হাসপাতালে ঢুকে
হাসপাতালে ঢুকে তার মনে হল ডক্টর দত্ত তাকে কী বলবেন? দশদিন হল শ্রাবণী এখানে আছে আর সে একবারও আসেনি। হয়তো ওপরে গেলে দেখবে অভিজিৎ বসে আছে। এত রাজনীতি করেও অভিজিৎ নিশ্চয়ই শ্রাবণীর জন্যে সময় দিচ্ছে।
সেই একই ভিড় চেম্বারে। দরজায় বেয়ারা নেই। ভরত ভেতরে ঢুকে একপাশে দাঁড়াল। ডক্টর দত্ত আর একটু বৃদ্ধ হয়েছেন। ফর্সা রঙ যেন একটু ম্লান। একজন রুগির সঙ্গে কথা বলছিলেন। শেষ করে তাকতে ভরতকে দেখতে পেলেন, আজ আমি আর নতুন কেস দেখতে পারব না ভাই। আপনি কাল আসুন।
ভরত ঢোঁক গিলল। উনি তাকে চিনতে পারেননি। সে এক পা এগিয়ে বলল, আমি ভরত। প্রেসিডেন্সিতে পড়তাম। শ্রাবণী!
ওহো। তাইতো। কেমন আছ তুমি?
ভাল। শ্রাবণী কেমন আছে?
তোমার সঙ্গে তো ওর অনেকদিন যোগাযোগ নেই, তাই না?
হ্যাঁ।
আমি ওকে তোমার কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ও তাই বলল। কথা শেষ করে ডক্টর দত্ত সামনে বসা এক ভদ্রলোককে বললো, মনে হচ্ছে আগামী সপ্তাহে আপনার ভাইকে ছেড়ে দিতে পারব। ও খুব ভাল ইমপ্রুভ করছে।
ভদ্রলোক কথা বলতে লাগল। ভরত লক্ষ্য করল ডাক্তারের কাছে এলে কিছু কিছু মানুষের কথা যেন শেষ হতে চায় না। ডক্টর দত্ত যেভাবে তার সঙ্গে কথা শেষ করলেন তাও পছন্দ করল না সে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে কতক্ষণ থাকা যায়।
ডক্টর দত্ত শার্টের হাতা সরিয়ে ঘড়ি দেখলেন, আপনারা একটু বসুন। বলে উঠে দাঁড়ালেন। ভরতের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, এসো।
অতএব ভরত তাঁকে অনুসরণ করল। হাঁটতে হাঁটতে হক্টর দত্ত বললেন, আজ একজন বিখ্যাত চিত্রপরিচালক এসেছিলেন আমার কাছে। উনি এখানে তার পরের সিরিয়ালের শু্যটিং করতে চান। ব্যাপারটা আমার এক্তিয়ারে নয়। বলেছিলাম জেনে নিয়ে জানিয়ে দেব। হসপিটাল কর্তৃপক্ষদের সঙ্গে আমিও একমত এখানে শুটিং করলে পেশেন্টদের অসুবিধে হবে। ওদের কাজের সঙ্গে এখানকার আবহাওয়ার মিলমিশ হবে না। ভদ্রলোক যে টেলিফোন নাম্বার দিয়েছেন তাতে শুধু রিঙ হয়ে যাচ্ছে।
ওঁকে কি খবরটা আজকেই দেওয়া দরকার?
হ্যাঁ।
আমাকে নামটা বলুন আমি দিয়ে আসব।
রাজেশ মুখার্জি। নিউথিয়েটার্স স্টুডিওতে অফিস।
ওরা ওপরে উঠে এসেছিল। একটা বিরাট হলঘরের দরজায় ডক্টর দত্ত দাঁড়াতেই নার্স ছুটে এল। সম্ভবত এখন ওঁর ওখানে যাওয়ার সময় নয়। ভরত দেখল এই ঘরটা অনেক বড়। এর আগেরবার শ্রাবণী এতবড় ঘরে ছিল না। তার মানে এটা জেনারেল বেড। বিভিন্ন বেডের রুগিদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ডক্টর দত্ত যেখানে গেলেন সেখানে শ্রাবণী শুয়ে আছে। তার চোখ। বন্ধ। পেছনে আসা নার্সকে জিজ্ঞাসা করলেন, ঘুমোচ্ছে নাকি?
নার্স ঝুঁকে পড়ল, ডাক্তারবাবু এসেছেন।
শ্রাবণী চোখ খুলল। আরও রোগা আরও বিবর্ণ এবং মাথার চুলগুলো খুবই উস্কোখুস্কো হয়ে আছে। ডক্টর দত্ত ধমকালেন, কী ব্যাপার মাদার, ঘুমোচ্ছ কেন?
শ্রাবণী হাসার চেষ্টা করল, একটু আগে আবার রক্ত বেরিয়েছে।
তাতে কী হয়েছে। ফোড়া হলে পুঁজ বের হবেই। উঠে বসো। দেখি।
ডক্টর দত্ত বললেন, সাহেবের এতদিন বাদে আমাদের কথা মনে এসেছে। শোনো সাহেব, তোমার বন্ধুদের খবর দাও। আমাদের আবার কয়েক বোতল রক্ত দরকার। আজ হলে আজই নইলে কাল। তোমরা কথা বলো। ডাক্তার দত্ত বেরিয়ে গেলেন।
ভরত আড়ষ্ট পায়ে কাছে এল, এরকম কবে থেকে হল?
শ্রাবণী ক্লান্ত গলায় বলল, হয়ে গেল।
আমি জানতাম তুমি ভাল আছ।
কী করে জানলে এখানে আছি।
আজ তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম।
কেন?
এমনি।
এতদিন পরে?
জবাবটা দিতে পারল না ভরত। যা সত্যি তা ওকে বলা যায় না। সে মুখ ঘুরিয়ে বলল, আমি জানতাম অভিজিৎ তোমাকে দেখাশোনা করছে।
অভিজিৎদাকে দেড়বছর দেখিনি।
সেকি?
কেন?
না, ও আমাকে বলেছিল তোমার পার্সেন্টেজের জন্যে লড়াই করছে। তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া-আসা করছে।
চেষ্টা করেছিল, হয়তো এখন সময় পায় না। পরীক্ষা দিয়েছ?
হ্যাঁ।
কেমন হল?
জানি না। আমি তো আর পড়ব না।
কেন?
পড়ে কী হবে! তোমার মা ভাল আছেন?
আমার যা অবস্থা তাতে মা কী করে ভাল থাকে। এবারে সুপার ফুল ফ্রি করেননি। ওষুধ কিনে দিতে হচ্ছে না কিন্তু আর সব দিতে হবে। বারংবার যদি একজন সুযোগ পায় তাহলে নতুনরা বঞ্চিত হবে।
তাহলে তো তোমার মায়ের উপর চাপ পড়েছে।
হু। মাকে বলেছি বিয়ের কথা ভেবে যেসব গয়না গড়িয়েছিল একসময় তাই বিক্রি করে দিতে। আমার তো ওসবের প্রয়োজন নেই।
একথা বলছ কেন? তুমি নিশ্চয়ই ভাল হয়ে যাবে।
দুবছর যেতে না যেতে এরকম হল, এরপর মাস চারেকের মাথায় হবে। তারপর চলে যেতে হবে। আগে গেলে মায়ের কষ্ট কম হত।
দূর! তুমি বেশি ভাবছ। শোনো। বলতে গিয়ে থেমে গেল ভরত।
শ্রাবণী তাকিয়ে থাকল। ভরত পাশের টুলে বসে নিচু গলায় বলল, আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি এতদিন খবর নিইনি বলে। সে বিছানার পাশে পড়ে থাকা শ্রাবণীর আঙুলগুলো স্পর্শ করল। আঙুলগুলো একটুও নড়ল না। কিন্তু শ্রাবণীর চোখের কোল টলটল করে উঠল। ভরত উঠে দাঁড়াল। বিকেলে আসব। বলে সে দাঁড়াল না।
রাস্তায় বেরিয়ে ওর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। নিজেকে অপরাধী বলে মনে হচ্ছিল। শ্রাবণী আর বেশিদিন বাঁচবে না নাহলে ডক্টর দত্ত তার প্রশ্নের জবাব দেননি কেন? তার মনে পড়ল আজ অথবা আগামিকালের মধ্যে ওর জন্যে রক্ত দরকার। কিন্তু কাদের বলবে সে? কলেজে এখন পরিচিত ছেলেরা নেই। আগে যেমন ক্লাসে গিয়ে অ্যাপিল করলে কাজ হত এখন নিশ্চই তা হবে না। বোঝাই যাচ্ছে শ্রাবণী আর কলেজের ছাত্রী নেই। ওর মনে হল অভিজিতের কাছে গেলে কাজ হতে পারে। অভিজিতকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে?
বেশ কয়েকটা জায়গায় খোঁজখবর নিয়ে শেষ পর্যন্ত অভিজিতের বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে সেখানে উপস্থিত হল ভরত। বাড়ির সামনে একটা গাড়ি আর জনা তিনেক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। অভিজিৎ নাকি একটু আগেই ফিরেছে, স্নানখাওয়া সেরেই বেরিয়ে যাবে। ভরতকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। তার মনে হলো অভিজিৎ এ মধ্যে তার থেকে অনেক বেশি মূল্যবান করতে পেরেছে নিজেকে।
বাইরে বোধহয় তাকে দেখে অভিজিৎ হবাক হলে, কিরে, হঠাৎ?
তোর সঙ্গে একটা কথা ছিল। ভারত ওর সঙ্গীদের দিকে তাকাল।
বল।
শ্রাবণী আবার অসুস্থ হয়েছে। ডক্টর দত্ত বলছেন আজই রক্ত দরকার।
শ্রাবণীর সঙ্গে তোর যোগাযোগ আছে?
মিথ্যা কথা বলল ভরত, হ্যাঁ। ও এখন আসেমব্লি অফ গড চার্চ হসপিটালে আছে।
ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে হলে আমি বলে দিতে পারি।
না। ফ্রেশ ব্লাড ছাড়া হবে না।
ও। অভিজিতকে একটু চিন্তিত দেখাল। তারপর সঙ্গীদের একজনকে কাছে ডেকে বলল, জনা পাঁচছয় কর্মীকে আজই অ্যাসেমব্লি অফ গডচার্চ হসপিটালে গিয়ে ডক্টর দত্তর পেশেন্ট শ্রাবণীর জন্যে ব্লাড ডোনেট করে আসতে বলো। যারা একবছরের মধ্যে রক্ত দেয়নি তাদেরই বলবে।
ছেলেটা বলল, তেমন কাউকে কি পাওয়া যাবে। এত ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প হচ্ছে, কেউ তো বাকি নেই। প্রত্যেকেরই কার্ড হয়ে গেছে।
চেষ্টা করে দ্যাখো। এটা হওয়া চাই-ই।
ঠিক আছে। হবে। ছেলেটি মাথা নাড়ল।
অভিজিৎ হাসল, বল ভরত, আর কী দরকার?
অনেক ধন্যবাদ। আর কিছু চাই না।
তুই এখন কী করছিস?
বসে আছি।
একদিন পার্টি অফিসে আয় না। সন্ধের সময় রোজ থাকি। ও হ্যাঁ, তোর সঙ্গে রবীনদার সম্পর্ক কীরকম? তোদের ওখানেই তো থাকে!
দেখা হলে কথা হয়, এই আর কি!
লোকটার সঙ্গে সম্পর্ক রাখিস, আখেরে কাজ দেবে। অভিজিৎ হাসল, কোনদিকে যাবি?
টালিগঞ্জে। একেবারে না ভেবেচিন্তে জবাব দিল ভরত।
বাঃ খুব ভাল হল। আমি নাকতলায় যাচ্ছি। চল, একসঙ্গে যাওয়া যাক।
.
অভিজিতকে একটুও ভাল লাগছে না ভরতের। সমবয়সী হওয়া সত্ত্বেও ওর ভাবভঙ্গিতে বেশ দাদা দাদা ভাব। যেন পৃথিবীর সব সমস্যা এক মুহূর্তে সমাধান করে দিতে পারে। ও এমন ভাব করছে যে ভরত যেন ওর কৃপাপ্রার্থী। যেভাবে শ্রাবণীর জন্যে রক্ত জোগাড় করে দিল তাতে আর যাই থাক আন্তরিকতা মোটেই নেই। তবু ওর সঙ্গে এক গাড়িতে উঠতে হলো। ওঠার পরই অভিজিৎ আর সঙ্গীরা অন্য আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নাকতলায় যে মিটিং এ ওরা যোগ দিতে যাচ্ছে সেখানকার সমস্যা এবং সমাধানের কৌশল নিয়ে ওরা ব্যস্ত থাকল। প্রথমে বিরক্ত হলেও শেষে মনে হল এ ভালই হয়েছে। তাকে কথা বলতে হয়নি। টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোর কাছে নেমে গেল ভরত। ও শুনেছিল এর চারপাশেই নাকি ফিল্মের স্টুডিওগুলো আছে। দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করে স্টুডিওতে এসে দেখল কেউ তাকে আটকাচ্ছে না। অনেকটা হাঁটতে হয়েছে তাকে, বিরক্ত লাগছিল। টিনের দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকে মনে হল কোনও মানুষজন নেই। ভরদুপুরেও সব ফাঁকা। সে খানিকটা এগিয়ে দেখল গাছতলায় দাঁড়িয়ে দুজন লোক কথা বলছে।
রাজেশ মুখার্জিকে কোথায় পাব?
কী দরকার? একজন পাল্টা প্রশ্ন করল দ্বিতীয়জন তাকে থামাল, অ্যাই, কী হচ্ছে? আপনি ভাই সোজা চলে যাবেন। বাঁ দিকে ক্যান্টিন দেখতে পাবেন, তার পাশের বিল্ডিং-এ রাজেশদার অফিস। যান।
ফিল্ম সম্পর্কে বাইরে লোকজন ভাল কথা বলে না। ভরতও সেসব শুনেছে। কিন্তু স্টুডিওতে ঢোকামাত্র এমন মন্তব্য কানে আসবে তা ভাবতে পারেনি। ভরতের ধারণা ছিল ফিল্মের স্টুডিও মানে খুব জাঁকজমক ব্যাপার। নায়ক-নায়িকারা সেজেগুজে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু তাদের চোখে পড়া দূরের কথা, কিরকম ঘুমন্তপুরী বলে মনে হচ্ছে।
ক্যান্টিনের একটি ছেলেকে জিজ্ঞাসা করে সে দোতলা বাড়ির নিচের বারান্দায় উঠে রাজেশ মুখার্জীর ঘরের দরজায় চলে এল, আসতে পারি?
ভেতরে একটি সাজানো ঘরে দুই ভদ্রলোক আলোচনা করছিলেন। একজন একটু বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী চাই?
আমাকে অ্যাসেমব্লি অফ গড চার্চ হসপিট্যালের ডক্টর দত্ত পাঠিয়েছেন। মিস্টার রাজেশ মুখার্জির সঙ্গে দেখা করব। স্পষ্ট গলায় বলল ভরত।
টেবিলের অন্য প্রান্তে বসা মানুষটি মাথা বাড়ালেন, আসুন। বসুন। আপনাকে ডক্টর দত্ত শু্যটিং-এর ব্যাপারে পাঠিয়েছেন তো? বসুন না। হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি।
চেয়ারে বসল ভরত। তার পা ব্যথা করছিল অনেকটা হাঁটায়। সে জানত ভদ্রলোকের মুখের চেহারা এখনই পাল্টে যাবে খারাপ খবর শুনে।
রাজেশ মুখার্জি বেল টিপল। কেউ সাড়া না দেওয়ায় সামনের ভদ্রলোককে বললেন, দত্ত, আপনি একটু দেখবেন–তিন কাপ চা।
সামনের লোকটি উঠে গেল নিঃশব্দে। রাজেশ মুখার্জি এবার তাকাল, আমাদের এখানকার টেলিফোনটা আজ সকাল থেকেই খারাপ হয়ে গেছে। বিকেলবেলায় আমি কাউকে দিয়ে খবর পাঠাতাম। ব্যাপারটা হল আমরা হসপিটালে শু্যটিং করতে পারছি না। লোকেশন হিসেবে ওই জায়গাটা আইডিয়াল ছিল কিন্তু আমার ক্যামেরাম্যান খুঁত খুঁত করছেন।
ও। ভরত ঠোঁট কামড়াল। কী বলতে এসে কি শুনল!
আপনি ডক্টর দত্তকে আমার ধন্যবাদ জানাবেন।
ভরত মাথা নাড়ল। সে উঠে দাঁড়াচ্ছিল। রাজেশ মুখার্জি বাধা দিলেন, আরে, বসুন বসুন। চা আসছে। আপনি কি ওই হাসপাতালেই আছেন?
না। ডক্টর দত্ত আমার পরিচিত।
কী করেন আপনি?
এবার বি এসসি দিয়েছি।
রাজেশ মুখার্জি ওর মুখের দিকে হঠাৎই অন্যচোখে তাকালেন। ভরতের অস্বস্তি হল। এবং সেই মুহূর্তে চা এল। কাই-এর থালায় উপচে পড়া ছোট কাপে ক্যান্টিনের চা। একটু আগে বেরিয়ে যাওয়া ভদ্রলোক আবার ফিরে এসে চায়ের কাপ তুললেন।
রাজেশ মুখার্জি হাসলেন, আপনার নামটা জানতে পারি?
ভরত নাম বলল। রাজেশ মুখার্জি জিজ্ঞাসা করলেন, কোন কলেজে পড়তেন?
প্রেসিডেন্সি।
গুড। কলেজে বা কোনো গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয় করেছেন?
না।
করার ইচ্ছে আছে?
ভাবিনি কখনও।
দেখুন, আমি এবার একটা সিরিয়াল করছি টিভির জন্যে। সমরেশ বসুর গল্প। আপনার বয়সী একটা ছেলে খুঁজছি, বেশ বুদ্ধিদীপ্ত, স্মার্ট। আমাদের ফিল্ম লাইনে যারা আসে তারা স্মার্ট হবার চেষ্টা নিয়েই আসে কিন্তু মুখে কোন ছাপও নেই। আমরা নতুনদের নিয়ে অভিনয়ের ব্যাপারে যে সমস্যায় পড়ি তা আপনার ক্ষেত্রে না হলে আমাদের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
কিন্তু কোনও অভিজ্ঞতা ছাড়া কি অভিনয় করা যায়? আমি তো কিছুই জানি না। ভরত বলল।
রাজেশ মুখার্জি বললেন, আমার যখন কথা বলি তখন যা বলতে চাই তার মানেটা বলার ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিই। সেই সময় মুখচোখেও সেটা ফুটে ওঠে। এই ব্যাপারটা অভিনয় করার সময় যে যত ঠিকঠাক করতে পারবে সে তত ভাল অভিনেতা। অনুশীলন করতে করতে অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই বাড়ে। তুমি কি মনে জোর পাচ্ছ না? তুমি বললাম ভাই।
চেষ্টা করে দেখতে পারি। আমাকে কী করতে হবে?
এখানে পার্ট মুখস্থ করার কোনও ব্যাপার নেই। বেশি হলে বড় জোর আট নটা লাইন একসঙ্গে বলতে হবে। সেটা রিহার্সাল মনিটরে হয়ে যাবে। তোমার খদ্দরের পাঞ্জাবি আর পাজামা আছে? গুড়। পরশু বিকেলে চলে এসো। শু্যটিং-এর তারিখগুলো বলে দেব। রাজেশ মুখার্জি একটা খাতা বের করে এগিয়ে দিলেন, এখানে তোমার নাম ঠিকানা টেলিফোন নম্বর লিখে দাও।
ভরত লিখল। দত্ত বলল, একবার ক্যামেরাটেস্ট করলে ভাল হত না?
দরকার কি। তাছাড়া এখন ক্যামেরা কোথায় পাবেন?
টেকনিসিয়ানে স্বপন শু্যটিং করছে সিরিয়ালের। ব্রেক হলে দুমিনিটে দেখে নিতাম। ও আপত্তি করবে না। আপনারই তো সহকারী ছিল। দত্ত বলল।
রাজেশ মুখার্জি বললেন, আপনি তাহলে ওকে নিয়ে যান।
দত্ত ইশারা করতে ভরত উঠে দাঁড়াল। রাজেশ মুখার্জি বিদায় জানালেন। বাইরে বেরিয়ে এসে দত্ত বলল, দেখুন কী করতে এসেছিলেন আর কী হয়ে গেল। একেই বলে কপাল। রোজ গণ্ডায় গণ্ডায় ছেলে আসছে হাত কচলে, তাদের টপকে আপনাকে ওঁর মনে ধরে গেল। এখন ক্যামেরায় চেহারাটা ভাল এলে আর ডায়লগ বলতে পারলে লাইনে ঢুকে যাবেন।
ভরত কিছু বলল না। মিনিট সাতেক হেঁটে ওরা আর একটি স্টুডিওতে এল। এখানে কিছু মানুষ ঘুরছে। মেয়েরাও আছে। দেখা গেল দত্তকে সবাই খুব খাতির করছে। দত্ত একজনকে জিজ্ঞাসা করল, স্বপন কোন্ ফ্লোরে আছে?
একনম্বরে।
একটা বিরাট গুদামঘরের দরজায় দত্ত তাকে নিয়ে এল। টিনের দরজা বন্ধ। দত্ত সামান্য ঠেলতে ভেতর থেকে চিৎকার ভেসে এল, কাট, ওকে। নেক্সট সিন, আলো রেডি করো। লাইটস?
দত্ত বলল, আসুন।
ওরা ভেতরে ঢুকতেই চারধার আলোয় ঝলমল করে উঠল। ভরত দেখল বড় বড় আলোর স্ট্যান্ডের মধ্যে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন বাংলা সিনেমার একজন নায়িকা। পোস্টারে যাকে এত মোহময়ী দেখায় তাকে সামনাসামনি নিতান্ত আটপৌরে বলে মনে হচ্ছিল। সুদেষ্ণা ওই ভদ্রমহিলার চেয়ে অনেক সুন্দরী।
দত্তকে দেখে একটা লোক এগিয়ে এল, কি, সৌভাগ্য দাদা, তুমি? এসো এসো। তোমার শু্যটিং কবে থেকে শুরু হচ্ছে?
নেক্সট উইকে। কাজ কেমন হচ্ছে? দত্ত জিজ্ঞাসা করল।
খুব ভাল। আমার তো দু সপ্তাহ পরেই টেলিকাস্ট।
স্বপন, রাজেশবাবু এই ছেলেটির চেহারা কেমন আগে দেখতে বলেছেন। তোমার কি ক্যামেরা অন করতে অসুবিধে হবে? দত্ত জিজ্ঞাসা করল।
আরে কি আশ্চর্য! এমন কথা বলো যার মানে হয় না। ওরা আলো ঠিক করছে ততক্ষণে তুমিই ক্যামেরা হ্যান্ডেল করো।
দত্ত তখন তার পরিচিত লাইটম্যানকে আলো দিতে বলতেই সেটের একাংশ সঙ্গে সঙ্গে আলোকিত। দত্ত এবার ভরতকে বোঝাল, কোনও মেকআপ ছাড়াই নিচ্ছি। আপনি এখান থেকে হেঁটে ওই আলোর মাঝখানে যাবেন। তারপর ক্যামেরার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে একটু হাসবেন। ব্যস দত্ত চলে গেল ক্যামেরার পেছনে। ভরত দেখল ওরা ক্যাসেট পাল্টে নিল। সেটের সবাই তাকে দেখছে এখন। একটু নার্ভাস হয়ে গেল ভরত। কিন্তু সেটাকে পাত্তা না দিয়ে সে সোজা হয়ে দাঁড়াল। দত্তর গলা ভেসে এল, স্টার্ট, হাঁটুন।
ভরত হাঁটল। সোজা আলোর বৃত্তে গিয়ে ক্যামেরার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে জোরাল আলোয় ওর চোখ যেন ধাঁধিয়ে গেল। তবু সে হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু এই হাসি বেশিক্ষণ হাসলে বোকা বোকা লাগে। সে অন্যপাশে তাকাল। দত্তর গলা ভেসে এল, এবার উল্টোদিকে তাকান। গুড। পেছন ফিরুন।
ভরত হুকুম মান্য করল। স্বপনের গলা ভেসে এল, ঝুমটা এগিয়ে ধরো তো। দত্তদা, ভয়েসটাও দেখে নিন না।
ঠিক আছে। শুনুন ভাই, আপনি যে কোন একটি কবিতার লাইন বলুন তো।
ভরত দেখল একটা নোক লম্বা লাঠি তার মাথার ওপর ধরেছে। সে সুকান্তর ছাড়পত্র বলতে লাগল। পুরো কবিতাটা শেষ হতেই দত্ত চিৎকার করল, কাট। লাইটস অন।
স্বপন বলল, এই মনিটারটা চালাও।
দত্ত টিভির মতো একটা বাক্সের সামনে গিয়ে দাঁড়াল স্বপনের সঙ্গে। ভরত চুপচাপ ওদের পেছনে এল। রি-উইন্ড হচ্ছে। ছবি স্থির হল। তারপর নিজেকে দেখতে পেল সে। ইস্, আর একটু সোজা হয়ে হাঁটা উচিত ছিল তখন। ক্যামেরার দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই যেন সামান্য ছোট হল যেন। এপাশ ওপাশ তাকাচ্ছে না ব্যায়াম করছে। কিরকম পুতুল পুতুল ব্যাপার। তারপর কবিতাটা শুনল। মনে হলো কোনো কোনো শব্দ জড়িয়ে যাচ্ছে, কোথাও গলা থেমে যাচ্ছে। একবার রিহার্সল করে নিলে এইসব খুঁত থাকত না। ওরা নিশ্চই তাকে বাতিল করে দেবে। কিন্তু প্রথমে স্বপনই বলল, বাঃ।
দত্ত বলল, কোনোরকম তৈরি না হয়ে ও যা করেছে তাতে রাজেশবাবুর চিন্তা থাকবে না। দ্যাখো, এই হল পরিচালকের চোখ। ঠিক আছে ভাই, ওকে! শেষ কথাগুলো চিৎকার করে বলে ভরতের পিঠ চাপড়ে দিল দত্ত।
ভরত বেরিয়ে যাচ্ছিল স্বপন তাকে ডাকল, আপনার নাম কী ভাই?
ভরত।
অদ্ভুত। বাঙালিদের সাধারণত এই নাম হয় না। আপনি আমার সিরিয়ালে একটা কাজ করবেন? দিন পাঁচেকের কাজ। চরিত্রটা ভাল। যাকে ভেবেছিলাম তার এখন অন্য ছবির আউড়োর পড়েছে?
ভরত দত্তর দিকে তাকাল। দত্ত হাসল। তাই দেখে স্বপন বলল, আপনার সঙ্কোচের কোনও কারণ নেই। আমি আজই রাজেশদার সঙ্গে কথা বলে নেব।
ভরত বলল, দেখুন, আমি এসব নিয়ে কখনও চিন্তা করিনি আগে। তাছাড়া ঠিকঠাক পারব কিনা তাও জানি না। রাজেশবাবু নিজে থেকে আমাকে সুযোগ দিচ্ছেন। উনি যা বলবেন এখন। তাই হবে।
ওটা আমার ওপর ছেড়ে দিন। আপনার ঠিকানা আর টেলিফোন নম্বরটা দিয়ে যান। স্বপন কথাগুলো বলতেই কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো একজন এসে ডায়েরি আর কলম খুলল। ভরত বলতেই লোকটা লিখে নিল।
.
এখন প্রায় বিকেল। ট্রাম ডিপোর সামনে থেকে বাসে উঠল ভরত। কী থেকে কী হয়ে গেল! একেই কি বলে যোগাযোগ? ডক্টর দত্তর কাছে না গেলে এবং যদি রাজেশ মুখার্জির কথা না বলতেন তাহলে এইসব ঘটনা ঘটত না। সারাদিন খাওয়া হয়নি তবু একটুও টায়ার্ড লাগছে না এখন। বসার জায়গা পেতেই রাস্তার ওধারে সিনেমার হোর্ডিং দেখতে পেল। তার ছবি ওখানে ঝুলবে নাকি! কি রকম মজা লাগল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, দূর, সে তো সিনেমায়। কাজ করছে না। সিরিয়ালের হোর্ডিং হয় না। যারা সিরিয়াল করে তাদের কজনকেই বা সাধারণ মানুষ চেনে? আজকাল বাংলা সিরিয়ালের যা দুর্দশা তাতে লোকের আগ্রহও কমে গিয়েছে। মনটা একটু দমে গেল। তারপরই মনে পড়লে ওরা কেউ টাকার কথা বলেনি। কাজ করলে কত টাকা পাওয়া যাবে তা সে জানে না। জিজ্ঞেস করলেই ওরা খারাপ ভাববে। তাছাড়া তাকে যদি প্রশ্ন। করে কত টাকা চাই সে কি জবাব দিতে পারবে না সে। নিজে কাজটা কিরকম করবে তাই। জানা নেই আগে টাকার কথা কি বলা যায়? ভরতের মনে হল অভিনেতা হলে টাকা যখন পাওয়া যায় তাহলে তার রোজগারের পথ আজ খুলে গেল। অভিনেতাদের গাড়ি বাড়ি হয়, দারুণ স্টাইলে থাকে, বিদেশি সিগারেট খায়। বোম্বের মতো না হলেও কলকাতার কিছু অভিনেতা আরামেই থাকে। সফল হলে সে-ও ওই রকম থাকতে পারে। কিন্তু এমনও হতে পারে, ওরা আর তাকে ডাকল না। সে খোঁজ নিতে গিয়ে শুনল ওকে প্রয়োজন নেই, অন্য কাউকে নিয়ে। নিয়েছে, তাহলে? না, এখনই কাউকে বলা ঠিক হবে না। শেষকালে বাতিল হয়ে গেলে সবাই।
এ নিয়ে হাসাহাসি করবে। ফিল্মলাইনে নাকি সব হয়।
পার্কস্ট্রিটের মোড়ে এসে পড়ল ভরত। ছায়া বাড়ছে। এখান থেকে হসপিট্যাল অনেকটা পথ। দ্রুত হাঁটতে লাগল সে। এতক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিল, এখন ভয় করছিল। যদি অভিজিৎ তার কথা না রাখে, কেউ যদি রক্ত না দিয়ে যায়? ভরত ঠিক করল সেক্ষেত্রে সে নিজেই রক্ত দেবে। শেষবার দিয়েছিল অনেকদিন আগে; এখন দিলে কোনও অসুবিধে হবে না।
হসপিটালের ব্লাডব্যঙ্কে ডিপার্টমেন্ট গিয়ে আশ্বস্ত হল ভরত। দুজন ছেলে এসে শ্রাবণীর জন্য রক্ত দিয়ে গেছে। তাদের একজনের সঙ্গে ওর ব্লাড গ্রুপের মিল আছে। ভরত বলল, আমার ব্লাড় নিন। আমার একই গ্রুপের।
কয়েকটি প্রশ্ন করার পর ভদ্রলোক রাজি হলেন। রক্ত দেওয়ার পর যে খাবারটা ও পেল, তা যেন অমৃত মনে হল। খিদেটা আর থাকল না। অভিজিৎ জনাচারেক ছেলেকে পাঠাবে বলেছিল, অন্তত দুজন এসেছে, এও তো অনেক ভাগ্য। কাল এবং পরশুর জন্যে রক্ত জোগাড় করতে হবে। পরিচিত ছেলেমেয়েদের একটা লিস্ট তৈরি করে অনুরোধ জানাবে সে।
শ্রাবণীর বিছানার পাশে ওর মা বসেছিলেন। ভরত লক্ষ্য করল ভদ্রমহিলাকে খুবই শীর্ণ দেখাচ্ছে। সে বেডের সামনে গিয়ে দেখতে পেল শ্রাবণীকে রক্ত দেওয়া হচ্ছে। তার মানে অন্য কোনও পেসেন্টের আত্মীয়দের দেওয়া রক্তের সঙ্গে শ্রাবণীর ব্লাডগ্রুপ মিলে যাওয়ায় এটা সম্ভব হয়েছে। অভিজিতের পাঠানো যে ছেলেটির রক্ত শ্রাবণীর কাজে লাগবে না তার সঙ্গে নিশ্চয়ই এটা বদলে দেওয়া হবে।
শ্রাবণীর মা বললেন, কেমন আছ?
এই প্রশ্নের অর্থ এতদিন তোমায় দেখিনি কেন! ভরত মাথা নাড়ল যার কোনো মানেই স্পষ্ট হয় না। মায়ের গলার স্বরে চোখ খুলল শ্রাবণী। ভরতকে দেখে হাসল। ভরত বলল, রক্তের কোনো সমস্যা নেই। ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে।
শ্রাবণী একবার চোখ বন্ধ করল। তারপর বলল, বসো।
ওরা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। মাসিমা বললেন, তুই বিকেলে আপেলগুলো খাসনি? মিষ্টি ছিল তো!
আপেল খেতে ভাল লাগে না।
তাহলে কী আনব?
কিছু আনতে হবে না। আমার খেতে ভাল লাগে না।
না খেলে চলবে কেন, শরীরে জোর থাকবে কী করে।
আর জোর! শ্রাবণী নিঃশ্বাস ফেলল।
ওই হয়েছে মুশকিল। সব যেন জেনে বসে আছিস। তুমি একটু বোঝাও তো বাবা। মাসিমা ভরতের দিকে তাকালেন। ভরত কী বলবে ভেবে পেল না।
শ্রাবণী জিজ্ঞাসা করল তুমি বাড়ি থেকে আসছ?
না। একটু কাজ ছিল।
সারাদিন খাওনি?
খেয়েছি। হঠাৎ বুকের ভেতর কি যেন নড়ে উঠল। ভরত মুখ ফিরিয়ে নিল।
এইসময় নার্স এসে মাসিমাকে বললে, কয়েকটা জিনিস বাড়ি থেকে আনতে হবে।
ভরত জিজ্ঞাসা করল, তুমি পেয়ারা খেতে পার?
পেয়ারা! হঠাৎ?
আপেল ভাল লাগে না বললে। আসলে আমার কাছে আপেলকে পথ্য বলে মনে হয়। শুনেছি পেয়ারায় আপেলের চেয়ে কম গুণ নেই।
একটু ঝালমুন মিশিয়ে দিলে দারুণ লাগে।
কাল এনে দেব।
তুমি কালও আসবে?
কেন? আসব না কেন?
তোমার নিশ্চয়ই অনেক কাজ আছে।
দূর। এতদিন বেকার ছিলাম। সামনের সপ্তাহ থেকে কাজ করতে হবে।
কী কাজ? চাকরি?
না। ভরত হাসল।
তাহলে? ব্যবসা?
না। এখন বলব না। আগে কাজটা শুরু করি তারপর বলব।
শ্রাবণী মুখ ফিরিয়ে ছাদের দিকে তাকাল, তাহলে এতদিন আসনি কেন?
ভরত মাথা নিচু করল একটু, তারপর বলল, আমি তো ক্ষমা চেয়েছি।
কিন্তু দিনগুলো যে চলে গেল।
তা হোক, এখনও অনেকদিন সামনে আছে।
আমার নেই। আমার আর বেশি দিন নেই।
একদম এসব বলবে না। তুমি ভাল হয়ে যাবেই। এখন আমার ভাল সময় আসছে। আমার যারা কাছের মানুষ তাদের ভাল হবেই। ভরত জোরের সঙ্গে বলল।
তোমার কাছের মানুষ কারা?
বলতে গিয়ে থমকে গেল ভরত। কাছের মানুষ মানে কী? একসঙ্গে থাকলেই কি কাউকে কাছের মানুষ বলা যায়? বাবার সঙ্গে তার কথা হয় নেহাই প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে। সেসব কথাবার্তা কখনওই একমতে হয় না। মায়ের অনেক কিছুই সে বুঝতে পারে না। মা তাকে যেমন সব কথা খুলে বলে না, সে-ও আজকাল বেশির ভাগ কথাই মাকে বলার তাগিদ অনুভব করে না। এই দুজনের বাইরে তার তেমন কোনও বন্ধু বা আত্মীয় নেই যাকে কাছের মানুষ বলা যায়। তবু অভ্যেসে মাকেই কাছের মানুষ বলতে হবে। এখনও তার জন্যে ওঁর উদ্বেগ তিনি স্পষ্ট প্রকাশ করে ফেলেন। সে মুখ ফেরাল, মা এবং, হেসে ফেলল ভরত, এখন বলব না।
কেন?
বলার মুখ আমি রাখিনি।
কবে বলবে?
সামনের মাসে। মুখ থেকে বেরিয়ে এল ভরতের।
সময় হয়ে গেলে ভরত মাসিমাকে নিয়ে নেমে এল নিচে। মাসিমা কোনও কথা বলছিলেন না। ডক্টর দত্তর চেম্বারের সামনে ওরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। উনি চেম্বারে নেই। জানা গেল বিকেলে হসপিটালে আসেননি।
ভরত খোঁজ নিল। ডক্টর দত্তের এক সহকারী ডক্টর বললেন, স্যার নটা নাগাদ একবার আসবেন। কোনও বক্তব্য থাকলে আমাকে বলতে পারেন।
মাসিমাকে বেঞ্চিতে বসিয়ে রেখেছিল ভরত। সরাসরি জিজ্ঞাসা করল, শ্রাবণীর অবস্থা কিরকম বুঝছেন? ওকে তো আবার রক্ত দেওয়া হয়েছে।
দুটো ইনজেকশন পড়েছে। তবে প্রথমবার যেরকম রেসপন্স করেছিল এবার সেরকম হচ্ছে না। এরকম কেসে কোনো ভবিষ্যৎবাণী করা ঠিক নয়। তবে আমি জানি স্যার একজন পেশেন্টকে বারো বছর দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। সহকারী বললেন।
হঠাৎ কোনও বিপদ হবে না তো?
নিয়মিত রক্ত না দিলে হিমোগ্লোবিন খুব ড্রপ করে যায়। রেড সেলস ম্যাচিওর হওয়ার আগেই ভেঙে যাচ্ছে। বোন ম্যারো অপারেশন করা হবে কাল। স্যার এখনও আশাবাদী।
কাল কখন অপারেশন হবে?
সকালে। নটার মধ্যে আপনারা রক্ত রেডি রাখবেন। ভরত বেরিয়ে এল। মাসিমার কাছে গিয়ে বলল, চলুন।
ডাক্তারবাবু?
ওঁর আসতে দেরি হবে। আমাদের কাল সকালেই আসতে হবে।
.
ওপরে ওঠার আগে প্রণবদের ফ্ল্যাটে গেল ভরত। প্রণবের মা কর্পোরেশন থেকে কাগজপত্র পেয়ে জমি বিক্রি করতে পেরেছেন। মেসোমশাই-এর চিকিৎসা এখন ভাল ভাবেই হচ্ছে। প্রণব তাকে দেখে অবাক, কিরে?
তোকে একটা অনুরোধ করব।
বল।
আমার এক আত্মীয়ের আগামীকাল অপারেশন হবে। ব্লাডব্যাঙ্কের রক্তে কাজ হবে না। তুই সকালে গিয়ে ডোনেট করতে পারবি?
আমি? প্রণবের মুখ শুকিয়ে গেল।
যেটুকু রক্ত দিতে হয় তাতে শরীরে কোনও ক্ষতি হয় না।
সেটা শুনেছি। কিন্তু আমি কখনও রক্ত দিইনি।
দিলে দেখবি ব্যাপারটা কিছুই নয়।
এই সময় মাসীমা এলেন, নাই বা, খামোকা রক্ত দিতে যাবে কেন ও? একেই ছেলেটার শরীর দুর্বল। প্রচন্ড পরিশ্রম গিয়েছে।
ভরত বলল, মাসিমা, ডাক্তাররা পরীক্ষা করে তবেই ওর রক্ত নেবে।
তাহোক। জানি না শুনি না এমন একজনের জন্যে রক্ত দেওয়া কি ঠিক। ধরো, তোমার মেসোমশাই-এর জন্যে রক্তের দরকার পড়ল হঠাৎ, তখন কী হবে?
মাসীমার মুখটাকে একদম অচেনা মনে হচ্ছিল। ভরত চুপচাপ বেরিয়ে এল। লিফটে ওপরে উঠতে উঠতে একবার পারমিতার কথা মনে হল। পারমিতাকে অনুরোধ করবে? ইচ্ছে হল না। ওর রক্ত বোধহয় আরও বেশি মূল্যবান।
বাড়িতে ঢুকে বাবাকে দেখতে পেল ভরত। আজই বাঙ্গালোর থেকে এসেছে। মা জিজ্ঞাসা করল, সকালে থেকে কোথায় ঘুরছিস?
কাজ ছিল।
কী কাজ? আমি আজকাল তোকে একটুও বুঝতে পারি না।
মায়ের কথা বলার ধরনে হেসে ফেলল ভরত। তারপর হাত মুখ ধুয়ে চা খেতে খেতে বলল, কাল সকালে আমার সঙ্গে যেতে হবে তোমাদের।
আমাদের মানে?
তোমাকে আর বাবাকে।
বাবা মন দিয়ে বাংলা কাগজ পড়ছিল টেবিলে বসে, মুখ তুলল। কোথায়?
হসপিটালে। শ্রাবণীকে রক্ত দিতে হবে। ওর কাল অপারেশন।
শ্রাবণী? মায়ের কপালে ভাঁজ পড়ল, সেই মেয়েটা?
হ্যাঁ। ওকে রক্ত দেবার কেউ নেই। ব্লাডব্যাঙ্কের রক্তে কাজ হবে না।
বাবা বলল, আমাদের তো রক্ত দেওয়া বারণ।
কেন?
আমার প্রেসারের সমস্যা আছে, ওষুধ খাই, তা তো জানিস। আর তোর মায়ের ব্লাডসুগার বেড়েছে। ডাক্তার এখনও ওষুধ শুরু করেনি বটে কিন্তু খাওয়া-দাওয়া রেসট্রিক্ট করেছে। মেয়েটি কে?
আমাদের কলেজে পড়ত।
তোদের কলেজের ছেলেদের বল না!
তারা সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছে। ভরত বাবা মায়ের শরীর দেখল। বেশ চমৎকার চেহারা। সাজলে মাকে বেশ সুন্দরী দেখায়। মা যখন সকালে অফিসে বের হয় তখন চমৎকার হয়ে যায়। অথচ ওদের শরীরের রক্ত আর একটা মানুষের কাজে লাগবে না একথা ভাবা যায়?
চা শেষ করে সে যখন উঠে দাঁড়াচ্ছে তখন মা বলল, একবার ডাক্তারকে ফোন করে দেখি, উনি যদি আপত্তি না করেন তাহলে আমার দিতে আপত্তি কি।
বাবা বলল, আপত্তি করবেন। তোমারও বয়স হয়েছে।
ভরত বলল, যদি অপারেশনটা আমার হত আর তোমাদের অন্য উপায় না থাকত তাহলেও কি এইসব কথা বলতে?
বাবা বলল, এরকম তুলনা করা বোকামি। যাকে চিনি না তার সম্পর্কে দায়িত্ববোধ থাকে না। সে আমাদের সন্তান নয়।
ঘরে চলে এল সে। অদ্ভুত অসহায় লাগছিল। অভিজিতের সঙ্গে কি আবার যোগাযোগ করবে? কিন্তু ও যা করার করেছে, বারংবার করবে কেন? সুদেষ্ণার কথা মনে এল। সুদেষ্ণার সঙ্গে
অনেককাল যোগাযোগ নেই।
বেরিয়ে এসে ও দেখল বাবা-মা এখনও খাওয়ার টেবিলে বসে আছে। তার মানে আবার ওদের মধ্যে আপাত যুদ্ধবিরতি হয়েছে। সে রিসিভার তুলে ডায়াল করল। ওপাশে এক ভদ্রলোকের গলা পাওয়া গেল। ভরত জানতে চাইল সুদেষ্ণা আছে কিনা! ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কে বলছ?
বলুন ভরত কথা বলছি।
ভরত? তুমি সুদেষ্ণার সঙ্গে পড়তে না?
হ্যাঁ।
আরে কী খবর বল? আমি ওর বাবা বলছি। তুমি তো সেই একবার আসবার পর এলেই না। কী করছ এখন? সুদেষ্ণার বাবা উজ্জ্বল হলেন। ভরতের মনে পড়ল মানুষটাকে। বই পত্তর নিয়ে থাকেন সবসময়।
কিছু না? কাজকর্মের চেষ্টা করছি।
পড়াশুনা?
ও আমার দ্বারা হবে না। সুদেষ্ণা কোথায়?
ও নিচে আছে। বাড়িতেই নাচের স্কুল করেছে। সামনের মাসে রবীন্দ্রসদনে ওদের প্রোগ্রাম। ও তো স্কুল থেকেই শিখত, পাশটাস করেছিল, এখন বিদ্যেটা কাজে লাগাচ্ছে। বেশ জমে গেছে ওর স্কুল। দাঁড়াও, আমি কানেকশনটা নিচে দিয়ে দিচ্ছি। ভরত শুনল ওপাশে বেল বাজছে তারপরই সুদেষ্ণার গলা, বাবা, আবার লাইন দিলে কেন? আমাদের রিহার্সাল চলছে এখন।
সুদেষ্ণার বাবার গলা শোনা গেল, ভরত ফোন করেছে অনেকদিন বাদে তাই—ভরত কথা বলো। ভদ্রলোক রিসিভার নামিয়ে রাখলেন, আওয়াজ বোঝা গেল। ভরত বলল, আমি খুব দুঃখিত এসময়ে বিরক্ত করার জন্যে।
সুদেষ্ণা হাসল, ঠিক আছে। কেমন আছ?
আছি। আমি তোমার সাহায্য চাই।
বল।
তোমার শ্রাবণীকে মনে আছে? আমাদের কলেজে পড়ত!
বাঃ, মনে থাকবে না কেন? তোমার কাছ থেকে খবর নিয়ে আমি একবার হসপিটালে গিয়েছিলাম। কী হয়েছে ওর?
আগামীকাল ওর অপারেশন। লিউকেমিয়ায় ভুগছে তা জানো। ফ্রেশ ব্লাড দরকার। ওর এমন কেউ নেই যে সাহায্য করতে পারে।
কখন দরকার?
কাল সকাল নটার মধ্যে।
অ্যাসেমব্লি অফ গর্ড চার্চে?
হ্যাঁ।
ওর ব্লাড গ্রুপটা যেন কী?
ও।
ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।
তুমি দেবে?
তোমাকে চিন্তা করতে মানা করছি। গুড নাইট।
রিসিভার নামিয়ে রাখতে রাখতে হঠাৎ গায়ে কাঁটা ছড়ালো ভরতের। এ যে কী আনন্দ তা সে কী করে বোঝাবে? মা জিজ্ঞাসা করল, কী হলো?
আপাতত আর সমস্যা নেই। পরম বিশ্বাসে বলে ফেলল ভরত।
.
সকাল সাড়ে আটটায় হসপিটালে পৌঁছে ভরত দেখতে পেল সুদেষ্ণা বেশ কয়েকজন মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে এগিয়ে এল সে, আমার স্কুলের মেয়ে এরা। প্রত্যেকের ব্লাড গ্রুপ ও।
অবাক হয়ে ভরত জিজ্ঞাসা করল, এরা সবাই নিজের ব্লাড গ্রুপ জানে?
যে কোনও শিক্ষিত মানুষের সেটা জানা উচিত। তাছাড়া স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় অ্যাডমিশন ফর্মে সেটা লিখতে হয়।
মনে মনে মাথা গুনল ভরত। সুদেষ্ণাকে নিয়ে ছয়জন। হঠাৎ যেন মনে হল শূন্য হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে থাকার সময় আচমকা বিপুল অস্ত্র পেয়ে গেল। সে ওদের নিয়ে সোজা ব্লাডব্যাঙ্কে চলে এল। দুজন ডাক্তার পালা করে তদারক করেন। এঁদের সঙ্গে ভালই পরিচয় হয়ে গেছে ভরতের। রক্ত দেবার ব্যবস্থা করে ভরত ছুটল ডক্টর দত্তর কাছে। গিয়ে দেখল মাসিমা সেখানে বসে আছেন। দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদছেন তিনি। ডক্টর দত্ত বলছেন, আপনি শক্ত হন মা। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করছি। আপনার মেয়ের কথা ভাবুন, ও নিজে কি লড়াই করছে! এই যে ভরত, এসে গেছ। রক্তের কী হলো?
পাঁচজন এসেছে যাদের রক্তের গ্রুপের সঙ্গে শ্রাবণীর মিলে গেছে। আর একজন–। ভরত বলতে গিয়ে ফাঁপরে পড়ল, সুদেষ্ণা নিজের কথা তাকে বলেনি।
সেটুকু শোনার মতো ধৈর্য ডক্টর দত্তর ছিল না, তিনি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, দারুণ। গুড। আমি যে কি চিন্তায় ছিলাম। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হতাম ব্লাডব্যাঙ্ক থেকে আনাতে। এখন আমরা স্বচ্ছন্দে কাজ শুরু করে দিতে পারি। রিসিভার তুলে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে তিনি বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, ভরত পেছন পেছন আসতেই দরজার বাইরে পা রেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন, কিছু বলবে?
শ্রাবণীর সঙ্গে দেখা করা যায় না?
ডক্টর দত্ত বড় চোখে দেখে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলেন, বিকেলে দেখা কোরো। ততক্ষণে ওর সেন্স এসে যাবে।
ডক্টর দত্ত চলে গেলেন। ভরত মাসিমাকে নিয়ে বাইরের বেঞ্চিতে বসল। হঠাৎ মাসিমা তার হাত ধরলেন, বাবা, তুমি না থাকলে–। ওঁর গলা বুজে এল।
ভরত প্রতিবাদ করল। ভদ্রমহিলা সেকথায় কান না দিয়ে আঁচলে চোখ বন্ধ করলেন। কিছুক্ষণ বসে থেকে সে উঠে পড়ল নিঃশব্দে। শ্রাবণীকে বাঁচাতেই হবে। আজকের অপারেশন ঠিকঠাক হলে ডক্টর দত্ত লড়াই করার জোর পাবেন। এই মুহূর্তে সে ভাবতেই পারছে না শ্রাবণী তার কেউ হয় না। ওর সঙ্গে এই হসপিটালের বাইরে কোনও সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু এসব সত্ত্বেও মনে হচ্ছে শ্রাবণী না বাঁচলে তার সব কিছু শূন্য হয়ে যাবে।
ওরা আসছিল। সুদেষ্ণা জিজ্ঞাসা করল অপারেশন শুরু হয়ে গিয়েছে?
মাথা নাড়ল ভরত।
সুদেষ্ণা জিজ্ঞাসা করল, তাহলে তো শ্রাবণীকে দেখা যাবে না, না?
বোধহয় না।
সুদেষ্ণা সঙ্গিনীদের বলল, তোমরা আর অপেক্ষা করে কি করবে? কারও শরীর খারাপ লাগছে না তো?
মেয়েগুলো হেসে উঠল। প্রত্যেকে যে যেমন দেখতে তোক ভরতের সুন্দর লাগল। একটি মেয়ে বলল, আমি তো কিছু বুঝতেই পারলাম না। আমার রক্ত ওকে দেওয়া হবে এটা ভাবতেই নিজেকে কিরকম ইম্পর্ট্যান্ট মনে হচ্ছে।
সুদেষ্ণা বলল, রক্ত শ্রাবণীর শরীরে গিয়ে যেন ওকে বাঁচতে সাহায্য করে সেই প্রার্থনা করো। তোমরা একা যেতে পারবে?
অন্য একটি মেয়ে শব্দ করে হাসল, আমরা পাঁচজন আছি, একা কোথায়।
ওরা চলে গেলে ভরত বলল তুমি একটা দারুণ কাজ করলে!
সুদেষ্ণা তাকাল, কিছু বলল না।
ভরত আবার বলল, তুমি বাড়ি ফিরবে না?
যে কোনও মুহূর্তেই যেতে পারি। তবে এখন হাতে কোনও কাজ নেই। চলো, অপারেশন থিয়েটারের সামনে যাই।
জিজ্ঞাসা করে ওরা চলে এল ও. টি.-র সামনে। দরজায় লাল আলো জ্বলছে। হঠাৎ সুদেষ্ণা জিজ্ঞাসা করল সেবার বাড়ি ফেরার পর শ্রাবণী এতদিন ভাল ছিল, না?
আমি ঠিক জানি না।
জানো না মানে? তোমার সঙ্গে দেখা হত না?
না।
হতো না? চমকে তাকাল সুদেষ্ণা।
ভরত মাথা নাড়ল, সেবার হসপিটাল থেকে নিয়ে যাওয়ার পর আমি আর কোনও যোগাযোগ করিনি। এতদিন পরে খেয়াল হতে ওর বাড়িতে গিয়ে জানতে পারলাম ও আবার হসপিটালে ভর্তি হয়েছে।
তাহলে তুমি এত কনসার্নড হয়ে গেলে কী করে?
সুদেষ্ণার চোখে বিস্ময়।
মনে হল ওর পাশে দাঁড়ানো দরকার।
শুধু তাই?
ভরত এবার বুঝতে পারল। সে সুদেষ্ণার দিকে তাকিয়ে বলল, ব্যাপারটা শুধু তাই ছিল। এখন কী আমি জানি না।
সুদেষ্ণা এবার অন্যদিকে তাকাল। ওরা আর কথা বলল না।
প্রায় আধঘণ্টা বাদে ডক্টর দত্ত বের হলেন। ওদের ওখানে দাঁড়াতে দেখে মাথা নাড়লেন। ভরত এগিয়ে গেল, কিন্তু কী প্রশ্ন করবে বুঝতে পারল না।
ডক্টর দত্ত বললেন, মানুষের হাড়ের মধ্যে স্পঞ্জের মতো যে জিনিসটা থাক তার নাম ম্যারো। লাল আর হলদে দু ধরনের ম্যারো। হলদেটা তৈরি করে ফ্যাট আর লাল ম্যারোর কাজ হল লোহিত রক্তকণিকা বানানো। মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লাল ম্যারো দুর্বল হয়ে যায় আর হলুদটা সক্রিয় হয় বেশি। তখন বুকের প্রধান হাড়ে, কোমরের, খুলির, শিরদাঁড়া, হাত পায়ের হাড়ে ওই লাল মজ্জা থাকে বাকি সব হাড়ে তাদের অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না। লাল মজ্জা থেকে তৈরি হয় স্টেম সেলস্, স্টেম সেলস থেকে রেড সেল, হোয়াইট সেল আর প্লেটলে। কোনও কারণে যদি লাল মজ্জা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে শরীরে রক্তের জোগান কমে যাবে। শ্রাবণীর তাই হয়েছে। দেখি এই অপারেশনের রেজাল্ট কী হয়। আমরা ওর ম্যারো পরীক্ষা করব যাতে কোনো রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায়।
এখন কেমন আছে?
আমি অবাক হয়ে গিয়েছি। ব্যাপারটা খুব পেইনফুল কিন্তু মেয়েটা চমৎকার সহযোগিতা করেছে। ডক্টর দত্ত চলে গেলেন।
মাসিমাকে খবরটা দিল ভরত। উনি বললেন সকালবেলায় স্নান করে এসেছেন। আর বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। মেয়েকে বেড়ে দেওয়ার পর জ্ঞান হয়েছে দেখে তারপর যাবেন। ভরত জিজ্ঞাসা করল, আপনার জন্যে কিছু খাবার এনে দেব?
না বাবা। আমি কিছু খেতে পারব না।
ভরতের কষ্ট হচ্ছিল। এই মহিলার মেয়ে ছাড়া জীবনে আর কেউ নেই। সেই মেয়ে—
ভরত বলল, বিকেলে আপনাকে আসতে হবে না। আমি আসব।
মাসিমা ম্লান তাকালেন, কোনও কথা বললেন না।
সুদেষ্ণার সঙ্গে বেরিয়ে এল ভরত। সুদেষ্ণা জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাবে?
আমার বাড়িতে চলো।
না, থাক।
তুমি আমাকে বন্ধু বলে ভাবতে পার না।
বাঃ। আজ যা করেছ তারপর না ভেবে কি পারি?
ও, আজ এটা না করলে বুঝি ভাবতে না?
তাহলে কাল রাত্রে তোমায় ফোন করলাম কেন?
একটু চুপ করে থেকে সুদেষ্ণা বলল, ভরত, তুমি একসময় আমাকে বলেছিলে, আই লাভ ইউ সুদেষ্ণা। আমি বলেছিলাম তোমার অনুভূতি আমার এলে ভেবে বলব। তুমি জিজ্ঞাসা করেছিলে কবে? আমি বলেছিলাম জ্যোতিষী নই। মনে পড়ে?
এসব কথা আবার কেন তুলছ?
কারণ তোমাকে উত্তরটা দেবার দায় আমার থেকেই গিয়েছিল।
না। কোনও দায় তোমার নেই।
ধন্যবাদ। তবে আজ মনে হচ্ছে উত্তরটা দিতে পারি।
জানা উত্তর শোনার কোন দরকার আছে কি?
সুদেষ্ণা হাসল, কি জান? বলব আমি তোমার ভালবাসা নিতে পারছি না।
ভরত সুদেষ্ণার দিকে তাকাল। তারপর হেসে ফেলল, সুদেষ্ণা, তুমি খুব সুন্দরী, সচ্ছল, গুণবতী মেয়ে। তুমি আমারই বয়সী। যেসময় তোমাকে আমি প্রস্তাবটা দিয়েছিলাম, তখন জীবন কী আমি জানতাম না। সময় একটু একটু করে সেই প্রস্তাবটাকে কুরে কুরে খেয়ে নিয়েছে। এখন আমি আর তোমাকে সেই প্রস্তাব করতে পারি না। আমি জানি কতটা যোগ্যতা থাকলে তোমাকে এমন প্রস্তাব দেওয়া যায়। আমি তোমার বন্ধুত্ব চাই সুদেষ্ণা, শুধু ওইটুকুই।
.
বিকেলবেলায় হসপিটালে গিয়ে ভরত দেখল শ্রাবণীর বিছানার পাশে মাসিমার সঙ্গে সুদেষ্ণাও বসে আছে। শ্রাবণীর রক্ত এবং স্যালাইন চলছে। মেয়েটাকে এখন কাগজের মতো সাদা দেখাচ্ছে। ভরতকে দেখামাত্র সুদেষ্ণা উঠে দাঁড়াল, সেন্স এসেছে।
ভরত মাথা নাড়ল। শ্রাবণীর চোখ বন্ধ। হয়তো ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় ঘুমাচ্ছে। সে নার্সকে জিজ্ঞাসা করল, ডাক্তারবাবু কিছু বলে গেছেন?
আপনাদের জানানোর জন্যে কিছু বলেননি।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে মাসিমাকে বলল, আপনি এবার বাড়ি চলুন।
সুদেষ্ণা বলল, আমি ওঁকে পৌঁছে দেব।
ভরত বলল, তাহলে আমি যাই।
তুমি বাড়ির দিকে যাবে না?
না।
সুদেষ্ণার গাড়ি আছে। সকালেও লিফট দিতে চেয়েছিল, ভরত নেয়নি। ও আসায় মাসিমার সুবিধে হল। ও যে আসবে ভাবেনি ভরত।
বাইরে বেরিয়ে একটা সাধারণ দোকানে বসে চা খেল ভরত। দোকানটা খুব খেলো টাইপের, তার খদ্দেররাও তথৈবচ। ভেতরের বেঞ্চিতে বসে গ্লাসে চা খেতে খেতে ভরত শুনল দুটো লোক হিন্দিতে কথা বলছে। কোন একটা জিনিস লুকিয়ে বিক্রি করা হবে কিন্তু যে কিনবে সে দামটা কম দিতে চাইছে। তাকে বাদ দিয়ে অন্য আর একজনকে বিক্রি করার প্ল্যান করছে ওরা। কিন্তু সেটা করতে গেলে আগের লোকটাকে যে ক্ষতি করতে চাইবে সে ব্যাপারেও সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রে আগের লোকটাকে এখনই টাইট দেওয়া দরকার। কথাবার্তা বলে ওরা একমত হয়ে চায়ের দাম মিটিয়ে উঠে গেল। ভরত চুপচাপ দেখল। লোকগুলোর রাগ তার বাবার মতো। কি সহজে ওরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। ওর মনে হল কাজ হাসিল করার পর ওই দুজনের মধ্যে একই কাণ্ড হওয়া অসম্ভব নয়। এ ওকে সরিয়ে দিতে চাইবে পুরো টাকাটা কজা করতে। এইভাবেই বেশিরভাগ মানুষ বেঁচে থাকে।
বাড়িতে এসে মায়ের মুখে শুনল তার ফোন এসেছিল। স্বপন নামে একজন চিত্রপরিচালক ফোনে বলেছেন আগামিকাল সকাল নটার মধ্যে স্টুডিওতে গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে। রাজেশবাবুর সঙ্গে তার কথা হয়ে গেছে।
ভেতরে ভেতরে খুব খুশি হলেও মুখে কিছু প্রকাশ করল না ভরত। খবরটা দিয়ে মা তাকে লক্ষ্য করে বললেন, কী ব্যাপার রে?
এবার সত্যি কথাটা বলতে হয়। তবু সে কিছুই নয় এমন ভঙ্গিতে বলল, ওই একটা টিভি সিরিয়ালের ব্যাপারে কথা বলতে চায়।
সে নিজের ঘরে ঢুকছিল, মা পেছন থেকে জিজ্ঞাসা করল টিভি সিরিয়াল তো তোর কী? তোর সঙ্গে কী কথা বলবে?
আমাকে সিরিয়ালে অভিনয় করার অফার দিয়েছে। সে ঘুরে জানিয়ে দিল।
তুই অভিনয় করবি? মায়ের মুখে বিস্ময়।
চেষ্টা করতে দোষ কী! ভরত হাসল।
তুই কি পাগল হয়ে গিয়েছিস? ওই লাইনটায় যাওয়া মানে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে যাওয়া সেটা জানিস। তো? ওখানকার মানুষের কি দুর্নাম!
ভরত নিচু গলায় কথা বলল, মা, এখন কোন্ লাইনের সুনাম আছে তুমি বল! বাবা যে চাকরি করছে তাতে কি ফেয়ার কমপিটিশন আছে? একজন সরকারি ডাক্তার হাসপাতাল ম্যানেজ করে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে যাচ্ছেন, সেটা কি ফেয়ার? একসময় এইসব দেখে আমার মাথা গরম হয়ে যেত। তখন প্রতিবাদ করেছি বোকার মতো। আমার কথা শুনে চললে নিচতলার প্রণবের মা এখনও কর্পোরেশন থেকে সার্টিফিকেট বের করতে পারতেন না। কালো টাকা নিয়ে জমি বিক্রি করতে তাঁকে ঘুষ দিতে হয়েছে। এটাও কি ফেয়ার? তুমি যে গ্যাসের সিলিন্ডার ঠিক সময়ে পাবে বলে এক্সট্রা টাকা দাও, তোমার কি মনে হয় সেটা ফেয়ার? চারপাশের মানুষ যা মেনে নিয়েছে, অন্যায় বলে মনে করার মনটা যখন মরে গিয়েছে তখন আর এসব প্রশ্ন তুলে লাভ কী! আর আমি তোমার মত ফিল্ম সম্পর্কে জেনেই যাচ্ছি, আমার আফসোস করার কিছু থাকবে না।
সে ঘরে ঢুকে গেল। ঢুকতেই আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল। হঠাৎ মনে হল সে সামনা-সামনি যা দেখতে তার চেয়ে অনেক ভাল টিভির পর্দায় দেখায়। অত খুঁত সত্ত্বেও তাকে চমৎকার দেখাচ্ছিল। কিন্ত কাল সকাল নটার মধ্যে স্টুডিও যেতে হলে হসপিটালে যাবে কী করে? দোটানায় পড়ল ভরত।
.
মোটামুটি ভাল পোশাক পরে ঠিক পৌনে নটায় স্টুডিওতে ঢুকতেই স্বপনকে দেখতে পেল ভরত। মাঝখানের লনে দাঁড়িয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছে, ওকে দেখে হাত নাড়ল, ভরত দাঁড়িয়েছিল, কথা শেষ করে স্বপন কাছে এল, রাজেশদার সঙ্গে কথা হয়েছে। স্ক্রিন টেস্টের রিপোর্ট পেয়ে খুব খুশি। ওঁর শুটিং আরম্ভ হবে সামনের বৃহস্পতিবার। উনি তোমাকে আজ বিকেলে শুটিং হয়ে যাওয়ার পর দেখা করে যেতে বলেছেন। আমার কাছে কাজ করলে ওঁর কোন আপত্তি নেই।
ভরত জিজ্ঞাসা করল, শুটিং হয়ে যাওয়ার পর মানে?
ওহো, কাল ভাই তুমি চলে যাওয়ার পর শিডিউল বদলেছি। আমার হিরোইনের ডেট নিয়ে প্রব্লেম হচ্ছিল। তুমি যে চরিত্রে কাজ করবে সেটা পরের দিকে ছিল। হিরোইনের সঙ্গেই। তখন ওঁর ডেট পাওয়া যাবে না বলে আজ থেকেই করছি। ওঁর সঙ্গে বুধবারের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। স্বপন এমন ভঙ্গিতে বলছিল তাতে মনে হল ও যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটাই শেষ কথা, ভরতের সঙ্গে আলোচনার দরকার নেই।
ভরতের রাগ হয়ে গেল। এরা তার সঙ্গে কথা বলার দরকার আছে বলে মনে করল না? তার কোনও অসুবিধা আছে কিনা জানতে চাইল না? অদ্ভুত জগৎ।
সে বলল, কিন্তু আজ আমার পক্ষে তো এখানে থাকা সম্ভব নয়।
স্বপন চমকে তাকাল, সেকি? কেন?
আমার অসুবিধে আছে।
মাইগড! আমি যে সেট তৈরি করতে বলেছি কালকেই। সব আর্টিস্টদের বলে দেওয়া হয়েছে। এখন অসুবিধের কথা বললে চলবে কেন?
কাল যখন আমাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তখন যদি জানতাম আজই কাজ করতে হবে তাহলে তখনই বলে দিতাম। আমি দুঃখিত।
তোমার অসুবিধে কী ধরনের?
আমার এক আত্মীয়ের অপারেশন হয়েছে। সিরিয়াস কেস। আমাকে সকালে হাসপাতালে যেতেই হবে। আর কোনো মেল মেম্বার নেই।
কখন?
এগারোটার মধ্যে।
স্বপন একটু ভাবল। তারপর বলল ওকে! দশটা-ছটা শিডিউল ছিল। আমি অন্য শটগুলো নেব, তুমি বারোটার মধ্যে চলে এসো। গাড়ি দরকার?
ট্যাক্সিতে আসতে হবে।
তাই এসো। এরা পেমেন্টে করে দেবে।
তাহলে আমি যাই?
স্বপন ঘড়ি দেখল যাও। দ্যাখো ভাই, আমাদের সব কিছু প্ল্যান মাফিক চলে না। অবস্থা অনুযায়ী অলটারেশন করতেই হয়। এটা সবসময় মাথায় রাখবে। এসো।
.
দশটার মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছাতে পারল ভারত। গেটের বাইরে ফুটপাতের দিকে চোখ পড়তেই সে দাঁড়িয়ে গেল। ঝুড়িতে একরাশ পেয়ারা নিয়ে বসে আছে একটা লোক। বেছে বেছে গোটা চারেক কিনে একটা মাঝখান থেকে কাটিয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, নুনঝাল আছে?
লোকটা মাথা নেড়ে কাগজে পুরিয়া করে সেটাও দিল।
কাগজের প্যাকট নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ও দেখল আজ প্রচুর ভিড় হয়েছে। বাঁ দিকের আউটডোরে এত লোক কখনও সে দ্যাখেনি। সিঁড়ি বেয়ে ঘরে উঠে এল ভরত। হলঘরের দরজায় পৌঁছে সে অবাক হয়ে গেল। শ্রাবণীর বিছানা খালি। সাদা চাদর বড্ড বেশি সাদা। হঠাৎ ভরতের সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। সে অসহায় চোখে চারপাশে তাকাল। সমস্ত শরীরে অদ্ভুত একটা কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ছে।
এইসময় নার্স এগিয়ে এল, আপনি তো শ্রাবণীকে খুঁজছেন?
শূন্য চোখে তাকাল ভরত। ওর গলা শুকিয়ে গিয়েছিল।
ওকে ওপাশের ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অবস্থা খুব খারাপ। ব্লাড নিতে পারছে না ভালভাবে ভোর থেকে। ওখানে সমস্ত ডাক্তারবাবুরা রয়েছেন।
কোথায়? ফ্যাসফেসে গলায় জিজ্ঞাসা করল ভরত।
নার্স বলল, আসুন।
করিডোরে খানিকটা হেঁটে নার্স তাকে দেখিয়ে দিল।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই সে দেখল সামনের ঘরের দরজায় আলো জ্বলছে। আর এইঘরের একপাশের বেঞ্চিতে সুদেষ্ণাকে জড়িয়ে ধরে মাসিমা কেঁদে চলেছেন। ভরতের খেয়াল হল তার হাতে পেয়ারার প্যাকেট রয়েছে। সে চুপচাপ বেঞ্চির একপাশে গিয়ে বসল। মাসিমার চাপা কান্না মাঝে মাঝে স্পষ্ট হচ্ছে। সুদেষ্ণা বলল, আপনি শান্ত হল। যা হবে তা তো মেনে নিতেই হবে। ডক্টর দত্ত এখনও চেষ্টা করছেন।
দরজা খুলল। ডক্টর দত্ত বেরিয়ে এলেন। ঝড়ো কাকের মত দেখাচ্ছে বৃদ্ধ মানুষটিকে। মাসিমার দিকে তাকালেন। ভরত উঠে সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ডক্টর দত্ত বললেন, স্টিল ফাইটিং। আমাদের বিদ্যে শেষ হয়ে গেছে। ঈশ্বরের যা ইচ্ছে তাই হবে। ডক্টর দত্ত বেরিয়ে গেলেন। তার পেছনে আর একজন ডাক্তার। ভরত দরজাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সামান্য ফাঁক হয়ে আছে পাল্লা। তার ফাঁক দিয়ে বিছানাটা দেখা যাচ্ছিল। শ্রাবণীর মাথার একটা অংশ দেখা যাচ্ছে। সে দরজাটা সামান্য ঠেলল। একজন নার্স মনিটার পরীক্ষা করছে। নানান নল এসে শ্রাবণীর শরীরে শক্তি যোগাতে সাহায্য করছে। শ্ৰবণী চিত হয়ে শুয়ে আছে। ওর মুখ খুব শান্ত। এই যে এত কাণ্ড হচ্ছে তাকে নিয়ে সে ব্যাপারে তার কোনও আগ্রহ নেই। এইসময় ভরত দেখল নার্স তাকে ইশারা করছে দরজা বন্ধ করার জন্যে। ভরত ধীরে ধীরে দরজা বন্ধ করল।
সুদেষ্ণা কাছে এল কী হবে?
জানি না।
মাসিমাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া উচিত।
উনি কি যাবেন?
সুদেষ্ণা একটু ইতস্তত করল, আমি, মানে, খুব জরুরি একটা কাজ আছে, কী করি বলো তো! মাসিমাকে এখানে একা রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না।
তোমার কাজ কখন শেষ হবে?
দুটো নাগাদ।
ওঁকে বললেও উনি বাড়ি যাবেন বলে মনে হয় না। তুমি যাও।
তুমি থাকবে?
দেখি।
সুদেষ্ণা অদ্ভুত চোখে তাকাল, এরকম করে বলছ?
আমি থেকে তো কিছু করতে পারব না।
সুদেষ্ণা মাসিমার কাছে চলে গেল। নিচু গলায় কিছু বলল। মাসিমা মাথা নাড়লেন। সুদেষ্ণা আবার ভরতকে দেখল। তারপর মাসিমার পাশে সে কথা বলতে লাগল। ভরত বেরিয়ে এল। তার হাতে প্যাকেটটা তেমনি করে ধরা ছিল।
ডক্টর দত্তের চেম্বারে তেমনি ভিড়। এই এত মানুষের কারও না কারও শরীরে রক্তের গোলমাল শুরু হয়ে গেছে। ডক্টর দত্ত তাদের আশ্বাস দিচ্ছেন। লড়াই করার প্রেরণা পাচ্ছে তারা। ভরতকে দেখে তিনি বললেন, একটা ফঁড়া আজ সকালে কেটেছে। বিকেল নাগাদ যদি এরকম চলে তাহলে খানিকটা স্বস্তি পাব। বলেই তিনি সামনে বসা মানুষটিকে প্রশ্ন শুরু করলেন।
ঘড়িতে এখন এগারোটা বেজে গেছে। এখন শ্রাবণী লড়ছে তা ওর নিজের লড়াই। তারা তো দূরের কথা, ডাক্তারের ক্ষমতার শেষ সীমাও আর তাকে সুনিশ্চিত করতে পারছে না। কিছুই করার নেই।
হসপিটালের বাইরে এসে ছেঁড়া জামাকাপড়পরা একটা বাচ্চার হাতে প্যাকেটটা ধরিয়ে দিল ভরত। তারপর হাত বাড়িয়ে ট্যাক্সি ডাকল।
.
মুখে হালকা মেকআপ, চুল চমৎকার আঁচড়ানো ভরতকে সেটে নিয়ে এল একজন সহকারী পরিচালক। স্বপন তার কাছে এল, দৃশ্যটি হল, তুমি নায়িকার বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলে। ভদ্রলোকের দুনম্বরী ব্যবসা আছে যা মেয়ে জানে না। তুমি বেশ নামকরা মস্তান। দুনম্বরীতে তোমার কোনও জুড়ি নেই। লোকটা তোমাকে ঠকাচ্ছে আর সমাজে ভদ্রলোকের মুখোশ পরে আছে। আজ বাড়িতে নেই। ওর মেয়ে তোমাকে জিজ্ঞাসা করছে বাবার সঙ্গে তোমার কি দরকার! সিচ্যুয়েশনটা এই।
আমাকে কীভাবে কথা বলতে হবে?
মস্তানের মত।
সেটা আগে নিশ্চয়ই বলা হয়নি।
না। এই প্রথম ছবিতে ইন করছে।
আমি যদি স্বাভাবিক গলায় বলি। মানে, দর্শকরা তো জানবেই লোকটা মস্তান।
তাতে কি নাটকীয় হবে? স্বপন বলল, ওহো বুঝেছি। দ্যাটস ইনটারেস্টিং। এসো, একটা রিহার্সাল দেখি।
স্বপন তাকে নিয়ে গেল নায়িকার সামনে। নায়িকার মাথা নিয়ে হেয়ারড্রেসার তখন খুব ব্যস্ত। স্বপন বলল, ম্যাডাম, একটু রিহার্স করতে হবে। কো-অ্যাক্টর নতুন।
এত বড় রোলে নতুন নিচ্ছেন? বেশি সময় যাবে। নায়িকার মুখ অন্যদিকে ঘোরানো, তার চুল ঠিক করা হচ্ছে, সেই অবস্থায় বললেন।
স্বপন বলল, কেন নিতে হল তা তো জানেন। হ্যাঁ, দরজা খুলে আপনি জিজ্ঞাসা করবেন, কাকে চান? লোকটা জবাব দেবে না। আপনি রিপিট করবেন, কী হল? তখন লোকটা বলবে, রায় সাহেবকে বলুন ওঁকে একটু দর্শন দিতে হবে। আমি একটা কম্বাইন শটে এটা নিয়ে প্রেফারেন্সে যাব।
নায়িকার চুল ঠিক হয়ে গিয়েছিল। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, দর্শন শব্দটা কানে লাগছে।
হ্যাঁ। আগে ছিল না। চরিত্রটাকে একটু অন্যরকম করব বলে এখন অ্যাড করলাম। স্বপন হাসল, নিন।
নায়িকা বললেন, কাকে চান?
ভরত গম্ভীর মুখে দেখে সামান্য হাসল।
কী হল?
রায়সাহেবকে বলুন, ওঁকে একটু দর্শন দিতে হবে। গলার স্বর খুব শীতল রাখার চেষ্টা করলেও ওর একটা হাত কথা বলার সময়ে উঠে এল। সে মাথা নেড়ে বলল, সরি! হাত উঠবে না।
স্বপন বলল, ঠিক আছে। ক্যামেরায় ওটা আসবে না।
নায়িকার কপালে ভাঁজ, অত ঠাণ্ডা গলায় বলবেন নাকি?
স্বপন বলল, মেইনটেইন করতে পারলে খারাপ লাগবে না।
সোজা নাকি! তাছাড়া ওইভাবে বললে আমার ওপর কর্তৃত্ব করা হয়। নায়িকা মাথা নাড়লেন,, না, যেভাবে মস্তানরা কথা বলে সেইভাবে অ্যাক্টিং করতে বলুন।
স্বপন বলল, ম্যাডাম, এটা আমার ভাল লাগছে। যাকে ভেবে প্রথমে সংলাপ লেখা হয়েছিল তিনি মস্তানদের মত বলতে অভ্যস্ত। কিন্তু এটা অন্য একটা ডায়মেনশন আনছে। সিনটা টেক করি, দেখে তারপর বলুন।
ভরত চুপচাপ শুনছিল। তার রাগ হচ্ছিল। হঠাৎ আবিষ্কার করল নিজেই জিভ দিয়ে গালের দেওয়ালে ঠেলছে। সে নতুন, কোন মন্তব্য করা উচিত নয় কিন্তু তবু স্বপনকে ভাল লাগল ওই বক্তব্য মেনে না নেওয়ায়।
ক্যামেরার সামনে আলো জ্বেলে যে রিহার্সাল তাকে মনিটার বলে। সেটা করতে গিয়ে বারবার বাধা পড়তে লাগল। লাইটের লোকজন সময় নিচ্ছে। মাল্টি কাটার ইত্যাদি শব্দগুলো শুনতে পাচ্ছিল সে। নায়িকা বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ভদ্রমহিলা তার সঙ্গে পরিচিত হতে চাননি। সে মহিলাকে দেখল। মেকআপ নেওয়া সত্ত্বেও সুদেষ্ণা ওর থেকে অনেক সুন্দর।
কী দেখছেন? নায়িকা জিজ্ঞাসা করলো।
আপনাকে। বলে ফেলল ভরত।
আপনি খুব ভাগ্যবান।
আপনাকে দেখছি বলে?
না পেলে আপনাকে দেখতে পারতাম না।
এরকম কথা শুনবেন যেন ভাবতে পারেননি নায়িকা, কিছু বলতে যাচ্ছিলেন রাগতভাবে। স্বপনের গলা শোনা গেল, রেডি! ক্যামেরা!
অন। আর একটি গলা ভেসে এল।
সাউন্ড?
ওকে!
অ্যাকশন।
কাকে চাই? নায়িকা স্বাভাবিক হতে পারেননি তখনও।
ভরত চেয়ে দেখল। এবং নিজের গালের দেওয়ালে জিভ ঠেকালো।
সেদিকে তাকিয়ে নায়িকা সংলাপ বলতে গিয়ে মাথা নেড়ে চোখ বন্ধ করলেন। স্বপনের গলা ভেসে এল, কাট। কাট। ওকে। ওয়ান্স মোর।
এবার ঠিকঠাক হল সব।
স্বপন বলল, ফাইন। মনিটার অন কর। সেট লাইট দাও।
বড় আলো নিভে গিয়ে অন্য আলো ছড়িয়ে পড়ল। সবাই মনিটারের সামনে জড়ো হয়েছে। ভরত এগোল না। একেই কি অভিনয় বলে? যে যত ভাল অভিনয় করবে তত সে নামি হবে? মিথ্যেটাকে সত্যি করতে হবে বিশ্বাসযোগ্য করে। ওপাশে নিজের গলা বাজছে কানে এল। শ্রাবণী লড়াই করছে জীবনের জন্যে। সুদেষ্ণা এখন অনেক নরম। সে যা করছে তাতে কৃতজ্ঞতা ভাব ছাড়া আর কোনও অনুভব নেই। কিন্তু কার জন্য। আমি যা নই তা হয়ে সবাইকে মোহিত করলে আমার পায়ে তলার জমি শক্ত হবে। এই চেষ্টাটা চারপাশের মানুষজন প্রতিদিন করে যাচ্ছে যা সে একসময় সহ্য করতে পারেনি।
হাততালি উঠল। নায়িকা এবং স্বপন এগিয়ে এল। নায়িকা বলেন, দারুণ, দারুণ হয়েছে। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি। আপনি কি গ্রুপ থিয়েটারে করেন?
গ্রুপ থিয়েটার? ভরত হাসল। স্বপন চেঁচাল, নেক্সট শট।
আমি পাস করে গেলাম। ভরত মনে মনে বলল। অ্যাসেমব্লি অফ গড চার্চ হসপিটালের বিছানায় শুয়ে যে হারতে বসেছে, সে এটা জেনে যাবে না এটুকুই স্বস্তির।