লাল রঙের তিল
ঠিকানা নিয়ে যে-বাড়িতে উপস্থিত হলাম সেটি তালাবন্ধ। গেটে টু লেট ঝুলছে। বাড়িওয়ালা আশেপাশেই ছিলেন, আমাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এলেন, বাড়ি ভাড়া করবেন? খুব সস্তায় পাবেন। সারভেন্টের জন্য আলাদা বাথরুম আছে। এখানে। গত বছর দেওয়াল ডিসটেম্পার করলাম।
বাড়িভাড়ার জন্যে আসি নি, খোরশেদ আলি সাহেবের খোঁজ করছি।–শুনে ভদ্রলোক খুব হতাশ হলেন।
এরা থাকে না। এখানে–জুন মাসে বাড়ি ছেড়ে গেছে। অঞ্চলটা নাকি নিরপাদ না। বলেন দেখি কোন অঞ্চলটা নিরাপদ? আমি তো এখানেই আছি, আমার কিছু হয়েছে? বলেন দেখি?
খোরশেদ আলি সাহেবরা এখন থাকেন কোথায় জানেন?
ঠিকানা আছে। গিয়ে দেখবেন, সেইখানেও নেই। নিরাপদ জায়গা যারা খোঁজে তারা এক জায়গায় থাকে না। ঘোরাঘুরি করে।
ভদ্রলোক ঠিকানা বের করতে এক ঘণ্টা লাগালেন। শেষ পর্যন্ত ঠিকানা যেটা পাওয়া গেল, সেটায় বাড়ির নম্বর দেওয়া নেই। লেখা আছে মসজিদের সামনের হলুদ রঙের দোতলা বাড়ি। বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক গম্ভীর হয়ে বললেন, মসজিদের সামনেই বাড়ি, তাই মনে করেছে খুব নিরাপদ। বুদ্ধি নেই, লোক তো গাছে হয় না, মায়ের পেটেই হয়।
বহু ঝামেলা করে মসজিদের সামনের হলুদ রঙের দোতলা বাড়ি খুঁজে বের করলাম। বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের কথাই ঠিক। খোরশেদ আলি সাহেব এখানেও নেই। কোথায় গেছেন, তাও কেউ জানে না। বাসায় ফেরার পথে মনে হল, লুনার চাচা ভদ্রলোক হয়তো আমার ঠিকানাই হারিয়ে ফেলেছেন। মানুষের স্বভাবই হচ্ছে সবচেয়ে জরুরী কাগজটা হারিয়ে ফেলা। ঠিকানা হারিয়ে ভদ্রলোক নিশ্চয়ই বড়ো আপার বাসায় খোঁজাখুঁজি করছেন। অবশ্যি এ-যুক্তি তেমন জোরাল নয়। বড়ো আপার বাসায় দারোয়ান শমসের মিয়া আমার ঠিকানা খুব ভালো করে জানে। তবে এটা অসম্ভব নয় যে, শমসের মিয়াকে বিদায় দিয়ে নতুন লোক রাখা হয়েছে। খুব সম্ভব বিহারী কেউ। গাড়ির ড্রাইভার যেমন বিহারী রাখা হয়েছে সে-রকম। এযুক্তি যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য মনে হওয়ায় আমি ক্ষুধায় তৃষ্ণায় ক্লান্ত হয়ে বড়ো আপার বাসায় দুপুর দুটিার দিকে উপস্থিত হলাম। না, শমশের মিয়াই আছে এবং কেউ এবাড়িতে আসে নি। আসবার মধ্যে পিয়ন এসেছে।
খাওয়ার কিছু আছে শমসের মিয়া?
ঘর তো তালা দেওয়া, ছোট ভাই। চাবি মেমসাবের কাছে।
তোমার কাছে কিছু নাই?
মুড়ি আছে।
দাও দেখি। তেল মরিচ দিয়ে মেখে। চিঠিপত্র কী আছে দেখি।
চিঠি এসেছে অনুর কাছ থেকে। বড়ো আপার কাছে লেখা দীর্ঘ চিঠি (অনু আমাকে কখনো চিঠি লেখে না, নববর্ষের সময় কার্ড পাঠায়)। বড়ো আপার কাছে লেখা চিঠি আমার পড়তে কোনো দোষ নেই, এই চিন্তা করে চিঠি খুলে ফেললাম, চিঠি পড়ে বড়োই কষ্ট লাগল। এই যে, এত বড়ো একটা দুঃসময় যাচ্ছে আমাদের, সেই সম্পর্কে শুধু একটি লাইন লেখা, দেশের খবর শুনে খুব চিন্তা লাগছে, সাবধানে থাকবি। তার পরপরই তিন পৃষ্ঠা জুড়ে মন্টানা যাওয়ার পথে কী ঝামেলা হয়েছিল সেটা লেখা : আইডাহো ছাড়ার পাঁচ ঘণ্টা পর গাড়ির ট্রান্সমিশন গোল বন্ধ হয়ে। হাইওয়েতে দু ঘণ্টা বসে থাকতে হল। শেষ পর্যন্ত হাইওয়ে পেট্রল পুলিশ এসে রাত তিনটায় একটা অতি বাজে হোটেলে নিয়ে তুলল। পেটে প্রচণ্ড খিদে। ভেণ্ডিং মেশিনে আপেল আর মিল্ক চকোলেট ছাড়া কিছু নেই। বাধ্য হয়ে আপেল আর চকোলেট খেয়ে ঘুমাতে যেতে হল সবাইকে। আর ঘুম কি আসে? এয়ারকুলারটা দিয়ে ঘড়ঘড় শব্দ।
শমসের মিয়া এক গামলা মুড়ি নিয়ে এল। কাঁচামরিচ যে কটা ঘরে ছিল, সবই বোধ হয় দিয়ে দিয়েছে। ঝালের চোটে চোখে পানি আসার যোগাড়। শমশের মিয়া গলা নিচু করে বলল, জায়গায়-জায়গায় নাকি যুদ্ধ শুরু হইছে, কথাডা সত্যি ছোট ভাই?
সত্যি। দেশ স্বাধীন হইলে গরিবদুঃখীর কোনো চিন্তা থাকত না, কী কন ছোট ভাই?
না থাকারই কথা।
খাওয়া–খাদ্য থাকব বেশুমার।
তা থাকবে।
খারাপের পরে বালা দিন আয়, এইটা বিধির বিধান।
খুবই খাঁটি কথা, শমসের মিয়া।
চিন্তা করলে মনটার মইদ্যে শান্তি হয়।
বাড়ি ফিরে শুনি লুনার চাচা আজকেও আসেন নি। লুনার জ্বরও বেড়েছে। কাদের এক জন ডাক্তার নিয়ে এসেছিল। ওষুধপত্র দিয়েছে আর বলেছে রক্ত পরীক্ষা করতে।
লুনা আমাকে দেখে বলল, কাউকে পান নি?
কাল ঠিক পাব। সকালেই গুলিস্তান থেকে বাস নিয়ে চলে যাব নারায়ণগঞ্জ।
আপনি যে সারা দিন ঘোরাঘুরি করেন, আপনার ভয় লাগে না?
নাহ, আমার অচল পা দেখেই মিলিটারিরা মনে করে, একে নিয়ে কোনো কামেলা হবে না।
লুনা গম্ভীর হয়ে বলল, আপনি ভাবছেন আপনার কথা শুনে আমি হাসব? আমাকে যতটা ছোট। আপনি ভাবছেন, তত ছোট আমি না। আমি অনেক কিছু বুঝি।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। লুনা শান্ত স্বরে বলল, এই যে আমার কাল রাত থেকে জ্বর, আপনি কি আমার গায়ে হাত দিয়ে দেখেছেন–কতটা জ্বর? আপনি কি মনে করেন, আমি জানি না কেন আপনি এ-রকম করছেন? আমি ঠিকই জানি।
কি জান?
লুনা থেমে থেমে বলল, গায়ে হাত দিলেই আমি অন্য কিছু ভাবব, বলেন, ভাবছেন না? আমি সব বুঝতে পারি। আমি যদি কালো, কুৎসিত একটা মেয়ে হতাম।–আপনি ঠিকই আমার গায়ে হাত দিয়ে জ্বর দেখতেন। দেখেন টিকটিকি টিকটিক করছে, তার মানে সত্যি।
আমি লুনার কপালে হাত দিয়ে দেখি বেশ জ্বর গায়ে। স্বাভাবিক সুরে বললাম, লুনা তুমি শুয়ে থাক, আমি ভাত খেয়ে আসছি। আর তুমি যা বলেছ সেটা ঠিক। খুবই ঠিক।
রান্নাঘরে ঢুকতেই মতিনউদ্দিন সাহেব বললেন, খতমে জালালীটা শুরু করা দরকার। লুনার চাচা আসছে না। এদিকে আবার জ্বরাজ্বরি। এক লাখ পাঁচশ হাজার বার দোয়া ইউনুস পড়লেই সব ঠিক হয়ে যাবে। খুব শক্ত খতম এটা।
ভাত খেতে বসে শুনলাম দূরে কোথায় যেন গোলাগুলী হচ্ছে। থেমে থেমে বন্দুকের আওয়াজ। মতিন সাহেব মাখা ভাত রেখে উঠে পড়লেন। তাকিয়ে দেখি তাঁর পা ঠকঠক করে কাঁপছে। কাদের বলল, ভয়ের কিছু নাই। নিশ্চিন্ত মনে ভাত খান!
আমার খিদে নেই। বমি বমি লাগছে।
খানিকক্ষণ পর ভারি ভরি দুটি ট্রাক গেল। মতিন সাহেব ভীত স্বরে বললেন, সব বাতিটাতি নিভিয়ে ফেলা দরকার।
তিনি দিশাহারার মতো জানালা বন্ধ করতে ছুটলেন। কাদের বলল, লক্ষণ খারাপ ছোড ভাই।
রাত দশটায় হঠাৎ বাদশা মিয়া এসে হাজির। সে খুব একটা খারাপ খবর নিয়ে এসেছে। বিহারীরা দল বেঁধে লুটপাট শুরু করেছে। মানুষও মারছে। শুরু হয়েছে তাজমহল রোড, নূরজাহান রোড অঞ্চল থেকে। খবর সত্যি হলে খুবই চিন্তার ব্যাপার। কাদেরের মুখ শুকিয়ে গেল।
আমি বললাম, কোথেকে খবর পেয়েছিস?
ঠিক খবর স্যার। এক চুল মিথ্যা না।
লুনার ঘরে গিয়ে দেখি সে জেগে আছে। আমাকে দেখেই বলল, ঐ ছেলেটি কী বলছে?
না, কিছু না।
বলেন আমাকে, কী বলছে?
কোন জায়গায়?
শুরু হয়েছে মোহাম্মদপুরে।
মোহাম্মদপুর কত দূর এখান থেকে?
দূর আছে।
আপনি ঠিক করে বলেন। কেন আমাকে লুকাচ্ছেন?
বেশি দূর না।
বাদশা মিয়া থাকল না। কাৰ্য্য হবে দশটা থেকে। তার আগেই দরবেশ বাচ্চু ভাইয়ের ঘরে পৌঁছান দরকার। সেখানে পুরুষমানুষ কেউ নেই। বাচ্চু ভাইয়ের ছেলের বয়স মাত্র চার বছর।
আমরা বাতিটাতি নিভিয়ে সমস্ত রাত জেগে বসে রইলাম। মাঝরাতের দিকে সোবহানবাগের দিক থেকে খুব হৈ-চৈ ও চিৎকার শোনা গেল। এর কিছুক্ষণ পর একনাগাড়ে দীর্ঘ সময় গুলীর শব্দ হতে লাগল। আমি দিশাহারা হয়ে গেলাম।
কাদের, কী করা যায়?
আল্লাহর নাম নেন ছোড ভাই। আল্লাহ্ হাফেজ।
লুনা কিছুতেই বিছানায় শুয়ে থাকতে রাজি হল না। অন্ধকার বারান্দায় আমাদের সঙ্গে সারা রাত বসে রইল। ভোর রাতে মাইকে করে বলা হল এই অঞ্চলে বিকাল তিনটা পর্যন্ত কার্ফ বলবৎ থাকবে।
দিনটি মেঘলা। দুপুর থেকে টিপটপ করে বৃষ্টি পড়তে লাগল। আমি নিচতলায় আজিজ সাহেবের ঘরের সামনে চুপচাপ বসে রইলাম। আজিজ সাহেব বা নেজাম সাহেব কারোর কোনো খোঁজখবর নেই। নেজাম সাহেবের নামে একটি রেজিষ্টি চিঠি অনেক দিন থেকে পড়ে আছে। লোকটি কোথায় আছে কে জানে?
ছোড ভাই, আপনের চা।
কাদের শুধু চা নয়, একটি পিরিচে দুটি বিঙ্কিটও নিয়ে এসেছে।
কী ব্যাপার, চা কেন?
ছোড ভাই, এই শেষ কাপ চা বানাইলাম।
আমি অবাক হয়ে তাকালাম।
আর দেখা হয় কি না-হয়।
ব্যাপার কী।
আমি রফিক ভাইয়ের সাথে মেঘালয় যাইতেছি ছোড তাই।
কবে?
আইজই যাওনের কথা। কার্ফু তুললেই রওনা দেওনের কথা।
আগে বলিস নি কেন?
কাদের চুপ করে রইল। এক সময় মৃদু স্বরে বলল, কার্ফু ভাঙলেই আমি লুল আফার জন্যে ডাক্তারের ব্যবস্থা কইরা রফিক ভাইয়ের বাসায় যাইয়াম। এখন ডাক্তার পাইলে হয়।
তাকিয়ে দেখি, কাদের শার্টের হাতায় চোখ মুছছে।
বেলা সাড়ে-তিনটায় কাদের সত্যি চলে গেল। মতিনউদ্দিন সাহেব কিছুই জানেন না বলে মনে হল। আমাকে বললেন, কাদেরের কাণ্ড দেখেছেন, তিন ঘণ্টার জন্যে কার্ফু রিল্যাক্স করেছে–এর মধ্যেই তাকে বেরুতে হবে। কথা বললে তো শোনে না। শেষে একার জন্যে সবাই মারা পড়ব।
মতিনউদ্দিন সাহেব গম্ভীর হয়ে চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন। তাঁর দৃষ্টি কেমন যেন উদভ্ৰান্ত। আমি বললাম, আপনার কি শরীর ঠিক আছে?
জ্বি, ঠিক আছে।
দেখছেন কেমন ঢালা বর্ষণ শুরু হয়েছে?
জ্বি দেখলাম।
লুনা কি ঘুমাচ্ছে?
মতিন সাহেব হঠাৎ বললেন, মেয়েটার কাছে গিয়ে বসেন। ওর শরীর খুব খারাপ। সহজ স্বাভাবিক ভালোমানুষের মতো কথাবার্তা।
লুনা জেগে ছিল। জ্বরের আচে তার ফর্সা গাল লালচে হয়ে আছে। চোখ দুটিও ঈষৎ রক্তবর্ণ।
খুব বেশি খারাপ লাগছে?
হ্যাঁ।
কাদের এক্ষুণি ডাক্তার পাঠাবে।
আপনি একটু বসবেন আমার কাছে?
আমি তার মাথার কাছে গিয়ে বসলাম। লুনা ছোট একটি নিঃশ্বাস ফেলল। আমার দিকে তাকিয়ে থেমে থেমে বলল, একদিন সব আবার আগের মতো সবে, ঠিক না?
নিশ্চয়ই হবে, খুব বেশি দেরিও নেই।
সেই সময় আপনাকে আমাদের বাসায় কয়েক দিন এসে থাকতে হবে। মতিন সাহেবকে আর কাদেরকেও।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। ভালোই হবে।
তখন কিন্তু হেন—তেন অজুহাত দিতে পারবেন না।
আচ্ছা, ঠিক আছে।
আপনার থাকার ইচ্ছা নেই, হাসছেন মনে মনে।
অ্যারে না।
আর যখন সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে, তখন কিন্তু আমি প্রায়ই আপনার এখানে বেড়াতে আসব।
তা তো আসবেই।
তখন আমার সঙ্গে অনেক কথা বলতে হবে। তখন যদি আপনি মনে করেন যে বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে আমি কী কথা বলব। তাহলে খুব রাগ করব।
না, রাগ করতে দেব না।
আমি কিন্তু মোটেই বাচ্চা মেয়ে না। আমি অনেক কিছু জানি। ওকি, আপনি হাসছেন কেন?
কই, হাসছি কোথায়?
মনে মনে হাসছেন। আমি ঠিক বুঝতে পারছি। যান, আপনার সঙ্গে কথা বলব না আমি।
লুনা ঝিম মেরে গেল। দীর্ঘ সময় কোনো কথাবার্তা বলল না। আমি চুপচাপ কাছে বসে রইলাম। কাদের কি ডাক্তারকে বলতে ভুলে গিয়েছে? ভোলবার কথা তো নয়।
লুনা সমস্ত দিন কিছুই খায় নি। আমি এক গ্লাস দুধ এনে দিলাম, সে তা স্পর্শও করল না। এক সময় গাঢ় রক্তবাণ চোখ মেলে বলল, কাদের এবং মতিন সাহেব এদের একটু ডেকে জিজ্ঞেস করুন তো ওরা আমাদের বাসায় থাকবে কিনা।
নিশ্চয়ই থাকবে।
তবু আপনি জিজ্ঞেস করুন।
মতিন সাহেবকে ডেকে আনলাম। লুনা জড়িত স্বরে বলল, আপনি কি থাকবেন আমাদের বাসায় কিছু দিন? থাকতে হবে। না বললে শুনব না।
মতিন সাহেব মুখ কালো করে বললেন, জ্বর মনে হয় খুব বেশি?
আমি বললাম, হ্যাঁ, অনেক বেশি। কাদের ডাক্তার পাঠাবে।
কখন পাঠাবো?
কার্ফু ভাঙার আগেই পাঠাবে।
লুনা বলল, কোনো ডাক্তার আসবে না। কেউ আসবে না আমার জন্যে।
ডাক্তার সত্যি সত্যি এল না। সন্ধ্যার আগে আগে বাদশা মিয়া এসে উপস্থিত। জানা গেল কাদের দু জন ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল, তাদের এক জন বলেছেন পরদিন সকালবেলায় আসবেন। অন্য জন বলেছেন হাসপাতালে নিয়ে যেতে।
সন্ধ্যা ছটা থেকে আবার কার্য্য। লুনা আচ্ছন্নের মতো পড়ে আছে। মাঝেমাঝে বেশ সহজভাবে কথা বলে পরক্ষণেই নিজের মনে বিড়বিড় করে। এক বার খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, ঠিক করে বলুন তো, আমার চেয়েও সুন্দরী কোনো মেয়ে দেখেছেন? আমাকে খুশি করবার জন্যে বললে হবে না। আমি ঠিক বুঝে ফেলব।
আমি চুপ করে রইলাম। লুনার মুখে আচ্ছন্ন।
চুপ করে থাকলে হবে না, বলতে হবে।
তোমার চেয়ে কোনো সুন্দরী মেয়ে আমি দেখি নি, লুনা।
সত্যি?
হ্যাঁ।
আমার গা ছুঁয়ে বলুন।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লুনার অবস্থা খুব খারাপ হল। মনে হল লোকজন ঠিক চিনতে পারছে না। মতিন সাহেব ঘরে ঢুকতেই বলল, আপনি আমার আম্মিকে একটু ডেকে দেবেন?
মতিন সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
ডেকে দিন না। বেশিক্ষণ কথা বলব না, সত্যি বলছি।
যাব। আপনি ওর কাছে বসে থাকুন। হাসপাতালে নিতে হবে।
মতিন সাহেবের ভাবভঙ্গি অত্যন্ত স্বাভাবিক। সহজ সাধারণ মানুষের মতো কাপড় পরলেন। বাদশা অবাক হয়ে বলল, কার্ফুর মইধ্যে যাইবেন?
হ্যাঁ।
আমি বললাম, সত্যি সত্যি বেরুচ্ছেন মতিন মাহেব?
হ্যাঁ। কাদের মুক্তিবাহিনীতে গেছে শুনেছেন?
শুনেছি।
বাদশা বলল–খুব নাকি কাঁদছিল। কাঁদার তো কিছু নেই, কী বলেন?
মতিনউদ্দিন সাহেব জুতো পায়ে দিতে—দিতে বললেন, দেখবেন, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি বসে রইলাম মেয়েটির পাশে। জানালা দিয়ে দেখছি, শান্ত ভঙ্গিতে পা ফেলে মতিনউদ্দিন সাহেব এগোচ্ছেন। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তাঁর দীর্ঘ ছায়া পড়েছে।
এক দিন এই দুঃস্বপ্ন নিশ্চয়ই কাটবে। এই অপূর্ব রূপবতী মেয়েটি গাঢ় নীল রঙের শাড়ি পরে হয়তো সত্যি সত্যি বেড়াতে আসবে এ বাড়িতে। বিলু নীলুরা ফিরে আসবে একতলায়। অকারণেই বিলু দোতলায় উঠে এসে চোখ ঘুরিয়ে বলবে, আচ্ছা বলুন দেখি, দুই এবং তিন যোগ করলে কখন সাত হয়? কনিষ্কও ফিরে এসে গর্বিত ভঙ্গিতে রেলিং-এ বসে ডাকবে কা-কা। কাদের মিয়া বিরক্ত ভঙ্গিতে বলবে–কী অলক্ষণ। যা-যা, ভাগ। গভীর রাত্রে মুষলধারে বর্ষণ হবে। সেই বর্ষণ অগ্রাহ্য করে পাড়ার বখাটে ছেলেরা সেকেণ্ড শো সিনেমা দেখে শিস দিতে-দিতে বাড়ি ফিরবে। বৃষ্টির ছাটে আমার তোষক ভিজে যাবে, তবু আমি আলস্য করে উঠাব না।
আমি বসেই রইলাম। বসেই রইলাম। লুনা ফিসফিস করে তার মাকে এক বার ডাকল। হঠাৎ লক্ষ করলাম, মতিন সাহেব ঠিকই বলেছেন। মেয়েটির নাকের ডগায় ছোট একটি লাল রঙের তিল। বহু দূরে একসঙ্গে অনেকগুলি কুকুর ডাকতে লাগল। আমার ঘরের প্রাচীন তক্ষকটি বুক সেফফের কাছে থেকে মাথা ঘুরিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল।