সোনার হরিণ নেই (Sonar Harin Nei) : এগারো
এক ঘুমে ভোর।
চোখ তাকিয়ে বাপী নিজেই অবাক। জানলা দিয়ে বানারজুলির নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে। তার গায়ে ধূসর পাহাড়ের দেয়াল। বাপীর লোলুপ দু চোখ সেদিকে স্থির খানিক।
দু রাত আগে বুকের তলায় যখন রক্ত ঝরছিল, সেই বানারজুলি তখন মায়ের মতো হাতছানি দিয়ে ডেকেছিল। বানারজুলি সত্যিই আশ্রয় দেবে ওকে? নইলে এমন একটানা শান্তির ঘুম এলো কোত্থেকে?
কিন্তু এই ক্লাবে থাকা পোষাবে না। পাঁচ ছ-বছরে ক্লাবের ভোলও একেবারে বদলে গেছে। একতলা বিশাল লম্বা দালান এখন। ছোট-বড় দুটো হলঘর। বাইরের অতিথি অভ্যাগতদের দুই-এক রাত থাকার মতো মাঝারি ঘরও আছে কয়েকটা। ভাড়া লাগে না, কিন্তু কর্তাব্যক্তিদের সুপারিশ লাগে। সাজানো—গোছানো ঘর। একদিকে গদির শয্যা, দেয়ালের গায়ে ড্রেসিং টেবল, আলমারি। অ্যাটাচড বাথ। সেখানেও বেসিন, বাথটাব, মাথার ওপর শাওয়ার। গায়ত্ৰী রাইয়ের চিফ একজিকিউটিভ ক্লাবের ম্যানেজারকে ঘরের কথা বলেই রেখেছিল। এখানে তাকে ম্যানেজার কেউ বলে না। ছোট-বড় উঁচু-নিচু সকলেরই সে ডাটাবাবু। বাপী পরে জেনেছে ভদ্রলোকের নাম বাবুলাল দত্ত—সকলের মুখে মুখে ডাটাবাবু হয়ে গেছে।
মুখ দেখে বয়েস আঁচ করা শক্ত। চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে যে কোনো বয়েস হতে পারে। ঢ্যাঙা, রোগা, ফর্সা। পরনে ঢিলে-ঢালা ট্রাউজার, গায়ে ঢোলা কোট। হাসি-হাসি মুখ, চটপটে হাব-ভাব।
লোকটা আবুকেও খাতিরই করে বোঝা গেছে। বেয়ারার মারফৎ খবর পেয়ে এসেই অন্তরঙ্গ সুরে বলেছিল, কদিনই ভাবছি আবুসাহেবের একেবারে দেখা নেই কেন।
একটা চোখ একটু ছোট করে ঠাট্টার সুরে আবু জিজ্ঞেস করেছিল, মালে টান পড়েছে।
পাশে অচেনা লোক দেখে ডাটাবাবু সপ্রতিভ সৌজন্যে বাপীকে নমস্কার জানিয়েছে—মিস্টার তরফদার? মিস্টার চালিহা আপনার কথা বলে গেছেন। সব ঘরই খালি—যেটা খুশি নিতে পারেন।
সব শেষের এই নিরিবিলি ঘরটাই বেছে নিয়েছে বাপী। বিকেলে একটু ভারী খাওয়া হয়েছিল, ক্ষুধা তৃষ্ণা বোধ খুব ছিল না। কিন্তু আবুর কাছে পার নেই। আজকের দিনটা অন্তত বাপীভাই তার আদরের অতিথি। ক্লাব ক্যানটিনের খানা ভালো, ওই ক্যানটিন চালিয়েই বাবু ডাটা লাল হয়ে গেল, নইলে ম্যানেজার হিসেবে তার মাইনে-কড়ি কিছু নেই—ক্যানটিনে দুজনে একসঙ্গে ডিনার সারবে, তাকে আবু খাওয়াবে।
ডিনারের আগে ক্লাব দেখিয়েছে আবু, ক্লাবের গল্প করেছে। সব কটা চা—বাগানের মালিক আর কর্তাব্যক্তিরা জোট বেঁধে বাড়তি লাভের কড়ি থেকে এই নতুন ক্লাব করেছে। নইলে এই পেল্লায় দালান তুলতে আর সব ব্যবস্থা করতে খরচ যা হয়েছে তার সবটাই ইনকাম ট্যাক্সের পেটে গিয়ে ঢুকত। ভাগাভাগি করে সব টাকাই কোম্পানীগুলোর খরচের খাতায় উঠেছে।
ক্লাবে সাজ বা সরঞ্জামের ত্রুটি নেই। তকতকে বিলিয়ার্ড টেবল, দু সেট টেবলটেনিস বোর্ড, গোটাতিনেক ক্যারমবোর্ড, মাঝারি হলঘরের একদিকে অনেকগুলো ছোট ছোট টেবল, চারদিকে শৌখিন চেয়ার। এখানে তাস দাবা জুয়ার আড্ডা। অন্যদিকে দুটো বড় বড় টেবলে খবরের কাগজ আর রংচঙা জার্নাল ম্যাগাজিন ছড়ানো।
রাত দশটার কাছাকাছি। তখনো জুয়ার আসর জমজমাট। দু-পাঁচজন আধ—বয়সী মহিলাকেও দেখা গেছে এখানে। খবরের কাগজ বা জার্নালের দিকে কেউ নেই। চার-পাঁচটা টেবিলে তিন তাস রামি পোকার চলেছে। ওদিকে সকলেই গম্ভীর, জোরালো আলোর নীচে সিগারেটের ধোঁয়া পাক খাচ্ছে। ব্যস্ত শুধু কয়েকটা তকমা পরা বেয়ারা। অর্ডার মাফিক ড্রিঙ্ক সারভ করে যাচ্ছে আর হিসেবের খাতায় সই নিচ্ছে। হিসেবের ফয়সলা হয় প্রত্যেক জুম্মাবার অর্থাৎ শুক্রবারে। শনি রবি দুদিন চা-বাগানের ছুটি। তাই শুক্রবার রাতে হোমরাচোমরাদের নাকি দিল ভালো থাকে। ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারি ইত্যাদি আছে। বুঝে শুনে রকমারি মদ আমদানির ব্যবস্থা এবং তদারক তারাই করে থাকে। মেম্বাররা কি দরে সেটা এখানে ভোগ করবে তাও তারাই হিসেব কষে ঠিক করে দেয়। এ ব্যাপারে ডাটাবাবু শুধু জিম্মাদার, সার্ভিস চার্জ ছাড়া আর বেশি কিছু লাভ করতে পারে না। তবে আবুর ধারণা বাজারে শুধু খালি বোতল বেচেই লোকটা মন্দ কামায় না। তার আসল লাভ ক্যানটিন থেকে। খানা ভালো। গলা-কাটা দাম। শুক্কুর শনি এই দুটো দিন ডাটাবাবুর লক্ষ্মীবাবুর। চা—বাগানের রইস মানুষেরা সপরিবারে ওই দু রাতে ওখানেই ডিনার সারে।
অল্প আর মাঝারি আয়ের খদ্দেরদের জন্য ডাটাবাবুর ডে-ক্যানটিন খোলা থাকে। তখন কম খরচে লাঞ্চ মেলে। আর যা মেলে সেটা ডাটাবাবুর নিজস্ব কারবার। কম দামে দিশী ভালো মালের যোগানদার ডাটাবাবু। সবাই তো আর হোমরা-চোমরা চাকুরে নয় এখানে। লাঞ্চ খেতে এসে বা এমনিতেও সূয্যি ডোবার আগে এসে তারা আস্ত বোতল কিনে নিয়ে যায়। একটু অসুবিধে, ইচ্ছে করলেও এ জিনিস এখানে বসে খাবার হুকুম নেই। এখানকার বড় সাহেব—সুবোদের সঙ্গে রণজিৎ চালিহার খাতির বাজারের থেকে সস্তায় নামী-দামী মাল যোগানোর দৌলতে, আর ডাটাবাবুর কাছে আবু সায়েবের খাতিরও অনেকটা একই কারণে। আবু বর্ডারের বাইরে গেলেই কম দামের দিশী মাল পাবার আশায় হাঁ করে থাকে ডাটাবাবু। বর্ডারের ওধারে হরেকরকমের দিশী মালেরও ছড়াছড়ি। এই দিশী মাল মানে হাঁড়িয়া পচাই নয়, তার থেকে ভদ্দরলোকের জিনিস।
এহেন জায়গায় কিনা বাপী তরফদার।
এরকম জায়গায় রাতটা অঘোর ঘুমের মধ্যে কেটে গেল সেটাই আশ্চর্য। আরো কদিন ক’রাত থাকতে হবে কে জানে। এখানে বানারজুলির বাতাস নেই, বানারজুলির মাটির গন্ধ নেই। এর থেকে আবুর জঙ্গলের ঘরের একটাতে থাকতে পেলেও বেশি স্বস্তি বোধ করবে।
মুখ হাত ধোয়া হতেই চায়ের তেষ্টা। আর তক্ষুণি বুকের তলায় মোচড়। এই দুটো কান আর দুটো চোখ একটা যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে এলো।…এমনি সকালে খুপরি ঘরের নড়বড়ে দরজা বাইরে থেকে ঠেলে খোলার ক্যাঁচ করে শব্দ।…এক হাতে রুটি বা বিস্কুট, অন্য হাতে গরম চায়ের গেলাস…ঘুমের দাগে ফোলা ফোলা একখানা শামলা মুখ!
দরজা খুলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলো বাপী। বারান্দায় একটা বেয়ারার জিম্মায় বনমায়ার নতুন মাহুত লছমন তার বাক্স আর বিছানা রেখে গেছে। আবু বলে গিয়ে থাকবে। এখানে এ দুটোর একটাও মানায় না। ঘরে ঢুকিয়ে দিতে বলে বাপী সোজা ক্যানটিনে। লম্বা লম্বা পা ফেলে আর এক দিক থেকে ডাটাবাবু সামনে এগিয়ে এলো।—গুড মর্নিং সার, রাতে কোনো অসুবিধে হয়নি?
টাটে গোলাপ কি গাঁদা ডাটাবাবু সেটা দেখে না। বাপী জবাব দিল, কিছু না।
ঘুরে দাঁড়িয়ে হালকা শিস দিতে বেয়ারা ছুটে এলো।—সাবকা ব্রেকফাস্ট।
ডাটাবাবু হাল্কা চালে কিচেনের দিকে চলে গেল। এরপর শুধু চা আর চোস্ট অর্ডার দেয় কি করে? সঙ্গে একটা ডিমের পোচ বলল। কিন্তু এরই বিল দেখে বাপীর দু চোখ কপালে। চায়ের পাট শেষ হতে বিল সামনে রেখে বেয়ারা জিজ্ঞেস করল, দুপুরে লাঞ্চ হবে কি না।
বাপী জানালো, হবে। কিন্তু ভিতরে আবার আর এক চিন্তা। এখানে ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ ডিনার করতে হলে তার পুঁজি ফাঁক হতে কদিন আর। আবু আর তার মেমসায়েব খাসা ব্যবস্থাই করল যা হোক।
এখানে সন্ধের পর কাগজ আসে। বাপী বাইরে বসে আগের দিনের কাগজটা উল্টে-পাল্টে দেখছিল। কত দিন যাবৎ বাইরের জগৎটাকেই ভুলে বসেছিল। খবরের কাগজ হাতে নিয়েও দেখেনি। কিন্তু আজও একটু বাদেই আর ভালো লাগল না।
দূরে বানারজুলির জঙ্গল দেখা যাচ্ছে। ওটা টানছে ওকে। আবু সকালে আসবে বলে গেছল। তার জন্য অপেক্ষা করতে না হলে বেরিয়েই পড়ত।
কিন্তু নটা বেজে গেল আবুর দেখা নেই। থাকা খাওয়ার ফয়সালাই আগে করে নেওয়া দরকার। জলপাইগুড়ির ললিত ভড়ের কল্যাণে রান্নাটাও রপ্ত হয়েছিল। নিজেরটা নিজেই করে নিতে পারে। এই ক্লাবঘরে থাকলে সেটা সম্ভব নয়। একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলে গায়ত্রী’ রাই যদি মাসে একশ টাকা— বাড়িভাড়া থেকে পঞ্চাশ টাকা করেও ওর হাতে দেয় তাহলে খাওয়া-খরচটা অন্তত চলে যেতে পারে। ভালো খেতে ভালো লাগে না এমন নয়, কিন্তু গত পাঁচ বছরে বাপী এ ব্যাপারে অনেকখানি নিরাসক্ত হতে পেরেছে।…যাক বাড়ির দশ হাজার টাকা দাম পাবার পর মাসে মাসে খুদ কুড়নোর কথা আর ওঠেই না। বেচেই দেবে। এমন লোভনীয় দর পেয়েও কাল রাতে অমন নিস্পৃহ থাকতে পারল কি করে সেটাই আশ্চর্য লাগছে এখন।
এই দশ হাজারের অঙ্কটা সামনে রেখে বাপীর নিজেকে একটু চাঙা করে তোলার চেষ্টা। কিন্তু গতরাতে এমন নির্লিপ্ত ভাবখানা দেখিয়ে এসে আজই আবার নিজে থেকে বাড়ি বিক্রির প্রস্তাব নিয়ে ছুটে যেতে পারে না। পরিস্থিতি বোঝার জন্যেও কটা দিন সবুর করতেই হবে।
আবুর এখনো দেখা নেই। বিরক্ত হয়ে পাজামা পাঞ্জাবি বদলাবার জন্য ঘরে এলো। সাড়ে নটা বাজে, এবারে বেরিয়ে পড়বে।
মিনিট দশেকের মধ্যে বেরুতে গিয়ে দেখে ডাটাবাবুর কিচেন ঘর থেকে আবু রব্বানী এদিকে পা বাড়িয়েছে। দরজার কাছে ডাটাবাবু দাঁড়িয়ে। অতটা দূরে থেকেও বাপীর মনে হল কাঁচুমাচু মুখ তার। আর বড় বড় পা ফেলে আবুর গম্ভীর চালের এই মুখ দেখলে কেউ বলবে না বানারজুলি জঙ্গলের বীটম্যান ও।
কাছে এসে ধমকের সুরে বলল, সকালে ব্রেকফাস্টের টাকা দিতে গেলে কেন? আর শুধু ডাল ভাত মাছের ঝোলের লাঞ্চ অর্ডার দিয়ে এসেছ কেন?
জবাব না দিয়ে বাপী চেয়ে রইল। এত দেরিতে এসেও প্রথমেই ডাটাবাবুর কাছে এই খোঁজ নিতে গেল, অবাক হবারই কথা।
ঘরে পা দিয়ে আবু আবার বলল, ডাটাবাবুকে বকে এলাম আর তোমার অর্ডার বাতিল করে ফার্স্ট ক্লাস লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে এলাম, আর বলে দিলাম এরপর যে কদিন এখানে থাকবে ব্রেকফ্রাস্ট বা লাঞ্চডিনারের কোনো বিল যেন তোমার কাছে হাজির না করা হয়।
—সে কি! টাকা কে দেবে—তুমি?
—না, মেমসায়েব।
বাপীর স্নায়ু সজাগ। কিছু কি ঘটেছে এর মধ্যে আর সেইজন্য আবুর আসতে দেরি? কিন্তু ওর মূর্তি দেখে কিছু বোঝা দায়।
পিছনের দরজা দুটো ভেজিয়ে দিয়ে আবু ভুরু কুঁচকে একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিল।—আমার দেরি দেখে সটকান দিচ্ছিলে?
—বসে বসে ভালো লাগছিল না। কিন্তু তোমার ওই—
—বোসো। আগে আমার কথার জবাব দাও। বয়সে আমি কত বড় হব তোমার থেকে?
এই গাম্ভীর্য দেখে বা প্রশ্ন শুনে বাপীর আবারও কেমন মনে হল সমাচার কিছু আছে। জবাব দিল, বছর ছয় হবে…
—তাহলে তুমি গুনে গুনে আমার দুগালে তিন-তিন ছটা থাপ্পড় মারো, আর কান দুটো ছ’বার কষে মুলে দাও।
কপট রাগ আর ধরে রাখতে পারল না। দু’ হাতে বাপীকে বুকে জাপটে ধরল আর দু’গালে নিজের গাল ঘষতে লাগল। এরপর চুমুটুমুও খেয়ে বসতে পারে, বাপীর নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা।
—বাপী ভাই আমি একটা পাঁঠা—আমি একটা গরু—আমি একটা গাধা।
এরপর যেটুকু, বাপীর কাছে অন্তত তা আর অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। তবু দু’ কান সজাগ রেখে মন দিয়েই শুনল। রাতে ব্যাজার মন নিয়ে আবু রব্বানী ঘরে ফিরেছে। দুলারিকেও বলেছে, মেমসায়েবের কাছে গিয়ে বাপী ভাই বিসমিল্লায় গলদ বাঁধিয়ে বসেছে, এখন ওর নিজের গলা বাঁচলে হয়।
সকালে জঙ্গলে যাবার আগে বাপী ভাইয়ের কাছে আসার কথা, কিন্তু তার আগেই লোক মারফৎ মেমসায়েবের তলব। জলদি যেতে হবে। আচ্ছা করে ঝাড়বে ধরে নিয়ে গিয়ে হাজির হয়েছে। মেমসায়েব বারান্দায় তার অপেক্ষাতেই বসেছিল। সামনে গিয়ে মন ভেজানোর মতো সেলাম ঠোকার সময়ও দিলে না। রক্ত জল করে দেবার মতো ঠাণ্ডা গলায় বলল, তোমার ওই লোক কাল অমন কথা বলে গেল কেন—তার কাছে তুমি আমাদের সম্বন্ধে কি বলেছ?
নিরুপায় আবু তখন আল্লার দোহাই দিয়ে জানালো, দোস্ত যা বলে গেছে তার সবটাই নিজের মাথায় গজিয়েছে, সে এরকম বলতে পারে মনে হলে এই বিপাকে পড়ার জন্য তাকে মেমসায়েবের কাছে নিয়েই আসত না। রাতে এখান থেকে বেরুনোর পর দোস্তের সঙ্গে তার এ নিয়ে একরকম ঝগড়াই হয়ে গেছে। আবু শুধু তার কাছে মিসিসায়েবের (ঊর্মিলার) এলেমদার বাপজানের জিপ অ্যাকসিডেন্টের গল্প করেছিল। ম্যানেজার চালিহা সাহেবের আয়ুর জোরের কথা বলেছিল, আর মেমসায়েব এই ম্যানেজারকে নিয়ে বুদ্ধি আর সাহসের জোরে কি করে তার খসমের ব্যবসা এমন জমজমাট করে তুললেন সেই সব গল্প করেছিল। দোষের মধ্যে মেমসায়েব এখন আর একজন লেখাপড়া জানা ইমানদার লোক খুঁজছেন আর এ পর্যন্ত দুজন লোককে ট্রায়েল দিয়ে ছাঁটাই করেছেন এ খবরটাও দোস্তকে জানিয়েছিল। ও খুব আশা করেছিল দোস্তকে মেমসায়েবের পছন্দ হবেই। কারণ এমন বিদ্যাবুদ্ধি আর সাহস ও-বয়সে কম ছেলেই ধরে। কিন্তু এখানে এসে আর চালিহা সায়েবকে দেখে দোস্ত কি ভেবে আর কি বুঝে অমন বেমক্কা কথা বলে ফেলল সেটা এখনো ওর মাথায় আসছে না।
বরফ-ঠাণ্ডা মুখ করে মেমসায়েব ওর কথা শুনে গেল। তারপর বলল, তোমার দোস্ত একটা হাড়-পাজী ছেলে— বুঝলে?
মেমসায়েবকে একটু তোষামোদ করার আশায় আবু মাথা নেড়ে প্রায় সায় নিতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই অবিশ্বাস্য কিছু দেখল। ঠোঁটের ফাঁকে হাসির মতো কি। আর চোখেও একটু খুশির জেল্লা।
আবু বিশ্বাস করবে কি করবে না ভেবে পেল না।
সঙ্গে সঙ্গে আবার মালকানের কড়া মুখ। ঝাঁঝালো গলায় আবুকে সাবধান করল, দোস্ত কাল রাতে এখানে কি বলেছে না বলেছে এ যেন কাক-পক্ষীতেও জানতে না পারে—জানলে দুজনেরই গর্দান যাবে। তারপর হুকুম করল তাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলো। তারপর নিজেই আবার বলল, এখন থাক, সকালের দিকে চালিহার আসার কথা, বিকেল তিনটে-চারটের সময় যেন দেখা করে।
আবু রব্বানীর বুদ্ধিসুদ্ধি একরাশ ধোঁয়ার মধ্যে সেঁধিয়েছিল। এবারে খোলসা। আনন্দে সেখানেই একটা ডিগবাজী খেতে সাধ গেছল তার। কিন্তু মেমসায়েবের জেরার শেষ নেই তার পরেও। ছেলেবেলায় কেমন দেখেছে দোস্তকে, একটু বড় হবার পর কেমন দেখেছে, পাঁচবছর দেখেনি এর মধ্যে বন্ধুর স্বভাব-চরিত্র যে বিগড়োয়নি সে জানল কি করে—এই সব
আবুও তখন লাগাম ছেড়ে বন্ধুর প্রশংসা করেছে। সত্য-মিথ্যে যা মনে এসেছে তাই বলেছে। বলেছে, পাঁচ বছরে স্বভাব বদলে থাকলে কলকাতার মতো আমোদ-আহ্লাদের জায়গা ছেড়ে সে এই জঙ্গলে ফিরে আসবে কেন। এতদিন বাদে দেখে ক’ঘণ্টার মধ্যে আবুর বরং ভয় করেছে বন্ধু বিবাগী-টিবাগী না হয়ে যায়। আর টাকার লোভ যে নেই সে প্রমাণ তো মেমসায়েব নিজেই পেয়েছেন পকেটে দশ টাকা আছে কিনা সন্দেহ কিন্তু বাড়িটার জন্য নাকের ডগায় দশ হাজার টাকা দুলিয়েও তাকে লোভের জালে আটকানো গেল না।
বুকের তলার ক্ষতর ওপর আঁচড় পড়ল কটা। ওর স্বভাব-চরিত্রের খবর জানা থাকলে প্রশংসা করতে গিয়ে এই আবু রব্বানীরও জিভ আটকে যেত। প্রসঙ্গ ঘোরানোর জন্য বাপী তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করল, আমার ক্লাব-ক্যানটিনে খাওয়া—দাওয়ার খরচ চালানোর ভার তাহলে তোমার মেমসায়েবের?
হ্যাঁ। ভালো ঘর পেয়েছ কিনা খোঁজ করল। আমিও তক্ষুনি কাজ হাসিল করে নিলাম। বললাম, ভালো ঘর পেলে কি হবে, ওখানে ডাটাবাবুর খাওয়ার বিল মেটাতে তো এক হাত জিভ বেরিয়ে যাবে। মেমসায়েব তক্ষুণি বলে দিল, বিল সব আমার কাছে পাঠাতে বোলো। আবু হাসছে হি-হি করে।―এমনিতে মেমসায়েবের আঙুলের ফাঁকে জল গলে না, আমার যে এখানে ম্যাজিকের মতো লাগছে গো বাপী ভাই!
এবার বাপীও হাসল।—গায়ে পড়ে অত সত্যি কথা বলার দরকার কি ছিল এখন সেটা বুঝছ তাহলে?
আবু অকপটে মাথা ঝাঁকালো।—হাড়ে হাড়ে বুঝছি। কাল দুলারির কাছে তোমাকে গালই পেড়েছি আর এই ভোজবাজির কথা শুনলে ও আমাকে বোকা পাঁঠা বলবে।
ঘরের মধ্যে আর ভালো লাগছিল না। আবুর সঙ্গেই বেরিয়ে পড়ল। ও এখন জঙ্গলের কাজে যাবে। হেড বীটম্যান হিসেবেও দায়িত্ব তো একেবারে কম নয়। ওর সঙ্গে আগের মতোই জঙ্গলে কাটানোর তৃষ্ণা বাপীর।
পাশাপাশি পাকা রাস্তা ধরে চলতে চলতে বাপী জিজ্ঞেস করল, আপাতত আমার এই ক্লাবে থাকাই ঠিক তাহলে?
আবু সানন্দে জবাব দিল, খাবেদাবে তোফা আনন্দে থাকবে—গ্যাটের পয়সা খরচা না হলে এর থেকে ভালো জায়গা আর আছে নাকি? তবে মেমসায়েব পাশের জমিতে তোমার ঘর তুলে দেয়ার কথাটা একেবারে ছেঁটে দেয় নি। আজও বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওই খালি জমিটুকু দেখে বলছিল, ঘর একটা-দুটো আরো তোলা যেতে পারে, কিন্তু এটুকুর মধ্যে মাঝখানে দেয়াল বা কাটের পাঁচিল তুললে বিচ্ছিরি দেখতে হয়ে যাবে। এতে রাজী হবে না বোধ হয়, কিন্তু তোমার থাকার ব্যবস্থা তো কিছু করে দিতেই হবে—বারো মাস ডাটাবাবুর বিল মেটানোর মেয়ে তো নয়।
বাপী জিজ্ঞেস করল, পাঁচিল তুলতেই হবে কেন, মেয়ের জন্য?
—আর কি। মেয়ের চারদিকে অষ্টপ্রহর চোখের পাঁচিল তো দিয়ে রেখেছে। নতুন কিছু রসের খোরাক পেয়ে আবু দাঁড়িয়েই গেল।—ওই মেয়ের কাণ্ডমাণ্ড তোমাকে কিছু বলা হয়নি—না?
বাপী সচকিত। শোনার লোভ নেই। কিন্তু সতর্কতার প্রয়োজন কতটুকু, জেনে রাখা দরকার। মাথা নাড়ল, বলেনি।
গোড়ায় এই কাণ্ডরও সবটাই আবুর সেই ভুটান পাহাড়ের বাংলোর ঝগড়ুর মুখে শোনা। হলে নিজে চোখেও কিছু দেখেছে আর তাই নিয়ে মা-মেয়ের মন—কষাকষির ব্যাপারটা আঁচ করেছে।
মেমসায়েবের এই মেয়ে ঝগড়ুর চোখের মণি। ঊর্মিলার কথায় ঝগড়ুর কড়া নেশার মুখেও স্নেহ গলে গলে পড়তে দেখেছে আবু। ও তাকে আদর করে ঊর্মি বলে ডাকে। মেমসায়েবকে ভয়ও করে ভক্তিও করে, কিন্তু ভালবাসে ওই উর্মিকে। মেয়েটার নাকি তার বাপের মতোই দিলখোলা দরাজ মন। মা-কে লুকিয়ে-চুরিয়ে ভালো মালের বোতল সময়-সময় ও-ই মেয়ে দিয়ে যেত ঝগড়ুকে। কিন্তু বরাত এমন দেড় বছর হয়ে গেল ওই মেয়ের সক্কলের ওপর রাগ আর অভিমান
ঊর্মিলা দার্জিলিং থেকে পড়াশুনা করত বরাবর। এবারে তার বি.এ. পরীক্ষা দেবার কথা। কিন্তু মায়ের কড়া দাপটে পড়াশুনায় জলাঞ্জলি দিয়ে তাকে মায়ের সঙ্গে থাকতে হচ্ছে এখন। মায়ের সাফ কথা বাড়িতে বসে পড়াশুনা করে প্রাইভেট পরীক্ষা দিতে পারো তো দাও, নইলে দিতে হবে না। মেয়েও রাগ করে ও-পাট বন্ধ করে বসে আছে।
মোদ্দা কথা, দার্জিলিঙের কাছাকাছি এক চা-বাগানের ছোকরা এঞ্জিনিয়ারের প্রেমের হাবুডুবু খাচ্ছে ঊর্মিলা রাই। মেয়ে চালাক যেমন সেয়ানাও তেমনি। অনেক দিন পর্যন্ত ব্যাপারখানা সকলের চোখে গোপন ছিল। কলেজের ছুটি-ছাটা মেয়ে মায়ের কাছে এসে থাকে আবার ছুটি ফুরোলে চলে যায়। ধরা পড়বে কি করে?
কিন্তু, প্রেম পাকতে থাকলে চালাক ছেলে-মেয়েরাও বোকা হয়ে যায়, আবার বেপরোয়াও হয়। এই জন্যেই দুনিয়ার কোনো প্রেমই শেষ পর্যন্ত চাপা থাকে না বোধ হয়। মেয়ের ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর লম্বা ছুটির মধ্যেই সব ফাঁস। ঊর্মিলা মাঝে মাঝে সকালে পাহাড়ের বাংলো থেকে নেমে আসে, দুপুরের খাওয়ার সময়ের আগে আর দেখা মেলে না। আবার খেয়ে-দেয়ে দুপুরে নামল তো সন্ধ্যার আগে আর দেখা নেই। মা বকাবকি করলেও চোখ উল্টে থাকে, নয়তো জবাব দেয়, ছুটির মধ্যে বাড়িতে ভালোলাগে না—পাহাড় আর জঙ্গল দেখে বেড়ায়।
মায়ের তাতেও দুর্ভাবনা। এসব জায়গায় একলা পাহাড় জঙ্গল দেখে বেড়ানো নিরাপদ নয়। কিন্তু ঝগড়ুকে সঙ্গে দিতে চাইলে মেয়ে মুখঝামটা দেবে। সে আর কচিটি আছে নাকি এখন?
মায়ের হাতে পড়লে বকুনি খাবে ভেবে ঝগড়ু নিজেই অনেক সময় মেয়ের ফিরতে দেরি দেখে নিচে নেমে এসেছে। কিন্তু কাছে দূরে কোথাও তার দেখা মেলেনি। এদিকে মা তো আর সর্বদা ঘরে বসে থাকে না, দিনরাতের বেশির ভাগ সময় তার মাথায় ব্যবসার চিন্তা। দু’চারদিনের জন্য আবার বানারজুলিতে বা অন্য কোথাও চলে যায়। বড় বড় পার্টির সঙ্গে নিজেরও অনেক সময় যোগাযোগ রাখতে হয় তার। মেয়ের জন্য তখন পর্যন্ত কোনো চিন্তা ভাবনা নেই। নিজের বাড়ি, ঝগড়ু আছে, চিন্তার কি আছে?
…মেয়ে একদিন সকালে বেরুলো, রাত পর্যন্ত দেখা নেই। তার খানিক আগে মালকান দু’দিনের জন্য বাইরে চলে গেছে। ঊর্মি অবশ্য ঝগড়ুকে বলে গেছল, দুপুরে ফিরবে না। তার চেনাজানা কয়েকজন মেয়ে এসেছে, তাদের সঙ্গে হৈ-চৈ করে কাটাবে আর বাইরে খেয়ে নেবে। কিন্তু সেয়ানা মেয়ে মা থাকতে একটি কথাও বলেনি। তারপর দুপুর গড়ালো, বিকেল আর সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হল, তার দেখা নেই! ভাবনা-চিন্তায় অস্থির হয়ে পাহাড় থেকে নেমে এলো ঝগড়ু। তাকে আর এ তল্লাটে না চেনে কে? শেষে অনেকটা দূরে সেই পাকা রাস্তার ধারে এক চালা-ঘরের বুড়ো সাঙাতের সঙ্গে দেখা। ঝগড়ুর দুশ্চিন্তার কথা শুনে সে যা খবর দিল, দুই চক্ষু ছানাবড়া। মিসি সায়েবকে নাকি মাঝে মাঝে জিপে করে এক ছেলের সঙ্গে হাওয়া খেতে দেখে তারা। এই রাস্তাতেই যাতায়াত তাদের। সুন্দরপানা অল্প-বয়সী ছেলে, কোন্ দেশী বলতে পারবে না, তবে স্বজাতের নয় এটা ঠিক—অর্থাৎ নেপালী নয়। সাদা চামড়ার সায়েব-সুবো বা ফিরিঙ্গি-টিরিঙ্গিও নয়। পরনে চেকনাই প্যান্ট শার্ট, নিজেই জিপ চালায়। পাশে মিসি সায়েব। সেই সকালেও এই রাস্তায় জিপে দুজনকে দেখেছে। অমন ফুর্তির মুখ কে না চেনে। তাই তারা ভেবেছে ঝগড়ুর মালকান মেয়ের জন্যে ভিনজাতের আদমী ঠিক করে ফেলেছে।
ঝগড়ু ফিরে এসেছে। কিন্তু বাংলোয় ওঠেনি। পাহাড়ে ওঠার রাস্তা আগলে নিয়েই দাঁড়িয়ে ছিল। ওই জিপের দেখা মিলেছে আরো ঘণ্টাখানেক বাদে। রাত তখন কম করে নটা। আশেপাশে জনমানব নেই।
সামনে এসে হেড লাইটের আলোয় ঝগড়ুকে পাথরখানার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঊর্মিলার প্রেমের চটকা ভাঙল। ওদিকে সেই ছেলেরও মুখ শুকনো। জিপ থেকে নেমে ঊর্মিলা ছুটে এলো। তার প্রথম ত্রাস, মা হঠাৎ ফিরে এসেছে কিনা, নইলে ঝগড়ু এখানে এই মুখ করে দাঁড়িয়ে কেন?
মা আসেনি শুনে মেয়ের শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা। বলল, ফিরতে দেরি হবে বলেই তো গেছল, অত চিন্তার কি আছে। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে দেরি হয়ে গেল, তাদের একজনের আত্মীয় পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছে।
প্রেমিকটিও জিপ থেকে নেমে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ঝগড়ু তখন রাগে ফাটছে। তাকে দেখিয়ে ঊর্মিলাকেই বলল, ফের মিথ্যে কথা বলবে তো তোমার সামনেই ওর মাথাটা ছিঁড়ে নিয়ে আসব। তোমার ওই খেলা কত দিন ধরে চলছে আমার জানতে বাকি নেই—আসুক মালকান
ঝগড়ুর মেজাজ জানে ঊর্মিলা, প্রেমিকটি জিভ নেড়ে কিছু বলতে গেলে হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়বে তার ওপর। ইশারায় চটপট তাকে সরে পড়তে বলল। তারপর বাংলোয় ফিরে ঝগড়ুকে নিয়ে পড়ল। তোয়াজ তোষামোদে কাজ হল না দেখে রাগবিরাগ শুরু হয়ে গেল। মা কিছু জানবে না কথা দিতেই হবে। আর তা না হলে নিজের ওপর এমন শোধ নেবে যে ঝগড়ুকে চিরকাল পস্তাতে হবে। কি করবে রাগের মুখে তাও বলল। শেষে ছোট মেয়ের মতোই ওকে জাপটেমাপটে ধরে সে কি আদরের ঘটা ঝগড়ুর, কথা না দিয়ে উপায় কি? মদ দু’চোখের বিষ মালকানের কিন্তু ম্যানেজার বা ব্যবসার সেরকম মানী অতিথি অভ্যাগতর জন্য ঘরে দামী মাল কিছু মজুত রাখতেই হয়। মেয়ের বুকের এত পাটা, তার থেকে একটা আস্ত বোতল সরিয়ে ওকে দিয়ে দিয়েছিল। আর পরদিন সেই ছেলেকে একেবারে পাহাড়ের বাংলোয় তুলে এনে ঝগড়ুর সঙ্গে মিতালি করিয়ে ছেড়েছে।
ঝগড়ু ভয়ে বাঁচে না। আরো পাঁচজন আছে এখানে। মেয়েটার জন্য তাদের মিথ্যে বোঝাতে হয়েছে, মিথ্যে বলতে হয়েছে। নানা রকম রইস খদ্দেরের আনা—গোনা আছেই বাড়িতে। এ রকম এক দিন না। মায়ের অনুপস্থিতিতে আরো অনেক সময় ওই ছেলেকে এই পাহাড়ের বাংলোয় দেখা গেছে। ঊর্মিকে ঝগড়ু বকা-ঝকা করে, মায়ের কাছে বলে দেবে বলে ভয় দেখায়, নিজের বিপদের কথা বলে—কিন্তু কে কার কথা শোনে!
ছেলেটাকে অবশ্য ভালোই লেগেছিল ঝগড়ুর। মিষ্টি চেহারা। নাম বিজয় মেহেরা। পাঞ্জাবী। কিন্তু দাড়ি-গোঁপের বালাই নেই। কেতাদুরস্ত হালফ্যাশানের ছেলে। এনজিনিয়ারিং পাস করে সবে মিরিকের চা-বাগানে ঢুকেছে। দার্জিলিং আর শিলিগুড়ির মাঝামাঝি জায়গা মিরিক। সুখিয়া পোখরির কাছে দল বেঁধে মেয়েরা পিকনিকে গেছল। সেখানে ওই ছেলের সঙ্গে ঊর্মিলার আলাপ। ঝগড়ু বলেছে প্রথম আলাপেই নাকি বেশ ঘন ব্যাপার। তারপর ফাঁক পেলেই ওই ছেলের দার্জিলিং-এ ছোটা, আর ফাঁক পেলে মেয়েরও তেমনি হস্টেল পালিয়ে মিরিক বেড়াতে আসা। বিজয়ের হেপাজতে কোম্পানীর জিপ আছে একটা। তার ফলে দার্জিলিং থেকে মিরিক বা মিরিক থেকে দার্জিলিং কতটুকু আর পথ? তাছাড়া শনি রবি সপ্তাহে দুদিন তো ছুটি।
সে-ও এক শনিবার। পড়বি তো পড় বাঘিনীর মুখে। অর্থাৎ মায়ের মুখো—মুখি। ঊর্মিলা তখন বি.এ. পড়ে। গায়ত্রী রাই ব্যবসার কাজে নিজের ভ্যানে কার্সিয়াঙে এসেছিল। কাজ শেষ করে ফেরার মুখে বিপত্তি। এক জায়গায় পথ আগলে একটা বাস বিকল হতে কতগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে গেছে। গায়ত্রী রাইয়ের ভ্যানও এসে থেমেছে। বাঁকা রাস্তার অদূরে একটা জিপ দাঁড়িয়ে। সেই জিপে চালকের পাশে তার মেয়ে বসে। দুজনেই হাসিখুশিতে এত মশগুল যে কোনদিকেই চোখ নেই। নিজের চোখ দুটোকে বিশ্বাস করবে কিনা গায়ত্রী রাইয়ের সেই বিস্ময়। কোথায় দার্জিলিঙের হস্টেল আর কোথায় কার্সিয়াঙ—কম করে পনের-ষোল মাইল পথ!
ভ্যানে গায়ত্রী রাইয়ের পিছনে যে লোকটা বসে ছিল সেও এইখানে জিপে ওই ফিটফাট ছেলের পাশে মিসিসায়েবকে দেখে হকচকিয়ে গেছে। লোকটা পাহাড়ের বাংলোয় কাজ করে। বাইরে বেরুলেই অনেক সময়ই বাংলোর কেউ না কেউ মেমসায়েবের সঙ্গে থাকে। জিপের ওই ছেলেটাকে সে পাহাড়ের বাংলোয় দেখেছে। ঝগড়ু বলেছিল, মেমসায়েবের খাতিরের খদ্দের। মেমসায়েবের এই মূর্তি দেখে আর তাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে লোকটা সে-কথাও না জানিয়ে পারল না। কারণ এখানে ওই ছেলের পাশে মিসিসায়েবকে দেখে তারও দস্তুরমতো খটকা লেগেছে।
তারপর বেড়াল যেমন ইঁদুর ঘরে আনে সেই রকম করে জিপ থেকে মেয়েকে টেনে নামিয়ে নিজের গাড়িতে তুলল মেমসায়েব। মেয়ের তখন হয়ে গেছে। সেখান থেকে সোজা নিজের পাহাড়ের বাংলোয়। ঘরে এনে বারকতক ঝাঁকুনি দিতেই মেয়ে গলগল করে সব স্বীকার করে ফেলল, আর বি.এ. পাশ করার পর ওই ছেলেকে তার বিয়ে করার সংকল্পের কথাও বলল। জবাবে মায়ের ঠাস ঠাস দুই থাপ্পড়ে সোজা বিছানায় গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে হল তাকে।
বাইরে থেকে মেমসায়েবের অলক্ষ্যে ঝগড়ু মেয়ের শাস্তি দেখেছে। তারপর নিজের শাস্তির অপেক্ষা করছে।
ডাক পড়তে ঝগড়ু মেমসায়েবের মুখের দিকে তাকাতে পারেনি। কিন্তু বলার যা বলেছে।—তাকে যেমন খুশি শাস্তি দিতে পারেন। সব জেনেও ও কিছু জানায় নি বা জানাতে পারে নি কারণ তার মেয়ে দুর্গা মায়ের নাম করে তাকে শাসিয়ে রেখেছিল মা-কে কিছু বললেই পাহাড়ের ওপর থেকে ঝাঁপ খেয়ে নিজেকে শেষ করবে আর শোধ নেবে। বলেছিল, সে ওই ছেলেকে বিয়ে করবে আর সময়ে সে-কথা মা-কে নিজেই জানাবে।
না, মালকান ওকে কোনো শাস্তি দেয় নি বা কিছুই বলে নি।
পরদিন মেয়েকে নিয়ে নিজে দার্জিলিং চলে গেছে। সেখানে কি হয়েছে না হয়েছে তারাই জানে। মোট কথা এটুকু বোঝা গেছে, মেমসায়েব সেখানে বেশ কড়া ব্যবস্থাই কিছু করে এসেছিল।
কিন্তু প্রেমজ্বর ছাড়ানো মুখের কথা নয়। তিন-চার মাসের মধ্যে দার্জিলিং থেকে মেমসায়েবের নামে চিঠি এসেছে। সেটা কি চিঠি ঝগড়ু জানে না, ফলে আবুও জানে না। তবে এটা ঠিক, হস্টেল থেকে মেয়ের নামে কড়া নালিশ কিছু। চিঠি পেয়েই থমথমে মুখে মেমসায়েব দার্জিলিং চলে গেছে আর বইপত্র বাক্স বিছানাসুদ্ধু মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছে। ব্যস, মেয়ের পড়ার পাট খতম। মা আর মেয়েকে কলেজে পাঠাবে না, মেয়েও প্রাইভেট পরীক্ষা দেবে না।
বিজয় মেহেরাকে আবু স্বচক্ষে এই বানারজুলিতেই দেখেছে। দেখেছে মেমসায়েবও। তাকে প্রাণের ভয় দেখিয়েছে পর্যন্ত। সাত-আট মাস আগে মেয়ে রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল। দু’-দিন দু’-রাত নিখোঁজ। এই আবুকে সঙ্গে করেই মেমসায়েব মিরিকে চলে গেছল। যে চা-বাগানের এঞ্জিনিয়ার সেই ছেলে, তার ম্যানেজারের কাছে নালিশ করেছিল। কিন্তু অপ্রস্তুত হয়ে ফিরতে হয়েছে। কারণ বিজয় মেহেরা সেখানেই তখন কাজে ব্যস্ত। ঊর্মিলা ঘর ছেড়ে পালিয়েছে শুনে সে হাঁ।
দু’-দিন বাদে ঊর্মিলার শিলিগুড়ির এক বান্ধবী এক-রকম জোর করেই তাকে মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়ে গেছে। দু’-রাত সে ওই বন্ধুর বাড়িতে বন্ধুর কাছে ছিল।
তারপর থেকে এ পর্যন্ত আর গোলযোগ কিছুই দেখা যায় নি। বাইরে মেয়েকে অনেকটা শান্তই দেখা যায়। মা তাকে সারাক্ষণ চোখে আগলে রাখে। যখন যেখানে যায়, সঙ্গে নিয়ে যায়। কিন্তু আবুর এখনো ধারণা, মেয়েটার ওই ছেলের ওপরেই মন পড়ে আছে। মায়ের চোখে ধুলো দেওয়া সহজ নয়, তবু তলায় তলায় কোন রকম যোগসাজশ আছে কিনা কে জানে। এদিকে বাইরের কোনো ভদ্রলোকের সঙ্গে মিশতে দেখে না তাকে। শহর থেকে গাদা গাদা ইংরেজি গল্পের বই আনায় আর পড়ে।
আবুর মুখ চলে তো পা চলে না। এতক্ষণে ওরা বনমায়ার আস্তানার রাস্তায়। বাপী অন্যমনস্ক ছিল। এ গল্প যেমন পুরনো আবার তেমনই নতুন। ঊর্মিলার মুখখানা খুঁটিয়ে ভাবছিল। বুকের তলায় কোনো বড় ঝড় জমাট বেঁধে আছে মনে হয় নি। বরং চোখের কোণে স্বাভাবিক কৌতুক দেখেছে। ঠোটের ফাঁকে মজার ছোঁয়া লাগা হাসিও দেখেছে।
…তাহলে মা জিতেছে?
বনমায়ার ডাকে ঘুরে তাকালো। শুঁড় উঁচিয়ে সেলাম তুলেই আছে আর ডাকছে। একসঙ্গে দু’জন আপনার মানুষ কতকাল বাদে দেখল, এই ভাব। লছমন ওর মুখে কচি ডাল-পাতা গুঁজে দিয়ে তোয়াজ করছিল। বনমায়া শুঁড় দিয়ে ওকে পাশে ঠেলে সরালো।
বাপীর হঠাৎ হাসি পেল। এই বনমায়ার পায়ে কতবার কত না শক্তপোক্ত বেড়ি লাগানো হয়েছে। কিন্তু সব বাধাবন্ধ ঠেলে ওর অভিসার কেউ ঠেকাতে পারে নি।
কোনো ভদ্রলোকের মেয়ে বোধ হয় বনমায়া হতে পারে না।