একটা জরাজীর্ণ বাড়ি
একটা জরাজীর্ণ বাড়ি, কোনও সাইনবোর্ড নেই। ছেলেটির সঙ্গে ভেতরে ঢুকতেই নাকে অদ্ভুত বোঁটকা গন্ধ এল। এই বিকেলেই এখানে আলো প্রায় নেই বললেই চলে। মাঝখানে একটা চাতাল, চাতালের পাশে কল। সম্ভবত সেটাই স্নানের জায়গা কারণ একজন বৃদ্ধ সেখানে স্নান করতে করতে জিজ্ঞাসা করলেন, কাকে চাই?
ছেলেটি বলল, আপনাকে।
বিশাল শরীর প্রায় অর্ধনগ্ন। মাথায় বালতির জল ঢেলে চিৎকার করে কোনো সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ করে লোকটি বললেন, কেন ভাই?
আমাদের কলেজে পড়ে। মেসে থাকতে চায়।
ভাল। খুব ভাল। পনের কলা পূর্ণ হয়েছে, ইনি এলে সোল কলা হয়। দুনম্বর ঘরের চার নম্বর সিট খালি আছে। দেখে এসো, ততক্ষণে নেয়ে নিই। বলেই হাঁক দিলেন, জগু, অ্যাই। জগু, বাবুদের দুনম্বরের চার নম্বর দেখা।
জগু নামক লোকটির উদয় হল এবং সে তাদের যে ঘরে নিয়ে গেল সেখানে আলো নেই। ভরত বলল, আলো জ্বালুন।
গরমকালে ছটা আর শীতকালে পাঁচটার আগে আলো জ্বালার আইন নেই।
তাহলে আমি দেখব কী করে? বিরক্ত হল ভরত।
জগু মুখ বাড়িয়ে বলল, অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছে না, আলো জ্বালতে বলছে।
আচ্ছা জ্বাল। গলা ভেসে এল।
অতএব আলো জ্বালা হল। তিনটে তক্তাপোশ বিছানা রয়েছে, একটি খালি। তিনটের গায়ে ছোট টেবিল, কারও চেয়ার নেই। নোনা ধরা দেওয়ালেই পেরেকে হ্যাঁঙার টানিয়ে জামা প্যান্ট ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এই তিনটি মানুষ কে কিরকম তা জানা নেই। জিনিসপত্রের অবস্থা দেখে কারও সঙ্গতি তেমন নয় বলে অনুমান হল।
জগু বলল, উনি একটু বেশি নাক ডাকেন। তবে শনি রবিবার দেশে যান। আর এই দুইবাবু ফেরেন রাত দশটায়। কারও সঙ্গে কথা বলেন না।
ভরত জিজ্ঞাসা করল, কেন?
কথা বলার অবস্থা থাকে না মা কালীর কৃপায়। বলে হাতের মুদ্রায় খাওয়া দেখাল। ভরতের খুব খারাপ লাগছিল। এমন একটা ঘরে থাকার কথা সে কখনও চিন্তা করেনি। কিন্তু কোনো উপায় নেই।
স্নান সেরে লোকটি একটা ছোট ঘরে ওদের বসিয়ে মাথা আঁচড়াতে আঁচড়াতে কথা বলছিল, এই বাজারে আমি যে সস্তায় মেস চালাচ্ছি তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। আপনি তো পাশের মেসে থাকেন। কত দিতে হয়?
অঙ্কটা বলল ছেলেটি। ভদ্রলোক বললেন, আমার এখানে পঞ্চাশ টাকা কম। সকালে নো চা। নটা থেকে বারোটা ভাত ডাল ঘ্যাঁট আর মাছের ঝোল। বিকেলে চায়ের ব্যবস্থা নেই। রাত্রে রুটি এবং তরকারি। সপ্তাহে একদিন মাছ। রান্না অপূর্ব। পোস্ত পাবেন দুদিন। টাকা এনেছেন?
আজ আনিনি।
দ্রুত নিয়ে আসুন। সিট ধরে রাখতে পারব না। হ্যাঁ, আমার এখানে কোনও ছাত্র নেই। ছাত্র থাকলেই গোলমাল পাকায়। রাত দশটার পর গেট বন্ধ হয়ে যায়। তখন এলে খাওয়া পাওয়া যাবে না। মদ খাওয়া যাবে না। মিল অফ করলে ফেরত পাবেন না কিছু। আর ওই যাকে বলে বান্ধবী, তাকে ঘরে আনা চলবে না। একজনের যদি আসে তাহলে বাকি সবার চরিত্র খারাপ হয়ে যাবে।
আমি তো ছাত্র, আমাকে নিচ্ছেন কেন?
মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে। একবার মুখ থেকে কথা বের হলে ফিরিয়ে নেওয়ার বান্দা আমি নই। বাড়ি কোথায়? ভদ্রলোক একটা খাতা খুললেন।
কলকাতায়।
অ্যাঁ। কলকাতায় বাড়ি অথচ মেসে থাকবেন?
হ্যাঁ। কোনও পুলিশ টুলিশের ব্যাপার নেই তো?
না।
বাবা টাকা দেবেন? ছাত্র বলে জিজ্ঞাসা করছি।
না। আমিই দেব।
ও বাবা! তা সেটা আসবে কোত্থেকে?
আমি টিউশনি করি।
মেরেছে। যে মাসে টিউশনির টাকা পাবেন না অথবা অভিভাবক যদি আপনাকে ছাড়িয়ে দেয় তাহলে তো–। কথা শেষ না করে মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক।
যেভাবেই হোক আপনি টাকা পেলেই তো হলো।
হলো। একমাসের অ্যাডভান্স দিতে হবে। যে মাসেরটা দিতে পারবেন না সেই মাসের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করব। আর হ্যাঁ, এখানে কোনওরকম আন্দোলন চলবে না।
আন্দোলন মানে?
ওই যে চলবে না চলবে না। খাবার খারাপ, চালে গন্ধ বাবুদের তো বায়নাক্কার শেষ নেই। আরে অত নাক উঁচু তো বাপের কাছে গিয়ে থাকুক।
হঠাৎ ভরত বলল, আপনি দেখছি খুব বদ লোক।
ভদ্রলোক হতভম্ব, তার মানে?
আপনি ডিক্টেটার হয়ে মেস চালাচ্ছেন। হিটলার মুসোলিনী।
সঙ্গে সঙ্গে মাথার ওপর দুটো হাত তুলে নমস্কার করলেন ভদ্রলোক, কি যে বলেন। ওইসব মহাত্মাদের সঙ্গে আমার তুলনা। আসুন।
আসুন মানে?
আপনাকে আমার চাই না।
কারণ?
প্রথমেই বদলোক বলেছেন। ঢোকার আগেই। পরে ভিটেমাটি ছাড়া করবেন।
আপনি চাই না বললেই হবে না। আমি থাকব। কাল টাকা দেব। আরে।
ইয়ার্কি নাকি। আমি মেস-মালিক, আমি বলছি আপনাকে চাই না।
আপনি বদলোক তাই বদ বলেছি। এটা কোনও অপরাধ নয়। আপনি লজিক দিয়ে বোঝন কেন আমাকে থাকতে দেবেন না।
আমি কিছু বোঝাতে পারব না। যান এখান থেকে।
যাওয়ার জন্যে আসিনি আমি।
কি মুশকিল। এই যে, তুমি তোমার বন্ধুকে বোঝাও! নইলে মেসে থাকা মুশকিল হবে। তোমাদের মালিক আমার পিসতুতো ভাই।
ওকি বোঝাবে? টেবিল থেকে একটা পেপার ওয়েট তুলে নিয়ে ঠুকঠুক করে টেবিলে শব্দ করতে লাগল ভরত, আমার পকেটে পঞ্চাশ টাকা আছে। অ্যাডভান্স নিন।
শব্দ অসহ্য লাগায় ভদ্রলোক পেপার ওয়েট কেড়ে নিতে চাইলেন কিন্তু পারলেন না। চিৎকার করে ডাকলেন, জগু, অ্যাই জগা। উত্তেজনায় ওঁর শরীর কাঁপছিল।
দৌড়ে এল আগের লোকটা, আজ্ঞে?
এদের তাড়া। বের করে দে। ভদ্রলোক চিৎকার করলেন।
আজ্ঞে আপনারা তাহলে আসুন। লোকটি ঘাড় নাড়ল।
পঞ্চাশ টাকা নিয়ে রসিদ দিন। একই গলায় বলল ভরত।
না। দেব না। তোমার মতো কাঁটা আমার গলায় বিঁধতে দেব না। আমার মুখের ওপর বলে কিনা আমি বদ লোক! বের হও।
আমি চলে গেলে আপনার বিপদ আছে।
তার মানে?
এটা একটা মেস? একটা গোয়ালঘর এর চেয়ে ভাল। কলেজের ছেলেরা এসে সব ভেঙে দিয়ে যাবে। মেস চালিয়ে পকেট ভারী করা বেরিয়ে যাবে। চাইকি, এক-আধজন ওই ভুড়িটাকে ফাঁসিয়েও দিতে পারে। তারপরে পুলিশ আসবে, হেলথ ডিপার্টমেন্টের লোক আসবে। তাদের সন্তুষ্ট করতে মোটা মাল ছাড়তে হবে। সেসব চুকে যাওয়ার পর আবার ছেলেরা আসবে। গুণ্ডা বদমাস নয়, কলেজ স্টুডেন্ট। ওরা যা ইচ্ছে করতে পারে পুলিশ কোনো কেস করবে না, এটা তো নিশ্চয়ই জানেন। ভরত পেপার ওয়েট ঠুকতে ঠুকতে বলে যাচ্ছিল। তার কথা শেষ হওয়ামাত্র জগু হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। প্রচণ্ড রেগে যাওয়া চেহারা নিয়ে ভদ্রলোক বসেছিলেন চেয়ারে। কিন্তু তার মুখ থেকে কোনও কথা বের হচ্ছিল না। ভরত দেখল তার সঙ্গী একটু একটু করে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। সে তাকে আটকাল, মিছিমিছি ভয় পাচ্ছিস? তোকে কিছু করলে আমরা এসে ছাল ছাড়িয়ে নেব। ছাল ছাড়ানো চর্বিওয়ালা মানুষের বডির এখন হেভি ডিম্যান্ড। তারপর ঘুরে তাকাল, কী সিদ্ধান্ত নিলেন?
জগু তখন চলে গেছে ভদ্রলোকের পাশে, বাবু মেনে নিন। দাদাকে নিজের দলে টেনে নিন তা হলে বাকি পনেরো বাবু আর মুখ খুলতে পারবে না।
না জগা, না। আমি চরিত্র খুইয়ে ব্যবসা করতে পারব না। এই করে এতদিনে দুটো ফ্ল্যাট করেছি, দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি, সারাজীবন নিজেকে বঞ্চিত করে এই মেসে পড়ে থেকেছি, এখন চরিত্র নষ্ট করতে পারব না। গলার স্বর করুণ হয়ে আসছিল। মুখ ছোট দেখাচ্ছিল। ভরত উঠে দাঁড়ল, তা হলে অপেক্ষা করুন।
না, না, তা বলিনি। আমি বলি কি, অন্য মেসে গেলে হয় না?
না। ঠিক আছে। তবে একটা কথা আছে।
বলুন।
কোনো অসুবিধে হলে সবার সামনে আমাকে যেন কিছু না বলা হয়। একটু আড়ালে-আবডালে বললেই হবে। কেমন?
না।
না মানে?
এই মেসে যাতে মানুষ বাস করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
মানুষই তো থাকে এখানে?
গরু-ভেড়ার মতো থাকে। দেওয়ালগুলোয় নতুন করে হোয়াইট ওয়াশ করান। ঘরে যাতে আলো আসে তার ব্যবস্থা করুন।
অসম্ভব। অনেক খরচ। পুরনো বাড়ি, একবার হাত দিলে আর দেখতে হবে না। আমি মরে যাব।
গেলে যাবেন। সকালে চা টোস্ট দেবেন। দুপুরে ঘাটের বদলে একটা ভাল তরকারি, বিকেলে টিফিন আর রাত্রে ডিম অথবা মাংস।
ওই টাকায়? পাগল। আমার হাতে কিছুই থাকবে না।
অনেক তো নিয়েছেন, একটু না হয় কম নিলেন। দরকার হলে একটু চার্জ বাড়ান। কিন্তু বেশি নয়। চলি। বেরিয়ে এল ভরত।
বাইরে বেরিয়ে ছেলেটি বলল, তোমার তো খুব জোর আছে!
তার মানে?
এসব কথা আমাদের কথা। কিন্তু আমরা কেউ বলতে সাহস পাইনি। ছেলেটি হাসল, তুমি কি ওই মেসে এসে থাকবে?
দেখি।
ছেলেটির সঙ্গে ওর মেসে গেল ভরত। যে অবস্থায় ওরা বাস করে দেখে শরীর গুলিয়ে উঠল তার। তখন মেসের বাসিন্দারা কেউ নেই। কিন্তু ঘরে পা ফেলার জায়গা পাওয়া মুশকিল। এই ঘরের অবস্থা আরও করুণ। উপায় নেই বলে মানুষ এমন পরিবেশে থাকতে বাধ্য হয়। ছেলেটি তাকে চা খাওয়াতে চাইল। মেসের চাকর বাইরে থেকে এনে দিল। ভরত হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের জেলায় তো অনেক ভাল কলেজ আছে। তুমি এত কষ্ট করে এখানে থেকে পড়তে এলে কেন?
ছেলেটি হাসল, প্রেসিডেন্সি কলেজে তো পড়তে পারতাম না।
এখানে তোমার কষ্ট হয় না?
প্রথম প্রথম হত, এখন হয় না।
ভরত কিছু বলল না। যে-কোনো কষ্টই প্রথম অসহ্য হয়। সুদেষ্ণা যখন তার প্রস্তাবে অবাক হয়ে গিয়েছিল তখন তার যে কষ্ট হয়েছিল এখন আর ততটা নেই।
বাড়িতে ফেরার সময় ভরত ঠিক করে ফেলল সে মেসে থাকবে না। ওখানে থাকতে পারবে না সে। বাবা এবং মা আলাদা হয়ে যাচ্ছে বলে সে অত কষ্ট করতে পারবে না। বাড়িতে ফিরে সে সোজা পারমিতাদের ফ্ল্যাটে গেল। এই সময় তার ওকে পড়াতে যাওয়ার কথা। পারমিতার বদলে তার মা দরজা খুললেন। খুলে তাকে দেখে একপাশে মাথা নিচু করে দাঁড়ালেন।
ভরত জিজ্ঞাসা করল, পারমিতা আছে?
ভদ্রমহিলা নীরবে মাথা নেড়ে না বললেন।
একটু বিরক্ত হল ভরত, আশ্চর্য! এইসময় পড়াতে আসব বলে গিয়েছিলাম।
আপনি বসুন। ভদ্রমহিলা দরজা আর একটু ফাঁক করলেন। সে ভেতরে ঢুকলে দরজাটা বন্ধ করে চলে গেলেন তিনি। ভরত বসবার ঘরে বসল। পারমিতার এতক্ষণে স্কুল থেকে ফিরে আসা উচিত। সে ভেতরদিকে তাকাল। ভদ্রমহিলার আচরণ বেশ অদ্ভুত। এত আধুনিকা মেয়ে যাঁর তার পক্ষে অমন চালচলন বেমানান।
দশ মিনিট বাদে বেল বাজল। ভরত উঠে দরজা খুলতে দেখল পারমিতা দাঁড়িয়ে আছে, সঙ্গে ওর বাবা। ভরত জিজ্ঞাসা করা, এত দেরি হলো?
শ্রমিক নেতা বললেন, আমরা একটু মার্কেটিং-এ বেরিয়েছিলাম। বসো।
পারমিতা চুপচাপ ভেতরে চলে গেল ওর বাবা চেয়ারে বসে বললেন, শুনলাম ওকে পড়াবে বলে তুমি টাকা চেয়েছ?
আমি টিউশনি করি।
অ। তোমার বাবার যা আর্থিক অবস্থা তাতে টিউশনি করার কথা নয় তোমার।
আমি স্বাবলম্বী হতে চাই।
বেশ। কিন্তু তোমার বাবা-মায়ের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল ওকে একটু ইংরেজিতে কইয়ে বলিয়ে করে দেবার জন্যে তোমাকে পাঠাবেন। চারশো টাকা মাসে খরচ করে ইংরেজিতে কথা বলা শেখানোর সামর্থ্য আমার নেই। ওঁদের সঙ্গে আমার সেই কথাও হয়নি। ওঁরা জানেন, তুমি আমার কাছে টাকা চেয়েছ?
কাজটা আমি করব ওরা জানবে কেন?
কারণ তুমি ওঁদের ছেলে। তোমার বাবাকে আমি ফেবার করছি বলে তুমি এই কাজটুকু করবে। শোন, ইংরেজিতে কথা বলতে পারে না জাপানিরা, তাই বলে ওদের কোন কাজটা আটকে থাকছে? পৃথিবীর অর্থনীতি ওরাই কন্ট্রোল করছে। হ্যাঁ, আমাদের দেশে ইংরেজি বলতে পারলে লোকে সমীহ করে, তাই। কিন্তু ভাই, আমি এটা এক্সপেক্ট করিনি। ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন।
আপনার মেয়ের ইংরেজির ভিত খুব কাঁচা। কথা বলতে গিয়ে দেখলাম ওর ক্লাসের পড়াটাও ঠিক হচ্ছে না। তাছাড়া ওই নিজে আমাকে বলল ওর ক্লাসের ইংরেজি পড়াতে। শুধু ইংরেজিতে কথা বলা শেখানোর জন্যে আমি চারশো টাকা চাইনি। ওর প্রেজেন্ট মাস্টারকে আপনি নিশ্চয়ই টাকা দিতেন?
না। তার ভাইকে চাকরি দিয়েছি। সে পড়াক বা না পড়াক আমার কিছু যায় আসে না।
কী বলছেন আপনি? অবাক হয়ে বলল ভরত।
ঠিকই বলছি। তুমি হাজার পড়িয়ে আমার মেয়েকে পণ্ডিত করে গ্যারান্টি দিতে পারবে যে ও স্কুল ফাইনালে ফার্স্ট ডিভিসন পাবে?
ও যদি সিরিয়াসলি পড়ে, তাছাড়া অন্য সাবজেক্টগুলোও আছে।
কিন্তু এই মাস্টার থাকলে ও ফার্স্ট ডিভিশন পাবেই।
না পড়িয়েও?
হ্যাঁ। পরীক্ষার মাসখানেক আগে প্রশ্নগুলো পেলে কিছু তো লিখতে পারবে। আর সেটা পারলে নাম্বার দিতে ওদের কোনও অসুবিধে হবে না। কত ছেলে স্কুল লাইফে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করেও ফাইনালে গিয়ে ঢ্যাড়ায় কেন? তখন অভিযোগ ওঠে খাতা ভাল করে দেখাই হয়নি। আরে পার খাতা পাঁচসিকে করে পেলে কোন মাস্টারের ধৈর্য থাকে সব কটা উত্তর ঠিক সময়ে পড়ার? বুঝলে? তাই বলছিলাম, তোমাকে ইংরেজি পড়াতে হবে না। আমার সব ঠিক করা আছে। ও বারো ক্লাস দিয়ে জয়েন্ট এন্ট্রান্স দেবে। মেডিকেলে ভর্তি হবে। আমি চাই ও ডাক্তার হোক।
জয়েন্ট দিয়ে ও মেডিকেলে চান্স পাবে?
আলবৎ পাবে। ডাইরেক্ট না পেলে সি এমের কোটায় পাবে?
আপনি কি ডাক্তারিটাও পাশ করাবার ব্যবস্থা করে রেখেছেন?
হাতে তো অনেক সময় আছে, দেখা যাক।
আপনি মানুষ খুন করতে পারেন।
তার মানে? হকচকিয়ে গেলেন পারমিতার বাবা।
আমি চললাম।
না, দাঁড়াও। তুমি আমাকে টন্ট করলে?
আপনি সেটা বুঝতে পারছেন?
শোনও হে, কার সঙ্গে এভাবে কথা বলছ তুমি জানো না? যাও, বাবাকে জিজ্ঞেস কর। ওঁর প্রমোশন হয়েছে আমার জন্যে। আমি বিনিপয়সায় কারও জন্যে কোন উপকার করিনি কখনও কিন্তু তোমার মা আমাকে এমনভাবে তেল মারল যে না করে পারিনি। আমার সঙ্গে ঠাট্টা? দেব তোমার বাবাকে টাইট?
তাতে আমার কিছু এসে যাবে না। বাবা-মা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। এরপর মা নিশ্চয়ই বাবার জন্যে আপনাকে বলতে আসবে না।
এ্যাঁ? আলাদা হচ্ছে? সেকি? দেখে তো বুঝিনি। তা অত মাল খেলে আলাদা হবে না? তা হলে তো ভালই করেছি তোমাকে ছাড়িয়ে দিয়ে। এইসব ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তানকে বাড়িতে ঢুকিয়ে নিজের বিপদ ডাকতাম।
আপনি এসব না করে মেয়ের বিয়ে দিন। আঠারো হয়নি যদিও তবু আপনি তো সব পারেন। তাতে বেঁচে যাবেন। ভরত দরজার দিকে এগোল।
তার মানে?
ও দ্বিতীয় দিনেই আমাকে একটা ইংরেজি বাক্য বলতে পেরেছে।
কী বাক্য?
আই লাভ ইউ। বুঝতেই পারছেন। নমস্কার। সজোরে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে এল সে। রাগে মাথার শিরা দপদপ করছিল। প্রতি বছর কাগজে মুখ্যমন্ত্রীর সুপারিশে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়া ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে সমালোচনা বের হয়। কিন্তু তাতে কোনও কাজ হয় না। এই ভদ্রলোকেরও তাই কোনও অসুবিধে হবে না। এর বিরুদ্ধে তার কিছুই করার নেই। বেনিয়মগুলো মানতে প্রথম প্রথম মানুষের অসুবিধে হত, এখন চারধারে তার এমন প্রাবল্য যে সেটা সহ্য হয়ে গেছে। কষ্টের মতো।
.
সন্ধেটা নিজের ঘরে ছিল ভরত। আটটা নাগাদ বসার ঘরে এসে দেখল বাবা টি ভি দেখছে আর মা কিচেনে। সে গলা তুলে বলল, তোমাদের সঙ্গে আমার কথা আছে।
বলার ভঙ্গি দেখে বাবা একটু অবাক, কী কথা?
মা, এদিকে এসো।
অতএব মা এল। চোখে বিস্ময়।
তুমি সামনের মাসে আলাদা হয়ে যাচ্ছ? বাবাকে জিজ্ঞেসা করল সে।
সবই তো জানিস।
তা হলে তো মায়েরও এই ফ্ল্যাটে থাকা উচিত নয়।
তার মানে? বাবা জিজ্ঞাসা করল, তোর মা কোথায় থাকবে?
সেটা মা ঠিক করবে। এই ফ্ল্যাট তোমরা কিনেছিলে যখন তখন তিনজনের থাকার কথা ছিল। তোমরা আলাদা হচ্ছ। তুমি অফিসের ফ্ল্যাটে উঠে যাচ্ছ, মায়েরও একটা ব্যবস্থা করা উচিত। মা চাকরি নিচ্ছে। যেহেতু আমি বেকার তাই এখানে থাকব।
আশ্চর্য! আমি কোথায় ব্যবস্থা করব? মা এগিয়ে এল, কলকাতায় থাকার জায়গা চাইলে চট করে পাওয়া যায়? আর কত মাইনে পাব আমি যে আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া করব?
সেটা তোমার সমস্যা। বাবার কেনা ফ্ল্যাটে তোমার থাকতে খারাপ লাগা উচিত। ভরত এইভাবে কথা বলতে বেশ মজা পাচ্ছিল।
খারাপ কেন লাগবে? আমি ক্ষতিপূরণ হিসেবে এই ফ্ল্যাটটা নিচ্ছি।
ও। আমার ক্ষতিপূরণ কীভাবে করবে তোমরা?
তোর ক্ষতিপূরণ?
নিশ্চয়ই। তোমাকে বিয়ে করে এখন আলাদা হচ্ছে বলে বাবা ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। তোমরা দুজনে আমাকে পৃথিবীতে এনে আলাদা হচ্ছ যখন তখন তো আমার দুজনের কাছেই ক্ষতিপূরণ পাওনা।
বাবা বলল, তোকে তো বলেছি, তোর যার কাছে ইচ্ছে তার কাছেই থাকতে পারবি। তুই বল কার কাছে থাকবি?
কারো কাছে নয়। একা থাকব। আমি যদ্দিন রোজগার না করব তদ্দিন ভালভাবে থাকতে চাই এবং তোমরা তার ব্যবস্থা করে দাও।
কীভাবে?
হয় এই ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দাও নয় অন্য কোনো ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করে দাও।
বাবা মায়ের দিকে তাকাল। মা সুর পাল্টালো, তোর হঠাৎ মতি বদলে গেল? আমাকে বলেছিলি টিউশনি করে স্বাবলম্বী হবি। তার কী হল? হঠাৎ এইসব কথা মাথায় কী করে এল?
ভেবেছিলাম। পরে মনে হল তোমাদের জন্যে আত্মত্যাগ করার কোনও মানে হয় না। আজ পারমিতার বাবা বলল তুমি তাকে এত তেল দিয়েছ যে বাবার প্রমোশনের ব্যবস্থা তাকে বিনা পয়সায় করে দিতে হয়েছে। ওর মেয়েকে পড়াতে হবে অথচ টাকা নিতে পারব না এমন শর্ত আমি মানিনি। শুনলাম তুমি ওকে কথা দিয়েছ বিনা পয়সায় পড়াব। তুমি যদি আমাকে বা মাকে এক্সপ্লয়েট করতে পার তাহলে চোরের ওপর রাগ করে আমি মাটিতে ভাত খেতে যাব কেন? আমার ব্যবস্থা না করে তোমাদের আলাদা হওয়া চলবে না। ভরত সোজা দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল।
এসব কথা বছরখানেক আগেও বাবা-মাকে বলার কথা ও স্বপ্নেও ভাবতে পারত না। কলেজে ওঠার পর কিরকমভাবে সব পাল্টে গেল। কোথায় যাচ্ছে কেন যাচ্ছে না ভেবে ভরত হাঁটছিল। একটা লোক আলো জ্বালিয়ে ঠেলাগাড়িতে করে কুলপি মালাই বিক্রি করছিল। তাতে দেখে তেষ্টা পেয়ে গেল তার। লোকটার সামনে দুটো ছেলে দাঁড়িয়েছিল। ওকে আসতে দেখে দ্রুত সরে গেল তারা। তাদের দিকে ভাল করে লক্ষ্য না করে ভরত লোকটাকে জিজ্ঞাসা করল, স্পেশ্যাল আছে?
ছোটবেলায় মা তার সামনে স্পেশ্যাল কুলপি খেত। ঠাণ্ডা খেলে গলায় ব্যথা হয়ে জ্বর আসবে বলে তাকে দু-একবার চাটতে দিত। আজ মনে হল আসুক জ্বর সে তবু খাবে। লোকটা চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল।
ভরত ধমক দিয়ে বলল, কী হল? কানে কালা নাকি?
আপনাকে তো আগে কখনও নিতে দেখিনি।
দ্যাখোনি বলে বিক্রি করবে না নাকি?
একটু বেশি দাম পড়বে। পুলিশ খুব নজর রাখছে।
পুলিশ! ভরত হকচকিয়ে গেল। কুলপি মালাই-এর জন্যে পুলিশ কিছু বলে বলে সে জানে না। মা বলত মাঝে মাঝে ভাঙ মিশিয়ে দেয় এরা। ও কি তাই ভাবছে? ভরত জিজ্ঞাসা করল, কত?
চল্লিশ টাকা। মালের বড় টানাটানি যাচ্ছে এখন।
কোয়ালিটি আইসক্রিম এর চেয়ে অনেক সস্তায় পাওয়া যায়। লোকটা বলে কী? কিন্তু ভরতের জেদ চেপে গেল। ও চল্লিশটা টাকা বের করে লোকটার হাতে দিতেই চারপাশে নজর বুলিয়ে নিয়ে ঝুড়ির নিচ থেকে একটা কাগজে মোড়া বস্তু চট করে বের করল। এক টুকরো কুলপি শালপাতায় দিয়ে এগিয়ে ধরল লোকটা, নিন। দুটো ট্যাবলেট আছে। নতুন হলে একসঙ্গে খাবেন না।
শালপাতায় কুলপি নিতে গিয়ে আঙুলে মোড়কটা টের পেল ভরত। হঠাৎ তার শরীর শিরশির করে উঠল। কুলপির টুকরোটা মুখে তুলতে গিয়েও তুলতে পারল না সে।
এটা তা হলে ড্রাগ। কাগজে টিভি-তে ড্রাগের বিরুদ্ধে কত কি লেখা হয়েছে, প্রচার চলেছে। শিল্পী সাহিত্যিকরা ড্রাগবিরোধী মিছিলে হেঁটেছেন কত। ড্রাগের নেশা সর্বনাশা, একটা পরিবার একটা জাতিকে শেষ করে দেয়। অথচ শহরের পথে একটু আড়াল রেখে এখনও সমানে তা বিক্রি হয়ে চলেছে। লোকটা কি তাকে ড্রাগশোর ভেবেছে! একটু আগে চলে যাওয়া লোকদুটো তা হলে ড্রাগ কিনতে এসেছিল! ভরতের মনে হল এই সময় পুলিশ যদি তাকে ধরে তা হলে চূড়ান্ত বিপদে পড়বে। মারাদোনার ড্রাগ খাওয়ার অপরাধে শাস্তি হয়েছিল। কাপ্রিয়েতির বিচার। চলছে। পানামার এক্স-প্রেসিডেন্ট তো এখনও জেলে পচছে। কোনো কোনো দেশে ড্রাগ সমেত কাউকে ধরলে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়। কিন্তু এসব সত্ত্বেও ভরতের ইচ্ছে হচ্ছিল বস্তুটাকে চাক্ষুষ করতে। টি ভি-তে দেখেছে রাঙতার মধ্যে পুড়িয়ে হাতে ডলে সিগারেটের তামাক সঙ্গে মিশিয়ে টানতে। কিন্তু এই বস্তুটি কি রকম?
সে যখন বাড়ির গেটের সামনে পৌঁছে গেছে তখন হঠাৎ দুটো লোক উদয় হল, এক মিনিট!
ভরত হকচকিয়ে গেল। প্রথমে লোকদুটোকে সে চিনতেই পারল না।
আপনি যে আমাদের লাইনের তা জানতাম না তো।
লাইনের? গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল ভরতের।
নেশার কথা বলছি। কত নিল? চল্লিশ?
হ্যাঁ।
শালা রোজ দাম বাড়াচ্ছে। আমাদের মাল কম পড়ে গেছে। কুড়িটা টাকা ধার দেবেন? কাল ওর কাছে দিয়ে দেব!
আপনাদের আমি চিনি না, টাকা ধার দিতে যাব কেন?
এই তো চেনাচেনি হল। এ বাড়িতেই থাকেন? বাঃ। আমরা এখন একই লাইনের লোক। আপনার অভাব হলে আমরা দেখব, আমাদের প্রয়োজনে আপনি। দিনই ভাই, ছাতি ফেটে যাচ্ছে।
আমার কাছে আর টাকা নেই।
নেই? আপনি দেখছি বিশ্বাস করতে পারছেন না। আরে মশাই একবার যখন নেশা ধরেছে। তখন দেখা হবেই। আপনি ড্রাগ খান শুনলে পাবলিক ঘেন্না করবে, আমরা করব না। দিন।
বিশ্বাস করুন, সঙ্গে নেই।
দ্বিতীয় লোকটি বলল, তা হলে বাড়ি থেকে এনে দিন না। এত টানাটানি যাচ্ছে যে রোজ টাকার জোগাড় করতে পারি না।
ভরত খুব নার্ভাস হয়ে গেল। এই লোকদুটো ড্রাগ খায়। তার উচিত এদের পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেওয়া। তা হলে ওই কুলপিওয়ালাও ধরা পড়বে। কিন্তু সেটা করতে গেলে ওরা তাকে জড়িয়ে দেবে। মোড়টাকে সে পকেটে রেখেছিল। বের করে এদের দিয়ে দিলে কি নিষ্কৃতি পাবে? সে কাতরগলায় বলল, দেখুন, আমি কোনওদিন এই নেশা করিনি। আজ হঠাৎ লোকটা আমায় দিতে নিয়ে ফেলেছি।
চাঁদু! নিজের লোকের কাছে মিথ্যে বলে না। আগে খাওনি কিন্তু খেয়ে দ্যাখ সব ভুলে যাবে। যেদিকে তাকাও দেখবে দু নম্বরী চলছে। ভাল কাজ করে তুমি এই পৃথিবীতে বাঁচতে পারবে না। এই যে আমি বারো বছর আগে গ্র্যাজুয়েট হয়েছি আজও চাকরি পাইনি। শালার এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ থেকে একটা চিঠি পাইনি। সবাই শালা লাথি ঝাটা মারছে। এই যে ও, চাকরি নেই বলে ওর প্রেমিকা সটকে পড়েছে একজন মালদারের সঙ্গে। ওর বোন আটটা প্রেম করে আটজনের কাছ থেকেই সোনার হার আর দামী ঘড়ি বাগিয়ে নয় নম্বর খুঁজছে। এসব থেকে ভুলে থাকার বেস্ট রাস্তা হচ্ছে ড্রাগ খাওয়া। যান, নিয়ে আসুন, যাব আপনার সঙ্গে? লোকটা ব্যস্ত হলো।
না। আমি আসছি। ভরত দেখল দারোয়ান তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। লোকটার দিকে মাথা নেড়ে সে ভেতরে ঢুকল। ওদের চোখের আড়ালে আসতেই ওর পা থামল। এখন কী করা যায়? ওদের টাকা দেবে? সে যদি আর ফিরে না আসে তা হলে এই বিশাল হাউজিং থেকে তাকে খুঁজে নিশ্চয়ই বের করতে পারবে না ওরা। তারপরেই মনে হল দারোয়ানই তো হদিশ বলে দেবে। ওরা যদি বাড়িতে এসে ঝামেলা করে, বলে সে ট্যাবলেট কিনেছে?
ভরত ফিরে এল গেটের সামনে। তার সঙ্গেই টাকা ছিল। তা থেকে কুড়িটা টাকা দিয়ে আর দাঁড়াল না সে। হনহনিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
দরজা খুলল মা। কোনো কথা না বলে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল সে। মা বলল, খোকা!
এই ডাকটা অনেকদিন পরে শুনল। ফিরে দাঁড়াতেই মা বলল, তোর বাবা বলছিল ইচ্ছে হলে তুই হোস্টেলে থাকতে পারিস।
কথা না বলে নিজের ঘরে চলে এল সে। হোস্টেলে থাকতে পারিস! যে যার নিজের ব্যবস্থা করে নেবে আর তাকে থাকতে হবে হোস্টেলে! যেন হোস্টেলে গেলে সে খুব সুখে থাকবে! তার কেউ নেই, কেউ না। সুদেষ্ণা নেই, পারমিতা তাকে আই লাভ ইউ! বলা সত্ত্বেও আজ একবারও সামনে আসেনি। বাবা-মায়ের কথা ছেড়ে দিতে হবে। সে কী নিয়ে থাকবে? কাকে নিয়ে? যদি তার কোনও ভাই অথবা বোন থাকত তা হলে এই বিরাট পৃথিবীতে সে একা হয়ে যেত না। ওরা এত স্বার্থপর যে দ্বিতীয় সন্তানকে পৃথিবীতে আনতে চায়নি।
তোর কী হয়েছে? মায়ের গলা পেল সে।
কিছু হয়নি।
তুই আমাকে বুঝতে পারছিস না কেন?
তোমাকে?
হ্যাঁ, আমাকে। তোর বাবা ছেলে। যে কোন অডস-এর সঙ্গে ছেলেদের মানিয়ে নেওয়া অস্বাভাবিক নয় কিন্তু এখনও মেয়েদের পক্ষে সেটা সম্ভব হয়নি।
তোমরা স্বার্থপর।
তুই না বুঝে কথা বলছিস।
না। তোমরা দুজন নিজেদের ইগো নিয়ে রইলে, একবারও আমার কথা ভাবলে না। তোমরা এতদিন ধরে আমার জন্যে যা করেছ তা সবই নিজের স্বার্থে। আজ আমি স্বাবলম্বী হবার চেষ্টা করছি বলে আমার সম্পর্কে কোনও কথা শেষ না করে চিৎকার করে উঠল ভরত, গো অ্যাহেড। যা ইচ্ছে কর। আমি তোমাদের দয়ার ওপর নির্ভর করে থাকব না।
খোকা। আর পাঁচ কি ছয় বছর পরে তুই চাকরি করবি, তারপর বিয়ে করে সংসারী হবি। তখন আমার কাছ থেকে তোর কিছু চাওয়ার থাকবে না। তুই তোর নিজের জগৎ নিয়ে থাকবি। তখন আমি কী করব তা একবার ভেবেছিস? তোর বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কোনোকালেই আর ভাল হবে না। কেন হবে না তার ব্যাখ্যা তোকে দেব না আমি। তোর জন্যে এতকাল অপেক্ষা করেছি। এখন আমার শেষ সময়। আরও ছয় বছর অপেক্ষা যদি করতে হয় তোকে সংসারী দেখার জন্যে তা হলে আমার চারপাশে অন্ধকার থাকবে তখন। তুই কি সেইটে চাইছিস?
তুমি, তুমি কি আবার বিয়ে করবে?
জানি না। জানি না একা হয়ে গেলে আমি কী করব। তবে জীবন যেভাবে আমাকে চলতে বাধ্য করবে সেইভাবে চলব।
আই কান্ট আন্ডারস্ট্যান্ড মা। বাবার সঙ্গে তোমার যে ঘটনা ঘটেছে তা দ্বিতীয়বার বিয়ে করলেও ঘটতে পারে। পারে না?
আমি কিছু ভাবিনি। আমি শুধু মুক্তি চাই। আমার নিজের আইডেন্টিটি নিয়ে বাঁচতে চাই। তুই তোর স্বার্থ দেখে আমাকে নিঃশেষ করে দিলে আমি কী নিয়ে বাঁচব? তোর বাবার সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক নেই, ওই অর্জিত সম্পর্ক ইচ্ছে করলে ভেঙে ফেলা যায়। কিন্তু তোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক রক্তের। একে ভাঙা যায় না, মোছা যায় না। তোর মুখ চেয়ে আমাকে যদি সব হজম করতে হয় তা হলে সন্তানরাই যে বাঙালি মায়েদের প্রধান শত্রু তা আর একবার প্রমাণিত হবে।
সন্তানরা শত্রু?
কথাটা নিষ্ঠুর হলেও সত্যি। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে মায়েরা সব কিছু মুখ বুজে মেনে নেয় শুধু সন্তানের জন্যে। যাকে পেটে ধরে একটু একটু করে বড় করেছে তার ভাল চেয়ে নিজের স্বার্থ বিসর্জন দেয়। কিন্তু বড় হয়ে সন্তান আর মায়ের কথা ভাবে না। তার নিজস্ব জগতে কোথাও মায়ের জায়গা নেই। এ সেই কাকড়ার বাচ্চাদের মতো যারা ডিম ফুটে বেরিয়ে এসে মায়ের শরীরের রক্তমাংস খেয়ে বড় হয়। একসময় মা কাঁকড়া কঙ্কাল হয়ে গেলে বাচ্চাগুলো বাইরের পৃথিবীর দিকে পা বাড়ায়। মায়ের গলায় কান্না ছিটকে এসেছিল। দ্রুত চলে গেল মা চোখের আড়াল থেকে।
কিছুক্ষণ বসে রইল ভরত। তারপর ধীরে ধীরে বাবার ঘরে এল সে। বাবা চুপচাপ শুয়েছিল খাটে, চোখে হাত চাপা দিয়ে। ভরত ডাকল, বাবা!
বাবা হাত সরিয়ে তাকে দেখল।
তোমার এসব ভাল লাগছে?
কারও লাগার কথা নয়।
কিছু করতে পার না তুমি?
আমি হেল্পলেস।
আশ্চর্য! হেল্পলেস! তোমার এত ক্ষমতা, একদিন গর্ব করে বলেছিলে বাঘের দুধও এনে দিতে পার, বলেছিলে টাকা থাকলে কলকাতায় সব করা যায় আর এখন বলছ হেল্পলেস? ফোঁস করে উঠল ভরত।
ভরত!
মা নিজেকে কেন বঞ্চিত মনে করে? কেন তোমাদের সম্পর্ক খারাপ? এত বছর ধরে কেন তোমাদের মধ্যে একটুও বোঝাপড়া হয়নি? এ সবকিছুর কারণ তুমি জানো। সেগুলোকে সংশোধন করতে পারনি?
বাবা উঠল। কাচের গ্লাসে জল ঢাকা দেওয়া ছিল। কলম খুলে তার ভেতরে কয়েকফোঁটা কালি ছড়িয়ে দিয়ে গ্লাসটা আলোর সামনে ধরল। ভরত দেখল কালির ফোঁটাগুলো জলের ভেতর ঢুকে আস্তে আস্তে মিশে যাচ্ছে। শেষপর্যন্ত জলের রঙ পাল্টে গেল। বাবা গ্লাসটা ধরে রেখে বলল, এখন ওই কালিটাকে জল থেকে আলাদা করা কি সম্ভব? সম্ভব নয়। জলটাকে ফুটিয়ে বাষ্প করে আবার নতুন জল পেতে পারিস কিন্তু কালিটাকে পাবি না। তখনও মনে হবে ওই জলে কালি মিশেছিল, হয়তো এখনও চরিত্র বদলে আছে।
তা হলে দুজন মানুষ সারাজীবন একসঙ্গে থাকে কী করে?
আমি জানি না। বেশিরভাগ মানুষ সহ্য করতে করতে সমস্ত বোধ মেরে ফেলে অসাড় হয়ে থাকে। কারও প্রবল ইচ্ছে সত্ত্বেও উপায় থাকে না বলে থাকে।
অতীতে যা হবার হয়েছে কিন্তু তুমি কি পার না ভবিষ্যতে অন্যজীবন তৈরি করতে?
ভবিষ্যৎ তো অতীতের ভিতেই দাঁড়িয়ে থাকবে।
তা হলে তোমার বন্ধুরা যখন আসত, মা তাদের ফ্রাই ভেজে দিত, হাসিঠাট্টা করত, সেটা কি শুধুই অভিনয় ছিল?
হ্যাঁ। তাই এজন্যে আমি ওর কাছে কৃতজ্ঞ।
তা হলে তোমার প্রমোশনের জন্যে মা ওই শ্রমিক নেতাকে তেল দিতে গেল কেন?
প্রমোশন না পেলে আলাদা ফ্ল্যাট অফিস থেকে দিত না। ওই ফ্ল্যাট পাওয়া খুব জরুরি ছিল। আমার ভাল লাগেনি কিন্তু মেনে নিতে হয়েছে।
আমার তো অনেক কিছু ভাল লাগছে না। রাস্তায় পুলিশ প্রকাশ্যে ঘুষ নিচ্ছে, সি.এমের কোটায় বাজে ছেলেমেয়ে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পাচ্ছে, পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র পেয়ে যাচ্ছে। ইনফ্লুয়েন্সিয়াল নেতার ছেলেমেয়ে, নাম্বারটা তাদের ইচ্ছেমতো দেওয়া হচ্ছে, প্রকাশ্যে একজন মহিলাকে নগ্ন করার অপরাধে অপরাধীও বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, মন্ত্রীর বাড়িতে অপরাধীকে ধরতে গিয়ে পুলিশ অফিসার সাসপেন্ড হচ্ছে, এসব মেনে থাকতে পারি তা হলে তোমরা পরস্পরকে মেনে নিতে পার না কেন? ভরত ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
.
কোনো লাভ নেই। কথা, যুক্তি যে এ মুহূর্তে অচল ভরত বুঝতে পারছিল। তার কেবলই কৌতূহল হচ্ছিল, কী কী কারণে বাবা এবং মায়ের সম্পর্ক এইরকম হল তা জানা যাচ্ছে না। দুজনের কেউ বলছে না। ওরা আর নিজেদের মধ্যে ঝগড়াও করছে না। এত বছর এই বাড়িতে একসঙ্গে থেকেও সে নিজে কখনও জানতে পারেনি। তাকে ওরা এমন শিশু করে রেখেছিল যে এসব ব্যাপারে আগ্রহ হয়নি।
হঠাৎ পুরিয়াটার কথা খেয়াল হল ভরতের। সে সন্তর্পণে মোড়কটা বের করল। দুটো ট্যাবলেট। একেই কি ড্রাগ বলে? ড্রাগ তো পুড়িয়ে খায়! তা হলে? ভরত উঠে দরজা বন্ধ করল। সঙ্গে সঙ্গে দরজায় আওয়াজ হল, খেতে দিচ্ছি।
মায়ের গলা। ভরত গলা তুলল, আমারটা ঢেকে রেখে দাও।
মা দ্বিতীয়বার অনুরোধ করল না। সেটাই স্বাভাবিক। এখন যা বলার তা বলা হয়ে গিয়েছে। খাওয়ার টেবিলে একসঙ্গে বসে নাটক করার আর কোনো প্রয়োজন নেই। প্রচণ্ড রাগ হয়ে গেল। ভরতের। ঘরে বাইরে এইসব দুশ্চিন্তা থেকে যেন মুক্তি নেই। সমস্ত পৃথিবীটা জুড়ে যেন ক্যান্সারের বিষ ছড়িয়ে পড়েছে। কে যেন বলেছিল ক্যান্সার রোগীর শেষ সময়ে যে যন্ত্রণা তা সহ্য করার চেয়ে তাকে আত্মহত্যা করার অধিকার দেওয়া উচিত। আমি একার চেষ্টা এই দেশের চেহারাটা পাল্টাতে পারব না। আমার মতো অনেকে কবে একত্রিত হয়ে সেই করবে তার ঈশ্বর জানেন। আমি একা এই বাড়ির চেহারাটাও বদলে দিতে পারব না। আমি অর্থহীন, দুর্বল একটি প্রাণীমাত্র। আমার চারপাশে ক্যান্সারের বিষ আর তার মধ্যে আমাকে বাস করতে হবে। আমি কেন সেটা মেনে নেব? আমি আত্মহত্যা করব। এই অধিকার আমাকে দেওয়া হয়েছে কি না তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাবো না। লোকটা বলেছিল এসব থেকে ভুলে থাকার একমাত্র উপায় ড্রাগ খাওয়া। সারা পৃথিবী জুড়ে ড্রাগের বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে কিন্তু যারা ড্রাগ খায় তাদের কথা শোনার কোনও চেষ্টা হয়েছে? কেন তারা ড্রাগ খায়? যে পৃথিবীতে সিগারেট খাওয়া বন্ধ করার জন্যে ব্যস্ততা শুরু হয়েছে সেই পৃথিবীতেই সিগারেট বিক্রি হচ্ছে প্যাকেটের ওপর সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর বাক্যটি লিখে। যদি ক্ষতিকর হয় তা হলে সরকার সেটা বিক্রি করতে দিচ্ছে কেন? সব ব্যাপারে এই ভাওতাবাজি। চারপাশে এখন দু নম্বরীদের মুখ আর মুখোশ একাকার।
ড্রাগ খেলেই মানুষ মরে যায় না চট করে। খেতে খেতে একসময় হয়তো মরে যায়। একটা বাচ্চা ছেলে যেমন কলকাতা শহরে টানা বাস করলে পলিউশনের কারণে ফুসফুস নংরা হয়ে মরে যেতে পারে। একটা মদ্যপ যেমন লিভার পচিয়ে মরে যায় অথবা একজন মাস্তান নেতাদের আশ্রয়ে মাস্তানি করতে করতে গুলি খেয়ে মরে। কিন্তু মাত্র একবার একটা ট্যাবলেট খেলে কিরকম প্রতিক্রিয়া হয় তা তার জানা নেই।
ক্রমশ সেটা জানার ইচ্ছে প্রবল হতে লাগল। একটা ট্যাবলেট খেলে কিরকম অনুভূতি হয়? কিন্তু কৌতূহল বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও কোথাও যেন কি একটা বাধা দিচ্ছিল তাকে। সঙ্গে সঙ্গে বাবার তুলে ধরা জলের গ্লাসের ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠল। ভরত উঠে ঢাকা দেওয়া জলের গ্লাসটা তুলে এক ঢোঁক গলায় ঢালল। তারপর একটা ট্যাবলেট মুখে ফেলে দিল। ওটা কিভাবে খায় সে জানে না। ওষুধ যেমনভাবে খেতে হয় সেইটেই সহজ উপায়। অসুখ হলে এভাবে ওষুধ খেতে হয় তাই এতকাল জেনে এসেছে।
প্রথমে কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না। সে সব কিছু সহজ সরলভাবে দেখতে পাচ্ছে। কোনও কিছু ভাবতে অসুবিধে হচ্ছে না। তারপরেই শরীর ঝিমঝিম করতে লাগল। বিছানায় শুয়ে পড়ল ভরত। সমস্ত শরীর জুড়ে অদ্ভুত অস্বস্তি। ঘরের টিউবলাইটটা যেন একডজন হয়ে গেছে আচমকা। চোখের সামনে নীল লাল হরেক রকম আলো।
তখনও ভেতরে ভেতরে একধরনের সচেতন শক্তি কাজ করছিল। ভরত প্রাণপণে ভাবতে চেষ্টা করছিল তার কিছু হয়নি, সব কিছু ঠিক আছে। বিছানা থেকে ধীরে ধীরে উঠে বসার চেষ্টা করল সে। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল শরীর ওপরে উঠে যাচ্ছে। আর কি আনন্দ! সে যেন পরীদের মতো আকাশে ভাসতে পারছে। ওড় ওড় ওড়। চঁদমামা দেয় হামা–। তার শরীরটা এখন এত হাল্কা। ঘরের দেওয়াগুলো সরে সরে যাচ্ছে আর সে ইচ্ছেমতন ঘোরার অথবা ওড়ার জায়গাটা বাড়িয়ে নিতে পারছে। এখন তার কোনো কষ্ট নেই, দুঃখ নেই। তার কী কোনো কষ্ট ছিল? দুঃখ ছিল? কিছুই মনে করতে পারল না ভরত। কে যেন তার দিকে উড়ে উড়ে আসছে। যে আসছে তার হাতে মালা। কাছে আসতেই সে সুদেষ্ণাকে চিনতে পারল। সুদেষ্ণা তাকে দেখে একগাল হাসল, হাই!
সে জবাব দিল, হাই।
সুদেষ্ণা হেসে বলল, চল যাই কুঞ্জবনে।
ভরত জিজ্ঞাসা করল, সেখানে গিয়ে আমরা কি করব?
সুদেষ্ণা চোখ ঘোরাল, ন্যাকা। নেকু আমার। নেকু সোনা।
মাইরি বলছি আমি জানি না।
আমরা লাভু লাভু খেলব।
লাভু লাভু? সে কেমন খেলা?
আই লাভ ইউ, টুকি! আমি তোমার টুনটুনি পাখি হব, তুমি আমার আলেকজান্ডারের বাজপাখি। এই ধর না, আমাকে ধর।
আবেগে গলে গিয়ে ভরত তাকে ধরতে যেতেই সুদেষ্ণা ইন্দিরা গান্ধী হয়ে গেল। ভরত বলল, যাচ্চলে।
ইন্দিরা গান্ধী বলল, আমি এখন স্ট্যাচু। মাথার ওপরে আরশোলা ঘুরছে, ওটাকে তাড়িয়ে দাও।
ভরত সযত্নে আরশোলা তাড়াল। আরশোলা উড়ছে। উড়তে উড়তে বলল, জিন্দাবাদ।
ভরত জিজ্ঞাসা করল, কিসের জিন্দাবাদ ভাই?
জানি না। বলতে হয় বলছি। দেশে তো এখন কোনও অভাব নেই। কোনো শ্রেণিশত্রু নেই। টাটা বিড়লা আমাদের বন্ধু, প্রধানমন্ত্রী বুকডন দেয় সি. এমের ডিকটেশন শুনে। নো প্রতিপক্ষ অই স্ট্যাচুটাকে আক্রমণ করেছিলাম।
আরশোলাকে ছেড়ে দিয়ে শ্যামবাজারের মোড়ে পৌঁছে ভরত ওপর থেকে দেখতে পেল একজন সার্জেন্ট বাইকে হেলান দিয়ে গান গাইছে, আমায় যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানি। একটা লরিওয়ালা যেতে যেতে দাঁড়িয়ে গেল, কী করব স্যার? আপনি ঘুষ নেবেন না?
না। নো এন্ট্রিতে ঢুকলে তোর লাইসেন্স কেড়ে নেব বরাহনন্দন।
লরিওয়ালা আবার ফিরে যেতে হাততালি দিয়ে উঠল ভরত, ও দাদা, আপনি গান গাইছেন?
সার্জেন্ট ওপরের দিকে তাকাল, কেন? গান গাইতে পারি না? মন্ত্রী নাটক লিখতে পারে, ফাংশন করাতে পারে যখন তখন আমিও গাইব।
ভরত হকচকিয়ে গেল। সে ওড়ার কথা ভাবতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে চলে এল। সেখানে মিটিং হচ্ছে। একজন জঙ্গি মন্ত্রী বলছেন, আমাদের নম্র হতে হবে। বাংলা সাহিত্যের প্রবীণ সেবকদের শ্রদ্ধা করতে শিখতে হবে। বঙ্কিম রবীন্দ্রনাথ তারাশঙ্করকে অস্বীকার করে বাঙালি কখনও বেঁচে থাকতে পারে না। মনে রাখবেন এঁরা কেউ অশ্লীল লেখা লেখেননি, বুর্জোয়াদের শ্রমিকের বিপক্ষে কলম ধরেননি বরং এঁরা বারংবার বলেছেন, আমি তোমাদের লোক। হাততালি পল্ল। ভরত খুব খুশি হল। কিন্তু ওরা কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না কেন? হঠাৎ সে দেখল কলেজ স্ট্রিট কালো করে একটা স্টেটবাস ডিজেলের ধোঁয়া ছড়াতে ছড়াতে আসছে আর তার পেছনে অদ্ভুত সব যন্ত্রপাতি নিয়ে কিছু লোক একটা লরিতে। সে বাসড্রাইভারের পাশে নেমে এল, এই যে মশাই, ধোঁয়া ছড়িয়ে কলকাতার বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছেন?
লোকটি বলল, দুর মশাই! কলকাতা মেগাসিটি হবে তাই ফরেন এক্সচেঞ্জ আর্ন করতে সাহায্য করছি। পৃথিবীর কোথাও আর ডিজেলের কালো ধোঁওয়ার সঙ্গে রাস্তার হাওয়ার মিকচার পাওয়া যায় না। তাই পেছনের ট্রাকের লোকেরা সেটা সংগ্রহ করছে উত্তর মেরুতে পাঠাবে এক্সপেরিমেন্টের জন্যে। তার বদলে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক লক্ষ লক্ষ ডলার দেবে। গ্রো মোর ধোঁয়া অ্যান্ড। মেক মেগাসিটি।
তারপর আর কিছু খেয়াল নেই। দপ করে যেন সব আলো নিভে গেল। তেষ্টায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছিল। দু হাতে বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরে সে কিছু একটা করার চেষ্টা করেছিল যা তার মনে নেই।
.
চোখ খুলতেই সাদা দেওয়াল। এই দেওয়াল তার ঘরের নয়। ভরত আবিষ্কার করল সে যেখানে শুয়ে আছে তার সব কিছু সাদা। পরক্ষণেই একটা তীব্র কষ্ট সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। যেন তার শরীরে সর্বত্র সাহারা মরুভূমির দুপুর হয়ে গেছে। সে কোনওমতে বলল, আঃ।
বলমাত্র একরাশ যন্ত্রণা শাবল ঠোকরাতে লাগল। গলা কানে এল, কী রকম লাগছে?
খুব কষ্ট হচ্ছে। জল, জল খাব!
দাঁড়ান, ডাক্তারবাবু আসুন। সাদা জামা পরা মহিলাটি যে নার্স তা বুঝতে পারল ভরত। ওর ইচ্ছে হচ্ছিল লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে এসে গ্লাস জল খুঁজে নিতে। কিন্তু উঠতে গিয়ে আবিষ্কার করল সমস্ত শরীর ভারী এবং অসাড়। তার একটুও শক্তি অবশিষ্ট নেই। সে চোখ বন্ধ করল।
খানিক পরে পুরুষ কণ্ঠ শুনল, সেন্স এসেছে? ভাল। কী বলছে?
জল খেতে চেয়েছে।
শুধু জল না ওই ট্যাবলেট-ফ্যাবলেট?
না। জল।
একটা হাত খপ করে তার কব্জি ধরল। পালস দেখছ বোধহয়। এই লোকটা তা হলে ডাক্তার। ট্যাবলেটের কথা বলল কেন? ভরতের মনে পড়ল সে ট্যাবলেট খেয়েছিল। নগদ চল্লিশ টাকা দিয়ে কেনা দুটো ট্যাবলেটের একটা সে গলায় ঢেলেছিল কিন্তু দ্বিতীয়টা কোথায়?
স্যালাইনটা খুলে দিন।
তার কি স্যালাইন চলছিল? সে এখন কোথায়? এটা তা হলে হাসপাতাল? না নার্সিং হোম! লোকটা তার পাশে চলে এল, এ যে ভাই! শুনতে পাচ্ছ?
ভরত চোখ খুলল।
এখন কেমন লাগছে?
ভাল না। সে কথা বলল কিন্তু নিজের গলা অচেনা মনে হলো।
লাগার তো কথা নয়। সত্তর ঘন্টা সেন্সলেস থাকার পর কেউ গান গাইতে পারে না। খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। কটা ট্যাবলেট খেয়েছ?
একটা।
অ্যাঁ? একটাতেই এই অবস্থা। ঐ কদিন ধরে খাচ্ছ?
এই প্রথম। আমি জল খাব।
কেন?
তেষ্টা পাচ্ছে।
ডাক্তার নার্সকে বললেন, দু চামচ জল দিন। ওর আরও কিছুক্ষণ ঘুমানো দরকার। পালস খুব লো। ইঞ্জেকশনটা দিয়ে দেবেন।
নার্স তাকে জল দিল। দু চামচ জল যে অমৃতের চেয়ে সুস্বাদু তা জীবনে প্রথমবার টের পেল ভরত। তার পরেই হাতে একটা যন্ত্রণা হয়েই মিলিয়ে গেল। ভরত বুঝতে পারল ধীরে ধীরে সে আর কিছু ভাবতে পারছে না। ঘুম আসছে সমস্ত পৃথিবী ঢেকে দিয়ে। তার চোখ বন্ধ হয়ে গেল।
.
নার্স বলল, বেডে শুয়ে মুখ ধোবেন না টয়লেটে যেতে পারবেন?
ভরত চোখ মেলেছিল একটু আগেই। নার্স জানলা খুলে দিতে বুঝেছিল এখন সকাল। সে বলল, টয়লেটে যাব।
কিন্তু তাকে ধরতে হলো। নার্স বলল, আমার কাঁধে হাত রেখে হাঁটুন। লজ্জা করার কিছু নেই, আপনি আমার ভাই-এর চেয়ে ছোট।
টয়লেটে পৌঁছে নিয়ে নার্স বাইরে বেরিয়ে গেল কিন্তু দরজাটা সামান্য ভেজিয়ে দিল মাত্র। প্রচন্ড দুর্বল লাগছে। পরিচ্ছন্ন হয়ে এক পা হাঁটতে মাথা ঘুরে গেল। সে দেওয়াল ধরে সোজা হতেই নার্স চলে এল কাছে। যত্ন করে বিছানায় ফিরিয়ে এনে বলল, শরীর তো ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। ধোঁয়া এঁকেছেন না ট্যাবলেট খেয়েছেন। ধোঁয়াতে তো এত বাড়াবাড়ি হয় না।
ভরত জবাব দিল না।
নার্স বলল, কোনও লাভ হয় না। একটু একটু করে মরে যাওয়ার কী মানে আছে? এত অল্পবয়স এখনই কি এমন দুঃখ যে ওসব গিলতে গিয়েছেন?
আপনার কোনও দুঃখ নেই? দুর্বল গলায় জিজ্ঞসা করল ভরত।
ওমা। থাকবে না কেন? নার্স বলল, সারাজীবন চাকরি করে ভাইবোনদের মানুষ করলাম, বিয়ে দিলাম এখন যে যার নিজেরটা নিয়ে আছে। এই চাকরি করতে এসে কতবার ইজ্জত নিয়ে টানাটানি হয়েছে, বেশি প্রতিবাদ করলে চাকরি যাবে তাই কোন্ কায়দায় লাঠি না ভেঙে সাপ মারতে হয় শিখে নিয়েছি। সবাই তাই করে। শুধু আপনার মতো বোকা গাধারা ওসব খায়। বলে হাসল, দুঃখ কিসের? প্রেম?
না।
তা হলে। বাবা-মাকে দেখে মনে হয় কোনো অভাব নেই।
বাবা-মা? তারা আসে?
ওমা। আসবে না কেন? দুবেলা আসে। আপনাকে এখানে নিয়ে আসার পর দুজনে পালা করে থেকেছে দিনরাত। খুব ভাল মানুষ।
ভরতের এতক্ষণে ওদের কথা মনে এল। তাকে এখানে নিয়ে ওরাই এসেছে। কবে? আজ কত তারিখ? জিজ্ঞসা করল সে। উত্তর শুনে সে অবাক? তিনদিন কেটে গেছে এখানে? এই তিনদিনের কোনো স্মৃতি তার মনে নেই।
বাবা-মা পালা করে তার জন্যে এখানে উপস্থিত থেকেছে। কথাটা শুনে বিশ্বাস করতে খুব ভাল লাগল। কেন থাকল? শুধু তার প্রতি যে স্নেহ তা থেকে জেগে ওঠা উদ্বেগ এর কারণ? কি জানি! আর দিন পাঁচেক বাদে বাবা চলে যাবে নতুন ফ্ল্যাটে। এই তিনদিন যদি অফিস কামাই করে তা হলে প্রমোশন আটকে যাবে না তো? একেবারে শয্যাশায়ী না হলে বাবাকে অফিস কামাই করতে দ্যাখেনি সে। অতএব ব্যাপারটা বিস্ময়কর।
নার্স তাকে চা খাওয়ালো, সঙ্গে ভিটামিন। খানিকবাদে ভরতের ইচ্ছে হচ্ছিল আবার ঘুমিয়ে পড়তে। খুব কাহিল লাগছিল তার। এই সময় পর্দাটা ঈষৎ সরে গেল। সে বালিশে মাথা রেখেই দেখল, মা দাঁড়িয়ে আছে।
মাত্র কদিন, কিন্তু মায়ের চেহারা যেন একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে। চুল বেশ উস্কোখুস্কো, চোখের তলায় কালি। মায়ের পেছনে নার্স।
নার্স বলল, আর কোনো চিন্তা নেই। ডাক্তারবাবু বলেছেন ভয় কেটে গিয়েছে। কয়েকটা টেস্ট করে ছেড়ে দেবে।
মা চুপচাপ এগিয়ে এসে পাশের টুলে বসল। নার্স জিজ্ঞাসা করল, বাবা আসেনি?
মা বলল, আসবে।
আসলে এটা যদি প্রথমবার হয় তা হলে ভয় নেই। বিষ এখনও রক্তে মিশে যায়নি। একবার মিশে গেলে ছাড়ানো মুশকিল। নার্স কথা বলে যাচ্ছিল।
মা বলল, ঠিক আছে।
মহিলা বুদ্ধিমতী, ইঙ্গিত বুঝতে পেরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
.
মা জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছিস?
ভরত তাকাল। মুখে কিছু বলল না।
এই কদিনেই চেহারা কি হয়ে গেছে। মুখে রক্ত নেই একটাফোঁটা।
ঠিক হয়ে যাবে।
নাও হতে পারত। আমরা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মায়ের হাত ওর হাতের ওপর এল। কদিন এই স্পর্শ পায়নি সে।
তোমরা কী করে টের পেলে?
তোর বাবা টের পেয়েছিল। রাত বারোটা নাগাদ ওর তোকে কিছু বলতে ইচ্ছে হওয়ায় ঘরে যেতে গিয়ে দ্যাখে দরজা বন্ধ। অনেকবার ধাক্কা দিতেও যখন দরজা খুলল না–ওঃ, আমার রক্ত হিম হয়ে গিয়েছিল।
কী কথা বলতে গিয়েছিল বাবা?
আমি জানি না। মাথা নাড়ল, জীবনে যা করিনি তাই করছি। কালীঘাটে মানত পর্যন্ত দিয়েছি। এ তুই কেন করতে গেলি খোকা?
তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না।
কেন?
আমি নেশা করব বলে ওটা খাইনি।
তা হলে?
কৌতূহলে খেয়েছিলাম।
কেন?
জানি না।
খেয়ে তো দেখলি!
দেখলাম। অনেক কিছু দেখলাম।
কী দেখলি?
পৃথিবীটা কি রকম ভাল হয়ে গিয়েছিল। হাসল ভরত, আচ্ছা, মা, আর একটা ট্যাবলেট ছিল, সেটা কোথায়?
পুলিশ নিয়ে গেছে।
পুলিশ?
নার্সিং হোম থেকে খবর দিয়েছে পুলিশকে। একটা সময় এরা তোর প্রাণের আশংকা করছিল। তো বাবা এখন থানায় গিয়েছে।
বাবা অফিসে যাচ্ছে না?
না
ভরত চুপ করে গেল। ঠিক তখনই পর্দা সরিয়ে বাবাকে ঘরে ঢুকতে দেখল। বাবার পরনে পাজামা পাঞ্জাবি, অফিসে যাওয়ার পোশাক নয়। বাবা তার পাশে এসে দাঁড়াল, খুব উইক লাগছে তো?
হ্যাঁ।
তোর মত ছেলে ড্রাগ খাবে আমি আশা করিনি।
কেন?
তুই আর পাঁচজনের মত তো নস। যাকগে, আমি ডাক্তারকে বলেছি তোকে বাড়ি নিয়ে যাব। বাবা বলল।
মা বলল, তবে যে, ওরা বলল কী সব পরীক্ষা করবে?
দেখতে চাইছে আবার অ্যাটাক হয় কি না? অ্যা
টাক মানে?
যারা এ্যাডিক্টেড তাদের একটা সময় পরে ড্রাগ নেবার ইচ্ছে প্রবল হয়। তখন কিছুতেই রেজিস্ট করতে পারে না। ওই সময় ড্রাগ না পেলে অসুস্থ হয়ে পড়ে। পাগলের মতো আচরণ করে। আমি বলেছি খোকার ক্ষেত্রে সেরকম সম্ভাবনা নেই। দিস ওয়াজ হিজ ফার্স্ট অ্যাডভেঞ্চার এবং এটা রেকার করবে না। বাবা হাসল, কিন্তু পুলিশ তোকে কিছু প্রশ্ন করবে। তোর কাছে কিছু জানতে চাইবে। যা সত্যি তাই বলবি।
মা বলে উঠল, কী দরকার ছিল। তুমিই তো কথা বলতে পারতে।
আমি তো কিছুই জানি না। তবে ভয়ের কিছু নেই, এটা রুটিন ব্যাপার। বলে বাবা দরজার কাছে গিয়ে পর্দা সরিয়ে ডাকলেন, আসুন স্যার।
ভরত একজন প্রৌঢ়কে ঢুকতে দেখল। পান খাচ্ছেন। পরনে পুলিশের উর্দি নেই। একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি শরীর ভাল?
ভরত এবারও জবাব দিল না।
বাবা বলল, আপনি বসে কথা বলুন।
মা সঙ্গে সঙ্গে উঠে টুলটা এগিয়ে দিল। ভদ্রলোক একটুও বিব্রত না হয়ে সেটা টেনে নিয়ে একেবারে মুখের কাছে এসে বসল, তুমি কী খেয়েছ?
ট্যাবলেট।
কী ট্যাবলেট? নাম কী?
জানি না।
ট্যাবলেট এই প্রথম?
হ্যাঁ।
আগে কি খেতে? পাউডার?
আগে কখনও এইসব খাইনি।
দ্যাখ, আমি চাই তুমি সত্যি কথা বল। তোমাদের এলাকায়ে অন্তত ছজন ছেলে রেগুলার ড্রাগ নেয়। তাদের মধ্যে দুজনের কেস খুব খারাপ। বারংবার চেষ্টা হয়েছে সারাবার, ফিরে গিয়ে আবার খাচ্ছে। টাকার জন্যে বাড়িতে ঝামেলা করছে। ওদের গার্জেনরা বলছে যে কোনও একটা কেস দিয়ে দুচার বছর জেলে ঢুকিয়ে দিতে। অর্থাৎ তোমাদের ওখানে এসব চালু আছে। এদের চেনো?
আমি কাউকে চিনি না।
এবার বাবা বলল, আমি তো আপনাকে বলেছি ও কখনও ওসব খায়নি।
বলেছেন। ডাক্তারও তাই বলেছে। তবু ওর মুখ থেকে শোনা আমার কর্তব্য। আচ্ছা, এই যে ট্যাবলেট তুমি খেয়েছ তার রিঅ্যাকশনের কথা তুমি জানতে?
না।
তাহলে খেলে কেন?
কৌতূহলে।
শাবাশ। কেউ তোমাকে বলেনি এটা খেলে কী হতে পারে?
না।
তোমাকে ট্যাবলেট কে দিল?
আমি কিনেছিলাম।
কোত্থেকে?
কুলপি মালাইওয়লার কাছ থেকে।
লোকটা তোমাদের পাড়ায় কুলপি বিক্রি করে?
হ্যাঁ।
ওর কাছে ট্যাবলেট পাওয়া যায় তা তুমি জানলে কী করে?
আমি জানতাম না। আমি ওর কাছে গিয়ে একটা স্পেশাল চেয়েছিলাম। স্পেশাল কুলপি। ও ভেবেছিল আমি এই জিনিস চাইছি। চল্লিশ টাকা দাম চাইল দুটোর জন্যে। কুলপির দাম অত হতে পারে না বলে আমার কৌতূহল হল। আমি নিয়ে নিলাম। ভরত কথাগুলো বলতে বলতে নিঃশ্বাস নিল।
নিয়ে তো নিলে, খেলে কেন? শুধুই কৌতূহলে? তুমি ভাল কলেজে পড়। তুমি নিশ্চয়ই ড্রাগ সম্পর্কে অনেক কিছু জানো। ড্রাগের বিরুদ্ধে যখন সমস্ত পৃথিবী লড়াই করছে তখন তুমি কৌতূহলে খেয়ে নিলে? ঐটা বিশ্বাস করতে বলছ?
ঠিক তা না–।
গুড। সত্যি কথাটা বলো।
আমি ওটা কেনার পর দুটো লোক এসে আমার কাছে টাকা চাইল। তাদের টাকা কম পড়ে গিয়েছিল। ধার চাইল। আমি দিতে না চাওয়ার ওরা খুব কাকুতি মিনতি করছিল। শেষ পর্যন্ত বলল ওটা খেলে সব ভুলে থাকা যায়। ওরা আমার বাড়িও চিনে ফেলেছিল। ওদের এড়াবার জন্যে আমি টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু ওই যে কথাটা, সব ভুলে থাকা যায়, শোনার পর মনে হল পরীক্ষা করা যাক।
লোকদুটো কোথায় থাকে?
আমি জানি না। আমার আগে ওরা কুলপি মালাইওয়ালার কাছে গিয়েছিল।
ঠিক আছে। কিন্তু ভাই, তোমার কাছে ওই নিষিদ্ধ ট্যাবলেট পাওয়া গিয়েছে। এটা যে অপরাধ তা নিশ্চয়ই জানো?
ভরত চুপ করে থাকল।
ভদ্রলোক হাসলেন, তোমাকে জেলে পাঠিয়ে চিরকালের জন্যে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার চেয়ে সংশোধনের জন্যে সুযোগ দেওয়া অনেক দরকারি। আমি সেই সুযোগটা তোমাকে দিচ্ছি। কিন্তু ভবিষ্যতে যদি আবার এই কাজ করো– আচ্ছা তুমি বলেছিলে, ওরা ভুলে থাকার কথা বলেছিলে তুমি কী পরীক্ষা করতে চেয়েছিলে?
ভরত একটা বিষণ্ণ হাসি হাসল, জবাব দিল না।
অফিসার বললেন, নো। এড়িয়ে গেলে চলবে না। উই ক্যান হেল্প ইউ।
পারবেন না।
পারব না! এতটুকু বয়সে তুমি এত জেনে বসে আছ। কথা বলো।
এর ওষুধ দুটো। এক, আমাদের চারপাশের মানুষ এবং তাদের চরিত্র বদলে দেওয়া যা কখনই সম্ভব নয়। দুই, এখন থেকে প্রতিমুহূর্তে স্বার্থপর হয়ে জীবন কাটানো।
আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না।
আপনি বুঝতে পারবেন না।
অফিসার কাঁধ নাচালেন, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বাবাকে বললেন, আপনাদের ছেলে, ওর প্রব্লেম আপনাদেরই দেখা উচিত।
অফিসার চলে গেলে জিজ্ঞসা করলেন, খোকা, এখন যেতে পারবি?
কোথায়?
বাড়িতে।
এখন বাড়িতে গেলে তোমাদের অসুবিধে হবে।
মা জিজ্ঞাসা করল, কেন একথা বলছিস?
আমার গায়ে একফোঁটা শক্তি নেই।
জবাব দেবার আগে শব্দ পেয়ে মা দরজার দিকে তাকাল। ডাক্তার চলে এলো বেডের কাছে, কি? কেমন আছ?
আছি।
একজন সাংবাদিক এসেছিলেন আমার কাছে অন্য একটা কাজে। তাকে তোমার কথা বললাম। স্রেফ কৌতূহলী হওয়ার তোমার কী অবস্থা হয়েছিল। এত দিন জেনে এসেছি জীবন সম্পর্কে হতাশ হয়ে, হেরে গিয়ে ছেলেরা ড্রাগ খায়, বড়রা মদ ধরে। অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় কেউ এসব কখনও করে?
আমি অ্যাডভেঞ্চার করিনি।
আই সি।
ধরুন, রেডিও বা টি ভি খারাপ হয়ে গিয়েছে একটা তার কেটে যাওয়ায়। আমি মেকানিকজম জানি না তাই মেকানিক যদি বলে দুশো টাকা খরচ হবে আমাকে তাই মানতে হবে। লোকটা ঠকাচ্ছে এবং আমি ঠকছি।
হ্যাঁ। অসৎ লোকেরা তাই করে।
পেটে যন্ত্রণা হচ্ছে, আমি আপনার কাছে এলাম। আপনি দেখে শুনে বললেন অপারেশন করতে হবে। পাঁচ হাজার টাকা বেরিয়ে গেল। কিন্তু যন্ত্রণাটা কয়েকটা ক্যাপসুল খেলে সেরে যেত। তাতে পঞ্চাশ টাকার বেশি আপনি পেতেন না।
হ্যাঁ। অসৎ ডাক্তাররা এরকম করে থাকে বলে শুনেছি।
আপনি নিজে কখনও করেনিনি?
ডাক্তারবাবু মাথা ঘুরিয়ে বাবার দিকে তাকালেন। তারপর ভরতের দিকে তাকিয়ে বললেন, করলে আজ তোমাকে রিলিজ করতাম না। তোমার যা কন্ডিশন তাতে আরও তিনদিন এখানে রাখা যেত এবং তাতে আমার নার্সিংহোমের আয় বাড়ত। আবার একদম করিনি এটাও ঠিক নয়। পেশেন্টকে হালকা ওষুধ দিয়ে সারাতে চেয়েছি। না সারলে কড়া দিতে হয়েছে। প্রথমেই সেটা দিলে সে দ্বিতীয়বার এসে আমাকে ফি দিত না। কিন্তু হালকাতেও সে সেরে যেতে পারত। কিন্তু ওষুধের বদলে চকের গুঁড়ো কখনও দিইনি।
আপনি ব্যতিক্রম।
তোমার খুব রাগ হয়, না?
হ্যাঁ।
কেন?
চারপাশে যেসব ঘটনা ঘটছে তা মেনে নিতে পারি না।
তোমার বাবা মায়ের প্রতি?
ভরত জবাব দিল না। ডাক্তার বললেন, হয়। ওঁদের সব কিছু তুমি মানতে পার না। আর এই কারণে তুমি ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়েছ। আচ্ছা, আমি একটু বাড়াবাড়ি করি। মা হিসেব উনি তোমার কাছে কী রকম?
ভরত মায়ের দিকে তাকাল, মা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সে বলল, ভাল।
আর বাবা হিসেব উনি?
ঠিক আছে।
তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
আমি জানি না। হয়তো আমি বড় হয়ে গিয়েছি সেটাই আমার সমস্যা। ওরা আমাকে যেভাবে মানুষ করেছিল, যে সততা সুস্থ জীবনের কথা বলে আমাকে তৈরি করেছিল তার সঙ্গে জীবনের কোনও মিল নেই তা বড় হয়ে বুঝলাম। মা মানে একটা এটারনাল ব্যাপার, সন্তানকে ঘিরেই তার সমস্ত একজিসটেন্স এমন একটা ধারণা ছেলেবেলা থেকে তৈরি হয়েছিল। বই-তে তাই লেখা হয়েছে আর সেসব বই আমি গিলেছি। কোথাও কেউ বলেনি মা একজন মানুষ তারও ব্যক্তিগত জীবন আছে, ইচ্ছে আছে। বাবার সঙ্গে তার বিরোধ অসহ্য হয়ে উঠলে আর মেনে নাও নিতে পারে। আমার মন এমনভাবে তৈরি হয়ে গিয়েছিল যে এটা সহ্য করতে পারিনি। একই কথা বাবার। এগুলো সবসময় চেপে বসেছে।
ডাক্তার ভরতের মাথায় হাত রাখলেন, চিয়ার আপ মাই বয়। বড় যখন হয়েছ তখন একটু উদার হও। উদারতা না দেখালে পৃথিবীতে ভালভাবে বেঁচে থাকা যায় না। মাঝে মাঝে তোমার সঙ্গে ফোনে কথা বলব। তুমিও আমাকে ফোন কোরো।
গাড়ি থেকে নেমে লিফট পর্যন্ত ভরত এল বাবার ওপর নির্ভর করে। তার মাথা ঘুরছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে বাবার গায়ের গন্ধ পেল অনেক দিন পরে। বাল্যকালে ওই গন্ধের সঙ্গে সে পরিচিত ছিল।
নিজের ঘরের বিছানায় শোওয়ামাত্র জানলা খুলে দিল মা। অনেকদূরে আকাশে একটা চিল খুব ধীরে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করল, একটু পরে স্নান। করে ভাত খেয়ে লম্বা ঘুম দে।
বাবা উল্টোদিকের চেয়ারে বসেছিল। বলল, ওকে আজ স্নান করিয়ে দাও।
আমি পারব। ভরত প্রতিবাদ করল।
মা বলল, এক পা হাঁটার ক্ষমতা নেই তবু জেদ আছে খুব, না?
জেদ না–।
তবে?
আমার অভ্যেস নেই।
তাই। নার্সিংহোমে বেডে শুয়ে যখন সব কিছু করতিস তখন তোর অভ্যেস কোথায় গিয়েছিল? মা চোখ বড় করে হাসল।
তখন উপায় ছিল না। সে বাবার দিকে তাকাল, তুমি অফিসে যাবে না?
না।
অনেক দিন যাওনি।
কে বলল তোকে?
তোমার প্রমোশন নিয়ে গোলমাল হবে না?
আমি প্রমোশন নিচ্ছি না।
নিচ্ছ না?
না। কাগজটা কোথায়? আজ সকালে কাগজ দেখা হয়নি।
বাবা যেন চলে যাওয়ার জন্যে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ভরত মায়ের দিকে তাকাল, প্রমোশন না নিলে তো বাবা ফ্ল্যাটে পাবে না?
হ্যাঁ।
তার মানে বাবা এক তারিখে চলে যাচ্ছে না?
এসব কথা থাক।
তুমি?
আমি তো এখানেই আছি। মা চলে গেল ঘর থেকে।
একটু পরেই ওদের কথাবার্তা কানে এল। মা বলছে ভাতের সঙ্গে মাছের ঝোল করবে আর বাবা বলছে মাংস দিতে। মাংস গায়ে তাড়াতাড়ি জোর আনবে। এরকম একটা বিষয় নিয়ে দুজনের আলোচনা কখনও শোনেনি ভরত।
সে আকাশের দিকে তাকাল, চিলটা উড়ছে। একা অত ওপরে অসীম আকাশে একলা উড়ে পাখিটা কি আনন্দ পাচ্ছে? ভরতের খেয়াল হল উড়ে ক্লান্ত হলে তবে চিল পৃথিবীতে নেমে আসে। দুদণ্ড জিরোয়। পৃথিবীর মাটিতে আর যাই হোক ওড়া যায় না।
ডাক্তারবাবু লোকটা ভাল। কথাটাও সুন্দর। উদার হতে হবে। যে যা ইচ্ছে করে যাক তাকে উদার হয়ে উপেক্ষা করতে হবে। দুর্বল হয়ে মেনে নেওয়ার মধ্যে একটা গ্লানিবোধ তৈরি হয় কিন্তু উদারতা শব্দটিতে গর্বের আড়াল থাকে। এই ভাবে নিজেকে আড়ালে রেখে বেঁচে থাকার নাম জীবনযাপন। পৃথিবীর সব মানুষ এর যে কোনো এক ভাবে দিব্যি বেঁচে আছে। এখন থেকে তাকেও সেই চেষ্টা করতে হবে। ওই চিলটাকেও বিশ্রামের জন্যে পৃথিবীতে নেমে আসতেই হয়।
ভরত চোখ বন্ধ করল। তার ঘুম আসছিল।
.
ভরত এখন সুস্থ। হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পর দিন দশেক সে নিজের ঘর থেকে বের হয়নি। প্রথম দিকে সেই সামর্থ্য ছিলও না। বিছানায় শুয়ে দিনভর আকাশ দেখতে দেখতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ত। আকাশ বেশিক্ষণ একনাগাড়ে দেখা যায় না ও আগে জানত না। আকাশ তো মুক্তির প্রতীক, আকাশ নিয়ে মানুষ কত কাব্য করেছে কিন্তু চেয়ে থাকতে থাকতে সেটাও যে একঘেয়ে হয়ে যা তা সে জানত না।
আর এটা বোঝার পর থেকেই ওর ভাবনা-চিন্তা পাল্টালো। যত প্রিয় জিনিস হোক, একনাগাড়ে তার সঙ্গে লেপ্টে থাকলে বৈচিত্র্য হারাবেই। আকাশকে ভাল লাগাতে মাঝে মাঝে তাই পৃথিবীর দিকে চোখ ফেরাতেই হয়।
মাথা ঝিমঝিম করা, খিদে না হওয়া, কয়েক পা হাঁটলেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলা উপসর্গগুলো ধীরে ধীরে কমে এল। মা এখন তার নতুন অফিসে যাচ্ছে। বাবাও কাজে যোগ দিয়েছে। দুপুরটা একই ভাবে কাটে ভরতের। সেই সময় টিভি দেখে কাটে। বি বি সি তাকে সমস্ত পৃথিবীর খবর দেয়। এশিয়া শুধু নয় ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশের মানুষ খুব কষ্ট করে থাকে। আফ্রিকার তো কথাই নেই। এমন কি ইউরোপের কিছু দেশের সাদা চামড়ার মানুষেরা একার রোজগারে ফ্ল্যাট ভাড়া করতে পারে না। লন্ডনের রাস্তায় ভিখিরি শুয়ে থাকে কম্বল মুড়ি দিয়ে। নিউইয়র্কের হানিফের সঙ্গে রাজাবাজারে বস্তির মনসুরের তেমন অমিল নেই।
এই সব তথ্য জানতে জানতে অদ্ভুত এক আগ্রহ আচ্ছন্ন করে রাখে তাকে। অবশ্য ইদানীং এবাড়ির আবহাওয়া পাল্টে গেছে। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর মা কয়েকবার, বাবা অন্তত দুবার কারণে অকারণে কথা বলে যায়। সন্ধের মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসে ওরা। চা খেতে খেতে খোশগল্প করে। রাত নটার একটু আগে বাবা নিজের ঘরে ফিরে যায়। ওটা তার পানের সময়, ভরতের মনে হয় এইসবই ওরা করছে বাধ্য হয়ে। ছেলেকে সুস্থ করতে যে চিকিৎসা দরকার তার অঙ্গ হিসেবে এসব করে। ভরতের এখন কিছুই ভাবতে ভাল লাগে না। এখন সে আর সেই স্বপ্নের ছবিটা দেখতে পায় না। সেই ছিমছাম রাস্তা, গাড়িগুলো ট্রাফিক আইন মেনে চলছে, বাসে কেউ দাঁড়িয়ে নেই। ছবির মতো সেই শহরে মানুষ মানুষের মত চমৎকার বেঁচে আছে। বাল্যকাল থেকে এই যে ছবিটা সে মনে মনে আঁকতে তো কখন উধাও হয়ে গিয়েছে, এখন শুধু একটি মানুষের সঙ্গে কথা বলতে তার ভাল লাগে। তিনি হচ্ছেন নার্সিংহোমের সেই ডাক্তারবাবু। ভদ্রলোক প্রায়ই তাকে টেলিফোন করেন। অসুখ বিসুখ অথবা ওষুধ নিয়ে কোনও কথাই বলেন না। এই যেমন, গতকাল দুপুরের কথাবার্তাগুলো। ফোন বাজল। তখন বাড়িতে কেউ নেই। ভরত রিসিভার তুলে হ্যালো বলতেই ডাক্তারবাবু বললেন, বুদ্ধিমানরা এত বোকা সেজে থাকতে পছন্দ করে কেন ভরত?
বুঝলাম না। হাসল ভরত।
বুঝলে না? তুমি কিং কিং নামের ছবি দেখেছ?
টিভিতে দেখেছি।
হুম্। কিংকং, স্যামসন এন্ড ডেলাইলা থেকে শুরু করে হাতেমতাই, যত আজগুবি গাঁজা কাহিনি যখন ছবি হয়েছে তখন পাবলিক হুমড়ি খেয়ে তা দেখেছে। একটা বিশাল গরিলা নায়িকাকে হাতের তেলোয় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অসম্ভব জেনেও আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখি। ক্লাসিক হয়তো নয় কিন্তু অল টাইম হিট লাগত। তখন পড়ার বই-এর তলায় নীহার গুপ্তের কালো ভ্রমর রেখে গোগ্রাসে গিলে সারারাত ঘুমাইনি। আর তোমরা এখন টিভির কল্যাণে কত বেশি জানেনা। ফেলুদা পড়ছ। তোমাদের কাছে ওসব জোলো বলে মনে হবে। কিন্তু এখনকার সবচেয়ে জনপ্রিয় ছবির নাম কি? জুরাসিক পার্ক। ডাইনোসরাসের ডিম ফুটিয়ে তাদের এখন বের করে যে কাণ্ডকারখানা ছবিতে করা হয়েছে তার সঙ্গে কিংকং এর পার্থক্য শুধু পরিবেশনের আধুনিকত্বে। এই আধুনিক ছাপটা আছে বলে অবাস্তব হওয়া সত্ত্বেও বুদ্ধিমান মানুষ বোকা সেজে উপভোগ করতে যাচ্ছে। এর আর একটা দিক আছে ভরত। এই আমাদের চারপাশে মজা পাবার উপকরণ খুব বেশি নেই। তাই অবাস্তব আনন্দে স্বচ্ছন্দে ডুবে থাকতে পারি যদি তা বাস্তবের গন্ধ মিশিয়ে পরিবেশন করা হয়। রাখি হে, অনেকক্ষণ বকবক করলাম।
আপনি কবে জুরাসিক পার্ক দেখলেন?
কাল রাত্রে, তুমি চাঁদের পাহাড় পড়েছ?
হ্যাঁ।
রাখছি।
কী কথা থেকে কোন কথায় চলে যান ভদ্রলোক। কেন তাকে ফোন করলেন তাও সবসময় বুঝে পায় না ভরত। কিন্তু তার ভালো লাগে মানুষটাকে। একদম খাপছাড়া মানুষ। নিয়মকানুনের ধার ধারেন না। একরকম লোকের সঙ্গে কথা বললে মন ভাল হয়ে যায়। আজও হলো।
ভরতের মনে হল ফোন রেখে দেবার পর ডাক্তারবাবুর হয়তো নতুন কিছু মনে এসেছে তাই আবার ফোন। সে রিসিভার তুলে বলল, বলুন।
মহিলাকণ্ঠ। নাম্বার যাচাই করল প্রথমে। তারপর বলল, আমি কি ভরতের সঙ্গে কথা বলছি? ও, কেমন আছ তুমি? আমি সুদেষ্ণা।
ভরত সোজা হয়ে দাঁড়াল। নিচু গলায় বলল, ভাল।
কলেজে আসছ না কেন?
যাব।
আমি যদি তোমার সঙ্গে দেখা করতে যাই তাহলে কি অসুবিধে হবে?
অসুবিধা কীসের?
তোমার টেলিফোন নম্বর আর ঠিকানা কালকে পেয়েছি। ঘন্টাখানেকের মধ্যে যেতে পারি। ঠিক আছে, রাখছি। সুদেষ্ণা লাইন কেটে দেবার পরও ভরত খানিকক্ষণ রিসিভার ধরে থাকল। অদ্ভুত এক ঝিমঝিম ভাব তার সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিল। তার মনে পড়ল সেদিনকার কথা যেদিন সে সুদেষ্ণাদের বাড়িতে ছুটে গিয়েছিল। সুদেষ্ণা বলেছিল, তুমি যা চাইছ সেরকম অনুভূতি কখনও যদি আমার হয় তাহলে তুমি জানতেই পারবে! ভরত প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে জানতে চেয়েছিল, কবে? সুদেষ্ণা হেসে বলেছিল, কখন যে সেটা হবে তা বলতে পারছে না কারণ সে জ্যোতিষী নয়। সেদিন সে মাথা নিচু করে চলে এসেছিল সুদেষ্ণাদের বাড়ি থেকে। নিজেকে বঞ্চিত, অপমানিত বলে মনে হচ্ছিল সেদিন। অদ্ভুত এক শূন্যতাবোধে আক্রান্ত হয়ে ভরত ঠিক করেছিল আর কখনও সুদেষ্ণার সঙ্গে যোগাযোগ করবে না। আর তারপরই একের পর এক ঘটে গেল ঘটনাগুলো। সেই সুদেষ্ণা এতদিন বাদে নিজে যোগাযোগ করেছে। কেন? শুধুই সে অসুস্থ হয়ে কলেজে যাচ্ছে না বলে? কলেজে তো কত ছেলে অনুপস্থিত থাকে। তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে নিশ্চয়ই সুদেষ্ণা যোগাযোগ করে না।
সুদেষ্ণা এ বাড়িতে আসবে শোনামাত্র কি রকম একটা ভাললাগা তৈরি হয়ে গেল। তার তখনই মনে হল গ্রহণ না করে সুদেষ্ণা ঠিক করেছে। চট করে এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া মুখের কথা নয়। তার মনে হচ্ছিল এতদিনে সুদেষ্ণা নিশ্চয়ই সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে। এখন মনে হচ্ছে তার প্রস্তাব অবশ্য সেসময় খুব খারাপ লেগেছিল। হয়তো সেই খারাপ লাগা থেকেই সে ড্রাগ খেয়ে ফেলেছিল। কি ছেলেমানুষী ব্যাপার। লোকে এককালে এরকম হলে মদ খেয়ে দেবদাস হয়ে যেত। এখন ভাবলেই হাসি পায়! ভরত ফ্ল্যাটটার চারপাশে তাকাল। সুদেষ্ণা এলে কোথায় ওকে বসতে বলবে? এই ড্রইং রুমে না নিজের ঘরে? সে ঝটপট নিজের ঘরটাকে আর একটু ভদ্রস্থ করে তোলার চেষ্টা করল। বইপত্র এত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যে নিজেরই রাগ হচ্ছিল।
ঠিক সওয়া তিনটের সময় বেল বাজল। ভরত যতটা সম্ভব দৌড়ে এসে দরজা খুলে দেখল। সুদেষ্ণা হাসছে এবং ওর পেছনে একটি যুবক সপ্রতিভ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। সুদেষ্ণা জিজ্ঞাসা করল, দরজা আটকে দাঁড়িয়ে আছ, ভেতরে যেতে বলবে না?
কিরকম অসাড় লাগছিল শরীরটা, দরজার খোলামাত্র সেটা হয়েছিল, তবু সরে দাঁড়াল ভরত। মাথা নেড়ে বলল, এসো।
ওরা ভেতরে ঢুকল। ড্রইং রুমের সোফা দেখিয়ে বসতে বলল ভরত। সুদেষ্ণা আরাম করে বসে জিজ্ঞাসা করল, শরীর কেমন আছে?
অনেকটা ভাল। ভরত একটুও উৎসাহ পাচ্ছিল না।
আলাপ করিয়ে দিই। এ হচ্ছে সঞ্জয় দত্ত। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ফাইনাল ইয়ারে আছে। সঞ্জয়, তোমাকে ভরতের কথা বলেছি। সুদেষ্ণা মিষ্টি হাসল।
সঞ্জয় মাথা নাড়ল, সুদেষ্ণা বলছিল আপনি খুব একরোখা। অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করে চলতে পারেন না। আপনাকে দেখার আগ্রহ থেকেই এলাম।
ভরত ভালভাবে তাকাল। একবছর পরে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যাবে ও। তার মা বাবা যা চেয়েছিল তা কি সুদেষ্ণাও চায়। নিশ্চিত নিরাপত্তা?
সুদেষ্ণা জিজ্ঞাসা করল, তুমি হঠাৎ ডুব মারলে। সেই যে দুপুরে আমাদের বাড়ি থেকে চলে আসার পর আর কোনও খবরই নেই। হঠাৎ অর্ণব বসুরায় বলল তুমি খুব অসুস্থ। কী হয়েছিল তোমার?
ভরত নিস্তেজ গলায় বলল, এমন কিছু নয়। ঝোঁকের মাথায় নেশার ট্যাবলেট খেয়ে ফেলেছিলাম। সহ্য হয়নি। কদিন নার্সিংহোমে থাকতে হয়েছিল। তারপর শরীর ঠিক হতে কিছু সময় লাগছে, এই আর কি?
নেশার ট্যাবলেট? মাইগড! সুদেষ্ণা আঁতকে উঠল।
সঞ্জয় জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি নিয়মিত ড্রাগ খান?
আমার চেহারা দেখে সেরকম মনে হচ্ছে নাকি? ভরত ঠোঁট কামড়াল।।
না না। হঠাৎ আপনি এই ট্যাবলেট খেতে যাবেন কেন?
কোনও কোনও ঘটনা হঠাই হয়ে যায়। উদাসীন গলায় বলল ভরত।
তুমি জানতে না ওই ট্যাবলেট খেলে ক্ষতি হতে পারে? সুদেষ্ণা প্রশ্ন করল।
কৌতূহল বড় মারাত্মক অসুখ।
কিন্তু তোমার মতো ছেলের ক্ষেত্রে এটা যে সম্পূর্ণ বেমানান।
না। কারণ কোনটা মানানসই সেই ফর্মুলা আজও আবিষ্কৃত হয়নি।
সঞ্জয় জিজ্ঞাসা করল, ওই বস্তু আপনি পেলেন কী করে?
পেয়ে গেলাম। যাক গেলো, এখন আমি ভাল আছি। ভরত প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইল, তোমরা কী খাবে? চা না কফি?
সুদেষ্ণা মাথা নাড়ল, ধন্যবাদ। আজ কিছু খাব না। বাড়িতে আর কেউ নেই?
না। মা-বাবা দুজনেই অফিসে।
তুমি কবে থেকে কলেজে যাচ্ছ?
দেখি।
বললে এখন ভাল আছ তাহলে যেতে অসুবিধে কোথায়?
ডাক্তার বলুক আগে।
তাহলে আজ উঠি।
ঠিক আছে। এখানে আসার জন্যে অনেক ধন্যবাদ।
সুদেষ্ণা আর সঞ্জয় দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজার বাইরে পা রেখে সঞ্জয় বলল, পরে একদিন আপনার সঙ্গে ভাল করে আলাপ করা যাবে।
ভরত কোনও জবাব দিল না। নেমে যাওয়ার আগে সুদেষ্ণা একবারও পেছন ফিরে তাকাল না। সঞ্জয়ের সঙ্গে অন্য প্রসঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে গেল সে। ভরত চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিল। সে কি বোকা! সুদেষ্ণা এসেছিল নেহাৎই ভদ্রতা করে তাকে দেখতে। অথচ ওর এই আসাটাকে উপলক্ষ করে সে কত কিনা ভেবে বসেছিল। একটা মেয়েকে বন্ধু হিসেবে ভাবতে পারার মতো সহজ মনটাকে সে আর পাঁচটা বাঙালি ছেলের মতো হারিয়ে বসে আছে।