Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » স্বামী-স্ত্রী || Swami Stree by Manik Bandopadhyay

স্বামী-স্ত্রী || Swami Stree by Manik Bandopadhyay

রাত দশটায় মেনকা ঘরে এল। এ বাড়িতে সকাল সকাল খাওয়াদাওয়ার হাঙ্গামা চুকে যায়।

ছোট ঘর, চওড়ার চেয়ে লম্বায় দুহাতের বেশি হবে না। মেনকার বিয়েতে মেনকার স্বামী গোপালকে দেওয়া খাটখানাই ঘরের অর্ধেক জুড়ে আছে। খাটের সঙ্গে কোণাচেভাবে পাশ কাটানোর কৌশলে পাতা আছে গোপালের ক্যাম্পচেয়ার, চারদিকেই চেয়ারটির পাশ কাটিয়ে চলাফেরা সম্ভব। সামনে ছোট একটি টুলে পা উঠিয়ে এই চেয়ারে চিৎ হয়ে গোপাল আরাম করে বিড়ি মেশাল দিয়ে সিগারেট খায় আর বই পড়ে। পপুলার বই–উঁচুদরের বই যারা লেখেন তাদের পর্যন্ত–যে-বই পড়ে সময় কাটিয়ে মনকে বিশ্রাম দিতে হয়। ঘরের এককোণে ট্রাংক ও সুটকেস-স্টিল, চামড়া আর টিনের। ট্রাংকটি মেনকার বিয়ের সময় পাওয়া। রং এখনো উজ্জ্বল, তবে কিসে ঘা লেগে যেন একটা কোণ থেবড়ে গেছে। দেয়ালে কয়েকটি বাজে ছবি আর মেনকা ও গোপালের বড় একটি ফটো টাঙানো। শাড়ি, শাড়ি পরার ঢং, গয়নার আধিক্য আর চুল বাধার কায়দা ছাড়া ফটোর মেনকার সঙ্গে যে মেনকা ঘরে এল তার বিশেষ কোনো তফাত চোখে পড়ে না। গায়ে একটু পুরন্ত হয়েছে মনে হয়, আবার সন্দেহও জাগে। ফটোর গোপালের চেয়ে ক্যাম্পচেয়ারের গোপাল কিন্তু অনেক রোগা। এতে ফটোর ফাঁকি নেই, বিয়ের পর সত্যই গোপাল রোগা হয়ে গেছে। বিয়ে করার জন্য অথবা চাকরি করার জন্য বলা কঠিন, চাকরি আর বিয়ে তার হয়েছে প্রায় একসঙ্গে।

ঘরে এসে দরজায় খিল তুলে দিয়ে মেনকা শেমিজ ছাড়ল। খাটের প্রান্তে পা ঝুলিয়ে বসে জোরে জোরে পাখা চালিয়ে বলল, বাবা, বাঁচলাম।

গোপাল বই নামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে সায়-দেওয়া হাসি একটু হাসল। তারপর আবার বই তুলে নিল।

উহ মাগো, সেদ্ধ হয়ে গেছি একেবারে।

এবার গোপাল বই নামাল না, পড়তে পড়তেই বলল, বিশ্রী গরম পড়েছে।

টেবল ফ্যানটা তুমি আর কিনলে না।

তুমি শাড়িটা না কিনলে–

ন্যাংটো হয়ে তো থাকতে পারি না।

পাখার হাওয়া গায়ে লাগাতে তাই সে এ রকম হয়ে আছে। ঘর যেন নির্জন, একজোড়া চোখও যেন ঘরে নেই। তিন মাস বাপের বাড়িতে কাটিয়ে সাত দিন আগে এখানে এসেছে। প্রথম দিন এভাবে হাওয়া খেতে পারেনি। ছি, লজ্জা করে না মানুষের! একদেহ, একমন, একপ্রাণ যারা, তিন মাসের ছাড়াছাড়ি তাদের এমনি করে দেয়, দেখা হওয়ামাত্র চট করে এক হয়ে যেতে পারে না। তিন মাস তারা পরস্পরকে কল্পনা করেছে, কামনা করেছে, ব্যথা আর ব্যর্থতার নিশ্বাস ফেলেছে, মুক্তির আস্বাদ আর স্বাধীনতার গৌরবে আনন্দ অনুভব করেছে শাস্তির মতো, রাত জেগেছে, আবেগের চাপে সময় সময় দম যেন আটকে এসেছে কয়েক মুহূর্তের জন্য। কত অভিনব পরিবর্তন ঘটেছে দুজনের মনেই দুজনের। দেখা হবার পর আবার একদেহ, একমন, একপ্রাণ হতে খিল দেওয়া ঘরে একটা রাতের, অন্তত আধখান বা সিকিখান রাতের, সময় লাগবে বৈকি। যন্ত্রের পার্টস খুলে আবার ফিট করতে পর্যন্ত সময় লাগে–বিধাতা মিস্ত্রি হলেও লাগে।

শরীরের ঘাম শুকিয়ে গেলে মেনকা পুবের দুটি পরদা লাগানো জানালার একটিতে গিয়ে দাঁড়াল। পাশের একতলা বাড়ির ছাতে গরম জোছনার ছড়াছড়ি। তার পরের তেতালা বাড়ির সাতটা জানালা দিয়ে ঘরের আলো বাইরে আসছে। আজকাল কখন সবগুলো জানালার আলো নেভে কে জানে! বিয়ের পর কিছুদিন এ খবরটা সে জানত। চারটে জানালা অন্ধকার হত প্রায় এগারটায়, দুটি হত বারটার কাছাকাছি, আর তেতালার কোণের জানালাটি নিভত রাত দেড়টা- দুটোর সময়। ওই ঘরটিতে কে বা কারা থাকে তাই নিয়ে সে কত কল্পনাই করেছে। অন্য সম্ভবপর কল্পনাগুলো তার মনে আমল পেত না, পরীক্ষার পড়া করতে ও-ঘরে কাউকে রাত জাগতে দিতে সে রাজি ছিল না, তার কেমন বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল তেতালার ওই কোণের ঘরটিতে তাদের মতো এক দম্পতি থাকে, বিয়ে যাদের হয়েছে অল্পদিন। তাদের মতো ভালোবাসতে-বাসতে কখন রাত দুটো বেজে যায়। ওদেরও খেয়াল থাকে না। তারা অবশ্য আলো নিভিয়ে দেয় অনেক আগেই। বাড়ির ভেতরের দিকে তাদের জানালাটি শুধু ঘন শার্সির, ঘরের মধ্যে নজর চলে না কিন্তু আলো জ্বলছে কি না জানা যায়। ওদের তেতলার কোণের ঘরটিতে হয়তো আলো জ্বালিয়ে রাখার অসুবিধা নেই।

বাপের বাড়ি থেকে ফিরে আসবার দিন তারা প্রায় রাত তিনটে পর্যন্ত জেগে ছিল। কিন্তু সেদিন ও-বাড়ির জানালার দিকে তাকাতে খেয়ালও হয়নি। মেনকা আপন মনে আফসোসের অস্ফুট আওয়াজ করল। সে রাত্রে বড় বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল। এক রাত্রে সব একঘেয়ে হয়ে গেল, বাপের বাড়ি যাওয়ার আগে একটানা ছমাস একসঙ্গে কাটিয়ে যেমন হয়েছিল।

ঘুম আসছিল। আফসোসটাই যেন ঘুম কাটানোর বেশি কী করে দিয়ে গেল মেনকার। স্তিমিত চোখের একটু চমক আর পিঠের ঠিক মাঝখানে মৃদু শিরশির। গোপাল মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে। পড়ায় বাধা দিলে সে বড় বিরক্ত হয়। কিছু বলে না, কিন্তু বিরক্ত হয়।

বিছানায় ফিরে গিয়ে মেনকা ইতস্তত করে, যতক্ষণ না তার মনে পড়ে যায় যে বেশি রাত জেগে বই পড়লে গোপালের মাথা গরম হয়ে যায়। ঘুম ভাঙিয়ে তাকে বড় জ্বালাতন করে গোপাল। মনে হয়, শান্ত সুবোধ মানুষটা যেন বদলে গেছে, মদ খেয়েছে। এমন বিশ্রী লাগে মেনকার, এমন রাগ হয়! সে কি পালিয়ে যাবে? পরদিন সে কি ঘরে আসবে না? দিনের পর দিন? ঘুম ভাঙিয়ে একটা মানুষকে কষ্ট দেওয়া কেন–যার শরীরও ভালো নয়! অথচ সে যদি কোনোদিন দরকারি কথা। বলতে মাঝরাতে গোপালের ঘুম ভাঙায়–যেদিন কোনো অজানা কারণে তার নিজের ঘুম আসে না অথবা হঠাৎ ঘুম ভেঙে মনটা অদ্ভুত রকম খারাপ লাগে আর সমস্ত শরীরটা অস্থির অস্থির করায় ছটফট করতে ইচ্ছা হয়–গোপাল শুধু বলে, কাল শুনব, সকালে শুনব!

তবু যদি সে নিজেকে তার বুকে খুঁজে দেবার চেষ্টা করতে করতে করুণ সুরে বলে, ওগো শুনছ? বুকটা কেমন জ্বালা করছে।

একটু সোডা খাও, বলে সে পাশ ফিরে বালিশটা আঁকড়ে ঘুমোতে থাকে। তখন মেনকার বুকটা সত্যি জ্বালা করে। মাসে ছমাসে একটা রাতে হয়তো এরকম ঘুম আসে না অথবা এভাবে ঘুম ভেঙে যায়–হলই-বা তা অম্বলের জন্য; কথা কইবার একটা সে লোক পাবে না, পাওনা আদরের একটু তার জুটবে না এই ভয়ানক দরকারের সময়! ইতস্তত করার কয়েক মিনিটে আবার ঘুমটা ফিরে এসেছিল, হাই তুলে মেনকা বলল, শোবে না? এত যে পড়ছ, চোখ তো আবার কটকট করবে কাল?

গোপাল বলল, চ্যাপ্টারটা শেষ করেই শোব, পাঁচ মিনিট।

মেনকা শুয়ে চোখ বুজল। ঘুমে শরীর অবশ হয়ে আসবার আরাম অনুভবের ক্ষমতাটুকু প্রায় ফুরিয়ে এসেছে, বই ফেলে টুল ঠেলে চেয়ার সরিয়ে গোপালের উঠবার শব্দে একটু সচেতন হয়ে উঠল। ভয়ে ভয়ে চোখ মেলে একবার গোপালের মুখের দিকে চেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে আবার চোখ বুজল। গোপালের মাথা গরম হয়নি, ঘুম পেয়েছে। একনজর তাকালেই মেনকা ওসব বুঝতে পারে। গোপালের চোখমুখের সব চিহ্ন আর সঙ্কেত তার মনের মুখস্থ হয়ে গেছে।

আলো নিভিয়ে মেনকার পা মাড়িয়ে গোপাল নিজের জায়গায় শুয়ে পড়ল।

মেনকা জড়ানো গলায় শুধোল, কাল ছুটি না?

গোপাল জবাব দিল, হুঁ।

দুজনে মিনিট দশেক ঘুমিয়েছে, এমন সময় ট্যাক্সি করে বাড়িতে এল অতিথি। একেবারে পর নয়, সস্ত্রীক গোপালের ভায়রাভাইয়ের ভাই রসিক। গত অগ্রহায়ণে রসিক বিয়ে করেছে। বৌকে বাপের বাড়ি রেখে আসবার জন্য আজ বারটার গাড়িতে তারা রওনা হয়েছিল, সাড়ে ছটায় কলকাতা পৌঁছে আবার রাত নটার গাড়ি ধরবে। অ্যাকসিডেন্টের জন্য লাইন বন্ধ থাকায় তাদের গাড়ি কলকাতা এসেছে দশটার। সময়। এত রাত্রে কোথায় যায়, তাই এখানে চলে এসেছে। নইলে এতরাত্রে কোনো খবর না দিয়ে–

মনে করে যে এসেছ, এই আমাদের ভাগ্যি!

স্টোভ ধরিয়ে মেনকা লুচি ভাজতে বসল, গোপালের ভাই সাইকেল নিয়ে বার। হল খাবারের দোকানের উদ্দেশ্যে। অন্তত চার রকমের ছানার খাবার আর রাবড়ি আনবে, মোড়ের পাঞ্জাবি হোটেল থেকে আনবে মাংস। ঘরে ডিম আছে, মেনকা মামলেট বানাবে। বাড়িতে কুটুম এসেছে, নতুন বৌকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে, খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থায় একটু সমারোহ করা গেল না, ছি ছি।

তবে কাল বিকেলে ওদের গাড়ি, দুপুরে ভালোরকম আয়োজন করা যাবে। মাসের শেষে টাকা ফুরিয়ে এসেছে বটে, কিন্তু কুটুম বাড়িতে এলে টাকার কথা ভাবলে চলবে কেন!

পিসিমাকে মেনকা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, একখানা ভালো কাপড় তো বৌকে দিতে হবে, না পিসিমা?

দেওয়া তো উচিত।

বাড়িতে হঠাৎ অতিথি আসার উত্তেজনা ছাপিয়ে গোপালের জন্য এবার মেনকার মমতা জাগে। আবার এ মাসে বেচারিকে টাকা ধার করতে হবে। একটা মানুষ, খেটে খেটে মরে গেল, ভাই বোন মাসি পিসি সবাই লুটেপুটে তার রোজগার খাচ্ছে। তার ওপর আবার কুটুমের এসে অতিথি হওয়া চাই। একটা টেবলফ্যান কেনার সাধ পর্যন্ত বেচারার মেটে না। সেই-বা কেমন মানুষ, ঘেমেচেমে অফিস থেকে ফিরলে দশ মিনিট একটু হাওয়া পর্যন্ত করে না তাকে! আজ রাত্রে পাখার বাতাস দিয়ে ওকে ঘুম পাড়িয়ে তবে সে ঘুমোবে। এক হাতে হাওয়া করবে, অন্য হাতে মাথার চুলে–

রসিক খেতে বসল ঘেরা বারান্দায়, রসিকের বৌকে বসানো হল ঘরে। রসিকের কাছে বসলেন পিসিমা, তার বৌয়ের ডাইনে বাঁয়ে গা ঘেঁসে বসল মেনকার দুই ননদ। পরিবেশন করতে করতে মেনকা লক্ষ্য করল, এদিকে ওদিকে নড়েচড়ে বেড়াতে বেড়াতে গোপাল রসিকের বৌকে দেখছে, আগ্রহের সঙ্গে দেখছে। প্রথমে রসিকের বৌকে দেখে গোপাল যেন একটু আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। আলাপ করতে গিয়ে লজ্জায় তাকে কাবু হয়ে পড়তে দেখে যেন একটু আহত হয়েছিল। সহজ একটা ঠাট্টায় তাকে ফিক করে হাসিয়ে কথা বলাতে পারায় খুশির যেন তার সীমা ছিল না। লুচি ভাজতে ভাজতে এসব মেনকা লক্ষ্য করেছে। এখন দুজনের খাওয়া তদারকের ছুতোয় ক্রমাগত বারান্দা থেকে ঘরে গিয়ে চোখ বুলাচ্ছে রসিকের বৌয়ের সর্বাঙ্গে। অন্য কারো চোখে পড়বার মতো কিছু নয়। অন্য কারো সাধ্য নেই গোপালের চলাফেরা আর হাসিমুখে মানানসই কথা বলার মধ্যে অতিরিক্ত কিছু আবিষ্কার করে। মেনকার মতো চোখ তো ওদের কারো নেই। কিন্তু গোপাল এ রকম করছে কেন? রসিকের বৌ সুন্দরী বলে? মেয়েটার রূপ আছে, একটু কড়া ধাঁচের রূপ। যে রূপ কাপড়-জামায় বিশেষ চাপা পড়ে না, বরং আরো উগ্র, আরো অশ্লীল হয়ে দাঁড়ায়। রাস্তার লোক হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। বাড়ির মানুষ সশঙ্ক অবস্থায় দিন কাটায়। আর রূপের অহঙ্কারে রূপসীটির মাটিতে পা পড়ে না।

গোপাল শান্ত, ন্দ্র, মিষ্টি রূপ ভালোবাসে–মেনকার মতো রূপ। রসিকের বৌকে দেখে তার তো বিচলিত হবার কথা নয়।

ঘরে গিয়ে একটু খোঁচা দিতে হবে। বুঝতে হবে ব্যাপারখানা কী।

অতিথিদের খাওয়া শেষ হতেই তাদের শোয়ার সমস্যা নিয়ে পিসিমা, মেনকা আর গোপালের পরামর্শ হল।

পিসি বললেন, ভূপাল আর কানাই এক বিছানায় শোবে। ওর বৌকে অনুবিনুদের ঘরে দেওয়া যাক। একটা রাত তো।

গোপাল বলল, না না, তাই কি হয়! নতুন বিয়ে হয়েছে, ওদের একটা ঘর দেয়া উচিত। ওরা আমার ঘরে থাকবে।

পিসিমা ঢোক গিলে বললেন, তবে তাই কর।

তারপর রাত একটায় বাড়ির সব আলো নিভল। গোপাল শুল ভূপালের ছোট চৌকির ছোট বিছানায়, মেনকা শুল অনুবিন দুই ননদের মাঝখানে। রাত্রিবেলা একান্ত দুর্লভ বৌদিকে ঘটনাচক্রে কাছে পেয়ে অনুবিনুর আহ্বাদের সীমা নেই। না ঘুমিয়ে সারারাত গল্প করবে ঘোষণা করে মিনিট দশেক ফোয়ারার মতো এবং তারপর আরো দশ মিনিট ঝিমিয়ে কথা বলে আধ ঘণ্টার মধ্যে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ল। মেনকা রইল জেগে। গোপালকে তার কত কথা বলার ছিল, কিছুই বলা হল না। আজকের রাতটা কাটবে, এই দীর্ঘ অফুরন্ত রাত, তারপর সারাটা দিন যাবে, কিছুতে কাটতে চায় না এমন একটা দিন, রাত দশটায় সে গোপালের সঙ্গে কথা বলবার সুযোগ পাবে। ততক্ষণে বাসি হয়ে যাবে সব কথা। বলার কোনো মানে থাকবে না। তাছাড়া, পিসিমা কাল ওদের এখানে থেকে যেতে বলেছেন। কাল দিনটা বড় খারাপ, যাত্রা শুভ নয়। রসিকেরা হয়তো কালও এখানে থেকে যাবে, রাত্রে দখল করবে তার ঘর। তাহলে সেই পরশু রাত্রের আগে গোপালকে সে আর কাছে পাচ্ছে না। কী হতচ্ছাড়া একটা বাড়িই গোপাল নিয়েছে, একটা বাড়তি ঘর নেই। বাড়তি ঘর থাকবেই বা কী করে? ভাই বোন মাসি পিসিতে বাড়ি গিজগিজ করছে। গোপালের দোষ নেই, এই বাড়ির জন্যই মাসে মাসে পঁয়ত্রিশ টাকা ভাড়া গুনছে। সকলের সুখের জন্য খেটে খেটে সারা হয়ে গেল মানুষটা। একটু রোগাও যেন হয়ে গেছে আজকাল।

নিশ্চয় রোগা হয়ে গেছে। পরশু যখন তাকে জড়িয়ে ধরেছিল, কই, আগের মতো জোরে তো ধরে নি! কাছে থাকলে আজকেই পরখ করা যেত কতখানি দুর্বল হয়ে পড়েছে। কাল সকালে চেয়ে দেখতে হবে গোপালের চেহারা কেমন আছে। কাল থেকে একটু বেশি মাছ দুধ খাওয়াতে হবে তাকে।

এখন গিয়ে যদি একবার দেখে আসে? ভূপাল আর কানাই নিশ্চয় ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু আলো জ্বালালে যদি ওদের ঘুম ভেঙে যায়। অন্ধকারে গায়ে হাত বুলোতে গেলে গোপাল যদি জেগে যায়।

আজ রাত্রে কিছু হয় না। আজ সে ফাঁদে পড়ে গেছে। হার্টফেল করে এখন সে যদি মরেও যায়, গোপালের একটু আদর পাবে না। কোনো উপায় নেই, কোনো ব্যবস্থা করা যায় না। একটা বাড়তি ঘর যদি বাড়িতে থাকত। রাত্রির স্তব্ধতা মেনকার কানে ঝমঝম শব্দ তুলে দেয়। ছুতো আর কৈফিয়তের আশ্রয় ছেড়ে, যুক্তি আর সঙ্গতির স্তর অতিক্রম করে, চিন্তা তার সোজাসুজি স্পষ্টভাবে গোপালকে চেয়ে বসে। পুরনো অভ্যস্ত মিলনের পুনরাবৃত্তি। তারপর মেনকা মরে যেতে রাজি আছে।

শুনছ?

একসঙ্গে শীত আর গ্রীষ্ম অনুভব করে মেনকা শিউরে উঠল।

জানালার শিকে মুখ ঠেকিয়ে গোপাল গলা আরেকটু চড়িয়ে বলল, ঘুমিয়েছ নাকি? আমায় একটা অ্যাসপিরিন দিয়ে যাও।

মেনকা সাড়া দেবার আগেই ঘরের এক প্রান্ত থেকে পিসিমা বললেন, কে রে, গোপাল? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?

না গরমে মাথা ধরেছে। অ্যাসপিরিন খাব। তুমি উঠো না। উঠো না কিন্তু পিসিমা। তোমার উঠে কাজ নেই।

মেনকা দরজা খুলে বেরিয়ে এল।

অ্যাসপিরিন যে ঘরে রয়েছে?

তবে অ্যাসপিরিন থাক। ছাতে গিয়ে একটু শুই। ভূপালদের ঘরটা বড় গরম।

খোলা ছাতে শোবে! অসুখ করে যদি?

কিছু হবে না। একটা পাটি বিছিয়ে দাও।

ঘর থেকে মেনকা পাটি আর বালিশ নিয়ে এল–একটি বালিশ। বারান্দা পার হয়ে ছাতের সিঁড়ির দিকে যাবার সময় তাদের ঘরের সামনের শার্সির জানালার কাছে। তাকে দাঁড় করিয়ে গোপাল চুপিচুপি বলল, দেখেছ? এর মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে!

শার্সি অন্ধকার। রসিকের নাক ডাকার শব্দ বাইরে শোনা যাচ্ছে। মেনকা বলল, ঘুমোবে না? রাত কি কম হয়েছে!

ছাতে পাটি বিছিয়ে মেনকা বালিশ ঠিক করে দিল। গোপাল শুধাল, তোমার বালিশ আনলে না?

আমিও শোব নাকি এখানে?

গোপাল হাত ধরতেই সে পাটিতে বসে পড়ল।–সবাই কী ভাববে!

গোপাল জড়িয়ে ধরতে কিছুক্ষণ তার শ্বাস বন্ধ হয়ে রইল। আর সিঁড়ি ভাঙতে পারি না। একটা বালিশেই হবেন।

তেতালা বাড়ির কোণের সেই ঘরের জানালাটা আলিসার উপর দিয়ে দেখা যাচ্ছিল। এখনো সে ঘরে আলো জ্বলছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *