তৃতীয় চিঠি
রাতের খাওয়ার পর বারান্দায় বসেছিলাম। কর্নেল পাহাড়ি অর্কিড নিয়ে বকবক করছিলেন। আমি বৃষ্টির আশা করছিলাম। রাতের বৃষ্টির সৌন্দর্য এমন করে কখনও বুঝিনি। কিন্তু আকাশে মেঘ নেই। নক্ষত্রমালায় এ রাত আজ অন্য সাজে সেজেছে।
শুয়ে পড়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। কিন্তু কর্নেল বললেন, আর একটু বসো জয়ন্ত। আশা করছি, আজ রাতেই রহস্যের শেষটুকু ফঁস হয়ে যাবে।
অগত্যা বসতে হল। বললাম, ফাস হতে আর বাকি কি আছে? খুনি রাকেশ শর্মা, সেটা তো স্পষ্ট। অচিন্ত্য যেভাবে হোক, শব্দছকের ধাঁধা ছাড়িয়ে স্বস্তিকা উদ্ধার করেছিল। তাকে মেরে স্বস্তিকা হাতিয়ে রাকেশ তার লাশ পুঁতে রেখেছিল। অতি উৎসাহী বটকৃষ্ণবাবু কলকাতা থেকে আমাদের সঙ্গে ফিরে কেল্লাবাড়িতে গিয়ে নিশ্চয় লাশ পুঁতে রাখার চিহ্ন দেখেছিলেন। তাই ভোরবেলা লাশ খুঁড়ে বের করতে–
ওই দেখ। সম্ভবত মিঃ পাণ্ডের জিপ আসছে।
উত্রাই পথের নিচে আলোর ঝলক দেখতে পেলাম। জিপ গেটের কাছে এসে হর্ন দিলে কৃপানাথ দৌড়ে গিয়ে তালা খুলে গেট ফাঁক করল। জিপটা এসে পোর্টিকোর তলায় থামল।
মিঃ পাণ্ডে এবং এক প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা নেমে এলেন জিপ থেকে। কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে সম্ভাষণ করলেন, আসুন মিসেস সাঁতরা।
ইনিই তা হলে দয়াময়ী সাঁতরা। উজ্জ্বল গৌরবর্ণা ব্যক্তিত্ববতী মহিলা। মুখে মানসিক শক্তির ছাপ স্পষ্ট। পরনে সাদা থান। কাঁধে একটা কিটব্যাগ ঝুলছে। সেটা টেবিলে রেখে শান্তভাবে বসলেন। মিঃ পাণ্ডে বললেন, সোজা স্টেশন থেকে এখানে আসছি। উনি বললেন, আগে আপনার সাথে দেখা করতে চান।
দয়াময়ী বললেন, আপনাকে আগে বলা উচিত, বাচ্চুর মৃত্যুতে আমি দুঃখিত হইনি। দুধ দিয়ে কালসাপ পুষেছিলাম। ও আমার জীবনে কাটার মতো বিধত। এবার আমি হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি।
কর্নেল বললেন, আপনি আমাকে ওর সম্পর্কে কিছু জানাননি।
ইচ্ছে করেই জানাইনি। এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে ওই খামটা সম্পর্কে আমার কৌতূহল ছিল তাই ভেবেছিলাম, আপনিই এই অদ্ভুত ধাঁধার জট ছাড়াতে পারবেন।
ছাড়িয়েছি। কিন্তু আগে প্রশ্নের উত্তর দিন। বাচ্চু কবে কলকাতা থেকে এখানে এসেছিল?
দয়াময়ী একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, ও মাঝে মাঝে কিছু না জানিয়ে উধাও হয়ে যেত। গত ১৩ জুলাই দুপুরে খেয়ে বেরিয়ে যায়। তারপর আর পাত্তা পাইনি। হঠাৎ আজ এখান থেকে পুলিশ ট্রাঙ্ককল করে জানাল–
আপনার দেবর নবকুমারবাবু আপনার কাছে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ। রায়বাবুর সঙ্গে মামলা মিটমাটের জন্য বলছিল। আমি বলেছি, ভেবে দেখি।
বটকৃষ্ণবাবু কি আপনার কাছে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ। বটো প্রায় যেত। বাচ্চুর সঙ্গে ওর ভাব ছিল। আমি বটোকে পাত্তা দিতাম না। বটোর দুমুখো স্বভাব ছিল।
নবকুমারবাবু আপনার ওখানে থাকার সময় কি বটকৃষ্ণবাবু গিয়েছিলেন?
না। নব বেরিয়ে যাওয়ার একটু পরে বটো গিয়েছিল।
তা হলে বটকৃষ্ণবাবু নবকুমারবাবুকে আপনার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে থাকবেন। কিংবা নবকুমারবাবু আছেন জেনে বাইরে উনি অপেক্ষা করছিলেন। যাই হোক, বটকৃষ্ণবাবু আপনাকে কি বলেছিলেন?
বাচ্চুর কথা জিজ্ঞেস করল। বললাম, বাচ্চু নেই। বটো বেহায়া লোক ছিল। খেতে চাইল। খেতে দিলাম। খেয়েদেয়ে চলে গেল। দশটা টাকা চাইল। তাও দিলাম।
বাচ্চু যাওয়ার আগে টাকা চেয়েছিল আপনার কাছে?
পাঁচশো টাকা ধার চেয়েছিল। ধার চাওয়াতে আমার রাগ হয়েছিল। অনেক সাধাসাধির পর তিনশো টাকা দিয়েছিলাম।
অনিলবাবুর সঙ্গে তো আপনার সম্পর্ক ভাল?
অনিল ওর বাবা আর দাদার মতো কুচুটে নয়। আমাকে খুব ভক্তিশ্রদ্ধা করে। আমি এলে অনিল আর ওর বউ খোঁজখবর নেয়। অনিল বাচ্চুর বন্ধু। হলেও বাচ্চুর মতো খামখেয়ালি বা দুষ্টু প্রকৃতির ছেলে নয়। বাচ্চুকে নিয়ে আমার ঝামেলার শেষ ছিল না কর্নেলসায়েব।
কিন্তু গতমাস থেকে অনিলবাবুর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কি আগের মতো আছে?
দয়াময়ীর চোখে চমক লক্ষ্য করলাম। অনিল কিছু বলছিল নাকি?
হ্যাঁ। গতমাসে এখানে এসে আপনি শাসিয়েছিলেন ওকে।
ওকে শাসাব কেন? ওর বাবাকে আর দাদাকে শাসিয়েছিলাম। শাসাব না? আমার ঘরের তালা ভেঙে জিনিসপত্র তছনছ করবে, আর আমি চুপ করে থাকব?
পুলিশকে জানাননি কেন?
দয়াময়ী আস্তে বললেন, কিছু চুরি যায়নি, তাই। কিন্তু ঘরের ভেতরটা লণ্ডভণ্ড করে রেখেছিল।
চোর কি কিছু খুঁজেছিল বলে আপনার মনে হয়?
পরে মনে হয়েছে।
আপনার ঘরে এমন কি থাকতে পারে যে চোর তা খুঁজবে?
এবাড়িতে তেমন দামি কিছু রাখিনি। শুধু কিছু আসবাবপত্র, বিছানা আর রান্নাবান্নার জিনিস। পার্টিশন করা বাড়ি। অন্য পাশে অনিল থাকে। তাই অনিলের গায়ে লেগে থাকতে পারে। না–আমি অনিলের নাম ধরে শাসাইনি।
নবকুমারবাবু বলছিলেন, অনিল তার ঘর থেকে কিছু দলিলপত্রের ফাইল চুরি করে আপনাকে দিয়েছে। তাই অনিলকে তিনি পৃথগন্ন করে দিয়েছেন।
দয়াময়ী বাঁকা মুখে বললেন, আমার স্বামীর দলিলপত্রের ফাইল। নব তা লুকিয়ে রাখবে, চাইলে দেবে না বাহ্। কেল্লাবাড়ির বড় রায়বাবুর কাছে আমার স্বামী গঙ্গা-যমুনা নামে দুটো পুকুর আর মাঝখানের জমিটা পুরো কিনেছিলেন। ওতে নবর শেয়ার নেই। সেই দলিলপত্র নব লুকিয়ে রেখেছিল। কাজেই আমি কোনও অন্যায় করিনি। বাচ্চু অনিলের বন্ধু। বাচ্চু অনিলকে বলেকয়ে ফাইলটা হাতাতে রাজি করিয়েছিল। তা অনিলকে বুঝি সেইজন্য টাকাকড়ি দিইনি? বলুক তো আমার সামনে।
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, আপনি ট্রেনজার্নিতে ক্লান্ত। আর একটা প্রশ্ন করব।
যত খুশি প্রশ্ন করুন।
শব্দছকের কাগজটা কি আপনি কখনো বাচ্চুকে দেখিয়েছিলেন?
দয়াময়ী একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, বছর তিনেক আগের ব্যাপার। তখন আমি এখানেই থাকি। খামটা ভুল করে ছিড়িনি–তা আপনাকে কলকাতায় বলেছি, কৌতূহলী হয়েই ছিঁড়েছিলাম। কিছু বুঝতে না পেরে টেবিলের ড্রয়ারেই রেখেছিলাম। তারপর হঠাৎ মনে পড়েছিল, আমার স্বামী বলতেন গঙ্গা-যমুনার তলায় নাকি কোন আমলের যক্ষের ধন পোঁতা আছে শুনেছি। মনে পড়ার পরই খামটা আলমারির লকারে লুকিয়ে রাখি। এখন বাচ্চু ওটা তার মধ্যে দেখে ফেলতেও পারে। কেল্লাবাড়িতে যক্ষের ধনের গুজব ভীমগড়ে বরাবরই চালু আছে।
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। ঠিক আছে। আপনি বিশ্রাম করুন গিয়ে। দরকার হলে যোগাযোগ করব।
পাণ্ডে বললেন, মিসেস সাঁতরা। আপনি গাড়িতে বসুন। জাস্ট এ মিনিট।
বলে উনি কর্নেলকে বারান্দার শেষ প্রান্তে ডেকে নিয়ে গেলেন। চাপা স্বরে কিছু কথাবার্তা হল। তারপর উনি জিপে গিয়ে বসলেন। স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। এতক্ষণে দেখতে পেলাম, জিপের পেছনের খোঁদলে কজন সশস্ত্র কনস্টেবল বসে আছে।
কর্নেল বললেন, সওয়া এগারোটা বাজে। চলো, শুয়ে পড়া যাক।
ঘরে ঢুকে বললাম, সত্যিই দজ্জাল মহিলা। বান্ধব পাঠাগারের ইন্দুবাবু ঠিকই বলছিলেন।
কর্নেল বাথরুমে গিয়ে রাতের পোশাক পরে এলেন। তারপর বিছানায় শুয়ে বললেন, সুখবর ডার্লিং। আশা করি তোমার সুনিদ্রা হবে। রাকেশ শর্মা জেরার মুখে কবুল করেছে, ১৪ জুলাই সন্ধ্যার একটু আগে সে এবং বাচ্চু কেল্লাবাড়ির সেই ঢিবিতে বসে কথা বলেছিল। কথা একটা চোরাই জিনিস নিয়ে। খুব দামি জিনিস। পাটোয়ারিজি দেখলেই নাকি কিনে নেবেন। তারপর রাকেশ গিয়ে মালিকের সঙ্গে কথাবার্তা বলে আসে। কিন্তু বাচ্চুর আর খোঁজ পায়নি। বাচ্চু রাকেশের বাড়িতে উঠেছিল, তাও সত্য। তো রাকেশ বরাবর দেখেছে, বাচ্চু ওইরকম খামখেয়ালি। তাই তার নিপাত্তা হয়ে যাওয়া নিয়ে মাথা ঘামায়নি। আর হ্যাঁ, রাকেশ বলেছে যে, বাচ্চুকে কোনও চিঠি লেখেনি। ইনল্যান্ড লেটারটা তাকে দেখিয়েছে পুলিশ। ইংরেজিতে টাইপ করা চিঠি। তলার সইটা রাকেশের সইয়ের সঙ্গে মেলেনি।
অন্য কাউকে দিয়ে সই করিয়েছে। ধূর্ত লোক।
কর্নেল জড়ানো গলায় বললেন, এখন আমাদের দরকার আর একটা চিঠি। তা হলেই কেল্লা ফতে। সেই চিঠিটা নিশ্চয় লেখা হয়েছিল এবং ১৩ জুলাই রাকেশের চিঠির সঙ্গে কলকাতা পৌঁছেছিল। আর বটকৃষ্ণবাবুর চিঠি পয়লা জুলাই লেখা। অথচ পৌঁছুল ১৪ দিন পরে–যখন বাচ্ছ কলকাতা থেকে চলে এসেছে। ভীমগড় ডাকঘরের ডেটস্ট্যাম্পে তারিখ ধেবড়ে গেছে। সে যাই হোক, বটকৃষ্ণবাবু কেন বাচ্চুকে পত্রপাঠ আসতে লিখেছিলন? চিঠিটা কলকাতা পৌঁছুতেই বা এত বেশি সময় লাগল কেন? দেরিতে পোস্ট করেছিলেন?
জবাব দেবার জন্য বটকৃষ্ণবাবু আর ইহলোকে নেই। ছেড়ে দিন।
নাহ্। তার হয়ে জবাব দেবার লোক আছে। দেখা যাক।
কর্নেলের নাক ডাকা শুরু হল। এইরকম ওঁর ঘুম। সামরিক জীবনে নাকি গাছের ডালেও ঘুমিয়ে পড়তেন।
পরদিন যথারীতি কর্নেলের ডাকে ঘুম ভাঙল। প্রকৃতিবিজ্ঞানী প্রাতঃভ্রমণ সেরে এসেছেন। হাতে একগুচ্ছ অর্কিড়। সুপ্রভাত বলে সম্ভাষণ করে জানালেন, কেল্লাবাড়ির জঙ্গলে পাথরের ফাঁকে এর খোঁজ পেয়েছেন।
হঠাৎ রাতের কথাটা মনে পড়ে গেল। বললাম, সেই তৃতীয় চিঠিটা খুজতেই কি কেল্লাবাড়ি গিয়েছিলেন?
কর্নেল হাসলেন। বাচ্চুকে মেরে তার লাশ যেখানে পোঁতা হয়েছিল, সেখানে মাটি নেই। লাইম কংক্রিটের চাবড়ার ভূপ। কাজেই খুনিকে কষ্ট করে খুঁড়তে হয়নি। চাবড়াগুলো সরালেই ফুট তিনেক গর্তের তলায় ঘরের মেঝে। সেখানে লাশ ঠেলে ঢুকিয়ে চাবড়াগুলো চাপিয়ে দিলেই পাকা কবর তৈরি হয়ে গেল। মুসহর বস্তির লোকেরা জাত শিকারি। কাজেই শেয়াল আসার চান্স নেই। শকুনও টের পাবে না। কারণ সেই কবরের ওপর ভাঙা ছাদের অংশ ঝুলছে। হ্যাঁ, মুসহররা কুকুর পোষে। কিন্তু ওদিকে গড়খাইয়ে এখন গভীর জল। কাজেই লাশ কোনও দিনই আবিষ্কৃত হত না।
আহ্। চিঠিটা–
হ্যাঁ। দুটো চিঠি আস্ত রেখে নিজেরটা বুদ্ধিমান খুনি হাতিয়ে নিয়েছিল। যাক শত্রু পরে পরে। কিন্তু তখন অন্ধকার রাত। হয়তো বৃষ্টিও পড়ছিল। চিঠিটা সাততাড়াতাড়ি ছিঁড়ে কুচি কুচি করে কবরের চাবড়ার তলায় খুঁজে রেখেছিল। ওখানে বৃষ্টি বাঁচানো ভাঙা ছাদ আছে। কাজেই ভেজেনি। কিন্তু আমার অবাক লাগছে, পুলিশ কবর খুঁড়ে লাশ বের করল। অথচ নীল রঙের কুচিগুলো চোখে পড়ল না কেন? পুলিশ রুটিন ওয়ার্কে পটু। তাই অত লক্ষ্য করেনি। বলে কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে রুমালে জড়ানো চিঠির কুচিগুলো বের করলেন। জয়ন্ত। বাথরুমে যাওয়ার আগে ফ্যান বন্ধ করে যাও। এগুলো উড়ে যাবে। দেখা যাক, কতটা মেলাতে পারি।
ফ্যান বন্ধ করে বাথরুমে গেলাম। এরপর ফিরে এসে দেখলাম, কর্নেল তখনও নীলচে কুচিগুলো মেলাচ্ছেন। কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম, একেকটা কুচিতে একটা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত হরফ পড়া যাচ্ছে। একটু পরে কৃপানাথ কফি দিয়ে গেল। কর্নেল কফির পেয়ালা তুলে বললেন, এনাফ। বরাবর দেখে আসছি, খুনি নিজের অজ্ঞাতসারে এমন কিছু চিহ্ন রেখে যায়, যা তাকে ধরিয়ে দিতে সাহায্য করে। হয়তো ব্যস্ততা কিংবা অতিবুদ্ধি, অথবা আতঙ্ক।
কার চিঠি বুঝতে পারছেন?
কর্নেল চারটে কুচির দিকে আঙুল রাখলেন। একটাতে বৃহ দ্বিতীয়টাতে ব তৃতীয়টাতে শব্দা এবং চতুর্থটাতে শুধু ন। কর্নেল হাসলেন। কিছু বুঝলে?
নড়ে বসলাম। মাই গুডনেস। বৃহৎ বঙ্গীয় শব্দাভিধান। তার মানে, এই চিঠি অনিলবাবু লিখেছিলেন। কর্নেল, আপনি কি বলতে চান অনিলবাবুই দু-দুটো খুন করেছেন?
চুপ। রহমত আসবে জিপ নিয়ে। আমরা এখনই বেরুব।