সোনার হরিণ নেই : ৪১
টানা দু মাস বাদে বাড়ির দোতলায় হাঁটা-চলার অনুমতি পেল বাপী। ডাক্তারের হুকুমে তার ওঠা বসা চলা ফেরা। তার নির্দেশ মিষ্টি একচুল এদিক ওদিক হতে দেবে না। সেই ভীষণ রাতটার কথা মনে নেই বাপীর। কারণ জ্ঞান ছিল না। পরদিন থেকে এই দুমাস যাবৎ চিকিৎসার ঘটা দেখছে। দেড় মাস পর্যন্ত দিন—রাত চব্বিশ ঘণ্টার জন্য দুজন নার্স মোতায়েন ছিল। বাপীর বিরক্তি দেখে দুদিন আগে মিষ্টি রাতের নার্স ছেড়েছে। এখনে তিন দিন অন্তর ডাক্তার আসছে, প্রেশার মাপছে। সপ্তাহে একদিন করে বাড়িতে ই-সি-জি হচ্ছে। প্রেশার আরো ওপরের দিকে চড়ে থাকল বলে মিষ্টির দুশ্চিন্তা। ডাক্তার আশ্বাস দিয়েছে। ওটাই মোটামুটি এখন স্বাভাবিক ধরে নিতে হবে। বেশি ওঠা-নামা করার থেকে এক জায়গায় বরং স্থির থাকা ভালো।
খবর পেয়ে বানারজুলি থেকে আবু রব্বানী ছুটে এসেছিল। একনাগাড়ে পনের দিন ছিল। তার পরেও একবার এসে ওকে দেখে গেছে। কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে ঠাট্টাও করেছে, তোমার এমন পেল্লায় হার্ট কে অ্যাটাক করতে পারে আমি ভেবে পাই না বাপীভাই। যাকগে, এখন আর নো ওয়ার্ক, নো চিন্তা—আমি আছি, জিত্ আছে, তোমার কিছু ভাবনা নেই।
ব্যবসা বা কাজকর্ম নিয়ে বাপী আর একটুও মাথা ঘামাচ্ছে না। এদিকের একটা মস্ত শেকল যেন ঢিলেঢালা হয়ে খসে খসে যাচ্ছে। একটুও খারাপ লাগছে না। বরং হালকা লাগছে। কিন্তু অস্বস্তি অন্য কারণে। সে কি পালানোর পথ খুঁজছে? দু মাসে আগের সেই ঘুম আর যদি না-ই ভাঙত।—কি হত? বেঁচে যেত?
ভিতর থেকে সায় মেলে না। এমন মৃত্যুর কথা ভাবতেও যন্ত্রণা। জীবনের এক বিরাট মুক্তির স্বাদ কোথাও লেগে আছে। কিন্তু সেটা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। চোরের মতো এই মৃত্যুর অন্ধকারে সেঁধিয়ে গেলে সেই মুক্তির নাগাল আর কোনদিন পাবে না।
রতন বণিক নিয়মিত আসে। বিপুলবাবুর শরীরের খবর নিয়ে যায়। গোড়ায় দেখা সাক্ষাৎ নিষেধ ছিল। এখন দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। দেখে। বিশেষ করে কপাল দেখে। ওর কপাল দেখার গল্প মিষ্টি এর মধ্যে বাপীর মুখে শুনেছে। তাই ও যখন কপাল দেখে মিষ্টি তখন ওর দিকে উদ্গ্রীব মুখে চেয়ে থাকে। রতন দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ালে সহজ হবার চেষ্টায় বাপীকে সব থেকে বেশি যুঝতে হয়। এক এক সময় হেসে জিজ্ঞাসা করে, কেমন দেখছ?
রতন মাথা নেড়ে জবাব দেয়, ভালই।…ভাববেন না।
কিন্তু লোকটাকে বড় বিমর্ষ আর ক্লান্ত মনে হয় বাপীর। রতন বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। ছেলের চিন্তায় সর্বদা উতলা। বিপুলবাবুর এত অসুখ, তাকে নিয়ে আসে কি করে। কিন্তু হাড়-পাজী ছেলে কোত্থেকে যে ওর ঘরে এলো ভগবান জানে!
বাপী পাশ থেকে আধ-পড়া বইটা তুলে নেয়। স্থির মনোযোগে পড়তে চেষ্টা করে। কিন্তু চাপা লাইনগুলো নড়াচড়া শুরু করে দেয়।
মিষ্টি এখন আবার দেড় দুঘণ্টার জন্য নিচের অফিস ঘরে বসে কাজকর্ম দেখছে। বাপী সত্যি এখন ব্যবসা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না বলে দায়িত্ববোধ আরো বেশি। ব্যবসা-সংক্রান্ত সব পরামর্শ এখন জিতের সঙ্গে। বা চিঠিপত্রে রব্বানীর সঙ্গে।
সেদিন নিচে নেমে দেখে, ছেলের হাত ধরে রতন বণিক আসছে। মিষ্টি বুঝল, ছেলেকে রেখে নিশ্চিন্তে বেশিক্ষণ বসতে পারে না বলে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। মিষ্টি আপিস ঘরে আসতে রতনও সঙ্গে এলো। ছেলেকে ভয় দেখানোর সুরে বলল, এই হল কর্তা-মা, ভয়ংকর রাগী কিন্তু। এখানে এই টুলে একেবারে চুপটি করে বসে থাকবি, নড়বি-চড়বি না। আমি বিপুলবাবুকে একটু দেখে আসি। ও এখানে বসে থাকলে কোন অসুবিধে হবে না তো মা-লক্ষ্মী?
মিষ্টি হাসিমুখে মাথা নাড়ল। অসুবিধে হবে না। ছেলেটা দুষ্টু খুব, সন্দেহ নেই। পাতলা ঠোঁটের ফাঁকে সামান্য হাসির রেখা। যা শুনল, অর্থাৎ কর্তা-মা সত্যিই ভয়ংকর রকমের রাগী কিনা বোঝার চেষ্টা। মিষ্টির বেশ লাগল ছেলেটাকে। এইটুকু ছেলের মা নেই। এ-ও মনে হল। বলল, বাইরে টুলে বসতে হবে না, আমার কাছে ঘরে বসে থাক। রতনকে বলল, ও একটুও দুষ্টুমি করবে না, তুমি ওপরে যাও।
এ-সময়ে এসেছে বলে মিষ্টি অখুশি নয়। একলা থাকলেই ওই লোক বইয়ের মধ্যে ডুবে যায়। কেউ কথাবার্তা কইতে বা গল্প করতে এলে সে সুযোগ হয় না। তাছাড়া রতন বণিককে যে খুব পছন্দ করে মিষ্টি এ-ও বুঝেছে।
খুশি মুখে রতন ওপরে উঠে এলো। একগাল হেসে বাপীর সামনে মেঝেতে বসে পড়ে বলল, দরাজ মন আর কাকে বলে। আমি ছেলেকে ভয় দেখালাম কর্তা-মা ভয়ংকর রাগী—চুপ করে বাইরের টুলে বসে থাক—আর উনি আদর করে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন—
রতন এলে বাপীর মানসিক প্রতিক্রিয়া একটু হয়ই। জিজ্ঞাসা করল, কার কথা বলছ?
—আমাদের মা লক্ষ্মীর কথা বলছিলাম—আমি যা দেখার দেখে নিয়েছি, বড় মন, মায়ামমতা আছে।
বাপীর মাথায় একটা শব্দ ঘুরপাক খেতে লাগল।—তোমার ছেলে কি ওকে কর্তা মা বলে ডাকবে নাকি?
—উনি হলেন গিয়ে রাজরাণী, মেমসায়েব-টায়েব ভালো লাগে না। সচকিত একটু।— উনি রাগ করবেন না তো?
অগত্যা বাপী মাথা নাড়ল, রাগ করবে না। চুপচাপ রতনকে দেখল একটু। বছর তিপ্পান্ন বয়েস হবে এখন। কিন্তু লোকটা বুড়িয়েই গেছে।
কথায় কথায় রতন বণিকের চাপা অভিমানটুকু আগে প্রকাশ পেল।—ও জোর দিয়ে বলেছিল বিপুলবাবুর ভাগ্য একদিন না একদিন ফিরবেই—বিপুলবাবু নিজেও সেদিন সে-কথা বিশ্বাস করেননি। তা রতন যতটা ভাবতে পারে, ভাগ্য তার থেকে ঢের বেশিই ফিরেছে মনে হয়। তা না হলে এমন বাড়ি, এমন দুখানা ঝকঝকে গাড়ি হতে পারে না। ভাগ্যের জোরে রাজরাণীর মতো বউ পর্যন্ত ঘরে এসেছে।—কিন্তু এত বড় হয়ে বিপুলবাবু ওদের এ-ভাবে ভুলে যাবেন ভাবেনি। এতকাল ধরে বিপুলবাবু কলকাতায় আছেন, একটা খবর পেলে রতন ছুটে আসত—কি ঝড়-জলটা না গেছে ওর ওপর দিয়ে—এখনো যাচ্ছে। সবই তার অদৃষ্ট ছাড়া আর কি।
বাপী একটুও বিরূপ হল না। কোন ওজর দেখালো না। এ-রকম বলার অধিকার ওর আছে।
একটু চুপ করে থেকে খাটো গলায় জিজ্ঞাসা করল, যাবার দিন সকালে তোমার বউয়ের কি মনে পড়েছিল বলেছিলে সেই একদিন—কি বলে গেছল?
—আপনাকে মনে পড়েছিল। বলেছিল, যদি পারো তাঁর খোঁজ কোরো। তুমি যা বলেছিলে ততো বড়টি যদি উনি হয়ে থাকেন, আমার কথা বলে মদনের ভার তাঁর হাতে ছেড়ে দিও—উনি একভাবে না একভাবে ঠিক ওকে মানুষ করে দেবেন।
বাপী স্থাণুর মতো বসে রইল। অনেকক্ষণ বাদে জিজ্ঞাসা করল, তুমি সেই ব্রুকলিনের চাকরি করছ এখনো?
বিষণ্ণ মুখে রতন মাথা নাড়ল। করছে না। পরে আস্তে আস্তে জানালো, মারা যাবার পরেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। কিচ্ছু ভালো লাগত না, সর্বদা পাগল পাগল করত। তাছাড়া সে আপিসে গেলে ছেলে দেখে কে? সেই থেকে নিজের ভাগ্য পুড়িয়ে লোকের ভাগ্য দেখাই পেশা তার। ঘরে বসেই এ-কাজ করত। কিন্তু বস্তিঘরে কোন্ পদের খদ্দেরই বা আসবে। গোড়ায় গোড়ায় যা-ও চলত, এখন আর চলছেই না। ছেলেটা বিনে পয়সায় করপোরেশনের স্কুলে পড়ে—কিন্তু সেখানে পড়া যে কি হয় তাও ভালই জানে।
বাপী উঠে পায়চারি করল খানিক। রক্তশূন্য মুখ। শোবার ঘরে ঢুকে গেল। মিনিট পাঁচেক বাদে আবার ফিরে এলো। রতনের ছেঁড়া কোর্তার দু পকেটে দু তোড়া নোট গুঁজে দিল। বলল দুই হাজার টাকা আছে, এখন এই দিয়ে চালাও। ছেলের ভার আমি নেব, কিন্তু এখনো মাসখানেক মাস-দেড়েক আমি বেরুতে পারব না—তাছাড়া ডিসেম্বর মাসটা না গেলে কোনো স্কুলে নতুন করে ভর্তি হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। তোমার কাউকে কিছু বলার দরকার নেই, ব্যস্ত হবারও দরকার নেই—সময়মতো ব্যবস্থা যা করার আমিই করব—আমিই তোমাকে খবর দেব।
বলার পরেই ভিতরে বৃশ্চিক দাহ। যে গোপনতার পর্দা ছিঁড়েখুঁড়ে ভিতরের মানুষটা বেরিয়ে আসতে চায়, তাকে আরো আড়ালে টেনে নিয়ে যাওয়া হল।
রতন বণিক হঠাৎ কেঁদে ফেলে বাপীর দু হাত ধরল।
হাত ছাড়িয়ে বাপী ভিতরে চলে গেল।
জানুয়ারির মাঝামাঝি, ব্যবস্থা যা করার নিঃশব্দেই করে ফেলল। বাপী অনেকটা নিশ্চিত।
কিন্তু আরো পনেরটা দিন না যেতে এই ব্যবস্থা যে-ভাবে পণ্ড হয়ে গেল, বাপী নিজেই হতচকিত, বিমূঢ়
মিষ্টি নিচের আপিস ঘরে ছিল। সাড়ে তিনটে না বাজতে উঠে এলো। বাপী খাটে শুয়ে বই পড়ছিল। বই সরাল। মিষ্টির অবাক মুখ।
—দিন পনের আগে তোমার সেই পিওন রতন বণিকের ছেলেকে নিজে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে নরেন্দ্রপুরে ভর্তি করে দিয়ে এসেছিলে—আর তুমি গার্জেন হয়ে তাকে হস্টেলে রেখে এসেছিলে?
বই রেখে বাপী উঠে বসল। হিসেবের বাইরে কিছু একটা হয়েছে বুঝতে পারছে। হঠাৎ ঠাণ্ডা একটু। সংযতও।—হ্যাঁ। কেন?
—এই শরীর নিয়ে তুমি এত-সব করেছ, আমাকে বলোনি তো?
—আমার শরীর খুব ভাল আছে।…তোমাকে কে বলল?
—রতন নিজেই। ছেলে নিয়ে ওই হলঘরে বসে কান্নাকাটি করছে— দেখগে যাও।
—কান্নাকাটি করছে কেন?
জবাব দেবার আগে শরীরটা কতটা ভাল আছে মিষ্টি তাই দেখে নিল কিনা বোঝা গেল না। বলল, ছেলে কাউকে কিছু না বলে কাল সকালে হস্টেল ছেড়ে এত পথ হেঁটে ঘরে চলে এসেছে। পথ ভুল করার জন্য আসতেও অনেক সময় লেগেছে। রতন বিকেলের মধ্যেই নরেন্দ্রপুর ছুটে গেছল, কিন্তু সেখানকার মহারাজদের হাতে-পায়ে ধরেও ফল হয় নি—তাঁরা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন এ—ছেলেকে আর রাখা সম্ভব নয়।
বাপী হতভম্ব। খাট থেকে নেমে এলো। হলঘরে এলো। পিছনে মিষ্টি। বিষণ্ণ পাংশু মুখে রতন মেঝেতে বসে আছে। একটু দূরে ছেলেটা ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে। বাপীকে দেখে রতন উঠে দাঁড়াল। সত্যি কাঁদছে। হাতজোড় করে বলল, আমাকে আপনি শুধু মাপ করে দিন বিপুলবাবু—খুব আক্কেল হয়েছে— গরিবের ছেলে মানুষ করার সাধ মিটেছে।
বাপী সোফায় বসল। থমথমে মুখ। কিন্তু তার পরেই কেন যেন অত রাগ আর থাকল না, ছেলেটার দিকে অপলক চেয়ে রইল খানিক। তারপর মিষ্টির দিকে তাকিয়ে সামনে হাত পাতল। বলল, ওর কান দুটো ছিঁড়ে এনে আমাকে দাও তো।
ছেলেটা ভয়ে ভয়ে দু পা সরে গেল। কান ছিঁড়তে যাকে বলা হল সে আসছে কিনা দেখে নিল। ঘাড় ফিরিয়ে খোলা দরজা দুটোর দিকেও তাকালো একবার সত্যি কেউ কান ছিঁড়তে এলে পালাবার পথ আছে কিনা দেখে রাখল।
বাপীর হঠাৎ হাসিই পাচ্ছে কি রকম। কিন্তু গম্ভীর তেমনি। ছেলেটা ঘাবড়েছে, কিন্তু গোঁ-ধরা মুখ। একটা আঙুল তুলে মুখোমুখি সামনের সোফাটা দেখাল।— ওখানে বোস্।
ছেলেটা মাথা গোঁজ করে দাঁড়িয়েই রইল। রতন মারতে এগলো।— হারামজাদা, এর পরেও কথা কানে যাচ্ছে না তোর—তোকে আমি আস্ত রাখব!
—রতন!
ছেলের পিঠে নেমে আসার আগেই রতন বণিকের হাত থেমে গেল।
বাপী বলল, আমি যেখানে ভার নিয়েছি সেখানে তোমার শাসনের আর দরকার নেই! ছেলের দিকে ফিরল।—আমি এক কথা দুবার বলি না মনে থাকে যেন। বোস্ ওখানে।
এঁকে-বেঁকে ছেলেটা সোফার সামনে গেল। বসল। কিন্তু বসার সঙ্গে সঙ্গে কিছু কৌতুকের ব্যাপার ঘটল যেন। বসার জায়গা এমন হয় তার ধারণার বাইরে। নিজের অগোচরেই আধাআধি দাঁড়িয়ে আবার বসল। তারপরেই অপ্রস্তুত মুখে ভয়ে ভয়ে বাপীর দিকে তাকালো। নরম গদীর লোভে আবার ওঠা আর বসাটা ভাল কাজ হল না নিজেই বুঝছে।
মিষ্টি চেষ্টা করে হাসি চাপল। বাপী আড়চোখে একবার তাকে দেখে নিল। তেমনি গম্ভীর। রতনের দিকে ফিরে একটু গলা চড়িয়ে বলল, তুমি কিছু ভেবো না—এ-বয়সে ওর থেকে আমিই ঢের বেশি বাঁদর ছিলাম, বিশ্বাস না হয় তোমার রাজরাণীকে জিগ্যেস কর। ওকে ঢিট করার ব্যবস্থা আমি করছি—ও আর কোথাও যাবে না, এখানে থাকবে।
মিষ্টি অবাক। রতন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। বিশ্বাস করবে কি করবে না ভেবে পাচ্ছে না।
বাপীর দু চোখ রতনের মুখের ওপর।—তুমি চলে যাও এখন। আমার ওপর বিশ্বাস রেখে ছমাসের মধ্যে আর এ-মুখো হবে না। তারপর ইচ্ছে হয়, দেখে যেও—কিন্তু এখন শিগগীর না!
রতন বোকা আদৌ নয়। অকুলপাথার থেকে উঠে এলো। মিষ্টি কিছু বোঝার আগেই চট করে এগিয়ে এসে তার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে উঠল। তার পর খোলা দরজা দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে চলে গেল।
ছেলেটা তক্ষুনি উঠে দাঁড়িয়েছে। পিছনে ছোটার ইচ্ছে। তার আগেই ধমক খেয়ে পা দুটো মাটির সঙ্গে আটকে গেল।
—বোস্।
বসে পড়ল।
মিষ্টি আর চুপ করে থাকতে পারল না।—–কি ব্যাপার?
—শুনলে তো। ঘাড় ফিরিয়ে হাঁক দিল, বাচ্চু!
ভিতরের ঘর থেকে বাচ্চু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলো। কলেজে পড়ছে। সুঠাম স্বাস্থ্য।
বাপী বলল, এখন থেকে এই ছেলেটা আমাদের এখানে থাকবে। ওর নাম মদন। কাল-পরশুর মধ্যে ভালো একটা স্কুলে ভর্তি করে দিবি। আর সব ব্যবস্থা আমি করছি। ওকে নিয়ে যা—
বাচ্চু অবাক একটু হল বটে, কিন্তু কিছুই জিগ্যেস করল না। এই কাকার বুকের খবর সে রাখে। এত শ্রদ্ধাও বোধ হয় দুনিয়ায় আর কাউকে করে না। মদনের হাত ধরে ভিতরে চলে গেল।
চোখ মুখ ভালো করে লক্ষ্য করে মিষ্টি তেমন জেরা করতে ভরসা পেল না। তার অনুমান প্রেশার একটু-আধটু বেড়েছে। শুধু মন্তব্যের সুরে বলল, ব্যবস্থাটা আর একটু-ভেবে-চিন্তে করলে হত না?
—কেন?
—পিওনের ছেলের সঙ্গে লেপটে থাকতে বাচ্চুর ভালো না-ও লাগতে পারে।
—লেপটে থাকতে হবে কেন? এ বাড়িতে ঘরের অভাব নাকি? আর ওই পিওন না থাকলে দুঃসময়ে তার কাকার অস্তিত্ব থাকত না এ কথাটা বাচ্চুকে জানিয়ে দিতেই বা তোমার অসুবিধে কি?
মিষ্টি চেয়ে রইল শুধু। এ-চাউনির অর্থ বাপীর কাছে দুর্বোধ্য নয় একটুও। যার জন্যে এত দরদ, দুঃসময়ে যারা এত করেছে—এতগুলো বছরের মধ্যে তাদের কথা একবারও মনেও পড়ে নি কেন? গাড়িতে পনের মিনিটের পথ…একটা খবর পর্যন্ত নেওয়া হয় নি কেন?
বাপী সোজা হয়ে বসল একটু। এই নীরব প্রশ্নের জবাব দেবে? গোপনতার অন্ধকার গর্ত থেকে বেরিয়ে আসার এমন সুযোগ আর পাবে? জবাব দেবে? দেবে দেবে দেবে?
কিন্তু অদৃশ্য কেউ গলা চেপে ধরেছে তার। দম বন্ধ হয়ে আসচে।
মিষ্টি তাড়াতাড়ি কাছে এগিয়ে এলো।—ঠিক আছে, যা করেছ বেশ করেছ, এখন ওঠো তো, মাথা ঠাণ্ডা করে চুপচাপ খানিক শুয়ে থাকো।
.
এক মাসের মধ্যে মদনের বাইরের ভোল বদলে গেল। কেউ দেখলে বুঝবে না ও এ বাড়ির ছেলে নয়। এমন চকচকে জামা প্যান্ট জুতো আগে চোখেও দেখে নি। তার আলাদা ঘর, আলাদা পড়ার ব্যবস্থা। দুবেলা দু’জন মাস্টারের কাছে পড়তে হয়। স্কুলবাসে যায় আসে। এমন তোয়াজে থাকার ফলে এরই মধ্যে ছেলেটার কচি মুখের শ্রী আরও ফিরে গেছে। মিষ্টিও লাগে। কিন্তু পিওনের ছেলের জন্য যা করা হচ্ছে তা খুব স্বাভাবিক মনে হয় না তার। ঘরের লোক যা করছে ঝোঁকের বশে করছে ভাবে।
বাপীও ছেলেটাকে লক্ষ্য করে। নিজে কাছে আসে না। কাছে ডাকে না। কিন্তু কিছুই চোখ এড়ায় না। একটা দুরন্ত খাঁচায় এনে পোরা হয়েছে। ফাঁক পেলে ছিটকে বেরিয়ে যেতে পারে। তক্ষুনি নিজের সেই দুরন্ত ছেলেবেলা চোখে ভাসে। একেবারে জাহান্নামেই যাবার কথা। যায় নি কারণ মাথার ওপর বাবা ছিল, আগলে রাখার মত পিসী ছিল, আর মিষ্টি নামে এক মেয়ের কাছে পৌঁছনোর একাগ্র লক্ষ্য ছিল। এই ছেলের কি আছে? কে আছে? ভেসে গেলে স্রোতের মতো ভেসে যাবে। ভাবতে গেলেও ভিতরটা ধড়ফড় করে ওঠে বাপীর।
দিন গড়ায়। মাস গড়ায়। একে একে দুটো বছরও গড়িয়ে গেল। বাপীর বয়েস এখন সাঁইত্রিশ। কিন্তু মনে হয় এই দেহ-পিঞ্জরের অন্ধকারে সুড়ঙ্গ-গহ্বরে অনন্তকাল ধরে কেউ গুমরে মরছে, বেরিয়ে আসার জন্য মাথা খুঁড়ছে। যতদিন পর্যন্ত কিছু লক্ষ্য ছিল, খোঁজা ছিল, শুধু ততদিনই বাঁচার মত বেঁচেছিল। লক্ষ্যের শেষ, খোঁজার শেষ মানেই মৃত্যু। এই মৃত্যু জীবনের শেষ কথা হতে পারে না, এ-বিশ্বাস এখন বদ্ধমূল। কিন্তু সামনে কে এগোবে? কে খুঁজবে? যে এগোবে যে খুঁজবে সে তো এক মিথ্যেকে আশ্রয় করে গোপনতার অন্ধকার কবরের তলায় ঢুকে বসে আছে।
বাপী খুব আশা করেছিল, এখানে চোখের ওপর থেকে ছেলেটা মিষ্টির মন কাড়বে। মিষ্টির মন ওকে ঘিরে একটু একটু করে মায়ের মন হয়ে উঠবে। তখন বাপী এই গোপনতার কবর থেকে বেরিয়ে আসার কোন না কোন পথ একদিন পাবেই।
তা হল না। মিষ্টির কর্তব্যে ত্রুটি নেই। কিন্তু বাচ্চু যত কাছের, এই ছেলে তার ধারে-কাছেও না। দিন কয়েক আগে বলেছিল, স্কুল-কলেজের গরমের ছুটি চলেছে, বাচ্চু ক’দিনই দেখেছে দুপুর রোদে মদন বয়সে বড় বাজে ছেলেদের সঙ্গে খেলা করছে নয়তো আড্ডা দিচ্ছে—ডাকলেও ওর কথা শোনে না তুমি ডেকে একটু ধমকে দিও তো।
শোনামাত্র বাপী তেতে উঠেছিল।—কেন, তুমি কিছু বলতে পারো না? তুমি ধমকে দিতে পারো না?
মিষ্টির সাফ জবাব, পরের ছেলেকে নিয়ে তুমি এত মাথা ঘামাচ্ছ—যা করার তুমিই করো।
বাপীর তক্ষুনি মনে হল, মিষ্টির চোখে এই পরের ছেলের সঙ্গে বাচ্চুর মতো পরের ছেলের অনেক তফাৎ। পিওনের বস্তিঘর থেকে এসেছে বলে শাসনের মর্যাদা দিতেও আপত্তি। সেদিনের মাত্রা ছাড়া শাসনের মুখে মিষ্টিই আবার বাধা দিয়েছে। বেশি উত্তেজনার ফল জানে। মদনকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বাপীকে বলেছে, বেশি বাড়াবাড়ি কোরো না। তুমি চাইলেই—
থেমে গেছে। সে চাইলেই বস্তিঘরের ছেলের স্বভাব এত সহজে বদলাবে না বলতে যাচ্ছিল বোধ হয়। তারপর দেড়-দুমাসের মধ্যে বাপী তার মুখে এই ছেলের ভালোমন্দ সম্পর্কে কোনো কথা শোনে নি।
.
…তারপর সমস্ত সত্তা দুমড়নো যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে বাপীর মুক্তির দিন। গোপনতার শেষ। বাষট্টি সালের জুলাইয়ের দু’তারিখ সেটা।
আগের দিনটা, অর্থাৎ পয়লা জুলাই, দেশের—বিশেষ করে এই বাংলার বিরাট শোকের দিন। ডাক্তার বিধান রায় নেই। বেলা বারোটার পাঁচ মিনিট আগে তাঁর জীবনদীপ নিভেছে। এই দিনে পৃথিবীতে এসেছিলেন। এই দিনেই চলে গেলেন। বাপীর ভিতরটা বিষাদে ছাওয়া। দোষ-গুণ নিয়ে মাটির এমন বিরাট পুরুষ আর কে থাকল?
পরদিন।…অর্থাৎ আজ সকাল। তাঁকে নিয়ে মহাযাত্রা শুরু হয়েছে। তাঁকে শেষ দেখা দেখতে কাতারে কাতারে মানুষ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। বাপীও ঘরে বসে থাকতে পারে নি। পায়ে হেঁটেই রাস্তার মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল। মহাযাত্রা এগিয়ে গেল। বাপী দেখছিল, দেশের মানুষ অকৃতজ্ঞ নয়। চোখের জলে তারা শ্রদ্ধা জানাচ্ছে।
বাপী ফিরে চলেছে। এ-ও মৃত্যু কি মুক্তি, ভাবছে। বাড়ির কাছাকাছি এসে হঠাৎ কিছু চোখে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় রক্ত চড়ে গেল। রাস্তার ও-ধারে পানের দোকানের সামনে চোদ্দ থেকে সতের আঠের বছরের চার-পাঁচটা ছোকরা জটলা করছে আর সিগারেট টানছে। তাদের মধ্যে মদন! তার মুখেও সিগারেট।
বাপী নিঃশব্দে রাস্তা পেরুলো। ডানা ধরে হিঁচড়ে ওকে রাস্তার এ-পারে নিয়ে এলো। ছেলেটা যমের মুখে পড়েছে বুঝছে। বাড়ি। জামার মুঠো ধরেই বাপী তাকে দোতলায় বড় ঘরটায় এনে ফেলল। তারপর পায়ের থেকে জুতো খুলে এলোপাতাড়ি পিটতে লাগল।
ভিতর থেকে মিষ্টি ছুটে এলো। বাচ্চুও। কিন্তু বাপীর মাথায় খুন চেপেছে। গড়াগড়ি খাচ্ছে ছেলেটা কিন্তু মুখ দিয়ে শব্দ বার করছে না। ওকে একেবারে শেষ না করে বাপী থামবেই না। মিষ্টি কয়েক পলক বিমূঢ়। সত্রাসে এগিয়ে এসে তাকে থামাতে চেষ্টা করল, দু’হাতে আগলে রাখতে চেষ্টা সরল। চেঁচিয়ে বলে উঠল, বাচ্চু, মদনকে তুলে নিয়ে শিগগীর ঘরে চলে যা!
বাচ্চু তাই করল। বাপী হাঁপাচ্ছে। চাউনিও অস্বাভাবিক।
হাত থেকে জুতোটা কেড়ে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মিষ্টি আকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে? ও কি করেছে?
জ্বলন্ত চোখে তার দিকে চেয়ে বাপী জবাব দিল, রাস্তায় ইয়ার-বন্ধুদের সঙ্গে সিগারেট টানছিল…।
শোনামাত্র মিষ্টিও রেগে গেল কি রকম। বলে উঠল, ছোটলোকের ছেলে, বিড়ি সিগারেট খাবে বেশি কথা কি? তা বলে তুমি এত ক্ষেপে গিয়ে নিজের ক্ষতি করবে কেন?
—কি বললে? প্রাণপণ চেষ্টায় বাপী সংযত করতে চাইল নিজেকে। কিন্তু ভিতরে ভূমিকম্প হচ্ছে। গোপনতার কবরটা সরার আগে ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে।—ও ছোটলোকের ছেলে হলে সেই ছোটলোক আমি।…ও আমার ছেলে।…শুনতে পাচ্ছ? বুঝতে পারছ? সেই ছোটলোক আমি!
টলতে টলতে বাপী নিজের ঘরে চলে গেল।
মিষ্টি চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে। দু কানের পরদা ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু মগজে কিছু ঢুকছে না। একটু বাদে পায়ে পায়ে সে-ও ঘরে এসে দাঁড়াল। বাপী খাটের রেলিং-এ ঠেস দিয়ে বসে আছে। উদ্ভ্রান্ত চাউনি। এই মুখের দিকে চেয়ে অশুভ আশংকায় মিষ্টির ভিরতটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। নিজের অগোচরে দু’পা এগিয়ে এলো।
বাপীর ঘোরালো চাউনি।—কি শুনলে? কি বুঝলে?
মিষ্টি বিড়বিড় করে বলল, এসব কথা থাক এখন…।
—আর থাকবে না। অনেক থেকেছে। উঠে নিজেই দরজা দুটো ভেজিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াল।—তোমাকে বলতে না পেরে প্রায় তিন বছর ধরে আমি মৃত্যু—যন্ত্রণা ভোগ করছি। অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি। তোমার আমার মধ্যে গোপনতা থাকবে না বড়াই করে বলেছিলাম—তার শাস্তি ভোগ করছি।…শোনো, আজ আবার বলছি, আমার যা-কিছু ভালো, যা-কিছু মন্দ—সব তোমার জন্যে—শুধু তোমার জন্যে।…লোক ডেকে নিয়ে গিয়ে তুমি আমার সমস্ত স্বপ্ন চুরমার করে দিয়েছিলে মনে পড়ে? অসিত চ্যাটার্জি আর তার সঙ্গের জনাকতকের অপমানে আমার মাথা মুড়িয়ে দিয়েছিলে, মনে পড়ে?
মিষ্টি বিমূঢ় মুখে চেয়ে আছে। নিজের অগোচরে মাথা নেড়েছে কিনা জানে না।
—সেই রাতে আমি পাগল হয়ে গেছলাম। সমস্ত মেয়ে জাতটাকে ভস্ম করে ফেলতে চেয়েছিলাম। সেই রাতে কমলা বণিক এসেছিল। আমি একটুও প্রস্তুত ছিলাম না। অন্ধকারের জানোয়ার শুধু তোমার ওপরেই ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য মাথা খুঁড়ছিল। সেই অন্ধকারে তোমার বদলে কমলা এসেছিল। সে আমাকে চায়নি ছেলে চেয়েছে। রতন বণিক তার দিদিকে ছেলে দিতে পারে নি, তাকেও দিতে পারবে না বুঝেছিল। আরো দু’রাত আমিই শুধু নরকে ডুবেছিলাম, তারপর চাবুকে-চাবুকে নিজেই নিজেকে রক্তাক্ত করেছি—সজাগ করেছি। পালিয়ে গেছি। কিন্তু কমলাকে ঘৃণা করতে পারি নি। যাবার আগে ও বলেছিল, এরপর তুমি কেবল আমাকে ঘেন্নাই করবে জানি, কিন্তু আমি হয়তো তোমাকে পুজো করেই যাব, আর ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করব যেন তোমাকে ভালো রাখে।
মিষ্টি চেয়ে আছে। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের সামনে এবার তারও জগৎ ভাঙছে, গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। কানে যা শুনল তা তলিয়ে ভাবার ফুরসৎ পেল না। তার আগে ভিতরে এ কিসের ঢেউ? ঘৃণা? বিদ্বেষ? সব থেকে বেশি— অবিশ্বাস?
মিষ্টি একরকম ছুটেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
বাপী খাটে বসল। শুয়ে পড়ল। দু’চোখ আপনা থেকে বুজে এলো। চোখের সামনে অন্ধকারের সমুদ্র। অথচ আশ্চর্য! এই সমুদ্র সে অনায়াসে পার হয়ে যাচ্ছে। চারদিকে আলোর তট উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। সব অন্ধকারে খসে খসে দূরে সরে যাচ্ছে!
মিষ্টি বাচ্চুকে বলেছে ডাক্তার ডাকতে। ডাক্তার এসেছে। দেখে গেছে। আবার ই সি জি করা হয়েছে। তার ফল কি বাপী জানে না। কৌতূহলও নেই। ওরা কেন এত করছে ভেবে পায় না। এত ভালো কি বাপী জীবনে থেকেছে? সাতদিনের মধ্যে মিষ্টি একটা কথাও বলে নি। কিন্তু কাছে এসেছে। কর্তব্য করেছে। রাতের জন্য আবার নার্স এনেছে। বাপী না ঘুমনো পর্যন্ত নিজেও ঘরে থেকেছে। তারপর চলে গেছে। ও প্রচণ্ডভাবে নিজের সঙ্গে যুঝছে, বাপী বুঝতে পারে। কিন্তু আশ্চর্য, তার জন্যও বাপীর ভিতরে এতটুকু উদ্বেগ নেই। আজ হোক বা দু’দিন বাদে হোক, মিষ্টি ওকে বুঝবেই। না বুঝে পারে না। না বোঝা মানে সত্যের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা থাকা যায় না।
…সকাল থেকেই বাপীর চোখ-মুখের চেহারা সেদিন অন্যরকম। ভিতরে যেন এক অবাক-করা আনন্দের ফোয়ারার মুখ খুলে গেছে।…কিন্তু মিষ্টি জিত্ বাচ্চু তার মুখের দিকে চেয়ে কি বুঝছে? কি বুঝছে? বাপীর হাসি পেয়ে গেল। ওরা ঘাবড়াচ্ছে। আনন্দের ছিটেফোঁটাও টের পাচ্ছে না।
মিষ্টি সারাক্ষণ প্রায় কাছে কাছে আছে। দু-বার করে ডাক্তার এসে দেখে গেল। ডাক্তারের মতে প্রেশার বোধ হয় বেশি হাই। বাপীর হাসি পাচ্ছে। হাতের খোলা বইটা খোলা অবস্থাতেই উল্টে রেখে সকলের মুখগুলো দেখতে লাগল।
বিকেল। মাত্র আধ ঘণ্টার জন্য মিষ্টি ঘর ছেড়ে গেছল। ফিরে এসে মিষ্টি দেখল বিছানা খালি। খোলা বইটা তেমনি উপুড় করা। ভাবল বাথরুমে গেছে। উঠে তাও যাবার কথা নয়।
মিষ্টি বইটা তুলে নিল। সকাল থেকে মোটা কালিতে লাল দাগ মারা একটা জায়গায় বহুবার করে পড়তে দেখেছে লোকটাকে। পড়েছে। তারপর চোখ বুজেছে। আর নিজের মনেই যেন হেসেছে। হাসিটা যে কি রকম অদ্ভুত লেগেছে মিষ্টির।
এখনো সেই লাল দাগ-মারা পাতা। মিষ্টি পড়ল। ছাপা অক্ষরে ছোট ছেলেদের উপকথার মতো গল্প একটু।
—‘গরিব কাঠুরে জঙ্গলে কাঠ কাটতে গেছল আর মনে মনে দুরবস্থার জন্য নিজেকে অভিসম্পাত করেছিল। সাধুর রূপ ধরে ভাগ্য এসে তার সামনে দাঁড়াল। বলল, এগিয়ে চল, এগিয়ে চল—পেয়ে যাবি। সাহস করে কাঠুরে সেদিন অনেক দূরে চলে গেল। তারপর অবাক কাণ্ড। সামনে মস্ত একটা চন্দনের পাহাড়। আনন্দে কাঠুরের পাগল হবার অবস্থা। তার দিন ফিরেছে। চন্দন কাঠে থলে বোঝাই করল। আর ভাবল, আস্তে আস্তে সমস্ত পাহাড়টাই তুলে নিয়ে যাবে।
কিছুদিন বাদেই কাঠুরের মনে হল, সাধু তো তাকে থামতে বলে নি— এগিয়ে যেতে বলেছিল। সামনে কি তাহলে আরো বেশি লোভের কিছু আছে নাকি? এগিয়ে চলল। এবারে টাকার পাহাড়। কাঠুরে আনন্দে দিশেহারা। দিন-কতক পাগলের মতো টাকা তোলার পর আবার সেই কথাই মনে হল। সাধু সামনে এগোতে বলেছিল। সামনে আরো কি? আবার চলল। এবারে সোনার পাহাড় তারপর অবার সেই। আরো সামনে কি? হীরে মুক্তো মানিকের পাহাড়! ব্যস, চাওয়ার বা পাওয়ার আর কি থাকতে পারে।
কিছুকাল মত্ত আনন্দে কাটানোর পর বিবেকের আবার সেই তাড়না। সাধু থামতে বলে নি। এগোতে বলেছিল। কিন্তু যা পাবার সব তো পেয়ে গেছে। আর কি পাবে? কোন দিকে এগোবে? বাইরে আর এগোবার কোনো দিক নেই নিজের ভিতরের দিকে চোখ গেল তার। কাঠুরে সেই পথ ধরে এগোতে লাগল। তারপর কি আশ্চর্য? সেখানে যে ঐশ্বর্য—তার আভাতেই যে দুচোখ ঠিকরে যায়! এমন ঐশ্বর্য যে তার চারিদিকে জ্যোতির সমুদ্র।
খোলা বইটা মিষ্টি তেমনি উল্টে রেখে দিল। একটু বাদেই খেয়াল হল, বাথরুমের এদিকে ছিটকিনি টানা। অর্থাৎ সেখানে কেউ নেই। ত্রস্তে উঠে দাঁড়াল। সব কটা ঘর খুঁজল নেই। নিচে নামতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। ঘুরে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দিকে চলল। মাস কয়েকের মধ্যে নিচে নামতে দেখে নি। ছাদে বেড়াতে দেখেছে।
তাই। লম্বা ছাদের এ-মাথা ও মাথা করছে। নড়াচড়া একেবারে বারণ! বাপী দেখতেও পেল না। আর একবার ছাদের এ-মাথা থেকে ও-মাথায় চলে গেল।
ফিরছে। মিষ্টি সামনে মুখোমুখি এগিয়ে গেল। বাপী থমকে দাঁড়াল। মুখে আলগা রক্ত জমাট বেঁধে আছে। চোখ অস্বাভাবিক চকচক করছে। অনেক দূরের কোথাও থেকে ফিরল যেন। ভালো করে দেখতে লাগল। খুব নরম গলায় বলল, মিষ্টি অবিশ্বাস কোরো না, অবিশ্বাস করে কষ্ট পেও না
মিষ্টির বুকের তলায় মোচড় পড়ছে। একটা অজ্ঞাত ভয় তাকে ছেঁকে ধরেছে। এক হাতে বাপীর একটা হাত ধরল। অন্য হাতে শক্ত করে তার কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল, ঠিক আছে, চলো—
মিষ্টির মনে হতে লাগল সিঁড়িগুলো বুঝি আর ফুরোবে না। একটু চেঁচিয়েই বলে উঠল, দেখে পা ফেলো—কাঁপছ কেন?
বাপী টেনে টেনে হেসে হেসে জবাব দিল, আনন্দে আনন্দে।
টের পেয়ে বাচ্চুও ছুটে এসেছে। ধরাধরি করে দুজনে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। মিষ্টির চোখের ইশারায় বাচ্চু ডাক্তারকে ফোন করতে ছুটল।
বাপী বেশ আরাম করে হাত-পা ছড়িয়ে শুলো। চোখ বুজল। ঠোঁটে হাসি।
.
কি একটা চমকের মধ্যে ঘোর কেটে গেল তার। মাঝে কতক্ষণ বা কটা দিন গেছে ঠাওর করতে পারছে না। ঘর ভরতি লোক। একটা অস্পষ্ট কোলাহলের মতো কানে আসছে। কি কাণ্ড, আবু রব্বানীর সঙ্গে এবারে দুলারিও এসেছে! কিন্তু এত আনন্দের মধ্যে ওদের চোখে জল কেন? ঘরের মধ্যে জিত্ মালহোত্ৰা… শ্বশুর শাশুড়ী দীপুদা…বাচ্চু, দরজার কাছে মদন…বিছানায় মিষ্টি। মিষ্টি চেঁচিয়ে বলছে কিছু। ও এত কাছে…কিন্তু কথাগুলো অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে মনে হচ্ছে কেন? মিষ্টি বলছে আমার সব ভুল ভেঙে গেছে, আমি আর কক্ষনো তোমাকে অবিশ্বাস করবে। না, মদন আমার কাছেই থাকবে, আমাকে মা বলে ডাকবে—শুনছ?
…ভালো কথা তো! এত ভালো আর কি হতে পারে? কিন্তু মিষ্টি কাঁদছে কেন? কান্না বাপীর কোন দিন ভালো লাগে না।
…এ কি! এ যে আরো অবাক কাণ্ড! এত কাছের এই মানুষগুলো এতদিন ছিল কোথায়? তারা এত সুন্দরই বা হল কি করে?
—বাবা! আমার দিকে চেয়ে এভাবে দেখছ কি? আর আমার একটুও রাগ নেই তোমার ওপর!
—পিসী? কত দিন দেখো নি আমাকে আচ্ছা জব্দ! আর পালাবে?
—বাঃ! রেমশা! দুষ্টু মেয়ে—এমন করে? সাপের কামড়ের আর একটুও জ্বালা-যন্ত্রণা নেই তো?
—আর একজন…ঠিক এক রকমই আছে, এই মুখ বাপী কখনো ভুলতে পারে?…ঠোঁটের ফাঁকে চুল-চেরা হাসি, দাপটের চাউনি…কিন্তু মুখখানা গায়ত্রী রাইয়ের অত ফ্যাকাশে নয় আর, লালচে। গায়ত্রী মা, তোমার মেয়ে-জামাই খুব ভালো আছে, সুখে আছে—ফুটফুটে একটা নাতনি হয়েছে তোমার জানো তো?
—আমি খুব…খুব অন্যায় করেছি মাস্টারমশায়—কিন্তু আপনি তবু আমাকে বকছেন না কেন? অত হাসছেন কেন?
…সকলের সঙ্গে দেখা হল খুব ভালো হল। কিন্তু তার কি বসে থাকার জো আছে…খুঁজতে হবে না? সামনে এগোতে হবে না? পেতে হবে না? চন্দন কাঠের পাহাড়, টাকার পাহাড়, সোনার পাহাড়, হীরে-মণি-মুক্তার পাহাড়ের পর আর কি কোনো ঐশ্বর্য নেই নাকি? সেই সোনার হরিণ চাও তো ভিতরে খোঁজো। বাইরে কোথাও নেই। বাপী তার আভা দেখেছে, জ্যোতি দেখেছে। বাপী চেয়েছে অথচ পায় নি এমন কিছু আছে?
না, বাপী তরফদারের থামার সময় নেই।