সোনার হরিণ নেই (Sonar Harin Nei) : বারো
ঘড়ির দিকে চোখ ছিল না এমন নয়। হাত-ঘড়িটা হাতে পরাই আছে। তিনটে বাজতে দেখেছে। কাঁটা এর পর চারের দাগের কাছে এগিয়ে আসছে তাও লক্ষ্য করেছে। কিন্তু বাপীর কোন তাড়া নেই। চিৎপাত শুয়ে আছে।
আবু রব্বানী ওকে জঙ্গল থেকে ছেড়েছে সাড়ে বারোটার পরে। তার আগে বারকয়েক মনে করিয়ে দিয়েছে মেমসায়েবের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট তিনটের থেকে চারটের মধ্যে। চারটের দরকার নেই, বাপী ভাই যেন অবশ্য সাড়ে তিনটের মধ্যেই চলে যায়। সময়ের ব্যাপারে মেমসায়েব খাঁটি মেমসায়েব। পরিস্থিতি অনুকূল জেনেও আবুর মনে একটু উদ্বেগ লেগেই আছে। মেমসায়েবের মেজাজ জানে, আবার বাপী ভাইয়ের মগজের খেলার যে নজির দেখেছে তাতেও তার দুর্ভাবনা। আবার কি বলে সব বানচাল করে দেয় তার কিছু ঠিক আছে। একবার কিস্তিমাত হয়েছে বটে, কিন্তু বার বার সেই রাস্তায় এগোলে ডাকসাইটে ঠাকরোন কি আর সেটা বরদাস্ত করবে? বাপীকে বলেওছে সে-কথা
জবাবে বাপী মিটি-মিটি হেসে বলেছে, না, এক রাস্তায় এগোলে কখনও হয়!
আবুর তাতে অস্বস্তি বেড়েছে বই কমেনি। তার ব্যবস্থায় বিরক্তির মিশেল। না না, আর কোনো রাস্তা-ফাস্তার কথা তুমি চিন্তাই করবে না। যা বলে শুনবে আর ভালো ছেলের মত রাজি হয়ে যাবে। মগজে বুদ্ধি কেমন ধরো সেটা ঠাকরোন ভালই বুঝেছে। আর সেই জন্যে এখন তোমার কদর। কিন্তু বেশি বুদ্ধির প্যাচ কষতে গেলে ভরা-ডুবি হবে বলে দিলাম। বুদ্ধির দাম পেয়েইছ, কিন্তু বিশ্বাসে এতটুকু আঁচড় পড়ল তো ভোকাটা। ঠাকরোনের কাছে ওটির কদর সব থেকে বেশি।
আবুর ভয়টা কোথায় বাপীর বুঝতে বাকি নেই! বুদ্ধির ফুটো দিয়ে শেষে বিশ্বাস না গলে যায়। বাপী ভাবতে বারণ করেছে, আশ্বাসও দিয়েছে। কিন্তু বিকেলের সাক্ষাতের ফলাফল না জানা পর্যন্ত ওর স্বস্তি নেই। দোস্তের মুখ দেখে মনে হয়েছে তার যেন খুব একটা গরজ নেই, গরজ শুধু ওরই। বার দুই বলেছে, খুব আশা করেছিল মেমসায়েব ওকেই হুকুম করবে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে। তা না বলার মানে, একলা দোস্তের সঙ্গে কথা বলতে চায়।
আবুর সেই জন্যেই কি-হয় কি-হয় ভাবনা।
বাপীর বুকের ওপর কেউ হাত রেখে দেখছে না। রাখলে বোঝা যেত ঘড়ির কাঁটা যত ঘুরছে বুকের তলার ধুপধুপুনিও ততো বাড়ছে। আবার ঘড়ি দেখল, চারটে বাজতে সতের। জামা-পাজামা বদলে এক্ষুনি রওনা হয়ে পড়লেও চারটের পনের-বিশ মিনিট পরে পৌঁছুবে। বানারজুলির ওই বাড়ি এই ক্লাব হাউস থেকে আড়াই মাইল পথ। আবু এখনও ওকে শয্যায় শয়ান দেখলে ক্ষেপেই যেত বোধ হয়। ভাবত দোস্তের একটুকু তাড়া বা গরজ নেই। কিন্তু তাড়া আর গরজ দুই-ই আছে বলে আজকের সময়ের হিসেবটা অন্য রকম। কলকাতার ব্রুকলিনে মাস—কতক থেকেই গোলামীর স্বাদ বুঝেছে। ঘাড়-নিচু ঘোড়ার পিঠে চাবুক বেশি পড়ে। দু পায়ে ভর করে দাঁড়ানোর পাটাতনটা শুরুতেই যতটা সম্ভব উঁচু করে নেওয়া দরকার। এই পাটাতনের বিচার টাকার অঙ্কে নয়। এই এক রমণীর দৌলতে বাড়তি টাকা তো বেশ আবুও কামাচ্ছে, আরও কতজনে কামাচ্ছে। দুপুরে আবু বলছিল, ঠাকরোনের সুনজরে আছে বলেই রেশমাও সুখের মুখ দেখেছে। কিন্তু বাপী আর সে রকম সুখের প্রত্যাশী নয়। ঠিক কি যে প্রত্যাশা বাপী নিজেও জানে না। সদ্য-সদ্য যে উঁচু পাটাতনের ওপর শুরুতেই দু’পা ভর করে দাঁড়াতে চায়—সেটা ওর নিজেরই সত্তা। টাকার নয়, সম্ভারের নয়—শুধুই সত্তা।
তাই মনে বলছে, আর একজনের মারফৎ আঙুল তুলে দু-করে ডাকা মাত্র ঘড়ির কাঁটা ধরে গোলামের মত আজ অন্তত ছুটে যাওয়ার কোনো দরকার নেই। কেন সময়ের অত খেয়াল ছিল না, হালকা চালের সে কৈফিয়তও মগজে ছকা হয়ে গেছে।…কৈফিয়ৎ তলব করার আগেই আবুর মেমসায়েব বা ঘরে যদি থাকে তো তার মেয়েরও কিছু দেখে দু’ চোখ হয়ত কপালে উঠবে। আবুকে ছেড়ে জঙ্গল থেকে ক্লাব-ঘরে ফেরার পথে বনমায়ার নতুন মাহুত লছমনকে যা বলে এসেছিল, খুশি আর কৃতজ্ঞতায় ডগমগ লছমন মাথা ঝাঁকিয়ে তাতে রাজি হয়েছে।
চারটেই বাজল। বাপী এবার শয্যা ছেড়ে বাথরুমে গিয়ে সাবান দিয়ে বেশ করে মুখটা ধুয়ে এলো। তোরঙ্গ থেকে নতুন আর এক প্রস্থ গেঞ্জি পাজামা আর পাঞ্জাবি বার করে পরল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পরিপাটী করে মাথা আঁচড়ে নিল। শেভিং পর্ব ঘণ্টাখানেক আগেই সেরে নিয়েছিল।
—বাঃ। তোকে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করছে যে রে!
চমকে উঠে হাত থেকে চিরুনি ফেলে দিয়ে আয়নার কাছ থেকে সরে এলো বাপী তরফদার। শেভিংয়ের পর প্রথম যে-দিন স্নান সেরে মাথা আঁচড়ে এমনি একসেট পাজামা পাঞ্জাবি পরে সকালে চায়ের টেবিলে এসে বসেছিল, গৌরী বউদি বড় বড় চোখ করে ওর দিকে চেয়েছিল, তার পর ঠোটে হাসির ফাটল ধরিয়ে বাচ্চু আর মণিদার সামনেই ওই কথাগুলো বলেছিল।
নিজের ওপরেই তিক্ত-বিরক্ত। পিছনের যা কিছু পিছনেই পড়ে থাকে না কেন? মনে পড়ে কেন? পড়ে কেন তাও জানে। মনের ব্যামোয় বাঁক ঘুরতে বাঘ দেখে।
হনহন করে পা চালিয়ে বনমায়া আর লছমনের আস্তানায় চলে এলো। পাশেই লছমনের ঝুপড়ি ঘর। সে তৈরিই ছিল। একগাল হেসে এগিয়ে এলো। ওদিকে আগেও বনমায়া যতবার দেখত বাপীকে সেলাম বাজাতো। মাঝে পাঁচটা বছর অদর্শনের ফলে এখন তো আরও খুশির সেলাম।
এই সকালটা লছমনের কাছে খুব সুদিন। বনমায়া বন-বিভাগের হাতী আর আবু রব্বানী হল গিয়ে জঙ্গলের এই এলাকার হেড বীটম্যান। সেই সুবাদে আবু সাহেবের কৃপার পাত্র। বনমায়ার মন না পেলে আর দু’জন মাহুতের মতো ওরও জবাব হয়ে যাবে—এই হুমকি সাফসুফ দিয়েই রেখেছিল। বনমায়ার তোয়াজ তার দিনরাতের কাজ। তাতে একেবারে ফল হয় নি এমন নয়। অন্য দু’জন মাহুতের মতো বনমায়া ওকে একেবারে বরবাদ করে দেয় নি। সময়ে অনেক সয়, বনমায়ারও এই তোয়াজ পেয়ে কিছুটা সয়ে এসেছিল। তবু মন পাওয়ার ব্যাপারে এই বাঙালী বাবুর কথায় আবু রব্বানী ওকে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে।
দু-দুজন ভালোবাসার মানুষকে একসঙ্গে দেখে এই বজ্জাত যখন শুঁড় দিয়ে ওকে ঠেলে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছিল, বা ফোঁস ফোঁস করছিল—বাঙালী বাবুর কথায় আবু সাহেব তখন এক হাতে শুঁড় আর এক হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে কাছে রেখে বনমায়াকে ধমক-ধামক করেছে। বলেছে, ও-ই এখন তোর আসল ভালোবাসার লোক, বুঝলি? ওদের দেখে লছমনের হাতে খেতে চায় নি, আবু সাহেব তখন বকেঝকে আর রাগ করে শুঁড়ে থাপ্পড় কষিয়ে ওর হাত দিয়েই খাইয়েছে। ভালোবাসার মানুষের গুঁতো খেয়ে কতক্ষণ আর গোঁ থাকে। এর পর বাঙালীবাবু আর আবু সাহেবকে হাতির পিঠে তুলে নিয়ে লছমনই মনের আনন্দে তাদের জঙ্গলে কাজের জায়গায় পৌঁছে দিয়ে এসেছে।
আবু সাহেবের ওপর লছমনের খুব একটা ভরসা ছিল না। কিন্তু বাঙালীবাবু এ কদিনের মধ্যে তার কথা রেখেছে। আর এই এক সকালের মধ্যে চাকরি খোয়াবার ভয়ও দূরে সরে গেছে। লছমন তাই কৃতজ্ঞ যেমন, খুশিও তেমনি।
হাওদা সাজিয়েই রেখেছিল। বাপী শুঁড় বেয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সে-ও উঠে পড়ল।
বাপী নিজের মনে হাসছে। মাথায় কি ভূত চেপেছে? সে-রকম ভাবলে এখনও নেমে পড়া চলে। চটক দেখানোর লোভে? তাও নয়। একটু বৈচিত্র্যের লোভ অবশ্যই। এর আড়ালে নিজের প্রত্যাশার চেহারাটাও চাপা পড়ার কথা।
আধা-আধি পথ ভাঙার পর বাপী সচকিত। আগে আগে পায়ে হেঁটে যে চলেছে, পিছন থেকে এক নজরেই তাকে চিনেছে। রেশমা। পরনে চকচকে ঘাগরা। পুষ্ট দুই বাহুতে রূপোর দুটো পেঁচানো গয়না। ফর্সা দুই পায়েও সেই রকম প্যাচানো রূপোর খাড়ুর মতো। এ-রকম গয়না গত সন্ধ্যায় অন্তত দেখে নি বাপী। দেখলে মনে থাকত। এখনও রোদ আছে সেই আলোয় ওগুলো চকচক করছে।
রেশমা সত্যি সুখের মুখ দেখেছে মনে হয়।…আবু বলেছিল, ও আর সাপ খেলা দেখায় না, সাপ বেচে। খপাখপ বিষাক্ত সাপের টুটি চেপে ধরে। জঙ্গলে সাপ কিলবিল করছে। ধরলেই টাকা। গায়ত্রী রাইয়ের কাছে সেই টাকা মজুত। কোন জাতের কটা সাপ পেল আবু সেই হিসেব দাখিল করলেই হাতে নগদ টাকা। কিন্তু শুধু সাপ ধরে আর বেচে কত টাকা রোজগার হতে পারে আর অতটা সুখের মুখ দেখা যেতে পারে বাপীর সেটা ধারণার বাইরে। যে চালে চলেছে, যেন দুনিয়ার অনেকটা তার বশে এখন।
রেশমা কি করে সাপের টুটি মুচড়ে ধরে জানি না। কিন্তু বাপী নিজের প্রবৃত্তির টুটি চেপে ধরে আছে। রেশমা কতটা সুখে আছে বা কেমন করে আছে সে—খোঁজে তার কি কাজ? নিজের ওপর একটা আক্রোশের চাবুক হেনে অবাধ্য দুটো চোখ সামনের জঙ্গলের দিকে ফেরালো।
কিন্তু ওকে ফেরালে কি হবে। আর একটু এগোতে বনমায়ার গলার ঘণ্টির ঠুনঠুন শব্দ রেশমার কানে গেছে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখেছে। তারপর দাঁড়িয়েই গেছে। বাপী গম্ভীর। আবুর ডেরায় গত সন্ধ্যার মতো হাসিমস্করার সুযোগ আজ আর দেবে না। ওকে দেখে কাল অমন হাঁ হয়ে যাওয়াটা নিজের কাছেই বিরক্তিকর বিস্ময়।
—ও বাপীভাই, সত্যি অত মন দিয়ে জঙ্গল দেখছ, না এদিকে তাকাবে না বলে?
ডাকবে জানাই ছিল। সামনের দশ হাতের মধ্যে রেশমা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। দু’-হাত কোমরে। কোমরে দু’-হাত তুলে দাঁড়ানোটা অভ্যাসের দরুন, না চটক বাড়ে বলে, জানে না। বাপীর আর সে-ভাবে দেখার দরকার নেই, ভাবারও নেই। এগোতে হলে বনমায়াকেই পাশ কাটাতে হবে। মেয়েটার সরে দাঁড়ানোর দায় নেই যেন।
কি করবে না বুঝে লছমন বনমায়াকেই দাঁড় করাল। বাপী সাদামাটা হাসি-মুখে জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার, এদিকে কোথায়?
—মেমদিদির ওখানে, ওই নেপালী মেমসায়েবের মেয়েকে আমি দিদি বলে ডাকি। ঠোঁটে হাসির ঝিলিক।—আর হাঁটতে পারি না, আমাকে তুলে নেবে? তুমি তো এ রাস্তাতেই যাচ্ছ…
মুহূর্তের একটা অস্বস্তি সরোষে ঠেলে সরালো বাপী। এতেও লোভের হাতছানি। বলল, আমিও সেখানেই যাচ্ছি, তোমাদের মেমসায়েব ডেকেছেন। দরকারী কথা আছে। তার মধ্যে তোমাকে তুলে নিয়ে সেখানে হাজির হলে তিনি খুশি হবেন?
—ও…। কিছু যেন মনে পড়ল রেশমার।—তোমার তো তিনটে-চারটের মধ্যে যাওয়ার কথা ছিল শুনেছিলাম—এখন যাচ্ছ?
বাপী থমকালো একটু।—কোথায় শুনেছিলে?
সকালে ওই মেমদিদির কাছেই। দু’ চোখে কৌতূহল উপচে উঠল। কাল রাতে তুমি নাকি সব বলেটলে ওই মেমসায়েবকে ঘায়েল করে এসেছ—আর এই জন্যেই তোমার ডাক পড়েছে—সত্যি নাকি?
বাপী এবারে গম্ভীর একটু।—এও তোমার মেমদিদি বলেছে?
—হ্যাঁ, মেমদিদি কেবল আমার সঙ্গেই গল্প-সল্প করে, আর কারও সঙ্গে ভালো করে কথাও বলে না। আত্মতুষ্টিতে উচ্ছল মুখ।—সকালে ওই মেমসায়েবই হঠাৎ এসে জিজ্ঞেস করলেন, আমি আর দুলারি তোমাকে চিনি কি না আর কতটা জানি। তক্ষুনি বলে দিলাম, আমরা খুব চিনি, খুব জানি—তুমি বেজায় ভালো মানুষ। কাল আবু সাহেব তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতেই বুঝেছিলাম কিছু মতলব আছে, ভাবীও তাই বলছিল। তাই চোখ কান বুজে তোমার প্রশংসা করে দিলাম।
হাসির ফাঁকে সাদা দাঁত ঝিকমিক করে উঠল। দুলারি নিজের দাদার বউ ছিল, তাই বোধ হয় এখনও ভাবী বলে।
রেশমার কথা শেষ হয় নি—তা মেমসায়েব চলে যেতেই হেসে হেসে মেমদিদির ওই কথা—বাইরে ভালো, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সেয়ানা ছেলে, কাল রাতে এসে মা-কে পর্যন্ত কাবু করে ফেলেছে। মা আবার বিকেল তিনটে চারটের মধ্যে তোমাকে আসতে বলেছে।
মেয়ে এর বেশি কিছু বলে নি বোঝা গেল। নইলে নিজের কদর বোঝানোর জন্যেই রেশমা তাও বলে দিত। তার দু’চোখ উৎসুক।—তোমার কাজকর্মের ব্যাপারে কথা নিশ্চয়?
বাপী আর কথা বাড়াতে চায় না। মাথা নাড়ল। তাই।
রেশমা খুশি।—যাও যাও, ডেকেছে যখন ঠিক হয়ে যাবে। অত দেরি করলে কেন?…আমার এখন আর গিয়েই কাজ নেই তাহলে। তারপরেই দু’চোখ বড় বড়। তা মেমসায়েব ডেকেছে আর তুমি হাতিতে চেপে দেখা করতে চললে?
ওই খুশি আর এই বিস্ময়ের ফাঁকে মেয়েটার সরল দিকটার হদিস মিলল। এরই মধ্যে হাতের আর পায়ের রূপোর গয়নাও লক্ষ্য করছে বাপী। প্যাঁচানো একজোড়া করে সাপ মুখোমুখি। ওগুলোর জেল্লা আর রেশমার চোখের জেল্লায় খুব তফাৎ ছিল না এতক্ষণ।
বাপী সাদাসিধে জবাব দিল, হাতের কাছে পেয়ে গেলাম, হেঁটে লাভ কি। এবারে রাস্তার মাঝখান থেকে সরে দাঁড়াল। হাতিতে চেপে মেমসায়েবের কাছে যাচ্ছে দেখেই হয়তো মুখে মজার ছোঁয়া।
বনমায়া আবার চলল। বাপী আর ওদিকে চোখ ফেরালো না। চোখ দুটো অবাধ্য হতে চাইছে বুঝতে পারছে। যে চাইছে তার গলা টিপে ধরলেও একেবারে শেষ হয় না কেন?
বাড়িটা আর পঞ্চাশ-ষাট গজের মধ্যে। সামনের বাঁক ঘুরলেই। বাপী লছমনকে দাঁড়িয়ে যেতে বলল। এর পরের হুকুম শুনে লছমনও অবাক। বাঙালীবাবু ওকে নামতে বলছে।
নামল।
গম্ভীর মুখে বাপী বলল, তুমি এখানে দাঁড়াও। আমি ওই নেপালী মেমসায়েবের বাড়ি যাচ্ছি। সেখানে বনমায়াকে ছেড়ে দেব। এখান থেকে লক্ষ্য রেখো, ও নিজে থেকে ফিরে না এলে পাঁচ-সাত মিনিট বাদে তুমি এসে ওকে নিয়ে চলে যেও।
নেপালী মেমসায়েবকে এখানে আর কে না চেনে-জানে। কিন্তু বাঙালীবাবুর এ-রকম আদেশের কিছু মাথামুণ্ডু ভেবে পেল না লছমন। সঙের মত দাঁড়িয়ে রইল।
মেয়ে বারান্দার সামনের দিকেই মুখ করে দাঁড়িয়ে। দূরের জঙ্গল বা মেঘ বা পাহাড় কিছু দেখছিল। আজ আর পরনে শাড়ি নয়, পা পর্যন্ত ধূসর রঙের গাউন। এই বেশে আরও কচি দেখায়। পিছনের টেবিলে মা ফাইল-টাইল কিছু দেখছে।
বনমায়া এসে লতা-ছাওয়া বাঁশের বেড়ার ও-ধারে দাঁড়াতে ঊর্মিলা রাই হতবাক প্রথম। তারপরেই পিছন ফিরে অস্ফুট বিস্ময়ে মায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করল বোঝা গেল। তারও দু’চোখ গোল একেবারে।
বাপী এটুকুই চেয়েছিল। ওই দু’জনকে অবাক হতে দেখে ওর মুখে সহজ সরল হাসি। হাতির পিঠে উঠে দাঁড়িয়েই দু’হাত কপালে তুলে গায়ত্রী রাইয়ের উদ্দেশে নমস্কার জানালো। তারপর শুঁড় বেয়ে তর তর করে নেমে এলো। শুঁড় ঠেলে তুলে চাপা গলায় পরিচিত ইশারা করতেই বনমায়া একেবারে কপালের ওপর উঁচিয়ে ওই মা-মেয়েকে দু’জনকেই লম্বা সেলাম জানালো।
মেয়ে অবাক যেমন খুশিও তেমনি। মা-টি অপলক চোখে দর্শনীয় কিছু দেখছে।
শব্দ করে আর শুঁড় ঘুরিয়ে বাপী বনমায়ার মুখটা এবারে ওই বাঁকের দিকে ফিরিয়ে দিল। বারান্দার দু’জনকে শুনিয়ে জোরে দুটো চাপড় মেরে বলল, যা— এবার ঘরে যা শিগগীর।
ওকে ছেড়ে লতা-ঢাকা বাঁশের গেট পেরিয়ে হাসিমুখে সোজা বারান্দায় এসে উঠল। মা-মেয়ে দু’জনে ওকেই দেখছে এখনও। মেয়ের চোখেমুখে তেমনি মজা-লাগা বিস্ময়। মা’টি অপলক গম্ভীর।
—ঘড়িতে ক’টা এখন? গায়ত্রী রাইয়ের গলার স্বর নীরস।
থতমত খাওয়াটা গোপন করার দরকার নেই আর। হাতঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে মুখের দিকে চেয়ে বাপী আরও একটু ঘাবড়ে গেল যেন।—পাঁচটা…আমার একটু দেরি হয়ে গেছে বোধ হয়।
—তোমাকে তিনটের থেকে চারটের মধ্যে আসতে বলা হয়েছিল। হাতি ছাড়া চলাফেরা করতে পার না?
—ইয়ে, আবু বলেছিল হয়তো…আমি ঠিক খেয়াল করি নি। মুখে সরল হাসি। পিছনে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওই হাতির জন্যেই তো আরও দেরি—পাঁচ—ছ’ বছর বাদে দেখে শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে রাখল—কিছুতে ছাড়বে না। শেষে ওর পিঠে চেপেই চলে এলাম।
ঊর্মিলা এগিয়ে এসে মায়ের কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল। উৎসুক। জিজ্ঞেস করল, 3 জঙ্গল আপিসের হাতি বনমায়া নয়?
বাপী মাথা নেড়ে সায় দিল।
ওখান থেকেই মেয়ে সকৌতুকে হাতিটাকে ভালো করে দেখে নিল একবার।—ও তো এক নম্বরের পাজী হাতি—প্রত্যেক বছর জঙ্গলের কোন্ একটা ইয়ের সঙ্গে পালায় শুনেছি। ফর্সা মুখ লাল একটু।—আপনার সঙ্গে ওর খুব খাতির বুঝি?
—হ্যাঁ, ও আমাকে খুব ভালবাসে। পাজী হাতি বলাটা বাপীর যেন একটু পছন্দ হল না। সেই ভীমবাহাদুরেরর মতো করে বলল, পালালেও বনমায়া খুব ভালো মেয়ে।
ঊর্মিলা খিলখিল করে হেসে উঠল। পরনে শাড়ি নেই যে মুখ চাপা দেবে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে হাসি চাপার চেষ্টা। অত হাসির কারণ বোঝার চেষ্টায় বাপীর মুখে বোকা-বোকা হাসি। কিন্তু দৃষ্টি বেশির ভাগ গায়ত্রী রাইয়ের মুখের ওপর। মা-ও যেন মেয়ের অত হাসি দেখে অখুশি নয়। হয়তো ও-রকম হাসতে কমই দেখে। কিন্তু তার নিজের মুখের গাম্ভীর্য একটু শুধু হালকা হল, তার বেশি কিছু নয়।
হাসি শেষ হলেও তার রেশ একটু লেগেই থাকে। ঊর্মিলা উৎফুল্ল মুখে বলল, আমার একদিন আপনার ভালো মেয়ের পিঠে চড়ার ইচ্ছে—ব্যবস্থা করতে পারেন?
বাপী অম্লান বদনে মাথা নাড়ল, পারে।—আবুকে বললেই তো হয়, যেদিন খুশি আপনারা দু’জনে জঙ্গলে বেড়িয়ে আসুন, হাতির পিঠে জঙ্গলে বেড়াতেই বেশি ভালো লাগে।
সঙ্গে সঙ্গে মেয়ের দু’চোখ কপালে।—মায়ের সঙ্গে হাতিতে! ভাবলেও হেসে সারা হবার মতো কিছু যেন। এবারের হাসি সামলানোর তাগিদে তাড়াতাড়ি ঘরেই ঢুকে গেল।
বাপী আবারও বোকার মতো সেদিকেই চেয়ে রইল। গায়ত্রী রাই চুপচাপ ওকেই লক্ষ্য করছে জানে।…এই মুখে নিছক সরলতা ছাড়া আর কিছু পাবে না, তাও জানে। এবারে তার দিকে চেয়ে বাপী আন্তরিক প্রশংসার সুরে বলল, আপনার মেয়েও অবিকল বাঙালীর মতোই ঝরঝরে বাংলা বলেন।
—আমার মেয়ে নিজের ভাষার থেকেও ভালো বাংলা বলে। বাচ্চা বয়েস থেকে এ-দিকে থেকে বড় হয়েছে, শুরু থেকে স্কুল কলেজে বাংলা পড়ে এসেছে, বলবে না কেন?…তা হাতির পর তুমি ভাষা নিয়ে আলোচনা করবে না কাজের কথা কিছু হবে?
—ইয়ে, না বলুন।
—চাকরি করবে?
আজ কোনো বাঁকা রাস্তায় না গিয়ে সোজা জবাব দিল, আপনি দিলে খুশি হয়ে করব।
গায়ত্রী রাই কিছু বলার আগে ভিতর থেকে মেয়ে আবার এসে হাজির। সামনের দিকে একবার তাকিয়েই বলে উঠল, আপনার ভালো মেয়ে সত্যি নিজেই ঘরে চলে গেল নাকি?
বাপীর জবাব দেবার ইচ্ছে ছিল বুনো হাতির সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে দূরের জঙ্গল থেকে ভালো মেয়ে তার খুশিমতো নিজেই আবার ঘরে ফেরে। কিন্তু আর হালকা কথার ধার দিয়েও গেল না। ঘুরে পেছনটা দেখে নিল একবার। বনমায়াকে আর দেখা যাচ্ছে না বটে। তবু কি ভেবে আধা-সত্যি কথাই বলল।—ওর মাহুত লছমনকে আসতে বলেছিলাম, হয়তো নিয়ে গেছে…নিজেও যেতে পারে।
মেয়ে মায়ের পাশের চেয়ারটা টেনে বসল। সেদিকে চেয়েও গায়ত্রী রাই বলল, আমরা দরকারী কথা বলছিলাম—
সঙ্গে সঙ্গে মেয়েরও ভ্রুকুটি! —বিজনেস না পারসোনাল?
—বিজনেস।
এরপর তাহলে আমাকে তোমার বিজনেসে মন দেওয়ার কথা আর বোলো না। চেয়ার ঠেলে উঠতে গেল।
—সীট ডাউন! মায়ের কড়া ধমক।—আমি যেতে বলিনি, বাজে কথা বলতে বারণ করছি।
মেয়ে আবার ঝপ করে বসে পড়ল। কনুই দুটো টেবিলের ওপর, হাত দুটো দুই ফোলা গালে।..অল রাইট, গো অ্যাহেড।
মায়ের ওপর মেয়ে বিরূপ কত, এটুকু থেকে কিছুটা আঁচ পাওয়া গেল। মেয়ের দিকে চেয়ে গায়ত্রী রাই বলল, ও কাজ করবে বলছে আমিও নেব ভাবছি…
ঊর্মিলা সেই রকম বসে, দুজনের মাঝখান দিয়ে সোজা সামনের দিকে চোখ। ঠোঁট উল্টে জবাব দিল, নেবে যে সে তো কাল রাতেই ঠিক করে ফেলেছ, তার আর কি কথা, নিয়ে নাও।
মায়ের রুষ্ট ঝাপটা। ডলি ডোন্ট বি সো ইমপসিবল।
…মেয়ের ডাকনাম ডলি বোঝা গেল। চেহারার সঙ্গে এ নাম মন্দ মানায় না। ফুটফুটে রং, লালচে ঠোঁট, ফোলা গাল, কাঁধছোঁয়া বব-কাট চুল। কিন্তু বাইরেটা দেখে ভিতরে ডল-এর ভাগে যে এত ঘাটতি ঠাওর করা শক্ত। হাসলে বিপদ। বাপীর গোবেচারা মুখ
তা সত্ত্বেও গায়ত্রী রাইয়ের দু’চোখের উষ্ণ আঁচ একটু ওর ওপরেও এসে পড়ল। —নিয়ে নেবার ব্যাপারে তুমিই গোল পাকিয়ে রেখেছ। আজ সকালে চালিহার সঙ্গে কথা হল। ওয়েস্ট বেঙ্গল রিজিয়নের জন্য একজন লোককে ট্রেনিং দিয়ে ঠিক করে নেওয়া দরকার বুঝিয়ে তাকে তোমার কথা বলেছি। কিন্তু চালিহা অন্য লোক দেবার কথা বলছে, তোমার কালকের ব্যবহারে সে একটুও খুশি নয়!
ওয়েস্ট বেঙ্গল রিজিয়ন শুনেই বাপীর বুকের তলায় নাড়াচাড়া পড়ল একপ্রস্থ। যতটুকু বুঝেছে এদের কাজের বিস্তার বেশির ভাগ উত্তর বাংলায় আর তার বাইরে। এখানে ওয়েস্ট বেঙ্গল বলতে খুব সম্ভব কলকাতার বাজারই আসল। কিন্তু আবার সেই কলকাতা! চিন্তাটা বাপী ছেঁটে দিল। চালিহাকে শুধু বোঝানো হয়েছিল কি-জন্যে লোক দরকার। আসলে কি-জন্যে দরকার তা এক চালিহা বাদে বাকি সকলেই জানে।
কিছু বুঝে নেবার মতো করে বাপী জিজ্ঞাসা করল, এ-কাজের জন্য আপনি যে আমাকে পছন্দ করেছেন সেটা কি মিস্টার চালিহা মোটামুটি আঁচ করতে পেরেছেন?
—হ্যাঁ। আমি তাকে বলেছি, বাড়ির টানে ওইরকম টানা-হেঁচড়া করেছে আর যা বলার বলেছে। সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু চাকরির কথা উঠতে অনেক নরম হয়ে গেছে। এ-লাইনে ইন্টারভিউ করে মনে হয়েছে আমরা ভালো কাজ পাব, এ কথাও তাকে জানিয়েছি। তবু চালিহা খুব একটা সায় দেয় নি, আর একটু ভেবে দেখতে আর যাচাই করে নিতে পরামর্শ দিয়েছে। আর এক দফা ইন্টারভিউর জন্য আজ আবার তুমি আসছ তাও সে জেনে গেছে।
একটু চুপ করে থেকে বাপী বলল, আপনি তাহলে এখন চান আমাকে নেবার ব্যাপারে তিনিও খুশি হয়ে সায় দিন?
গায়ত্রী রাই অল্প মাথা নাড়লেন।—সে আমার বিজনেসের চিহ্ন। শুরু থেকে তোমার এই অ্যাপয়েন্টমেন্ট আপত্তির চোখে দেখলে অসুবিধে, সায় থাকলে ভালো হত—
বাপীর এবারের জবাব নির্লিপ্ত, কিন্তু দ্বিধাশূন্য।—তাই হবে!
গায়ত্রী রাই ঠিক বুঝে উঠল না।—কি তাই হবে?
—আমাকে নেবার জন্য দুই এক দিনের মধ্যে তিনিই আপনার কাছে সুপারিশ করবেন।
এবারে মেয়েরও টেবিল ছেড়ে সোজা হয়ে বসে এই লোককে আর একটু ভালো করে দেখার দরকার হল। গায়ত্রী রাইয়ের চাউনি স্থির, কিন্তু মুখে বিস্ময়ের আঁচড়।—কি করে?
একই সঙ্গে মেয়েও ফস করে জিজ্ঞাসা করল, আঙ্কল চালিহাকে ঘুষ দেবেন? তার দিকে চেয়ে বাপী হাসল একটু।—ঘুষ অনেক রকমের হয়। আপনি যে ঘুষের কথা বলছেন তার টাকা আমার পকেটে থাকে না। মায়ের দিকে ফিরল।— কি করে, আমি এখনো সেটা জানি না, তবে আপনার সায় আছে এটা যখন তিনি বুঝে গেছেন, তাঁরও সায় পাবার ব্যবস্থা আমি করতে পারব—আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
এই জোর কোথা থেকে পেল বাপী জানে না। কিন্তু পেল যে তাতে নিজেরও এতটুকু সংশয় নেই। ওর মুখের দিকে চেয়ে মা-মেয়েও এই জোরেরই হদিস খুঁজছে।
বাপীর ভিতরে ভিতরে হঠাৎ আবার শুরু থেকে সেই উঁচু পাটাতনে দু’ পা রেখে দাঁড়ানোর তাগিদ। কর্ত্রী-কর্মচারী সম্পর্কটাকেই গোড়ায় নাকচ করার ঝোঁক। মুখখানা একটু কাঁচুমাচু করে তার দিকে তাকালো।—এবারে আমি একটা কথা বলেই ফেলি?
তক্ষুনি মহিলার মালিকের মুখ, মালিকের চাউনি।—টাকা পয়সার কথা?
বাপী অপ্রস্তুত।—সে কি। আপনার ওপর ছেড়ে দিয়েছি যখন ও তো আপনার ভাবনা। হাসল।—আমার চাওয়াটা তার থেকে অনেক কম। বিকেলে চায়ের অভ্যেস, এখন পর্যন্ত এক পেয়ালাও জোটে নি। ভাবছিলাম, বলাটা ধৃষ্টতা হবে কিনা—
মেয়ে ছেলেমানুষ, সে হেসেই ফেলল। তার গুরুগম্ভীর মা-টিকে এমন উল্টো-পাল্টা পরিস্থিতির মধ্যে আর কখনো পড়তে দেখে নি। উঠতে যাচ্ছিল, ওই মা-ই ইশারায় নিষেধ করল। আর এক দফা সামনের ছেলের মুখখানা দেখে নিয়ে ভিতরের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে জোরেই ডাকল, কোয়েলা!
পাঁচ সেকেণ্ডের মধ্যে যে রমণীটি সামনে এসে দাঁড়ালো তাকে দেখে বাপীর দু’চোখ বড় রকমের হোঁচট খেল একপ্রস্থ। কোয়েলা মানে যদি স্ত্রী-কোকিল হয় তাহলে মেয়ে-জাতের দিক থেকে আর গায়ের রঙের দিক থেকে মেলে অবশ্য। কিন্তু গায়ে-গতরে এমন জাঁদরেল মেয়েমানুষ কমই চোখে পড়ে। বাপীর মনে হল তাকেও আলতো করে তুলে ধরে বারান্দার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে। পরনে খাটো গাউন। কোমর বেড়িয়ে একটা মোটা এপ্রন গোঁজা। বইয়ের পাতার গাবদা আদিবাসিনীর মূর্তি। প্রমীলা-পরিবারের প্রহরী হবার মতোই।
নাম কোয়েলা!
—তিন পেয়ালা চা। কুইক
নতুন মানুষের মুখের ওপর একবার দ্রুত চোখ বুলিয়ে হেলে-দুলে কোয়েলা আবার ভিতরে ঢুকে গেল। যাবার আগে সুইচটা টিপে দিয়ে গেল। দিনের আলোয় টান ধরেছে। বাপী সোজা না তাকিয়েও লক্ষ্য করছে, তিন পেয়ালা শুনেই মেয়ে যেন মায়ের মুখে না হোক চোখে একটু প্রশ্রয়ের বিরল আভাস দেখতে পাচ্ছে।
সেটুকুও গোপন করার জন্যেই হয়তো গায়ত্রী রাই ভুরু কুঁচকে তাকালো।—শুধু চা, না এরপর বলবে খিদে পেয়েছে?
লজ্জা পেয়ে বাপী হাসল।—না তা বলব না, দুপুরে ডাটাবাবু ভালো খাইয়েছে।
গায়ত্রী রাই তক্ষুনি কাজের কথায় চলে এলো—তোমার থাকার ব্যবস্থা কি হবে?
বাপী সবিনয়ে জবাব দিল, আমার সব ভার আপনি নিচ্ছেন, এটুকুও নিন…ওখানে এক রাত থেকেই আমার হাঁপ ধরে গেছে।
—কেন? ওখানকার অ্যারেঞ্জমেন্ট তো খুব ভালো শুনেছি, আর তোমার বিল তো আমিই পেমেন্ট করব বলে দিয়েছি?
—তা বলেছেন কিন্তু অত ভালো বলেই আমাদের মতো লোকের কাছে অস্বস্তি। বুদ্ধি করে আরো একটু যোগ করল।..রাতে জানলা খোলা থাকলে লিকারের গন্ধ ঘরে আসে—
এই জবাবে অখুশি নয় মনে হল বাপীর।
কোয়েলা ট্রে-তে তৈরি চায়ের পট আর পেয়ালা রেখে গেল। ঊর্মিলা উঠে দাঁড়িয়ে পেয়ালায় চা ঢালল। যে যার পেয়ালা টেনে নেবার পর গায়ত্রী রাই বলল, কিন্তু এখানে আবার একটা পার্টিশন দিয়ে ঘর তুলতে গেলে বিচ্ছিরি হবে—
নিজের পেয়ালাটা হাতে করে বাপী উঠে দাঁড়াল। তারপর বারান্দার এদিকে এসে পাশের খালি জমিটুকু দেখে নিল। মায়ের সামনে এই সহজতাটুকু মেয়েটার লক্ষণীয় বস্তু। ফিরে এসে নিজের চেয়ারে বসে বাপী বলল, মাঝখানে কাঠ বা ইঁটের পার্টিশন দিতে গেলে বিচ্ছিরিই হবে, মালীকে দিয়ে মেহেদীর উঁচু ঝাড় সমান করে ছেঁটে নিয়ে বসালে খারাপ দেখতে হবে না। পার্টিশনের কাজ হবে আবার দু’দিকে ফুলটুল ফুটলে দেখতেও ভালো হবে। সামনে একটা ঘর, পিছনে একটু কিচেন আর বাথ, সামান্য জায়গাই নেবে। মেহেদীর পার্টিশান করলেও দু’দিকে কিছু জায়গা ছাড় থাকবে।
এরকম পার্টিশনের কথা গায়ত্রী রাই ভাবেন নি। এ ছেলের মাথা কত দিকে খেলে তাই দেখছেন। একটু চুপ করে থেকে বলে, সে যা হয় দেখা যাবে, চালিহার সঙ্গে পরামর্শ করে দেখি। ঘর তুলে দিলেও তো আর দু’দিন চারদিনে হচ্ছে না, আপাতত তোমাকে ওই ক্লাবেই থাকতে হচ্ছে।
—থাকব।
—বাট্-সাপোজ, ঘর তুলে দিয়ে ওদিকটা তোমাকে ছেড়ে দিলাম, আর এদিকটা যেমন আছে তেমনি আমি কিনে নিলাম…তাহলে আপত্তি হবে?
এবারে লুব্ধ হবার মতোই প্রস্তাব বটে। কিন্তু বাপীর হঠাৎ কেমন মনে হল এটা লোভের টোপ হতে পারে। আবু মহিলার কাছে ওকে নির্লোভের সার্টিফিকেট দিয়ে গেছে। সেটা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে এই উদার প্রস্তাব কিনা বলা যায় না। তাছাড়া, ভাগ্যের ছকে বড় দান যদি কিছু পড়ে থাকে তো এই পৈতৃক ভিটের দৌলতেই পড়েছে। মন বলছে লোভে পড়লে ভুল হবে।
বাপীর মুখে বিড়ম্বনার হাসি। খুব নরম করে জবাব দিল, বিক্রী করার দরকার হলে আপনাকেই আমি সবার আগে বলব।…আমার বাবা অনেক কষ্টে এখানে মাথা গোঁজার একটু ঠাই করেছিলেন, এই বাড়িতে আমি জন্মেছি…বেচে দেব ভাবতে খারাপ লাগে। আপনি আপনার নিজের বাড়ি মনে করেই এখানে থাকুন না।
মেয়ে এবারে একটু শব্দ করেই বেতের চেয়ারটা ঠেলে উঠে দাঁড়াল। বলল, ফার্স্ট ডিভিশন—!
মেয়ের হঠাৎ এই আচরণ বা মন্তব্যের জন্য প্রস্তুত ছিল না মহিলা। জিজ্ঞেস করল, কি…?
বলছি একেবারে ফার্স্ট ডিভিশন। ইউ নিডন্ট গো ফারদার, এবারে ছেড়ে দাও, হাঁপ ফেলে বাঁচুক। হাসি চাপার চেষ্টা
—আঃ ডলি! ডোন্ট বি সিলি! কিন্তু মুখখানা যতটা কড়া করে তোলার চেষ্টা ততোটা পারা গেল না যেন। আর অনুশাসনও বাপীর কানে তেমন জোরালো ঠেকল না।
.
সামনে জঙ্গল, তাই বানারজুলির এদিকটায় সন্ধে হতে না হতে ঘন অন্ধকার। ফেব্রুয়ারি মাস, ছ’টা বাজতে না বাজতে সন্ধ্যা। বাইরে পা দিয়ে বাপী তরফদার অন্ধকারের মধ্যে পড়ল, আর শীতের ঝাপটা খেল। কলকাতার তুলনায় এখনো বেশি ঠাণ্ডা এখানে।
পরনে কাল রাতেও শুধু পাজামা পাঞ্জাবি ছিল। কিন্তু কাল রাতে এতটা টের পায়নি, অথবা আবুর কড়া মেজাজের মুখে পড়ার ফলে খেয়াল করে নি। বাপীর হাসি পেল হঠাৎ। আরামের শরীরে শীত-গরম কিছুই সয় না। বাপী কি তাহলে আরামের মুখ দেখতে চলল? আসলে দিনের রোদে বেরুনোর সময় গরম জামা সঙ্গে নেবার কথা মনে থাকে না। থাকবে কি করে, মাথার তো আর বিশ্রাম নেই। জোরে পা চালিয়ে যে শরীর গরম করবে তারও উপায় নেই। অন্ধকারে ঠোক্কর খাবার ভয়। টর্চ আনতেও ভুলেছে। বাক্স থেকে টর্চটা বারই করা হয় নি। ব্যাটারি আছে না ফুরিয়েছে তাও জানে না।
বাঁক ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে সোজা মুখের ওপর এক ঝলক জোরালো আলো। চোখ ধাঁধিয়ে উঠল। অন্যমনস্কতার দরুন চমকেও উঠল। দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু বড় টর্চের ঝাঁঝালো আলো চোখের ওপর থেকে নড়ছে না, কাছ থেকে আরো কাছে এগিয়ে আসছে।
—আঃ! টর্চটা সরাও, চোখ দুটো গেল যে! সামনে একটা হাত আড়াল করে বাপী দেখে নিয়েছে।
আবু দাঁড়িয়ে। তার এক হাতে আজ একটা মস্ত টর্চ, অন্য হাতে লাঠি। পরনে খাকী ট্রাউজার, গায়ে পুরো হাতার গলাবন্ধ মোটা গেঞ্জি। বলা সত্ত্বেও মুখের ওপর থেকে টর্চটা সরল না। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। একটু বেশি গম্ভীর।
—কি মুশকিল! ওর রকম-সকম দেখে বাপী হেসে ফেলল।—শিকারের টর্চ ফেলে আমার চোখ দুটো কানা করে লাভ কি!
আবু টর্চ নামালো। কিন্তু এমন করে ধরল যাতে মুখ আর পথ দুইই দেখা যায়। সঙ্গ নিয়ে বলল, মেমসায়েব তোমাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দেয় নি তাহলে?
বাপী হাসছে।—তুমি সেই রকম আশা করেছিলে?
আবু চুপ একটু। তারপর আবার প্রশ্ন।—আমি পই পই করে তোমাকে সাড়ে তিনটের মধ্যে চলে যেতে বলেছিলাম—সে জায়গায় তুমি পাঁচটায় গিয়ে হাজির হয়েছিলে?
—দেরিই হয়ে গেল। তোমাকে কে বলল?
কোনো জবাব দেবার মেজাজ নয় এখন আবু রব্বানীর। আবার প্রশ্ন।—আর, তুমি হাতির পিঠে চেপে মেমসায়েবের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলে?
বাপী একটু জোরেই হাসল এবার। বলল, দেখে দু’জনেরই তাক লেগে গেছল, লছমনটাকে তো ওই বাঁকের খানিক আগেই নামিয়ে দিয়েছিলাম। বনমায়াকে দেখে তোমাদের বাচ্চা মেমসায়েবের ওর পিঠে চাপার ইচ্ছে একদিন। আমি বললাম, আবুই মুরুব্বি, তাকে বললেই হবে।
আবুর হাতে টর্চ আবারও মুখের ওপর উঠে এসে তারপর নামল। অর্থাৎ ভালো করে আর এক দফা দেখা দরকার হয়েছে। ফোঁস করে একটা বড় নিঃশ্বাস ছাড়ল।——নাঃ, মেমসায়েবকে যা-ই বলে আসি না কেন, তোমার চরিত্তির বোঝা এই মোল্লারও কাজ নয় আর।
বাপী হেসেই জিগ্যেস করল, দেরিতে আসা আর হাতিতে চেপে আসার খবর তোমাকে কে দিলে—রেশমা?
—জানো তো সবই, আর জিগ্যেস করো কেন?
—বাঃ, তোমার রাগের কি হল?
—পাঁচটায় গিয়ে হাজির হলে, মেমসায়েব কিছু বলল না?
—রাগ করল।
—আর তুমি?
—শুনলাম। দেখলাম। তুমি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে?
—কম করে এক ঘণ্টা। আসার মাঝে মাঝরাস্তায় রেশমার সঙ্গে দেখা। তুমি তার মাত্র মিনিট দশেক আগে হাতি চেপে মেমসায়েবের সঙ্গে দেখা করতে গেছ শুনেই আমার মাথা খারাপ হবার দাখিল। কি হল না হল, দয়া করে বলবে এখন।
বাপী তাকে আশ্বস্ত করল, সব ঠিক আছে কিছু ভেবো না।
কি-রকম ঠিক আছে খুঁটিয়ে শুনল। এ ব্যাপারে যেমন ধৈর্য তেমনি মনোযোগ। মেমসায়েবের আচরণ আবুর কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার মেয়ের কাণ্ড শোনার ফাঁকে ফাঁকে হেসে উঠেছে। আর বাপীকে সাবধান করেছে, খবরদার খবরদার! তুমি পছন্দ করলেও মরেছ, মেয়ে পছন্দ করলেও মরেছ!
এত কথার ফাঁকে ক্লাবের কাছাকাছি এসে গেছে। বাপী থামতে আবারও দুশ্চিন্তা।—সবই তো ভালো, কিন্তু ওই ম্যানেজার তোমার জন্য সুপারিশ করবে বলে এলে তার কি হবে?
—করবে। ক্লাবে রোজই আসে তো।
—এখানে থাকলে আসে। টর্চের আলোয় আবু হাতঘড়ি দেখে নিল।—তার আসতে আটটা সাড়ে আটটা, এখনো ঢের দেরি। এখন আবার মদের গেলাস নিয়ে জুয়ায় বসে গেলে নড়ানো যাবে না। ডাকাডাকি করলে উল্টে বিরক্ত হবে। তার থেকে তার বাড়িতে যাও না, কাছেই—
কথাটা ভাবার মতো। মদ খেলে মতিগতি কেমন হয় বাপীর সেটা খুব ভালো জানা নেই। ঘোর-লাগা অবস্থায় রতন বনিককে দেখেছে। তবে সে লোকটা নির্বিষ ভালো মানুষ। কিন্তু মেজাজী বা প্যাঁচালো মানুষের কথা বলা যায় না। আবুর বাবা কালুকেই হাঁড়িয়া গিলে ছেলের ওপর হম্বিতম্বি করতে দেখেছে।
—তাই চলো।
ক্লাবের পাশ দিয়ে রাস্তা। এই এলাকায় দু’ঘরের একটা কনট্রাকটার কোয়াটার্স ভাড়া নিয়ে থাকে। বাপী বলল, কারো সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকলে যদি ক্লাবে এসে গিয়ে থাকে—দেখেই যাই।
দেখতে এসে আর এক মুশকিল। বারান্দায় পা দিতেই ব্যস্তসমস্ত ডাটাবাবু এগিয়ে এলো। মাথা চুলকে যে সমাচার জানালো শুনে আবুর মেজাজ খাপ্পা। চা-বাগানের এক ছোকরা অফিসারের বন্ধু হঠাৎ সস্ত্রীক ডুয়ার্স থেকে এসে গেছে। অফিসার তাদের আপাতত বাপীর পাশের ঘরে তুলেছে, আর ডাটাবাবুকে অনুরোধ করেছে, পরিবার নিয়ে থাকবে, ওই কোণের ঘরটা তাদের ছেড়ে দিলে ভালো হয়।
আবু খেঁকিয়ে উঠল, ও-ঘরে গেস্ট আছে শুনেও ছাড়তে বলে কি করে? আপনি বললেন না?
—বলেছি। মেয়েছেলে নিয়ে থাকা, তাই অনুরোধ করেছেন। রাজি না হলে বলে দেব। হুট করে মেয়েছেলে নিয়ে কেউ হাজির হবে আমিই কি ভেবেছি, সচরাচর তো এ-রকম হয় না।
বাপী বুঝল, চা-বাগানের অফিসারের গেস্ট বলেই ডাটাবাবু একটু বিপাকে পড়েছে। তাদেরই দাবী আগে। আবুকে থামিয়ে বাপী তাকে নিশ্চিত করল।— ঠিক আছে, আমরা এক্ষুনি বেরিয়ে যাচ্ছি, আপনি কাউকে দিয়ে আমার বাক্স আর বিছানা এ-ঘরে এনে দিয়ে তাদের কোণের ঘরেই যেতে বলুন।
ডাটাবাবু কৃতজ্ঞ।
চালিহা ক্লাবে আসে নি। আবুকে সঙ্গে করে বাপী কোণের ঘর খুলে দিল। ভিতরে ঢুকে টেবিল থেকে কলমটা তুলে নিয়ে একটুকরো কাগজে গোটা গোটা করে লিখল, বাপী তরফদার—ফ্রম মিসেস গায়ত্রী রাই।
আবু জিজ্ঞেস করল, এ দিয়ে কি হবে?
—আমি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব, আগে তুমি গিয়ে এটা চালিহার হাতে দেবে। বেরিয়ে আসতেই পাশের ঘরের অতিথিটির মুখোমুখি। নিজের ঘরে ঢোকার সময় দরজা বন্ধ দেখেছিল, এখন খোলা। দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। অবাঙালী বিহারী-টিহারী হবে। মোটা কালো মুখশ্রী দেখলে দ্বিতীয় বার তাকাতে ইচ্ছে করবে না। ড্যাবডেবে চোখে লোকটা ওদের দিকেই চেয়ে আছে। তাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে এসে আবু অস্ফুট কটূক্তি করে উঠল, এই চেহারা নিয়ে বউয়ের সঙ্গে রস করার জন্যে শালার কোণের ঘর চাই!
বাপীও হালকা মন্তব্য করল, বউ নিশ্চয় সুন্দরী, তাই যেটুকু সম্ভব চোখের আড়ালে রাখতে চায়।
রসের ঠাট্টায় আবুও কম যায় না। তক্ষুনি বলল, মরদের যা ছিরি, তুমি সাবধান তাহলে। তোমার সঙ্গে মেয়েছেলের একটু বেশি যোগ দেখছি। একদিকে মেমসায়েব আর তার মেয়ে ঘায়েল, এদিকে ক্লাবে পরিবার সঙ্গে করে অতিথি আসে না বড়, তুমি এলে আর ওমনি একজন এসে হাজির!
ডাটাবাবুকে চাবি দেবার জন্য বাপী তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল। আবুর ঠাট্টা বুকের কোথাও বেঁধার মতোই। আবুর জানার বাইরেও আরো চার-চারটে মুখ আছে। গৌরী বউদি, ব্রুকলিন বড়বাবুর মেয়ে ঊষা, কমলা বনিক….মিষ্টি। মিষ্টি…? হ্যাঁ মিষ্টির সম্পর্কেও আরো কিছু ভাবার আছে, কিন্তু ভাবনাটাকে এ পর্যন্ত সে জোর করে ঠেলে সরিয়ে রেখেছে।
রাস্তায় নেমে আবু জিজ্ঞাসা করল, তোমার এখন মতলবখানা কি? ম্যানেজারের হাতে-পায়ে ধরবে?
—সেই গোছেরই কিছু করতে হবে। দেখবেই তো।
এখানেও বাইরের ঢাকা বারান্দায় বসার জায়গা। জোরালো আলো জ্বলছে। সেখানে মাঝবয়সী একজন দাঁড়িয়ে। আবু চেনে তাকে। ম্যানেজার সায়েবের কম্বাইনড হ্যান্ড। অসমীয়া। নাম অর্জুন। বারান্দার পর ভিতরে একটু প্যাসেজের মতো। প্যাসেজের দু’দিকে দুটো মুখোমুখি ঘর। বারান্দায় ওঠার পর বাপী লক্ষ্য করল, একটা ঘর থেকে প্যাসেজে সবুজ আলো এসে পড়েছে। বারান্দায় চড়া আলো, তাই লক্ষ্য না করলে চোখে পড়ে না।
আবুর ইশারায় বাপী নামের স্লিপ লোকটার হাতে দিল। কিন্তু ওটা হাতে নিয়েও তার নড়াচড়ার ইচ্ছে দেখা গেল না।
আবু জিজ্ঞেস করল, সায়েব নেই বাড়িতে?
—আছেন। পার্টির লোকের সঙ্গে কথা কইছেন। ব্যস্ত আছেন—
এবারে হুকুমের সুরে আবু বলল, এই সায়েব মালকানের কাছ থেকে আসছেন, এটা তাঁকে দিয়ে এসো।
লোকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেই গেল। মিনিট খানেকের মধ্যেই রণজিৎ চালিহা বেরিয়ে এলো। পরনে চকচকে লুঙ্গি আর হালকা-নীল গরম কাপড়ের ফুল হাতা শার্ট। ফর্সা মুখ বেশ লাল। আসামাত্র বাপীর মনে হল ঘরে বসেই মদ্যপান চলছিল। কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁ করে গন্ধও নাকে এলো।
বাপীর বিনীত নমস্কারের জবাবে রণজিৎ চালিহা একটু চড়া গলায় জিজ্ঞাসা করল, হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?
বাপী শুকনো গলায় জবাব দিল, মিসেস রাই আপনার সঙ্গে দেখা করতে বললেন, তাই অসময়ে….
—আমার সঙ্গে দেখা করতে বললেন? কখন?
—আজই তো মনে হল, এতক্ষণ তাঁর ওখানে ছিলাম, সেখান থেকেই আসছি।
ভুরু কুঁচকে চালিহা একবার আবুকে দেখে নিল। তারপর নিজে একটা চেয়ার টেনে বসে বাপীকে বলল, সীট্ ডাউন—কি ব্যাপার?
হুকুম পেয়েও বাপী বসল না। মুখ দেখে মনে হবে, বেয়াদপীর সাহস আজ আর নেই।—বলছি…কিন্তু তার আগে আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, বাড়ির চিন্তায় কি বলে ফেলেছি না ফেলেছি, ঠিক নেই, আমার অন্যায় হয়েছে—
লোকটার নেশা হয়তো এখনো তেমন জমেনি। বাঁকা চোখে খানিক চেয়ে চেয়ে দেখল ওকে। জিজ্ঞেস করল, এখন আর বাড়ির চিন্তা নেই?
—আজ্ঞে না, মিসেস রাইকে কথা দিয়ে এসেছি, আপনি যা ঠিক করে দেবেন, তাই হবে।
—আমি?
—হ্যাঁ।
ঠোটের ফাঁকে হাসির রেখা স্পষ্ট হল এবার। কলে-পড়া ইঁদুরের মুখ দেখছে যেন।—ওয়েল, আই অ্যাম বিজ্ই নাও, শুট!
একই রকম নিরুচ্ছ্বাস বিনয়ে বাপী বলল, একটা কাজের জন্য মিসেস রাই গতকাল আর আজ দু’দিন আমার ইনটারভিউ নিলেন, আপনারা আমার জন্য এতটা চিন্তা করবেন ভাবতেই পারি নি। মিসেস রাই আজ জানালেন, তাঁর কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু এ-ব্যাপারে ফাইন্যাল ডিসিশন আপনার, আপনার অ্যাপ্রুভাল ছাড়া তিনি কিছু করেন না।
ঠোঁটের হাসি আরো প্রসারিত এখন।—তিনি এ-কথা তোমাকে বললেন, আর আমার সঙ্গে দেখা করতে বললেন?
এবারে সোজা তুমি। কাল হলে কি হত বলা যায় না, আজ বাপী একটু অনুগ্রহ হিসেবে গ্রহণ করল।—আজ্ঞে হ্যাঁ।
চালিহা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।—এখানে ওবিডিয়েন্স ইজ ফার্স্ট কনডিশন—এটা এরপর মনে থাকবে তাহলে?
বাপী মাথা নাড়ল। থাকবে।
—অল রাইট, কাল মিসেস রাইয়ের সঙ্গে কথা বলব।
আর আবুর সেলাম বা বাপীর নমস্কারের জন্য অপেক্ষা না করে ভিতরে ঢুকে গেল। ওরা দু’জন বারান্দা থেকে নেমে আবার অন্ধকারে।
আবু বলল, বয়েসে যত ছোটই হও, একটা গড় করে ফেলব?
বাপী হাসছে।
—কিন্তু তুমি অত নিশ্চিন্ত ছিলে কি করে? ওই দাপটের লোকের সঙ্গে কাল তুমি যে-রকম ব্যবহার করেছ, মওকা পেয়ে আজ যদি তোমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করত?
বাপী ধীরেসুস্থে জবাব দিল, তা যে করতে পারে না একটু মাথা খাটালে তুমি নিজেও নিশ্চিন্ত থাকতে। চালিহা জানে তোমার মেমসায়েব আমার বাড়ির ভাড়াটে, জানে চাকরির ব্যাপারে তার সঙ্গে পর পর দু’দিন আমার কথা হল, আর অত টাকা খরচ করে আমাকে ক্লাব-হাউসে রাখা হয়েছে তাও জানে—এর পরেও সে কি এত বোকা যে গোঁয়ারতুমি করে আমাকে একেবারে ছেঁটে দেবে? বরং তোমাদের মেমসায়েব তাকে অত মর্যাদা দিল শুনে কত খুশি দেখলে না?
আবুর হাতের টর্চ বাপীর মুখের ওপর উঠে এলো।
—কি হল?
টর্চ নামিয়ে আবু হালছাড়া গলায় জবাব দিল, আর একবার তোমাকে দেখে নিলাম।
বাপী বলল, কিন্তু চালিহা ভিতরের ঘরে সবুজ আলো জ্বেলে পার্টির সঙ্গে কথা কইছিল, এ আবার কেমন পার্টি?
আবুরও তক্ষুনি টনক নড়ল।—ইস্! জানতে পারলে খুব ভালো হত। ব্যাটা ক্লাবে না গিয়ে বাইরের মানুষকে অন্দরে ঢুকিয়ে মদ গিলছিল যখন, কোনো শাঁসালো মক্কেলই হবে—কত দিকে যে ফাঁক করলে মেমসায়েবকে ঠিক নেই।
অন্ধকারে বাপী মুখ টিপে হাসছে। রসের ইঙ্গিতটা আবু ধরতে পারে নি। লুঙ্গি পরে আর ঘরে সবুজ আলো জ্বেলে যার সঙ্গে মদ খাচ্ছিল সেই মক্কেল কোনো মেয়েমানুষ হতে পারে কিনা সেটাই তার জিজ্ঞাস্য ছিল।
ক্লাবে কে এলো বা ক্লাব থেকে কে বেরুলো ডাটাবাবু নিজের জায়গায় বসেই দেখতে পায়। বাপীকে দেখে নিজেই নতুন ঘরের চাবি হাতে দিয়ে গেল। লম্বা বারান্দা ধরে এগোতে গিয়ে কোণের ঘরের দিকে চোখ গেল। খোলা দরজার সামনে আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে একজন বেয়ারার সঙ্গে কথা কইছে ডুয়ার্সের অতিথির বউ। মুখের আধখানা দেখা যাচ্ছে। পরনে রং-চঙা সিল্কের শাড়ি, যে-হাতটা দরজার দিকে, সেই হাতে অনেকগুলো কালো চুড়ি, মাথায় কপাল-ছোঁয়া ঘোমটা, নাকে একটা ঝকঝকে পাথরের ফুল। বয়েস বেশি নয়, বেশ দীর্ঘাঙ্গী, গায়ের রঙ দস্তুরমতো ফর্সা, দোহারা চেহারা। মুখের সবটা দেখা না গেলেও বউটা যে বেশ সুশ্রী সন্দেহ নেই।
আবুর সঙ্গে চোখাচোখি হতে দু’জনেই হাসল। আবুর একটা চোখ আপনা থেকে ছোট হয়ে গেল। ফিসফিস করে বললে তোমার কথা মিলেছে, বউ সুন্দরী।…কাল বাপীকে জঙ্গলে আসতে বলে সে চলে গেল।
আজ জুয়ার আসর কেমন বসেছে দেখার জন্য বাপী সামনের বড় হলটায় ঢুকে গেল। গত রাতের মতো অতটা জমজমাট নয় এখনো। এক টেবিলে ডুয়ার্সের কালো-কালো অতিথিটিকে দেখে আর একটু এগিয়ে এলো। হাতে মদের গেলাস। এরই মধ্যে বেশ টইটম্বুর অবস্থা। পাশের চেয়ারের লোকটি তার এখানকার অফিসার বন্ধু হবে।
বউ নিয়ে খাসা বেড়াতে এসেছে যা-হোক! বাপী বেরিয়ে এলো। বউটা দরজার সামনে এখন একা দাঁড়িয়ে। এদিকেই চেয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তে বাপী মুখ ফিরিয়ে নিল। কোণের ঘরের আগের ঘরটাই তার। কিন্তু কি রে বাবা, কাছাকাছি হবার পরেও বউটা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। সোজা না তাকিয়েও বাপী অনুভব করল, তার দিকে চেয়েই আছে। দরজার তালা খোলার ফাঁকে বাপী একটু ঘাড় না ফিরিয়ে পারল না। সঙ্গে সঙ্গে আবার মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে পড়তে হল। তাজ্জব ব্যাপার। নাকের ঝকঝকে সাদা ফুলটার মতোই বউটার বড় বড় চোখ দুটোও চকচক করছিল। আর সেই চাউনি ওর মুখের ওপর আটকে ছিল।
হতে পারে পারিবারিক জীবনে বউটা অসুখী। কিন্তু তা বলে এ কি কাণ্ড? অথচ ওই চাউনিতে অশোভন যে কিছু দেখেছে ঠিক তাও নয়।
ঘণ্টাখানেক বাদে ডিনারের জন্য আবার দরজা খুলে বেরুলো যখন, ও-ঘরের দরজা বন্ধ। ডিনার সেরে ফিরল যখন, তখনো। বড় হলঘরটা একচুপি দেখে নিল। এখন মদ আর জুয়ার আসর জমজমাট। সেই অতিথির মাথা এখন চেয়ারের কাঁধে। আর সোজা রাখতে পারছে না।
এই রাতে আর ভালো ঘুম হল না বাপীর। কাজ এবারে একটা হবে বুঝতে পারছে। গোড়াপত্তন যে রকম হল, ভালো থাকার মুখ এরপর হয়তো সেও দেখবে। গায়ত্রী রাই চালিহাকে বুঝিয়েছে ওয়েস্ট বেঙ্গল রিজিয়নের জন্য একজনকে ট্রেনিং দিয়ে তৈরি করা হবে। মালিকের মাথায় মতলব যা-ই থাক, মাঝেসাঝে কলকাতায় তাহলে তাকে যেতে হবে। অস্তিত্বের মানচিত্র থেকে ওর একটা জায়গা মুছে ফেলার তাড়না তার
কিন্তু সত্যি কি তাই? মনের তলায় এতটুকু লোভের অস্তিত্বও কি আর নেই? বানারজুলিতে পা দিয়ে জঙ্গলের সেই সব স্মৃতি ওকে কি সেই আগের মতোই পাগল করে তোলে নি? দুর্বার আক্রোশে এক মেয়ের ওপর তার দাবীর ঘোষণা তখনো ভিতর থেকে কেউ করে নি? বলতে চায় নি আগের এই সবকিছু যদি সত্যি হয় তাহলে পরে যা ঘটেছে, তাই শেষ নয়? সেই মেয়ের সম্পর্কে যে চিন্তাটা এ পর্যন্ত ঠেলে সরিয়ে রেখেছিল সেটাই এখন এই শেষের প্রতিবাদে আঙুল তুলছে।…ওর ওপর হামলা করার জন্য পাড়ার মস্তান ছেলে কটাকে ধরে আনা হয়েছে দেখে মিষ্টির সেই রাগ, তার হাতের ক্রুদ্ধ ধাক্কায় মারমুখো একটা ছেলের দূরে ছিটকে পড়া আর তারপর সোনালি চশমার মুখের ওপর সেই আগুন ছিটানো। এর পিছনে যদি আর কোনো সত্যের অস্তিত্ব না থাকে এরকম হতে পারে কি করে?
শেষে হতাশ হয়েই হাল ছেড়েছে বাপী। এ যন্ত্রণার থেকে কি মুক্তি নেই? এত সবের পরেও আশা মরে না কেন?
সকালে উঠে মুখ-হাত ধুয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল। খানিক ঘোরাঘুরির পর চায়ের টানে ক্লাবে পা দেবার মুখে আবার সেই ধাক্কা। কোণের ঘরের জানালায় সেই বউটা দাঁড়িয়ে। ওর দিকেই অপলক চেয়ে আছে। দিনের আলোয় নাকের সাদা পাথর অত আর চকচক করছে না, কিন্তু চোখে পড়ে।
মুখ ফিরিয়ে বাপী পা চালিয়ে ক্যানটিনের দিকে চলে গেল। আজও অস্বস্তি। বিরক্তিও।
তারপর সকাল প্রায় দশটা পর্যন্ত অর্থাৎ যতক্ষণ বাপী ক্লাবে ছিল, খবরের কাগজ পড়ার ফাঁকে আর ঘর-বার করার ফাঁকে অনেকবার বাপীর ওই চোখের ঘা খেতে হয়েছে। বাপী ভালো করে তাকাতেও পারে নি, দেখতেও পারে নি। ভালো করে চোখাচোখি হবার আগেই দৃষ্টি ফেরাতে হয়েছে। বউটার ঘরের লোকের সঙ্গেও অনেকবার দেখা হয়েছে। সামনেই বারান্দায় একটা চেয়ার পেতে বসে ছিল। তার ঝিমুনো ভাব এখনো ভালো করে কাটে নি। বউটার আচরণ ভেবেই বিস্ময়ের অন্ত নেই বাপীর। কোনরকম ইঙ্গিত ইশারার ছিটেফোঁটাও নেই, কেবল দেখাটুকুই সব
এত বেলায় আর জঙ্গলের দিকে এগলো না। ঘুরে ঘুরে চা-বাগান দেখল। দূরে দাঁড়িয়ে মেয়েদের আড়াই-পাতি তোলার কাজ দেখল। তারপর আধ মাইল পথ ভেঙে বনমায়ার সঙ্গে খানিক খেলা করে বেলা বারোটার মধ্যেই ফিরে এলো। রাতে ভালো ঘুম হয়নি, এখন চান-খাওয়া সেরে আগে একটু ঘুমনোর ইচ্ছে।
জানলার কাছে সেই বউটা দাঁড়িয়ে। দূর থেকেই বাপী মুখ ফিরিয়ে নিল। আবার ঘুম সেরে বেলা তিনটে-চারটে নাগাদ বেরুনোর সময়েও তাই। ওই জানলার কাছেই দাঁড়িয়ে। বাপীর একবার ইচ্ছে হল সোজা ঘুরে তাকায়, আর নিজের দুটো চোখ দিয়েই জিগ্যেস করে, কি ব্যাপার? পারা গেল না। মাথায় ছিট কিনা কে জানে। নইলে বেড়াতে এসেও স্ত্রীকে ভদ্রলোক কাল বিকেল থেকে এ—পর্যন্ত ক্লাবের বাইরে নিয়ে গেল না কেন?
জঙ্গলে ঢুকলে বাপীর আর সময় কাটতে অসুবিধে নেই। তবে যেদিকে স্মৃতির টান বেশ, আজ আর সেদিকে পা বাড়ালো না। নতুন গাছপালা আবিষ্কারের জন্য উৎসুক। কিন্তু নতুন কিছুই চোখে পড়ছে না। সবকিছু অন্তরঙ্গ পুরনো দোসরের মতো কাছে টানছে তাকে। আবুর সঙ্গে সকালে দেখা হয় নি, কোনো খবর আছে কিনা জানার জন্যও এ-বেলা যাওয়ার কথা ভেবে রেখেছিল। কিন্তু এই জগতের নিভৃতে ঢুকে পড়ার পর কিছুই আর মনে থাকল না। আগু-পিছু রঙিন প্রজাপতি উড়তে দেখল, গাছের ডালে জোড়ায় জোড়ায় কাঠবিড়ালি খেলা করছে দেখল, জোড়ায় জোড়ায় খরগোশের ছোটাছুটি দেখল, ময়ূরময়ূরী দেখল। বাপীর নিজেরই হঠাৎ মনে হল, ছেলেবেলায় ও বড় নিষ্ঠুর ছিল। কত সময় মরণপাথর ছুঁড়ে ওদের এই আনন্দ খতম করে দিয়েছে।
ঘণ্টা দুই ঘোরাঘুরির পর যেখানে এসে দাঁড়াল সে-জায়গাটা চেনা মনে হল, আর অদূরের ওই ডেরাটাও। যদিও মাটির ঘরের এখন আর সেই ভাঙা-দশা নয়, নতুন টালি বসানো হয়েছে, তবু চিনতে ভুল হল না। রেশমার মরদ মাতাল কাঁদনার ডেরা ছিল ওটা। রেশমা কি এখনো এখানেই থাকে?
আবু সঙ্গে নেই, আর এগলো না। ফিরে চলল। গেলে রেশমাই হয়তো বিশ্বাস করবে না ও বেড়াতে বেড়াতে এদিকে চলে এসেছে। কিন্তু পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে পিছনে কলকণ্ঠে—ও বাপীভাই! সামনে অত কি দেখার আছে গো, পিছনে দেখো?
রেশমা। কিন্তু রেশমার পাশে যে তাকে দেখে বাপী যথার্থ অবাক। ঊর্মিলা রাই। পরনে শাড়ি। রেশমা অবশ্য কাল বলেছিল মেমদিদি কেবল তার সঙ্গেই গপ্পসপ্প করে, আর কারো সঙ্গে ভালো করে কথাও বলে না। তা হলে দুই সখীর জঙ্গলে বেড়ানোর মতো খাতির ভাবে নি। হাসছিল সেও। এবারে ঠেসের সুরে রেশমাকেই বলল, যেভাবে দেখতে দেখতে যাচ্ছিল খাঁটি ভাবুকের মতো লাগছিল।
মুখখানা ভারিক্কি করে ঊর্মিলা বাপীর দিকে তাকালো।—মায়ের সঙ্গে আজ দেখা হয়েছে?
বাপী মাথা নাড়ল, হয় নি
—আঙ্কল্ চালিহা সকালে এসেছিল, তুমি কাল রাতে তার সঙ্গে দেখা করেছ বলল, আর মায়ের কাছে তোমার বেশ প্রশংসাই করল।
এটা খুব অবাক হবার মতো খবর নয়। বিস্ময়ের ধাক্কা এই মেয়ের মুখে সরাসরি তুমি শুনে। কাল বিকেলেও আপনি করে বলেছে, আজ ওর মায়ের মতোই তুমিতে নেমে এলো।
ঊর্মিলা আবার বলল, হাঁ করে চেয়ে আছে কি—তুমি সেয়ানা কম? কিছু বুঝতে পারছ না?
বাপী সাদা মুখ করে জবাব দিল, সে-জন্য নয়, হঠাৎ অনুগ্রহ দেখে অবাক লাগছিল, কাল পর্যন্ত ‘আপনি’ ছিলাম, কাজ শুরু হওয়ার আগেই ‘তুমি’ হয়ে গেলাম।
মেয়ে বলল, আমি আপনি-টাপনির ধার ধারি না, তুমিও তাই বলতে পারো।…আংকলকে বশ করলে কি করে, ম্যাজিক-ট্যাজিক জানো?
জবাব দেবার আগেই রেশমা আলতো করে ঠেস দিল, পায়ে ধরে কান্নাকাটি করেছে বোধ হয়। কি-যে হল বাপীর, হঠাৎ কেন যেন রেশমার মুখখানাই ভালো করে দেখে নেওয়ার ইচ্ছে। সে-চেষ্টার আগেই ঊর্মিলার ভ্রুকুটি।—এই পাজী মেয়ে, আমি বলি বলে তুইও বলবি, দু’দিন বাদে ও-ই তোর মুরুব্বি হবে সে খেয়াল আছে?
রেশমা চার আঙুল জিভ কাটল তক্ষুনি।—ও বাপীভাই, তুমি এমন করে চেয়ে আছ কেন? আমার খুব অন্যায় হয়েছে, এই নিজের কান মলছি।
সত্যি সত্যি কানে হাত দিল। তারপর হেসে ঊর্মিলাকেই বলল, আমি কি রকম পাজী মেয়ে তোমার থেকে বাপীভাই ঢের ভালো জানে মেমদিদি—রাগ করবে না। তা আমার কি আর পৌঁছে দেওয়ার দরকার আছে—লোক তো পেলে?
ঊর্মিলা সঙ্গে সঙ্গে ওকে ছুটি দিয়ে দিল, ঠিক আছে, তোকে আর আসতে হবে না। ঘরে যা, বিকেলে আর সাপ-টাপ ধরতে বেরুবি না বলে দিলাম।
জঙ্গলের পথ ধরলে এখান থেকে বাড়ি খুব একটা দূরে নয়। আবার একেবারে কাছেও নয়। বাপীর অস্বস্তি লাগছে। ঊর্মিলা আগে আগে খানিকটা এগিয়েই ঘুরে দাঁড়াল।—এখনো কি জঙ্গলের শোভা দেখতে দেখতে যাবে নাকি? পা চালিয়ে চলো, খ্যাঁক-খ্যাক করার জন্য মা বাইরে বসেই আছে দেখো’খন—
বাপী যথার্থই ঘাবড়ালো, বলল, আমাকে সঙ্গে দেখলে কি খুশি হবেন…
কথাটা আদৌ তলিয়ে ভাবল না ঊর্মিলা। জবাব দিল, তুমি না থাকলে তো রেশমাই সঙ্গে আসত, অখুশির কি আছে!
অর্থাৎ মেয়ের যাতায়াতে একজনের সঙ্গে থাকা নিয়ে কথা। আসার সময় সঙ্গে কে ছিল সে কথা না তুলে বাপী আলতো করে জিগ্যেস করল, একা চলাফেরা উনি পছন্দ করেন না বুঝি?
—নাঃ! এক শব্দের জবাবেই একপশলা বিরক্তি।—কোথাও বেরুতে হলে সঙ্গে হয় কোয়েলা, নয় রেশমা, নয় আবু, নয় তো উনি নিজে!
তারপরেই উৎফুল্ল একটু।—প্রথম দিন দেখেই তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। তুমিই ঠিক মাকে জব্দ করেছ—ইউ উইল বি মাই ফ্রেন্ড—উইল ইউ? বিপন্ন মুখ করে বাপী বলল, সেটা কি আমার দিক থেকে একটু ভয়ের কথা হবে না?
—ভয়ের কথা হবে কেন?
—ইয়ে, আবুর মুখে শুনেছিলাম, আমার আগে চা-বাগানের একজন চৌকস লোককে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া হয়েছিল…সে বন্ধুত্বের জন্য এগোতে তার চাকরি গেছে।
ঊর্মিলা প্রথমে অবাক মুখ করে তাকালো তার দিকে। তারপর মনে পড়ল।—তার তো অন্য রকম মতলব ছিল, আমিই তো মাকে বলে তাকে তাড়িয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে চোখ পাকালো, তোমার সাহস তো কম নয়, তুমি বুঝি সে-রকম বন্ধুত্বের কথা ভেবেছ?
বাপী তাড়াতাড়ি মাথা নাড়ল।—তা না…সেই একজন কি-রকম বন্ধুত্বের দিকে এগিয়েছিল আবু সেটা বলে নি।
ঊর্মিলা জোরেই হেসে উঠল। তরতাজা হাসি। বলল, আবু একটা ওয়ার্থলেস্ আর তুমি একটা সেয়ানা বোকা—ওয়েট ক্যাট্।
.
বাপী ক্লাবে ফিরল রাত প্রায় ন’টায়। মন-মেজাজ সত্যি ভালো। গায়ত্রী রাইয়ের ঠোটের ফাঁকে আজ একটু হাসিও দেখেছে। দেখামাত্র বলেছে, চালিহা সকালে এসে তোমার জন্য সুপারিশ করে গেছে। তুমি তাকে কি বলেছ, তাও শুনেছি। বাট্ ডোন্ট্ এভার ট্রাই টু ওয়ার্ক দ্যাট্ স্টাফ অন্ মি…বি স্ট্রেইট অ্যান্ড বি অনেস্ট।
আজ আর মুখ ফুটে বলার দরকার হয় নি, নিজেই চা খাইয়েছে। পাশের জমিতে ওর জন্য ঘর তোলার কথাও চালিহার সঙ্গে হয়ে গেছে। সে কনট্রাক্টর লাগানোর ব্যবস্থা করবে। ঘর না ওঠা পর্যন্ত ক্লাবে থাকা ছাড়া উপায় নেই।
সেখান থেকে বেরিয়ে সোজা আবুর ঘরে এসেছে। সুখবর আবু আগেই জানে। বিকেলে ওর খোঁজে ক্লাবে এসে ফিরে গেছে। এই নতুন মানুষটার সঙ্গে বাপের জড়াজড়ি কাণ্ড দেখে ওর ছেলে দুটো খুশিতে হাঁ। দুলারি আজ আবার প্রচুর জলখাবার খাইয়েছে। আর ঘরের লোকের উদ্দেশে ঠেস দিয়ে বাপীকে শুনিয়েছে, বানারজুলিতে এতদিন একজনই বুদ্ধিমান লোক ছিল, কাল থেকে সেই অহংকার একটু কমেছে।
ক্লাবে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে কোণের ঘরটার দিকে আগে চোখ গেল। এতক্ষণ মনেও ছিল না। ঘর অন্ধকার, দরজা খোলা। দু’দিন থাকার কথা ছিল, আজই চলে গেছে হয়তো। বউটার আচরণ দুর্বোধ্যই থেকে গেল। নিজের দরজা খোলার ফাঁকেও আর একবার ও-ঘরটার দিকে তাকালো। কেউ আছে মনে হল না।
দরজা ভেজিয়ে গায়ের বুক খোলা সোয়েটার আর পাঞ্জাবি খুলে সটান শয্যায়। ভারী জলযোগের ফলে আরো ঘণ্টা দেড়েকের আগে খাবার তাড়া নেই। ডাটাবাবু হয়তো কালই আবার ওকে কোণের ঘরটা দিতে চাইবে। কিন্তু বাপীর আর দরকার নেই, এ-ই বেশ ভালো। আবার যে কখন পরিবার নিয়ে হাজির হয় ঠিক কি।
দরজায় টুক-টুক শব্দ। বাপী শুয়েই ঘাড় ফেরালো। ডাটাবাবু এই রাতেই ঘর বদলের কথা বলতে এসেছে, নাকি গায়ত্রী রাই আবার কিছু খবর পাঠালো? রণজিৎ চালিহা নয় তো…।
তাড়াতাড়ি সাড়া দিল, কাম ইন!
আস্তে আস্তে এক পাট দরজা খুলে যে এলো তাকে দেখামাত্র প্রচণ্ড বিস্ময়ে বাপী ধড়মড় করে উঠে বসল।
কোণের ঘরের বউটা।
চোখ দুটো চকচক করছে! ঠোঁটে হাসি। নাকের পাথরে সাদা জেল্লা। আরো দু’তিন পা এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল।
বাপীর গলা শুকিয়ে কাঠ। এমন বিমূঢ় যে একটা শব্দও বার করতে পারছে না।
—দু’দিন আমাকে দেখে চিনতে পারলে না বাপীদা, আমি তো তোমাকে দেখেই চিনেছি!
মাথার খাটো ঘোমটা খসে গেছে। এবারে আর এক প্রস্থ ইলেকট্রিক শক্ খেল বাপী। তারপর স্থান-কাল ভুলে হাঁ করে দেখছে। চেনা আদলই বটে। কিন্তু কপালে সবুজ টিপ, নাকে চকচকে সাদা পাথর, দু’হাতে এক গোছা করে কালো চুড়ি…একে বাপী কবে কোথায় দেখল? মেয়েটার ভুল হয়ে থাকলে ওর নাম বলবে কি করে—বাপীদা বলবে কি করে!
—থাক, আর চেষ্টা করতে হবে না। আমি তোমাদের ড্রইং মাস্টারমশাই ললিত ভড়ের মেয়ে কুমকুম। মনে পড়ছে, না তাঁকেও ভুলে গেছ?
মাথায় একটা মুগুরের ঘা খেয়ে আত্মস্থ হল বাপী তরফদার। তার পরেও বিস্ময়ের সীমা-পরিসীমা নেই। নিজের দুটো চোখের ওপর বিশ্বাস খোয়ানোর দাখিল। তেতাল্লিশ সালের গোড়ার দিকে হাড়ের ওপর শুধু সাদা চামড়া মোড়া বছর চৌদ্দর এই মেয়েটাকে প্রথম দেখেছিল। বাপের হাঁকডাকে কড়াইশুঁটি সেদ্ধ আর চিঁড়ে ভাজা খেতে দিয়েছিল। তার বেশির ভাগ রোগা পটকা দুটো ছেলে আর মাস্টারমশাইয়ের পেটে গেছল। পরের দেড় বছরের মধ্যে মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে কমই যাওয়া-আসা ছিল, কিন্তু তখনো এই মেয়ে নিজের স্বাস্থ্যের লজ্জায় হোক ময়লা ছেঁড়াখোঁড়া জামা-কাপড়ের লজ্জায় হোক, সামনে আসতই না। ভিতরের ঘরে সেঁধিয়ে থাকত। একদিন মাত্র রাগের মুখ দেখেছিল—যেদিন জিলিপির ঠোঙা আর মুড়ি নিয়ে যেতে ও বলেছিল, মায়ের বাক্স থেকে বাবা দশ টাকা চুরি করে দুর্ভিক্ষের ফান্ডে পাঠিয়েছিল বলে বাড়ির সকলের উপোস চলছে।…আর মাস্টারমশাই অ্যারেস্ট হবার দিন মেয়েটা ছেঁড়া আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদছিল। দেখা বলতে সর্বসাকুল্যে তিন-চার দিনের।
পাঁচ-ছ বছরে সেই হাড়-চামড়া-মোড়া মেয়ে এই হতে পারে কোনো কল্পনার মধ্যেও আসা সম্ভব নয়। বাপী মাথা নাড়ল বটে, মাস্টারমশাইকে ভোলে নি, কিন্তু এখনো বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না, এ সেই মেয়ে।
কুমকুম বলল, কাল সকালে চলে যাচ্ছি, আজ একবার না এসে পারলাম না। বাপী দ্রুত নিজের মধ্যে ফিরে আসছে। কাল থেকে দেখছ, চিনেছ…এলে না কেন…বরের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলে না কেন?
এক জবাবে কুমকুম দু’দিক সারল।—আলাপ করানোর মতো মানুষ নয়, এখনো এ-ঘরে দেখলে চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে যাবে।
চমকে দরজার দিকে তাকালো বাপী। তারপর তাড়াতাড়ি উঠে এসে দরজার দু’পাটই খুলে পর্দাটাও তুলে দিল। কুমকুম হাসল একটু–তোমার ভয় নেই, আমি দেখে এসেছি, মদ আর জুয়ার নেশায় এখন আর কোনদিকে হুঁশ নেই।
হঠাৎ ভয়ানক অস্বস্তি বোধ করছে বাপী। কুমকুমের ঠোটের হাসি আর চকচকে চোখ কেন যেন খুব স্বাভাবিক লাগছে না।
—বোসো। বসার চেয়ার নিজেই সামনে এগিয়ে দিল। নিজে খাটে বসল।— তোমার বরের নাম কি?
—ব্রীজমোহন। কুমকুমের মুখে অদ্ভুত হাসি।
—নিজে বিয়ে করেছ?
—তা ছাড়া আর কি। কবে থেকেই তো নিজের বাঁচার ভাবনা নিজের।
তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ বদলালো বাপী।—মাস্টারমশাইয়ের খবর কি?
খবর বলা নয়, বাপীর বুকের ভিতরটা দুমড়ে-মুচড়ে দিল কুমকুম। মাস্টারমশাইয়ের খবর ও জানে না, বা কেউ জানে না।… দিনাজপুরে এসে প্রথম দু’আড়াই বছর তারা মামা-মামীর আদরযত্ন পেয়েছিল। মামা মুহুরী কিন্তু জনাকতক পয়সা-অলা মক্কেলের সঙ্গে তার খুব খাতির ছিল। মামার তাগিদে মামী সস্তার বাজারে কুমকুমকে আম-দুধ-ঘি খাইয়ে বেশ তাজা করে তুলেছিল। তারপর বাপের থেকেও বয়সে বড় এক বউ-মরা খাতিরের মক্কেলের সঙ্গে ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিল। এই সময় বাবা এসে যেতে এই বিয়ে নিয়েই মামার সঙ্গে তার ফাটাফাটি ঝগড়া। মুখ দেখাদেখি বন্ধ। ওদের এক খোলার ঘরে উঠে যেতে হল, তারপর প্রায়দিনই উপোস। মাস্টারমশাই জঙ্গল থেকে একদিন কি—সব ফল আর লতাপাতা এনে হাজির—সেদ্ধ করে নুন দিয়ে খেতে নাকি চমৎকার। কুমকুম বা তার মা ফিরেও তাকালো না দেখে নিজেই সেদ্ধ করল। তারপর বাবা আর ছোট ভাই তাই খেল। বড় ভাইটাকে মামা আগেই ঢাকায় এক আত্মীয়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সে বেঁচে গেল। অবশ্য বেঁচে আছে কি নেই কুমকুম জানে না। সেখানকার বড় দাঙ্গার পর থেকে সেই আত্মীয়ের কারো আর খবরই পাই নি। ওই সেদ্ধ বুনো আনাজ খাওয়ার দু’ঘণ্টার মধ্যে বাবা আর ছোট ভাইয়ের সে কি পেট কাচিয়ে রক্ত, আর আধাকাটা পশুর মতো যন্ত্রণায় ছট্ফটানি। রাতের মধ্যে ভাইটা মরেই গেল। বাবা শেষ পর্যন্ত সামলে উঠল, আর তারপর থেকে একেবারে পাগলের মতো হয়ে গেল। বেরিয়ে যেত, আর কখনো কখনো দু’দিন তিনদিন পরেও ফিরত। শেষে একবার আর ফিরলই না। পরের ক’বছরের মধ্যে কুমকুম আর তার দেখা পায় নি।
শোনার যন্ত্রণাও কম নয়। বাপীর দম আটকে আসার দাখিল।—আর তোমার মা?
—বাবা চলে যাবার দুমাসের মধ্যে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলেছে। তার আগের রাত পর্যন্তও আমাকে অজস্র অভিসম্পাত করেছে।
মাথাটা ঝিমঝিম করছে বাপীর। আর কিছু জিগ্যেস করতেও ইচ্ছে করছে না।…এবারে কুমকুমের চকচকে চোখ উৎসুক একটু।—তুমি বিয়ে করো নি বাপীদা…?
—না।
—এখানেই থাকো?
বিশদ করে বলল না। জবাব দিল, থাকব বলে এসেছি—কলকাতায় ছিলাম। শুধু চোখ নয়, কুমকুমের মুখও ব্যগ্র হঠাৎ।—কলকাতা কেমন জায়গা বাপীদা?
—আছে একরকম। অস্বস্তি বাড়ছেই বাপীর। বলল, কুমকুম এখন তুমি ঘরে যাও, ব্রীজমোহন উঠে এলে…তুমি যা…বলছ…
হ্যাঁ, খুব মুশকিল। কুমকুম তক্ষুনি উঠে দাঁড়াল। ঠোটের ফাঁকে তীক্ষ্ণ হাসির ফালা।—বেইমানী ভাবলে তোমার ঘাড়েও ফেলে চলে যেতে পারে।
চলে গেল। এই রাতে বাপীর আর ডিনার খেতে বেরুনোও হল না।
সকাল। বাপী ইচ্ছে করেই প্রাতঃরাশের পর বাইরের বারান্দায় চেয়ারে বসে কাগজ পড়ছিল। খানিক আগে’ একটা জিপ এসে দাঁড়িয়েছে। জিপে ড্রাইভারের পাশে চা-বাগানের সেই ছোকরা অফিসার—ব্রীজমোহনের বন্ধু।
আগে স্যুটকেস হাতে বেয়ারা কোণের ঘর থেকে বেরুলো। পিছনে বিপুলবপু ব্রীজমোহন। তার পিছনে চার আঙুল ঘোমটা টানা কুমকুম। বাপীর দিকে মেয়েটা তাকালোও না একবার। বারান্দা থেকে নেমে গেল।
অফিসার বন্ধুটি মিটিমিটি হাসছে। ব্রীজমোহনও দাঁত বার করে হেসে পিছন ফিরে কুমকুমকে দেখল একবার।
ওদের নিয়ে জিপটা বেরিয়ে গেল।
আর তক্ষুনি বাপীর চোখের সামনে থেকে একটা ঝাপসা পর্দা আচমকা ছিঁড়েখুঁড়ে একাকার হয়ে গেল। কুমকুম আর কত ভাবে বোঝাবে ওকে ও কি? বলেছে, কবে থেকেই নিজের ভাবনা নিজের—বলেছে, মা গলায় দড়ি দিয়েছে, তার আগে পর্যন্ত অজস্র অভিসম্পাত করেছে—বলেছে, বেইমানী ভাবলে ওই লোক তাকে বাপীর ঘাড়ে ফেলেও চলে যেতে পারে। তার আগে ব্যগ্রমুখে জিগ্যেস করেছিল, কলকাতা কেমন জায়গা।
এই একজন নয়, পুরুষ প্রবৃত্তির কোন্ কাঁচা ভিতের ওপর কুমকুমের মরণ—বাঁচন নির্ভর—সেটা আর কত ভাবে ও বলে যাবে?
বাপী স্তব্ধ। বিবর্ণ।