত আনন্দের মাঝে হঠাৎ ব্যথায় যেন নিষ্প্রভ হয়ে উঠল। এক মুহূর্ত স্মিতার মুখে তাকিয়ে থেকেই চোখ নামিয়ে বলল, আচ্ছা বউদি, ন’টার সময়ই। পাঠিও।
সঙ্গে সঙ্গে সুমনের স্ত্রী সুমনের দিকে তাকাল।
স্মিতা চানুকে নিয়ে, পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরে গেল। আমি রয়ে গেলাম, তক্ষুনি চলে গেলে খারাপ দেখাতো। চেনা-জানা এত লোক চারপাশে।
কত লোক কত কথা বলছিল, রসিকতা, হাসি ঠাট্টা ওদের শোবার ঘর ভারী সুন্দর করে সাজানো হয়েছে একথা সকলেই বলল।
অলকা কোনো মহিলাকে জিজ্ঞেস করল, কে সাজালেন শাওয়ার ঘর?
তিনি বললেন, রবিদাদার স্ত্রী, স্মিতা বৌদি।
অলকা বলল, তাই-ই বুঝি!
অতিথিরা একে একে প্রায় সকলেই চলে গেলেন বুধাই-এর মা আর ছোটুয়া যতক্ষণ না ওদের খাওয়ার নিয়ে এলো ততক্ষণ আমাকে থাকতেই হল বুধাই-এর মা এসে বলল বউদির শরীর খারাপ সারাদিন রান্নাঘরে ধকল গেছে—বাড়ি গিয়েই শুয়ে পড়েছিল। এই খাবার-দাবার কোনোরকমে বেড়ে দিয়ে আবার শুয়ে পড়েছে।
তারপর বুধাই-এর মা সুমনের দিকে তাকিয়ে বলল, বউদি আসতে পারলো না।
সুমন একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল কথাটা শুনে।
অলকা আমাকে বলল, আপনি তাহলে যান ওঁর কাছে। শরীর খারাপ যখন।
আমি বললাম, আপনারা একা একা খাবেন?
চৌধুরী বলল, আরে দাদা, ওরা তো এখন একাই থাকতে চাইছে। দেখছেন না, আমাদের সকলকে কীভাবে তাড়িয়ে দিচ্ছে।
আমি হাসলামা হাসতে হয় বলল। তারপর বললাম, আচ্ছা তাহলে তোমরা ভালো করে খেও। দু-একজন কৌতূহলী, অত্যুৎসাহী মহিলা বাসরে বর-বউকে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্যে রয়ে গেলেন
সুমন দরজা অবধি এলো একা একা। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আমাকে কী যেন বলবে বলবে করল, তারপর বলল না। শুধু বলল, আচ্ছা রবিদা।
আমি যখন বাড়ি ফিরলাম তখন রাত প্রায় দশটা বাজে। চানু ঘুমিয়ে পড়েছে। বুধাই-এর মা একা বসে আছে খাওয়ার ঘরে, মোড়া পেতে, দেওয়ালে মাথা দিয়ে।
বুধাই-এর মা বলল, দাদাবাবু, আপনি খাবেন না?
বউদি খেয়েছেন?
বউদির শরীর ভালো না। শুয়ে রয়েছেন।
আমি বললাম, আমাকে এক গ্লাস জল দাও বুধাই-এর মা। আমিও খাবো না। শরীর ভালো নেই।
বুধাই-এর মা জল এনে দিয়ে হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা।
আমি চমকে উঠে তাকালাম তার দিকে। তার চোখেও দেখলাম বড় ব্যথা।
বললাম, তুমি খেয়ে শুয়ে পড়ো বুধাই-এর মা।
বুধাই-এর মা বলল, আমার খিদে নেই একদম।
শোওয়ার ঘরে গিয়ে দেখি স্মিতা সেখানে নেই। পাশের ঘরে ঢুকলাম। দেখি, চানুর পাশে স্মিতা উপুড় হয়ে সন্ধেবেলার সেই লাল-কালো সিল্কের শাড়িটা পরেই শুয়ে আছে। ওর হালকা ছিপছিপে সুন্দর গড়নে চানুর পাশে অল্পবয়সী ওকে চানুর মা বলে মনেই হচ্ছিল না।
আমি কাঠখোট্টা লোক। বুঝি কম। ভাবি কম। কিন্তু কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে-পড়া আমার চেয়ে দশ বছরের ছোট আমার ছেলেমানুষ স্ত্রীর দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলাম দরজায় দাঁড়িয়ে।
তারপর ঘরে ফিরে গিয়ে জামা-কাপড় ছেড়ে পায়জামা-গেঞ্জি পরে আমি ইজিচেয়ারে শুলামা
অন্ধকার রাতে তারারা সমুজ্জ্বল। জঙ্গলের দিক থেকে মিশ্র গন্ধ আসছে হাওয়ায় ভেসে শিয়াল ডাকছে লাতেহারের দিকের রাস্তা থেকে গোঁ গোঁ করে মাঝে মধ্যে দুটি একটি মার্সিডিস ডিজেল ট্রাক যাচ্ছে দূরের পথ বেয়ে আজ বাইরেও রাত বড় বিধুরা রাতের পাখিরা একে
অন্যের সঙ্গে কথা বলছে। ঝিঝির একটানা ঝিনঝিনি রবের ঘুমপাড়ানি সুর ভেসে আসছে। জঙ্গলের দিক থেকে।
ইজিচেয়ারে শুয়ে আমি কত কী ভাবছিলাম এমন সময় ঘরে একটা মৃদু খসখস শব্দ হল। পারফুমের গন্ধে ঘরটা ভরে গেল। স্মিতা কথা না বলে সোজা এসে আমার বুকের মধ্যে মুখ খুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
আমার মধ্যে যে খারাপ মানুষটা বাস করে সে বলল, আঘাত দাও ওকে। এমন শিক্ষা দাও যে, জীবনে যেন এমন আর না করে। ওর প্রতি এক তীব্র ঘৃণা ও অনীহাতে আমার মন ভরে উঠল। ভীষণ নিষ্ঠুর হয়ে উঠল আমার মধ্যের সেই আমিত্বময় সাধারণ স্বামী।
কান্নার বেগ কমলে আমি বললাম, কি হলো?
ও বলল, আমার জন্যে আজ তোমার এত লোকের সামনে… আমার জন্যেই। আমি জানি।
আমি চুপ করে রইলাম।
আমাকে তুমি শাস্তি দাও।
কিসের শাস্তি?
ভুলের শাস্তি।
আমি বললাম, ব্যঙ্গাত্মক স্বরে, ভালোবেসেছিলে বলে অনুতাপ হচ্ছে?
স্মিতা এবার মুখ তুলল। আমার পায়ের কাছে হাঁটু-গেড়ে বসে বলল, আমার যে বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামী ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসা…
আমি বললাম, আমিই কি বললাম? বললাম, আমার কী এমন রূপ গুণ আছে যাতে তোমার শরীরে ও মনে চিরদিন একা আমিই সর্বেসর্বা হয়ে থাকতে পারি? সংসারের একজন স্বামীরই কী আছে?
তারপর একটু চুপ করে থেকে ওর মাথায় হাত রেখে বললাম, আমার ভাগে যা পড়েছিল তাই ই তো যথেষ্ট ছিল সেই ভাগের ঘরে কোনো শূন্যতা তো কখনও অনুভব করিনি স্মিতা। সত্যিই করিনি।
স্মিতা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল তার বোকা, অগোছালো, ভুলোমনের স্বামীর দিকে।
দূরের ঝাঁটি জঙ্গল ভরা মহুয়াটাঁড়ে চমকে চমকে রাতচরা টি-টি পাখিরা ডেকে ফিরছিল। হাওয়া দিয়েছিল বনে বনে কারা যেন ফিসফিস করছিল বাইরে।
ভাবছিলাম, এই মুহূর্তে আর একজন মানুষ সুমন তার নব-পরিণীতা স্ত্রীকে বুকে নিয়ে শুয়ে আছে। স্মিতারই ভালোবাসার হাতে-পাতা বিছানাতো।
সুমন এখন কী ভাবছে কে জানে? কিন্তু যদি স্মিতার কথা সুমন একবারও ভাবে তাহলে আমার মতো সুখী এ মুহূর্তে আর কেউই হবে না।
অনেক বছর আগে বিয়ের রাতে যজ্ঞের ধোঁয়ার মধ্যে বসে যেসব সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলাম তার বেশিরই মানে বুঝিনি। সেদিন আমি আমার কোনো যোগ্যতা ব্যতিরেকেই স্বামী হয়েছিলাম স্মিতার
স্মিতা কাঁদছিল নিঃশব্দে। আমার বুক ভিজে যাচ্ছিল ওর চোখের জলে। কিন্তু ভীষণ ভালোও লাগছিল।
স্মৃতিতে হঠাই বউভাতের রাতটা ফিরে এল তখন মা বেঁচে ছিলেন। জ্যাঠামণি, রতনমামা। স্মিতার বাবাও আরো কেউ কেউ আজ যাঁরা নেই। আমার পুরোনো বন্ধুরা, কত আনন্দ, কল্পনা সে-রাতে সুগন্ধ, সানাই…
স্মিতার মাথায় হাত রেখে বসে থাকতে থাকতে আমার হঠাৎ মনে হলো যে যে-আমি টোপর মাথায় দিয়ে সমারোহে গিয়ে স্মিতাকে একদিন তার পরিবারের শিকড়সুষ্ঠু উপড়ে এনেছিলাম তার সঙ্গে যে মানুষটা তার স্ত্রীর সুখে দুঃখে জড়াজড়ি করে অনেক অবিশ্বাস ও সন্দেহ পায়ে মাড়িয়ে বিবাহিত জীবনের কোনো বিশেষ বিলম্বিত মুহূর্তে সত্যিই স্বামী হয়ে উঠলাম, তাদের দুজনের মধ্যে বিস্তরই ব্যবধান
‘বর হওয়া’ আর ‘স্বামী হওয়া’ বোধহয় এক নয়।