আমি, তুমি, আমরা
০১.
আমি, তুমি, আমরা সকলেই অনেক কিছু বলতে চাই, বলিও, কিন্তু বোধহয় শোনাবার লোক পাই না।
পাই না, কারণ যে শুনবে তারও যে বলার অনেক কিছু আছে। তার নিজের কথা কেউ মনোযোগ দিয়ে শোনে না যখন, সে কেন আমার তোমার কথা শুনতে যাবে?
তাই বোধহয় আমি, আমরা সকলেই, প্রায়ই নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলি, দুপুরবেলার খোঁটায় বাঁধা একলা বাছুরের মতো আমরা সবাই বলি। ভাগ্যিস সোচ্চারে বলি না। আয়নার সামনে বসে চুল বাঁধতে বাঁধতে, অথবা ক্লাসের অফ পিরিয়ডে, অথবা চান করতে করতে আমরা সকলেই নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলি।
আমরা সকলেই লেখিকা নই। আমি তো চিঠি পর্যন্ত লিখতে পারি না, অথচ আমি কী দারুণ ভাবতে পারি। সময় নেই, অসময় নেই, আমি কেমন ভাবতে বসে যাই। নিজের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা-কাটাকাটি করি।
আজকে আমার ছুটি। আজকে মঙ্গলবার; অথচ আমার ছুটি। জামশেদপুরে অন্য সব কিছু মঙ্গলবার বন্ধ বলে, আমার স্কুলও ছুটি।
আজ অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম। এবারে যা গরম, প্রথমরাতে ঘুম মোটে আসেই না; ঘুম আসে শেষরাতে। ভোরের দিকে খুব আমেজ লাগে, উঠতে ইচ্ছে করে না।
ঘরের মধ্যেই শুই। আমি বাবা পারি না বাইরে শুতে। আমি কলকাতার মেয়ে, বাইরে খোলা আকাশের নীচে শুয়ে আমার অভ্যেস নেই, তারপর পাশেই রাস্তা; কখন শাড়ি উঠে যায়, শায়া উড়ে যায় হঠাৎ হাওয়ায়–আমি পারি না, লজ্জা করে; তাই আমায় ঘরেই শুতে হয়।
রমেন বাইরেই শোয়। কোনো কোনোদিন শেষরাতে আমার ঘুম ভাঙাতে ঘরে আসে। ঘুমের মধ্যে তখন মনে হয় সব কিছু স্বপ্ন; অথবা দুঃস্বপ্ন। আমরা মেয়ে, অনেক কিছু ভালো না লাগলেও আমাদের করতে হয়; ইন্দিরা গান্ধির রাজত্বেও।
এই গরমে কারুর গায়ের ছোঁয়াই ভালো লাগে না। রমেন অথবা রমেনরা রাতের কোনো এক প্রহরে কালা হয়ে যায়, কানা হয়ে যায়, তখন, কিছুক্ষণের জন্য তারা গুহামানব হয়ে যায়। সেইসব মুহূর্তে ভাবতে ঘেন্না করে যে ওকে আমি স্বেচ্ছায়, ভালোবেসে, বাড়িসুদ্ধ সকলের অমতে বিয়ে করেছিলাম। ভাবতেও ঘেন্না হয়।
ঘুম থেকে উঠে চা খেয়ে ঘরবাড়ি পরিষ্কার করলাম ভালো করে। আজ মুখী আসেনি। মুখী সাঁওতাল মেয়ে। ও-ই বাড়ির সব কাজকর্ম করে। আজ ও আসেনি। ওর মেয়েটার হাম উঠেছে খুব।
যা তরি-তরকারি কেনা ছিল সব শেষ। একবার বাজারে যেতে হবে।
বাইরে বেরোতে হবে ভাবলেই ভয় হয়–যদিও কদমা বাজার বেশিদূর নয়। রমেন আজ দুপুরে খেতে আসবে–একটু কিছু স্পেশ্যাল রাঁধতে হয় ওর জন্যে।
বাজারে বেরোতে হবে এমন সময়ে মিস্টার বোস এলেন। সুশান্ত বোস। পাশের বাংলোয় থাকেন। রমেনের প্রথম স্ত্রীর কীরকম দূর-সম্পর্কের কাজিন। ভদ্রলোক মানুষ বড়ো ভালো। আমার খুব ভালো লাগে। আজকালকার ছেলেদের মধ্যে স্মার্টনেসের বিকল্প চিবিয়ে চিবিয়ে আমেরিকান উচ্চারণের ভুল ইংরিজি ও অদ্ভুত সাজপোশাক দেখে দেখে এমন ক্লান্তি এসেছে যে তার মধ্যে সুশান্ত বোস একজন ব্যতিক্রম। স্মার্টনেস মানে যে লাফানো-ঝাঁপানো নয়, ড্রেইনপাইপ বা অ্যালিফ্যান্ট ট্রাউজার নয়, তার মানে যে ঘন ঘন সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়া নয়, সে সুশান্তকে দেখলে বোঝা যায়। ভারি একটা শান্ত সমাহিত চেহারা। কথা বলেন কম, যা বলেন তা বক্তব্যে ভরা। কেন জানি না, ওঁকে আমার খুব ভালো লাগে। এবং ওঁকে ভালো লাগে বলেই ওঁর কাজিন, আমার সতীন অদেখা মমতার প্রতিও আমার বেশ একটা দুর্বলতা জন্মায়; জন্মে গেছে।
মমতার প্রতি যে রমেন অবিচার করেছে একথা সবসময়েই মনে হয়। প্রথম প্রথম ভেবে খারাপ লাগত যে এমন একজন ভালোমেয়ের স্বামীকে আমি ছিনিয়ে নিলাম তার কাছ থেকে। এখন মনে হয়, রমেনের মতো শনিকে তার কাছ থেকে সরিয়ে এনে তার পরমহিতাকাঙ্ক্ষীর কাজ করেছি।
রমেনের সঙ্গে ঘর করা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। হয়তো আমার পক্ষেও নয়। কিন্তু কী করব? দাদা বাবা মা দিদিমা সকলেই বলেছিল এমন করিস না। তাদের প্রত্যেকের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলেছিলাম যে, তোমরা দেখো, দেখে নিয়ে যে, আমি ভুল করিনি।
আমার মনে মনে এই জেদ ছিল যে, ও খারাপ হলেও, ওর সব দোষ থাকলেও, ওকে আমার গুণে আমার নিজের মতো করে নিতে পারব।
কিন্তু পারলাম কই?
আর পারলাম যে না, এ জানাটা দিনে দিনে আমার কাছে যতই স্পষ্ট হয়ে উঠছে, ততই আমার অসহায়তা বাড়ছে। আমি জীবন থাকতে, আমার জ্ঞান থাকতে, কখনো বলতে পারব না, স্বীকার করতে পারব না, বাবাকে গিয়ে জানাতে পারব না যে আমি ভুল করেছি, আমাকে একজন ঠগ মর্মান্তিকভাবে ঠকিয়েছে। সেকথা বললে, নিজের কাছে, নিজের বিচার-বিবেচনা, নিজের গর্ব, দম্ভ, নিজের সমস্ত কিছু আমিত্বর কাছেই যে আমি চিরদিনের মতো হেরে যাব।
তাই রমেন আমাকে লাথি মারলেও তা আমার সহ্য করতে হবে। তাকে যে আমি অনেক সাধ করে একদিন মালা পরিয়েছিলাম, অনেকে সেদিন বলেছিল, বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা। তবুও ভেবেছিলাম, বাঁদর বশ করা কি এতই কঠিন? দেখবে তোমরা, আমি ওকে কী একজন তৈরি করি, পুরুষের মতো পুরুষ।
আজ বিয়ের পর প্রায় আড়াই বছর কেটে গেছে কিন্তু পারিনি।
এখনও শরীরটা বড়ো ভীষণভাবে আমাদের সম্পর্কটাকে ছেয়ে আছে। মানা করি, যাই করি, ভালো লাগুক কি না লাগুক, একটু সময় পরে, আমার অজান্তে আমি আমার শরীরের দাসী হয়ে যাই। আমার মতো নরম লাজুক মেয়েও যে এমন হঠাৎ নির্লজ্জ হয়ে উঠতে পারি –সমস্ত মানসিক অপরাধ, ভালো লাগা ভুলে গিয়ে শুধু অন্য একটা পুরুষের শরীরের কাছেই সম্পূর্ণ সমর্পিত হতে পারি–একথা অন্য সময়ে ভাবলে আমার লজ্জা হয়।
আসলে আমরা মেয়েরা ঠিক কতখানি শরীর-নির্ভর আমরা নিজেরাই হয়তো তা জানি না। জানলে, আমাদের ন্যাকামিগুলো হয়তো একটু কমাতে পারতাম। কিন্তু সত্যিই বলছি, ঘুমপাড়ানো-শরীরের আমরা, আর ঘুমজাগানো-শরীরের আমরা একেবারে আলাদা আলাদা মানুষ। আমি জানি না, আশা করি পুরুষরা কোনোদিন আমাদের সত্যি সত্যি বুঝতে শিখবে। আমাদের বিভিন্ন সত্তাকে সম্মান করতে শিখবে?
ভদ্রলোক কতক্ষণ বসবার ঘরে বসেছিলেন, খেয়াল ছিল না। থলে হাতে আমাকে ঢুকতে দেখে অপ্রতিভ হয়ে বললেন, বাজারে যাচ্ছেন? আমি আসি তাহলে।
আমি বললাম–আসবেন কেন? চলুন না বাজারে আমার সঙ্গে। আজকে ছুটির দিন তো –একা একা বাজারে ওই ঠেলাঠেলির মধ্যে যেতেও ইচ্ছে করে না।
সুশান্ত বলল, বেশ তো। চলুন।
আপনার কাজের কোনো ক্ষতি করলাম না তো? বললাম আমি।
তা একটু করলেন বই কী।
কী কাজ?
এই ভেবেছিলাম, শার্টের বোতামগুলো সব ঠিক করে লাগাব। ধোপাটা এমন বিনা কারণে আছাড় মারে না, সব কটা বোম সব শার্টেরই প্রায় ছিঁড়ে এসেছে।
আমি হেসে ফেললাম।
ও বলল, হাসছেন যে?
বললাম, কেন জানি, আমার খুব হাসি পায়। কোনো লম্বা-চওড়া পুরুষমানুষ মনোযোগ সহকারে বালিশের ওয়াড় অথবা পায়জামার দড়ি কিংবা জামার বোতাম লাগাচ্ছে দেখলেই আমার হাসি পায়। কিছু মনে করবেন না।
তা আর কী করা যাবে?
হাসি হাসি মুখে বলল সুশান্ত। সকলের তো আর রমেনবাবুর মতো স্ত্রী নেই। লক্ষ লক্ষ ব্যাচেলার লোকেরা নিজেরাই ওসব করে।
না করে উপায় কী?
তারা করে করুক, আপনার করতে হবে না। আমাকে পোঁটলা করে সব দিয়ে যাবেন, আমি লাগিয়ে দেব।
বাঃ তাহলে তো ভালোই হয়। আমি আসলে পারিও না, জানেন? দেখুন না, আসবার আগেই আঙুলে অনেকখানি ছুঁচ ঢুকে গেছে।
ওর হাতটা আমার হাতে তুলে নিয়ে দেখলাম। তাই-ই তো! ইশশ।
পরমুহূর্তেই ওর চোখ আমার চোখে লাগল।
আমরা দুজনেই কয়েক মুহূর্ত কথা বলতে পারলাম না।
রমেন আমাকে ভীষণ ভীষণ আদর করলেও আমার এত ভালো লাগে না, সুশান্ত চোখ। তুলে তাকাতে আমার যেমন লাগল।
কেন এমন হল? কেন এমন হয়? ভাবতে লাগলাম আমি।
একজনের চোখ চাওয়ায় এমন হয় আর অন্যজনে নিরাবরণে আলিঙ্গন করলেও তা হয় না। কেন? এ কেন হয়?
সুশান্ত বলল, চলুন, যাবেন না?
চলুন। বলে ঘরের পাল্লা ভেজিয়ে বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে আমরা পথে নামলাম।
সুশান্ত ছাতাটা খুলল। বলল, আসুন, আমার দিকে সরে আসুন রোদ লাগবে না। নাকি, রমেনবাবু দেখতে পাবেন?
আমি বললাম, ইশশ দেখলেই বা–। আমি কাউকে কেয়ার করি না।
না করলেই ভালো।
রাখুন তো! এই রোদে ছাতার তলায় যাচ্ছি, তার আবার কৈফিয়ত। আমি বললাম।
আমার কিন্তু বেশ লাগছিল।
সুশান্তর বুকের কাছে আমার মাথা। সুশান্তর গায়ের গন্ধটা বেশ। মিষ্টি মিষ্টি। রমেন বড়ো পাউডার মাখে। পাউডারের গন্ধ ছাপিয়ে ওর গায়ের নিজস্ব গন্ধটা কখনো বুঝতে পাইনি! তা ছাড়া ওর বোধহয় নিজস্ব কিছুই নেই, দু-একটা অতি-অবশ্য জিনিস ছাড়া। ওর সবই পরস্মৈপদী। ওর ব্যক্তিত্বটাও তাই। সবসময়ে ও যেন অন্য কার চরিত্রের অভিনয় করে। অভিনেতা হিসেবে ভালো হলেও কথা ছিল, অভিনয়ও করতে পারে না ও ভালো করে।
পথ গরমে ঝাঁ ঝাঁ করছিল। পথের পাশের সোনাঝুরি গাছ থেকে ফুল ঝরে পড়েছিল পথে। ইউক্যালিপটাসের শুকিয়ে ওঠা পাতার গন্ধে গরমের সকাল ম ম করছিল। সুশান্তর পাশে পাশে হ্যাঁজেল রোড দিয়ে হেঁটে যেতে বেশ লাগছিল।
রমেন যদি পুরুষমানুষ হয়, যদি এই কোম্পানির কাজে বরাবর লেগে থাকে, যদি সম্ভাবে খাটে, তবে হয়তো হ্যাঁজেল রোড কি গাড়য়া রোড কি পাডি রোডে থাকবে প্রোমোশন হলে। বেশ লাগে আমার, এই কাইজার বাংলোগুলো। জানি না, কী হবে।
কত কী-ই তো ভাবি কত কী-ই-ই তো ভালো লাগে। তার চেয়ে এই মুহূর্তের ভালো লাগাটা দিয়ে মন ভরে নিই।
বেশ লাগছে সুশান্তর বুকের কাছের, ছাতার নীচের আস্তে আস্তে পথ চলা।
রমেনের আসলে দারুণ চটক ছিল একটা, হয়তো এখনও আছে। যে চটক দেখে আমি ভুলেছিলাম। এখন বুঝতে পারি মলাটটাই সব নয় কোনো মানুষের। মলাটের অন্তরালে যা থাকে সেইটেই সব।
বিয়ের পর পরই ও আমাকে একটা দারুণ মিথ্যা কথা বলেছিল, বলেছিল ওর একটা লিফট হয়েছে, ও কভেনান্টেড অফিসার হয়ে গেছে, শিগগিরই ট্রেনিংয়ে যেতে হবে ওকে হায়দারাবাদ না কোথায় যেন। আমি জানি যে ও মিথ্যা কথা বলেছিল এবং ও-ও জানে যে ওর মিথ্যা কথা ধরা পড়ে গেছে।
তখন কোনো ভালো ফ্ল্যাটে গেলে, কোনো সাদা-রঙা ছোটো ছিমছাম গাড়ি দেখলে, আমি হাঁটতে হাঁটতে ওর হাত জড়িয়ে ধরে বলেছি, তুমি এমন ফ্ল্যাট পাবে কখনো?
ও বলেছে, শিগগিরই।
তখন এসব কিছুই অবিশ্বাস করিনি। অবিশ্বাসই যদি করব, তাহলে সকলের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওকে গ্রহণ করব কেন? তখন বিশ্বাস করতাম, সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করতাম। কিন্তু এখন আর করি না। কারণ আমি জেনে গেছি যে, ও একটা শঠ, ও একটা মিথ্যেবাদী প্রবঞ্চক।
ও চাকরিতে উন্নতি করেনি, করবে না কোনোদিনও, একথা জেনে বা অন্য দশজন মেয়ের মতো আমার ভালো ফ্ল্যাট হবে না বা গাড়ি হবে না বলে আমার কোনো দুঃখ নেই। সে তো কত মেয়েরই থাকে না। দুঃখটা সে জন্যে নয়। দুঃখটা এই জন্যে যে আমার জেদকে জেতাতে গিয়ে আমি আমার সম্মান আর বুদ্ধিকে এমনভাবে হারিয়ে দিলাম। আমাকে ও এমন মর্মান্তিকভাবে ঠকাল একথাটাই আজকাল আমাকে বড়ো পীড়িত করে, বড়ো ক্লান্ত, অবসন্ন করে রাখে সব সময়ে; সে ক্লান্তিটা এই জামশেদপুরের গরমের চেয়েও বেশি ক্লান্তিকর।
আসলে আমরা মেয়েরা, মানি আর নাই মানি, এখনও মেয়েদের সবচেয়ে বড়ো পরিচয় তাদের স্বামী। আমরা নিজেরা যতই গুণবতী হই না কেন, যাকে নিয়ে জীবন, যার হাতে মাথা রেখে শোওয়া, যার পাশে পাশে জীবনের পথে হাঁটা, সে যদি আমার মাথা ছাড়িয়ে আমার পাশে দৃশ্যমান হয়ে না প্রতিভাত হয়, সে যদি আমারই ছায়া হয়, আমারই অনেক গয়নার এক অপছন্দসই গয়নার মতো আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে, তাহলে আমার নিজের সম্মান কোথায় থাকে?
যখন কলেজে পড়তাম তখন ন-বৌদি বলত : দেখিস, যাকেই বিয়ে করবি, দেখে করিস, তার মধ্যে যেন সম্মান করবার মত কিছু থাকে। যাকে সম্মান না করা যায়, শ্রদ্ধা না করা। যায়, তাকে কখনো বিয়ে করিস না। সুখী হবি না।
তখন ভাবতাম, ন-বৌদি বেশি বোঝে। ভাবতাম, আমি কি আর আর কচি খুকি? আমার কি আর বুদ্ধি নেই?
তখন বুঝতে পারিনি যে আমার সত্যিই বুদ্ধি নেই। ভালোবাসা ব্যাপারটার মূল ও স্থায়ী উপাদান যে সম্মান তখন তা বুঝতে পারিনি।
রমেন প্রায় হাতে পায়ে ধরত, বলত আমাকে না হলে বাঁচবে না; তারপর ওর নিজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ও এতসব কথা বানিয়ে বলত যে ওর ওপর কখন নিজের অজান্তে দয়া করে ফেলেছিলাম। আত্মীয়-স্বজনের বিরোধিতা, আমাকে ভীষণ জেদি করে তুলেছিল, মন বলেছিল যে, যাকে আমার ভালো লাগল তাকে তোমাদের একটুও ভালো লাগল না? আমার ওপর তোমাদের একটুও ভরসা নেই কেন?
এসব মিলিয়ে ব্যাপারটা ঘটে গেল। বাবা অনেক ধার করলেন বাজারে। সে সময়ে বাবার ব্যাবসাটা ভালো যাচ্ছিল না, তাই ধার করলেন, দাদারা প্রভিডেন্ট ফাণ্ড থেকে টাকা ওঠালেন, কিন্তু যে করেই হোক আমার বিয়েতে জাঁকজমক কিছু কম হল না। রোশনচৌকি বসল, হাজারখানেক লোক খেল, শুধু খেলই নয়, খেয়ে সব বাহা! বাহা! করল।
পেছনে চাইলে এখন বুঝতে পারি, আমার বিয়েতে কোনো কিছুরই বিন্দুমাত্র ত্রুটি ছিল না, ত্রুটি যতটুকু ছিল, তা ছিল আমার সঙ্গী নির্বাচনে। যে এসে সেদিন মখমল-মোড়া সিংহাসনে বসেছিল–শুধু তাকেই চিনতে আমার ভুল হয়ে গেছিল। নইলে ফুলের সাজ, ফ্রায়েড রাইস, আতরের পিচকিরি, ফার্নিচারের পালিশ, গয়নার ডিজাইন, বিয়ের বেনারসি, বিভিন্ন-রঙা শাড়ির সঙ্গে মানানসই নানা-রঙা শায়া সব কিছুই পারফেক্টলি মানানসই হয়েছিল। সেদিন যদি জানতে পেতাম যে আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিনে আমি একটা সবচেয়ে অসুন্দর ভুল করলাম, তাহলে হয়তো সেদিন অমন হাসতে পারতাম না; ফোটোগ্রাফারের দিকে তাকিয়ে শুভদৃষ্টির সময়ে অমন তনুজার মতো ভুরু তুলে তাকাতে পারতাম না।
যাঁরা আমার নিজের এই জবানবন্দি পড়ছেন, তাঁরা হয়তো ভাবছেন যে আমি ডিভোর্স কেন করছি না এখনও রমেনকে। বিশেষ করে আমার সহপাঠিনী, আমার বন্ধু-বান্ধবী, আমার পরিচিতরা, যাদের কাছে বিয়ের আগে আমি সদম্ভে বারংবার ঘোষণা করেছিলাম যে, একটু এদিক-ওদিক হলে, আমার মনঃপুত না হলেই আমি যাকে বিয়ে করব তাকে ডিভোর্স করব –যাতে সেপারেশন হয় তাই-ই করব। তাদের আমি আজ কী করে মুখ দেখাব?
ওসব কথা শুধু আমি কেন, হয়তো আমার বয়েসি সব মেয়েরাই বলে ও ভাবে আধুনিকা ও শিক্ষিতা সব মেয়েরা।
কিন্তু এখন আমি জানি বলা যত সহজ, করা তত নয়। এই জন্যে নয় যে, করা অসম্ভব। করা খুবই সম্ভব, কিন্তু ডিভোর্স করতে কঠিন হতে হয়। আমরা বেশিরভাগ মেয়েরাই কঠিনহৃদয় নই। এমনকী আজকেও যত ডিভোর্স হচ্ছে, তার দশগুণ বেশি ডিভোর্স হওয়ার কথা ছিল।
আমরা জ্বলে-পুড়ে মরি, প্রতিবাদ করি, তারপর যেই আমাদের মতো মেয়েদের মিথ্যাবাদী, অপদার্থ, রেসুলরা, জুয়াড়ি, মাতাল ও দুশ্চরিত্র স্বামীরা বাড়ি ফেরে, তাদের পরিচিত মুখের দিকে চেয়ে আমরা আমাদের সব অভিযোগ ভুলে যাই। তাদের খাবার দিই। তাদের কীসে আরাম হবে দেখি, তারপর ওরা নির্লজ্জর মতো (নির্লজ্জর মতো কেন বলি, বলা উচিত ধুরন্ধরের মতো।) আমাদের সরল মন ও নরম শরীরের বেলাভূমিতে নামে। ওদের সব অপারগতার একমাত্র সমস্যা একটা বিশেষ বর্ম দিয়ে ওরা ঢেকে রাখতে চায়। গা জ্বালা করে।
রমেনের কাছে যেতে আমার ঘেন্না হয়, অথচ তবু একসময়ে কাছে যাই। একসময়ে ঘেন্নার অনুভূতিটা চলে গিয়ে একটা উদাসীনতার অনুভূতি আসে, তারপর একটা সময়ে, হয়তো একটা ক্ষণিক মুহূর্তের জন্যে আমার সব ঘৃণা, সব উদাসীনতা, সমস্ত ছুঁড়ে ফেলে আমি পৃথিবীর সবচাইতে সুখী রমণী হয়ে উঠি।
একটি বিশেষ মুহূর্তে–একটি ক্ষণিক জয়ে জয়ী হয়ে রমেনরা ওদের স্বামীত্বের মেয়াদ আবার কিছুদিন বাড়িয়ে নেয়। পরদিন, সারাদিন, কাজের ফাঁকে ফাঁকে কেবলি মনে হয় আর কোনোদিন ওই জন্তুটার, যে আমার সবচেয়ে বড়ো আপন, যাকে আমার শ্রদ্ধা করার কথা ছিল, যাকে আমার ভীষণ ভীষণ ভালোবাসার কথা ছিল, সেই মিথ্যাবাদী প্রবঞ্চক জন্তুটাকে কিছুতেই আর আমার কাছে আসতে দেব না।
আমি জানি না, কেন এমন হয়। হয়তো সারাদিন মেয়েদের সঙ্গে চেঁচামেচি করে ও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবে এত ক্লান্ত থাকি যে বাড়ি ফিরে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে আর ভাবার সময় পাই না। মন বলে, বর্তমানে তো বাঁচি, আজকের দিনটা তো কাটুক, তারপর কাল সকালে উঠে ঠাণ্ডা মাথায় একটা কর্তব্য ঠিক করা যাবে। কিন্তু সকাল হতে না হতেই তো স্কুলের তাড়া, রমেনের কারখানার তাড়া, দৌড়াদৌড়ি করে কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়, বিকেল গিয়ে রাত আসে, বুঝতে পারি না। বাড়ি ফিরে, জামাকাপড় খুলে অনেকক্ষণ ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকি। তারপর অনেকক্ষণ আরাম করে চান করি। চান করার পরে শরীর ও মন ঠাণ্ডা হলে অনেক কথা মনে হয়। অনেক কিছু কর্তব্যের কথা। কিন্তু বাথরুম থেকে বেরিয়ে আর কিছু মনে থাকে না।
.
০২.
সুশান্ত বলল, কী হল? চুপচাপ যে?
এই ভাবছি।
কী ভাবছেন এত?
ভাবনা কি দেখানো যায়?
না তা যায় না, তবে হয়তো ইচ্ছে করলে শোনানো যায়।
হয়তো শোনাতে ইচ্ছে করছে না।
তাহলে থাক।
পেট্রোল-পাম্পটার কাছাকাছি পৌঁছে আমি বললাম, আপনার বাজার হয়ে গেছে?
না।
কেন?
আজকে আমার বাহন আসেনি। ময়ূরের সানস্ট্রোকের মতো হয়েছে কাল। যা গরম, আর দোষ কী শরীরের।
কী নাম বললেন? ময়ূর? আপনার বাহনের নাম ময়ুর? তাহলে আপনি হচ্ছেন কার্তিক।
সুশান্ত হেসে উঠল। বলল, এমন কথা বলেন না আপনি!
ময়ূর আসেনি তাহলে দুপুরে খাবেন কোথায়? শুধোলাম আমি।
চলে যাব বিষ্ণুপুর। সেখানে পাঞ্জাবি হোটেলে রুটি-তড়কা খেয়ে নেব।
থাক এই রোদে আর রুটি-তড়কা খেতে এতদূরে মোটরসাইকেল ফটফটিয়ে যেতে হবে না।
তবে কি উপোস করব? তা ছাড়া আমার মোটরসাইকেলের ওপর আপনার এত রাগ কেন!
রাগ না, আমার ওই শব্দটা শুনলে বিরক্তি লাগে। আর মনে হয় কেমন সুড়সুড়ি লাগে।
হাসালেন আপনি। মোটরসাইকেলের আওয়াজে সুড়সুড়ি লাগে এমন কথা তো কখনো শুনিনি।
আমি বললাম, সত্যি। তারপর বললাম, মোটরসাইকেল চড়েন কেন?
গাড়ি কেনার সামর্থ্য নেই বলে। তা ছাড়া, এইরকম শহরে গলাকাটা ট্যাক্সিভাড়া দিতে পারি না। বাসের ভরসায় থাকলে তো চাকরি রাখা যাবে না।
মোটরসাইকেল চড়া কিন্তু খুব ভয়ের।
অ্যাকসিডেন্টের কথা বলছেন?
না। অ্যাকসিডেন্ট তো আছেই। তা ছাড়া কুকুর কামড়ানোর ভয়।
সুশান্ত এবারে হো হো করে হেসে উঠল। বলল, বা: বাঃ, আপনি সব নজর করেছেন তো। সত্যি! সাধু সাহেবের কুকুর দুটো ভারি পাজি। আমাকে আসতে দেখলেই এমন তাড়া করে দু-পাশে। সত্যিই ভয় হয় কবে কামড়ে দেবে।
ওদেরও বোধহয় আমার মতো সুড়সুড়ি লাগে ওই ফটফট আওয়াজটাতে। তবে সত্যি বলছি–আমার এক জামাইবাবুকে কলকাতার এক পাগলা কুকুর মোটরসাইকেল ধাওয়া করে কামড়ে দেওয়ার পর তিনি মোটরসাইকেলই বেচে দিলেন। তা ছাড়া এপাড়ার সাধু সাহেবের কুকুর ছাড়াও বে-পাড়ার অসাধু সাহেবদের কুকুররাও কি কম আছে জামশেদপুর শহরে?
সুশান্ত হাসল, বলল, আপনার সঙ্গে কথায় পারব না।
বাজারে ঢুকে বললাম, বলুন, কী মাছ খেতে ভালোবাসেন আপনি?
আমি তো মাছ খাই না।
সে কী! মাছ খান না কেন?
সুশান্ত একটু চুপ করে থাকল। তারপর বলল, আমার ছোটোবোন মাছ খেতে খুব ভালোবাসত। একেবারে মাছের পোকা ছিল। মাস ছয় আগে ও হঠাৎ মারা যায়। তারপর থেকে মাছ খাই না। এমনিই খাই না। কোনো কারণ নেই।
আমি কিছু বললাম না। মাছ না খেয়ে মৃত বোনকে কীভাবে ভালোবাসা দেখানো হয় বুঝি না। তবে সুশান্তর মনটা ভারি নরম। ওর চোখ দেখলেই মনে হয়।
আমি কোনো কথা বললাম না। তারপর শুধোলাম, তাহলে মাংস কিনি?
মাংস? বলে সুশান্ত একবার আমার দিকে তাকাল। বলল, আমার জন্যে ব্যস্ত হবার কী আছে। তা ছাড়া আপনি কিনবেন কেন? আমিই কিনি। মুরগি কিনি।
না না, এই গরমে মুরগি খাওয়া যায় না। তার চেয়ে ছোটো খাসির মাংস আছে, মাংসই কেনা ভালো।
আপনি কেন কিনবেন? আমি কিনব।
প্লিজ। বলে সুশান্ত একবার তাকাল আমার চোখে।
চশমার আড়ালে ওর কালো গভীর চোখের দিকে চোখ পড়ল আমার।
ওর চোখে কী যেন একটা আছে। ও মুখে যত কথা না বলে চোখে বলে তার চেয়ে অনেক বেশি। ও কিছু বললে, কিছু আবদার করলে, উত্তরে ‘না’ বলা বড়ো শক্ত। অস্বস্তির কথা এই যে, এসব লোক সহজে অথবা সস্তা কিছু চায় না কখনো।
সুশান্তকে একটু বেশি ভালো লেগে যাচ্ছে আমার। মনে মনে নিজেকে একধমক লাগালাম। মেয়েদের ধমকে ধমকে নিজেকেও ধমকাতে শিখেছি আমি।
মাংস কিনল সুশান্ত। আমি কিছু আনাজ কিনলাম। পটল, আলু, পোস্ত, কাঁচা-কলাইয়ের ডাল। এ গরমে কাঁচা-কলাইয়ের ডাল ছাড়া আর কিছু খেতে ভালো লাগে না। কাঁচা কলাইয়ের ডাল আর পোস্তর তরকারি।
বাজার থেকে বেরিয়ে গরমটা যেন আরও বেশি লাগতে লাগল।
সুশান্ত বলল, ইশশ, গরমে আপনার মুখটা লাল হয়ে গেছে।
গরমেই যে লাল হয়েছে কী করে বুঝলেন?
তাহলে?
বলে সুশান্ত থেমে গেল আমর দিকে চেয়ে। মুখ নামিয়ে নিল।
আমি জানি, সুশান্ত আমাকে খুব পছন্দ করে। বিয়ের আগে আগে বিশেষ বিশেষ ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে যেমন দুষ্টুমি করতাম, তেমন দুষ্টুমি করলাম একটা সুশান্তর সঙ্গে।
আমার দিদিরা বলত, তুই একনম্বরের পাজি। ছেলেগুলোকে এমন নাজেহাল করিস-না।
দিদিরা যদি দেখতে পেত যে আজ সেই আমি সত্যিই কেমন নাজেহাল হচ্ছি রমেনের কাছে। ভাগ্যিস মনে মনে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলা যায়, নইলে দিদিরা একথা শুনতে পেলে বলত, কেমন? বলেছিলাম না? তখন কত করে বলেছিলাম এমন ভুল করিস না।
দিদিদের মরে গেলেও বলব না। তার চেয়ে বলব, রমেন খুব ভালো ছেলে। কালই তো ছোড়দিকে চিঠি লিখলাম–দারুণ চিঠি–আমি কী দারুণ আছি, কী ভীষণ সুখী আমি, এসব কথা ইনিয়ে-বিনিয়ে বানিয়ে-টানিয়ে ডাইরেক্টলি-ইনডাইরেক্টলি লিখলাম।
আমি ভাবছিলাম, তোমরা জানো না দিদি। আমি মরে গেলেও কখনো স্বীকার করব না যে, আমি ভুল করেছি, স্বীকার করব না যে রমেন ভালো ছেলে নয়।
রমেনকে ছাড়লেও ভবিষ্যতে ছাড়ব, এই মুহূর্তে রমেন খারাপ একথা আমার পক্ষে মানা অসম্ভব। আমি ভুল করেছি একথা বলা অসম্ভব।
কী করব এল ছোড়দি? এল বাবা? নিজের সম্মান কি নিজে এমন করে নষ্ট করা যায়? সম্মান ছাড়া কি কেউ বাঁচে? এল?
সমস্ত কষ্ট আমি নিজে একাই সহ্য করব। তোমাদের এর মধ্যে জড়াব না। ডিসিশান যখন আমি একাই নিয়েছিলাম, এর কনসিকোয়েন্সের দায়িত্ব তো আমার! আমার নিজের কাছে আমি সৎ। বাবা, তুমি আমাকে দোষ দিও না। তোমাকে দু-মাস দেখি না। প্রতিসপ্তাহেই ভাবি রাউরকেল্লা এক্সপ্রেসে চলে যাব কলকাতা শনিবার রাতে। কিন্তু যাওয়া আর হয় না। এ মাসে যাবই। বাবার জন্যে আম নিয়ে যাব একঝুড়ি। বাবা আম খেতে বড়ো ভালোবাসেন। বাবা, তুমি কেমন আছ বাবা? তুমি এখন কী করছ? আজ তো রবিবার। বেলা দশটা। তোমার তৃতীয় কাপ চা খাওয়া হয়ে গেছে–তুমি এখন তোমার ইজিচেয়ারে বসে বই পড়ছ। খবরের কাগজ পড়াও শেষ।
আমার বাবার মতো একটা সুন্দর মুখ আমি এ পর্যন্ত দেখলাম না। আমার বাবার মতো আদর করতেও দেখলাম না কাউকে। দিদিদের কাছে শুনেছিলাম, বিয়ের পরদিন আমি শ্বশুরবাড়ি গেলে বাবা নাকি ছাদে গিয়ে হাউ হাউ করে কেঁদেছিলেন। বাবাকে কখনো আমি কাঁদতে দেখিনি জীবনে।
বাবা, আমি ভালো আছি, দারুণ সুখে আছি বাবা। এই দেখো-না আমার পাশে সুশান্ত আছে। দেখো, বাবা, একবার দেখো। সুশান্ত ভালো ছেলে না? তোমার খুব ভালো লাগত ওকে, তুমি যদি দেখতে। কী করব এল, বাবা, সুশান্তরা আগে কোথায় ছিল, কোথায় লুকিয়েছিল, বুঝতে পারিনি। আমার সামনে তখন শুধু রমেনই ছিল। ছোড়দি যাকে ‘পটানো’ বলে, ও আমাকে তেমনি পটিয়েছিল। এখন বুঝি বাবা, যে ভালো ছেলেরা কাউকে কখনো পটায় না। তারা যা বলার, চোখের চাউনিতে বলে, সুন্দর চিঠিতে বলে, তারা কেউ এসে হাতে-পায়ে ধরে বিয়ে করতে চায় না। তারা তাদের আত্মসম্মাননিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের ভালো লাগা জানাবার পর তারা আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে–কোন শুভমুহূর্তে আমরা সসম্মানে তাদের পাশে গিয়ে তাদের সম্মানিত করি এবং নিজেরাও সম্মানিত হই; সেই অপেক্ষায়।
কী করব এল বাবা? ভুল করেছি।
তুমি তো বলতে বাবা, সব সময়ে বলতে; মানুষ ভুলের মধ্য দিয়ে যা শেখে, তেমন করে আর কিছুই শেখে না। তুমিই তো বলতে বাবা যে, প্রত্যেকের জীবন তার নিজের নিজের। তার নিজের জীবনের নিয়ন্ত্ৰী সে নিজে। বাবা নয়, মা নয়, দাদা নয়; কেউ নয়। প্রত্যেকের অধিকার আছে তার নিজের জীবনে তার নিজের ইচ্ছে ও পছন্দমতো বাঁচবার। সেই অধিকার প্রয়োগ করতে তুমি তো আমাকে একবারও বারণ করোনি। অন্য সবাই-ই করেছিল, তুমি করোনি। যে ভুল করেছি, সে তো আমার ভুল। তুমি এজন্য কষ্ট পাও কেন, বাবা? এই ভুলের মধ্য দিয়ে কোনোদিন হয়তো আমি আমার কোনো বড়ো ও ঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারব। আমার জন্যে কষ্ট পেয়ো না বাবা। লক্ষ্মী, সোনা বাবা।
আমি একেবারে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম।
সুশান্ত হঠাৎ বলল, কী হল?
আমি চমকে উঠলাম, বললাম, না। বাবার কথা ভাবছিলাম। হঠাৎ বাবার কথা মনে পড়ে গেল। একবার কলকাতা যাব শিগগিরই। এখানে ভালো আম কোথায় পাওয়া যায় জানেন? বাবার জন্যে আম নিয়ে যাব একঝুড়ি যাবার সময়ে।
সুশান্ত বলল, জানি না, তবে খোঁজ নেব; নিয়ে জানাব আপনাকে। কোনো বিশেষ আম কি?
না। এমনি। ভালো ল্যাংড়া আম।
ততক্ষণে রোদটা সত্যিই দারুণ চড়া হয়ে গিয়েছিল।
সুশান্তর সঙ্গে বড়ো বড়ো পা ফেলে পথের পাশে পাশে যতটুকু ছায়ার সুযোগ পাওয়া যায়, সেই সুযোগ নিয়ে নিয়ে আমরা দুজনে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম।
মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া দিচ্ছিল। শুকনো পাতা, খড়কুটো, ঝরা ফুল সব ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে হঠাৎ হঠাৎ হাওয়ার ফুৎকারে হই হই করে আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছিল। গরমে চতুর্দিক ঝাঁ ঝাঁ করছিল। পাশে লোকজন ছিল না বললেই চলে। এই কদমা-সোনারি লিংকের আশেপাশে লোকজন এমনিতেই কম।
যতই রোদ থাকুক, যতই গরম থাকুক, তবু হাঁটতে বেশ ভালো লাগছিল, দারুণ ভালো লাগছিল, সুশান্তর সঙ্গে। সুশান্তর সঙ্গ।
.
০৩.
গতকাল রমেনের ফ্যাক্টরির ফর্মাল ওপেনিং সেরিমনি ছিল।
কাজে ও ঢুকেছে প্রায় ছ-মাস, কিন্তু এতদিন কারখানার কাজ পুরোপুরি চালু হয়নি। আমি ওসব বুঝি না। রমেন যা গল্প করত, তাই-ই শুনতাম।
এর আগে টেলকোতে কাজ করত ও। সেকাজ এক অজ্ঞাত কারণে রাতারাতি চলে গেল। কারণটা হয়তো রমেনের কাছে অজ্ঞাত ছিল না, কিন্তু আমার কাছে ও বানিয়ে বানিয়ে যা বলেছিল সেটাকে বিশ্বাস করার ইচ্ছা হয়নি আমার।
কিছুদিন কাজ ছিল না। আমার রোজগারই তখন একমাত্র রোজগার ছিল। আমি যা রোজগার করি, সে রোজগারে আমার স্বামীকে স্বচ্ছন্দে খাওয়াতে পারি, কিন্তু যে স্বামী নিজের দোষে নিজের চাকরি বার বার খোওয়ায় তাকে খাওয়ানোর ভাবনাটাও ভালো লাগে না। যোগ্যতা না থাকলে অন্য কথা ছিল, যোগ্যতা না থাকলে বিভিন্ন জায়গায় চাকরি পায় কী করে চটপট রমেন? তার যোগ্যতায় আমার সন্দেহ নেই; আমার যত সন্দেহ ওর সততায়। পাওয়া চাকরি সে রাখতে পারে না। কোনো চাকরিই। তা ছাড়া বড়ো কুঁড়ে ও।
কারখানায় যাবার আমার মোটেই ইচ্ছা ছিল না, রমেনের বিশেষ অনুরোধে আমায় যেতে হল।
রমেন বলেছিল, আমি গেলে নাকি ওর সম্মান বাড়বে, রমেনের যে আমার মতো একজন স্ত্রী আছে, তা জানলে কোম্পানিতে ওর কদর হবে।
জানি না, কদর হবে কি না; কিন্তু রমেন একবারও বোঝেনি, যে আমি বিলক্ষণ বুঝতে পারছিলাম যে, রমেনের যাই হোক, ওখানে গিয়ে আমি নিজেকে সম্মানিত করিনি।
কারখানার মোল্ডার, মেল্টার, লেবারাররা সকলেই আমার দিকে কেমন অবাক চোখ তুলে তাকিয়েছিল। সকলের চোখেই লেখা ছিল, আরে? এ মেয়েটা রমেনের মধ্যে কী দেখল? এত ছেলে থাকতে তাকে বিয়ে করতে গেল কেন?
ডিরেক্টরদের স্ত্রীরা এবং অন্যান্য অনেকের স্ত্রীরাও এসেছিলেন। তাদের মধ্যে আমার সমবয়েসি দু-তিনজন ছিলেন। এ কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টরদের মধ্যে প্রায় সকলেই কমবয়েসি। দারুণ দারুণ শাড়ি পরেছিলেন মহিলারা, কিন্তু দেখতে বেশিরভাগ পানওয়ালির মতো, একজনকে দেখতে অবিকল আমাদের ভবানীপুরের ভাড়াবাড়ির ঠিকে ঝি মোক্ষদার মতো।
কিন্তু হলে কী হয়, বাঘা বাঘা লোকেদের স্ত্রী তারা। সকলেই তাদের চারপাশে ভিড় করে আছে। কেউ ডিরেক্টরের ছোটো বাচ্চার নাকের পোঁটা রুমাল দিয়ে পুঁছছে, কেউ ছোটো মেয়েকে কাঁধে নিয়ে বেড়াচ্ছে, অন্য কেউ বউদিরা কখন কী বলবেন বা আজ্ঞা করবেন সেই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।
আমি নিরুপমা চৌধুরি, যেহেতু আমি দেখতে ওঁদের সকলের চেয়ে ভালো, যেহেতু আমি ওঁদের সকলের চেয়ে শিক্ষিত ও সকলের চেয়ে সুন্দর করে সেজেছি–এবং যেহেতু আমি রমেন ঘোষের স্ত্রী-আমাকে ওরা সকলেই কৃপার চোখে দেখতে লাগলেন।
আমি যে আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে রইলাম, আমাকে কেউ একটা চেয়ার এনে বসতে পর্যন্ত বলল না। অনেকক্ষণ পর রমেন নিজেই কোথা থেকে একটা চেয়ার বয়ে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে আমার জন্য পেতে দিল। ওর মুখ গরমে ঘেমে গিয়েছিল, আমাকে বলল, বোসো, তোমার গরমে কষ্ট হচ্ছে না?
কষ্ট আমার হচ্ছিল, সেটা গরমের জন্যে নয়, কী জন্যে তা রমেনকে বলে লাভ ছিল না তখন। রমেনের জন্যেও কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু সে কষ্টের চেয়েও বড়ো একটা কষ্ট, প্রত্যেক বিবাহিতা মেয়ের মনে যে-কষ্ট মাঝে মাঝে হয় সেই কষ্ট আমাকে সে মুহূর্তে বড়ো পীড়িত করেছিল। নিরুপমা চৌধুরি নিজে যাই-ই হোক, তার চেহারা যাই-ই হোক, তার পারিবারিক পটভূমি যাই-ই হোক, তার শিক্ষা যাই-ই হোক, এই মুহূর্তে এই ইলেকট্রিক ফারনেসের পাশে দাঁড়িয়ে, তার স্বামীর কর্মক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে তার বিন্দুমাত্র দাম নেই তার নিজের জন্যে। হয়তো কোনো বিবাহিত মেয়েরই নেই। এখনও, এই টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরিতেও স্বামীর পরিচয়ই মেয়েদের সবচেয়ে বড়ো পরিচয়। এটা ভালো কি মন্দ, ন্যায় কি অন্যায়, তা আমি জানি না, কিন্তু এটা মর্মান্তিকভাবে সত্যি।
আমার যেসব বন্ধু এখনও বিয়ে করেনি, কিন্তু ডেটিং করছে বা প্রেম করছে, আমার চেয়ে ছোটো যেসব মেয়েদের আমি চিনি না, অথচ যারা একদিন বাবা-মার অমতে আমার মতো জেদ করে নিজের মতামতকে ভীষণরকম দামি ভেবে জীবনের পথে পা বাড়াবে, তারা যদি আমার এ লেখা পড়ে, একথা শোনে, তবে তারা হয়তো কিছু করার আগে দু-বার ভাববে।
এই মুহূর্তের অনুভূতি আমি বোঝাতে পারব না কাউকে, আমার মতো অবস্থায়, এইরকম সিচুয়েশানে যদি অন্য কোনো বিবাহিতা মেয়ে কোনোদিন পড়ে থাকেন তবে একমাত্র তাঁরাই আমার দুঃখের কথা বুঝবেন। আমরা, এই বর্তমান যুগের, উদ্ধত ও অবুঝ মেয়েরা স্বীকার করি আর না-ইকরি, একথা সত্যি যে, আমাদের বিবাহিত জীবনে একমাত্র আমাদের স্বামীরাই আমাদের যথার্থ সামাজিক সম্মান দিতে পারেন, স্বামী ছাড়া আর কেউই তা পারেন না। যতদিন সমাজ থাকবে, স্বামী-স্ত্রীতে একসঙ্গে বসবাস করতে হবে, নেমন্তন্নে, পার্টিতে মিস্টার অ্যাণ্ড মিসেস দুজনেরই আমন্ত্রণ থাকবে, ততদিন আমাদের মতো সবজান্তা, বোকা ও ইমপালসিভ মেয়েদের এমনি করেই অপমানিত হতে হবে। এর কোনো প্রতিকার নেই। স্বামীদের বড়োলোক হবার দরকার নেই, তারা যেন যথার্থ পুরুষমানুষ হয়, তাদের যেন যথার্থ ভবিষ্যৎ থাকে, তাদের জন্য আমরা যেন গর্বিত হতে পারি–এ ছাড়া আর কিছু রমেনদের কাছে চাইবার নেই, কোনোদিন ছিলও না আমাদের।
ওদের কারখানায় দুটো কিউপোলা কাস্ট আয়রন ফাউন্ড্রির আর দুটো ইলেকট্রিক আর্ক ফারনেস। একটু পরে আর্ক ফারনেস দুটো চার্জিং হবে। বোতাম টিপবেন ম্যানেজিং ডিরেক্টরের স্ত্রী। সে মহিলা মাঝবয়েসি, মিষ্টি দেখতে, একটা অফ-হোয়াইট শাড়ি পরেছেন, হালকা বেগুনি পাড়, সঙ্গে হালকা বেগুনি ব্লাউজ, গলায় মঙ্গলসূত্রম।
আমি একা অন্যদিকে বসে আছি-ফারনেসগুলোর কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে অন্য সবাই বসে আছেন। লাইমস্টোন, পিগ আয়রন এ সমস্ত চার্জ করা হচ্ছে ফারনেসের ঢাকা খুলে, এমন সময় দেখি শেফালি আসছে।
শেফালি চ্যাটার্জি। আমাদের সঙ্গে কলেজে পড়ত–ভীষণ রোগা ছিল–এখনও আছে পার্ট টু পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি। শেফালি এত রোগা যে ও বরাবর শাড়ির নীচে দুটো শায়া পরত মোটা দেখাবার জন্যে–আজও পরেছে। আমাকে দেখেই ও হাসল, সোজা আমার কাছে এল-রোগা হলেও বেশ দেখাচ্ছে শেফালিকে–একটা লাল জমির ওপর হলদে কাজ করা ঢাকাই পরেছে। ও বলল, বাংলাদেশ থেকে আনিয়েছে। শেফালি আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, নিরু? তুই এখানে? বেশ বাবা, বিয়ে করলি খবরও দিলি না। তোর বর কি এখানে কাজ করেন নাকি?
আমি ঘাড় হেলালাম।
তোর বরের কী নাম? নিশ্চয়ই ডিরেক্টরদের মধ্যে কেউ? কথাটা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে শেফালির ফর্সা মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে এল।
আমি আবার মাথা নাড়ালাম। রমেনের নাম বললাম। শেফালির মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, বলল, ও! ও, তাই নাকি? তারপর বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, রমেনবাবু তোর বর? তার সম্বন্ধে শুনেছি আমার স্বামীর কাছে।
কী শুনেছে জিজ্ঞেস করার মতো বুকের জোর আমার ছিল না। পাছে ও নিজেই রমেনের সম্বন্ধে কিছু বলে বসে, তাই আমি তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে বললাম, তুই এখানে কোথায় থাকিস?
শেফালি বলল, কাইজার বাংলোয়–এদের কোম্পানির পাঁচটা বাংলো নেওয়া আছে ডিরেক্টরদের জন্যে, আর–বলে কপাল থেকে চুল সরিয়ে বলল, আমার স্বামী তো ওয়ার্কস ম্যানেজার। দাঁড়া, তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই–বলেই, শেফালি ফারনেসের দিকে চেয়ে যেখানে সকলে দাঁড়িয়েছিলেন সেদিকে ডাকল, ওগো শুনছ।
শেফালির ডাকে সাদা কচ্ছপের মতো দেখতে বেঁটেখাটো গাবলু-গুবলু এক ভদ্রলোক আমাদের দিকে আসতে লাগলেন। ভদ্রলোকের পরনে কমলা-রঙা একটা টেরিলিনের প্যান্ট, গায়ে নীল-রঙা ব্যাংলনের গেঞ্জি, চুলটা ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ানো–দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আগে পাশ ফিরিয়ে আঁচড়াতেন, বিয়ের পর শেফালির ডাইরেকশানে এই শাসন চুলের ওপর।
ভদ্রলোক বেশ ভালো মানুষ, দেখলেই মনে হয় পড়াশোনায় ভালো ছাত্র ছিলেন, এতদিন পড়াশোনা ছাড়া আর কিছুই করেননি, এখন আর সমস্ত কিছু, সাজপোশাক, চুলের কায়দা, স্মার্টনেস ইত্যাদি শেফালির প্যাকেজ ট্রেনিংয়ে তাড়াতাড়ি সব শিখে নিচ্ছেন; মানে শেফালি যেমন শেখাচ্ছে, তাই শিখছেন। নইলে কি এমন সাজে সাজেন কোনো ভদ্রলোক?
উনি নমস্কার করে বললেন, ওকী? আপনি এখানে একা বসে আছেন কেন? কী অন্যায় কথা! চলুন চলুন, ওদিকে চলুন, মেয়েরা সব একসঙ্গে বসবেন, গরমে একটু কষ্ট হবে, কী আর করবেন?
আমি হেসে বললাম, আমি কিন্তু বেশ হাওয়া পাচ্ছি একটু একটু, এখানেই বসি। ভিড় ভালো লাগে না।
উনি একটু পরে চলে গেলেন।
শেফালি বলল, গরমও পড়েছে বল? আর সারাদিন এয়ারকণ্ডিশানড ঘরে বসে থাকি, বাইরে বেরোলে এত কষ্ট হয় যে কী বলব। তুই তো আসবি না, আমিই যাই ওদিকে, বুঝলি?
শেফালি চলে গেল।
আমি বসে বসে ভাবছিলাম যে, একটু আগেই আমি যা ভাবছিলাম তা ঠিকই।
শেফালিকে আমি হিংসা করি না, তবু ক্লাসের পরীক্ষায় ফেল করা শেফালি–যাকে এই নিরুপমা চৌধুরি একজন নন-এনটিটি বলেই জেনে এসেছে এতদিন, যার বলার মতো কোনো গুণই নেই–সেই শেফালি তার স্বামীর পরিচয়ে আজ আমার চেয়ে এইখানে অনেক বড়ো হয়ে রইল।
আমি হয়তো কখনো অমন ক্যাবলা ছেলেকে বিয়ে করতে পারতাম না-পড়াশুনোয় সে যতই ভালো হোক না কেন–কিন্তু রমেনের মতো হ্যাণ্ডসাম অথচ শেফালির বরের মতো গুণী ছেলেও কলকাতায় বহু ছিল। তাদের আমার সঙ্গে দেখা হল না। প্রথম বয়েসের ঘোরে, প্রথমজনকে দেখে, তার সস্তা সেলসম্যানশিপে ভুলে গিয়ে আমি তাকে গ্রহণ করলাম। এতগুলো লোকের সামনে একজন সন্দেহজনক চরিত্রসম্পন্ন চালিয়াত ও আত্মসম্মানজ্ঞানহীন স্বামীর স্ত্রীর পরিচয়ে এককালীন রূপে-গুণেচোখ-ঝলসানো আমি মাথা নীচু করে বসে থাকলাম।
কিছুক্ষণ পর ম্যানেজিং ডিরেক্টরের স্ত্রী ফারনেস চালু করলেন। প্রচন্ড শব্দ করে ফারনেস চালু হল। ইলেকট্রোডগুলো ধীরে ধীরে নেমে এল ফারনেসের মধ্যে। তারপর অতিকায় প্রেশার কুকারের মতো ফারনেসের মধ্যে ইস্পাত রান্না হতে লাগল। কিউপোলাগুলো অনেকদিন আগেই চালু হয়েছিল। আজ সেগুলো চলছে না। দারুণ উঁচু শেডের নীচে একা একা নিঃসঙ্গ হয়ে দূরে দূরে দাঁড়িয়ে আছে ওগুলো।
সকলকে খাবার দেওয়া হল। কারখানার সকলের জন্যে প্যাকেটে করে মিষ্টি, শিঙাড়া ইত্যাদি আনা হয়েছিল। আমাকেও কে যেন এনে দিল একটা প্যাকেট।
বাড়িতে রান্না করে এসেছিলাম, গিয়ে আরেকবার চান করে আরাম করে খাব–ঘামে ব্লাউজ, ভেতরের জামা সব ভিজে জব জব করছে। এখানে আর একমিনিটও বসতে ইচ্ছে করছে না।
এখন অফিস বিল্ডিংয়ের মধ্যে এয়ারকণ্ডিশানড ঘরে ডিরেক্টরেরা ও তাঁদের স্ত্রীরা সকলে বসে আছেন। শেফালিও আছে। নভেলটি থেকে বিয়ার এসেছে, নটরাজ থেকে চাইনিজ খাবার।
এখনও পর্দা-টর্দা লাগানো হয়নি বলে ঘরের মধ্যে কী হচ্ছে দেখা যাচ্ছে।
আমি উঠে দাঁড়ালাম বাড়ি যাব বলে। রমেন এসে জিজ্ঞেস করল খেয়েছি কি না। ও নিজে হাতে খুরিতে করে এককাপ চা নিয়ে এল আমার জন্যে। চা-টা খেলাম। ফাই-ফরমাশ খেটে বেচারির চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছে। ওর দিকে তাকিয়ে আমার কষ্ট হল। শাড়িটা ক্রাশড হয়ে গেছিল, ঠিক করে নিয়ে আবার ওর মুখের দিকে তাকালাম।
আমার মনে হল ওকে বলি, আমার কোনো উপায় নেই তোমাকে সাহায্য করার। পুরুষমানুষরা একমাত্র নিজেরাই নিজেদের সাহায্য করতে পারে।
ও বলল, সেন তার মোটরসাইকেলের পেছনে তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে।
আমি শুধোলাম, তুমি যাবে না?
রমেন বলল, পাগল! মেটাল গলবে, পোরিং হবে। সকলে মিলে দেখতে হবে কেমন কাস্টিং হল। তারপর ল্যাবরেটরিতে কার্বন-কন্টেন্ট পরীক্ষা হবে, কত ঝামেলা। ঝামেলা কি সোজা? সব শেষ করে যেতে যেতে আমার রাত হয়ে যাবে।
রাত হয়ে যাবে তোমার?
বা: হবে না? আমার ওপর কত দায়িত্ব। আমি না থাকলে হয়?
আমি কিছু বললাম না, কারখানার গেটের দিকে এগোতে লাগলাম। যখন অফিস বিল্ডিংয়ের কাছাকাছি এসেছি এমন সময়ে শেফালি দৌড়ে এসে বলল, এই নিরু, তোকে সকলে ডাকছেন।
কেন জানি না, আমার মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেল, কিন্তু হেসে বললাম, কেন রে?
তোকে যেতে দেখে ম্যানেজিং ডিরেক্টর জিজ্ঞেস করলেন, হু’জ দ্যাট প্রিটি লেডি? যেই শুনেছেন যে তুই আমার বন্ধু, বললেন ডেকে আনতে। আয় না আমাদের সঙ্গে একটু চাইনিজ খাবি?
আমি বললাম, না রে। আমার তাড়া আছে।
শেফালি হাত ধরল, বলল, আয় না বাবা, এম ডি বলছেন।
আমার সত্যিই এবার রাগ হল, বলে ফেললাম, এম ডি কি ভগবান?
শেফালি চমকে উঠল। বলল, না। তা নয়। তবে তোর না হলেও তোর বরের ভগবান তো বটেই। তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর তোর বরের চাকরি নির্ভর করছে।
আমি হেসেই বললাম, তবে সে ভগবানের পুজো আমার স্বামীরই ব্যাপার, আমার নয়। তাই না। বল?
তারপর কথাটাকে হালকা করার জন্যে বললাম, সত্যিই বলছি রে, গরমে অবস্থা কাহিল, দেখা করার মতো অবস্থা নেই।
শেফালি হালকা গলায় বলল, তোর মতো মেয়েকে যে-কোনো অবস্থাতে দেখতে পেলেই যে-কোনো পুরুষ ধন্য হয়ে যাবে।
পরক্ষণেই বলল, তোর আর তোর বরের সম্বন্ধে আলোচনা হচ্ছিল।
আমি আর কথাটাকে ফেনাতে দিলাম না। আমি জানি কী আলোচনা হয়; কী আলোচনা হতে পারে। সে আলোচনা তো আমিও করি; সবসময়ে মনে মনে। কিন্তু উপায় কী? মুক্তির এখনও কোনো উপায় নেই। হয়তো পরে কোনোদিন হবে। জানি না, সেদিন কবে হবে।
সেন গেটে দাঁড়িয়েছিল, ডাক দিল, বউদি আসুন, রোদে বেগুনপোড়া হয়ে গেলাম।
আমি পৌঁছোতে ও ইঞ্জিন স্টার্ট করল। ওর কোমর জড়িয়ে ধরে বসতে আমার লজ্জা করছিল। মোটরসাইকেলের পেছনে বসলেই যে চালায় তাকে জড়িয়ে ধরে তার পিঠে বুক লাগিয়ে বসতে হয়, নইলে জামশেদপুরের এই ফাঁকা রাস্তায় যা জোর চালায় এরা, যে কোনো মুহূর্তে পড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।
সেন আমার ছোটো ভাইয়ের মতো। ওকে জড়িয়ে ধরতে লজ্জা নেই কোনো–কিন্তু সারা গা ভিজে গেছে ঘামে। আমার তো লজ্জা করবেই; হয়তো ওরও লজ্জা করবে।
সেন ভটভটিয়ে বের হল বাইরে, তারপর জোরে ছোটাল তার মোটরসাইকেল।
বাতাসে আমার চুল উড়ছিল, আঁচল উড়ছিল। গরম হাওয়ায় চোখ শুকিয়ে যাচ্ছিল। অসহ্য গরম।
সেন যেন কী বলল। হাওয়ায় ওর কথাগুলো উড়ে গেল। আমার দু-হাতই আটকা। হাত বাড়িয়ে যে কথার টুকরোগুলো ধরব, তার উপায় ছিল না। চেঁচিয়ে বললাম, জোরে এল, শুনতে পাচ্ছি না।
সেন বলল, বলছি যে, মোটরসাইকেলের পেছনে আপনাকে মানায় না।
তো, কীসে মানায়?
ক্যাডিলাক গাড়িতে।
বললাম, ফাজিল।
একটু পরে সেন আবার বলল, বউদি, আপনার ছোটোবোন নেই?
হেসে বললাম, আছে। দু-বোন।
আপনার মতো দেখতে?
আমার চেয়ে অনেক ভালো দেখতে। সেন মুখ ফিরিয়ে বলল, আমার জন্যে একটু কিছু করুন না বউদি।
আমি হাসলাম, বললাম, মুখ ফিরিয়ো না; অ্যাকসিডেন্ট হবে।
আপনার সঙ্গে অ্যাকসিডেন্ট হলেও সুখ। তারপর বলল, আপনার সঙ্গে মরলেও দুঃখ নেই আমার।
আমি বললাম, কিন্তু আমার আছে। আমি আমার এই জীবনকে দারুণ ভালোবাসি।
এই জীবনকে? সেনের গলা গম্ভীর শোনাল। বলল, বউদি আপনি বড়ো মিথ্যুক।
কেন? একথা বলছ?
এই জীবনকে আপনি সত্যি ভালোবাসেন? বলেই গতিটা আস্তে করল।
আমি বললাম, কোন জীবনের কথা তুমি বলছ জানি না–তবে জীবন তো আমাদের একটাই–জীবন হয়তো খন্ড খন্ড, টুকরো টুকরো বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা, তবু সব মিলিয়ে তো একটাই জীবন। সত্যিই আমি আমার জীবনকে ভালোবাসি।
বাড়ির দরজায় পৌঁছে পেয়ারাগাছের নীচে মোটরবাইকটা রাখল সেন। বলল, একটু বসে যাই।
বললাম, বসবে? এসো। কী খাবে এল? ঘোলের শরবত করে দিই? না লেমন স্কোয়াশ খাবে?
সেন উত্তর দিল না।
আমি তালা খুলে ভেতরে এলাম।
বসবার ঘরটা বাইরের তুলনায় অনেক ঠাণ্ডা।
সেন বলল, আঃ কী আরাম! আপনার ঘরটা কী ঠাণ্ডা বউদি।
সেন ভেতরে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিল। আমি পাখাটা খুলতে গিয়েছিলাম, পাখা খুলে স্ট্যাণ্ড-লাইটটা জ্বেলে ফিরতেই দেখি সেন একেবারে আমার পেছনে।
কিছু বোঝার আগেই ও আমার কোমর জড়িয়ে ধরল, জড়িয়ে ধরেই আমার ঘামে ভেজা বুকে মুখ গুঁজল। পরক্ষণেই মানা করার বা বাধা দেওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়েই এমন একটা কান্ড করে বসল, যা আমি বলতে পারছি না।
ঠাস করে ওর গালে একচড় লাগালাম আমি। ও তড়িতাহতের মতো সরে গেল। ওর চোখের দিকে চাইতেই দেখলাম ও আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে, ওর চোখের কোণ জলে ভিজে উঠেছে।
সেন দেখতে কুৎসিত–কুচকুচে কালো রং, মোটা থ্যাবড়া নাক, ছোটো ছোটো কদমছাঁট চুল, মোটা ঠোঁট, ওকে ওরকমভাবে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমার গা জ্বালা করতে লাগল। আমি দরজার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম, বেরোও এখান থেকে বেরিয়ে যাও এখুনি-চেঁচিয়ে বললাম।
ঠিক সেই সময়ে দরজা ঠেলে সুশান্ত ঢুকল, অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে ও বলল, আমাকে বলছেন?
আমার কী যেন হয়ে গেল। মাঝে মাঝে আমার মাথার ঠিক থাকে না, বললাম, সবাইকেই বলছি, সবাইকেই বলছি বেরিয়ে যেতে।
তারপরই বললাম, আমাকে একটু একা থাকতে দিন, প্লিজ আমাকে একটু একা থাকতে দিন।
সুশান্ত কিছু না বলে যেমন নিঃশব্দে এসেছিল তেমনি নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।
সেনও কোনো কথা বলল না। আরেকবার আমার দিকে তাকিয়ে চলে গেল। দেখলাম ওর দু-চোখ বেয়ে জল পড়ছে।
হঠাৎ আমার মনে হল রমেন আমার কাছে যে মুখ নিয়ে আসে, সেনের এ মুখে সেই মুখের ছায়া নেই। সেনের সমস্ত মুখে কী যেন ভীষণ একটা কষ্ট ছড়িয়ে ছিল, সে কষ্টের কোনো ব্যাখ্যা আমি জানি না।
একটু পরে সেনের মোটরসাইকেলের শব্দ দূরে মিলিয়ে গেল কালীবাড়ির মোড়ের দিকে। দরজাটাতে ছিটকিনি দিয়ে আমি ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে পড়লাম।
আমি কী করব জানি না। এত অপমান, এতরকম অপমান আমার আর সহ্য হয় না। পাখার ব্লেডগুলোদেখা যায় না–পাখাটা ‘অন’-এ ঘুরছিল। হঠাৎ মনে হল পাখার সঙ্গে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুললে কেমন হয়? কী করে ঝোলে লোকে? যারা ঝোলে, তারা হঠাৎ কখন সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছোয়? হয়তো এমনই কোনো মুহূর্তে। আমি আজ সে মুহূর্তের সামনে এই অসহ্য গরম ও অসম্মানে দাঁড়িয়ে আছি।
আমার চোখ দিয়ে সচরাচর জলে পড়ে না। কিন্তু ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে ঘুরন্ত পাখার দিকে চেয়ে দু-চোখ বেয়ে জল ঝরতে লাগল। ছিঃ, সুশান্ত কী ভাবল আমাকে। সুশান্ত এই মরুভূমির মধ্যে একমাত্র মরূদ্যান আমার, আমার এক এবং একমাত্র সম্মানের পাত্র, যে আমাকে সম্মানের চোখে দেখে; সে আমাকে ভাবল, হয়তো সেনের সঙ্গে আমার কোনো বিশেষ সম্পর্ক আছে। ভাবল, সেনকে আর ওকে আমি একই চোখে দেখি।
জানি না কেন এমন হল, আমার কেন এমন কপাল হল? এত মেয়ে থাকতে শুধু আমার জন্যেই কি পৃথিবীর সমস্ত সমস্যা জমা হয়েছিল?
.
০৪.
বাইরে কখন প্রখর রোদের বেলা পড়ে এসেছিল বুঝতে পারিনি। বোধহয় অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম।
ঘুম যখন ভাঙল, তখন প্রায় ছ-টা বাজে। বাইরে পেয়ারাতলায় রোদের ফালিগুলো বেঁকে গেছে। একটা একলা বুলবুলি কোথা থেকে উড়ে এসে শুকনো ডালে বসে কিসকিস করে কী সব বলছে।
জানালাগুলো খুলে দিলাম। আমার দম বন্ধ হয়ে এসেছিল। এই ভাড়া করা ফার্নিচার, এই ভাড়া করা গালিচা, এই ভাড়া করা জীবনের গ্লানি, এই অসম্মানের জীবন বড়ো দুর্বিষহ বলে মনে হচ্ছিল।
মুখী এলে, ওর ওপর ঘরদোর পরিষ্কারের ভার দিয়ে চান করতে গেলাম।
আমার সারা-গা দিয়ে গরম ঝাঁঝ বেরোচ্ছিল।
বাথরুমে ঢুকে সমস্ত জামাকাপড় ছেড়ে বাথরুমের আয়নার সামনে চুল খুলে দাঁড়ালাম শাওয়ারের নীচে। সারাশরীর বেয়ে ঠাণ্ডা জল গড়াতে লাগল।
ভালো করে বার বার অনেকবার সাবান মাখালাম সারাগায়ে মুখে, বুকে, তবুও ঘেন্না গেল না। সেন আমার শরীরের যেখানে যেখানে হাত দিয়েছিল সেই সমস্ত জায়গা তখনও জ্বলছিল –যেন ওর হাতে লঙ্কাবাটা ছিল। ঘেন্নায় গা রি রি করছিল।
জানি না, আমি মেয়ে, আমি, আমরা, কোনোদিনও হয়তো পুরুষদের এই লজ্জাকর প্রবৃত্তি-সর্বস্বতা ক্ষমা করতে পারি না।
সেনকে আমার ছোটো ভাইয়ের মতো দেখতাম, ওই কালোচালো অল্পবয়েসি ছোটো ছেলেটার জন্যে আমার মনের কোণে বেশ একটা আদুরে অনুকম্পার স্থান গড়ে উঠেছিল। ও এই একমুহূর্তের স্পর্শের সামান্য পাওয়ার বিনিময়ে কেন যে এত বড়ো পাওয়াটাকে ধুলোয় ফেলে দিল তা ও-ই জানে; পুরুষরাই জানে।
আয়নার সামনে সম্পূর্ণ নগ্না হয়ে দাঁড়ালে এখনও আমার গর্ব হয়। আমার ফিগারটা সত্যিই ভালো। নীলামে চড়ালে এর দাম কত হত জানি না। হয়তো এ এক বহুমূল্য বস্তু, অন্যদের চোখে, পুরুষের চোখে, কিন্তু এই সুন্দরী নারী-শরীরের আড়ালে যে একটা নরম ভালোবাসার কাঙাল কাঠবিড়ালির মতো মন আছে, সে মনটার খোঁজ কেউ রাখল না। এই সুন্দরী শরীর না থাকলে আমার–আমি কখনো রমেনের মতো লোকের শিকার হতাম না। সত্যিকারের সুন্দর মনের কেউ হয়তো একদিন আমাকে আদর করে, সমস্ত সম্মানের সঙ্গে তার ছোটো মধ্যবিত্ত সংসারের রানি করত।
কিছুই হল না।
আমি, এই উদ্ধত, সুন্দরী, সর্বগুণসম্পন্না নিরুপমা চৌধুরি আজ কিছু নিয়েই আর গর্ব করতে পারি না। গর্ব করার মতো কিছুই বুঝি আমার অবশিষ্ট রইল না আজ।
অনেকক্ষণ ধরে চান করার পর শরীরটা বেশ স্নিগ্ধ লাগতে লাগল। পয়লা বৈশাখে ছোড়দি একটা সাদা জমির ওপর হালকা হলদে পোলকা ডটের খাটাউ ভয়েল দিয়েছিল। সে শাড়িটা বের করে পরলাম। হালকা হলদে রঙের ব্লাউজ পরলাম যা ওই শাড়ির সঙ্গে মানায়। ফলস মুক্তোর সাদা মালা পরলাম একটা গলায়। ভুরুতে আইব্রো-পেনসিল মাখলাম–অনেকদিন ভুরু প্লাক করাইনি, একদিন করতে হবে। কেন জানি না, সেই অসম্মানের দুপুরের পর, সেই সন্ধেয় ড্রেসিং-টেবিলের সামনে বসে অনেক অনেকদিন পর ভালো করে সাজতে আমার ভারি ভালো লাগছিল।
বিয়ের সময়ে বন্ধুরা মিলে একটা ইন্টিমেট সেন্ট কিনে দিয়েছিল। বিশেষ বিশেষ দিনে, যেদিন মন খারাপ থাকে, অথবা অত্যন্ত ভালো থাকে, আমি ওই সেন্টটা মাখি। ইন্টিমেটটা বের করে ঘাড়ে, গলায় একটু মাখলাম। তারপর চটিটা পায়ে গলিয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পড়লাম।
কোথায় যাব জানি না, এখানে আমার তেমন জায়গাও নেই যাওয়ার; তবু বেরোলাম।
মাঝে মাঝে এমন বোধ হয় সব মেয়েরই হয়। দমবন্ধ-দমবন্ধ লাগে। কোথাও যাবার জায়গা নেই জেনেও বেরোতে হয়, পথে পথে ঘুরতে হয়, কোনো অপরিচিত পথিকের স্তুতিভরা চোখের আয়নায় নিজের ব্যক্তিত্বের ছায়া দেখে নিজেকে নতুন করে নিজে ভালোবাসতে ইচ্ছে যায়।
অনেকক্ষণ একা একা সোনারি-লিংকে হেঁটে বেড়ালাম। কতরকম লোক হাঁটতে বেরিয়েছে। গরমের সন্ধে। একদল কাক আসন্ন সন্ধ্যার গান গাইছে সমবেত হয়ে। কোম্পানির কুকুরগুলোকে কে যেন ট্রেনিং দিচ্ছেন–পাশের মাঠে। বড়ো বড়ো অ্যালসেশিয়ান কুকুরগুলো লাফাচ্ছে, ঝাঁপাচ্ছে, পরমুহূর্তেই শান্ত ও বাধ্য ছেলেদের মতো কথা শুনছে।
হাঁটতে হাঁটতে প্রায় এয়ারস্টিপ অবধি চলে গিয়েছিলাম। তারপর ফিরলাম। এখন পথে পথে আলো জ্বলে উঠেছে। অন্ধকার হয়ে গেছে সোনারির রাস্তা। মাঝে মাঝে তীব্র গতিতে বুকের মধ্যে চমক তুলে কোনো গাড়ি ছুটে চলেছে পথ বেয়ে।
কাইজার বাংলোগুলোর কাছে এসে মোড় নিলাম। মোড়েই একটা ফুলগাছ। বোধ হয় কেসিয়া নডুলাস। পথটা ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে।
ফুলের গালচের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতেই আমার মনে বিদ্যুৎ চমকের মতো একজনের কথা মনে পড়ল। একটা ব্যথিত মুখ। মনে পড়তেই, বুকের মধ্যেটা মুচড়ে মুচড়ে উঠতে লাগল।
কী আশ্চর্য! সেনকে বের করে দেবার পর থেকে সুশান্তর কথা একবারও আমার মনে পড়েনি। এই মুহূর্তে ফুল মাড়ানোর সময়ে কেন জানি না, আশ্চর্যভাবে সুশান্তর কথা মনে পড়ে গেল আমার। ইচ্ছে হল এক্ষুণি গিয়ে ওর কাছে ক্ষমা চাই। ওর কাছে দৌড়ে গিয়ে বলি, তোমাকে কিছু বলতে চাইনি, বলতে চাইনি গো, যা বলেছি তা আমার মুখের কথা; মনের কথা নয়।
জানি না, কী এক অদৃশ্য টানে আমি বড়ো বড়ো পা ফেলে বাড়ির দিকে এগিয়ে চললাম।
সুশান্তর বাড়ি আমাদের বাড়ির পাশেই। পথে বেরোবার সময়েও ওর বাড়ির পাশ দিয়েই গিয়েছি, অথচ একবারও মনে পড়েনি ওর কথা তখন, অথচ এখন কী এক অজানা কারণে ও এমন করে টানছে আমাকে।
বাড়ির বাইরের দরজায় দেখি ওর বাহন ময়ূর সিঁড়িতে বসে আছে।
বললাম, দাদাবাবু আছেন নাকি?
ময়ূর হেসে বলল, আছেন।
খবর দেবে একটু যে, আমি এসেছি।
ময়ুর উঠে দাঁড়াল। বেশ চটপটে সপ্রতিভ ছেলে। বলল, খবর দেবার দরকার নেই। দাদাবাবু জানেন যে আপনি আসবেন।
সেকী? তুমি কী করে জানলে?
বারে। আমাকে উনি যে বললেন, বললেন পাশের বাড়ির বউদি এলে ভেতরে পাঠিয়ে দিবি।
আমি একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে পড়ে ঠোঁট কামড়ে একটু ভাবলাম। যেতে বড়ো সংকোচ হচ্ছিল। আমি কোনোদিনও যাইনি এপর্যন্ত সুশান্তর বাড়ি। ও-ই বরাবর এসেছে। তা ছাড়া একজন বিবাহিতা অল্পবয়েসি মেয়ের পক্ষে একা একা ব্যাচেলারের বাড়ি যাওয়ার কোনো যৌক্তিকতাও নেই। তবু যেতেই হবে আমাকে। আজ ক্ষমা না চাইতে পারলে হয়তো রাতে ঘুমোতে পর্যন্ত পারব না। ছিঃ ছিঃ কী ভাবল আমাকে সুশান্ত–কত কী ভাবল হয়তো।
আমি ময়ূরকে বললাম, তুমি একটু খবর দিয়ে এসো মুখীকে যে, আমি এ বাড়িতে আছি। দাদাবাবু এলেই যেন খবর দেয় আমাকে–আর দাদাবাবুকে যেন বলে যে আমি এখানে আছি।
ময়ূর বলল, আপনি ভেতরে যান, আমি বলে আসছি।
বাইরের ঘরটায় একটা সোফাসেট, পাটের একরঙা কার্পেট–একটা তেলরঙের ছবি।
বাইরের ঘরে কয়েক মূহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরে ঢুকলাম আমি পর্দা সরিয়ে। একফালি বারান্দা–অন্ধকার। বারান্দার ওপারের একটি ঘর থেকে আলোর ফালি এসে বারান্দায় পড়ছিল। ঘরে সবুজ-রঙা পর্দা ঝুলছে। ঘরের পাখার হাওয়ায় দুলছে পর্দাটা।
আস্তে আস্তে পর্দার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। ভেতরে কোনো শব্দ নেই–শুধু পাখাটার একটানা একটা গুনগুনানি শব্দ ছাড়া। অনেকক্ষণ পর, যেন বহুযুগ পর–কে যেন একটা বইয়ের পাতা ওলটাল-তারপরই সুশান্ত নিজের মনে বলে উঠল, The woods are lovely, Silent and deep. I have miles to go and promises to keep. কবিতা পড়ছিল সুশান্ত।
ওর গলার সুন্দর আন্তরিক শুদ্ধ উচ্চারণে সেই কথাগুলো আমার সমস্ত কানভরে ঝুমঝুম করে বাজতে লাগল।
কতক্ষণ পর জানি না, অনেকক্ষণ পর আমি বললাম, আসতে পারি?
আমার নিজের কাছেই নিজের গলাটা বড়ো চোর চোর শোনাল।
সুশান্ত লাফিয়ে উঠে পর্দার দিকে এগিয়ে এল, এসে পর্দা সরিয়ে বলল, আসুন, আসুন। ময়ূর কি ছিল না? এ কী? অন্ধকারে কতক্ষণ থেকে দাঁড়িয়েছিলেন?
অনেকক্ষণ।
সে কী! ডাকেননি কেন আমাকে?
লজ্জা? কীসের লজ্জা আপনার? আচ্ছা এসব কথা পরে হবে, এখন বসুন তো।
বসুন তো বলেই সুশান্ত খুব মুশকিলে পড়ল, কোথায় বসতে দেবে ভেবে না পেয়ে।
ঘরময় একটা শতরঞ্চি পাতা, তার ওপর অনেকগুলো ইংরাজি-বাংলা বই একসঙ্গে ছড়ানো। একটা তাকিয়া। ঘরের দেওয়ালজোড়া একটা বইয়ের আলমারি–ছোটো একটা ডিভান : তার ওপরও বই স্থূপীকৃত করা আছে।
কিছুক্ষণ বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকে সুশান্ত দৌড়ে গিয়ে কোথা থেকে যেন একটা চামড়ার মোড়া নিয়ে এল, বলল, বসুন তো, বসুন।
তারপর বলল, এ ঘরে তো খুব আপনজন ছাড়া কেউ আসে না, সবাই বাইরের ঘরেই বসে। আপনি যখন এসেই পড়েছেন, তখন বসবার একটা বন্দোবস্ত তো করা উচিত।
আমি বললাম, আমি তাহলে চলে যাই বাইরের ঘরে? আমি তো আপনজন নই আপনার।
সুশান্ত অনেকক্ষণ আমার দিকে চেয়ে রইল, কোনো কথা বলল না। তারপর নীচু গলায় বলল, বসুন বসুন, আমার কী সৌভাগ্য!
অনেকক্ষণ কেউই কোনো কথা বললাম না।
সুশান্ত মুখ নীচু করে বসেছিল।
একটা চাপা পায়জামা আর একটা হালকা বেগুনি পাঞ্জাবি পরেছিল সুশান্ত। চশমাটা নাকে একটু নেমে গিয়েছিল। ডান হাতে একটা খোলা বইয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ও বসেছিল। কিন্তু ওর মন ছিল অন্য কোথাও। ও কিছু ভাবছিল, যা সে বইয়ের কথা নয়।
পাখাটা গুন গুন করছিল।
সারাঘরে আর কোনো আওয়াজ ছিল না।
অনেকক্ষণ পর সুশান্ত মুখ তুলল, মুখ তুলে আমার দিকে ভালো করে তাকাল।
ওর চোখের বিস্ময়ের দৃষ্টিটা আস্তে আস্তে মুগ্ধতায় ভরে গেল, ও যেন নিজের মনেই বলল, বাঃ তোমাকে, সরি, আপনাকে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে তো আজকে, ঠিক যেন…
ঠিক যেন কী? আমি মুখ তুলে বললাম।
সুশান্ত মুখ নীচু করে বলল, ঠিক যেন করবীফুল। হলুদ করবী। বলেই থেমে গেল।
অনেকক্ষণ পরে বলল, তারপর? হঠাৎ এলেন যে? কী মনে করে?
আমি মুখ নীচু করে বললাম, ক্ষমা চাইতে।
সুশান্ত কোনো জবাব দিল না।
অনেকক্ষণ কোনো জবাব না পাওয়াতে আমি ওর দিকে তাকালাম ভয়ে ভয়ে, লজ্জায়; তাকিয়ে দেখি সুশান্ত হাসছে–এক অদ্ভুত হাসি। এক দারুণ ভালোবাসা, ক্ষমা ও কৌতুকমেশা হাসি ওর মুখময় ছড়িয়ে ছড়িয়ে গিয়ে ওর সমস্ত মুখকে এক দারুণ দীপ্তিতে দীপ্তিমান করেছে।
সুশান্ত বলল, ক্ষমা কীসের জন্যে?
আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি বলে।
আমার সঙ্গে তো করেননি, আপনার মেজাজ তখন খুব খারাপ ছিল বুঝতে পেরেছিলাম। আমি জানি, রাগটা আমার ওপর নয়, ওই ভদ্রলোকের ওপর হয়েছিল। আমি নেহাত উপলক্ষ্য।
তারপর বলল, ভদ্রলোক কী করেছিলেন? আপনাকে এমন রাগতে আমি তো কখনো দেখিনি।
ওকে ভদ্রলোক বলবেন না। কোনো ভদ্রলোক এরকম ব্যবহার করেন না। কী করেছিলেন তাও আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না।
জিজ্ঞেস করছি না। না বললেও অনুমান হয়তো করতে পারছি। ভদ্রলোককে আমি চিনি না, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তাঁর ওপর আপনি অবিচার করছেন।
আমার রাগ হল, ভীষণ রাগ হয়ে গেল।
বললাম, আপনি কিছুই জানেন না, তাই এরকম মহৎ হওয়ার ভান করছেন। কী করেছিলেন জানলে আপনি এত বড়ো বড়ো কথা বলতেন না।
ওঃ–বলে মুখ তুলল সুশান্ত।
বলল, আমি জানি না উনি কী করেছিলেন, জানতে চাইও না, তবে আমি বলছিলাম যে, কোনো লোকের একমুহূর্তের কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যবহারই কোনো লোককে সামগ্রিকভাবে বিচার করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। কারও ওপরেই অত সহজে বিশ্বাস হারাতে নেই। মানুষকে, যে কোনো মানুষকেই বাতিল করার আগে তাকে বিশ্বাস করা উচিত, তাকে বোঝানো উচিত; তাকে বোঝা উচিত। আমি অবশ্য সেই ভদ্রলোক সম্পর্কে কিছুই জানি না, তবে আমার সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল যে আপনি হয়তো ভদ্রলোককে ভুল বুঝেছিলেন।
আবারও আপনি ভদ্রলোক ভদ্রলোক করছেন!
কী করব? বেসিক্যালি আমরা প্রত্যেকেই যে ভদ্রলোক, কখনো-সখনো মাঝে-মধ্যে আমরা অভদ্র হয়ে উঠি, কিন্তু সেজন্যে আমাদের সমগ্র পরিচয়টা তো আর বদলে যায় না; যেতে পারে না। এই তো আপনি আমাকেও আপনার বাড়ি থেকে পত্রপাঠ বের করে দিলেন, আমি তো কারণ না বুঝতে চেয়ে, আপনি কী ও কীরকম লোক তা না জানতে চেয়ে, আপনার ওপর রাগ করে থাকতে পারতাম; কিন্তু সেটা কি চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়া হত না?
আমি অধৈর্য হয়ে বললাম, আপনি জানেন না তাই বলছেন। একজন ভদ্রমহিলাকে একলা পেয়ে, তার স্নেহের সুযোগ নিয়ে যে তাকে অপমান করতে পারে, তাকে ভদ্র বা ভালো বলা কী করে সম্ভব তা তো আমার বুদ্ধিতে কুলোয় না।
সুশান্ত এবার হেসে বইটাকে মুড়ে রাখল, বলল, আমাদের বুদ্ধিতে তো অনেক কিছুই কুলোয় না, আমার অথবা আপনার বুদ্ধিতে কুলোয় না বলেই যে সেটা বুদ্ধিগ্রাহ্য নয় এমন কথা তো নেই। উনি যাই করে থাকুন, আপনাকে অপমান করার জন্যে যে করেছেন তা আপনি বুঝলেন কী করে? আপনি কাজটা, কী কাজ আমি জানি না; খারাপ ভাবতে পারেন, কিন্তু কাজের উদ্দেশ্যটাও যে খারাপ তা জানলেন কী করে?
জানি। আমরা মেয়ে। আমাদের চোখে কিছুই এড়ায় না। আমাদের সহজাত বুদ্ধিতে পুরুষদের ব্যবহারের উদ্দেশ্য আমাদের চোখ এড়ায় না।
ভুল, ভুল; একেবারেই ভুল। বলল সুশান্ত।
তারপর হেসে বলল, পুরুষদের পক্ষ নিয়ে দেখছি আপনার সঙ্গে আমার রীতিমতো ক্রুসেডে নামতে হবে।
বলেই খুব হাসতে লাগল।
আমার আবার রাগ হয়ে গেল, বললাম, আপনি লোকটা মোটেই ভালো নয়, নইলে এরকম একজন লোকের ধামা ধরতেন না।
সুশান্ত আবার হাসল, বলল, ধামা তো ধরিনি। ছেলেটির চেহারা দেখে মনে হল ও একেবারে ছেলেমানুষ–ও কী করেছে আমি জানি না, তবে ওকে আপনি যেমন দাগি আসামি ভাবছেন, ওকে দেখে আমার তেমন মনে হল না। আমরা প্রত্যেকেই, প্রত্যেক মানুষই মানুষ; আমরা মেশিন নই। তাই আমাদের দু-একটা কৃত বা অকৃত কর্মকে ম্যাগনিফাইং গ্লাসের নীচে ফেলে অত বড়ো করে দেখলে আমাদের প্রত্যেকের প্রতিই অবিচার করা হয়। আমার বিশ্বাস, সব লোকই ভালো। ওই ছেলেটিও ভালো। কেন জানি না, আমার মন কেবলই বলছে যে ওকে আপনি যা ভেবেছেন ও তা নয়।
আমি বললাম, জানি না। হয়তো জানতে চাইও না। তারপর বললাম, ক-টা বেজেছে দেখুন তো আপনার ঘড়িতে? আমার ঘড়িটা তাড়াতাড়িতে ফেলে এসেছি।
সুশান্ত ঘড়ি দেখল, বলল, আটটা। বসুনই না আর একটু। এই তো এলেন। আমার সামনে মোড়ায় বসে আছেন, আমার সমস্ত ঘর দারুণ একটা মিষ্টি গন্ধে ভরে গেছে, আমার ভীষণ ভালো লাগছে। এই অগোছালো ব্যাচেলারের ঘর ছেড়ে আপনি একটু পরে আপনার সাজানো সুখের ঘরে ফিরে যাবেন, অথচ আমার এই ঘরও এক দারুণ সুখে ভরে যাবে। আপনার পারফিউমের গন্ধে তখনও ঘর ম ম করবে। আপনি চলে যাবার বহুক্ষণ পর পর্যন্ত আমি কল্পনা করব আপনি আমার সামনে বসে আছেন, মনে মনে আপনার সঙ্গে আরও কত ঝগড়া করব দেখবেন।
ভারি সুন্দর কথা বলেন তো আপনি। আপনার অনেক বান্ধবী আছে, না? তারা সকলেই কি আমার মতো হাঁ করে আপনার কথা শোনেন?
সকলের সঙ্গে সব কথা বলে সমান আনন্দ হয় না। বান্ধবী হয়তো আছেন, তবে আপনার মতো এমন বান্ধবী কেউ নেই। আপনি আপনিই। ভয় পাবেন না। কিছু চাইব না আপনার কাছে। কিছুই না। তা ছাড়া আজ দুপুরেই একজনের যা হেনস্তা দেখলাম চোখের সামনে, তাতে মনের কোণে যদি বা কিছু ভিক্ষা চাওয়ার সাধ জন্মেছিল তা উবে গেছে। বিশ্বাস করুন, আপনাকে শুধু আপনার জন্যেই আমার ভালো লাগে, বদলে আপনি আমার কিছু কোনোদিন দেবেন বা দিতে পারেন বলে নয়। কথাটা হয়তো বুঝিয়ে বলতে পারলাম না, কিন্তু কী করব বলুন, আমার কথার ধরনই এমনি। নিজেই ভালো বুঝি না নিজের কথা, আর আপনি যে বুঝবেন না এতে আশ্চর্য হবার কী আছে।
তারপর সুশান্ত বলল, যাক, বাজে কথা থাক, আপনি কী খাবেন বলুন?
আপনি কী রান্না করতে পারেন? খাওয়ানোর কথা যে বলছেন? আমি বললাম।
সুশান্তকে ভীষণ বিব্রত দেখাল, মুখটা লাল হয়ে উঠল, বলল, রান্না মানে, একেবারে পারি না তা নয়, পারি। মানে, এই ওমলেট, খিচুড়ি আর মাংস পারি; সত্যিই, কারও সাহায্য ছাড়াই পারি।
আমি হাসলাম। বললাম, তবে তো অনেক কিছুই পারেন। তাও কারও সাহায্য ছাড়াই যখন পারেন।
ও বলল, আমি একটা স্পেশাল শরবত বানাতে পারি এমন আপনি কোথাওই খাননি। দাঁড়ান বানিয়ে আনছি।
আপনি অত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? ময়ুরই তো এনে দিতে পারে।
ময়ূর পারবে না। আমিই আনছি। বলেই সুশান্ত চলে গেল।
আমি একা বসে সুশান্তর ঘরের চারিদিকে চোখ বোলালাম! বইয়ে বইয়ে ঘর ভরতি। বদলির চাকরি করে! এত বই কী করে যে সব জায়গায় বয়ে বেড়ায় ও-ই জানে। ঘরের এককোনায় একটা ছোটো ইজেল, মাঝে রং, তুলি, টার্পেনটাইন তেল, রং-মাখা ছেঁড়া ন্যাকড়া। ইজেলে কোনো কিছু আঁকার মহড়া চলেছে।
সব মিলিয়ে এই ঘরে বসে সুশান্তর মন সম্বন্ধে একটা ধারণা করা চলে। কোনো ঝাঁকড়া গাছের নীচে গরমের দিনে এসে বসলে যেমন লাগে তেমন একটা শান্ত ঠাণ্ডা ভাব ঘরটায়।
বই রমেনও পড়ে, বেশির ভাগ ক্রাইম থ্রিলার, মারামারি-কাটাকাটির বই, নয়তো অর্ধনগ্ন মেয়ের ছবিসর্বস্ব মলাটওয়ালা ওয়েস্টার্ন পেপারব্যাক। কিন্তু সুশান্ত নানারকম বই পড়ে। সাহিত্যের বই-ই বেশি।
সত্যি কথা বলছি, সুশান্তকে যতই পাশাপাশি দেখছি, আমার পক্ষে রমেনের মধ্যে ভালো লাগার মতো কোনোরকম গুণই খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ছে। অথচ আজ থেকে আড়াই বছর আগে এই লোকের মধ্যে আমি কত গুণ দেখেছিলাম। গুণ আর রূপে কোনোরকম খুঁতই চোখে পড়েনি। শনিবার-শনিবার ও আমাকে যখন বাইরে নিয়ে যেত, কোনো ইংরিজি বা হিন্দি ছবি দেখে এসে পার্কস্ট্রিটের কোনো রেস্তোরাঁতে যখন ও আমাকে নিয়ে খেতে ঢুকত, স্টুয়ার্ডকে ডেকে স্মার্ট ইংরিজিতে খাবারের অর্ডার দিত, অবহেলায়, ক্যাজুয়ালি, দামি সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট ধরাত ঘন ঘন এবং ওর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ইনডায়রেকটলি আমাকে এক দারুণ সুন্দর স্বপ্নলোকের আভাস দিত–আমার বেশ লাগত তখন।
তখন ও আমার বড়ো বাধ্য ছিল। এখন ও জ্ঞানে থাকলে বাধ্যতার ভান করে। সেদিন, মানে বিয়ের আগে আগে ওর এই বাধ্যতা-গুণটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু সেদিন আমি বুঝিনি যে বাধ্যতা-গুণই পুরুষমানুষের একমাত্র গুণ নয়; তাহলে যে কোনো ককার স্প্যানিয়েল কুকুরকে বিয়ে করেই আমার মতো মেয়েদের সুখী হওয়া উচিত ছিল! স্বামীদের মধ্যে আর কিছুই খোঁজার ছিল না।
মা যখন স্নেহের সঙ্গে বলতেন, তুই ভুলে যাস না নিরু, আমাদেরও তোর মতো বয়েস ছিল একদিন। আমরাও তোদের অনুভূতি, তোদের বয়েস সব পেরিয়ে এসেছি। তুই এত তাড়াতাড়ি মনস্থির করিস না। আজকে যে জানাকে শেষ বা পরম জানা বলে জানছিস, কাল দেখবি সেটাই মিথ্যা।
তখন আমার মনে আছে, আমি সদম্ভে মাকে বলতাম যে, আমি যা জানি, তা ঠিকই জানি। তোমরা যা জানতে তা ভুল। আমি, আমরা, আমাদের জেনারেশানের মেয়েরা, তোমাদের চেয়ে অনেক বেশি জানি ও ঠিক ঠিক জানি।
আসলে আমারই ভুল হয়েছিল। সেদিন যদি বলতাম যে, হয়তো আমি আজ যা জানছি তা ভুল, তবুও আমার ভুলের দায়িত্ব আমারই, ঠিকই করি বা ভুলই করি, তার সমস্ত কৃতিত্ব ও অসম্মান আমার একারই প্রাপ্য–সব আমার একারই সামলাবার। আমার ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে তোমরা কেন মাথা ঘামাও?
এ বললেও হয়তো ভালো করতাম।
সেদিন এটুকুও বলিনি মাকে। মাকে শুধুই বলেছিলাম যে তোমরা ব্যাক-ডেটেড ফসিল, তোমাদের সঙ্গে আমাদের মেলে না।
মায়ের ছবির দিকে এখন মাঝে মাঝে চেয়ে সেসব কথা ভাবি। একা একা চোখ দিয়ে জল পড়ে।
মা, আমার মাগো, তুমি ঠিকই বলতে মা, আমি তখন ছোটো ছিলাম, আমি আমার নিজের ভালো বুঝিনি, আজ তুমি নেই বলে তাই আমার বাঁচোয়া– তুমি আজ বেঁচে থাকলে তুমি সবই বুঝতে, সবই জানতে; আর কেউ নাই-ই বুঝুক, নাই-ই জানুক, কিন্তু তবুও আমি আমার দম্ভ ভেঙে, আমার সবজান্তার মুখোশ খুলে কখনোই তোমার কোলে মাথা রেখে কাঁদতে পারতাম না। তোমাকে হয়তো আরও দুঃখ দিতাম, আরও কষ্ট দিতাম, যা বলার নয় সেইসব অন্তঃসারশূন্য সর্বৈব মিথ্যা কথাগুলোপাকা অভিনেত্রীর মতো তোমার নিষ্কম্প চোখে চোখ রেখে বলে আসতাম–বলে এসে–নিজে হাউমাউ করে কাঁদতাম।
আমরা এই যুগের এই অসংখ্য অল্পবয়েসি মেয়েরা কী যেন এক অভিশাপ মাথায় করে জন্মেছি। ক্যাডবেরি, আইসক্রিম, সিনেমা, রেস্তোরাঁ, কার-রেসিং, ক্লাব, পার্টিতে আমরা যা খুঁজে বেড়াই বিয়ের আগে এবং হয়তো বিয়ের পরও, তা হয়তো আসলে আমরা কেউই চাই না। আসলে আমরা যা চাই তা আমার মায়েরা যা চাইতেন তার চেয়ে পৃথক কিছু নয়। চাই, সত্যিকারের ভালোবাসা।
ভান নয়, ভন্ডামি নয়, জুয়াচুরি নয়; নিছক অম্লান, দাবিহীন সত্যিকারের ভালোবাসা। একজন সৎ, সুপুরুষ স্বামী, একটি শান্ত ঠাণ্ডা থাকার জায়গা, এবং একগোছা চাবি। পৃথিবীতে কোনো সুখের আলমারি নেই যে আমাদের সেই চাবির থোকার কোনো-না-কোনো চাবিতে খোলে।
কতক্ষণ যে একা একা বসে এতসব ভাবছিলাম জানি না, এমন সময়ে সুশান্ত ফিরে এল। বলল, সরি, ভীষণ দেরি হয়ে গেল। সেনগুপ্ত সাহেবের বাড়ি যেতে হল তাই দেরি হয়ে গেল!
অবাক হলাম আমি, বললাম, কেন? সেনগুপ্ত সাহেবের বাড়ি কেন?
ওঁর বাড়িতে লেবুগাছ আছে।
লেবুগাছ? মানে বুঝলাম না আপনার কথার।
মানে লেবুপাতা আনতে গিয়েছিলাম। আমি যে শরবত বানালাম তাতে লেবুপাতা অবশ্যই লাগে।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে ওর হাত থেকে গ্লাসটা নিলাম। লালচে ও ঘন দেখতে কী এক অদ্ভুত তরল পদার্থ তার মধ্যে শোভা পাচ্ছে। চুমুক দেবার আগে শুধোলাম, বস্তুটি কী?
আগে খান একচুমুক, তারপর বলব; বলল সুশান্ত।
একচুমুক দিয়েই কিন্তু দারুণ লাগল খেতে। টক টক, মিষ্টি মিষ্টি; ঝাল ঝাল।
বললাম, কী দিয়ে বানালেন?
সুশান্ত খুব খুশি হল, আমার ভালো লেগেছে শুনে, তারপর শতরঞ্চিতে বসে পড়ে চোখ মুখ নাচিয়ে বাচ্চা ছেলের মতো বলল, বলব কেন? ট্রেড সিক্রেট।
বলুনই না। হেসে বললাম আমি।
সুশান্ত বলল, আগে বসুন, বলছি।
আমি বললাম, আপনি নীচে বসে আছেন, আর আমি মোড়ায়; মনে হচ্ছে আমি আপনাকে পড়াচ্ছি। খারাপ লাগছে আমার। নীচে বসি, কেমন?
সুশান্ত তাড়াতাড়ি করে বই সরিয়ে আমার জন্যে জায়গা করে ছিল, তারপর বলল, তেঁতুলের রস, শুকনোলঙ্কা-পোড়া, একটু নুন, একটু চিনি, আর লেবুপাতা এই-ই তো সব উপাদান। তবে উপাদানেই তো আর সব হয় না, হাতের গুণও চাই, খুব যত্ন করে ভালোবেসে বানাতে হবে। ফ্রিজে বরফ নেই, থাকলে দেখতেন এর ওপর কয়েকটা আইস কিউবস ফেলে দিলে কেমন লাগে।
আমি বললাম, সত্যিই ভারি ভালো খেতে।
সুশান্ত কী বলতে যাচ্ছিল, এমন সময়ে ময়ূর দৌড়ে এসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দাদাবাবুর খুব অসুখ, ট্যাক্সি করে বাড়িতে নিয়ে এসেছে, শিগগির চলুন।
দৌড়ে এসে দেখি, সেন আর মুখী রমেনকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে।
আমরা ঘরে ঢুকতেই হুড়হুড় করে অনেকখানি বমি করে ফেলল রমেন বিছানাতে। ওর কপালে গালে অনেকগুলো কালশিরার দাগ, জামাকাপড় ধুলোমাখা।
রমেন ঘোরের মধ্যে একটা অশ্লীল ইংরিজি গালি দিল।
মুখী ওর কাছে দাঁড়িয়েছিল, বললাম বমিটা পরিষ্কার করে ফেলতে।
সুশান্ত চলে গেল; একটু পরেই একটা লাইমজুস কর্ডিয়ালের বোতল নিয়ে ফিরে এল, বলল, জলের সঙ্গে মিশিয়ে খাইয়ে দিন ওঁকে।
সেন মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিল। ওকে শুধোলাম, কী হয়েছিল?
কোনো উত্তর দিল না।
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, কী হয়েছিল এর?
সেন একবার মুখ তুলে সুশান্তর দিকে তাকাল।
আমি বললাম, এসো, পাশের ঘরে এসো, ওঁর কাছে কিছু লুকোবার দরকার নেই; তুমি এসো।
আমরা এসে বসবার ঘরে বসলাম।
সেন বসল না, দাঁড়িয়েই রইল, মেঝের দিকে তাকিয়ে বলল, বিকেল থেকে রাম খাচ্ছিল রমেনদা, তখনই শরীর খারাপ হয়েছিল, কিন্তু কথা শুনল না, আমি বারণ করাতে আমাকে ঘুষি মারল–বলে হাত দিয়ে ওর কপাল দেখাল, দেখলাম ওর কপালেও কালশিরা পড়ে গেছে।
তারপর বলল, আমার কথা না শুনে আদিবাসী কুলিদের সঙ্গে ওদের বস্তিতে চলে গেল। ওখানে গিয়ে আবার মহুয়া খেল। খাওয়ার পর বুধিয়া বলে একটা রেজা কুলিকে রমেনদা অসম্মান করাতে বস্তির আদিবাসীরা রমেনদাকে ভীষণ মারতে লাগল। আমাকেও মার খেতে হল ওঁর সঙ্গে। ওরা বোধ হয় মারতে মারতে মেরেই ফেলত যদি না ভড় সাহেব খবর পেয়ে কারখানার দারোয়ানদের নিয়ে দৌড়ে না আসতেন।
ভড় সাহেব কে?
ভড় সাহেব আমাদের ওয়ার্কস ম্যানেজার। ওঁর স্ত্রী তো আজ সকালেই আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন ওঁর, মনে নেই বউদি? আপনার বান্ধবীর স্বামী।
বললাম, মনে আছে। শেফালির স্বামী।
সুশান্ত এতক্ষণ সোফার কোনায় মুখ নীচু করে বসেছিল। উঠে পড়ে ও আমাদের শোবার ঘরে রমেনের কাছে গেল। গিয়ে কী করল জানি না। মুখী ঘরেই ছিল।
সেন তখনও দাঁড়িয়েছিল। বললাম, বোসো, দাঁড়িয়ে রইলে কেন?
আমি চুপ করে বসে রইলাম। শোবার ঘরে আহত মত্ত স্বামী, বাইরের ঘরে আমি, আজ দুপুরেই যে আমাকে অপমান করেছে তার সঙ্গে বসে আমার স্বামীর সম্মানের উপাখ্যান শুনছি তারই মুখে। শুনছিই শুধু; আমার করার তো কিছুই নেই।
অনেকক্ষণ পর হঠাৎ সেন নিজের থেকেই বলল, নীচু গলায়, বউদি আমাকে ক্ষমা করেছেন তো?
আমি মুখ তুলে তাকালাম। দেখলাম সেন তক্ষুনি মুখ নামিয়ে নিল।
সেন আবার বলল, বউদি এখন আপনার মনের অবস্থা কীরকম অনুমান করতে পারছি, এখন ওসব প্রসঙ্গ আলোচনা করব না। পরে সময়মতো কখনো আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে
তারপরেই হঠাৎ বলে উঠল, আমি ভীষণ কুৎসিত না বউদি? যেমন চেহারা, তেমন স্বভাব। তাই না?
আমি কোনো জবাব দিলাম না। সেনকে বললাম, রমেন হঠাৎ এই গরমে রাম খেতে আরম্ভ করল কেন? তুমিও কি খাচ্ছিলে নাকি?
আজ যে কারখানার লেবারারদের সবাইকে সন্ধের সময়ে রাম খাওয়ানো হয়েছে। সন্ধে পর নাচও হয়েছিল। রেজা কুলিরা সকলে নাচ-গান করল।
ওঃ। বললাম, আমি। তারপর শুধোলাম, তুমি খাওনি সেন?
সেন বলল, আমি তো ওসব খাই না বউদি।
কথাটা বিশ্বাস হল না আমার, বললাম, সেকী? ভারি আশ্চর্যের কথা তো? একা থাকো, কারখানায় কাজ করো, এত স্বাধীনতা, এত রোজগার; আর ড্রিঙ্ক করো না? আজকাল এসব কথা ভাবলেও অবাক লাগে যে!
সেন অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল।
আমার কথায় যে বিদ্রূপ ও শ্লেষের ঝাঁঝ ছিল, তা বোধহয় হজম করছিল ও, হজম করতে সময় লাগল, তারপর সেন একসময়ে মুখ তুলে বলল, করি না বউদি। সত্যিই করি না, কারণ এর মধ্যে বাহাদুরি করার মতো কিছু আছে বলে মনে হয় না আমার। তা ছাড়া আমার মাইনেতে কলকাতায় আমাদের সংসার চলে। আমার বিধবা মা ও আমার ছোটো দু-ভাইবোন আমার মুখ চেয়ে সারামাস বসে থাকেন। যা রোজগার করি তার চেয়ে বেশি রোজগার করলে, নিজের খুশিমতো খরচ করার মতো পয়সা থাকলে কী করতাম জানি না, তবে এখন এসব করতে গেলে চুরি করতে হয়। চুরি করতে পারি না বলেই, হয়তো পারি না।
সেনের গলার স্বরে কোনরকম ঔদ্ধত্য বা বাহাদুরি ছিল না, বরং বিনয় ছিল।
ওর কথা শেষ হতেই ওর দিকে তাকালাম। স্ট্যাণ্ড-লাইট ছাড়াও ওপরের বড়ো বাতিটাও জ্বলছিল, দেখলাম সেনের কালো কুৎসিত মুখটার মধ্যে ওর চোখ দুটো অত্যন্ত উজ্জ্বল এবং সরল। কেন জানি না সেই মুহূর্তে আমার মনে হল, হয়তো সুশান্ত একটু আগে যা বলছিল, তা ঠিক।
সেন বলল, বউদি, রমেনদা এরকম করলে কিন্তু রমেনদার চাকরি বেশিদিন থাকবে না। এ বাজারে চাকরি গেলে নতুন চাকরি পাওয়া কিন্তু সত্যিই মুশকিল। তা ছাড়া জানেনই তো, আমাদের মতো মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়র এখন ছড়াছড়ি যাচ্ছে দেশে। আপনি রমেনদাকে একটু বুঝিয়ে বলবেন।
আমি বললাম, ব্যাপারটা আমার নয়, আর যাকে বলব সে-ও শিশু নয়, তাই এসব কথা আমাকে বোলো না।
একটু পরে সেন আবার বলল, আমি কি রাতে থাকব? আমার কি দরকার হবে?
না। না। কোনো দরকার নেই। কীসের দরকার?
আমার বলার ধরনে সেন লজ্জা পেল, আমিও ওরকমভাবে কথাটা বলে ফেলে লজ্জিত হলাম।
আজ দুপুরের ঘটনাটা মন থেকে চট করে মুছে ফেলা সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে।
সুশান্ত যে ওঘরে এতক্ষণ ধরে কী করছে, ও-ই জানে।
সেন উঠে পড়ল হঠাৎ, বলল, রমেনদাকে বলে আসি।
ওঘর থেকে ফিরে এসে সেন বলল, চলি, রমেনদা ঘুমোচ্ছেন; কাল সকালে এসে খোঁজ নিয়ে যাব।
সিঁড়ির কাছে এসে মুখ ঘুরিয়ে ও আবার বলল, চলি বউদি!
আমি বললাম, দাঁড়াও–বলে আরও কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম, তুমি দুপুরে ওরকম করলে কেন?
সেন লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে গেল।
ঘরের মধ্যেও এতক্ষণ যে বসেছিল আলোয়, তাতেই মনে হচ্ছিল এত আলোয় বসে থাকতে বুঝি ওর খুব অসুবিধা হচ্ছে, ও যেন কোনো অন্ধকার কোণের আশ্রয় খুঁজছে। এখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ও যেন একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে গেল। তারপর আস্তে আস্তে মুখ নীচু করে বলল, আমি জানি না বউদি। তখন থেকে আমিও কেবলই সে কথাই ভাবছি; কেন এমন করলাম? সত্যিই জানি না।
শোনো! আমি ডাকলাম ওকে।
ও আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল।
বললাম, তুমি আর কোনোদিন আমাদের বাড়ি এসো না; কোনোদিনও না।
বলেই সম্পূর্ণ বিনা কারণে শব্দ করে দরজাটাকে ওর মুখের ওপর বন্ধ করে দিলাম।
সেনের মোটরসাইকেল ছিল না; ও রমেনকে নিয়ে ট্যাক্সি করে এসেছিল। ও নিশ্চয়ই হেঁটে হেঁটে কালীবাড়ির ট্যাক্সি-স্ট্যাণ্ডের দিকে যাচ্ছিল। আমি জানি ও মাটির সঙ্গে মিশে কোনো পোকার মতো হীনমন্য পদক্ষেপে হেঁটে যাচ্ছিল, ওকে আমি যদি শংকর মাছের চাবুক দিয়ে চাবকাতাম তবেও বোধহয় ও এত আঘাত পেত না।
কিন্তু আমার কিছু করার নেই। অন্তত এই মুহূর্তে আমার মনে হল যে আমার কিছুই করার নেই ওর জন্যে।
ওঘরে গিয়ে দেখি, সুশান্ত মুখীকে দিয়ে বিছানার চাদর বদলেছে ও ওডিকোলোনের পটি লাগিয়েছে রমেনের মাথায়, বড়ো আলোটা নিভিয়ে দিয়ে ছোটো টেবল-ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিয়েছে। সুশান্ত রমেনের মাথার কাছে বসে ওর গায়ে হাত বুলোচ্ছে; রমেন ঘুমিয়ে পড়েছে।
আমি গিয়ে রমেনের পাশে দাঁড়ালাম। সুশান্ত উঠে দাঁড়াল, তারপর বসে পড়ে বলল, আমি এখানে বসছি; আপনি খেয়ে আসুন।
আমার খেতে ইচ্ছা করছে না। আমি বললাম।
সুশান্ত দৃঢ় গলায় বলল, ইচ্ছে না করলেও, অনেক কিছু করতে হয়। যান, খেয়ে আসুন।
সুশান্তর গলার স্বর শুনে আমার অবাক লাগল, ও যেন আমাকে আদেশ করছে। আমার ও কে যে ও আমাকে আদেশ করে?
আমি বললাম, আমি খাব না।
আপনি খাবেন। যান বলছি, খেয়ে নিন। জোর দিয়ে বলল সুশান্ত।
তারপর বলল, আপনি বড়ো জেদি। এই জেদের জন্যে জীবনে আপনি অনেক কষ্ট পাবেন। মেয়েদের এত জেদ ভালো নয়।
আমার রাগ হয়ে গেল। বললাম, আপনি পিসিমার মতো কথা বলবেন না তো। আমি কষ্ট পাচ্ছি, কি পাব, তা আমার ব্যাপার। আপনার মাথা ঘামাতে হবে না। আপনি বাড়ি যান।
সুশান্ত আমার মুখের দিকে চাইল, তারপর বলল, বেশ। আমি যাচ্ছি। রাতে কোনোরকম দরকার হলে আমাকে ডাকবেন।
মুখ ফিরিয়ে আমি বললাম, ডাকব; যদি দরকার হয়। হয়তো দরকার হবে না।
আমার দিকে বিস্ময়ের চোখে তাকাল সুশান্ত, তারপর বলল, চলি, নমস্কার।
আমার অবাক লাগল। ও কোনোদিনও আমার সঙ্গে এমন ফর্মালিটি করেনি। আমার ধারণা ছিল এসব সামাজিক ফর্মালিটি ওর আসে না। জানি না, কেন আজ ও হঠাৎ এমন ফর্মাল হয়ে উঠল।
আমি আর উঠে ওঘর অবধি গেলাম না।
মুখী গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
মুখীকে বললাম, খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়তে।
তারপর একটা বই নিয়ে এসে ইজিচেয়ারে শুলাম। কেন জানি না, রমেনের পাশে শুতে আমার ঘেন্না করছিল। আমার প্রেমিক, আমার আদরের রমেন, আমার অবলম্বন, আমার ভবিষ্যৎ, আমার সোনা, আমার সর্বস্ব; আমার স্বামীর পাশে শুতে আমার ঘেন্না করছিল।
মাঝরাতে হঠাৎ কতকগুলো কুকুরের চিৎকার শুনে আমার ঘুম ভেঙে গেল।
ইজিচেয়ারে শুয়ে থাকায় কাঁধে একটা ব্যথা হয়েছিল। উঠে একবার রমেনের কাছে গেলাম।
ও তেমনি ঘুমোচ্ছে। Sleeping it off–খোঁচা খোঁচা দাড়ি; নাকের ফুটো থেকে কয়েকটা লোম বেরিয়ে আছে, দেখলে আমার ঘেন্না লাগে, চোখে-মুখে মারের দাগ, মুখে এখনও ভক ভক করছে গন্ধ, চুলগুলো লেপটে আছে কপালে। আমার বয়ফ্রেণ্ড, আমার ইহকাল পরকালের ভরসা, আমার সম্মান ও প্রেমের পাত্র, আমার প্রিয় রমেন, মাতাল হয়ে শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে আছে।
জানালার কাছে সরে গেলাম।
ইউক্যালিপটাস গাছের পাতায় পাতায় জ্যোৎস্না ঠিকরে যাচ্ছে। টিসকোর কারখানার ব্লোয়িং হচ্ছে; আকাশের চাঁদের রুপোকে ম্লান করে তার রক্তিমাভা থই থই করছে। কী একটা রাতচরা পাখি ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল জানালার পাশ দিয়ে।
চারিদিক নিস্তব্ধ। প্রত্যেক বাংলোয় প্রত্যেকে শান্তির ঘুম ঘুমোচ্ছে। আমি একা মাঝরাতের জানালায় দাঁড়িয়ে ভাবছি আমি কী করব। বাবার শরীরটা ভালো না; বাবাকে বড়ো দেখতে ইচ্ছে করছে।
এতক্ষণ আমি একটা দারুণ মিষ্টি স্বপ্ন দেখছিলাম। ভাবছিলাম জীবনে সব কিছু করারই একটা রকম আছে, রুচি আছে। এই রুচিভেদই একজন মানুষের সঙ্গে অন্য একজন মানুষের পৃথকীকরণের উপায়।
স্বপ্ন দেখছিলাম আমার স্বামী কারখানা থেকে ফিরল রাত করে! আমি বসবার ঘরে বসে উল বুনছিলাম। আমরা ঠিক করেছি, আগামী মাসে আমি কনসিভ করব। স্বামীর বিশেষ ইচ্ছা ছিল না, ও বলেছিল, চাকরিতে আর একটু উন্নতি হোক, একটা গাড়ি কিনি; তারপর।
আমিই বলেছিলাম যে না, তা নয়। সময়মতো ছেলে-মেয়ে না হলে তাদের মানুষ করা মুশকিল। ও রাজি হয়েছিল। তাই এখন থেকে আমি আগন্তুকের জন্যে তৈরি হচ্ছি। আমার ইচ্ছা দারুণ একটা দুরন্ত ছেলে হবে, ঘরময় হুটোপাটি করে বেড়াবে, এটা ভাঙবে, ওটা ভাঙবে, চেঁচামেচি করবে; ওর মতো লম্বা-চওড়া হ্যাণ্ডসাম হবে।
ছেলেরা বেশি ফর্সা হলে ভালো লাগে না, গায়ের রং ওর মতো হবে; মুখটা যেন আমার মতো হয়।
ও এসে জামাকাপড় খুলেই সোজা বাথরুমে গেল। ওর পায়জামা-পাঞ্জাবি দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। পায়জামা-পাঞ্জাবি নিয়ে বাথরুমের দরজায় টোকা দিতেই, দরজা খুলেই সাবান মাখা মুখে ও আমায় আদর করে দিল।
অসভ্য কোথাকার! বলে, আমি এগুলো এগিয়ে দিয়ে পালিয়ে এলাম।
চান-টান করে ও এসে বসবার ঘরে বসল।
পায়জামা-পাঞ্জাবি পরলে ওকে খুব ভালো দেখি আমি। ও বলল, বুঝলে নিরু, আজ একটা ভালো খবর আছে।
কী খবর? বললাম আমি, উলের কাঁটা থেকে চোখ না তুলে।
চোখ তোলো, না হলে বলব না।
বলো না বাবা, বলে আমি তাকালাম ওর দিকে।
তোমার শোওয়ার ঘরে এয়ার-কণ্ডিশনার লাগছে পরের সপ্তাহে।
আমার ভীষণ আনন্দ হল, কিন্তু মুখে তা প্রকাশ না করে বললাম, বাজে কথা বোলো না।
বাজে কথা নয় ম্যাডাম। আজকে এম ডি ডেকেছিলেন, বললেন, আমার কাজে উনি খুবই সন্তুষ্ট। এই গরমে মিসেস ঘোষের খুবই অসুবিধা হয় নিশ্চয়ই, তা ছাড়া আমি চাই যে আমাদের কোম্পানির সকলে ভালোভাবে থাকুন। তাই আমি বলে দিয়েছি, মেনটেনেন্স ডিপার্টমেন্টকে যে, পরের সপ্তাহে আপনার বেডরুমে একটা এয়ার-কণ্ডিশনার লাগিয়ে দিয়ে আসবে।
সত্যি! আমি বললাম।
সত্যি ম্যাডাম, সত্যি। আমাদের কোম্পানিটা খুব ভালো। এম ডি-র মতো তো লোক হয় না। আমাদের কোম্পানির প্রতিটি লেবারার খুশি। ইউনিয়ন-ফিউনিয়নের বালাই নেই–ছ মাসের বোনাস পায় প্রত্যেকে, তা ছাড়া কারও কোনো অসুবিধায় নেই।
বা:! খুব ভালো।
খুশি তো, তুমি?
আমি হেসে বললাম, খু-উব। তারপর বললাম, তুমি দেখো, তোমার আরও উন্নতি হবে। তুমি কত ভালো তা তুমি জানো না। তা ছাড়া তোমার জন্যে আমি যে সবসময়ে কত বলি!
কাকে এল? আমার স্বামী দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল।
যাকে বলার, সেই একজনকে। তুমি তো বিশ্বাস করো না; আমি করি। তুমি বড়ো হও গো জীবনে; শুধু টাকায় নয়, সবদিক দিয়ে, তোমার জন্যে যেন আমি গর্বিত হতে পারি। আমার বাড়ির আত্মীয়-স্বজন একদিন কত কী বলেছিল, আমি ঠকেছি, বলেছিল নিজের পায়ে আমি নিজে কুড়ল মারছি। আমি একদিন দেখিয়ে দেব যে আমি যা করেছিলাম, তা ঠিক; তোমরা ভুল। তোমাকে অনেক বড়ো হতে হবে। হবেও তুমি; তুমি দেখো। একদিন লোকে বলবে, এরকম ব্রিলিয়ান্ট ইঞ্জিনিয়র দেশে নেই, এরকম ভালো লোক হয় না; এরকম সৎ লোক হয় না।
ও হাসল, বলল, তুমি কিন্তু যতখানি আছ, তার চেয়ে বেশি ভালো বা বেশি সুন্দর হোয়ো না।
আমি হাসলাম, বললাম, কেন?
বাঃ তাহলে তোমাকে হারাবার ভয় থাকবে সব সময়ে। এমনিতেই তোমাকে আমার এ ঘরে মানায় না। আমার জীবনে তুমি হলে সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি। যা হয়েছে এবং যা হবে সবই তো তোমার জন্যে, তোমার শুভকামনায়, এল, কী চাকরি করতাম কলকাতায়, আর এখন কী করছি।
জানো, আমার বিশ্বাস, ভালো করলে ভালো হয়। কখনো ফাঁকি দিয়ো না, কাজে ফাঁকি দিয়ো না, অন্যকেও না, দেখবে, ভালো একদিন হবেই। সফলতা বা বিফলতা; সব ব্যাপারেই তার পেছনে কারণ থাকেই।
ও হাসল, বলল, মেয়েদের পড়িয়ে পড়িয়ে তোমার একেবারে দিদিমণি দিদিমণি ভাব হয়ে গেছে। এমন চোখ বড়ো বড়ো করে এল না?
আমি হেসে বললাম, ইয়ার্কি কোরো না।
একটু পরে ও বলল, আজ বড়ো খাটুনি গেছে। গরমটাও কমবে না। জুন মাসের মাঝামাঝি, অথচ বৃষ্টির দেখা নেই।
সত্যি, তা ছাড়া তোমাদের কারখানায় যা গরম, শরীরের রক্ত শুষে নেয়। একটা বিয়ার খাও না। সেদিন দাশগুপ্ত সাহেব বলেছিলেন যে কারখানা থেকে আসার পর গরমের দিনে একটা করে বিয়ার খাওয়া খুব ভালো।
তা ভালো, কিন্তু রোজ বিয়ার খেতে গেলে কত টাকা লাগে? এখনও অত সব অ্যাফোর্ড করতে পারি না। তা ছাড়া তুমি আবার গুণ্ডা ছেলের মা হবে-টাকা-পয়সা জমাতে হবে তো?
আহা? অসভ্য! মাঝে মাঝে খেয়ো। রোজ খেতে হবে না। তা ছাড়া আমি কি রোজগার করি না? আমিই তোমাকে খাওয়াব। বলে, মুখীকে দিয়ে তার বরের হাতে চিঠি দিয়ে টাকা দিয়ে পাঠালাম। সে সাইকেল নিয়ে গিয়ে ওর জন্যে কোল্ড-বিয়ার নিয়ে এল।
আমার সামনে বসে, গল্প করতে করতে বিয়ার শেষ করে উঠল ও।
খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা শুতে গেলাম।
ওর ভীষণ শখ, আমি যেন নাইটি পরে শুই। আমার ভালো লাগে না। কেন, জানি না। বিয়ের আগে তো কখনো পরিনি। আসার আগে নিউমার্কেট থেকে একটা নাইলনের নাইটি কিনে নিয়ে এসেছিল ও। ও বলে নাইটির ওপর দিয়ে আমার গা ছুঁতে ওর নাকি দারুণ লাগে, ওর নাকি মনে হয় ও অ্যারাবিয়ান নাইটসের যুগ চলে গেছে।
ও ইঞ্জিনিয়র হলে কী হয়, ও খুব রোমান্টিক। ও জানে মেয়েদের কী করে ভালোবাসতে হয়, কী করে আদর করতে হয়। ওর চরিত্রে কোথাও কোনো স্থূলতা নেই। আমার সঙ্গে ওর ব্যবহার আমার কাছে আলি আকবরের বাজনার মতো মনে হয়। ওর সবল হাতে মাথা রেখে শুয়ে থাকতে আমার দারুণ ভালো লাগে। জানতে ভালো লাগে যে, আমি কত বুদ্ধিমতী, নিজের মতানুযায়ী আমি কী দারুণ একজনকে বিয়ে করেছি; জীবনের সঙ্গী নির্বাচনে আমার ভুল হয়নি কোন। ওর ব্যবহারে, ওর চেহারায়, ওর বিনয়ে, আমাদের পরিবারের সকলে মুগ্ধ। ওর একমাত্র খুঁত ছিল এই যে, ওর প্রথম স্ত্রী ওকে ডিভোর্স করেছে। ওকে দেখে আমার এই বিশ্বাস জন্মেছে যে, সে নিশ্চয়ই কোনো হতভাগিনী। যে-মেয়ে এমন ছেলের সঙ্গে ঘর করতে না পারে, সে কারও ঘর করারই যোগ্য নয়।
.
০৫.
কতক্ষণ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। ভোর হয়ে এল। মালহোত্রা সাহেবের বাড়ির মুরগিগুলো ডাকতে আরম্ভ করল। গুপ্ত সাহেবের বাড়ির গোয়ালা চোঁয়াক চোঁয়াক আওয়াজ করে গোরু দুইতে আরম্ভ করল।
আমি রমেনের কাছে এলাম।
ডান পা-টা বুকের কাছে গুটিয়ে শুয়ে আছে রমেন।
পায়জামাটা হাঁটুর অনেকখানি ওপরে উঠে গেছে। অসভ্যর মতো দেখাচ্ছে।
ওর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম যে, আমি অনেকদিন ভাবার ও বোঝার চেষ্টা করেছি ও কেন এমন করে।
অনেক সময়ে অনেক পুরুষমানুষ এমন করে যাদের কোনো গভীর দুঃখ আছে, যে দুঃখকে তারা ভোলার জন্যে এমন করে নিজেদের নষ্ট করে। কারও বা কোনো অভিযোগ থাকে জীবন সম্বন্ধে যে অভিযোগের কোনো প্রতিকার নেই। সমস্ত দিক থেকে আমি রমেনকে বোঝাবার চেষ্টা করেছি, যাতে ওকে খারাপ ভাবার আগে ওর প্রতি আমি যথেষ্ট সুবিচার করি। আমার কাছে এর কোনো ব্যাখ্যা নেই।
মনে হয় যারা দাগি চোর, তারা বোধহয় কিছুদিন বাদে কোনো কারণ ছাড়াই চুরি করে, চুরি করার আনন্দেই চুরি করে, খুনি যেমন রক্তের নেশায় খুন করে, রমেনও বোধহয় তেমনি কোনো অজ্ঞাত কারণেই এরকম করে।
বিয়ের আগে ও আমার কাছে যে-রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল, যেসব ভূরি ভূরি মিথ্যাকথা বলে আমাকে ভুলিয়েছিল, তা বোধহয় শুধুই আমার শরীর এবং আমার পরিবারের সঙ্গে জড়িত হয়ে নিজের নামগোত্রহীন পরিচয়কে উন্নত করার জন্যে।
জানি না। জেনে এখন লাভও নেই কোনো। ভগবানকে সাক্ষী রেখে বলতে পারি যে, আমার দিক থেকে কোনোরকম ত্রুটি হয়নি। আমার কোনো দোষ নেই ওর খারাপ হবার জন্যে। ও কেন যে এমন ঠগির মতো ব্যবহার করল আমার সঙ্গে তা ও-ই জানে।
আমার লজ্জা নানা কারণে। এই লোকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্যে ধার করে, কত কষ্ট স্বীকার করে বাবা ও দাদা-দিদিরা আমার জাঁকজমক করে বিয়ে দিয়েছিলেন। এ তো শুধু আমার একার সর্বনাশ নয়; আমার জেদের জন্যে কতজন নিরপরাধ লোকের কত ক্ষতি। এই লজ্জা আমার রাখার জায়গা নেই। এ অপমান আমার একারই সইতে হবে।
যে আশ্রয় ত্যাগ করে, নিজে মাথা উঁচু করে একদিন রমেনের হাত ধরে সানাইয়ের সুরের মধ্যে, ফুলের গন্ধের মধ্যে, অগণিত বন্ধুবান্ধব ও দাদা-দিদিদের অশ্রুসিক্ত চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম, সেই আশ্রয়ে ফিরে গিয়ে মাথা নীচু করে আমি কোনোদিনও বলতে পারব না যে, আমারই ভুল হয়েছিল। তোমরাই ঠিক।
মাঝে মাঝেই আমার বিয়ের দিনটার কথা মনে পড়ে। আমার জীবনে এত সুন্দর, এত বড়ো, অথচ এতখানি ব্যর্থ আর কোনো উৎসব আর কোনোদিনও উদযাপিত হবে না।
মনে মনে আমি আজকাল বাবার মৃত্যুকামনা করি। বাবা বেঁচে থাকতে যেন বাবা কোনোদিনও জানতে না পান যে তাঁর সবচেয়ে আদরের মেয়ের আজ এই অবস্থা।
রমেন চোখ খুলল।
বললাম, কেমন আছ?
রমেন হাসল। অনুশোচনার হাসি নয়। বাহাদুরির হাসিও নয়। জেমস বণ্ডের ছবির ভিলেনরা যেমন হাসে তেমন হাসি। এ হাসির কোনো মানে হয় না।
ও বলল, মুখী কোথায়? চা দিতে এল।
মুখীকে চা করতে বললাম। আজ আমার স্কুল আছে, চা খেয়ে চান করতে যাব।
তারপর ঘরে এসে বললাম, চান করবে না? কারখানায় যাবে না আজ?
তোমার এত মাথাব্যথা কীসের? আমাকে তো তাড়ালেই তুমি খুশি হও।
মানে?
কোনো মানে নেই।
বললাম, সেন বলছিল, তোমাদের ওয়ার্কস ম্যানেজার না গিয়ে পড়লে নাকি তোমাকে মেরেই ফেলত।
মেরে ফেলা কি এতই সহজ? আমি হচ্ছি অক্ষয়; অমর। তবে তোমার বান্ধবীর বরই সময়মতো বাঁচিয়ে দিয়েছে। সেকথা সত্যি।
আমার হঠাৎ শেফালির মুখটা মনে পড়ে গেল। শেফালির বর বাড়ি ফিরে নিশ্চয়ই শেফালিকে সব কথা বলেছে।
আমি মুখ নীচু করে রইলাম। তারপর বললাম, এরকম করলে চাকরিটা কি থাকবে?
না থাকলে, থাকবে না। আমার কোয়ালিফিকেশান আছে, আমার মতো স্মার্ট সেলসম্যান পাবে ওরা? চাকরি গেলে আবার অন্য চাকরি নেব। আমাকে তো তুমি মনে করো যে আমি একটা কিছুই না। আমার এলেম আর বুঝল কে?
বললাম, আর কেউ না বুঝুক, আমি অন্তত বুঝেছি।
রমেন আমার দিকে আগুনের চোখে তাকাল। তারপর বলল, কাল পাড়ার লোক জড়ো করেছিলে কেন? ওই সুশান্ত বোসকে সব ব্যাপারে ডাকার দরকার কী? আমি মার খেয়েছি, কি নেশা করেছি সেটা আমার-তোমার ঘরোয়া ব্যাপার–তাতে বাইরের লোককে ডাকার দরকার ছিল কি কোনো?
ব্যাপারটা আর ঘরোয়া রইল কোথায়? বললাম আমি।
রাখা উচিত ছিল।
সেটা যাতে থাকে, তা ভবিষ্যতে তুমি মনে রেখো। এরকম ব্যাপার যাতে না ঘটে, তা দেখো।
আর কথা না বলে আমি চান করতে গেলাম।
মুখীকে বললাম, আমি খাব না, দাদাবাবু খাবেন কি না জিজ্ঞেস করে রান্না করিস। কারখানায় না গেলে হয়তো খাবেন।
আমার কোথাও যাবার ছিল না, স্কুলের তখন অনেক দেরি, তবু সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ সকালের পথে একা একা হাঁটা দরকার। রাতে ঘুম হয়নি, মাথাটা বড়ো ধরে আছে। কাল সারাদিন খাইনি।
বাড়ি ছেড়ে এগিয়েছি, পথে ডাকপিয়োনের সঙ্গে দেখা। বলল, চিঠি আছে, চিঠিটা রমেনের নামে। হাতের লেখাটা চেনা লাগাতে নিয়ে নিলাম। দেখলাম মেজোকাকার লেখা চিঠি।
মেজোকাকা হঠাৎ রমেনকে কেন চিঠি লিখতে গেলেন ভেবে পেলাম না। চিঠিটা হাঁটতে হাঁটতে খুললাম। ভীষণ কৌতূহল হল।
ভবানীপুর কলিকাতা
১০.৬.৭২
কল্যাণীয় বাবা রমেন,
আশা করি তোমরা দুজনে ভালো আছ। জামশেদপুরে আসার সময়ে তুমি ব্যাবসা করবে বলে যে আড়াই হাজার টাকা ধার হিসেবে নিয়েছিলে তা আজও শোধ দাওনি। তুমি বলেছিলে যে তোমার চাকরির রোজগারের ওপর আরও কিছু রোজগার হলে নিরু খুশি হবে। নিরু আমাদের সকলেরই স্নেহের পাত্রী। তার সুখের জন্যে তোমাকে ওই টাকা তখন জোগাড় করে দিই। কথা ছিল, তুমি তিন মাসের পরই মাসে মাসে পাঁচশো করে দিয়ে টাকাটা শোধ দিয়ে দেবে। কোনোরকম সুদ দিতে হবে না, তাও তোমাকে বলেছিলাম।
আজ দেড়বছর হয়ে গেল, এপর্যন্ত তুমি টাকাটা পাঠালে না, এবং আমাকে এ সম্বন্ধে কিছু জানালেও না। তোমার সঙ্গে আমার যা সম্পর্ক, তাতে টাকার তাগাদা করে চিঠি লেখা আমার পক্ষে অত্যন্ত লজ্জার। কিন্তু আমার ছোটোমেয়ে মণির বিয়ে প্রায় ঠিক হয়ে গেছে। টাকাটা আমার অত্যন্ত দরকার। বুঝতেই পারছ, খুব দরকার না থাকলে এ চিঠি তোমাকে আমি লিখতাম না।
সেরকম অবস্থা থাকলে টাকাটা তোমাকে এমনিই দিয়ে দিতে পারলেই আমি সুখী হতাম, কিন্তু সেরকম অবস্থা আমার নয়; তা তুমি জানো।
এ চিঠি অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে লিখছি। যদি আমার নিরু মা একথা জানে, তবে সে বড় লজ্জা পাবে। আমি তাকে ভালো করেই জানি–তার মতো আত্মসম্মানজ্ঞানী মেয়ে বড়ো একটা দেখিনি। আমার অনুরোধ, অন্তত তার সম্মানার্থে এ টাকাটা তুমি পাঠাবার চেষ্টা করবে জুলাই মাসের মধ্যে। ইতি
আশীর্বাদক
হরিচরণ চৌধুরি
শ্রীরমেন ঘোষ, কল্যাণীয়েষু,
কদমা, জামশেদপুর
আমার ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করল।
মনে হল পা বুঝি আর চলবে না।
কী করব ভেবে পেলাম না। স্কুলে যাওয়া আমার হল না। এ অবস্থায়, এমন মন নিয়ে কিছু করা চলে না। মেয়েদের পড়ানোর মতো মনের অবস্থা আমার নেই। এখনও স্কুল খোলেনি, খুললে কোথাও থেকে ফোন করে দেব মিসেস প্রধানকে, আজ ক্যাজুয়াল লিভ নেব।
মনস্থ করলাম বাড়িই যাব। কোনোদিন রমেনের সঙ্গে ঝগড়া বলতে যা বোঝায় তা করিনি আমি, আমার খুব গলা ছেড়ে আজ ঝগড়া করতে ইচ্ছে হল। একদিন আমার মনে হত যে যতটুকু কষ্ট বা অপমান তা আমার একারই; আমার জন্যে যে আমার পরিবারের অন্য কেউ এমনভাবে জড়িয়ে পড়বে তা ভাবতে পারিনি।
মেজোকাকার অবস্থা কী আমি জানি। তাঁর একমাত্র অপরাধ যে উনি আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন। সেকথা রমেন জানত। রমেন যদি মেজোকাকার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে আসতে পারে, তাহলে হয়তো অন্য অনেকের কাছ থেকেই নিয়েছে। যা আমি গোপন করে রাখতে চাইছিলাম এতদিন, আমার সম্মানের জন্যে, তা বুঝি অনেক আগেই সকলের কাছে ফাঁস হয়ে গেছে। সকলে জেনে গেছে আমি কত বড়ো একজন জোচ্চোরকে বিয়ে করেছি। সত্যি সত্যি, আমার এখন কী করণীয় তা আমি জানি না।
বাড়ির পথে আসতে আসতে সুশান্তর বাড়ির সামনে এসে কালকের মতো থমকে দাঁড়ালাম।
সুশান্ত অফিসে কাজ করে, কারখানায় নয়; তাই সকাল সাড়ে নটার আগে ও বেরোয় না বাড়ি থেকে।
ময়ূর এসে দরজা খুলল, বলল, দাদাবাবু এখনও ঘুম থেকে ওঠেননি।
বললাম, সেকী? দাদাবাবুকে তোলো, এল, আমি এসেছি।
ময়ূর বলল, বউদি, আমি একটু বাজারে যাচ্ছি, একদৌড়ে যাব আর আসব। আপনি গিয়ে তুলে দিন দাদাবাবুকে। দরজা খোলা আছে। কাল দাদাবাবু খাননি রাতে, শোওয়ার ঘরেও যাননি। ওই ঘরেই বইপত্রর মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছেন বই পড়তে-পড়তে।
আমি যখন দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম সে ঘরের, সুশান্ত তখনও বাচ্চা ছেলের মতো শতরঞ্চির ওপর শুয়েছিল।
আমি ডাকতে পারলাম না, বুঝলাম না, কী বলে ডাকব ওকে।
ঘুমের মধ্যে ওকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। ও নিজেই একবার পাশ ফিরল, তারপর হঠাৎ উঠে বসল। উঠে বসেই মাথার পাশে রাখা হাতঘড়িটা তুলে নিয়ে দেখে বলল, ইশশ…
বলেই, যেই দরজার দিকে চাইল, দেখতে পেল আমাকে।
আমাকে ওই সকালে দেখে অবাক হল সুশান্ত। বলল, রমেনবাবু ভালো আছেন তো?
আমি বললাম, ভালোই আছেন।
তবে?
আপনি ভালো আছেন কি না তাই দেখতে এলাম।
ও। বলল সুশান্ত। পরক্ষণেই বলল, আপনি বসবার ঘরে বসুন, আমি মুখ-চোখ ধুয়ে আসি।
আজ বসবার ঘরে বসতে বলায় আমার মনের কোণে কোথায় যেন কী একটা বাজল। কালকে যে আপনজনের মতো আদর করে আমাকে ভেতরের ঘরে বসিয়েছিল, আজ সেই-ই আমাকে বাইরের ঘরে গিয়ে বসতে বলল।
একটু পরে সুশান্ত ট্রেতে বসিয়ে চায়ের পট, দুধ, চিনি এবং কয়েকখানা ক্রিমক্র্যাকার বিস্কিট নিয়ে এল। বলল, চা খান। আমার অফিসের আজ ভীষণ দেরি হয়ে যাবে। কাল পড়তে পড়তে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল।
বললাম, কাল খাননি কেন?
সুশান্ত চায়ে চিনি মেশাতে মেশাতে বলল, আপনাকে কে বলল? ময়ূর বুঝি?
হ্যাঁ।
এমনিই খাইনি, কোনো কারণ নেই।
বলেই মুখ ঘুরিয়ে রাস্তার দিকে চেয়ে রইল।
অনেকক্ষণ সুশান্ত কোনো কথা বলল না।
কী বলব, আমিও ভেবে পেলাম না।
বলতে ইচ্ছে করল আমার, সুশান্ত, তুমিই এখানে আমার একমাত্র বন্ধু, তোমার কাছে আমার অনেক কিছু বলার ছিল, ছিল অনেক কিছু পরামর্শ করার, তুমি ছাড়া আমার কেউই নেই যে এই মুহূর্তে আমাকে বলতে পারে, কী আমার করা উচিত। তুমি আমাকে পথ বলে দাও সুশান্ত। আমি একজন সাধারণ মেয়ে, আমি এক সাংঘাতিক ভুল করেছি জীবনে, এর চেয়ে বড়ো ভুল আর হয় না। তুমি আমাকে এই মুহূর্তে ফিরিয়ে দিয়ো না চলে যেতে বোলো না। তোমার সঙ্গে আমি খারাপ ব্যবহার করেছি, কেন করেছি তা তুমি জানো; সব জেনেও তুমি আমাকে ফিরিয়ো না। এমন করে, আমার এই অসহায়তায় আমাকে দূরে ঠেলো না।
একটু পরে ময়ূর এল বাজারের থলে নিয়ে।
সুশান্ত আমাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলল, তাড়াতাড়ি রান্না কর ময়ুর-আমার অফিসের দেরি হয়ে যাবে।
তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, একটা ওমলেট খান না, আরেক কাপ চায়ের সঙ্গে।
ময়ূরকে ডেকে বলল, ময়ুর তাড়াতাড়ি একটা ওমলেট ভেজে আন, আর টি-পটটা নিয়ে যা, চা নিয়ে আয় আবার।
আমি কিছু বললাম না।
আমি আজ তোমার ঘরে একটু বসে থাকতে চাই সুশান্ত, একটু ভাবতে চাই; আমি কী করব? আজ তুমি নিজের হাতে কিছু কোরো না আমার জন্যে, শরবত কোরো না, ওমলেট ভেজো না, তুমি আমার সামনে বসে থেকো, যাতে আমি বুঝতে পারি, জানতে পারি যে, এই পরবাসে আমার তবু একজন লোকও আছে যার কাছে আমি বিপদে যেতে পারি। একটুক্ষণ নিরুপদ্রবে শান্তিতে বাস করতে পারি।
সুশান্ত বলল, স্কুলে যাবেন না আজ?
যাব। বললাম, আমি।
আপনাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। হালকা গলায় বলল ও।
হুঁ। আমি বললাম।
আর কিছু বলার ছিল না। ও আর কিছু জিজ্ঞেসও করল না।
আমার অফিসে আজ একটা বিশেষ কাজ আছে, ন-টার সময়ে বেরোতে হবে। ওমলেটটা আসুক, আর এককাপ চা খান, তারপর আমি চান করতে যাব, কেমন? নইলে আমার দেরি হয়ে যাবে।
আমি বিব্রত হয়ে বললাম, ওমলেট, চা থাকুক, আমি চলি, নইলে আপনার দেরি হয়ে যাবে।
সুশান্ত বলল, দশমিনিটে এমন কিছু দেরি হবে না।
আমি মুখ নীচু করে বসে রইলাম; কিছু বলা হল না।
চা ও ওমলেট এলে, আমি যেন ভিখারি এমনি ভাবে যন্ত্রচালিতের মতো তাড়াতাড়ি খেলাম। চা-টা শেষ করে কাপটা নামিয়ে রাখলাম। কাপটা হাত ফসকে পড়ে যাচ্ছিল, কোনোরকমে ঠিক করে ডিশের ওপর বসালাম।
সুশান্ত তবুও চোখ তুলল না আমার দিকে; কথা বলল না; পথের দিকেই চেয়ে রইল।
একবার খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে হেডলাইনগুলোয় চোখ বোলাল, তারপর স্বগতোক্তি করল, কবে যে বৃষ্টি হবে; এভাবে বাঁচা যায় না।
তারপর একটু পরে সুশান্ত হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, বলল, কিছু মনে করবেন না। এবার আমি চান করতে যাই। তারপর নিরুত্তাপ গলায় বলল, আবার আসবেন।
এই বলে কোনোদিকে না তাকিয়ে সুশান্ত পর্দার আড়ালে চলে গেল।
আমি আমার ব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।
সুশান্তর বাড়ির বাইরে এসে পথে দাঁড়িয়ে হঠাৎ আমার মনে হল, আমার কোথাও যাবার নেই। তবু যে পথে এসেছিলাম, সে পথেই আবার পা বাড়ালাম।
কোথায় যাব? এখন আমি কোথায় যাব ভেবে পেলাম না। সোনারির দিকে হাঁটতে লাগলাম।
গলার কাছে কী একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা দলা পাকিয়ে উঠে আসতে লাগল, সে যন্ত্রণার কোনো তল নেই।
রমেনের সম্বন্ধে এই মুহূর্তে আমার ঘৃণা ছাড়া অন্য কোনো অনুভূতি নেই।
কিন্তু এই একই মুহূর্তে সুশান্তর ওপর এক দারুণ নিরুদ্ধ অভিমানের তীব্রতা হঠাৎ আমার জীবনের আর সমস্ত বোধকে আচ্ছন্ন করে অতিক্রম করে ফেলল। আমার মন, আমার সমস্ত অভিমানী মন বলতে লাগল, সুশান্তকে, বার বার বলতে লাগল, তুমি নিষ্ঠুর; তুমি বড়ো নিষ্ঠুর। আমার মন বলতে লাগল যে, সুশান্তর এই ক্ষণিকের শান্ত শীতল উপেক্ষা রমেনের প্রতিদিনের চিৎকৃত উষ্ণ অসভ্যতার চেয়েও অনেক বেশি কষ্টদায়ক।
ব্যাগটা কাঁধে ফেলে সোনারির রাস্তায় আমি উদ্দেশ্যহীনের মতো হাঁটতে লাগলাম। আমার দু-চোখ জলে ঝাপসা হয়ে এল।
কতক্ষণ এরকম একা একা হাঁটতে পারব জানি না। আমি জানি না।
আমি আধুনিকা, হতে পারি আমি শিক্ষিতা; তবুও আমি যে একজন নরম মনের চিরদিনের মেয়ে। কোনো পুরুষের হাতের অস্বস্তির উষ্ণ তালুতে হাত না রেখে যে আমরা হাঁটতে পারি না বেশিক্ষণ। এখনও পারি না। কোনোদিনও বুঝি পারব না। যারা আমার মতো অবস্থায় না পড়েছে, তারা আমার একথা যে কতবড়ো সত্যি তা বুঝবে না।
ধরার মতো কোনো হাত, কারও হাত আমার পাশে নেই–আজ আমার কেউই নেই।
সুশান্ত, তুমি ভীষণ খারাপ, তুমি অসভ্য, তুমি একনম্বরের দাম্ভিক। আমার যা হবার তা হবে, কিন্তু আমি মরে গেলেও তোমার কাছে কখনো যাব না, কখনো কথা বলব না তোমার সঙ্গে।
তুমি দেখো; সত্যি বলছি, তুমি দেখো।
অসভ্য।
তুমি একটা ভীষণ অসভ্য।