সোনার হরিণ নেই (Sonar Harin Nei) : দশ
চারদিকের আবছা অন্ধকারের মধ্যে শুধু বাপী তরফদারের বাড়িটাই আলোয় ঝলমল করছে। লাইন ধরে কাছে-দূরের আর সব লণ্ঠন কুপী মোমবাতির টিমটিম আলো। ওই বাড়িটা এখন চোখ টানার মতোই ব্যতিক্রম। নেপালী মহিলার রুচির প্রশংসা করতে হয়। দিনের বেলায়ও বাপী বাড়িটার ছিমছাম চেহারা দেখে গেছে।
সামনের বারান্দায় আরো চড়া আলো জ্বলছে। টেবিলের দুদিকের শৌখিন বেতের চেয়ারে গায়ত্রী রাই আর তার ম্যানেজার রণজিৎ চালিহা বসে। হাসিমুখে কথাবার্তা চলছে। আবু বলছিল, ওই ম্যানেজার ছাড়া মেমসায়েবকে আর কারো সঙ্গে হেসে কথা বলতে দেখে না ওরা। কথা বেশি রণজিৎ চালিহাই বলছে। গায়ত্রী রাই অল্প অল্প হাসছে, এক-একবার মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছে বা কিছু বলছে। দূর থেকে এ-দৃশ্য দেখেই আবুর পিত্তি জ্বলে গেল। চাপা ঝাঁঝে বলে উঠল, শালা ঠিক গ্যাঁট হয়ে বসে আছে, আর মেমসাহেবকে কিছু লাভের রোশনাই দেখাচ্ছে। ও-ব্যাটা এখন ওখানে না থাকলেই ভালো হত, মেমসাহেবের ওপর দিয়ে কথা কইবে।
কি ভেবে মৃদু গলায় বাপী বলল; বাড়ি নিয়ে কথা উঠলে তুমি চুপ করে থেকো, আমি এসে যাবার পরে আর তোমার কোনো দায়িত্ব নেই।
এতেই আবু ঘাবড়ে গেল।—তুমি কি গোলমেলে কথা কিছু বলবে নাকি? মেমসাহেবের মেজাজ খারাপ করে দিও না বাপী ভাই, আর ওই ম্যানেজারও একটুও সাদা মনের লোক নয় মনে রেখো।
বাপী আশ্বস্ত করল তাকে, ঠিক আছে।
বারান্দার জোরালো আলো, বাইরের দিকটা অন্ধকার। তাই একেবারে দাওয়ার কাছে আসার আগে বারান্দার দু’জন ওদের লক্ষ্য করল না। দু’জন নয়, তিনজন। বারান্দা-লাগোয়া ঘরের দরজার কাছে একটা চেয়ারে বসে গায়ত্রী রাইয়ের মেয়ে ঊর্মিলা রাই বই পড়ছে। এদের আড়ালে দূর থেকে তাকে দেখা যাচ্ছিল না।
ভিতরে ঢুকে পড়তে বারান্দার দু’জনের ওদের দিকে চোখ গেল। সঙ্গে সঙ্গে দু’জনেরই খুশি মুখ গাম্ভীর্যের আড়ালে সেঁধিয়ে গেল। কাছে এগোবার ফাঁকে প্রথম রণজিৎ চালিহাকেই এক নজর দেখে নিল বাপী। পরনে দামী স্যুট, দামী টাই, ধপধপে ফর্সা রং, চওড়া উঁচোনো কপাল, সে-তুলনায় ছোট চোখ। আসামের মানুষ দেখলেই বোঝা যায়। বয়েস বেশি হলে চুয়াল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ।
ওরা কাছে আসার ফাঁকে গায়ত্রী রাই নেপালী ভাষায় চাপা গলায় রণজিৎ চালিহাকে বলল কিছু। চালিহা অল্প ঘাড় বেঁকিয়ে আবুকে ছেড়ে বাপীকে ভালো করে দেখে নিল। বাপীর ধারণা, ও যে বাড়ির মালিক মেমসাহেব তার ম্যানেজারকে সেটাই জানান দিল। .
এখানে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে আবু রব্বানীর অন্য মুখ। বিনয় উপচে পড়ছে। ঝুঁকে মেমসাহেবকে সেলাম জানালো। আবার মুখেও বলল, গুড ইভনিং মেমসায়েব। তারপর ম্যানেজারের উদ্দেশে আরো বিনীত অভিবাদন।—গুড ইভনিং সার!
মনে মনে বাপী আবুকে তারিফ না করে পারল না। ও উন্নতি না করলে কে করবে!
বাপী দু হাত জুড়ে কপালে ঠেকালো, কিন্তু মহিলা ওর দিকে তাকালোই না। ফলে বাপী ম্যানেজারের দিকে আর না ফিরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। মেয়ে ঊর্মিলা বিকেলে বাড়ির মালিকের হেনস্থা দেখেছে, আবার সে এসে দাঁড়াতে তার বই পড়ার মনোযোগ গেল। এবারে মায়ের সঙ্গে আংকল চালিহা, লোকটার কপালে দুর্ভোগ আছে ভাবছে।
বাড়ির মালিকের অস্তিত্ব স্বীকার করারও দায় নেই যেন গায়ত্রী রাইয়ের। ঈষৎ রুষ্ট স্বরে আবুকে বলল, বিকেল থেকে তোমার খোঁজে লোক পাঠানো হয়েছে—কোথায় ছিলে?
আবু রব্বানীর অপ্রস্তুত মুখ, কিন্তু জবাব সপ্রতিভ। এতকাল বাদে দোস্তকে কাছে পেয়ে ভুলে গেলাম—
আবু রব্বানীর মতো একজনের সঙ্গে এত দোস্তির কারণে কিনা বলা যায় না, বাপীকে এখনো কেউ বসতে বলছে না। আবুর জবাবও গায়ত্রী রাইয়ের কাছে তেমন খুশি হবার মতো নয়। আরো গম্ভীর। বাড়ীর ব্যাপারে কাগজপত্র কবেই সই হবার কথা ছিল, এখনো হয়নি কেন?
আবুর বিনীত জবাব, ম্যানেজার সায়েব জানেন—
রণজিৎ চালিহা বলল, সব রেডি আছে, কালই হতে পারে।
জবাবের আশায় আবু এবার বাপীর দিকে তাকালো। কিন্তু বাপীর এমন মুখ যেন মাথায় ঢুকছেই না কিছু। অগত্যা আবু মেমসাহেবের দিকে ফিরল। বলল, ঘরের মালিক এসে গেছে, এখন যা করার সেই করবে—তাকে বলুন।
গায়ত্রী রাইয়ের এই উক্তিও পছন্দ হল না—আমি মালিক-টালিক জানি না, তোমার সঙ্গে আমার কথা পাকা হয়েছে, তাকে যা বলার তুমি বলো—কনট্রাক্ট কালই সই হওয়া চাই।
নিরুপায় আবুর দু’ চোখ আবার বাপীর দিকে। দোস্ত সব জেনেশুনে ওকে এমন ফ্যাসাদে ফেলছে কেন?
অগত্যা এবারে বাপীর জিভ নড়ল। দু’ চোখ মহিলার মুখের ওপরে।—কোন্ বাড়ির কথা হচ্ছে…এই বাড়ি?
গায়ত্রী রাইয়ের বিরূপ চাউনি।—সেটা এতক্ষণে বুঝলেন?
বাপীর এই মুখে কৃত্রিমতা খুঁজে পাওয়া শক্ত। বলল, আপনাদের কথাবার্তা আমি ঠিক খেয়াল করিনি—বিকেল থেকে এই ক’ঘণ্টার অর্ধেক সময় আবুর মুখে কেবল আপনার প্রশংসা শুনেছি। তাই আমি ভাবছিলাম একজন ভদ্রলোকের ছেলেকে আপনি বসতেও বলছেন না কেন…
ধাক্কাটা শুধু সামনে মহিলা নয়, রণজিৎ চালিহা, দরজার ও-ধারের চেয়ারে বই হাতে ঊর্মিলা, এমন কি আবুর ওপরেও গিয়ে পড়ল।
—সীট্ ডাউন প্লীজ। বলা বাহুল্য, শিষ্টাচারের খোঁচা মেয়ে মহিলার মুখ-ভাব আরো অপ্রসন্ন।
বাপী চেয়ার টেনে বসল। ঊর্মিলা উঠে ঘর থেকে একটা মোড়া এনে আবুর সামনে রেখে আবার নিজের চেয়ারে ফিরে গেল। ইশারায় ওকেও বসতে বলে, গায়ত্রী রাই বাপীর মুখোমুখি।
বাপী জিজ্ঞাসা করল, বলুন, বাড়ির কি হয়েছে?
—কি হয়েছে আপনি দেখতে পাচ্ছেন না?
কি হয়েছে দেখার জন্যেই বাপীর দু’চোখ বারান্দার চারদিকে আর ঊর্মিলা রাইকে ছাড়িয়ে ভিতরের দিকেও একবার ঘুরে এলো। মেয়েটার চাউনিতে কৌতুকের ছায়া।
এদিকে বাপীর হৃষ্ট পর্যবেক্ষণেও ভেজাল কিছু নেই। অকপট প্রশংসার সুরেই বলল, দিনের বেলা দেখে গেছলাম, রাতে আরো ভালো লাগছে…ঘর বেড়েছে, ইলেকট্রিক লাইট এসেছে…নিজের সেই বাড়ি বলে চেনাই যায় না।
গায়ত্রী রাই তেমনি গম্ভীর, কিন্তু গলার স্বর নরম একটু।–এর জন্য আমার অনেক টাকা খরচ হয়েছে নট্ লেস্ দ্যান…ফাইভ থাউজ্যান্ড। এ-টাকাটা ভাড়া থেকে কিভাবে অ্যাডজাস্ট করা হবে সেটা আবুর সঙ্গে সেল্ড হয়ে আছে। আপনি জেনে নেবেন…এগ্রিমেন্ট রেডি আছে। চালিহার দিকে ফিরল, গেট্ ইট সাইন্ড্ টুমরো—
বাপী পাশের দিকে অর্থাৎ ম্যানেজারের দিকে ফিরেও তাকালো না। তার আবেদন খোদ কর্ত্রীর কাছে। মুখখানা ফাঁপরে পড়ার মতো। বলল, আপনি আমার ভাঙা বাড়ির চেহারা পাল্টে যা করেছেন মিসেস রাই, আমি তার জন্য কৃতজ্ঞ। এরকম করার সামর্থ্য আমার কোনদিন হত না, সই-টইয়ের জন্যেও কিছু আটকাবে না…কিন্তু একটু মুশকিল হল আমি থাকব কোথায়?
মুখের কথা শেষ হতে না হতে চালিহা বলে উঠল, দ্যাটস্ নট্ আওয়ার লুক আউট!
বাপীর ভেবাচাকা খাওয়া মুখ। চালিহাকে একবার দেখে নিয়ে সংকোচ আর সম্ভ্রমের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, ইনি?
চালিহা থমকালো। ধৃষ্টতা দেখছে। গায়ত্রী রাই জবাব দিল, ইনি মিস্টার রণজিৎ চালিহা, আমাদের বিজনেসের চিফ একসিকিউটিভ।
আমার বিজনেস বলল না বা ম্যানেজার বলল না বাপীর কানে সেটুকু ধরা পড়েছে। সবিনয়ে তাকে নমস্কার জানিয়ে আবার মহিলার দিকে ফিরল।——বাড়ির এগ্রিমেন্ট আপনার সঙ্গে, না আপনার ফার্মের সঙ্গে?
—আমার সঙ্গে।
—তাহলে কথাবার্তাও আপনার সঙ্গে হোক।…বাড়ি নিয়ে আপনাকে আমি কোনো ট্রাবল দেব না, আবুর সঙ্গে যা সে করেছেন তাই হবে। কিন্তু আমার প্রবলেমটা আপনিও এঁর মতো এক কথায় নাকচ করে দেবেন আমি আশা করছি না।
রণজিৎ চালিহার ফর্সা মুখ লাল। সরাসরি কারো দিকে না তাকালেও বাপীর অগোচর কিছু নেই। মোড়ায় বসা আবুর উতলা মুখ। আর দরজার লাগোয়া চেয়ারে বসা ওই মেয়ের চোখের কোণে কৌতুক আরো বেশি জমাট বেঁধেছে। অর্থাৎ কর্ত্রীর সামনে বসে প্রকারান্তরে তার ম্যানেজারকে তুচ্ছ করাটা নতুন কিছু।
কিন্তু বাপী তরফদারের ষষ্ঠ অনুভূতি ওকে বড় ঠকায় না। আবুর মুখে গায়ত্ৰী রাই আর তার এই ম্যানেজারের সম্পর্কে আদ্যোপান্ত শোনার পর থেকেই একটা সম্ভাবনা মনের তলায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। এখন এই কথার পরে মহিলারও গম্ভীর চাউনিতে যদি পলকের প্রশ্রয়ের আভাস সত্যিই মিলিয়ে যেতে দেখে থাকে, তাহলে তার হিসেবের সঙ্গে মেলে।
মনে হল দেখেছে।
গায়ত্রী রাইয়ের কথায় অবশ্য সেই প্রশ্রয়ের ছিটেফোঁটাও নেই। কথাও বিরক্তি-ছোঁওয়া।—আপনার প্রবলেম শুনে আমি কি করতে পারি?…বড়জোর পুরো ভাড়া একশ’ টাকার জায়গায় মাসে পঞ্চাশ-ষাট টাকা করে কাটা যেতে পারে।
মহিলা চতুর কত বুঝতে একটুও সময় লাগল না বাপীর। টাকা তার কাছে কোন সমস্যা নয়। পঞ্চাশ-ষাট ছেড়ে পঁচিশ-তিরিশ টাকা করে কাটতে বললেও হয়তো রাজি হয়ে যাবে। কারণ তাতে বাড়ির দখলের দাবি অনেক বছর ধরে কায়েম থাকবে। কিন্তু ম্যানেজার রণজিৎ চালিহা এই কূট চালের ধার দিয়েও গেল না। অসহিষ্ণু ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠল, তাহলে আবার ফ্রেশ এগ্রিমেন্ট করতে হয়—এমনিতেই ওই আবু রব্বানী যতটা পারে স্কুইজ করছে।
বাপী এবার তার দিকে ফিরল। ঠাণ্ডা-গলায় জবাব দিল, ওই এগ্রিমেন্টের আমি কানাকড়িও দাম দিই না।
রণজিৎ চালিহার ফর্সা মুখ তেতে ওঠার বা সামনের মহিলার দু’চোখ ঘোরালো হয়ে ওঠার আগেই বাপী একই সুরে আবার যা বলল, সেটা কেউ আশা করেনি। চোখে গায়ত্রী রাইকে দেখিয়ে ম্যানেজারকেই বলল, আমার বন্ধু আবু রব্বানী যাঁকে এত শ্রদ্ধা করে আর বিশ্বাস করে, আমারও তাকে তেমনি শ্রদ্ধা করতে আর বিশ্বাস করতে অসুবিধে নেই। ওই এগ্রিমেন্ট আপনি ছিঁড়েও ফেলতে পারেন, ওঁর মুখের কথাই যথেষ্ট। ধীরেসুস্থে গায়ত্রী রাইয়ের দিকে ফিরল।— সত্যিই যদি স্কুইজ করা হয়েছে মনে করেন, তাহলে বলবেন, যা উচিত বিবেচনা করবেন তাই হবে। কিন্তু আমার সমূহ প্রবলেম অন্যরকম—
কথার কলে পড়ে চালিহার মেজাজ আরো তিরিক্ষি। আবারও আগ্ বাড়িয়ে গজগজ করে উঠল, সেটা আমাদের বলে লাভ কি—আপনার প্রবলেম মাথায় রেখে আমরা বাড়ির রিনোভেশনে হাত দিইনি বা এত টাকা ঢালিনি।
বাপীর নিরীহ দু’চোখ প্রথমে মা, পরে দরজার ওধারে মেয়ের মুখের ওপর ঘুরে এলো। অত বিশ্বাস আর শ্রদ্ধার কথা বলার পর ম্যানেজারের এই মেজাজ তাদের কাছেও সুশোভন লাগছে না। বাপীর স্নায়ুগুলো আরো যেন নিজের বশে এখন। মোড়ায় বসা হতবাক মূর্তি আবুর দিকে ঘুরে তাকালো।—ঘর বাড়ানো বা এত সব করার পরামর্শ তুমি দিয়েছিলে?
আবুর হাঁসফাঁস দশা। কি জবাব দেবে ভেবে পেল না। পাশ থেকে রণজিৎ চালিহাই খেঁকিয়ে উঠল আবার।—ও পরামর্শ দেবে কি? এই ঘর-বাড়ি ওঁর মতো মহিলার বাসযোগ্য ছিল? যেটুকু দরকার করে নেওয়া হয়েছে।
বাপীর ঠোটের ফাঁকে একটু হাসি যেন আপনা থেকেই এসে গেল। বলল, বাড়ির হাল দেখে ছেলেবেলায় আমার নিজেরই খুব খারাপ লাগত, আর তখন চা-বাগানের বড় বড় বাংলোগুলো দেখে ভাবতাম বড় হয়ে ওখানে ও-রকম একটা বাংলো তুলব।…তা এই গরীবের কুঁড়েঘর নিয়ে টানাহেঁচড়া না করে আপনিও চা-বাগানের কোনো জমিতে ওঁর উপযুক্ত একখানা হালফ্যাশানের বাংলো তুলে দিতে পারতেন?
এই বানারজুলির জঙ্গলেই বাপী দেখেছে, তৈরি মৌচাকে ঢিলের যুৎসই ঘা পড়লে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি তাড়া করে আসে আবার চাক থেকে টসটস করে মধুও ঝরে। আবুর দিকে বাপী তাকায়নি, তার দিশেহারা অবস্থাটা আঁচ করতে পারে। বাকি তিনজোড়া ক্রুদ্ধ দৃষ্টি প্রথমে ছেঁকে ধরল তাকে। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের মধ্যে হাওয়া আর ততটা গরম মনে হল না। ঊর্মিলা রাইয়ের চোখের সামনে বই। গায়ত্রী রাইয়েরও বাইরে রুষ্ট মুখ কিন্তু ভিতরে তরল কিছু তল করার চেষ্টা।
…খোঁচাটা শেষ পর্যন্ত একজনেরই দম্ভের চাকে গিয়ে লেগেছে। সম্ভাবনার সেই অনুভূতিটা ভিতরে আর এক দফা নড়া-চড়া করে গেল। বাপীর হিসেব মিলছে।
রণজিৎ চালিহা চেয়ার ছেড়ে উঠেই দাঁড়াল এবার। ক্রুদ্ধ দু’চোখ গায়ত্ৰী রাইয়ের দিকে। এই একজনকে এরপর ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করা হবে কিনা এই জিজ্ঞাস্য হয়তো।
জবাবে রমণীর পল্কা ভ্রুকুটি। গলার স্বরে হালকা শাসন, ডোন্ট বি ইমপেশেন্ট ম্যান! বোসো। তারপরেই রসকষশূন্য গম্ভীর দু চোখ বাপীর মুখের ওপর চড়াও হল। গলার স্বরে ঠাণ্ডা ঝাপটা।—ওঁকে ও-কথা বলবার অর্থ কি, এ বাড়ি আমরা জবর-দখল করে খুশিমতো রেনোভেট করে নিয়েছি?
বাপীও ঠাণ্ডা মুখেই মাথা নাড়ল।—না। যা করেছেন একটু আগে তার জন্য আমি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছি, আর ভাড়া-টাড়ার ব্যাপারে আপনি যা বলবেন তাই হবে বলেছি।
ঘরে বসে আবু বলছিল, বাপী ভাইয়ের মুখখানা আগের থেকে ঢের মিষ্টি লাগছে, দেখলে মনে হয় ভেতর বার সাফ—নেপালী মেমসায়েবের ঠিক পছন্দ হয়ে যাবে। আবুর সে-আশায় এখন ছাই পড়েছে কিনা জানে না, কিন্তু মুখের দিকে চেয়ে ওর মেমসায়েবের এখন ভিতর দেখার চোখ।
—ঠিক আছে। থাকার জায়গার প্রবলেমের কথা শুনেছি। কিন্তু আমরা কি করতে পারি?
এ-প্রশ্নের জন্য বাপী প্রস্তুতই ছিল। জবাব দিল, বাড়ির জন্য আপনি অনেক খরচ করেছেন আরো কিছু খরচ করলে সমস্যা মেটে। পাশের খালি জমিতে সেপারেট আর এক্সক্লুসিভ অ্যারেঞ্জমেন্ট সুদ্ধু আমার জন্য একখানা ঘর তুলে দিন।
প্রায় কর্কশ স্বরেই গায়ত্রী রাই বলে উঠল, অ্যাবসারড! এখানে আমি থাকি, আমার মেয়ে থাকে—আমাদের অসুবিধে হবে!
দরজার কাছে সেই মেয়ে তেমনি বসেই আছে। বাপীর সহিষ্ণুতায় এবারে চিড় খেল একটু। সব মেয়েই মেয়ে। হয়তো ওকে করুণাপ্রার্থী ভাবছে এবার। সংযত সুরেই বলল, অসুবিধে আমারও খুব হবে মিসেস রাই…নিজের নিরিবিলি শান্তির ঘরে একটু আশ্রয় পাব বলে কলকাতা থেকে চলে এসেছিলাম। যাক, মাঝে যেমন খুশি পার্টিশন দিয়ে নিতে পারেন, আর সব সুদ্ধ যা খরচ হবে তাও ওই ভাড়ার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে নিতে পারেন।
মায়ের পিছনে মেয়ে উসখুস করে উঠল একটু। অসুবিধে তারও হবে শুনে হয়তো মজার ছোঁয়া লেগে থাকবে। বাপী তাকালো না। সব থেকে বেশি অবিশ্বাস আর ঘৃণা নিজের ওপর।
গায়ত্রী রাই মাথা নাড়ছে। চাউনিও সদয় নয়। বলল, তাই ডোন্ট লাইক দি আইডিয়া।
এবারেও বাপীর নরম মুখ। কিন্তু কথাগুলো স্পষ্ট।—টাকা সংগ্রহ করে নিজের জমিতে যদি সেপারেট ঘর তুলি, আপনি আটকাবেন কি করে?
এবারে যথার্থ হালছাড়া ক্রুদ্ধ মুখ মহিলার। এদিকটা ভাবেনি। তার দাপটের ম্যানেজার এতক্ষণে হয়তো ধৈর্যের শেষ মাথায় এসে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু এ কথার পর সেও আর দাপট দেখালো না। ঘাড় বেঁকিয়ে নেপালী ভাষায় কি দুই-এক কথা বলল তাকে।
কি বলল তক্ষুনি বোঝা গেল। গায়ত্রী রাইয়ের দু’চোখ আবার বাপীর মুখের ওপর এঁটে বসল। বলল, পাশের জমিসুদ্ধু বাড়িটা যদি আমি কিনে নিতে চাই? আই উইল পে ফেয়ার প্রাইস, পাঁচ হাজার টাকা আমি অলরেডি খরচ করেছি…আরো আট হাজার টাকা দিতে পারি। এগ্রিড?
বলা নেই কওয়া নেই একটা মুখের কথায় আট হাজার টাকার মালিক হয়ে বসতে পারে—ভাবলেও বুকের ভিতরটা ধড়ফড় করে ওঠার কথা। আট হাজার টাকা একসঙ্গে কখনো চোখে দেখেনি। কিন্তু বাপী গরজ দেখছে। গরজ বুঝছে। রয়ে-সয়ে ফিরে জিগ্যেস করল, আপনার বিবেচনায় সব মিলিয়ে এই বাড়ি আর জমির দাম তাহলে তেরো হাজার টাকা?
—টেন থাউজ্যান্ড? ঝাঁঝালো গলায় দর চড়িয়ে গায়ত্রী রাই বলল, কিসের কি দাম আমার জানা আছে, আমার দরকার তাই এই দাম—কিন্তু আর বাড়বে না। এগ্রিড?
ঘাড় ফিরিয়ে একবার আবুর মুখখানা দেখতে ইচ্ছে করছে বাপীর। কিন্তু বেচারা বিড়ম্বনার মধ্যে পড়বে। সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার টালি এলাকার ব্রুকলিন পিওন রতন বনিকের কথা মনে পড়ে গেল। আসার দিনও বলেছিল, কপালের রং বদলাচ্ছে, এবারে দিন ফিরল বলে। কয়েকশ’ টাকা পুঁজির বৃত্ত থেকে একেবারে দশ হাজার টাকার বৃত্তের মধ্যে এসে দাঁড়াল? কিন্তু বুকের তলায় যে বৃত্তে পৌঁছনোর তৃষ্ণা এখন, সেটা দশ হাজারের দশ বিশ গুণ হলেও কিছু নয়। আবুর কথা আর উচ্ছ্বাস সত্যি হলে এই একটি রমণীর সঙ্গে তেমন যোগ-নির্বন্ধে ভাগ্যের পাশায় তার থেকে ঢের বড় দান পড়তে পারে। দশ হাজার টাকা হাতের মুঠোয়। যে-কোন সময় হাত বাড়ালেই পাবে, কিন্তু এক্ষুনি হাত বাড়ানো মানেই এই যোগের শেষ। বাপী তরফদার আজ যেখানে দাঁড়িয়ে, দশ হাজার টাকা কেন, এই জীবনটাকে জুয়ার আসরে নামাতে আপত্তি নেই।
রমণীর অসহিষ্ণু প্রতীক্ষা মুখের ওপর স্থির হয়ে আছে। দু’ চোখের অকরুণ ঝাপটায় ওর মুখের জবাব টেনে বার করার মতো। বাপী বলল, না, আর বাড়াতে হবে না, মন থেকে সায় পেলে ওতেই হবে। পেলে বলব।
মহিলা চেয়েই আছে। দশ হাজার টাকার টোপ গেলার মতো জোরটা কোথায় বোঝার চেষ্টা। এবারে ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞাসা করল, সায় পেতে কতদিন লাগবে?
এত বড় একটা লোভের থাবা থেকে এমন অনায়াসে বেরিয়ে আসতে পেরে বাপীর ভিতরটা হালকা লাগছে। সেই সঙ্গে নিজের একটা জোরের দিকেরও হদিস মিলছে। মুখে বিপন্ন হাসি।—সায় এক্ষুনি পাচ্ছি না যখন কতদিনের মধ্যে পাব বলি কি করে…কিন্তু আপনার এত তাড়া কিসের, আমি সত্যি বাড়ি নিয়ে আপনার সঙ্গে কোনো রকম বোঝাপড়া করতে আসিনি। আপনাকে দেখতে এসে নিজের সমস্যার কথাটা বলে ফেলাই হয়তো অন্যায় হয়েছে।
গায়ত্রী রাইয়ের ব্যাপারটা দেখে ভেতর বোঝা কারো দ্বারা সম্ভব কিনা বলা যায় না। এ-কথার পরেও মুখে কোনো রকম রেখা দেখা গেল না। তবু বাপীর কেমন মনে হল, বোঝাপড়ার চেষ্টা বাতিল করে মহিলা এবারে শুধুই ওর ভেতর দেখছে।
এ-দিকে ম্যানেজার রণজিৎ চালিহা কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখল, তারপর অনেকক্ষণের একটা অসহ্য বিরক্তি ঠেলে উঠে দাঁড়াল।
গায়ত্রী রাইও সঙ্গে সঙ্গে তার দিকে তাকালো। বাড়িতে ঢোকার আগে আছা অন্ধকার থেকে মহিলার হাসিমুখ দেখা গেছল। এখন হাসি নেই মুখে, কিন্তু চাউনিটা অন্তরঙ্গ।—যাচ্ছ?
—হ্যাঁ, সাড়ে আটটায় ক্লাবে সেই পার্টির সঙ্গে মিট্ করার কথা।
—ঠিক আছে। কাল সকালে আসছ?
মাথা নাড়ল, আসছে।
সে পা বাড়াবার আগে গায়ত্রী রাই আবার বলল, ক্লাবেই যাচ্ছ যখন একটা কাজ কোরো তো, সেখানকার ম্যানেজারকে দিন-কতকের জন্য এঁকে ঘর ছেড়ে দিতে বলো…আটিল উই রিচ্ সামহয়্যার।
রণজিৎ চালিহা বাপীর দিকে একটা উষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিল। বাড়ির দর দশ হাজার টাকা তুলে ফেলার জন্যেই হাবভাবে জ্বলতে দেখা গেছে লোকটাকে। এখন এই কথা। জবাব দিল, কোথাও রিচ্ করার জন্য তোমার এত ব্যস্ত হওয়ার দরকার আছে?
সঙ্গে সঙ্গে এদিক থেকে আবার সেই হাল্কা-গম্ভীর ভ্রুকুটি। যার একটাই অর্থ, যা বলছি করো, এ-রকম জল-ভাত ব্যাপার নিয়ে মেজাজ গরম কোরো না।
রণজিৎ চালিহা বারান্দা থেকে নেমে অন্ধকারে মিশে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বাপীর মনে হল অনেকক্ষণের একটা কৃত্রিম গুমোট কেটে গেল। সামনের মহিলা এখনো গম্ভীর বটে, কিন্তু মুখের অকরুণ টান-ভাবটা গেছে। ওদিকে তার মেয়েও বেতের চেয়ার তুলে এনে মায়ের পাশে বসল। লালচে ঠোঁটের ফাঁকে টিপ-টিপ হাসি। আরো কিছু মজার খোরাকের প্রত্যাশা।
বাপী তাকাতে চায় না। দেখতে চায় না। সব মেয়েই মেয়ে। ওর জীবনে শনি। শনির দৃষ্টিতে সব জ্বলে, সব পোড়ে। ভিতরের ক্ষতবিক্ষত সত্তা কাউকে যেন চিৎকার করে নালিশ জানাতে চাইছে, এখানেও আবার একটা মেয়ে কেন? কেন?
ঘাড় বেঁকিয়ে একবার মেয়েকে দেখে নিয়ে আবার এদিক ফিরে গায়ত্রী রাই হঠাৎ ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠল, ইউ রাসকেল, কাম হিয়ার।
বাপী হকচকিয়েই গেছল। কিন্তু না এই আচমকা সম্ভাষণ বা আহ্বান ওকে নয়। আবুকে। কিন্তু আবুও এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়াল।
ঝাঁঝালো গলায় গায়ত্রী রাই আবার হুকুম করল, মোড়াটা এনে এখানে বোসো।
নিজের বাঁ পাশটা দেখিয়ে দিল। আবু শশব্যস্ত হুকুম তামিল করল। ঘাড়ে কি অজানা কোপ পড়ে ভেবে পাচ্ছে না।
গায়ত্রী রাইয়ের দুই সাদাটে ভুরু কুঁচকে জোড়া লাগার দাখিল।—কমাস আগেও বাড়ির মালিকের সম্পর্কে তুমি আমার কাছে গাদা গাদা প্রশংসা করে গেছ—সে এই মালিক?
এবারেও আবুর হতচকিত মূর্তি। জবাব দিল, জি মেমসায়েব।
সোজা হয়ে বসে নাক দিয়ে ফোঁস করে গরম বাতাস ছড়ালো এক ঝলক। তুমি একটা গাধা, হি ইজ্ এ ডেনজারাস্ ম্যান।
—জি মেমসায়েব—না, মেমসায়েব না। ভুল শুধরে ব্যস্তমুখে আবু উঠে দাঁড়াল একেবারে।—খোদার কসম খেয়ে বলছি বাপীভাই খুব ভালো লোক— আমার থেকে সাচ্চা লোক। ওই ম্যানেজার সায়েব খামোখা গরম হয়ে উঠতে
ওর মেজাজ খারাপ হয়েছিল—বাপীভাই, মেমসায়েবকে তুমি বুঝিয়ে বলো না।
এই আবু ঢিল নিয়ে বা শুধু লাঠি হাতে জঙ্গলের জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গে মোকাবিলা করে ভাবা শক্ত। কিন্তু বাপীর স্নায়ুতে স্নায়ুতে সাড়া জেগেছে আবার। ভিতরে আবার সেই অনুভূতির আনাগোনা। সে অনুভূতি আগে থাকতে কিছু ইশারা পাঠায়, কিছু বলে দেয়। আবুটা সরলই বটে। সত্যিই ডেনজারাস ভাবলে ওর মেমসাহেব এমন ঘটা করে বলত না—ভাবল না।
ওর হাঁসফাস দশা দেখে মেয়েটা হাসছে। বাপীর চোখে হাসি, মেমসায়েবকেই দেখছে।
আবুর কপালে আবার একটা ধমক।—ইউ শাট্ আপ অ্যান্ড সীট ডাউন! গায়ত্রী রাইয়ের দু চোখ আবার বাপীর মুখের ওপর আটকালো। ঘনিষ্ঠ আদৌ বলা যাবে না, কিন্তু সেরকম তপ্তও নয়।
—কি নাম বলেছিলে—বাপী তরফদার?
সোজা তুমি করে বলল। এতক্ষণই যেন একটা বাড়তি সৌজন্যের লাগাম ধরে বসেছিল। এ-ও বাপীর হিসেবের সঙ্গে একটু বেশিই মিলছে।
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
—আই থিংক ইউ আর নট এ স্ট্রেট ম্যান—আর ইউ?
চোখে চোখ রেখে বাপী হাসল একটু।—খুব স্ট্রেট বলেই তো মিস্টার চালিহা আর সেই সঙ্গে আপনিও একটু রেগে গেছলেন…আমি কি একটাও বাঁকাচোরা কথা বলেছি?
নিজে না চাইলে ওই মুখে নরম দাগ পড়েই না বোধ হয়। কিন্তু জবাব শুনে অখুশি মনে হল না। জিজ্ঞেস করল, পড়াশুনা কতদূর করা হয়েছে?
বলল।
—অনার্স ছিল?
আজ্ঞে না, অনার্সের বই কেনার মতো সঙ্গতি ছিল না। ডিসটিংশন পেয়েছিলাম।
আবু রব্বানীর মুখে একটা বড় আশার বাতি জ্বলে উঠেছে। তড়বড় করে বলল, দারুণ ভালো ছাত্র ছিল মেমসায়েব, আমার সঙ্গে মিশে আর দিনরাত জঙ্গল চষে অল্পের জন্য স্কলারশিপ মিস করেছে। হাই ফার্স্ট ডিভিশনে
মেমসায়েব ওকে ধমকে থামালো, তোমাকে কিছু জিগ্যেস করা হয়নি। বাপীই যেন হাঁপ ফেলে বাঁচল, উৎসাহের ঝোঁকে আবু ওকে আরো কত বেমক্কা ফাঁপিয়ে তুলত ঠিক নেই।
—বয়েস কত?
বাপীর মনে পড়ে ব্রুকলিনের বড়বাবু মন্মথ সোম খাঁটি বয়েস জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তাঁর মনে কিছু ছিল, এঁর মনে কিছু থাকা অবশ্য সম্ভব নয়। তবু পাশে এই বয়সের একটা মেয়ে বসা বলেই নিজের বয়েস দশটা বছর বাড়িয়ে বলতে পারলে স্বস্তি বোধ করত। কিন্তু পারা গেল না, সত্যি কথাই বেরিয়ে এলো।—এবার তেইশ হবে।
এত কাঁচা বয়েস মহিলারও খুব মনঃপূত হল না যেন। কারণটাও বাপী হয়তো আঁচ করতে পারে। কিন্তু তলিয়ে ভাবার আগেই পরের প্রশ্ন। কলকাতায় কি করা হত?
—যুদ্ধের আপিসের টেম্পোরারি চাকরি।
—গেছে?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। ভিতরে ভিতরে কেন যেন এখন আবার মেয়েটার পাশে বসে থাকা পছন্দ হচ্ছে না বাপীর। এখন কিছু মজার কথা হচ্ছে না, উঠে গেলেই তো পারে।
—এখন এখানে থাকা হবে?
বাপীর মনে হল প্রত্যেক কথার ফাঁকে মহিলা ওকে যাচাই করে নিচ্ছে।
-–সুযোগ সুবিধে হলে সেই রকমই ইচ্ছে।
—কিরকম সুযোগ সুবিধে?
চাকরির কথা ইচ্ছে করেই মুখে আনল না। বলল, ছোটখাটো কোনো ব্যবসা যদি করতে পারি?
এই জঙ্গলে আবার কি ব্যবসা?
বাতাস অনুকূল। বাপী হেসেই জবাব দিল, সে তো আমার থেকে আপনি ভালো জানেন।
এবার চাউনিটা আবার রুক্ষ কয়েক নিমেষের জন্য।—যা জানি সে-চেষ্টা করতে গেলে আমিই তোমাকে আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেব।…চাকরি করবে?
আবুর আর সবুর সইল না।—কেন করবে না মেমসায়েব, আপনার মুখের কথা খসলে বাপীভাইকে আমি আর ছাড়ি! ওর থেকে সেরা লোক আপনি এই তামাম বানারজুলিতেও পাবেন না—এ আমি হলপ করে বলতে পারি। জঙ্গলের নাড়ি-নক্ষত্র জানে, গাছ-গাছড়াও কম চেনে না—
এরপর তোমাকে আমি এখান থেকে বার করে দেব!
সঙ্গে সঙ্গে আবুর উচ্ছ্বাসের গলায় কুলুপ। কিন্তু মেমসায়েবের এরকম ঠাণ্ডা দাবড়ানি খেয়ে ও অভ্যস্ত বোধ হয়। হেসেই নিজের দু’কানে হাত দিয়ে সামাল দিল।
বাপীর দিকে ফিরল গায়ত্রী রাই। আমি প্রথমে তোমাকে ছ’মাসের জন্য ট্রায়েল দেব—ইট উইল বি এ রিগরাস জব, বাট দেয়ার ইজ ফিউচার—এই ছ’মাস কি পাবে না পাবে সেটা পরে ঠিক করব।
ভাগ্যের পাশায় দান পড়েছে, শুরুতেই সেটা জোরালো করে তোলার মতো জুয়াড়ীর খেলা দেখানোর এই মওকা। বাপীর এখন বদ্ধ ধারণা, আবুর মুখে সব শোনার পর যে অনুভূতিটা মনের তলায় আনাগোনা করে গেছে তাতে কোনো ভুল নেই। ভুল হলে একটা মানুষ এখান থেকে চোখের আড়াল হবার সঙ্গে সঙ্গে বাতাস এমন বদলে যেত না।
বাপী চুপ। কিছুটা নির্লিপ্তও।
—ও কে?
—ভেবে আপনাকে জানাব।
জবাব শুনে আবু তড়াক করে মোড়া ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠল।
না, মহিলাও এই জবাব আশা করেনি। ভুরুর মাঝে ভাঁজ পড়ল।—ভাবার কি আছে?
বিড়ম্বনার ধকল কাটাবার চেষ্টাতেই যেন সময় নিল একটু। বলল, যে-রকম লোক চাইছেন, ছ’মাসের ট্রায়ালে সেটা সম্ভব কিনা আপনিই জানেন।…তাছাড়া মিস্টার চালিহার জন্য আমাকে কিছুটা ফ্রীহ্যান্ড দিতে আপনারই হয়তো অসুবিধে হবে।
এটুকুতেই ঠিক বোধগম্য হবার কথা নয়, হলও না। কিন্তু এতেই চোখকান সজাগ। মনে আরো কিছু আছে তাও যেন আঁচ করতে পারছে। কোনো ব্যাপারে অস্পষ্ট বরদাস্ত করার মেজাজও নয় মহিলার। বলল, কারো যোগ্যতা বুঝতে ছ’মাস যথেষ্ট সময়। ফ্রি-হ্যান্ড দেবার কথা এখনই আসছে কোথা থেকে? আর তোমার জন্যে মিস্টার চালিহাকে নিয়ে আমার কি অসুবিধে হবে? হি উইল বি ইয়োর বিগ বস্…অবশ্য তোমার সম্পর্কে তিনি ভালো ইমপ্রেশন নিয়ে যাননি, তোমাকে গ্ল্যাডলি অ্যাকসেপ্ট করবেন বলে মনে হয় না। আই উইল ট্রাই—
বেশ স্পষ্ট অথচ নরম গলায় বাপী বলল, মিস্টার চালিহা আমাকে খুব গ্ল্যাডলি অ্যাকসেপ্ট করবেন মনে হলে আপনি কি অনেক আগেই আমাকে এখান থেকে তাড়িয়ে দিতেন না?
নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল গায়ত্রী রাই। এই মুখ আর এই চাউনি দেখে ওদিকে ঊর্মিলা রাই আর এদিকে আবু রব্বানীও চকিত বিমূঢ়।
—হোয়াট ডু ইউ মীন্?
বাপী চুপ। একবারেই জবাব দেবার ইচ্ছে নেই।
ফলে মহিলার আরো ঝাঁঝালো গলা।—কাম স্ট্রেট, হোয়াট ডু ইউ মীন?
বেশ সহজ অথচ শান্ত মুখে বাপী বলে গেল, আপনি অসন্তুষ্ট হয়েছেন বুঝতে পারছি, মনে যা আসে বলে ফেলে আমি অনেক সময় এরকম মুশকিলে পড়ি।…আবুর মুখে আপনার আর আপনার ব্যবসার গল্প শুনে আমার কেমন মনে হয়েছিল; এত বড় অর্গানিজেশনে বাইরের কোনো একজন সর্বেসর্বা হয়ে উঠবে এটা আপনি চান না। আর এই জন্যেই মিস্টার চালিহার মতোই যোগ্য হয়ে উঠতে পারে এমন একজন নির্ভরযোগ্য বিশ্বাসী লোক আপনার দিক থেকে আপনি চাইছেন। এ যদি ঠিক না হয়, ছ’মাসের ট্রায়েল দেবার দরকার নেই—নিজেকেই আমি বাতিল করছি।
মাত্র দু’চার মুহূর্তের জন্য বাপী যা দেখে উঠল সে কি ভুল? বুকের তলায় গোপন কিছুর ছবিটা কেউ যদি আচমকা চোখের সামনে তুলে ধরে, সে কি চকিতের জন্য এমনিই ধড়ফড় করে ওঠে না? কিন্তু সে শুধু কটা পলকের জন্য। গায়ত্রী রাইয়ের পালিশ করা সাদাটে মুখে আলগা রক্ত জমাট বাঁধছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। হিসহিস স্বরে বলল, ইউ আর রিয়েলি ইমপারটিনেন্ট। আমার সামনে বসে আমারই চিফ একজিকিউটিভ সম্পর্কে তুমি এমন কথা বলো? এত সাহস তোমার? শুধু গলার নয়, চোখেও আগুন ঝরছে।—ইউ মে গো নাও।
বাইরে পা দিয়ে আবুর হতাশা একটা আর্তনাদের মতো বেরিয়ে এলো গলা দিয়ে।—একেবারে পারে এনে এভাবে খেয়া ডোবালে বাপীভাই?
এদিকটায় রাস্তায়ও আলো নেই। বেশ অন্ধকার। চা-বাগানের কাছাকাছি হলে তবে রাস্তায় আলো। আবুর হাতে টর্চ। সন্ধ্যার পর ঘরের বার হলে এখানে সকলের হাতেই টর্চ বা হ্যারিকেন থাকে।
টর্চের আলোটা পায়ের দিকে রাস্তার ওপর। পাশাপাশি চললেও আবু ভালো করে দোস্ত্-এর মুখ দেখতে পাচ্ছে না। বাপী হাসছে একটু একটু। নিজেকে নিয়ে খুব একটা ভাবনা-চিন্তা আর সত্যি নেই। কারণ খুব বড় কিছু খোয়াবারও নেই আর।
বলল, তুমি এত ঘাবড়াচ্ছ কেন?
আবু যথার্থ বেজার। একটু হয়তো বিরক্তও।—এরপর ওই মেমসাহেব আমাকেও ছাড়বে না। তোমার ওইসব কথা ফাঁস করে দিলে ওই শালা ম্যানেজার ছাড়বে?
নির্লিপ্ত সুরে বাপী বলল, তাহলে তুমি আমাকে ছাড়ো। আমাকে ক্লাবে পৌঁছে দিয়ে ফিরে গিয়ে তোমার মেমসাহেবকে বলো, পাঁচ বছরে আমি এত বদলে গেছি তুমি জানতে না।
আবুর হাতের টর্চ আস্তে আস্তে বাপীর মুখের ওপর উঠে এলো। ঠোঁটে হাসি দেখে রাগই হল।—তুমি সত্যি বেশ বদলেছো তাহলে? আবু রব্বানী মওকা খোঁজে কিন্তু আসলে কোন্ শালার পরোয়া করে? দশ হাজার টাকা বাড়ির দাম পেলে—নিলে না। সেধে চাকরি দিতে চাইলে—তার জবাবে ওপর-পড়া হয়ে ওই কথা বলে এলে—তোমার মতলবখানা কি?
টর্চ নামাও।…বাড়ির দাম মজুতই আছে। দরকার হলে বেচে দেব, আর তুমি সঙ্গে থাকলে ওই টাকায় নিজেরাই কিছু করতে পারব। কিন্তু তোমার কি মত, মেমসাহেবকে যা বলেছি, সত্যি নয়?
আবু তবু ক্ষুব্ধ।—গায়ে পড়ে অত সত্যি কথা বলার দরকার কি ছিল?
বাপী আর কিছু বলল না। বলার আছেই বা কি। আবু যা ভাবছে তা হতেই পারে। গায়ত্রী রাই বাপীকে হয়তো হেঁটেই দিল।…কিন্তু তা যদি হয়, ভাগ্যের ছকে তেমন কোনো বড় দান পড়েনি বুঝতে হবে। ছেঁটে দিলেও বাপীর খেদ থাকবে না। কিন্তু মন সে-কথা বলছে না। দেখা যাক…।
আর কিছু ভাবতে ভালো লাগছে না। রাজ্যের ক্লান্তি। কাল সমস্ত রাত ঘুম হয়নি। ঘুম ক’রাত ধরেই নেই। আজও সকাল থেকে এ পর্যন্ত ধকলের মধ্যে কাটল। এখন নিরিবিলির তৃষ্ণা। একলার কোটরে সেঁধিয়ে যাবার তাড়না।
জিগ্যেস করল, ক্লাবে আলাদা ঘর-টর একটা পাব তো?
বুক ঠুকে বলার মতো করে আবু জবাব দিল, এজন্যে ওই মানেজারকে বলার কিছু দরকার ছিল না—সে ব্যবস্থা এ-মোল্লাই করতে পারত।