সোনার হরিণ -3
নিদ্রিত অতীত যখন তার ঘুম ভেঙে সরাসরি সামনে এসে উপস্থিত হয়, তখন তার প্রবল আকর্ষণে সমগ্র সত্ত্বা দুলে ওঠে। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। ঝড়ের পূর্ব মূহুর্তে যেমন ধরণী থমথম করে,বাতাস গম্ভীর হয়, আকাশ বিমনা হয়, তারপরে প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ে সব কিছু তছনছ করে দেয় সুবর্ণের জীবন টাও সেই প্রাথমিক ঝড়ের ধাক্কায় প্রথম দিকে এলোমেলো বিপর্যস্ত হয়েছিল।
স্বপ্নের মধ্যে সোনার উপস্থিতি তাকে যেমন টলিয়ে দিয়েছিল, তমলুকের হাস্পাতালের কেবিনে শুয়ে থাকতে থাকতে তার প্রতি মূহুর্তে মনে হচ্ছিল, তার ঘুমের আড়ালে যদি সোনা আবার ধরা দেয় তবে তাকে, ” বাঁধিব স্বপন পাশে।” সোনাকে আর কিছুতেই মেঘলোকে উধাও হতে দেওয়া যাবে না। জ্বরের বেগ কমে এলেও সুবর্ণ এখনো বেশ দুর্বল।
দুর্বলতা কাটলেই সি এম ও ডিসচার্জ সার্টিফিকেট লিখবেন। দুজন নার্স এখনো পালা করে ডিউটিতে। সাহেব ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন এটাই বনমালীর মুখে হাসি ফিরিয়ে এনেছে। এখন সে দু বেলা দুমুঠো মুখে তুলছে। তবে তার মনে একটা ক্ষোভ ও দানা বেঁধেছে। সাহেবের বাড়িতে খবর দেওয়া সত্ত্বেও কলকাতার বাড়ি থেকে কেউই এলোনা। শুধু সাহেবের মা একদিন খুবই উৎকন্ঠিত হয়ে খবর নিয়েছিলেন। ওনাকে সাহেবের প্রকৃত অবস্থা জানাতে বনমালী সি এম ও সাহেবের নম্বর টা দিয়েছিল। তবে সে একটু শুনেছিল, যে, বাড়িতে মা ছাড়া আর কেউ নেই, সবাই দলবেঁধে আউটিং এ গেছে। অর্কপ্রভর কাছ থেকে বনমালী পরে জেনেছিল, উনি সাহেবের মা কে বলেছেন যে, ভয়ের কিছু নেই, জ্বর সেরে গেছে, সামান্য দুর্বলতা আছে, আর দু এক দিনেই সেরে যাবে। শুনে মা নিশ্চিন্ত হয়েছেন।
সামান্য দুর্বলতা নিয়ে সুবর্ণ ও আর হাস্পাতালের কেবিনে শুয়ে থাকতে চায় না।কাজ পাগলা মানুষ, বেডে শুয়ে দিনরাত কড়িকাঠ গোনার মানসিকতা তার নেই। কিন্তু নিরুপায় সে। গোটা জেলার দন্ডমুণ্ডের কর্তা হলেও এখানে সে সি এম ও র পারমিশন ছাড়া হাস্পাতাল ছাড়তে পারেনা। হতচ্ছাড়া জ্বর আর শরীর খারাপের উপর প্রচন্ড রেগে যায় সে, আবার ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে ও পড়ে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দেয়। নার্সের চোখে এটা পড়া মাত্র ঘাবড়ে গিয়ে ডাক্তার বাবুকে খবর পাঠায়। কাল বিলম্ব না করে অর্কপ্রভ ছুটে আসে, টেম্পারেচার দেখে, প্রেসার মাপে, দুটো ই স্বাভাবিক আছে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে বলেন, কেউ যেন ওনাকে ডিস্টার্ব না করে।
সুবর্ণ তার রাগ আর হতাশার ক্লান্তিতে সামান্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হলেও পরিপূর্ণ ঘুমের মতো সম্পূর্ণ চেতনা তার লুপ্ত হয়নি। ডাক্তার চলে যাবার পর সে উঠে বসার চেষ্টা করে কিন্তু মাথাটা টলে যায়। নার্স তৎক্ষনাৎ তাকে ধরে শুইয়ে দিয়ে দিয়ে বলে, স্যার, কোনো অসুবিধা হচ্ছে? সুবর্ণ মাথা নাড়িয়ে বলে, আমাকে একটু একা থাকতে দেবে? নার্স বেরিয়ে যায়, আর সেই মুহূর্তে তার ফোনটা বেজে ওঠে।
কলকাতা থেকে তার বউ সমাপ্তি তাকে ফোন করেছে। তার শারীরিক অবস্থার কথা সে জানতে চায়। সুবর্ণ কোনো কালেই নিজেকে অসুস্থ ভাবতে রাজি নয়, আজও সে বলে দেয় কোনো সমস্যা ই নেই, সে ভালো আছে। তমলুকে দেখতে আসার কথায় সে সমাপ্তিকে বলে দেয়, সেরেই তো উঠেছি, তুমি আবার তোমার সব কাজ ফেলে এই গোবিন্দ পুরে ছুটে আসতে যাবে কেন।
সমাপ্তি হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। তাকে যে সাত দেশ ডিঙিয়ে সব আনন্দ ফেলে রেখে কেবলমাত্র কর্তব্যের খাতিরে কর্তাকে দেখতে ছুটতে হবে না তাতে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
সুবর্ণ ফোন রেখে দেয়। সমাপ্তির সাথে মামুলি কথাই হয়েছে। আন্তরিকতার থেকে সে যে কেবলমাত্র কর্তব্যের খাতিরে ফোন করেছে সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে।
সে ভাবে, সংসার এক অদ্ভূত জগৎ। আভিজাত্য আর অহংকারের ঠেলায় মানবিক মূল্যবোধের দয়া মায়া করুণা এ সব গুণগুলো বড় দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। সে বড় একা আর নিঃসঙ্গ বোধ করে।
বেশ কিছু পরে বনমালী আর নার্স একইসাথে প্রবেশ করে। সাহেব জেগে আছে দেখে,বনমালী আচমকাই তার সাহেবকে প্রশ্ন করে আপনি কি অনেক খানি সোনা হারিয়ে ফেলেছেন?
সুবর্ণ চমকে ওঠে। নার্সটি অনুসন্ধিৎসু হয়।বনমালী লক্ষ্য করে সাহেবের মুখটা কেমন থমথমে হয়ে উঠলো। সে বুঝতে পারে, অপরিচিত নার্সের সামনে এই মূল্যবান ধাতুটির কথা না তুললেই ভালো হতো। সুবর্ণ বনমালীর কাঁচুমাচু মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ও প্রসঙ্গ থাক। বনমালী চুপ করে যায়। নার্স ও না শোনার ভান করে অন্য কাজে মন দেয়।
সোনার ব্যাপারে কৌতুহলী বনমালী কে চুপ করিয়ে দিলেও সে নিজে অশান্ত হয়ে ওঠে। তার মনের মধ্যে নতুন করে তোলপাড় শুরু হয়। বনমালী তার অজান্তেই সুবর্ণের অতি কোমল জায়গায় হাত দিয়ে ফেলেছে। জায়গাটা এতোটাই স্পর্শ কাতর যে অতি আপনজনকে ও এ ব্যাপারে কিছুই বলা যাবেনা। তার মনের প্রত্যন্ত গভীরে যে গভীর গোপন ভালোবাসা নিবিড় স্পর্শকাতরতায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলো, তা কোনো এক অসতর্ক মূহুর্তে মায়াময় স্বপ্নের মাধ্যমে হাইবারনেশন ভেঙে জাগ্রত হয়েছে, প্রবল আবেগে তার উপস্থিতি জানান দিয়েছে। তার ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায়, মনে ভেসে আসে,
” এসেছিলে তবু আস নাই, জানায়ে গেলে
সুমুখের পথ ধরে পলাতকা ছায়া ফেলে”
এই ছায়া ছায়া মায়া মায়া সোনার উপস্থিতি এতো বছর বাদে হলো কি করে! সোনা কি তবে সত্যিই পলাতকা ছায়া! কৈশোরের সেই মায়াভরা আদুরী মুখ, সেই রক্তিম অধর, সেই ভুবন ভোলানো হাসি সে তো তার প্রতিটি স্নায়ুতে, অস্থিতে, মজ্জায়, অণুতে পরমাণুতে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। তার সেই স্বপ্নের স্মৃতি কে এতোদিন বুকের গভীরে জগদ্দল পাথর চাপা চাপা দিয়ে কিশোর প্রেম কে ভুলতে চেয়েছিল। কে যে সেই পাথর অতি সন্তর্পণে সরিয়ে দিলো!
সুবর্ণ নার্স কে বলে, তার কাজ হয়ে গেলে সে যেন বাইরে থেকে বনমালী কে ডেকে দেয়। বনমালী ধারে কাছে নেই দেখে সাহেবকে সে কথা বলে সে বেরিয়ে যায়।
সুবর্ণ ভেবেছিল, বনমালী কি জানে আর কতটা জানে সেটা পরখ করবে। কেননা, সোনাকে ভালোবাসাটা তার কাছে অত্যন্ত স্পর্শ কাতর বিষয় এবং গোপনীয়। বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়লে নানান অসুবিধা দেখা দিতে পারে। সে কোন কিশোর বয়সে কার সাথে ঝিনুক কুড়িয়ে ছিলো, খেলার ছলে কার সাথে গান গেয়েছিল সেটা বড়ো কথা নয়, বড়ো কথা হচ্ছে এখন সে কি?
সে মনে মনে সাজাতে থাকে, সে একজন ডি এম, সে বিবাহিত, সে সন্তানের জনক, সে অবাঞ্ছিত হলেও একজনের স্বামী, সে তাকে যতই না মানুক, অবহেলা করুক খাতায় কলমে সেই তার স্ত্রী। কাজে কাজেই তাকে এখন অনেক কিছুই মানায় না। যতই সে কিশোর প্রেমের অমৃত ধারায় অবগাহন করে থাকুক না কেন। সমাজ সংসার আত্মীয় স্বজন দেশের আইন ও শাসন কেউ তাকে ছেড়ে কথা বলবে না। সে ঠিক করে তার মনের কথা মনেই থাকুক, তার প্রেম অন্তরেই থাকুক। অবশ্য সেই বয়সের ভালো লাগাকে সে প্রেম বলতে রাজি নয়, তার কাছে প্রেমের সজ্ঞাও অন্য রকম। প্রেম বললে তার মধ্যে দেহের একটা ব্যাপার এসে যায়, দেহাতীত প্রেম বলে কিছু হয় বলে তার জানা নেই। দেশপ্রেম, ভগবত প্রেম, সন্তান প্রেম আর প্রকৃতি প্রেম ছাড়া মানুষ মানুষী প্রেমকে সে দেহাতীত বলে মানতে রাজি নয়। সে মনে করে মানব মানবী প্রেম দেহ ছাড়া কখনোই পরিপূর্ণতা লাভ করে না। যেহেতু তার এবং সোনার মধ্যে দেহের কোনো ব্যাপার ই ছিল না তাই প্রকৃত অর্থে সেটা প্রেম নয়, সেটা ছিলো শুধুই ভালো লাগা আর ভালোবাসা। এই পরিণত বয়সে তার মনে হয়, “রজকিনী প্রেম নিকশিত হেম, কামগন্ধ নাহি তায়” শুধুই কথার কথা। প্রিয়ার অধরসুধা যদি পান করা নাই গেলো, তা হলে সে প্রেম না হলেই বা কি হলো?
সুবর্ণ জানে প্রেমের আরো কিছু অত্যাবশকীয় শর্ত আছে, যেমন পূর্বরাগ, অভিসার, মান, মাথুর ইত্যাদি। এর কোনটা ই তার আর সোনার জীবনে ঘটেনি। তাদের মধ্যে যেটা ছিল তা এক নিখাদ স্নেহ আর ভালো বাসা। কামগন্ধ সেখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
এরপর বেশ কিছুকাল অতিক্রান্ত হয়েছে। সুবর্ণ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে আগের মতো ই নিজের কাজের জগতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সেই আগের মতো ই সৎ, দক্ষ, বিচক্ষণ, ন্যায়পরায়ণ, নিয়মনিষ্ঠ অতি ভদ্র অমায়িক এক ডি এম। এরই মাঝে একদিন সে পরখ করেছে বনমালী কে, জ্বরবিকারের ঘোরে কতটা কি বলেছে সেটা জানা দরকার এবং নিশ্চিন্ত হয়েছে এই বুঝে যে, সোনা অর্থে বনমালী প্রকৃত অর্থেই সোনার গহনা ইত্যাদি বুঝেছে। ফলশ্রুতি হিসাবে দুশ্চিন্তা দূর হয়েছে, এবং সোনার স্মৃতিও ক্রমশ ই মন থেকে ধূসর হয়েছে।
সেদিন সুবর্ণ তার এজলাসে অত্যন্ত ব্যস্ত। এ ডি এম ছুটি নেওয়ায় তার এজলাসে অতিরিক্ত ভীড়। তাই সে যত দ্রুততার সঙ্গে সম্ভব এক একটা কেসের শুনানি শেষ করছে। যে সব কেসে বাদী পক্ষের আইনজীবী আসে নি বা বিবাদি পক্ষের আইনজীবী দেরি করে আসবে তাদের শুনানির জন্য অন্য দিন ধার্য্য করে ছেড়ে দিচ্ছে। ভীড় ও বেশ পাতলা হয়ে আসছে। এমন সময় দুজন সেপাই আর একজন এস আই একটা লোককে কাঠগড়ায় তুললো। সুবর্ণ ভ্রু কুঁচকে সে দিকে তাকালে সরকারি আইনজীবী অনুরোধ জানিয়ে বলে, স্যার, এর কেসটা একটু শুনতে হবে। সুবর্ণ সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়ে। পেশকার কে বলে, আপনি কাগজ পত্র জমা করুন, ত্রিশ মিনিটের জন্য আদালত বন্ধ থাকবে। সে এজলাস ছাড়ে।
আসলে বেলা ২টো বাজে, ২টো থেকে ৩টে পর্যন্ত জজ ব্যারিস্টার উকিল মোক্তার, কেরানী দাখিলদার সকলের টিফিন টাইম। সাহেব অসুস্থ হওয়ার পর থেকে বনমালীর কড়া নজর, দুটো বাজার দশ মিনিট আগে থেকে সে সাহেবের লাঞ্চ রেডি করে সাহেবের রূমে অপেক্ষা করতে থাকে। কোনো কোনো দিন খাবার ইচ্ছা না থাকলেও সে বনমালী কে কোনো দিন ফেরাতে পারেনা।
বিশ্রাম কক্ষে ঢুকেই সে বনমালী কে বলে লাঞ্চের পর আজ আর বিশ্রাম করবো না, আজ কাজের চাপ একটু বেশী। বনমালী লাঞ্চ সার্ভ করতে করতে অনুচ্চ স্বরে বলে, আপনার কাজের চাপ কোনো দিন কি কিছু কম হয়েছে? সুবর্ণ বলে, আজ এ ডি এম সাহেব ছুটিতে গেছেন। বনমালী বলে, সবাই তো দেখি ছুটি নিয়ে কত হিল্লিদিল্লি করে বেড়ান, আপনার ছুটি ও নেই আর বিশ্রামও নেই, এতো বড় অসুখের পরে ও যে মানুষ ছুটি নেয় না সে হয় দেবতা, না হয় মেশিন। বনমালীর কথা শুনে বিষম খেতে খেতে একটু জল খেয়ে সে নিজেকে সামলে নেয়।
কাঁটায় কাঁটায় আড়াইটার সময় সুবর্ণ এসে এজলাসে বসে। সরকারি উকিল কে শুনানি শুরু করতে বলে। সন্তোষ পাখিরা নামে একটা লোককে কাঠগড়ায় তোলা হয়। সে শপথ নেওয়ার পরেই গড়গড় করে বলতে শুরু করে উর্মিলাকে আমি ভালোবাসতাম স্যার, সরকারি উকিল কটমট করে তাকাতেই সে বলে, আসলে উর্মিলা আমার বিয়ে করা বউ। আমাদের তিনটে ছেলেমেয়ে আছে। আজ সকালে কি হলো, ইয়ার্কির ছলে ওর মাথায় একটা গাঁট্টা মেরেছিলাম, একটু জোরেই মারা হয়ে থাকবে হয়তো, বুঝতে পারি নি, তাতেই ও যে অমন নেতিয়ে পড়বে, ভাবতেই পারিনি। বলেই সে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো।
সুবর্ণ সরকারি উকিলের দিকে তাকাতেই, উকিল সন্তোষ কে ধমক দিয়ে বলে, চুপ করো, এটা আদালত। সন্তোষের পক্ষের আইনজীবী তাকে শান্ত হতে বলে, জিজ্ঞাসা করে , স্ত্রীকে গাঁট্টা মারার আগে তুমি কি করছিলে? আর তোমার স্ত্রী ই বা কি করছিলো?
সন্তোষ মুখ কাঁচুমাচু করে বলে, ওই সকাল বেলা উঠে যা হয় আর কি। একটু আধটু খুনসুটি করছিলাম। আদালতে হাসির রোল ওঠে। সুবর্ণ হাতুড়ি ঠোকে। আদালত শান্ত হলে উকিল আবার জিজ্ঞেস করে, গাঁট্টাটা তুমি কোথায় মেরে ছিলে?
সন্তোষ বলে, মাথায়।
উকিল বলে, তারপর তুমি কি করলে?
সন্তোষ বলে, বউকে ডেকে ডুকে তোলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু বউ আর উঠলো না দেখে ছেলে মেয়েগুলো চীৎকার করে কাঁদতে লাগলো, আমি ভয় পেয়ে দৌড়ে পালালাম।
সরকারি উকিল বলে, স্যার বউকে খুন করার কথা ও নিজের মুখে স্বীকার করেছে। পেশাদার খুনির মতো মাথায় আঘাত করে মেরে ফেলেছে, ওকে কঠিনতম সাজা দিন।
সুবর্ণ জিজ্ঞেস করে, তুমি বলছ, পালিয়ে গেছিলে, তাহলে এরা তোমাকে পেলো কোথায়?
সরকারি উকিল বলে, পাখিরা বাড়িতে কান্নার রোল উটেছে, আর সে ছুটে পালাচ্ছে দেখে, গ্রাম বাসীরাই ওকে ধরে পুলিসের হাতে তুলে দেয়।ওকে চরম শাস্তিদানের আবেদন রাখছি।
সন্তোষের উকিল বলে, স্যার এটা একটা আকস্মিক ঘটনা, সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত খুন, এখানে চরম শাস্তি হতে পারে না। তাছাড়া বাড়িতে ওই একমাত্র রোজগেরে পুরুষ। ওর তিনটে নাবালক বাচ্ছা রয়েছে, চরম শাস্তি হলে তারা ভেসে যাবে।
সে দিনের মতো শুনানি শেষ হয়, সুবর্ণ জানিয়ে দেয়, পোষ্টমর্টেম রিপোর্ট আর পারিপার্শ্বিক প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য বয়ান মিলিয়ে দেখে তবেই রায় দেওয়া যাবে। আপাতত আসামী কে জেল হেফাজতের নির্দেশ দিয়ে আদালতের কাজের সমাপ্তি ঘোষণা করে।
সময় অত্যন্ত দ্রুত বয়ে যায়। সব ধরনের রিপোর্ট চলে এসেছে, রায় বেরোনোর দিন নির্দিষ্ট হয়।সুবর্ণ অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে সবদিক বিবেচনা করে সন্তোষ পাখিরার যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেয়, তবে সেইসঙ্গে এক মাসের মধ্যে উচ্চতর আদালতে আপিল করার ব্যবস্থা মঞ্জুর করে।
কেস মিটে গেছে, রায়দান হয়ে গেছে, সরকারি হোমের আশ্রয়ে নাবালকদের দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, খুনসুটি করতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃত ভাবে কারো মৃত্যু ঘটিয়ে ফেলা ছাড়া এ কেসের আলাদা কোনো মেরিট নেই। কিন্তু বহু বছর আগে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে তার।
সুবর্ণর তখন সতের-আঠার বছর বয়স। ওরা বিকেলে বন্ধুরা মিলে পিট্টু খেলছিল ওদের বাড়ির সামনের মাঠটায়। ওই মাঠেরই একধারে ওর বোন আর বোনের বান্ধবীরা কিৎ কিৎ খেলছিলো। খেলাতে সবাই মশগুল, এমন সময় ফটাস করে একটা শব্দ হল, সবাই তাকিয়ে দেখল, সোনা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে আর মানস বলে পাড়ারই একটা ছেলে ছুটে পালাচ্ছে।
পিট্টু খেলা ফেলে রেখে সবাই ছুটে যায় সোনার কাছে। সোনা দুহাতে মুখ ঢেকে বসে আছে। সবাই অবাক হয়ে সোনাকে জিজ্ঞাসা করে, কেন রে তোকে মানস অতো জোরে মাথায় গাঁট্টা মেরে পালালো? সোনা হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো, জানিনা।সোনার কষ্ট দেখে অনেকে মানসকে ধরে উত্তম মধ্যম দেবার জন্যে মানসের পিছনে দৌড়ালো।
সুবর্ণ সোনার মাথায় জল দিয়ে পাখার বাতাস করে কিছুতেই সোনার কান্না থামাতে পারছিল না। উপায়ান্তর না দেখে, সোনাকে কোলে তুলে নিয়ে গোটা মাঠ দৌড়াতে থাকে।কিছুক্ষণ পরেই সে খেয়াল করে সোনা কান্না থামিয়ে মৃদু মৃদু হাসছে।
সোনাকে হাসতে দেখে সে খুশী হয়, বলে কিরে ব্যথাটা একটু কমেছে, এবার নামবি কোল থেকে?
সোনা হাসি থামিয়ে খুব স্পষ্ট আর দৃঢ় স্বরে বলে, তুমি আমাকে কোল থেকে নামাবে না। অগত্যা সে সোনাকে কোলে নিয়েই সারা মাঠ বেশ কয়েক পাক ঘুরে যখন আবার নামাতে যাবে, দেখে সোনা তার গলাটা নিবিড় বন্ধনে ধরে রেখে বুকের সাথে এমন ভাবে মিশে আছে যেন মনে হয় যুগ যুগান্তের এ বাহু বন্ধন চেষ্টা করেও ছাড়ানো যাবেনা। এ বন্ধন যদি জন্ম জন্মান্তর ধরে জড়ানো থাকে তাতেই বা ক্ষতি কি?
সোনাকে কোলে তুলে নেওয়ার সেই শুরু, আর তাকে আরো বেশী করে ভালোবাসার ও সেই শুরু। তারপর থেকে এমন একটা দিনও যায়নি যেদিন সোনা খেলতে এসে কোলে ওঠার বায়না করেছে আর সে কোলে নেয়নি।
খেলার পর সন্ধে হয়ে যাওয়ার আগে মাঠে সুবর্ণ কে ঘিরে ধরে সব ছেলে মেয়েরা গল্প বলার বায়না করতো, সোনার শর্ত থাকতো তাজে কোলে নিয়ে গল্প শোনাতে হবে। সুবর্ণ আর কাউকে কোলে না নিতে চাইলেও সোনাকে কোলে নিতেই হতো। নানা ধরনের গল্প সুবর্ণের ঝুলিতে থাকতো, যেমন, ভূত পেত্নী, দত্যিদানো, রাক্ষস খোক্কস, চোর ডাকাত, আর ডিটেকটিভ গল্প। সোনার কোলে উঠতে চাওয়ার কারন, গল্প শুনে ভয় পেলে সে সুবর্ণের বুকে মুখ লুকাতে পারবে। এমনি করেই সুবর্ণর বুকে সোনার জন্যে আলাদা একটা জায়গা তৈরী হয়ে যায়।
সবার মিলে ঠিক করে, সোনার মাথায় গাঁট্টা মারার জন্য মানস কে শাস্তি পেতেই হবে। সেদিন পালিয়ে গেলেও তাকে পরে কান ধরে ওঠবস করিয়েই ছেড়েছিল। কেন সে সোনার মাথায় গাঁট্টা মারল জিজ্ঞেস করায় সে বলে, সোনার মাথায় লাল ফিতে দিয়ে করা ফুল তাকে প্রলুব্ধ করে, সে শুধু গাঁট্টা মেরে ফুলটাকে চটকে দিতে চেয়েছিল। গাঁট্টা অত জোরে লাগবে ভাবেনি।
এখন বিচারকের চেয়ারে বসে গাঁট্টা মেরে মৃত্যু ঘটিয়ে ফেলার ঘটনায় অতীতের স্মৃতি তাকে চমকে দিয়েছিল, অত জোরে গাঁট্টায় সেদিন সোনা তাহলে মরেও যেতে পারতো!
কেউ কেউ এমন বিকৃত মনস্ক আছে, যারা সুন্দর সহ্য করতে পারেনা। সুন্দর ফুল গাছে দেখলে পট করে তুলে নিয়ে একটু গন্ধ শুঁকেই ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলে দেয়। কেউ নখ দিয়ে গাছের ডগা কেটে দেয়, কেউ ফুটফুটে শিশু দেখলে তার সামনে নানার বিকৃত মুখ ভঙ্গি করে তাকে ভয় দেখায়, কেউ সুন্দরী মেয়েদের উন্মুক্ত কোমরে ব্লেড চালিয়ে রক্তাক্ত করে। এগুলো সবই বিকৃত মানসিকতার পরিচয়। সুবর্ণ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, এই সমস্ত বিকৃত মানসিকতার কোন ক্ষমা নেই।
দোষ প্রমাণিত হলে সে কড়া শাস্তির বিধান দেয়, কিন্তু সন্তোষ পাখিরার ক্ষেত্রে তার নাবালক সন্তানদের কথাও তাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। তাই তাকে চরম শাস্তি সে দিতে পারেনি।
এজলাস শেষে ঘরে ফিরে সে তার অশান্ত মনকে শান্ত করতে কবিগুরুর চরণে আশ্রয় নেয়ঃ-
” যে ইচ্ছা গোপন মনে
উৎস সম উঠিতেছে অজ্ঞাতে আমার
বহুকাল ধরে, হৃদয়ের চারিধারে
ক্রমে পরিপূর্ণ করি বাহিরিতে চাহে
উদ্বেল উদ্দাম মুক্ত উদার প্রবাহে
সিঞ্চিতে তোমায়।”
সে আরো আবৃত্তি করে,
জীবনের প্রতিদিন
তোমার আলোক পাবে বিচ্ছেদ বিহীন,
জীবনের প্রতি রাত্রি হবে সুমধুর
মাধুর্যে তোমার, বাজিবে তোমার সুর
সর্ব দেহে মনে, জীবনের প্রতি সুখে
পড়িবে তোমার শুভ্র হাসি, প্রতি দুখে
পড়িবে তোমার অশ্রুজল, প্রতি কাজে
রবে তব শুভ্র হস্ত দুটি ; গৃহ মাঝে
জাগায়ে রাখিবে সদা সুমঙ্গল জ্যোতি।”
রাত ক্রমশ গভীর হয়,নিশুতিরাতের নৈশব্দ তাকে ক্রমশই একাকীত্বের গভীর বন্ধনে আবদ্ধ করে।অবসরের দ্বার প্রান্তে পৌঁছিয়েছে সে।চশমা খুলে চোখের কোনে অবরুদ্ধ অশ্রুবারি রুমালে মুছে জীবনানন্দ তুলে নেয় সে,
” তুমি তো জাননা কিছু — না জানিলে,
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে।”
সুষুপ্তির অতল তলে তলিয়ে যায় সে সোনার হরিণের খোঁজে ।