Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সৌরভ (১৯৮৪) || Humayun Ahmed » Page 2

সৌরভ (১৯৮৪) || Humayun Ahmed

আজিজ সাহেবের সঙ্গে দেখা

সকালবেলা নিচে নামতেই আজিজ সাহেবের সঙ্গে দেখা।

আজিজ সাহেব বিলুনীলুর বাবা। দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী। চোখেও দেখতে পান না। পায়ের শব্দে মানুষ চিনতে পারেন। আমি পা ঘষটে ঘষটে বাড়ি ঢুকলেও তিনি চিকন সুরে ডাকবেন–কে যায়? শফিক না?

আজিজ সাহেবের সঙ্গে দেখা হওয়া একটি দুর্ঘটনা বিশেষ। দেখা হওয়ামাত্র তিনি বাড়ির কোনো একটি সমস্যার কথা তুলবেন–

কল দিয়ে পানি লিক করছে।

বসার ঘরে সুইচটা নষ্ট, হাত দিলেই শাক করে।

শোবার ঘরের একটি জানালার পুডিং উঠে গেছে, যে-কোনো সময় কাঁচ খুলে পড়বে।

যে-লোক চোখে দেখে না এবং সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকে, সে এত সব লক্ষ করে কী করে, সে এক রহস্য। বাড়ির প্রসঙ্গ শেষ হওয়ামাত্র তিনি রাজনীতি নিয়ে আসেন। তাঁর রাজনীতিরও কোনো আগামাথা নেই। একেক দিন একেক কথা বলেন। রাজনীতির পরে আসে স্বাস্থ্যবিধি। পৃথিবীর যাবতীয় ব্যাধির কোনো-না–কোনো টোটকা তাঁর জানা আছে। জলাতঙ্ক রোগের একমাত্র অষুধ যে রসুনের খোসা, সেটি তাঁর কাছ থেকেই আমার শোনা।

সকালবেলা তাঁকে ধরাধরি করে বারান্দার ইজিচেয়ারে শুইয়ে দেওয়া হয়। দুপুর পর্যন্ত অনবরত ভ্যাজর ভ্যাজার করতে থাকেন। তিনি বারান্দায় থাকলে আমি পারতপক্ষে নিচে নামি না। আজকেও তিনি বারান্দাব্য ছিলেন না। পায়ের শব্দ শুনে শোবার ঘর থেকে ডাক দিয়েছেন কে, শফিক না? আসি তো দেখি এদিকে। বাথরুমের ফ্লাশটা থেকে ঘােসর ঘােসর শব্দ হয়। পানির কোনো ফ্লো নাই।

আমি কাদেরকে বলব। আজিজ সাহেব। সে মিস্ত্রী নিয়ে আসবে।

আস তো ভেতরে, কথা আছে তোমার সঙ্গে।

আমার একটা জরুরী কাজ আছে, আজিজ সাহেব।

এক মিনিট বসে যাও। ও নীলু, চা দে তো।

আজিজ সাহেব, আমার এখন না গেলেই না।

চা খেতে আর কয় মিনিট লাগে? নীলু, তাড়াতাড়ি চা দে।

বাধ্য হয়ে ঘরে ঢুকতে হয়। আজিজ সাহেব ঘরে ঢোকামাত্র গলার স্বর নামিয়ে বললেন, কালকে রাতে কিছু শুনলে?

গুলীর কথা বলছেন?

আহ, আস্তে বল। চারদিকে স্পাই। ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পারছ?

কিসের কথা বলছেন?

আরো মিলিটারি তো সব কচুকাটা হয়ে গেল। আছ কোথায় তুমি?

তাই নাকি?

ভিক্ষা চাই না, মা, কুত্তা সামলা অবস্থা এখন। হা হা হা। মিলিটারিরা আর বড়ো জোর এক মাস আছে। বিশ্বেস না হয় লিখে রাখ। গুণে-গেঁথে ত্রিশ দিন।

গণ্ডগোলের দিন থেকেই তিনি মিলিটারিকে হয় এক মাস নয়। পনের দিন সময় দিচ্ছেন। তাঁর হিসাবে রোজ দু থেকে তিন হাজার মিলিটারি খতম হয়ে যাচ্ছে। চিটাগাং এবং কুমিল্লা–এই দুই জায়গা থেকে টাইট দেওয়া হচ্ছে।

জিয়া সাহেব কি সহজ লোক? বাঘের মামা ট্যাগ। পাঞ্জাবী সব কাঁচা খেয়ে ফেলবে না? তুমি ভাবছ কী?

আজিজ সাহেব এমন মুখভঙ্গি করলেন, যেন পাঞ্জাবী মিলিটারিদের আমি লেলিয়ে দিয়েছি। আমি বিরস মুখে বললাম, আজিজ সাহেব, আজ উঠতে হয়। চা আজকে আর খাব না।

আহু, বস দেখি। এই নীলু, চা হয়েছে?

নীলু সাড়াশব্দও করল না, চা নিয়েও এল না। আজিজ সাহেব শুরু করলেন যুক্তফ্রন্টের রাজনীতি। ওদের ভুল থেকে আমাদের কী কী শেখা উচিত ছিল, এবং না শেখাতে আমাদের কী হয়েছে। এই সব। আমার বিরক্তির সীমা রইল না। প্ৰায় আধা ঘণ্টা পর নীলু এসে বলল, চা দেরি হবে। চিনি নেই। আনতে গেছে। তাকিয়ে দেখি, নীলু। মুখ টিপে হাসছে। চোখে চোখ পড়ামাত্র অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে বলল, সত্যি চিনি নেই। বিশ্বেস করুন।

ছাড়া পেলাম এগারটায়। টিপা-টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে তখন। এই সময় মগবাজারে বড়ো আপার বাসায় যাবার কোনো অর্থ হয় না। প্রথমত, দুলাভাই বাসায় থাকবেন না। দ্বিতীয়ত, বৃষ্টিতে ভিজলে আমার টনসিল ফুলে ওঠে। সবচেয়ে ভালো হয় রফিকের বাসায় গিয়ে টেলিফোন করলে। কিন্তু তারও সমস্যা আছে। টেলিফোন রফিকদের শোবার ঘরে। টেলিফোন করতে গেলেই বাড়ির মেয়েরা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। শুনতে চেষ্টা করে, কী কথাবার্তা হচ্ছে। এবং টেলিফোনের শেষে রফিকের মা প্রচুর চিনি দিয়ে হিমশীতল এক কাপ চা খেতে দেন। সেই চায়ে দুধের সর এবং কালো রঙের পিঁপড়ে ভাসতে থাকে।

শফিক সাহেব, আপনার সঙ্গে একটা কথা।

লোকটিকে চিনতে পারলাম না। লম্বা দাড়ি। হালকা নীল রঙের একটা লম্বা পাঞ্জাবি-কুল নেমে এসেছে হাঁটু পর্যন্ত। গা থেকে আতরের গন্ধ আসছে।

আমি আব্দুল জলিলের বড়ো ভাই।

ও আচ্ছা। কেমন আছেন?

আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। জলিলের বৌ আর বাচ্চাটারে নিতে আসছি। আমি থাকি চানপুরে। মাস্টারী করি।

কিছু বলতে চান আমাকে?

জ্বি

বলুন।

জনাব, আমি শুনলাম। আপনি জলিলের খোঁজখবর করতেছেন।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। বলে কি এই লোক! আমি খোঁজ করব কি? আর খুঁজবই—বা কোথায়?

আপনার অনেক জানাশোনা আছে। একটু যদি দয়া করেন।

ভদ্রলোক চোখ মুছতে লাগলেন। এক জন বয়স্ক লোকের কানার মতো কুৎসিত আর কিছুই নেই। আমি ধমক দিয়ে কান্না থামাতে চাইলাম, কাঁদবেন না।

ঢাকা শহরে আমার চেনা-জানা কেউ নাই শফিক সাব।

দিন কাল খুব খারাপ এখন। চেনাজানাতে কাজ হয় না।

তা ঠিক ভাই। খুব ঠিক। কী করব বলেন, মনটা পেরেশান।

মন পেরেশান করে তো লাভ নেই। মন শক্ত করেন।

চেষ্টা করি, খুব চেষ্টা করি। বিনা দোষে জেলখানাতে আছে মনে হইলেই মন কান্দে।

জেলখানাতে আছে, বলল কে?

আপনার সাথে যে ছেলেটা থাকে, কাদের মিয়া–সে বলল। অতি ভালো ছেলে। বিশিষ্ট ভদ্রঘরের সন্তান। দুই-তিন বার খোঁজখবর নেয়। গতকাল এক দরবেশ সাহেবের তাবিজ এনে দিয়েছে। দরবেশ বাচ্ছ ভাই। খুব বড়ো আলেম। নাম শুনেছেন বোধ হয়।

আমি সাধ্যমত খোঁজখবর নেব। তবে সময়টা খারাপ, ইচ্ছা থাকলেও কিছু করা যায় না। ও কি, আবার কাঁদেন কেন?

আল্লাহ পাক আপনার ভালো করবেন, শফিক ভাই।

আমার মন খারাপ হয়ে গেল। রাস্তায় নেমে দুটি জিনিস ঠিক করে ফেললাম। রফিকের বাসায় গিয়েই টেলিফোন করব, আর রফিককে জিগেস করব লোকজন হারিয়ে গেলে কোথায় খোঁজ করতে হয়। রফিক অনেক খবরাখবর রাখে। সে কিছু একটা করবেই।

রফিক বাসায় ছিল না। তার ছোট ভাই গম্ভীর হয়ে বলল, টেলিফোন করতে এসেছেন? আমাদের টেলিফোন নষ্ট।

রফিকের এই ভাইটিকে আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না। সব সময় চালিয়াতি ধরনের কথাবার্তা বলে।

আপনি কি বসবেন? দাদা ঘণ্টাখানিকের মধ্যে ফিরবে।

তাহলে বসব। ওর সঙ্গে দরকার আছে আমার।

বসার ঘরের দরজা খুলে সে আমাকে নিয়ে বসাল। কালকে রাত্রে আপনি কি গুলীর শব্দ শুনেছেন? আমি অম্লান বদনে মিথ্যা বললাম, না। কাল খুব ভালো ঘুম হয়েছে, কিছু টের পাই নি।

কালকে ভীষণ গুলী হয়েছে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। কী জন্যে হয়েছে জানেন?

না, আমি কী করে জানব?

সে এমন ভাবে তাকাল, যেন আমি একটি গরুবিশেষ।

আপনার কি কোনো কিছুই জানতে ইচ্ছা করে না?

না, তেমন করে না।

ও আচ্ছা।

ঘণ্টাখানিক বসে থেকেও রফিকের খোঁজ পাওয়া গেল না। সরভাসা চা খেলাম পরপর দু কাপ। রফিকের মা-ও যথারীতি এক ফাঁকে এসে আহাজারি করে গেলেন।

রফিকটার পড়াশোনা হয় নাই কুসঙ্গে থাকার জন্য। যত ছোটলোকের সাথে তার খাতির। তুমি আবার কিছু মনে করো না বাবা। তোমাকে কিছু বলছি না।

না খালা, মনে করার কী আছে।

আমি আবার মনের মধ্যে যা আসে বলে ফেলি।

এইটাই ভালো। বলে ফেলাই ভালো।

ঘর থেকে বের হয়ে বড়ো রাস্তা পর্যন্ত এসে দেখি রফিক আসছে। হনাহন করে। তার দু হাতে দুটি প্রকাণ্ড বাজারের ব্যাগ। নিখোঁজ লোকদের কোথায় খুঁজতে হবে জিজ্ঞেস করা মাত্রই সে বলল, লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে থােক। আমি ব্যাগ দুটি রেখে আসছি।

আমরা গেলাম জনাব ইজাবুদ্দিন সাহেবের বাড়ি। ইজাবুদ্দিন সাহেব শান্তি কমিটির এক জন মেম্বার। হলুদ রঙের একটা দোতলা বাড়িতে থাকেন। বাড়ির নাম ভাই ভাই কুটির। নেমপ্লেটে লেখা এম. এ. (গোল্ড মেডালিষ্ট) এল-এল. বি.। রফিক বলল, লোকটার সবচেয়ে বড়ো গুণ হল–বিরক্ত হয় না। সব সময় হাসিমুখ।

কথা খুবই ঠিক। ইজাবুদ্দিন সাহেব মন দিয়ে আমার কথা শুনলেন। খাতা বের করে নাম-ধাম লিখে রাখলেন এবং বললেন, মিলিটারি জেলে আছে কিনা সেখবর তিনি দু দিনের মধ্যে এনে দেবেন। যখন বেরিয়ে আসছি, তখন ইজাবুদ্দিন সাহেব হাসিমুখে বললেন, আপনার বাবার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। বিশিষ্ট ভদ্রলোক ছিলেন তিনি। তাঁর বড়ো মেয়ের বিয়েতে আমি উপস্থিত ছিলাম। খাওয়াদাওয়া নিয়ে দারুন ঝামেলা হয়েছিল।

আমি বললাম, আমি এসে খোঁজ নিয়ে যাব।

না না, আপনার আসতে হবে না, আমি খবর দেব। বাড়ি আমি চিনি, কত বার গিয়েছি। শরিফ আদমী ছিলেন আপনার বাবা।

রফিককে ছেড়ে দিয়ে নিউমার্কেট পর্যন্ত চলে এলাম। হাঁটা আমার পক্ষে বেশ কষ্টকর। কিন্তু কোনো একটি বিচিত্র কারণে রিকশায় উঠলেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। নিঃশ্বাস নিতে পারি না।

নিউ মার্কেটের সামনে একটি প্রকাণ্ড মিলিটারি ট্রাক দাঁড়িয়ে ছিল। তিন-চার জন কালো পোশাক পরা মিলিটারি (নাকি মিলিশিয়া? কে যেন বলেছিল কালো পোশাকেরগুলি মিলিশিয়া–আরো ভয়ঙ্কর) জটিলা পাকাচ্ছিল। সবার চেহারা দেখতে এক রকম। এক জন একটু দূরে দাঁড়িয়ে লম্বা একটা চুরুট টানছে। এর চেহারা অদ্ভুত সুন্দর। পাতলা পাতলা ঠোঁট, টানা চোখ, রাজপুত্রের মতো চেহারা।

এরা দাঁড়িয়ে থাকার জন্যেই এই দিক দিয়ে লোক চলাচল একেবারেই নেই। এক জন বুড়ো মতো মানুষ। শুধু একটি ওজনের যন্ত্র নিয়ে শুকনো মুখে বসেছিল। দুটি মিলিটারি ওকে কী সব জিজ্ঞেস করে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে। এক জন আবার দেখি, ওজনের যন্ত্রটায় উঠে দাঁড়িয়েছে। আমি বিনা দ্বিধায় ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম। মিলিটারি। আমাকে কখনো কিছু জিজ্ঞেস করে না। আইডেনটিটি কার্ড দেখতে চায় না। ছাত্র না। চাকরি করি, তাও জানতে চায় না। কারণ আমার ডান পাটি বাঁকা। আমি ডান দিকে ঝাঁকে বিচিত্র ভঙ্গিতে হাঁটি। লাঠি দিয়ে শরীরের ভার অনেকটা সামলাতে হয়। আমার দিকে ওদের কোনো আগ্রহ নেই।

শারীরিক অক্ষমতা যে এমন একটি সুখকর ব্যাপার হতে পারে, তা আমার জানা ছিল না। আমাকে দেখে রাজপুত্রের মতো সেই মিলিটারিটি পরিষ্কার বাংলায় বলল, ভালো আছেন?

ওজন-মাপা লোকটি অবাক হয়ে তাকাচ্ছে আমার দিকে। আমি হাসিমুখে রাজপুত্রটিকে বললাম, আমি ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন তো ভাই?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress