অফিস থেকে বাড়ি ফিরে
১১.
অফিস থেকে বাড়ি ফিরেই কমল শুয়ে পড়ে। শরীর গরম, জ্বরজ্বর ভাব। ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। অমিতাভর ডাকে চোখ মেলল।
খাবেন না, রাত হয়েছে।
কমল উঠে বসার সময় অনুভব করল, তার সারা গায়ে ব্যথা। অমিতাভ দেখল, কমলের চোখ দুটি লাল।
তোমার খাওয়া হয়েছে?
ইতস্তত করে অমিতাভ বলল, না, একসঙ্গেই খাব।
আমার বোধ হয় ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছে, আমি কিছুই খাব না।
অমিতাভ চলে যাচ্ছে, কমল তাকে ডাকল।
তোমার অ্যালার্ম ঘড়িটা আমায় একটু দেবে? কাল খুব ভোরে উঠতে হবে। প্র্যাকটিসে যাব।
প্র্যাকটিসে! অমিতাভর চোখ বড় হয়ে গেল। আপনার তো জ্বর হয়েছে!
এই বলে অমিতাভ এগিয়ে এসে কমলের কপালে হাত রাখল। প্রায় একশো।
কমল চোখ দুটি বন্ধ করে অমিতাভর শীর্ণ আঙুলের স্পর্শ অনুভব করতে করতে বলল, আমাকে খেলতে হবে।
এই শরীরে?
হ্যাঁ? প্র্যাকটিস না করলে খেলা যায় না। আমি আর সময় নষ্ট করতে পারি না।
কিন্তু— অমিতাভ চুপ করে গিয়ে একরাশ প্রশ্ন তুলে ধরল।
কমল একটু হাসল। সারা জীবন পারফেক্শন খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি। যে যার নিজের ক্ষেত্রে পারফেক্ট হতে চায়; আমার ক্ষেত্রটা ফুটবল। আমি মানুষ হতে পারব না জেনে ফুটবলার হতে চেয়েছি। কিন্তু দুঃখের কথা কী জানো, ফুটবলারের সময়টা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তার শরীর, তার যৌবনই তার সময়, কিন্তু বড্ড ছোট্ট সময়টা। আমার মতো তৃতীয় শ্রেণীর ফুটবলার অল্প সময়ের মধ্যে কী করতে পারে যদি না খাটে, যদি না পরিশ্রম করে?
কিন্তু আপনি অসুস্থ।
হোক। চ্যালেঞ্জ এসেছে, আমি তা নেবই। বহু অপমান সহ্য করেছি, তার জবাব না দিতে পারলে বাকি জীবন আমি কী করে কাটাব?
কমল উঠে দাঁড়াল। কুঁজো হয়ে খাটের তলা থেকে ধুলোয় ভরা নীল রঙের কেডস্ জুতোজোড়া বার করে বুরুশ দিয়ে ঘষতে শুরু করল। হঠাৎ অমিতাভ বলল, আপনি ফুটবলকে এত ভালবাসেন!
মাথা হেলিয়ে কমল কয়েক সেকেন্ড থেমে বলল, হ্যাঁ, এজন্য আমার দাম দিতে হয়েছে। অনেক কিছুই হারিয়েছি, তার বদলে এমন কিছুই পেলাম না যা দিয়ে আমার লোকসান পূরণ করতে পারি। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ খেলার জীবনে অনেক শুনেছি, কিন্তু মূর্খ, বোকা, বদমাস, অহঙ্কারীদের অপমানের জবাব না দিয়ে আমি রিটায়ার করব না। আমি খেলব, যেমন করেই হোক, যদি মরতে হয় তবুও।
যদি না পারেন? সময় তো ফুরিয়ে এসেছে বললেন।
আমি ভয় পাই এ কথা ভাবতে। আমাকে পারতেই হবে, একাই আমায় চেষ্টা করতে হবে। আমি জানি, ঠিক সময়ে বল এগিয়ে দেব কিন্তু তখন বল ধরার লোক থাকবে না। নিখুঁত পাস দেব কিন্তু কন্ট্রোলে আনতে পারবে না, বল পাব কিন্তু এত বিশ্রী ভাবে আসবে যে কাজে লাগাবার উপায় তখন থাকবে না। নানান অসুবিধা নিয়ে আমার চারপাশের প্লেয়ারদের সঙ্গে মানিয়ে খেলতে হবে। কেউ কারোর খেলা বোঝে না, ওরা এক একজন এক এক রকমের। ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। এজন্য প্র্যাকটিস চাই একসঙ্গে।
তা হলেই আপনি সফল হবেন?
কমল তীব্র কৌতূহল দেখতে পেল অমিতাভর চোখে। এতক্ষণ ধরে এত কথা তারা আগে কখনও বলেনি। কমলের মনে হল, তার কথা শুনতে অমিতাভর যেন ভাল লাগছে। যে ভয়ঙ্কর ঔদাসীন্য এবং চাপা ঘৃণা নিয়ে সে বাবার সঙ্গে কথা বলত, সেটা সরে গিয়ে একটা কৌতূহলী ছেলেমানুষ বেরিয়ে এসেছে। আর একটা ব্যাপার কমল বুঝতে পারল, তার জ্বরজ্বর ভাব এবং গায়ের ব্যথা এখন আর নেই।
স্কিপিং-এর দড়িটা টেনে পরীক্ষা করতে করতে কমল বলল, সফল? তোমার কী মনে হয়?
অমিতাভ গম্ভীর হয়ে গেল।
কমল উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে রইল।
আমি ফুটবলের কিছু বুঝি না।
কিন্তু এটা ফুটবল হিসাবে দেখছ কেন, জীবনের যে কোনও ব্যাপারেই তো এরকম পরিস্থিতি আসে। যে মানুষ একা, যার কেউ নেই, সে তখন সফল হবার জন্য কী করতে পারে?
অমিতাভ চুপ করে রইল।
কমল উত্তেজিত হয়ে বলল, সে তখন পারে শুধু লড়তে। তুমি কি নিজেকে একা বোধ করো অমিতাভ?
অমিতাভ জবাব দিল না।
কমলের উত্তেজনা ধীরে ধীরে কমে এল। আস্তে আস্তে সে বলল, যোগাযোগ করো। মাঠে আমি খেলার সময় তাই করি। কিন্তু বাড়িতে ফিরে আর তা পারি না। বড় একা লাগে।
খাটের উপর বসে মেঝের দিকে তাকিয়ে কমল বলল, অনেক কথা বললাম, হয়তো এর মানে আমরা কেউই জানি না। তুমি আমাকে ভালবাস না, আমাকে ঘৃণা করো, এটা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু আমি তোমায় ভালবাসি।
কমলের চোখ জলে চিকচিক করছে। স্বর ভারী। অমিতাভ পাথরের মূর্তির মতো একই ভাবে দাঁড়িয়ে। কমল মুখ নামিয়ে মেঝের দিকে তাকাল।
ফুটবল খেলা একদিন আমায় শেষ করতেই হবে, তারপর আমি কী নিয়ে, কাকে নিয়ে থাকব?
এ কথা শুনে অমিতাভর মুখে কোন ভাব ফুটে ওঠে দেখার জন্য মুখ তুলে কমল দেখল, ঘরে অমিতাভ নেই। নিঃসাড়ে সে বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে।
.
ভোর সাড়ে পাঁচটায় কমল কিটব্যাগ হাতে বাড়ি থেকে বেরোল। বাগবাজার থেকে ময়দান সে ধীর গতিতে জগ করে পৌঁছল যখন, শোভাবাজারের টেন্টে তখন তিনটি ছেলে সদ্য এসে পৌঁছেছে। ওরা—স্বপন, রুদ্র আর শিবশম্ভু চটপট তৈরি হয়ে নিল।
এখান থেকে চৌরঙ্গি রোড ধরে ভিক্টোরিয়া, তারপর পশ্চিমে বেঁকে রেস কোর্সের দক্ষিণ দিয়ে ট্রামলাইন পেরিয়ে প্রিনসেপ ঘাট। সেখান থেকে গঙ্গা ধরে উত্তরে, তারপর বেঁকে মোহনবাগান মাঠের পাশ দিয়ে নেতাজি স্ট্যাচু ঘুরে আবার এখানে। কমল দৌড়ের পথ ছকে দিল রওনা হবার আগে। ওরা ঘাড় নাড়ল।
চৌরঙ্গি দিয়ে দৌড়বার সময় একটা বাস থেকে লাফিয়ে নামল ভরত। ওরা থমকে দাঁড়াল।
কমলদা, আপনারা বেরিয়ে পড়েছেন, আমিও তো প্র্যাকটিস করব বলে এলুম।
ঘন্টা খানেকের মধ্যেই আসছি। তুই রেডি হয়ে থাক।
ওরা চারজন আবার ছুটতে শুরু করল। কিছুক্ষণ ছোটার পর কমল পাশে তাকিয়ে। স্বপনকে বলল, সাত বারো কত হয় রে?
বিস্ময় ফুটে উঠল স্বপনের মুখে। ছুটতে ছুটতে এ কী বেয়াড়া প্রশ্ন! ক্লাস এইটে ফেল করার পর স্বপন আর স্কুল-মুখো হয়নি এবং মাথা খাটানোর মতো কোনও ঝাটে ব্যাপারে ব্যস্ত হয়নি। কমলের প্রশ্নের জবাব দিতে সে বিড়বিড় করে সাতের ঘরের নামতা শুরু করল।
কিছুক্ষণ পর স্বপন বলল, চুরোআশি।
দেশ কোথায় ছিল, যশোরে?
স্বপন একগাল হাসল।
ওরা ছুটতে ছুটতে রবীন্দ্রসদন পার হয়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পিছন দিয়ে পশ্চিমে চলেছে। কমল এবার রুদ্রকে বলল, পাখি সব করে রব—পদ্যটা মুখস্থ আছে?
না, পড়িনি।
পঞ্চনদীর তীরে বেণী পাকাইয়া শিরে?
মুখস্থ নেই।
এগারোর উপপাদ্য কিংবা ভারতের জলবায়ু মনে আছে? তুই তো গত বছর। বিকম পরীক্ষা দিয়েছিস, বল তো।
ছুটতে ছুটতে রুদ্রর ভুরু কুঁচকে গেল। প্রাণপণে সে মনে করার চেষ্টা শুরু করল। কমল তখন শিবশঙ্কুকে কর্মধারায় ও দ্বিগু সমাসের ধাঁধায় ফেলে স্বপনকে একটি সহজ মানসাঙ্কের জট ছাড়াতে দিল। কমল ট্রেনিংয়ের অঙ্গ হিসাবে মাথার কাজ শরীরের খাটুনি একসঙ্গে করার এই পদ্ধতিটা শিখেছে পল্টুদার কাছে! তাকে দিয়ে তিনি এই ভাবে কাজ করাতেন। কমল নিষ্ঠার সঙ্গে বরাবর তা পালন করে এসেছে। পল্টুদা বলতেন, শরীর যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন মাথাও আর কাজ করতে পারে না। ফুটবলে মাথা খাটাতে হয় ক্লান্তির মধ্যেও। সেইজন্যে ব্রেনটাকে তৈরি করতে হয়, তারও ট্রেনিং লাগে। যখন দৌড়বি তখন মাথাকে অলস রাখবি না কখনও।
গঙ্গার ধার দিয়ে ছোটার সময় মালভর্তি লরি যেতে দেখে কমল বলল, তাড়া কর লরিটাকে, দেখি কে ধরতে পারে।
চারজনে একসঙ্গে প্রিন্ট শুরু করল। প্রায় সত্তর মিটার দৌড়ে লরিটাকে ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করে ওরা দাঁড়িয়ে হাঁফাতে লাগল। একটা বাস ওদের পাশ দিয়ে চলে গেল। কমল হঠাৎ বলল, স্বপন, এটাকে ধর।
হকচকিয়ে স্বপন বলল, আবার?
কুইক।
স্বপন প্রাণপণে ছুটে পঁচিশ মিটার যেতেই কমল চেঁচিয়ে তাকে দাঁড়াতে বলল। এই ভাবে রুদ্র ও শিবশম্বুকেও আচমকা সে ছুটতে বলল বাস বা লরির পিছনে পালা করে। এরপর ওরা আবার ছুটতে শুরু করল। কমল তিনজনের আগে দৌড়চ্ছে। ইডেনের কাছে এসে কমল বলল, চল, গাছে চড়ি।
একটা জামরুল গাছ বেছে নিয়ে কমল বলল, কে আগে চড়ে ওই ছড়ানো ডালটা ধরে ঝুলে নীচে লাফিয়ে পড়তে পারে!
চারজন একসঙ্গে গাছটাকে আক্রমণ করল। স্বপন ধাক্কা দিয়ে কমলকে ফেলে দিয়ে সবার আগে গাছে উঠল, তারপর রুদ্র। শিবশম্ভুর পর কমল যখন গাছে উঠে ডালের প্রান্তে পৌঁছে প্রায় বারো ফুট উঁচু থেকে মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তখন স্বপন কাঁচুমাচু মুখে কমলকে কিছু বলার জন্য এগোতেই সে হেসে বলল, ঠিক আছে, খেলার সময়ও ওই রকম শ্যোলডার চার্জ করবি।
শোভাবাজারের মাঠে ওরা যখন পৌঁছল, ভরত তখন শূন্যে উঁচু করে বল মেরে দৌড়ে গিয়ে লাফিয়ে মাথার উপর থেকে বল ধরা প্র্যাকটিস করছিল একা একাই। ওদের দেখে সে চেঁচিয়ে বলল, আমাকে কেউ একটু প্র্যাকটিস দিয়ে যাও।
হবে হবে, আগে একটু জিরোতে দে। কমল এই বলে ঘাসের উপরে শুয়ে পড়ল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এই পর্যন্ত সে প্রায় দশ-বারো মাইল ছুটেছে। ফুটবল মরশুমের মাঝামাঝি এমন পরিশ্রমী ট্রেনিং কেউ করে না।
ঘণ্টা দেড়েক বল দেওয়া, বল ধরা, দুজনের বিরুদ্ধে একজনের ট্যাকলিং হেডিং এবং শুটিং-এর পর কমলের খেয়াল হল, অফিস যেতে হবে। অফিস থেকে শুধু বেরিয়ে যাওয়ারই নয়, এখন থেকে অফিসে হাজিরা দেওয়ার সময় সম্পর্কেও তাকে সাবধান হতে হবে। তা ছাড়া ছেলেগুলো পরশু খেলবে মহমেডানের সঙ্গে। এখন আর খাটানো ঠিক হবে না। কমল টেন্টেই স্নান করে, ক্যান্টিনে ভাত খেয়ে হেঁটেই অফিস রওনা হয়ে গেল।
দুপুরে নতু সাহা তাকে জানাল, কাল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে খেলা আছে। কমল বলল, শরীর খারাপ, খেলব না।
গম্ভীর হয়ে নতু সাহা চলে গেল।
.
১২.
যুগের যাত্রীর পনেরোটা ম্যাচ খেলে আঠারো পয়েন্ট। মোহনবাগানের চৌদ্দটি খেলায় চব্বিশ, ইস্টবেঙ্গলের চৌদ্দটি খেলায় ছাব্বিশ, মহমেডানের পনেরোটি খেলায় পঁচিশ পয়েন্ট। আর শোভাবাজারের যোলোটি খেলায় ছয় পয়েন্ট। লিগের প্রথমার্ধ শেষ হয়ে আসছে। ইতিমধ্যে ময়দানে গুলতানি শুরু হয়ে গেছে—দ্বিতীয় ডিভিশনে শোভাবাজার অবধারিত নামছে। বালী প্রতিভা, স্পোর্টিং ইউনিয়ন, জর্জ টেলিগ্রাফ, কালীঘাট দু-তিন পয়েন্টে শোভাবাজারের উপরে।
যুগের যাত্রীর সঙ্গে লিগের প্রথম খেলার আগের দিন, অফিসের লিফটে ওঠার জন্য কমল যখন দাঁড়িয়ে, পিছন থেকে একজন বলল, কমলবাবু, কাল খেলছেন তো?
গলার স্বরে চাপা বিদ্রুপ বিচ্ছুরিত হল। কমল জবাব দিল না। প্রশ্নকারী তাতে উত্তেজিত হয়ে উঠল। এবার রেগে বলল, আরে মশাই, যেটুকু নাম এখনও লোকে করে সেটা ডুবিয়ে কোনও লাভ আছে? অনেক তো খেললেন সারা জীবনে।
লিফটের দরজা খুলে গেল। লাইন দেওয়া লোকেরা ঢুকল, তাদের সঙ্গে কমলও। দরজা বন্ধ হবার সময় সে শুনতে পেল, লাইনে দাঁড়ানো প্রশ্নকারী সকলকে শুনিয়ে বলছে, বুঝলেন, এরাই ফুটবলের ইজ্জৎ নষ্ট করে।
টিফিনের সময় কমল নিজের চেয়ার থেকে উঠল না। আবার কে তাকে শুনিয়ে বিদ্রুপাত্মক কথা বলবে কে জানে। একমনে মাথা নিচু করে সে কাজ করে চলেছে। চমকে উঠল যখন তার সামনে একটা লোক হাজির হয়ে বলল, কমল, আছ কেমন?
মুখ তুলে কমল দেখল, যুগের যাত্রীর তপেন রায়। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়ল, একশো টাকা ধার নেওয়ার কথাটা—মুখটা পাংশু হয়ে গেল।
খেলাটেলা কেমন চলছে, শুনলুম, দারুণ প্র্যাকটিস করছ? চেয়ার টেনে বসতে বসতে তপেন রায় বলল।
তপেনদা, আপনার টাকাটা এখনও দিতে পারিনি, এবার মাইনে পেলেই দিয়ে দেব।
টাকা! কীসের টাকা? তপেন রায় আকাশ থেকে পড়ল।
কমল আরও কুণ্ঠিত স্বরে বলল, মনে আমার ঠিকই আছে, তবে একবারে একশোটা টাকা দেওয়ার সামর্থ তো নেই।
তপেন রায় কিছুক্ষণ কমলের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে যেন অতি কষ্টে মনে করতে পারল। তারপর বলল, ও হো, সেই টাকাটা! আমি তো ভুলেই গেছলুম। আরে দূর, ওটা তোমার ফেরত দিতে হবে না। তারপর গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, যাত্রীর কাছে কত টাকা তুমি পাও, সেটা তো আমি ভাল করেই জানি। তোমায় ঠকিয়েছে কী ভাবে তার সাক্ষী আমি ছাড়া আর কে! এ টাকা তো আর মামলা করে যাত্রী আদায় করতে পারবে না। যা পেয়েছ তাই নিয়ে নাও।
মুহূর্তে কমল সাবধান হয়ে গেল। এতদিন ফুটবল খেলে সে মাঠের লোকেদের চিনেছে। হঠাৎ তপেন রায়ের আবির্ভাব এবং খুবই বন্ধুর মতো কথাবার্তা তার ভাল লাগল না। সে সতর্ক স্বরে বলল, তারপর, কী মনে করে হঠাৎ…
বলছি। তপেন রায় সিগারেট বার করল, ধরাল এবং প্রথম ধোঁয়া ছেড়ে বলল, যুগের যাত্রীকে কমল গুহ যে সার্ভিস দিয়েছে তা ভোলার নয়। কিন্তু যাত্রী তার বিনিময়ে তাকে কী দিয়েছে? কিছুই নয়। এই নিয়ে ক্লাবে অনেকে অনেক কথা বলেছে। কমিটি মিটিং ডাকা হয়েছিল। ঠিক হয়েছে, তোমাকে এবারের লিগের শেষ খেলার দিন মাঠেই পাঁচ হাজার টাকার চেক দেওয়া হবে।
যাত্রীর সঙ্গে লিগের শেষ খেলা কিন্তু শোভাবাজারের।
তাই না কি! তা হলে তো ভালই। কিন্তু সবার আগে তোমার অনুমতি চাই, তুমি গ্রহণ করবে কি না। অবশ্য বলে রাখছি, পরশু দিনই কমিটির একটা মিটিং আছে, ব্যাপারটা তখনই পাকাপাকি ঠিক করা হবে।
কমল একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখছিল তপেন রায়ের চোখ দুটি। অতি সরল। ভিতর থেকে আন্তরিকতা ঠিকরে বেরোচ্ছে। কমল মনে মনে হেসে বলল, কাল যাত্রীর সঙ্গে খেলার পর আপনাকে জানাব।
কাল তুমি খেলছ না কি?
হ্যাঁ।
তপেন রায় ঘন ঘন সিগারেটে টান দিয়ে কী যেন ভাবতে ভাবতে বলল, এই বাজারে পাঁচ হাজার টাকার দাম কম নয়। বলতে গেলে এক রকম পড়েই পাওয়া। মাথা গরম করে হারিয়ো না এটা। যাত্রী তো নাও দিতে পারে, তবু দেবে বলে মনস্থ করেছে। এতে তোমাকে যেমন সম্মান দেওয়া হবে, তেমনি যাত্রীর উপরও প্লেয়ারদের কফিডেন্স আসবে, তাই নয় কি?
কমল ঘাড় নাড়ল।
এখনকার ক্লাবগুলো যা হয়েছে, বুঝলে কমল, একেবারে নেমকহারাম। প্লেয়াররাও সেই রকম। পয়সা ছাড়া মুখে কোনও কথা নেই। কিন্তু যাত্রী তো সেরকম ক্লাব নয়। প্লেয়ারদের সঙ্গে আত্মার সম্পর্কে না থাকলে ক্লাব চলে না। তপেন রায় আবেগ চাপতে গিয়ে চুপ করল! কমল কথা বলল না।
তা হলে তুমি এখন বলবে না টাকা নিতে রাজি কি না?
না। কাল খেলার পর এ নিয়ে ভাবব।
তপেন রায় চলে যাবার পর বিপুল ঘোষ গলা বাড়িয়ে বলল, পাঁচ হাজার টাকা! ব্যাপার কী?
পরীক্ষা দিলাম। স্টপার খেলি, নানান দিক থেকে আক্রমণ আসে। এটাও একটা।
তার মানে?
আমরা সবাই তো স্টপার ঘোষদা, কেউ মাঠের মধ্যে, কেউ মাঠের বাইরে। ঠেকাচ্ছি আর ঠেকাচ্ছি। এটাও ঠেকালাম—লোভকে। ঘুষ দেবার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল লোকটা। কাল ওদের টিমের সঙ্গে খেলা। আমাদের মজুমদার সাহেবের টিম। এবছর লিগ চ্যাম্পিয়ন হবার জন্য খেলছে, ভালই খেলছে। হয়তো হয়েও যাবে। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হবার পথে যাতে একটিও কাঁটা না থাকে সেই ব্যবস্থা করতে এসেছিল। আমাকে ওরা একটা কাঁটা ভাবে।
ঘুষ দিয়ে? না না মশাই, কাল আপনি ভাল করে খেলুন। দারুণ খেলুন। আচ্ছা করে জব্দ করে দিন।
কমল দেখল, বিপুল ঘোষের সারা মুখ আন্তরিকতায় কোমল ও উজ্জ্বল।
কাল অফিসে আসছেন তো? দূর থেকে রণেন দাস প্রশ্ন করল।
কেন? কমল সচকিত হয়ে বলল।
সেটা আপনি ভালই জানেন। তবে বলে রাখছি, পাঁচটার আগে আপনাকে আমি ছাড়তে পারব না।
জানি আমি। তবে কাল আমি ক্যাজুয়াল নিচ্ছি।
.
অফিস ছুটির পর শোভাবাজার টেন্টে আসা মাত্র কৃষ্ণ মাইতি হাত ধরে বলল, গুলোকে শিক্ষা দিতে হবে কমল। ব্যাটা টাকা মেরেছে কাজ হাসিল করে নিয়ে। পয়েন্ট চাই-ই চাই। তুই কিন্তু প্রধান ভরসা। ক্লাবের সবাই তোকে খেলানোর এগেস্টে, আমি জোর করে বলেছি, কমলকে খেলাতেই হবে।
নার্ভাস বোধ করল কমল। বিব্রত স্বরে বলল, কিন্তু কেষ্টদা, একা আমার ওপর এতটা ভরসা করবেন না, করা উচিত নয়। ফুটবল একজনের খেলা নয়।
তুই একাই এগারোজন হয়ে খেলতে পারিস, যদি মনে করিস খেলব। তা ছাড়া—মনে আছে সেই চাকরির কথাটা, পল্টু মুখুজ্যের মেয়ের চাকরি। যদি কাল একটা পয়েন্ট আনতে পারিস, গ্যারান্টি দিচ্ছি চাকরিটা হবে।
কমল তর্ক করে কথা বাড়াল না। হঠাৎ সে ক্লান্ত বোধ করতে শুরু করল। অনেক কিছু নির্ভর করছে কালকের খেলার উপর। এখন যার সঙ্গেই দেখা হবে, সে মনের উপর একটা দায়িত্বের পাথর চাপিয়ে দেবে। কমল চেয়ার নিয়ে টেন্টের বাইরে বেড়ার ধার ঘেঁষে বসল।
ভরত এসে বলল, কমলদা, একটা কথা বলার ছিল। খুবই জরুরি, কিন্তু এখানে। বলব না। আপনি বাইরে আসুন, মিনিট পাঁচেক পর আমি টাউন ক্লাব টেন্টের সামনে থাকব।
এই বলেই ভরত হনহন করে বেরিয়ে গেল। অবাক হয়ে কমল চারপাশে তাকাল। ক্যান্টিনের কাছে সত্য আর দেবীদাস হাসাহাসি করছে। স্বপন একটু আলাদা দাঁড়িয়ে ঘুগনি খাচ্ছে। টেন্টের মধ্যে যথারীতি টেবিল ঘিরে গুলতানি। ভরতের কী এমন কথা থাকতে পারে যা একান্তে বলা দরকার!
কমল টাউন টেন্টের কাছে পৌঁছতেই অপেক্ষমাণ ভরত বলল, কমলদা, আমাদের দুজন কাল গট আপ হয়েছে।
শোনামাত্র কমল জমে গেল। গট আপ! কারা?
আজ সকালে যাত্রীর লোক এসেছিল আমার বাড়িতে। সঙ্গে ছিল শম্ভু। টেরিলিন স্যুট করে দেবে যাত্রী। শম্ভু আর সত্য গোলাম আলিতে মাপ দিয়ে এসেছে।
তুই গেলি না?
ভরত শুধু হাসল। কমলও হাসল। তারপর ভরতের পিঠ চাপড়ে বলল, এখন কাউকে বলিসনি এসব কথা। আগে খেলাটা হোক।
সলিলের কিছু খবর জানেন, আসে না কেন? ও থাকলে খানিকটা সামলানো যেত।
সলিল একটা কাজ পেয়েছে, খেলার জন্য আর সময় পায় না। হয়তো আর কোনও দিনই পাবে না। কিন্তু ভরত, বাটার সঙ্গে খেলার মতো অবস্থা কাল যেন হবে মনে হচ্ছে।
কী জানি! অনিশ্চিত স্বরে ভরত বলল, আমাদের আর একটা ছেলেও নেই যাকে নামানো যায়। নইলে কেষ্টদাকে বলে সত্য আর শম্ভুকে বসিয়ে দেওয়া যেত।
ম্লান হেসে কমল বলল, তা হলে কাল ভাগ্যের উপরই ভরসা করতে হবে।
হ্যাঁ, ভাগ্যের উপরেই।
.
১৩.
যুগের যাত্রী ৫-০ গোলে শোভাবাজারকে হারাল।
অন্ধকার ঘরে বিছানায় উপুড় হয়ে কমল শুয়ে। অ্যালার্ম ঘড়ির টিকটিক শব্দ একটানা তার মাথার মধ্যে হাতুড়ির ঘা মেরে চলেছে। কমল হাত দিয়ে দুকান চেপে অস্ফুটে কাতরাল। এখনও কানে বাজছে ভয়ঙ্কর চিৎকারগুলো। ঘড়িটা আছড়ে ভেঙে ফেলা যায়, কিন্তু পাঁচটা গোলের চিৎকার।
গ্যালারির মাঝখানের সরু পথ দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় উপর থেকে তার মাথায় থুথু পড়ে, ইটের টুকরো লাগে পিঠে। একটা চিৎকারও শুনেছিল, কী রে কমল, অনুপমকে আটকাতে পারিস বলেছিলি না!
আজ অনুপম তিনটি গোল দিয়েছে। তবে হ্যাটট্রিক হয়নি। কমল বিছানায় বার কয়েক কপাল ঠুকল। অজান্তে একটা গোঙানি মুখ থেকে বেরিয়ে এল।
কী গো কমল, যাত্রীর জার্সিকে ভয়ে কাঁপিয়ে দেওয়ার ইচ্ছেটা এবার ছাড়ো।
গুলোদার হাসিখুশি মুখ আর চিবিয়ে চিবিয়ে বলা কথাগুলো যেন বিছানার মধ্যে থেকে উঠে আসছে। বিছানাটাকে ঘিঁড়েখুঁড়ে একশা করা যায়, কিন্তু কথাগুলোকে।
আমি কী করব, যিনি টিম করেছেন তাঁকে গিয়ে বলুন। বুড়ো প্লেয়ার দিয়ে যদি ফুটবল খেলাতে চান তা হলে খেলান। বলিহারি শখ! নিজেরও তো একটা আক্কেল-বিবেচনা থাকে। সরোজ খেলা শেষে মাঠের উপর দাঁড়িয়ে একজনকে যখন কথাগুলো বলছিল, কমল মুহূর্তের জন্য দেখেছিল চাপা তৃপ্তির আমেজ তার চোখে মুখে ছড়িয়ে রয়েছে।
খেলার শেষ বাঁশি বাজতেই ভরত ছুটে গিয়ে মাঠের মধ্যেই শম্ভুকে চড় কষায়। শম্ভু লাথি মারে ভরতকে। দুজনকে যখন সরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, তখন চিৎকার করে শম্ভু বলে, গোল কি আমার দোষে হয়েছে? ওই লোকটা, ওই লোকটার জন্য।
শম্ভুর আঙুল একটা ছোরার মতো উঠে কমলকে শিকার করে। কোনও দিকে না তাকিয়ে কমল মাঠ থেকে বেরিয়ে আসে।
এত ভরসা করেছিলুম তোর ওপর। আমায় একেবারে ডুবিয়ে দিলি। কেষ্টদার হতাশ এবং বিরক্ত কণ্ঠস্বরে কমলের চকিতে মনে পড়েছিল, অরুণার চাকরিটা বোধ হয় হল না!
মুখ দেখাবার উপায় কোথাও আর রইল না। বাটার সঙ্গে খেলাটাই আবার অনুষ্ঠিত হল। তবে যাত্রী আরও দক্ষ, আরও কঠিন এবং উদ্দেশ্যপরায়ণ। কমল চোখ বুজে এখনও দেখতে পাচ্ছে, অনুপম আর প্রসূন তার দুপাশ দিয়ে ঢুকছে আর ফাঁকা মাঝ মাঠ দিয়ে বল নিয়ে উঠে আসছে যাত্রীর রাইট ব্যাক। স্বপন আর রুদ্র কোন দিকে কাকে আটকাবে ভেবে পাচ্ছে না। কমল স্থির করেছিল আজ সে অনুপমকে রুখবে। কিন্তু অনুপমের পাশাপাশি প্রসূন সব সময় ছিল তাকে ধাঁধায় ফেলার জন্য। যেখানেই। বল প্রসূন সেখানে তার দলের খেলোয়াড়ের পাশে গিয়ে হাজির হয়েছে। শোভাবাজারের একজনের সামনে যাত্রীর দুজন ফরোয়ার্ড সব সময়ই। লোক পাহারা দেবে না জমি আগলাবে কমল এই সমস্যা সমাধান করতে পারেনি লোকের অভাবে। এবং কেন এই অভাব ঘটল এক মাত্র সে আর ভরত তা জানে।
কিন্তু সেকথা এখন বললে লোকে বলবে সাফাই গাইছে। উপায়ও নেই, মুখ। দেখাবার কোনও উপায় আর রইল না। বিদ্রুপ আর ইতর মন্তব্য শুনতে হবে বহুদিন। কমল বিছানায় মুখটা চেপে ধরে থরথরিয়ে কাঁপতে শুরু করল।
হঠাৎ ঘরের আলোটা কে জ্বালল। কমল ছিটকে উঠে বসল।
কমলদা, আমি এসেছি।ঘরের মধ্যে সলিল দাঁড়িয়ে। মুখে লাজুক বিব্রত হাসি।
কেন?
শুনলুম আজ পাঁচ গোলে শোভাবাজার হেরেছে।
কথা না বলে কমল একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
আমি খেলব কমলদা। আমি আর বাড়িতে ফিরব না। কাজ আমি করতে চাই না, আমি খেলতে চাই। আমাকে শুধু দুমুঠো খেতে দেবেন আর একটু ঘুমোবার জায়গা।
উঠে দাঁড়াল কমল।
আমি বাড়ির জন্য আর ভাবব না। ওদের বাঁচানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি-।
এরপরই সলিল পেটটা চেপে ধরে ছিটকে দেয়ালে আছড়ে পড়ল কমলের লাথি খেয়ে।
কী জন্য এসেছিল এখানে! রাসকেল, করুণা দেখাতে এসেছিস? পাঁচ গোল খেয়েছি বলে সাহায্য করতে এসেছিস? ফুটবল খেলে আমায় উদ্ধার করতে এসেছিস? বলতে বলতে কমল আবার লাথি কষাল। সলিল কাত হয়ে মেঝেয় পড়ে গেল। তার পিঠে কোমরে মাথায় কমল পাগলের মতো এলোপাথাড়ি লাথি মারতে শুরু করল। চুল ধরে টেনে তুলে মুখে ঘুষি মারল।
আমার মারবেন না কমলদা, আমি চলে যাচ্ছি, আমি চলে যাচ্ছি। সলিল উঠে বসতেই কমল ওর চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে শুরু করল।
কেন এসেছিস, বল কেন এসেছিস?
সলিল হাঁ করে মুখটা তুলে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের কোণ বেয়ে, নাক দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে আর চোখ বেয়ে জল। ও বলার আগেই দরজার কাছে অমিতাভ বলে উঠল, ছাড়ুন, ওকে ছাড়ুন।
দ্রুত ঘরে ঢুকে সে সলিলের চুলধরা কমলের হাতে ধাক্কা দিল।
তোমার কী দরকার এখানে?
আপনি এভাবে মারছেন কেন ওকে?
আমি যা করছি তাতে তোমার নাক গলাতে হবে না।
একজনকে এভাবে মারবেন আর তাই দেখে বাধা দেব না? দেখুন তো কী অবস্থা হয়েছে ওর! জানোয়ারকেও এভাবে মারে না।
না না, কমলদা আমায় মারেননি। সলিল দুহাত তুলে অমিতাভর কাছে আবেদন জানাল ঘড়ঘড়ে স্বরে। কমলদা আমায় কখনও মারেন না, শুধু আমায় শাস্তি দেন।
চুপ করো তুমি। অমিতাভ ধমক দিল সলিলকে। তারপর ঝুকে তার শীর্ণ হাতটা বাড়িয়ে সলিলের কাঁধে আঙুল ছোঁয়াল। এসো আমার ঘরে, মুখ ধুইয়ে মলম লাগাতে হবে।
অমিতাভ বেরিয়ে যাবার সময় থমকে একবার কমলের দিকে তাকাল। অদ্ভুত একটা ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে কমলের মুখে ফুটে উঠেছে দীনতার ছাপ। বয়সটা যেন দশ বছর বেড়ে গেছে। কমল কুঁজো হয়ে ধীর গতিতে এসে খাটের উপর বসল। শূন্য দৃষ্টিতে সলিলের দিকে তাকিয়ে থেকে অন্যমনস্কের মতো চুলে আঙুল চালাতে লাগল।
সলিল ওঠবার চেষ্টা করে যন্ত্রণায় কাতরে উঠে পেট চেপে বসে পড়ল। আবার চেষ্টা করল ওঠবার। আবার বসে পড়ল। অসহায়ভাবে কমলের দিকে তাকাল। একদৃষ্টে কমল তার দিকে তাকিয়ে, চোখে কোনও অভিব্যক্তি নেই।
আপনার মাথায় দাগটা এখান থেকেও আমি দেখতে পাচ্ছি কমলদা।
কমল নিরুত্তর রইল। সলিল হাসবার চেষ্টা করল, তারপর হামাগুড়ি দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কমল চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে যেতে লাগল। অনেকক্ষণ পর অমিতাভ ঘরে ঢুকে মৃদু স্বরে বলল, আপনি শুয়ে পড়ুন।
কমল মুখ তুলে কিছুক্ষণ ধরে অমিতাভর মুখের উপর চোখ রাখল। ক্রমশ সংবিৎ ফিরে এল তার চাহনিতে। মুখ দুমড়ে গেল বেদনায়। ফিসফিস করে সে বলল, আমি শেষ হয়ে গেলাম!
অমিতাভ আলো নিভিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
.
১৪.
পরদিন থেকে কমল যেন বদলে গেল। চেহারায় এবং মনেও। অফিসে সারাক্ষণ নিজের চেয়ারে থাকে। কথা বলে না প্রয়োজন না হলে। ছুটির পর সোজা বাড়ি চলে আসে। গড়ের মাঠের পথ আর মাড়ায় না। অফিসে অরুণা ফোন করেছিল। কমল কথা বলেনি। বিপুল ঘোষকে সে বলতে বলে, অফিসে আসেনি, জানিয়ে দিন।
কমল যতটা ভেবেছিল তেমন কোনও বিদ্রুপ অফিসে বা অন্য কোথাও তাকে শুনতে হয়নি। সবাই যেন ধরেই নিয়েছে এমনটিই হবে। ওর মনে হয়, এই রকম ঔদাসীন্যের থেকে বরং বিদ্রুপই ভাল ছিল। মাসের মাইনে পেয়েই সে রথীনের ঘরে গিয়ে একশো টাকার নোট টেবিলে রেখে বলে, ধার নিয়েছিলাম, সেই টাকাটা।
ধার! আমি তো দিইনি। যে দিয়েছে তাকে দিয়ে এসো। রথীন কমলের দিকে। আর না তাকিয়ে কাজে মন দেয়।
কমল দ্বিধায় পড়ে। অফিসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে ভেবে সে স্থির করে, তপেন রায়ের হাতেই টাকাটা দিয়ে আসবে। ছুটির পর সে যাত্রীর টেন্টের দিকে রওনা হয়। যখন পৌঁছল, যাত্রীর প্লেয়াররাও ঠিক তখনই এরিয়ান মাঠ থেকে ফিরল বি এন আর-কে ২-০ গোলে হারিয়ে। প্রায় শখানেক লোক হইচই করছে টেন্টের মধ্যে ও বাইরে। কমল একধারে দাঁড়িয়ে খুঁজতে লাগল তপেন রায়কে।
আরে কমলবাবু, ইখানে দাঁড়িয়ে! ক্লাবের বুড়ো মালী দয়ানিধি কমলকে দেখে নমস্কার করে এগিয়ে এল।
তপেনবাবুকে খুঁজছি, কোথায় বলতে পারো?
ভিতরে আছে বোধ হয়, যান না।
ইতস্তত করে কমল ভিতরে গেল।
তপেন রায় কয়েকটি ছেলের পথ আটকে প্লেয়ারদের ড্রেসিংরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলছে, না না, এখন নয়। ওরা এখন টায়ার্ড। এখন কোনও কথাবার্তা নয়।
কমল এগিয়ে গেল। তাকে দেখে তপেন রায় অবাক হয়েও স্বাভাবিক স্বরে বলল, কী খবর কমল?
একটু দরকার ছিল।
দেখছ তো কী অবস্থা, এখান থেকে নড়ার উপায় নেই, যা বলার বরং এখানেই বলো।
কমল নোটটা পকেট থেকে বার করে এগিয়ে ধরে বলল, টাকাটা দিতে এসেছি।
তপেন রায় কী ভেবে নিয়ে তাচ্ছিল্যভরে বলল, ও টাকা তুমিই রাখো। এত বছর যাত্রীতে খেলে গেলে—ট্রফিফ্রফি তো কিছুই ক্লাবকে দিতে পারোনি, টাকা ফেরত দিয়ে ক্লাবের কী আর এমন উপকার করবে? এবছর যাত্রী লিগ পাচ্ছেই, শুধু বড় টিম দুটোর সঙ্গেই আসল যা খেলা বাকি; তারপর শুধু বাজিই পুড়বে দশ হাজার টাকার। একশো টাকার ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় আমার নেই।
শুনতে শুনতে কমলের পা দুটো কেঁপে উঠল। মাথার মধ্যে লক্ষ গোলের চিকার। তবু ঠাণ্ডা গলায় বলল, বাজি পোড়ানো দেখতে আমি আসব। কিন্তু টাকা আপনাকে ফেরত নিতে হবে। যাত্রীর কাছে আমি ঋণী থাকব না, থাকতে চাই না।
ওদের ঘিরে বহু লোকের ভিড় জমে গেছে। গুললাদা এই সময় টেন্টে ঢুকল। ভিড় দেখেই কৌতূহলভরে এগিয়ে এল।
ব্যাপার কী? আরে কমল যে!
এক সময় দরকারে টাকা নিয়েছিলুম। ফেরত দিতে এসেছি, কিন্তু তপেনদা নিচ্ছেন না।
সেই টাকাটা গুলোদা, আপনিই তো বলেছিলেন দরকার নেই ফেরত নেবার। তপেন রায় মনে করিয়ে দিল ব্যস্ত ভঙ্গিতে।
অ। দিতে চায় যখন নিয়ে নাও তবে, গুলোদা অতি মিহি স্বরে বলল, যাত্রীর শেষ খেলা শোভাবাজারের সঙ্গে, যদি কমল কথা দেয় সেদিন খেলবে না, তা হলেই ফেরত নেব।
ভিড়ের মধ্য থেকে একজন বলল, খেললেই বা কমল গুহ, যাত্রী এবার দশ গোল ভরে দেবে শোভাবাজারকে।
স্মিত মুখে গুলোেদা বলল, সেইজন্যই তো বলছি, কমলের মতো এতবড় প্লেয়ারের টিম দশ গোল খাচ্ছে, এ দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারব না। এটা যাত্রীর পক্ষেও বেদনাদায়ক হবে। হাজার হোক এক সময় কমল তো যাত্রীর-ই ছিল।
ঠিক ঠিক, গুললাদা ঠিক বলেছেন। ভিড়ের মধ্যে একজন মাথা নেড়ে বলল, কমলদা, আপনি কিন্তু সেদিন খেলতে পারবেন না। আপনার ইজ্জতের সঙ্গে যাত্রীর ইজ্জতও জড়িয়ে আছে।
পাংশু কালো মুখ নিয়ে কমল হাসল। এরা আজ অপমান করার জন্য পন্থা নিয়েছে। করুণা দেখাবার। ওর ইচ্ছে করল নোটটা টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠতে—আমি এখনও শেষ হয়ে যাইনি, যাইনি। ঠিক তখনই কমলের বুকের মধ্যে এক বৃদ্ধের কণ্ঠ ফিসফিস করে উঠল ব্যালান্স, কমল, ব্যালান্স কখনও হারাসনি।
ম্লান চোখে কমল সকলের মুখের উপর দিয়ে চাহনি বুলিয়ে ধীর স্বরে বলল, টাকাটা ফেরত নিন। আমার আর খেলার ইচ্ছে নেই।
নোটটা তপেন রায়ের হাতে গুঁজে দিয়ে কমল বেরিয়ে এল যাত্রীর টেন্ট থেকে। মাথার মধ্যেটা অসাড় হয়ে গেছে। হাঁটু দুটো মনে হচ্ছে মাখনে তৈরি, এখনি গলে গিয়ে তাকে ফেলে দেবে। বুকের মধ্যে দপদপ করে জ্বলে উঠতে চাইছে শোধ নেবার একটা প্রচণ্ড ইচ্ছা। যে বিমর্ষতা, হতাশা তাকে এই কদিন দমিয়ে রেখেছে, সেটা কেটে গিয়ে এখন সে অপমানের জ্বালায় ছটফট করে উঠল। উদ্দেশ্যহীনের মতো ময়দানের মধ্য দিয়ে এলোপাথাড়ি হাঁটতে হাঁটতে কমল কখন যে শোভাবাজার টেন্টে পৌঁছে গেছে খেয়াল করেনি। ডাক শুনে তাকিয়ে দেখল, ভরত আর সলিল ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে। ভরত এগিয়ে এল, সলিল এল না।
আপনার কি অসুখ করেছে কমলদা? কেমন যেন শুকনো দেখাচ্ছে। অনেক দিন আসেন না, ভেবেছিলুম আপনার বাড়িতে যাব।
প্রশ্নটা এড়িয়ে কমল বলল, ক্লাবের খবর কী, বল।
খবর আর কী, যা হয়ে থাকে প্রতি বছর তাই হচ্ছে। তিনটে ড্র করে তিন পয়েন্ট ম্যানেজ হয়েছে, তবু এখনও ভয় কাটেনি।ভরত বিপন্ন হয়ে বলল, ভাল লাগে না কমলদা। এইভাবে ফাস্ট ডিভিশনে খেলার কোনও মানে হয় না।
সলিল কি খেলছে?
কেন, আপনি জানেন না! ও তো লাস্ট চারটে ম্যাচে খেলেছে, বেশ ভাল খেলছে। ইস্টবেঙ্গলের দিন হাবিবকে নড়াচড়া করতে দেয়নি। সব কাগজে ওর কথা লিখেছে।
তাই নাকি, আমি কাগজ পড়া ছেড়ে দিয়েছি। আর কী খবর আছে?
আর যা আছে সেটা খুব মজার। সত্য আর শম্ভু তো গোলাম আলিতে স্যুটের মাপ দিয়ে এসেছিল। সাত দিন পর ট্রায়াল দিতে গিয়ে শোনে, গুলোদা টেলিফোন করে আগেই জানিয়ে রেখেছিল, তার অর্ডার না পাওয়া পর্যন্ত কাঁচি ধরবে না, শুধু মাপটা নিয়ে রেখে দেবে। গুলোদা আর ফোন করেনি। শুনে সত্য আর শম্ভু তো ফুসছে, এভাবে বোকা বনে যাবে ওরা কল্পনাও করতে পারেনি। কথাটা কাউকে বলতেও পারছে না, কিল খেয়ে কিল চুরি করা ছাড়া ওদের আর উপায় নেই। এখন বলছে, রিটার্ন ম্যাচটায় যাত্রীকে দেখে নেবে।
কমল ফিকে হাসল মাত্র কথাগুলো শুনে। বলল, সরোজ কোথায়, প্র্যাকটিস কেমন চলছে?
কোথায় প্র্যাকটিস! সরোজদা তো প্রায় দশ দিন হল টেন্টই মাড়ায় না। শুনছি জামশেদপুর না দুর্গাপুরে চাকরি পেয়েছে। সলিল, স্বপন, রুদ্র, এরাই যা বল নিয়ে। সকালে নাড়াচাড়া করে। সকালে এখন এক কাপ চা আর দুটো টোস্ট ছাড়া আর সব বন্ধ করে দিয়েছে কেষ্টদা।
সলিল চাকরিটা করছে কি এখনও?
একদিন ওর বাবা এসেছিল খুঁজতে। সলিল কাজ ছেড়ে দিয়েছে, বাড়িতেও থাকে না। কোথায় থাকে কেউ জানে না। ওকে জিজ্ঞেস করেছি, ঠিকানা দেয়নি।
সলিলকে বলিস আমার সঙ্গে দেখা করতে।
কমল বাড়ি ফেরার জন্য রওনা হতেই ভরত মাথা চুলকে বলল, সেদিনের পর থেকে আর আপনি মাঠে আসেন না।
হ্যাঁ, আর ভাল লাগে না। মাঠ থেকে এবার চলে যাওয়াই উচিত। আমার কোনও ফোন এসেছিল কি?
জানি না তো।
.
১৫.
বাড়ি ফিরেই কমল শুনল যে, কালোর মা গজগজ করে চলেছে, বাইরের লোকের প্যান্ট আমি কেন কাচব? বাইরের লোকের খাওয়া এঁটো বাসন মাজতে হবে, এমন কথা তো বাপু ছিল না। মাইনে না বাড়ালে আমি আর বাড়তি কাজ করতে পারব না। ইত্যাদি ইত্যাদি?
বাইরের লোকটা আবার কে? কমল কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করে।
কেন, দাদাবাবুর যে বন্ধুটি থাকে!
থাকে! দাদাবাবুর বন্ধু?
কেন, আপনি জানেন না? কালোর মা বিস্ময়ে চোখ কপালে তোলার উপক্রম করতে কমল আর কথা বাড়াল না।
রাত্রে কমলের মনে হল, অমিতাভর ঘরে চাপা স্বরে কারা কথা বলছে। সকালে অমিতাভর ঘরের সামনে দিয়ে যাতায়াত করবার সময় খুঁটিয়ে ঘরের মধ্যে লক্ষ করে সে কিছুই বুঝতে পারল না। ভাবল, অমিতাভকে জিজ্ঞাসা করবে।
অফিসে বেরোবার সময় অমিতাভ তার কাছে কুড়িটা টাকা চাইল। এক সপ্তাহে চল্লিশ টাকা দিয়েছে, তাই কমল অস্বস্তিভরে বলল, হঠাৎ এত ঘন ঘন টাকার দরকার হচ্ছে যে? আমি যা মাইনে পাই তাতে এভাবে চললে কুলিয়ে ওঠা তো সম্ভব হবে না।
এক বন্ধুর অসুখ, তাকে ওষুধ কিনে দেবার জন্য— অমিতাভ ঢোঁক গিলে বলল।
কালোর মা বলছিল তোমার এক বন্ধু নাকি এখানে খায়?
তিন-চার দিন খেয়েছে। আর খাবে না।
টাকা দেবার সময় কমল বলল, খাওয়ার জন্য আমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না।
এরপর কমল লক্ষ করল, অমিতাভ যেন ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। গম্ভীর ভারিক্কি ভাবটা আর নেই, চলাফেরায় চঞ্চলতা দেখা যাচ্ছে, চেঁচিয়ে হঠাৎ গানও গেয়ে ওঠে, এমনকী একদিন সকালে উঠে চা তৈরি করে সে কমলকে ডেকে তুলেছে। কমল লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি বলে, খেলা ছেড়ে দিয়ে দেখছি অভ্যাস খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সকালের একসারসাইজটা আবার শুরু করতে হবে কাল থেকে।
আপনি খেলা ছেড়ে দিয়েছেন? অবাক হয়ে অমিতাভ জিজ্ঞাসা করে।
হ্যাঁ।
কেন?
কমল জবাব না দিয়ে বাজার রওনা হয়। সেইদিন শোভাবাজার টেন্টে গিয়ে সে শোনে, মহমেডানের সঙ্গে খেলায় বলাই ও অ্যামব্রোজ মারপিট করায় রেফারি দুজনকেই মাঠ থেকে বার করে দিয়েছে, আর শ্রীধরের হাঁটুর পুরনো চোটটায় আবার লেগেছে, যার ফলে তার দাঁড়াবার ক্ষমতা পর্যন্ত নেই। টেন্টে সকলেরই মুখ শুকনো, দুশ্চিন্তায় কপালে কুঞ্চন। খেলার মতো এগারো জন প্লেয়ার এখন শোভাবাজারের নেই। সহসম্পাদক অবনী মণ্ডল ওকে দেখে ছুটে এসে বলে, কমলবাবু, আপনার কাছেই যাব ভাবছিলুম! আপনাকে বাকি ম্যাচ তিনটে খেলতে হবে।
না। কমল গম্ভীর স্বরে বলে, আমি আর খেলব না। তারপর সে টেন্ট থেকে। বেরিয়ে পড়ে হতভম্ব অবনী মণ্ডলকে ফেলে রেখে।
অস্বস্তিপূর্ণ মন নিয়ে কমল বাড়ি ফিরল। শোভাবাজার এখন সত্যিই দুরবস্থায়। অথচ সে বলে এল খেলবে না। এই ক্লাব থেকেই সে গড়ের মাঠে খেলা শুরু করেছিল। ব্যাপারটা নেমকহারামির মতো লাগছে। ইচ্ছে করলে তিনটে ম্যাচ এখন সে অনায়াসে খেলে দিতে পারে। শেষ ম্যাচটা যাত্রীর সঙ্গে। গুলোদার বিদ্রুপভরা কথাগুলো কমলের কানে বেজে উঠল। তপেন রায়ের হাতে একশো টাকার নোটটা দেবার আগে সে বলেছিল, আর খেলব না। তখন দাউদাউ আগুন জ্বলছিল মাথার মধ্যে। আর এখন শুধু ছাই হয়ে পড়ে আছে তার প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছাটা।
অমিতাভর ঘর অন্ধকার। কমল নিজের ঘরে ঢুকে জামাপ্যান্ট বদলে ইজিচেয়ারে গা ঢেলে দিল আলো নিভিয়ে। কুড়ি বছরের খেলার জীবনের অজস্র কথা আর দৃশ্য মনের মধ্যে ভিড় করে ঠেলাঠেলি করছে। তার মধ্যে বার বার দেখতে পাচ্ছে পল্টুদাকে, শুনতে পাচ্ছে তাঁর গলার স্বর—প্র্যাকটিসটা আরও ভাল কর। হতাশা আসবে, তাকে জয় করতেও হবে…তুই খেলা ছেড়ে দিবি বলছিস, তার মানে তুই বড় খেলোয়াড় হতে পারিসনি।
না, পারিনি। কমল বার বার নিজেকে শোনাতে থাকে, পারিনি, পারিনি, আমি হতে পারিনি। আমার মধ্যে প্রশান্তি আসেনি। অনেক কিছুই অপূর্ণ রয়ে গেছে।
অমিতাভর ঘরের দরজা খোলার এবং আলো জ্বালানোর শব্দ হল। কমলের মনে পড়ল আজ সকালে সে স্কিপিং দড়িটা খুঁজে পায়নি। অমিতাভ কি কোনও কাজে নিয়ে গেছে তার ঘরে! জিজ্ঞাসা করার জন্য সে উঠল। আলো জ্বালল। চটি পরে অমিত বলে ডেকে ঘর থেকে বেরোবার সময় তার মনে হল, পাশের ঘরে দ্রুত একটা ঘষড়ানির শব্দ হল। দ্রুত অমিতাভর ঘরের দরজায় পৌঁছে সে দেখল, খাটের নীচে কেউ ঢুকে যাচ্ছে, পলকের জন্য দুটি পা শুধু দেখতে পেল।
চোর! কমল থমকে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও চেঁচাল না। পা দুটো তার চেনা মনে হল। প্যান্টের যতটুকু দেখতে পেয়েছে, সেটাও খুব পরিচিত। সলিল!
দুহাতে পাঁউরুটি নিয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়ে অমিতাভ থমকে তারপর আড়ষ্ট হয়ে গেল কমলকে খাটে বসে একটা বইয়ের পাতা ওলটাতে দেখে!
পাঁউরুটি! কেন, ভাত রান্না হয়নি?
আজ শরীরটা ভাল নয়, তাই
এতগুলো? এ তো প্রায় দুজনের মতো দেখছি!
কালকের জন্যও এনে রাখলুম।
কমল গম্ভীর মুখে আবার কয়েকটা পাতা উলটিয়ে গেল। অমিতাভ সন্তর্পণে ঘরের চারধারে চোখ বুলিয়ে নিল।
ফুটবল যারা খেলে তাদের তুমি ঘৃণা করো। যেমন আমায় করো। কমল অত্যন্ত মৃদু কণ্ঠে, কিন্তু প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট ভাবে ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল, তোমার মার মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী ভেবে তুমি কখনও আমায় সহজভাবে নিতে পারেনি, বাপ-ছেলের স্বাভাবিক সম্পর্ক আমাদের যেন হয়নি। হ্যাঁ, স্বীকার করি, তাকে অবহেলা করে আমি ফুটবলকেই বড় করে দেখেছি। আমি শুধু জানতে চাই, আমার প্রতি ঘৃণাটা তোমার আছে কি এখনও?
অমিতাভ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি বুঝতে পারছি না, হঠাৎ এসব কথা বলছেন কেন?
কৌতূহলে। তোমার কি কখনও কৌতূহল হয় না, খেলার জন্য তোমার মাকে অগ্রাহ্য করেছে যে লোক, তার খেলা একবারও দেখার?
হয়, কিন্তু ওই কারণে নয়। ফুটবলকে এত ভালবেসে শেষে অপমান ও তাচ্ছিল্য নিয়ে খেলা থেকে সরে যাচ্ছে যে লোকটি, তার খেলা একবার দেখতে ইচ্ছে করে।
কমল তীব্র চোখে তাকাল ছেলের দিকে। অমিতাভ অচঞ্চল।
শুধু এই জন্য ইচ্ছে করে?
না। খেলাকে ভালবাসলে মানুষ কী পরিমাণ পাগল হয়, সেটা দেখতে দেখতেই আমার কৌতূহল জেগেছে।
কাকে দেখে, সলিলকে?
অমিতাভ চমকে উঠে কমলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বিস্ময় তার সারা মুখে।
তুমি ওকে আশ্রয় দিয়েছ কেন? কমল কঠিন স্বরে প্রশ্ন করল।
ও আমাকে অবাক করেছে। সেদিন অমানুষিক মার খাবার পর বলেছিল, কমলদার মতো আমার মাথায় দাগ তৈরি হবে না, আমার মাথা ফাটেনি। এই বলে ও কেঁদেছিল। ও আশ্রয় চেয়েছিল, আমি আশ্রয় দিয়েছি। এই ঘরে। ভোরে বেরিয়ে যায়, দুপুরে আসে, বিকেলে বেরিয়ে রাত্রে আসে। ও নিজের বাপ-মা ভাই-বোনদের ত্যাগ করেছে। ওর মধ্যে আমি অনেক কিছু না বোঝা ব্যাপার বুঝতে পেরেছি।
কী বুঝেছ, কী বুঝেছ? কমল উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে উঠল। আমার কোনও দোষ ছিল না। খেলা শুধু শারীরিকই নয়, একটা মানসিক ব্যাপারও—সেটা বুঝেছ কি?
আপনার খেলা দেখার পর সেটা বুঝব।
তুমি আমার খেলা দেখবে! কমল হাত বাড়িয়ে ধীরে ধীরে হাতটা নামিয়ে নিল। অমিতাভ মাথাটা কাত করল। কমল পরদিন অফিস থেকে শোভাবাজার টেন্টে ফোন করল, আমি খেলব, যাত্রীর সঙ্গে খেলাটায়।