সোনার হরিণ -2
সুবর্ণ যেমন কৈশোর থেকে যৌবনে পা রেখেছে অনেক দিন, সোনাও তেমনি কিশোরী থেকে যুবতী হয়েছে স্বাভাবিক ভাবেই। সুবর্ণ দূর দেশ থেকে বাড়িতে খুব স্বল্প সময়ের জন্য আসলে ও সোনার খবর নেওয়ার চেষ্টা করতো, কিন্তু সোনার রাশভারী বাবার কাছে গিয়ে সোনাকে চাওয়ার মতো দুঃসাহস তার ছিলো না। একমাত্র উপায় ছিল সোনাকে সরাসরি বলা। কিন্তু নিয়তির অদ্ভূত পরিহাস, যে যাকে চায় সে তাকে পায় না। কিন্তু সুবর্ণ ভাবে যাহা চাই তাহা ঠিক করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না।
আজ এই নদী পারে ইজিচেয়ারে বসে পুরানো সেই চাওয়া পাওয়ার দ্বন্দ্বের হিসাব মেলাতে গিয়ে সূর্য দেব মাথার উপরে ওঠে। বনমালী দুপুরের খাবার রেডি করে সুবর্ণ কে ডাকতে আসে। সুবর্ণ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়, মাথায় একরাশ চিন্তা নিয়ে ধীর পদবিক্ষেপে বাংলোর দিকে পা বাড়ায়।
সুবর্ণ স্নান করে, নিয়মমাফিক খেতেও বসে।বনমালী পরিবেশনের মধ্যে লক্ষ্য করে তার সাহেব যেন উদাসীন, টেবিলে বসে কিছু আহার্য মুখে তুললেও যেন গভীর ভাবে চিন্তিত, যেন সুদূরে কোথাও হারিয়ে যাওয়া একটা মানুষ।
এই সুযোগেই কথাটা পাড়ে সে। বলে, দাদাবাবু, আজও একবার আমাকে বাড়িতে যেতে হবে। বড় মেয়ের দেখাশোনা চলছে, আজ পাত্রপক্ষ আসবে বলেছে, ফাইনাল কথা- বার্তার জন্যে।আমি সব কিছু গোছগাছ করে দিয়ে যাবো, আপনার কোনো চিন্তা নেই।
সুবর্ণ উদাসী দৃষ্টিতে বনমালীর দিকে তাকায়। বনমালী বলে, কাল সকালে তো আপনি ওই রাস্তাতেই ফিরবেন, আমি সকাল সকাল বড়ো রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকব, আজ মেয়েটার পাকাদেখা, আজ না গেলেই নয়।
সুবর্ণ মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। বনমালী খুশী হয়ে কাজ সারার দিকে মন দেয়। সুবর্ণ খাওয়াদাওয়া সেরে শীতলকুঞ্জের দিকে পা বাড়ায়।
শীতলকুঞ্জের ইজিচেয়ারে বসে উদাসী সুবর্ণ পুরানো দিনে ডুব দেয়। গতকালের দেখা স্বপ্নটা তার স্পষ্ট মনে পড়ে। তার ছোট বেলাকার খেলার সাথী সোনা তার কাছে এখন নিদ্রিত অতীত। বাড়ির চাপাচাপিতে বাড়িরই পছন্দ করা মেয়ের সাথে তার বিয়ে হয়ে গেলো বটে, কিন্তু সে মেয়ে তার নিজস্ব লাইফস্টাইলেই মত্ত,তার সোসাল এনগেজমেন্ট, তার কানেকশন, তার ফ্রেন্ড সার্কেল, তার নিজস্ব আর্নিং ছেড়ে সে কখনো ই সুবর্ণের পিছু পিছু ঘুরতে রাজি নয়। সুবর্ণ ও জোর করে নি। আর এই কারণেই তাদের সন্তানাদি হলেও তাদের দুজনের মধ্যে আত্মীক বন্ধন কখনোই তেমন দৃঢ় হয়নি।
বিয়ের ঠিক আগে আগে সে যে সোনার সাথে দেখা করার চেষ্টা করেনি তা নয়। কিন্তু সোনার দাম তখন সাংঘাতিক বেড়ে গেছিলো। একে সে পাড়ার সুন্দরী শ্রেষ্ঠা, তার উপরে উদ্ভিন্নযৌবনা এবং দুষ্প্রাপ্যা। তখনকার সমাজব্যবস্থায় কড়াকড়ি যেমন ছিলো, তেমনি এখনকার মতো মোবাইল ফোনের কোনো চলই ছিলো না। প্রচন্ড ব্যস্ত সুবর্ণের পক্ষে সুন্দরী সোনার নাগাল পাওয়া দুষ্কর হয়ে যায়। তার উপরে সোনার নাকি কারো সাথে এফেয়ার চলছে কানাঘুষোয় সে কথা সুবর্ণের কানে আসে, কাজে কাজেই সোনাকে পাবার আশা তাকে ছাড়তেই হয়েছিলো।
তার বিয়ের বহুদিন পরে সোনার এক দাদার সাথে তার দেখা হয়েছিল। এ কথা সে কথার পরে লজ্জার মাথা খেয়ে তাকে সোনার কথা জিজ্ঞেস করে জেনেছিল যে, কলকাতার এক অভিজাত পাড়ায় এক বনেদী বাড়িতে সোনার বিয়ে হয়েছে। সে কথা শুনে ভবিষ্যতেও সোনাকে কোনো দিন দেখতে পাওয়ার আশা বা যোগাযোগ করার ইচ্ছাও ত্যাগ করেছিল।
কিন্তু সেই নিদ্রিত অতীত গতরাতে সরাসরি তার সামনে হাজির হয়েছিল। সে কি শুধু ঝড়ের রাতে গোপন অভিসার! স্বপ্ন এতো স্পষ্ট হয় কি করে! সে যে স্পষ্ট দেখেছে নদী পারে গহন রাতে সেই নিদ্রিত অতীত সরাসরি সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সুবর্ণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কবিগুরুর কাছে আশ্রয় খোঁজে, —
“জানি আমি জানি সখি,
যদি আমাদের দোঁহে হয় চোখাচোখি
সেই পরজন্ম পথে, দাঁড়াব থমকি;
নিদ্রিত অতীত কাঁপি উঠিবে চমকি
লভিয়া চেতনা,জানি, মনে হবে মম
চির জীবনের মোর ধ্রুবতারা -সম
চির পরিচয় ভরা ওই কালো চোখ,
আমার নয়ন হতে লইয়া আলোক
আমার অন্তর হতে লইয়া বাসনা
আমার গোপন প্রেম করেছে রচনা
এই মুখখানি, তুমিও কি মনে মনে
চিনিবে আমারে?”
সুবর্ণের চিন্তা হোঁচট খায়, সামনে বনমালী। তার গ্রামের বাড়িতে যাবার আগে বলে যেতে এসেছে রান্নাবান্না সব গুছিয়ে রাখা আছে, দাদাবাবু যেনো সময় মতো খেয়ে নেয়। আর গতকালের মতো যেনো এখানেই রাত কাটায় না। বনমালী বিদায় নেয়, সুবর্ণ ও আবার অতীতে ডুব মারে।
যে অভিজাত পাড়ার নাম সোনার দাদা করেছিলো সেখানে সোনার খোঁজ করার কথা চিন্তাই করা যায় না। তা ছাড়া কি বলেই বা সে সোনার খোঁজ করবে, কী পরিচয়ে? আর খোঁজ পেলেই বা সোনাকে সে কী বলবে?
সে নিজে যেমন বিবাহিত, দায়িত্বশীল ডি এম, এবং সন্তানের জনকও বটে, তেমনি সোনাও এখন অভিজাত কূল বধূ, হয়তো বা সন্তানের জননী। সে তার হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা সম্বন্ধে কিছু জানে না, বা জানতেও চায় না। নিজেই নিজেকে বলে, ভুল হলো, ভালোবাসা কখনো হারিয়ে যায় না, সে বুকের গভীরে কোনো এক নিভৃত কক্ষে জমাট ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে, আর আশ্চর্য, সামান্য নূপুরের ছন্দে যে ঘুমন্ত ভালোবাসার নিদ্রা ভঙ্গ হয় তার প্রমাণ সে নিজেই। মাত্র গতকাল ই তার পরিচয় পেয়েছে শুধু নয় তার রেশ এখনো পর্যন্ত বয়ে নিয়ে চলেছে।
নদীর জল ছলছল শব্দে বয়ে চলে, নদী কিনারে তরুবীথির ছায়া প্রলম্বিত হয়, সূর্য দেব পাটে বসে।পশ্চিমের আকাশ লালে লাল হয়ে যায়, সেই লালিমার অপূর্ব আভা নদীর জলে ঝলমল করে, ঝলমলে আলোয় নদীর জল যেনো জ্বলতে থাকে। সুবর্ণ সে দিকে তাকাতে পারে না, সে ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে।
পরদিন সোমবার। অফিস আছে। ভোররাত থেকে উঠে বনমালী নন্দকুমারের বড়ো রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে, কথামতো সাহেবের গাড়িতে একসাথে ফিরে যাবে। ক্রমশ বেলা বাড়ে, সাতটা, আটটা, নটা বেজে যায়, সাহেবকে এখনো দেখা যাচ্ছে না। বনমালী চিন্তিত হয়। সাহেবকে শ্রদ্ধা ভক্তির সাথে সাথে ভালোও বাসে, বুকটা তার ছ্যাঁত করে ওঠে। গতকালের মতো সাহেব আজও শীতলকুঞ্জের ইজিচেয়ারে বেহুঁশ হয়ে বসে নেই তো! একটা ভ্যান রিক্সা ধরে বাংলোর পথে সে পাড়ি দেয়। বাংলোতে ঢুকে একবার চোখ বুলিয়ে ই সে বুঝে যায় যে কাল থেকে সাহেব ঘরেই ঢোকেনি। সে দৌড়ে যায় শীতলকুঞ্জের দিকে। যা ভেবেছিল ঠিক তাই। সাহেব ইজিচেয়ারে ই। সে উদ্বিগ্ন হয়ে ডাকে দাদাবাবু উঠুন, বেলা হয়ে গেলো যে, অফিসে যাবেন না?
সুবর্ণ একেবারে ই বেহুঁশ। কপালে হাত ঠেকিয়েই চমকে ওঠে বনমালী। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। আর দেরী না করে বাংলো থেকে ফোন করে তমলুক জেলা হাসপাতালে। ডি এম সাহেব অত্যন্ত অসুস্থ, শীগগির য়্যাম্বুলেন্স পাঠাতে বলে।
ডি এম সাহেব অসুস্থ শুনে তড়িঘড়ি সব ব্যবস্থা করে দেয় সি এম ও অর্কপ্রভ, সে ডি এম সাহেবের পরিচিত আর বনমালীকেও চেনে। নানান ধরনের ব্লাড টেস্ট হয়, একফাঁকে বনমালীকে ডেকে সাহেবের বাড়িতে খবর দিতে বলে। তারপর আটচল্লিশ ঘন্টা পার হয়ে যায়, মাঝে মাঝে সুবর্ণের জ্ঞান ফিরে আসে আবার জ্ঞান হারায়। সি এম ও দুজন নার্সকে পালা করে সুবর্ণের দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে। বনমালী এই দুদিন বসে আছে সাহেবের কেবিনের সামনে। মাঝে মাঝে কপাল চাপড়িয়ে সে বিড়বিড় করছে, কেন সাহেবকে একা ফেলে বাড়ি চলে গেলাম। চোখ দিয়ে তার টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ে, গত দুদিন কেউ তাকে একদানা অন্ন মুখে তুলতে দেখেনি।
সি এম ও অর্কপ্রভ ব্যাপার টা জানে, যে, ডি এম সাহেবের বাড়ি থেকে কেউ আসেনি। তাই তিনি বনমালী কে নিজের চেম্বারে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, বনমালী, তোমার সাহেব কি দামী কিছু হারিয়ে ফেলেছেন? যেমন ধরো সোনা জাতীয় কিছু?
বনমালী অবাক হয়, বলে, আমার সাহেবের আঙুলে একটাও আংটি নেই, গলায় সোনার চেন নেই, হাতে সোনার বালাও নেই। এই বয়সে কত সাহেব তো দেখলুম, হাতে মোটা মোটা সব সোনার বালা, গলায় মোটা সোনার চেন, আট আঙুলে আট দশটা করে পাথর বসান সোনার আংটি।আমার এই সাহেবের ওসব সোনা টোনা কিছুর বালাই নেই। অর্কপ্রভ অস্ফুটে বলে, ডি এম সাহেব বার বার সোনা সোনা করছে। নিজেই আবার বলে, জ্বরের ঘোরে বলা প্রলাপের মানে খুঁজতে নেই। হয়তো বা, দামী কিছু এখানে না হারালেও বাড়িতে হারিয়ে থাকতে পারে। যাকগে, বনমালী, তুমি ওনার বাড়িতে খবর পাঠিয়েছ তো? বনমালী মাথা নাড়ে, তাতে হ্যাঁ বা না কোনো কিছুই বোঝা যায় না।
এ কাহিনির এখানেই শেষ নয়, বরং বলা চলে এ কাহিনির শুরু এখান থেকেই। কোনো স্বপ্ন নয়, কোনো মায়া নয়, নয় কোনো হ্যালুসিনেসন।বাস্তবেই সোনার সশরীরে আগমন ঘটবে কি সুবর্ণের জীবনে, এক অন্য গরিমায়, অন্য মহিমায়? সে প্রায় চল্লিশ বছর পরে সে আলাদা গল্প । সুবর্ণ তখন পঁয়ষট্টি আর সোনা তখন পঞ্চান্নতে। দুজনের সাক্ষাৎ হয় এক সামাজিক অনুষ্ঠানে নিতান্তই আকস্মিক ভাবে। কেউই কাউকে প্রথমে দেখতে পায়নি, দেখলেও চিনতে পারতো কিনা সন্দেহ। সোনার এক বোন ওদের দুজনের সাথে দুজনের পরিচয় করিয়ে দেয়।
সেই শুরু। তারপর গঙ্গা আর রূপনারায়নের মিলিত স্রোতধারার মতো জীবনের ঘূর্ণিপাকে নতুন ধারাপাতে এগিয়ে চলে মোহনার দিকে। সাগর সঙ্গমে লীন হওয়ার আগে মোহনার কাছাকাছি জীবনের নতুন বদ্বীপের দিকে এক আলাদা পরিসরে অন্য মহিমায় ।