সোনার সিংহাসন
সন্ধ্যে থেকেই বাতাস পড়ে গেছে। আকাশে গভীর কালো মেঘ জমছে অনেকক্ষণ থেকেই। ফ্রান্সিসরা ঝড়ের পূর্বাভাস ভালোই বোঝে। সন্দেহ নেই ঝড় বৃষ্টি হবে। ওরা সাবধান হল। জাহাজের পালে হাওয়া নেই। পালগুলো নেতিয়ে পড়েছে।
হ্যারি ফ্রান্সিসের কেবিনঘরের কাছে এল। সঙ্গে সিনাত্রা। ফ্রান্সিসের কেবিনঘরের দরজায় টোকা দিল। মারিয়া দরজা খুলে দিল। ঘরে ঢুকে হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস আকাশের অবস্থা ভালো নয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রচণ্ড ঝড় আসছে। কী করব? ফ্রান্সিস একটু ভাবল। বলল–একেবারেই সময় নষ্ট করা চলবে না। সবাইকে রাতের খাবার খেয়ে নিতে বলল। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ফান্সিস বলল–চলো। ডেক এ যাবো।
–তাহলে ঝড় বৃষ্টি হবে? মারিয়া বলল।
–হ্যাঁ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড়ের সঙ্গে লড়াইয়ে নামতে হবে। সিনাত্রা বলল।
মারিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ফান্সিসরা সিঁড়িঘরের দিকে চলল। ডেকএ উঠল। বন্ধুরা ভিড় করে এল। ফ্রান্সিস চারিদিক ভাল করে তাকিয়ে দেখল। ঝড়ের পূর্বাবস্থা। দক্ষিণ দিগন্তে বিদ্যুৎ চমকানো শুরু হয়েছে। ভেজা হাওয়া ছুটে আসছে। ফ্রান্সিস’বলল। দূরে নিশ্চয়ই কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। বেশি দেরি করা চলবে না।
তখনই মাস্তুলের ওপর থেকে নজরদার পেড্রোর চড়াগলা শোনা গেল ভাইসব-সাবধানঝড় আসছে। ফ্রান্সিস ডেক থেকে গলা চড়িয়ে বলল–দড়িদড়া ধরে ধরে পেড্রো নেমে এসো। একটু পরেই মাস্তুলের দড়িদড়া ধরে ধরে পেড্রো নেমে এল। পেড্রো পশ্চিমদিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল–ঐদিকে ডাঙ্গা দেখেছি! তবে মাটি জঙ্গল আর পাহাড়ের মত কিছু।
–ফ্রান্সিস এখন কী করবে? হ্যারি জানতে চাইল। চারদিকে জড়ো হওয়া বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–আমরা পাহাড়ের দিকেই জাহাজ চালাবো।
–কিন্তু পাহাড়ের ধাক্কা লেগে–হ্যারি আর কথাটা শেষ করল না।
উপায় নেই। ঝড়ের প্রচন্ড ঝাঁপটা থেকে বাঁচতে ঐ পাহাড়ের আড়ালে যেতে হবে। ফ্রান্সিস বলল। তাহলে ফ্লেজারকে বলো। হ্যারি বলল। তারপর বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল–ভাইসব সবাই রাতের খাবার খেয়ে নাও-যত তাড়াতাড়ি পারো। এবার ফ্রান্সিস জাহাজচালক ফ্লেজারের কাছে গেল। ফ্লেজার এদিক ওদিক হুইল ঘোরাচ্ছিল। ফ্রান্সিসকে দেখে বললঝড় আসছে। কী করবো বুঝে উঠতে পারছি না। ফ্রান্সিস পশ্চিমদিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল–ঐদিকে আবছা একটা পাহাড়ি এলাকা দেখা যাচ্ছে। ঐদিকেই জাহাজ চলাও। কাছাকাছি গিয়ে দেখা যাক ওটার আড়ালে জাহাজ ভেড়ানো যায় কিনা। এছাড়া ঝড় এড়ানোর অন্য কোন উপায় নেই।
ফ্লেজার জাহাজের মুখ ঘোরাল। জাহাজ চলল আবছা-দেখা পাহাড়ী এলাকার দিকে। ফ্রান্সিস ভুরু কুঁচকে দেখল-পাহাড়গুলোর মধ্যে মাঝেরটা বেশ উঁচু। অন্যগুলো ততটা উঁচু নয়। ওখানে কাছাকাছি গিয়ে বোঝা যাবে কোথাও আড়াল পাওয়া যায় কিনা।
ওদিকে বন্ধুরা সব তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেতে শুরু করল। ফ্রান্সিসও মারিয়া আর হ্যারিকে নিয়ে খাবার ঘরে চলল। শাঙ্কো ততক্ষণে খেয়ে নিয়েছে। ও এসে হুইল ধরল। ফ্লেজার খেতে গেল। জাহাজ দুলতে দুলতে চলল পাহাড়ী এলাকার দিকে।
ততক্ষণে মাথার ওপর আকাশে বিদ্যুৎ চমকানো শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে ঘন ঘন বাজ পড়ার গুরুগম্ভীর শব্দ।
সবারই রাতের খাবার খাওয়া হয়ে গেল। সবাই ছুটোছুটি করে দ্রুত সব পাল নামিয়ে ফেলল। মাস্তুলের পালের কাঠামোর হালের দড়িদড়া টেনে ধরতে ধরতেই প্রচন্ড ঝড় জাহাজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। জাহাজটা থর থর করে কেঁপে উঠল। বেশ কয়েকজন ভাইকিং ছিটকে ডেকএর উপর পড়ে গেলো। অবশ্য পরেক্ষণেই উঠে দাঁড়িয়ে জাহাজের দড়িদড়া টেনে ধরল। তখনই শুরু হল বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি। তারপরই মুষুলধারে বৃষ্টি শুরু হল। চারদিক যেন একটা সাদাটে আস্তরণে ঢাকা পড়ে গেল। ঝড়বিক্ষুদ্ধ সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ জাহাজের গায়ে আছড়ে পড়তে লাগল। জাহাজ একবার ঢেউয়ের মাথায় ওঠে পরক্ষণেই ঢেউয়ের ফাটলে আছড়ে পড়ে।
জাহাজের এই দুলুনির মধ্যে মাস্তুলের দড়িদড়া ধরে ফ্রান্সিস ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে দুহাত দড়িদড়া থেকে ছিটকে সরে যাচ্ছে। বেশ কষ্টে ফ্রান্সিস সেই ধাক্কা সামলাচ্ছে আর তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উঁচু পাহাড়টার দিকে।
কিছু পরে বৃষ্টির ঝাপ্টা কমল। তখনই ফ্রান্সিস আবছা অন্ধকারের মধ্যে দেখল পাহাড়টায় একটা বড় বেশ উঁচু গুহামত। ফ্রান্সিস আনন্দে প্রায় চিৎকার করে উঠল–ওহহ হো। ঝড়ের শব্দের মধ্যেও সেই ধ্বনি কয়েকজন ভাইকিংএর কানে গেল। ওরাও চিৎকার করে ধ্বনি তুলল–ওহো হো। এবার সবাই সেই ধ্বনি শুনল। সবাই মিলে ধ্বনি তুলল–ও হো হো।
ফ্রান্সিস জাহাজের মধ্যে টলতে টলতে ফ্লেজারের কাছে এল। চিৎকার করে বলল–ফ্লেজার–ঐদিকে দেখ। একটা বড় গুহা। দেখ ভালো করে। ফ্লেজারও তীক্ষ্মদৃষ্টিতে তাকাল। গুহাটা আবছা দেখতে পেল। তখন বৃষ্টি আরো কমেছে।
এবার গুহাটা অনেক পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
ফ্রান্সিস চিৎকার করে বলল–দেখেছো?
–হ্যাঁ। দেখছি। ফ্লেজারও চিৎকার করে বলল।
-ঐ গুহার মধ্যে জাহাজটা ঢুকিয়ে দাও। সাবধান গুহার মুখে যেন ধাক্কা না লাগে। ফ্রান্সিস চিৎকার করে বলল। এবার ফ্লেজার দুলতে থাকা জাহাজটা চালিয়ে গুহার মুখের কাছে নিয়ে এল। দৃঢ়হাতে হুইলটা ঘোরাতে লাগল। দোল খেতে খেতে জাহাজটা গুহার মুখের কাছে এল। তারপর সাবধানে অন্ধকার গুহাটায় জাহাজ ঢুকিয়ে দিল। বোঝা গেল পাহাড়টা বেশ বড়। কিছুটা এগোতেই আর ঝড়ের ঝাঁপটা নেই। বৃষ্টি নেই। ভাইকিংরা ধ্বনি তুলল ও–হো–হো।
এখন জাহাজটা নিরাপদ। জলের ওপর গুহার এবড়ো খেবড়ো গা। জাহাজটা অনেকটা ভেতরে ঢুকে গেল। শান্ত পরিবেশে ঝড়ের অস্পষ্ট শব্দ শোনা যেতে লাগল। ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে ক্লান্ত সিক্ত ভাইকিংরা জাহাজের ডেক-এ এখানে ওখানে শুয়ে পড়ল। বসে পড়ল। সবাই মুখ হাঁ করে হাঁপাচ্ছে।
জাহাজটা আরো ভেতরে ঢুকল। অন্ধকার গাঢ় হল। ফ্রান্সিস ফ্লেজারের কাছে দাঁড়িয়েছিল। এবার বলল–ফ্রেজার-জাহাজ থামাও। ঝড়বৃষ্টি থামলে জাহাজ গুহা থেকে বের করবে। ফ্লেজার জাহাজ থামাল।
হঠাৎ ফ্রান্সিস দেখল–কিছুদূর কয়েকটা মশাল জ্বলে উঠল। বেশ চমকে উঠল ফ্রান্সিস। তার মানে এখানে মানুষের বসতি আছে। ততক্ষণ আরো কয়েকটা মশাল জ্বলে উঠল। ফ্লেজার বিস্ময়ের সঙ্গে বলল–ফ্রান্সিস অবাক কান্ড।
–হ্যাঁ! এখানে মানুষ থাকে। জানি না তারা কেমন মানুষ। ফ্রান্সিস বলল। ওদিকে ভাইকিংদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। ওরাও মশালের আলো দেখেছে।
এবার মশালের আলোয় সবাই দেখতে পেল কিছুদূরে একটা এবুড়ো খেবৃড়ো পাথরের বেদী মত। তার ওপর একটা পাথরের আসনমত। তাতে কে একজন বসে আছে। বেদীটার চারপাশে মশাল জ্বলছে। প্রায় পনেরো কুড়িজন কালো মানুষ বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
ফ্লেজার মৃদুস্বরে বলল–ফ্রান্সিস–এরা কারা?
কালো মানুষ। পাথরের আসনে যে বসে আছে সে নিশ্চয়ই এদের রাজা। ফ্রান্সিস আস্তে বলল।
–এখানে কী করবে? ফ্লেজার জানতে চাইল।
–দেখি–এদের মতলব কী? ফ্রান্সিস বলল।
হঠাৎ মশালের অস্পষ্ট আলোয় দেখা গেল একদল কালো মানুষ বর্শা দাঁতে কামড়ে ধরে সাঁতরে ফ্রান্সিসদের জাহাজের দিকে আসছে। সবাই দেখল সেটা। শাঙ্কো ছুটে ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল–ফ্রান্সিস কী করবে? আরো কয়েকজন ভাইকিং বন্ধু ছুটে এল। বলল–ফ্রান্সিস-লড়াই। ফ্রান্সিস মাথা নিচু করে অনেকক্ষণ ভাবল। তারপর মাথা তুলে বলল–না। আত্মসমর্পণ। বন্ধুদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল। ফ্রান্সিস। গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসবঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে আমরা অত্যন্ত ক্লান্ত। শরীরের এই অবস্থায় লড়াই করতে গেলে আমরা হেরে যাব। বেশ কিছু বন্ধু মারাও যাবে। তার চেয়ে দেখা যাক ওরা আমাদের নিয়ে কী করে। লড়াই না করলে ওরা নিশ্চয়ই আমাদের কোন ক্ষতি করবে না। শুধু বন্দীই করবে। দেখা যাক আমাদের কোথায় কীভাবে বন্দী করে। তারপর সময় সুযোগ বুঝে পালাবো। এখন লড়াই নয়।
ওদিকে হালের দড়ি বেয়ে কালো মানুষেরা ডেকএ উঠে আসতে লাগল। ওদের জলে-ভেজা কালো কালো শরীরে মশালের আলো পড়ে চক্ করছে। এতক্ষণ বর্শা দাঁতে চেপে ধরে ওরা সাঁতরে এসেছে। এখন হাতে বর্শা উঠিয়ে ওরা দ্রুত ফ্রান্সিসদের ঘিরে দাঁড়াল। একজন বেঁটেমত যোদ্ধা ফ্রান্সিসদের দিকে এগিয়ে এল। বোঝা গেল সেই দলনেতা। গলা উঁচু করে ভাঙা ভাঙা পর্তুগীজ ভাষায় বলল নেতা কে? ফ্রান্সিস এগিয়ে এল।
বলল–আমি।
–বন্দী–তোমরা। দলপতি বলল।
–কেন? আমরা তো কোন অপরাধ করিনি। ফ্রান্সিস পোর্তুগীজ ভাষায় বলল।
লড়াই চাও? দলনেতা বলল।
না। সুবিচার চাই। ফ্রান্সিস বলল।
–রাজা নিকুম্বা-চল। দলনেতা বলল।
–রাজা নিকুম্বা কোথায়? ফ্রান্সিস জানাতে চাইল।
দলপতি আঙ্গুল তুলে পাথরের বড় বেদীমত জায়গাটা দেখাল। বলল–সিংহাসন। তাহলে পাথরের সিংহাসনে যে বড় বড় গোঁফ দাড়িওয়ালা লোকটি বসে আছে সেই রাজা নিকুম্বা।
এখান থেকে সাঁতরে আমরা যাব না। জাহাজ ওখানে নিয়ে যাব। তারপর কাঠের পাটাতন পেতে ঐ বেদীতে উঠবো। ফ্রান্সিস বলল।
–আচ্ছা বেশ–চল। দলপতি বলল।
–জাহাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। দাঁড় বাইতে হবে। ফ্লেজার বলল।
–না–তোমরা–আমরা। দল নেতা কয়েজনকে কী বলল। কয়েকজন দাঁড় ধরে নেমে গেল। তখনও কয়েকজন ভাইকিং ক্লান্তিতে ভেজা ডেকে-এর ওপরই শুয়ে বসে ছিল।
একটু পরেই জাহাজ আস্তে আস্তে চলল। সেই এবড়ো খেবড়ো পাথরের বড় বেদীমত জায়গাটায় জাহাজ এসে লাগল। দলনেতা ভাইকিংদের উঠে যেতে ইঙ্গিত করল। ওদিকে কিছু কালো যোদ্ধা সিঁড়ি বেয়ে নেমে কেবিনঘর খাবার ঘরে নেমে গিয়েছিল। ওরা মারিয়াসহ রাঁধুনিদেরও ধরে নিয়ে এল।
মারিয়া ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল কী করবো?
–আমাদের আর কিছুই করার নেই। এদের সঙ্গে লড়াইয়ে নামবো না। ফ্রান্সিস বলল।
–বন্দীত্ব মেনে নেবে? মারিয়া বলল?
–উপায় নেই। এখন লড়াইয়ে নামালে আমরা কেউ বাঁচবো না।
নির্ঘাৎ মৃত্যু। এখন এদের কথা মতই চলতে হবে। বাধা দিয়ে লাভ নেই। ফ্রান্সিস না বলল।
–কিন্তু এরা তো যে কোন সময় আমাদের মেরে ফেলতে পারে। মারিয়া বলল।
–সেই ঝুঁকি নিতেই হবে। আগে এদের রাজার সঙ্গে কথা বলি। তখনই বুঝতে পারবো এরা আমাদের নিয়ে কী করতে চায়। ফ্রান্সিস বলল।
–আমি এদের বিশ্বাস করি না। মারিয়া বেশ জোর দিয়ে বলল।
–এখন আর বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্ন তুলে লাভ নেই। এখন আমরা বন্দী। ভবিতব্য মেনে নিতেই হবে। ফ্রান্সিস বলল।
ওদিকে দলপতির নির্দেশে ভাইকিংরা সার বেঁধে পাটাতন দিয়ে পাথরের বেদীমতন জায়গাটায় উঠতে লাগল। ফ্রান্সিস মারিয়াকে নিয়ে সেই সারিতে দাঁড়াল।
কালো যোদ্ধাদের পাহারায় সবাই সেই বেদীমত জায়গাটায় উঠে এল। ক্লান্ত ভাইকিংরা কেউ কেউ বসে পড়ল।
এবার মশালের আলোয় রাজা নিকুম্বাকে অনেক স্পষ্ট দেখা গেল। রাজা নিকুম্বা পাথরের আসনে বসে আছে। ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে আছে। মাথা ভর্তি কাঁচাপাকা বড় বড় চুল। কাঁচাপাকা দাড়িগোঁফ। দাড়ি বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে। কুঁৎকুতে চোখের দৃষ্টি কুটিল।
দলপতি রাজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একটু মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে এক নাগাড়ে কী বলে গেল।
রাজা দু-একবার মাথা ওঠা-নামা করে কী বলল। দলপতি ফ্রান্সিসের কাছে এল। রাজার দিকে এগিয়ে যাবার ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিস বুঝল রাজাকে সম্মান না জানালে বিপদ হতে পারে। ও রাজার সামনে এসে মাথা একটু নুইয়ে সম্মান জানাল।
রাজা নিকুম্বা দাড়ি গোঁফের ফাঁকে একটু হেসে ভাঙা ভাঙা পোর্তুগীজ ভাষায় বলল-কে-তোমরা?
–আমরা ভাইকিং। ফ্রান্সিস বলল।
–কেন–এখানে? রাজা জানতে চাইল।
আমরা দেশে দেশে দ্বীপে দ্বীপে ঘুরে বেড়াই। গোপন ধন ভান্ডার উদ্ধার করি। ফ্রান্সিস বলল।
নিয়ে পালাও। রাজা নিকুম্বা বলল।
না। সেই গুপ্ত ভান্ডারে যার অধিকার তাকে দিয়েদি। ফ্রান্সিস বলল
বদলে—নাও–না। রাজা নিকুম্বা বলল।
–না। একটা তামার মুদ্রাও নিই না। ফ্রান্সিস বলল।
রাজার সঙ্গে ফ্রান্সিসের কথা হচ্ছে তখনই রানি এল। পরনে রাজার মতই ঢোলা হাতা হলুদ রঙের ময়লা পোশাক। যেমন কালো তেমনি মোটা। মাথায় কঁকড়া লম্বা চুল। রাজার পাথরের আসনের পাশেই একটা ছোট পাথরের আসনে বসল। এসে অব্দি রানী হেসেই চলেছে। কালো মুখে সাদা দাঁতের হাসি। মারিয়াকে দেখে রানির হাসি বেড়ে গেল। রাজাকে ফিফিস্ করে কী বলল। রাজা মারিয়াকে দেখিয়ে ফ্রান্সিসকে বলল
কে?
–আমাদের দেশের রাজকুমারী মারিয়া। ফ্রান্সিস বলল। রাজা রানীকে কী বলল। রানীর হাসি বেড়ে গেল। অবাক চোখে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল। মারিয়ার গা জ্বলে গেল। কিন্তু কিছুই বলার নেই। এখন রাজা রানির দয়ার ওপর ওদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
এবার রাজা একই গম্ভীরস্বরে বলল-জলদস্যু–তোমরা। ফ্রান্সিস একটু চমকাল। পরক্ষণেই বলে উঠল–এই অপবাদ আমাদের অনেকেই দিয়েছে। কিন্তু আমরা জলদস্য নই। আমরা কখনও কারো কাছ থেকে একটা স্বর্নমুদ্রাও জোর করে নিই নি। যে যেমন দিয়েছে নিয়েছি আমাদের খাদ্য পোশাকের জন্য।
উঁহু। জাহাজ দেখা হবে–খুঁজে। দামি কিছু। রাজা বলল। হ্যারি নিম্নস্বরে বলল–দামি কিচ্ছু নেই। ফ্রান্সিস কথাটা শুনল। বলে উঠল–জাহাজ তল্লাশী করতে পারেন। দামী কিছুই পাবেন না।
–দেখি। রাজা নিকুম্বা বলল। তারপর দলনেতার দিকে তাকিয়ে কী বলল। দলপতি কয়েকজন যোদ্ধাকে কী বলল। জনা ছয় সাতেক যোদ্ধা পাতা পাটাতনের দিকে গেল। পাটাতন দিয়ে হেঁটে জাহাজে উঠল। সিঁড়ি দিয়ে নেমে কেবিনঘরগুলোর তল্লাশী চালাতে লাগল। মারিয়া নিশ্চিন্ত ছিল সোনার চাকতিগুলো ওরা খুঁজে পাবে না। তবে ওর নিজের পোশাক ভাইকিংবন্ধুদের পোশাক ওরা চুরি করতে পারে। এর আগেও এরকম হয়েছে। ও ওদের জাহাজের দিকে তাকিয়ে রইল কখন ঐ যোদ্ধারা ফিরে আসে।
প্রায় আধঘন্টা পরে জাহাজে তল্লাশী সেরে যোদ্ধারাদলপতির সঙ্গে ফিরে এল। মারিয়ার একটা নতুন পোশাক ভাইকিংদের কিছু নতুন পোশাক কয়েকটা তরোয়াল এসব নিয়ে যোদ্ধারা ফিরে এল। দলপতি রাজার কাছে গিয়ে কোমরের ফোট্টিতে গুঁজে রাখা মারিয়ার গলার সোনার নেকলেসটা রাজাকে দিল। রাজা দাড়ি গোঁফের ফাঁকে হেসে হারটা নিল। রানি হাসতে হাসতে রাজার হাত থেকে হারটা প্রায় কেড়ে নিয়ে হাতে জড়াল। রানি জানে না যে হারটা গলায় পরতে হয়। ফ্রান্সিস বুঝল এখন রাজারানির মন রেখে চলতে হবে। তাই মৃদুস্বরে বলল-মারিয়া-হারটা রানির গলায় পরিয়ে দিয়ে এসো। মারিয়া শুনল কথাটা মৃদুস্বরে বলল হতচ্ছাড়ি রানি।
–যাও। ফ্রান্সিস গলায় জোর দিয়ে বলল। মারিয়া আর আপত্তি করল না। আস্তে আস্তে রানির কাছে গেল। রানির হাত থেকে হারটা খুলে নিল। রানির ঝাকড়া চুল সরিয়ে গলায় পরিয়ে দিল। এবার রানি খুব খুশি। খিলখিল্ করে হেসে উঠল। এবার রাজা নিকুম্বা দলপতিকে কী বলল। রানি দু’হাত তুলে চিৎকার করে কী বলে উঠল। রাজা একটু চুপ করে থেকে দলপতিকে কী একটা আদেশ করল। দলপতি একবার মাথা ঝুঁকিয়ে নিয়ে ফ্রান্সিসদের দিকে তাকাল। ওর পেছনে পেছনে আসতে ইঙ্গিত করে ডানদিকের গুহামুখ দিয়ে ভেতরে চলল। ফ্রান্সিসরাও দলপতির পেছনে পেছনে চলল। এই গুহায় রাজার প্রজাদের ঘরসংসার। সব নারীপুরুষ শিশুর দল। এখানেই রান্না খাওয়া দাওয়া শোয়া। সে সব সংসারের পাশ দিয়ে ফ্রান্সিসরা চলল। গুহার শেষে এলো ওরা। সারা গুহাটাতেই এখানে ওখানে মশাল জ্বলছে। তারই আলোয় ফ্রান্সিস দেখল একেবারে গুহার শেষে ডানদিকে একটা বিরাট গর্তমত। উত্তপ্ত বাষ্প বেরুচ্ছে গর্তটা থেকে। ফ্রান্সিস মুখ নিচু করে দেখল–গর্তের নিচে জল ফুটছে। বোঝাই যাচ্ছে কী প্রচন্ড উত্তপ্ত সেই জল। দলপতি ফ্রান্সিসের কাছে এল। মৃদুস্বরে বলল–রাজা–এই কুণ্ডে–তোমাদের শাস্তি-রানি বাঁচাল। ফ্রান্সিস বুঝল রাজা ওদের এই উষ্ণকুন্ডে ছুঁড়ে ফেলতে আদেশ দিয়েছিল। রানি আপত্তি করেছিল। তাই ওরা বেঁচে গেল। ফন্সিস মৃদুস্বরে হ্যারিকে বলল সেই কথা। হ্যারি মৃদুস্বরে বলল অবধারিত প্রচন্ড যন্ত্রনাদায়ক মৃত্যু থেকে বেঁচে গেলাম। রাজকুমারীর হার পেয়ে রানি খুশি হয়েছিল।
দলপতি বাঁদিকে ঘুরল। কিছু দূর থেকেই দেখা গেল লোহার গরাদ। হামাগুড়ি দিয়ে ঢোকা যায় এরকম একটা দরজা। দরজার মাথায় মশাল জ্বলছে। দরজায় একটা বড় তালা ঝুলছে। দু’জন বর্শাধারী যোদ্ধা দরজায় পাহারা দিচ্ছে।
দলপতি সবাইকে ঘরে ঢুকতে ইঙ্গিত করল। এবার ফ্রান্সিস দলপতির সামনে গেল। মারিয়াকে দেখিয়ে বলল–ইনি আমাদের দেশের রাজকুমারী। এই কয়েদ ঘরে থাকতে পারবেন না।
নিরুপায়–রাজা নিকুম্বার হুকুম। দলপতি বলল।
–তাহলে রাজার কাছে নিয়ে চলো। ফ্রান্সিস বলল।
–রাজা নিকুম্বা– বিশ্রাম।
ফ্রান্সিস মারিয়ার দিকে তাকাল। বলল–রাজার সঙ্গে তো এখন কথা হবে না। আজকের রাতটা কষ্ট করে থাকো।
–তোমরা কষ্ট করে থাকলে আমিও থাকবো। মারিয়া বলল।
–না না। কাল রাজার সঙ্গে কথা বলবো। ফ্রান্সিস বলল।
এবার ফ্রান্সিস আর মারিয়া হামাগুড়ি দিয়ে কয়েদ ঘরে ঢুকল। মশালের আলোয় দেখল বন্ধুরা বেশ চাপাচাপি করে বসেছে। বাসযোগ্য ঘর তো নয়। গুহারই একটা অংশ। ওরই মধ্যে ফ্রান্সিস হ্যারিকে নিয়ে গুহার এবড়ো খেবড়ো পাথুরে দেয়ালে গা ঠেকিয়ে বসল। হ্যারি এগিয়ে এল। বলল–ফ্রান্সিস–এতো অন্ধকূপ। রাজকুমারী এখানে থাকতে পারবেন?
–রাজা নিকুম্বা এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন। কালকে সকালে রাজার সঙ্গে কথা বলবো। যে করে তোক মারিয়াকে আমাদের জাহাজে রাখতে হবে। খাবার টাবারও ওরাই দিয়ে আসবে। আজ রাতে আর কিছুই ব্যবস্থা করা যাবে না। বন্ধুদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল। এই বন্দী দশা কিছু বন্ধু মেনে নিতে পারছিল না। সিনাত্রা ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল–লড়াই করে জাহাজ নিয়ে পালালে হত। ঐ গাদাগাদির মধ্যে বেশ কয়েকজন বন্ধু কোনরকমে আধশোয়া হয়ে পড়ে ছিল। ফ্রান্সিস ওদের দেখিয়ে বলল–ঐ দেখ কী পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে ওরা। উঠে বসে থাকার সাধ্যটুকুও নেই। শরীরের এই অবস্থা নিয়ে লড়তে গেলে অনেক বন্ধুর মৃত্যু হত। আমি সেটা চাইনি।
–কিন্তু এখানে এভাবে বন্দী জীবন কাটাতে গিয়েও তো অনেকে মারা যেতে পারে। সিনাত্রা বলল।
তার আগেই পালাতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–পারবে? সিনাত্রা বলল।
–পারতেই হবে। তখন সুস্থ সবল শরীর নিয়ে লড়াই করতে হবে। এখন সময় ও সুযোগের প্রতীক্ষা। বন্ধুদের বোঝাও সেটা। ফ্রান্সিস বলল।
–দেখি…বোঝাতে পারি কিনা। সিনাত্রা উঠে বন্ধুদের কাছে চলে গেল।
রাত বাড়ল। ভাইকিং বন্ধুদের মধ্যে গুঞ্জন থেমে গেছে। ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে লড়াই করা সত্যিই সম্ভব ছিল না। এখন ভরসা ফ্রান্সিস। যদি পালানোর উপায় ভেবে দেখতে হয় সে ক্ষেত্রে ফ্রান্সিসই একমাত্র পারবে।
একসময় লোহার গরাদে শব্দ তুলে দরজা খুলে গেল। প্রহরী দু’জন খাবার নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকল। পাথর কুঁদে থালা মত তৈরি করা হয়েছে। পাঁচটা করে রুটি ঐ থালায় খেতে দেওয়া হল। মাছের টুকরো বোধহয় ভাজাই হয় নি। আঁশটে গন্ধ। প্রায় কেউই কোনরকমে খেল। ফ্রান্সিস তখনও খায়নি। ও রান্নার অবস্থা বুঝতে পারল। গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব–খেতে ভালো না লাগলে নাক টিপে খাও। পেটপুরে খাও। শরীরটা তেজি রাখো। কম খেয়ে শরীর দূর্বল হলে পালাবার শক্তি থাকবে না। বন্ধুরা ফ্রান্সিসের কথা শুনল। কেউ আঁশটে গন্ধ সত্ত্বেও খাবার ফেলল না। পেট পুরেই খেলো সবাই। থালা কম। কাজেই দফায় দফায় খেতে হল।
সবার খাওয়া হলে প্রহরীরা এঁটো থালা নিয়ে বেরিয়ে গেল। দরজায় তালা লাগিয়ে বর্শা হাতে পাহারা দিতে লাগল।
শাঙ্কো ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল কী করবে ফ্রান্সিস?
–সব দেখিটেখি। উপায় একটা হবেই। ফ্রান্সিস বলল।
–পাহারাদার তো মোটে দু’জন। খাবার দিতে তো ঐ দু’জনই আসে। ঐ দুটোকে কবজা করে পালানো যায় না? শাঙ্কো বলল।
এখন নয়। এখন শুধু বিশ্রাম। দিন কয়েক চুপচাপ থাকো। পাহারাদাররা পাহারায় একটু ঢিলে দিক। ফ্রান্সিস বলল। ভেবে দেখো তাহলে। এই কথা বলে শাঙ্কো নিজের জায়গায় চলে গেল।
একে শরীরের ক্লান্তি। তারপর এইভাবে গাদাগাদি করে থাকা, গুহায় অসহ্য গরম। প্রায় সবাই ভালো করে ঘুমতে পারল না। হ্যারির কষ্ট হল সবচেয়ে বেশি। একে ও শরীরের দিক থেকে বরাবরই দুর্বল। ফ্রান্সিস হ্যারির দিকে তাকাল। বলল–হ্যারি খুব কষ্ট হচ্ছে? হ্যারি ম্লান হাসল। বলল–তা একটু হচ্ছে।
–উপায় নেই। সহ্য কর। ফ্রান্সিস বলল।
–আমার ভয় কি জানো? হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া–এই রোগ তো আমার আছে। হ্যারি আস্তে আস্তে বলল। ফ্রান্সিস বেশ চমকাল। হ্যারির কাঁধে হাত রেখে বলল–আমার উরুর উপর মাথা রাখো।
-না-না। হ্যারি মাথা নাড়ল। ফ্রান্সিস শুনল না। হ্যারির মাথাটা ধরে নিজের উরুর ওপর শুইয়ে দিল। মারিয়া দেখল সেটা। একটু এগিয়ে হ্যারির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। একটু পরেই হ্যারি ঘুমিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল মারিয়া তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও। হ্যারিকে আমি দেখছি। মারিয়া আপত্তি করল না। সরে এসে গুহার এবড়ে খেবড়ো পাথরের মেঝেয় মাথা রেখে আধশোয়া হল। ফ্রান্সিস বসে থেকেই ঘুমিয়ে পড়ল। ওর এভাবে ঘুমোবার অভ্যেস আছে।
ভোর হল। ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। একজন দু’জন করে বন্ধুরা ঘুম থেকে। উঠতে লাগল। ওদের অস্বস্তি দেখেই ফ্রান্সিস বুঝতে পারল অনেকেরই ভালো ঘুম। হয়নি। ততক্ষণে মারিয়ারও ঘুম ভেঙে গেছে। ফ্রান্সিস মারিয়ার দিকে তাকাল। বলল–ঘুম হয়েছে?
–ঘন্টা দুয়েক ঘুমিয়েছি। মারিয়া বলল।
–সে কি! সারারাত ঘুম হয়নি? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–ঐ সব মিলিয়ে ঘন্টা দুয়েক। মারিয়া বলল।
ফ্রান্সিস আর কিছুই বলল। হ্যারিরও তখনই ঘুম ভাঙল। তাড়াতাড়ি ফ্রান্সিসের উরু থেকে মাথা তুলে হেসে বলল–আমার জন্যে তোমার বোধহয় ঘুম হয় নি।
–আমি গাছের গুঁড়ির মতো ঘুমিয়েছি। তোমার ঘুম হয়েছে তো? ফ্রান্সিস বলল।
হ্যাঁ। হ্যারি মাথা কাত করল।
গুহার মধ্যেই কোনার দিকে একটা পাথরের চৌবাচ্চা মত। তাতে জল রাখা। সবাই হাত মুখ ধুল।
কিছু পরে প্রহরীরা সকালের খাবার দিয়ে গেল। সেই দফায় দফায় পাথরের থালায়। পোড়া রুটি আর সবজির ঝোল। সবজির ঝোলের স্বাদটা ভালই। সবাই পেটপুরেই খেল।
ফ্রান্সিস প্রহরীটিকে বলল–তোমাদের দলনেতা কোথায়? প্রহরীটি কিছুই বুঝল না। এবার হ্যারি আকার ইঙ্গিতে দলনেতার কথা বোঝাল। এবার প্রহরীটি বুঝল। মৃদুস্বরে কী বলল। তারপর মাথা ওঠানামা করল। বোঝা গেল দলপতি আসবে।
এখানে তো অন্ধকারের রাজত্ব। রোদ নেই যে ফ্রান্সিসরা কত বেলা হল বুঝবে। তবে বেশ কিছুক্ষণ পরে দলপতি এল। ফ্রান্সিস গরাদের কাছে এগিয়ে গেল। গরাদে গাল চেপে বলল-রাজামশাই সভায় এসেছেন?
-না–পরে। দলপতি বলল।
এলে আমাকে বলবেন–রাজার সঙ্গে একটু কথা আছে। ফ্রান্সিস বলল। দলপতি মাথা ওঠা নামা করল। তারপর বলল–সকালে–খাবার-।
– হ্যাঁ খেয়েছি। অনেক ধন্যবাদ। দলপতি মৃদু হাসল।
দলপতি প্রহরীদের কী বলল। তারপর চলে গেল। ফ্রান্সিস ওর ফিরে আসার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।
কিছুক্ষণ পরে দলপতি ফিরে এল। একজন প্রহরীকে কী বলল। প্রহরী সেই গুহার ঘরের দরজা খুলে দিল। হামাগুড়ি দিয়ে ফ্রান্সিস মারিয়াকে নিয়ে বেরিয়ে এল। দলপতির পেছনে পেছনে চলল। গুহাপথে কালো মানুষদের পাতা সংসার। সে সবের পাশ দিয়ে চলল তিনজনে।
সেই বেদীমত উঁচু জায়গায় পৌঁছাল দুজনে। ফ্রান্সিস দেখল রাজা নিকুম্বা পাথরের আসনে বসে আছে। বোধহয় বিচার চলছে। পাথরের ছোট আসনে রানি বসে আছে। গলায় মারিয়ার গলার হার। রানি আপন মনে হাসছে। হারটায় হাত বুলোচ্ছে। বোঝা গেল হার পেয়ে রানি খুব খুশি হয়েছে।
কয়েকজন কালো মানুষ রাজার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের মধ্যে একজন একনাগাড়ে কী বলে যাচ্ছে। রাজা শুনছে। মাঝে মাঝে ভুরু কোঁচকাচ্ছে। লোকটির বলা শেষ হল। রাজা চিৎকার করে কী বলে উঠল। দুজন যোদ্ধা বশা হাতে ছুটে এসে দু’জন কালো মানুষকে ধরল। টেনে নিয়ে চলল ফ্রান্সিসরা যে কয়েদঘরে আছে সেইদিকে। রানিও হাসতে হাসতে ওদের পেছনে পেছনে চলল। ফ্রান্সিস বুঝল–ওদের মৃত্যুদন্ড হয়েছে। নিশ্চয়ই ঐ উষ্ণকুন্ডে এদের ছুঁড়ে ফেলা হবে। সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখতেই বোধহয় রানিও যাচ্ছে। ওদের মৃত্যু যন্ত্রণা রানি তাকিয়ে তাকিয়ে উপভোগ করবে। ফ্রান্সিস দু’চোখ বুজে একবার ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিল। অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে ওরা বেঁচে গেছে।
এবার এক বৃদ্ধকে ধরে একজন যোদ্ধা রাজার সামনে নিয়ে এল। বৃদ্ধটি মাথা নিচু করে একনাগাড়ে কী বলে গেল। রাজা ডান হাত তুলে ইঙ্গিত করল। একজন যোদ্ধা। এগিয়ে এসে বৃদ্ধকে সরিয়ে নিয়ে এল। বৃদ্ধটি হাসতে হাসতে বার বার মাথা নিচু করে চলে এল।
বোধহয় বিচার পর্ব শেষ হল। দলপতি রাজাকে কাছে গিয়ে কিছু বলল। রাজা ফ্রান্সিস আর মারিয়াকে এগিয়ে আসতে ইঙ্গিত করল।
ফ্রান্সিস আর মারিয়া এগিয়ে গেল। একটু মাথা নিচু করে ফ্রান্সিস মারিয়াকে দেখিয়ে বলল–ইনি আমাদের দেশের রাজকুমারী। কয়েদঘরের কষ্টকর জীবন ইনি সহ্য করতে পারবেন না।
–বন্দী–থাকতে হবে। রাজা বলল।
–যদি রাজকুমারীকে আমাদের জাহাজে বন্দী করে রাখেন তাহলে আমরা বাধিত হব। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমরা? রাজা নিকুম্বা বলল।
–আমরা কয়েদঘরেই থাকবো। রাজকুমারীকে বন্দী রেখে আমরা পালাতে পারব না।
এই সময় রানি ফিরে এল। আগের মতই হাসতে হাসতে। এসে রাজার পাশে ছোট পাথরের আসনে বসল। রাজা রানিকে কিছু বলল। বোধহয় ফ্রান্সিসের আবেদনের কথাই বলল। রানি খিলখিল্ করে হেসে উঠল। তারপর মারিয়ার দিকে তাকিয়ে কী বলে উঠল। ফ্রান্সিস মারিয়া কিছুই বুঝল না। এবার রাজা বলল, বেশ–পাহারা থাকবে। ফ্রান্সিস হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বলল–অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
— তোমরা এত কষ্টের মধ্যে থাকবে আর আমি–মারিয়া বলল।
–ওসব ভাবনা ছাড়ো। এছাড়া কোন উপায় নেই। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলল।
রাজা কী বলে উঠল। দু’জন যোদ্ধা বর্শা হাতে এগিয়ে এল। দলপতি মারিয়াকে বলল–জাহাজ–হ্যাঁও।
দুজন যোদ্ধার পেছনে পেছনে মারিয়া পাটাতনের উপর দিয়ে হেঁটে নিজেদের জাহাজের ডেক এ নামল। তারপর সিঁড়ি দিয়ে কেবিনঘরে নেমে এল।
এবার ফ্রান্সিস রাজার দিকে তাকাল। বলল–আমাদের বন্দী রেখে আপনার কী লাভ। আমাদের জাহাজ তল্লাশী করেও মূল্যবান কিছু পাননি। এবার আমাদের মুক্তি দিন। রাজা ঝাঁকড়া-চুলো মাথা নেড়ে বলল না। দলপতিকে বলল- কয়েদঘর। দলপতি ফ্রান্সিসের দিকে এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস আর কিছু বলল না। উপায় নেই। বন্দীদশাই মেনে নিতে হবে।
দলপতির সঙ্গে ফ্রান্সিস কয়েদঘরে ফিরে এল। হ্যারি জিজ্ঞেস করল–রাজা রাজি হল?
–হ্যাঁ। মারিয়া জাহাজেই থাকবে। কিন্তু আমাদের মুক্তি দেবে না। ফ্রান্সিস বলল।
হ্যারি কিছু বলল না। উপায় নেই। বন্দীদশা মেনে নিতেই হবে।
গুহাঘরে দুঃসহ অবস্থার মধ্যে ফ্রান্সিসদের দিনরাত কাটতে লাগল। প্রায় অখাদ্য খাবার পানীয় জলের টানাটানি অসহ্য গরম–এসবের মধ্যে দিয়েই ফ্রান্সিসদের বন্দীজীবন কাটতে লাগল।
দু’জন বন্ধু বিশেষ করে শরীরের দিক থেকে দূর্বল হ্যারি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ল। হ্যারির চিকিৎসার প্রয়োজন। প্রচন্ড জ্বরে হ্যারি প্রায় অজ্ঞানের মতো হয়ে গেল। ওদের এক বন্দি পোশাকের প্রান্ত ছিঁড়ে জলে ভিজিয়ে হ্যারির কপালে চেপে চেপে দিতে লাগল। অন্য দুই বন্ধু চুপ করে শরীরের অসুস্থতা সহ্য করতে লাগল।
ফ্রান্সিস গরাদের দিকে ছুটে গেল। হাতছানি দিয়ে প্রহরীকে ডাকল। প্রহরী কাছে এল আকার ইঙ্গিতে দলপতিকে ডাকতে বলল। প্রহরীটি বুঝল সেটা। ও চলে গেল। ফ্রান্সিস গরাদের কাছে অপেক্ষা করতে লাগল।
কিছু পরে দলপতি এল। ফ্রান্সিস গরাদে মুখ চেপে বলল–আমাদের তিন বন্ধু। খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। একজন বৈদ্য ডেকে দাও।
খুব অসুখ? দলপতি বলল।
–হ্যাঁ। তাড়াতাড়ি চিকিৎসা দরকার। ফ্রান্সিস বলল।
–দেখি। দলপতি বলল। তারপর চলে গেল।
ফ্রান্সিস হ্যারির পাশে এসে বসল। অপেক্ষা করতে লাগল যদি কোন বৈদিটৈদ্যি আসে।
রাত হল। খাওয়ার সময় হল তখনও বৈদি এল না। প্রহরীরা দফায় দফায় ওদের খাবার দিয়ে গেল। ফ্রান্সিস মনের এই উদ্বেগ নিয়েও পেট পুরে খেল। শরীর ঠিক রাখতে হবে।
একটু রাতে দলপতি এল। তার পেছনে একজন রোগা লিকলিকে কালো মানুষ। কোঁকড়ানো মাথার চুল দাড়ি গোঁফ। কাঁধে একটা মোটা কাপড়ের ঝোলা ঝোলানো। বোধহয় কাপড়টা জাহাজের পাল থেকে কাটা।
বৈদ্যি হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকল। পাথুরে মেঝেয় ঝোলাটা রাখাল। ফ্রান্সিস ইঙ্গিতে হ্যারিকে দেখাল। বৈদ্যি হ্যারির কপালে হাত দিয়ে দেখল। হ্যারির গলায় হাত দিয়ে দেখল। দুচোখের পাতা টেনে দেখল। ফ্রান্সিস দুই অসুস্থ বন্ধুকেও দেখাল। বৈদ্যি তাদেরও দেখল। এবার ঝোলা থেকে দুটো চিনে মাটির বোয়াম বার করল। দুটো বোয়াম থেকে কাদার মত কালো দুটো জিনিস বাঁ হাতের তালুতে ঢালল তারপর দুটো হাতের তালু ঘষতে লাগল। কিছু পরে দেখা গেল কাদার মত জিনিসগুলো শক্ত হয়ে গেছে। বৈদ্যি তাই থেকে বেশ কয়েকটা বড়ি বানাল। বড়িগুলো তিন ভাগ করল। ছটা করে ভাগ ফ্রান্সিসের দিকে এগিয়ে দিল। প্রথমে একটা আঙ্গুল দেখাল। তার মানে একবার। তারপর তিনটে আঙ্গুল দেখাল। তার মানে তিনবার করে। এবার একটু হেসে হাতের তালু দেখাল। বোধহয় অভয় দিল। তারপর বোয়াম ঝোলায় পুরে চলে গেল হামাগুড়ি দিয়ে। ফ্রান্সিস একটু আশ্বস্ত হল। হয় তো এই ওষুধেই কাজ হবে।
দিন দুয়েকের মধ্যে অসুস্থ দুই বন্ধুর সুস্থ হল। হ্যারিও অনেকটা সুস্থ হল। বৈদ্যি অবশ্য দুদিন ধরেই ওষুধ দিয়ে গেছে। কিন্তু হ্যারিকে নিয়ে ফ্রান্সিসের দুশ্চিন্তা গেল না। হ্যারি যদি আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে? গভীরভাবে ফ্রান্সিস ভাবতে লাগল কী করে এই কয়েদঘর থেকে পালানো যায়। এখানে দিনের পর দিন থাকলে কারো বাঁচার আশা নেই। এর মধ্যে ঘটল এক কান্ড। সেই রাতে দু’জন প্রহরী খাবার দিতে এসেছিল। সবারই খাওয়া হয়ে গেছে তখন। হঠাৎ সিনাত্রা পাগলের মতো এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে এক প্রহরীর চিবুকে প্রচন্ড জোরে ঘুষি মারল। প্রহরীটি ছিটকে দরজার উপরে পড়ল। সিনাত্রা দরজার দিকে দ্রুত গেল। কিন্তু পায়ের কাছে পড়ে থাকা প্রহরীটিকে ডিঙ্গোতে পারল না। অন্য প্রহরীটি ততক্ষণ দরজার কাছে এসে গিয়েছে। সে পাথরের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা বর্শাটা তুলে নিল। বর্শার মুখ তাক করে ধরল সিনাত্রার দিকে। সিনাত্রা আর দরজা দিয়ে বেরোতে পারল না।
ঘুষিতে আহত প্রহরীটিকে নিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে প্রহরীটি চলে গেল।
কিছু পরে তিন-চার জন যোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে দলনেতা ফিরে এল। ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বলল–তোমাদের একজন্ম আমাদের এক প্রহরীকে আহত করেছে। ফ্রান্সিস কোন কথা বলল না। বলবার কিছু নেই। সিনাত্রা পাগলের মত যা কান্ড করলে এতে যে ওদের বিপদ বাড়ল সেটা বুঝল ও। ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে ফ্রান্সিস এবার বলল-যা হবার হয়েছে। প্রহরীকে মারা উচিত হয়নি। অনুরোধ রাজা নিকুম্বাকে কিছু বলল না।
রাজা জানলে–উষ্ণকুন্ডে–মরণ। দলনেতা বলল।
–সেটা জানি বলেই বলছি রাজা যেন কিছু না জানে। ফ্রান্সিস বলল।
-বেশ–এবারের মতো–দলপতি বলল। চারজন যোদ্ধাকে পাহারায় রেখে দলপতি চলে গেল।
ফ্রান্সিস সিনাত্রাকে কাছে ডাকল। সিনাত্রা কাছে এল। ফ্রান্সিস বলল–অত্যন্ত অন্যায় কাজ করেছে। বোকার মত। এখনও হ্যারি বন্ধুরাও সম্পূর্ণ সুস্থ হয় নি। এর মধ্যে এই কান্ড করে পাহারাদারদের সংখ্যা বাড়িয়ে দিলে। দু’জন প্রহরী থাকলে তবু পালানো সম্ভব ছিল। এখন সেটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। তোমার জন্যে। সিনাত্ৰা ঘাড় গোঁজ করে বসে ছিল। বলল–এখানে থাকলে এমনিতেই মরবো।
–না। তার আগেই পালাবো। তখন তোমার সাহস আক্রমনের ক্ষমতা এসব দেখিও। পরিকল্পনা করে কাজ করতে হয়। ভুলে যেও না রাজকুমারী জাহাজে বন্দী হয়ে আছে। তাকে নিয়ে পালাতে হবে। কাজটা সহজসাধ্য নয়। সব পরিকল্পনা বানচাল করে দিলে। তোমার জন্য বিপদ বাড়ল। রাজা যদি এই ব্যাপারটা জানতে পারে আমাদের পালাবার সব পথ বন্ধ হয়ে যাবে। উকুন্ডে ছুঁড়ে ফেলবে আমাদের। তুমি একা পালাতে গিয়ে সবাইকে ভীষণ বিপদে ফেললে। এখন আমাদের জীবন সংশয়। বেঁচে থাকব কিনা জানি না। তবে তোমাকে বলি এরকম অবিবেচকের মত কাজ করে না। যাও নিজের জায়গায় যাও। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিসদের ভাগ্য ভাল দলপতি রাজা নিকুম্বাকে কিছু বলল না। অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেল ফ্রান্সিসরা। এবার এই অন্ধকূপ থেকে পালাবার উপায় ভাবতে হবে। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু ফ্রান্সিসের চোখে ঘুম নেই। একটাই চিন্তা কী করে বন্ধুদের নিয়ে মারিয়াকে নিয়ে পালানো যায়। তবে লড়াই করে নয়। বুদ্ধি করে সবাইকে নিরাপদে নিয়ে কী করে এই দুঃসহ জীবন থেকে বাঁচা যায়।
প্রায় এক মাস কাটল। হ্যারি আর দুই বন্ধু এখন অনেক সুস্থ। কয়েদঘরে পাহারাদারদের সংখ্যা দুজন কমানো হয়েছে। পাহারার কড়াকড়িটা কমেছে। ফ্রান্সিস পালাবার ছক ভাবছে গভীরভাবে। হ্যারি শাঙ্কোর সঙ্গে কথাও বলছে। কিন্তু বিনা বাধায় পালানো সম্ভব মনে হচ্ছে না।
এবার ফ্রান্সিস ভাবল ওদের মুক্তির ব্যাপারে রাজার সঙ্গে কথা বলবে। সকালের খাবার খাওয়া হলে ফ্রান্সিস দরজার কাছে গেল। একজন প্রহরীকে ইশারায় ডাকল। ইঙ্গিতে দলনেতাকে ডেকে দিতে বলল। প্রহরীটি চলে গেল।
কিছু পরে দলপতি এল। বলল–কেন?
–রাজা নিকুম্বার সঙ্গে কথা বলবো। তুমি ব্যবস্থা করে দাও।
–রাজসভায় চল। দলপতি মাথা নেড়ে বলল। কয়েদঘরের দরজা খোলা হল। ফ্রান্সিস হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল। দলপতির পিছনে পিছনে চলল রাজসভার দিকে। কালো মানুষদের ঘর সংসারের পাশ দিয়ে হেঁটে রাজসভায় এল দুজনে।
তখন রাজসভায় একটা বিচার চলছিল। বিচার শেষ হলে দলপতি রাজার সামনে এ গেল। মাথা একটু নুইয়ে বোধহয় ফ্রান্সিসের কথা বলল। আজকে পাশের আসনে রানি নেই। ফ্রান্সিস একটু হতাশই হল। রানির জন্যই ওরা বেঁচে গিয়েছিল। রানি থাকলে হয়তো ওদের স্বপক্ষে কিছু বলতো। এখন তো রাজা নিকুম্বা একা। রাজাকে বোঝানো মুশকিল হবে। তবু চেষ্টা করে দেখা যাক মুক্তি মেলে কিনা।
রাজা ততক্ষণে ফ্রান্সিসকে এগিয়ে আসতে ইঙ্গিত করেছে। ফ্রান্সিস এগিয়ে গেল।
-বল। রাজা বলল।
আমরা তো কোনভাবেই আপনাদের বা আপনার এই রাজত্বের কোন ক্ষতি করিনি। তবে আমাদের বন্দী করে রেখেছেন কেন? ফ্রান্সিস বলল-জলদস্যু আসবে–বিক্রি। রাজা দাড়ি গোঁফের ফাঁকে হেসে হাতের আঙ্গুল গোল করে ঘুরিয়ে বলল–সোনা। ফ্রান্সিস বুঝল–ওদের জলদস্যুদের কাছে বিক্রি করা হবে। বদলে রাজা সোনার চাকতি পাবে। ফ্রান্সিসের মন দমে গেল। তবু হাল ছাড়ল না। বলল–আমরা নিরীহ। আপনাদের কোন অপকার করি নি। তবে আমাদের ক্রীতদাসের হাটে বিক্রির জন্যে জলদস্যুদের হাতে তুলে দেবেন কেন? –সোনা চাই। রাজা এবার একটু জোরেই হেসে উঠল। ফ্রান্সিসের মন নিরাশায় ভরে উঠল। বুঝল–কোন যুক্তিতর্কে লাভ হবে না। রাজা তার সিদ্ধান্তে অটল। ফ্রান্সিস আর কিছু বলল না।
রাজা পাথরের সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বিচারসভা শেষ। এবার ফ্রান্সিস লক্ষ্য করল রাজার কোমরে একটা চামড়ার কোমর বন্ধনী। তাতে গোল গোল সোনা বসানো। তাহলে একটা গুহার রাজা হলেও রাজা সোনার মূল্য বোঝে। রাজা গুহার সামনের দিকে চলে গেল।
ফ্রান্সিস কয়েদঘরে ফিরে এল। হ্যারি এগিয়ে এল। বলল–কথা হল?
-হ্যাঁ। আমাদের মুক্তি নেই। রাজা জলদস্যুদের কাছে আমাদের বিক্রি করবে বলে বন্দী করে রেখেছে। ফ্রান্সিস বলল।
বলো কি? হ্যারি বেশ আশ্চর্য হল। বলল–রানী কিছু বলল?
–রানি ছিল না। আমি বোঝবার চেষ্টা করলাম। লাভ হল না। রাজা স্থির প্রতিজ্ঞ। আমাদের ক্রীতদাসের জীবন মেনে নিতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
বন্ধুরা সব কথা শুনল। শাঙ্কো এগিয়ে এল, বলল–ফ্রান্সিস–এখন আমরা আর ক্লান্ত নই। আমরা লড়াই করে পালাতে পারবো।
না। সেই অসম লড়াইয়ে অনেকের প্রাণ যাবে। এটা আমি মেনে নেব না। ক্রীতদাসের জীবন মেনে নিলে তবু তো আমরা বেঁচে থাকবো। একবার তো ক্রীতদাসের জীবন থেকে পালিয়েছি। সময় সুযোগ বুঝে আবার পালাবো। কিন্তু অসম লড়াইয়ে নামলে অনেকেই মারা যাবো। অপেক্ষা কর। দেখা যাক ঘটনা কোনদিকে গড়ায়? ফ্রান্সিস বলল।
সেদিন দুপুরে। সবার খাওয়া হয়ে গেছে। প্রায় অখাদ্য খাবার। তবু ভাইকিংরা পেট পুরে খায়। ফ্রান্সিস বলে–শরীর ঠিক রাখো। পেটপুরে খাও।
ভাইকিংরা কেউ কেউ আধশোয়া হয়ে আছে। বেশিরভাগ বসে আছে। এইটুকু গুহাঘর। শোওয়া প্রায় অসম্ভব। হঠাৎ প্রচন্ড দুলুনি। সেইসঙ্গে গুগুর শব্দ।
দুচারজন ভাইকিং উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। পারল না। দুলুনিতে ছিটকে পড়ল। সমস্ত পাহাড়াটাই দুলে উঠল। কয়েদঘরের বাঁ পাশের পাথুরে দেয়াল হুড়মুড় করে। ভেঙে পড়ল। নিচেই সমুদ্রের জল। ঢেউয়ের মাথায় রোদ ঝাচ্ছে। ফ্রান্সিস চিৎকার করে বলল–ভাইসব ভূমিকম্প। সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ো। ওদিকে গুহাঘরের ভিতর থেকে স্ত্রী পুরুষ শিশুর আর্ত চিৎকার কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। মশাল নিভে গেছে।
ফ্রান্সিসের নির্দেশে বন্ধুরা সবাই বাইরের সমুদ্রের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বাইরে দুপুরের রোদ। সবই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ফ্রান্সিস জল থেকে মুখ তুলে চেঁচিয়ে বলল–গুহা মুখের দিকে সাঁতরে চলো। আমাদের জাহাজ উদ্ধার করতে হবে।
সবাই গুহা মুখের দিকে সাঁতারে চলল। তখনই দেখা গেল ডানদিকে পাহাড়ের একটা অংশ ভেঙে পড়ল। গুর গুর শব্দ কমল। সমুদ্রের জলে ঢেউয়ের মাতামাতি। তার মধ্যে দিয়েই ফ্রান্সিসরা সাঁতরে চলল।
গুহামুখের কাছে এল সবাই। একে একে গুহার মধ্যে ঢুকল। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার চারদিক। সব মশাল নিভে গেছে। ততক্ষণে গুন্ গুন্ শব্দ থেমে গেছে।
শাঙ্কোই সবার আগে সাঁতরে যাচ্ছিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই অন্ধকারটা ওর চোখে সয়ে গেল। অস্পষ্ট দেখল রাজার সিংহাসন বসানো পাথরের বেদীটা ভেঙে দুভাগ হয়ে গেছে। কালো মানুষদের চিৎকার আর্তস্ব তখনো শোনা যাচ্ছে।
শাঙ্কো এবার স্পষ্ট দেখল ওদের জাহাজের গা। ও সাঁতারে গিয়ে জাহাজের ঝোলানো দড়ি ধরে হাঁপাতে লাগল। ততক্ষণে ফ্রান্সিসরাও এসে গেছে। আবছা অন্ধকারে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে ফ্রান্সিস দড়ি ধরে হাঁপাতে লাগল। ও খুঁজছিল হ্যারিকে। একটু গলা চড়িয়ে ডাকল–হ্যারি? একটু দূর থেকে হ্যারি বলল–যাচ্ছি। একটু পরেই হ্যারি এসে দড়ি ধরল। মুখ হাঁ করে হাঁপাতে লাগল।
একটু বিশ্রাম নিয়েই শাঙ্কো দড়ি বেয়ে জাহাজের অন্ধকার ডেক উঠে এল। অস্পষ্ট দেখল–দু’জন প্রহরী মাস্তুল আঁকড়ে ধরে আছে। হাতে বর্শা নেই। শাঙ্কো এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। দেখল একপাশে দুটো বর্শা পড়ে আছে। আসলে জাহাজের দুলনির জন্যে প্রহরী দু’জন টাল সামলাতে মাস্তুল জড়িয়ে ধরে আছে। এরকম দুলনি শাঙ্কোদের কাছে সমস্যাই নয়। ও দুলুনির মধ্যে ছুটে গিয়ে বর্শা দুটো তুলে নিল। প্রহরী দুজন এবার নিজেদের নিরস্ত্র অবস্থাটা বুঝল। কোন কথা বলল না।
শাঙ্কো সিঁড়িঘরে এল। সিঁড়ি বেয়ে নিচে ফ্রান্সিস মারিয়ার কেবিন ঘরে এল। দরজা বন্ধ। শাঙ্কো দরজায় টোকা দিয়ে ডাকল–রাজকুমারী-রাজকুমারী। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল। ঘরে একটা মোমবাতি জ্বলছিল। সেই আলোয় শাঙ্কো দেখল মারিয়ার মাথার চুল উস্কোখুস্কো। ভয়াত মুখ। রাজকুমারী শুধু বলল–ফ্রান্সিস?
কিছু ভাববেন না। আমরা সবাই মুক্ত আর সুস্থ।
ভুমিকম্প। ভয়াতস্বরে মারিয়া বলল।
–হ্যাঁ। এখন থেমে গেছে। শাঙ্কো বলল।
এরমধ্যে ফ্রান্সিসরা জাহাজে উঠে পড়েছে। ফ্রান্সিস ডেকএ দাঁড়িয়ে বলল একদল দাঁড় ঘরে চলে যাও। জাহাজ উল্টো দিকে গুহার বাইরে নিয়ে যেতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। একদল ভাইকিং চলে গেল দাঁড় বাইতে।
জাহাজ চালক ফ্লেজার ছুটে এল ফ্রান্সিসের কাছে। বলল–
–ফ্রান্সিস সর্বনাশ হয়েছে।
কী হয়েছে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–হালের ওপর পাথরের চাই ভেঙে পড়েছে। হাল ভেঙে গেছে।
–ঠিক আছে। তুমি যেভাবে পারো গুহা থেকে জাহাজটা বের কর। ফ্রান্সিস দ্রুত বলল।
–দেখি। ফ্লেজার চলে গেল।
ওদিকে দাঁড় বাইতে থাকায় জাহাজটা একটু নড়ল। তারপর গুহার মুখের দিকে চলল। শাঙ্কো মারিয়াকে নিয়ে ডেকও উঠল। মারিয়ার মুখ দেখেই ফ্রান্সিস বুঝল মারিয়া ভীষন ভীত হয়ে পড়েছে। মারিয়ার ডান হাতটা ধীরে ধীরে ফ্রান্সিস একটু চাপ দিল। মারিয়ার ভয় ভাঙাবার চেষ্টা করল। বলল–কোন ভয় নেই। আমরা সবাই নিরাপদ। এক্ষুনি জাহাজ বাইরের সমুদ্রে বেরিয়ে আসবে। তুমি বরং কেবিনঘরে যাও। বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নাও।
–না। আমি তোমাদের সঙ্গেই থাকব। মারিয়া বলল।
বেশ। ভূমিকম্প আমাদের উপকারই করেছে। কয়েদঘর ভেঙে পড়েছে। তাই আমরা নিরাপদে পালাতে পেরেছি। ফ্রান্সিস বলল।
জাহাজের ওপর পাথর ভেঙে পড়েছে।
-হা হাল ভেঙে গেছে। ওটা আমরা সরিয়ে নেব। জাহাজের আর কোন ক্ষতি হয়নি। ফ্রান্সিস বলল।
জাহাজটা আস্তে আস্তে গুহা মুখ থেকে বেরিয়ে এসে উন্মুক্ত সমুদ্রে পড়ল।
তখন বিকেল হয়ে এসেছে। ফ্রান্সিস ফ্লেজারকে সঙ্গে নিয়ে হালের কাছে এল। সত্যিই হাল প্রায় ভেঙে গেছে। বোঝাই যাচ্ছে পাথরের চাইটা বেশ বড়ই ছিল। হাল ভেঙে চাইটা গুহার জলে পড়ে গেছে।
–যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাল মেরামত করতে হবে। নইলে হাওয়ার ধাক্কায় জাহাজ যেদিকে খুশি যাবে। হুইলই ঘোরানো যাবে না। ফ্লেজার বলল।
–হ্যাঁ–দেখছি। ফ্রান্সিস মাথা ওঠানামা করল।
ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে ডাকল–শাঙ্কো। শাঙ্কো এগিয়ে এল। বলল–কী বলছো?
কয়েকজনকে নিয়ে কাঠযন্ত্রপাতি বের কর। নইলে হাওয়ার ধাক্কায় কোন দিক ঠিক রাখতে পারবে না। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে। শাঙ্কো বলল। তারপর ছুটল বন্ধুদের জোগাড় করতে।
ওদিকে নজরদার পেড্রে কয়েকজনকে নিয়ে পাল টাঙাবার জন্যে পালবাঁধার কাঠামোয় উঠতে লাগল। ফ্লেজার ছুটে গিয়ে বলল-পেড্রো–এখন পাল টাঙিওনা। তাহলে জাহাজ এদিক ওদিক ছুটবে। সব দিকটিক গুলিয়ে যাবে। আগে হাল ঠিক। হোক। তারপর পাল টাঙাবে। পাল ছাড়াও জাহাজ এদিক ওদিক ছুটল। ফ্লেজার অসহায় চোখে তাকিয়ে দেখল। হাল মেরামত না হলে কিছুই করার নেই।
তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। মারিয়া এসময় প্রতিদিন সূর্যাস্ত দেখে। আজও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। কিন্তু মনে দুশ্চিন্তা। বেহাল জাহাজ কোনদিকে চলছে যা মেরিই জানে। সূর্য অস্ত গেল। সন্ধে নামল। আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক।
ওদিকে সিনাত্রা রাজা নিকুম্বার দুই প্রহরীকে ওদের কেবিন ঘরে বন্দী করে রেখে ছিল। দু’জনেরই হাত বাঁধা। এবার সিনাত্রা ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল-রাজা নিকুম্বার দুই প্রহরীকে বন্দী করে রেখেছি। কী করবে ওদের নিয়ে?
এখন তো আমরা কোথায় এসেছি কিছুই বুঝতে পারছি না। কোন বন্দর টন্দর পাই। সেখানে ওদের দুজনকে নামিয়ে দেব। ওদের বন্দী করে রেখে কী লাভ। ফ্রান্সিস বলল।
রাতে শাঙ্কো কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে হাল মেরামতির কাজ করতে লাগল। মশালের আলোয় কাজ চলল। বড় বড় কাঠের তক্তা এনে কেটে ঘষে হাল সারাই হয়। কাজ চলল সারারাত। ফ্রান্সিসের নির্দেশ- যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাল সারাই। করতে হবে।
ভোর হল। তখনও শাঙ্কোরা কাজ করে চলেছে। সমুদ্রের উত্তাল হাওয়ায় জাহাজ এদিক ওদিক ছুটছে।
শাঙ্কোরা প্রায় দিন সাতেক রাতদিন খেটে জাহাজের হালটা মেরামত করল। ফ্লেজার হুইল চেপে ধরল। ফ্রান্সিস কাছেই ছিল। বলল–মোটামুটি উত্তরদিকটা ঠিক রেখে জাহাজ চালাও। ফ্লেজার সেভাবেই জাহাজ চালাতে লাগল।
জাহাজ চলল। দিন যায় রাত যায় ডাঙার দেখা নেই।
ফ্রান্সিস চিন্তায় পড়ল। তবে কি দি হারালাম। ও ফ্লেজারের কাছে যায়। জিজ্ঞেস করে–ফ্লেজার আমরা কি দিক হারলাম?
–কতকটা তাই। ডাঙা না পেলে এভাবেই জাহাজ চালাতে হবে।
–উত্তরদিকটা ঠিক রেখে চালাও। ডাঙা পেতেই হবে। ঘাবড়ে যেও না। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে। ফ্লেজার মাথা কাত করল। জাহাজ চলল।
সেদিন বিকেলে মাস্তুলের ওপর থেকে পেড্রে চিৎকার করে বললডাঙা দেখা যাচ্ছে ডাঙা। ভাইকিংরা ভিড় করে এসে রেলিং ধরে দাঁড়াল। সিনাত্রা চেঁচিয়ে বলল–কোন দিকে?
–ডান দিকে। পেড্রো চেঁচিয়ে বলল।
একটু পরেই ডানদিকে একটা সবুজ পাহাড় দেখা গেল। তারপর গাছগাছালি। ফ্লেজার ডাঙার দিকে জাহাজ ঘোরাল!
সমুদ্রের তীরভূমি দেখা গেল। মানুষজন দেখা গেল না। হ্যারি ছুটে ফ্রান্সিসের কেবিনঘরের দরজায় এসে টোকা দিল।
এসো। ফ্রান্সিস বলল।
দরজা খুলে গেল। মারিয়া দাঁড়িয়ে।
–আমি সূর্যাস্ত দেখতে যাচ্ছি। মারিয়া চলে গেল।
–ফ্রান্সিস ডানদিকে ডাঙা দেখা গেছে। সমুদ্রতীর নির্জন। একটা ঘাসে ঢাকা সবুজ পাহাড় দেখা গেছে। হ্যারি বলল।
–চলো–ডেকএ যাই। ফ্রান্সিস বলল।
দুজনে ডেক উঠে এল। সূর্য ডোবার আগে সমুদ্রতীর মোটামুটি দেখা গেল। টানা বালিয়াড়ি চলে গেছে বেশ কিছুদূর পর্যন্ত। গাছগাছালি নেই তারপর একটানা চলে গেছে শুকনো গাছের সারি। দূর থেকে বোঝা গেল না কী গাছ ওগুলো।
সূর্য অস্ত গেল।
অন্ধকার নামল
কী করবে? হ্যারি বলল।
–এই রাতে নামা চলবে না। বিদেশ বিভুঁই। বিপদে পড়বো। ফ্রান্সিস বলল। তারপর ফ্লেজারকে গিয়ে বলল–জাহাজটা কাছাকাছি নিয়ে চলো।
তীরে জাহাজ ভেড়ানো যাবে না। জল অগভীর। ফ্লেজার বলল। তারপর জাহাজ থামাল। শাঙ্কোরা জাহাজের পালগুলো গুটিয়ে ফেলল। জাহাজ অনড় দাঁড়িয়ে রইল।
–কাল সকালে খাবার খেয়ে নামব। আজকে জাহাজ এখানেই থাকুক। ফ্রান্সিস বলল।
-বেশ। হ্যারি বলল।
রাতের খাবার খেয়ে ফ্রান্সিস আর মারিয়া নিজেদের কেবিনঘরে এল।
কী করবে ঠিক করলে? মারিয়া জানতে চাইল।
বেশ কিছুদিন পর ডাঙার দেখা পেলাম। কাল সকালে নামব। খোঁজখবর করব। ফ্রান্সিস বলল।
–অচেনা জায়গা! যদি বিপদ হয়? মারিয়া বলল।
উপায় নেই। সেই ঝুঁকিটা নিতেই হবে। নাহলে কোথায় এলাম জানব কী করে? ফ্রান্সিস বলল।
সকালে খাবার খেয়ে ফ্রান্সিস সমুদ্রতীরে নামবার জন্যে তৈরী হল। সঙ্গে শাঙ্কো আর সিনাত্রাকে নিল। হ্যারি যেতে চাইল। কিন্তু ফ্রান্সিস রাজি হল না। বলল তুমি এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ নও। কী রকম অবস্থায় গিয়ে পড়ব কে জানে। তারপর বলল– রাজা নিকুম্বার দুই প্রহরী রয়েছে জাহাজে। ওদের আসতে বললো। এখানেই ওদের নামিয়ে দেব।
হ্যারি গিয়ে প্রহরী দু’জনকে ডেকে আনল। ওরা পাহাড় জঙ্গল দেখে নামতে সাহস পেল না। একজন বলল–এখানে নামব না। কোন বড় বন্দরে আমাদের নামিয়ে দিও। এখানে কোন বাড়ি ঘরদোর আছে কিনা কে জানে। শেষে কোন বিপদে না পড়ি। এই প্রহরীটি মোটামুটি পোর্তুগীজ ভাষা বলতে পারে।
–বেশ। ফ্রান্সিস বলল–কোন বন্দরেই তোমাদের নামিয়ে দেব।
একটা নৌকা জলে নামানো হল। ফ্রান্সিসরা জাহাজ থেকে দড়ির মধ্যে পা রেখে নৌকায় নেমে এল। ফ্রান্সিস নৌকোয় রাখা বৈঠা তুলে নিল। নৌকো ছেড়ে দিল। ফ্রান্সিস নৌকো বাইতে লাগল। আস্তে আস্তে নৌকো গিয়ে তীরভূমিতে লাগল।
ফ্রান্সিসরা একে একে নেমে এল। নৌকোটা মাটিতে কিছুদূর টেনে এনে রাখল যাতে জোয়ার এলে নৌকোটা ভেসে না যায়।
বালিয়াড়ি ভেঙে চলল সবাই। কিছুদূর গিয়ে দেখল কাছেই কিছু পাথরের ঘর বাড়ি। ডানদিকে বুনো গমের ক্ষেত প্রায় সবুজ পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত। পাশে তামাক পাতার ক্ষেত।
বাড়িগুলোর দিকে যেতে যেতে দেখল বাড়িগুলো ঘিরে কালো কালো লম্বা লম্বা নিষ্পত্র কাঁটাগাছের সারি। জাহাজ থেকে ফ্রান্সিস এই গাছগুলো দেখেছিল। ফ্রান্সিস ভেবে পেল না কী করে এই কাঁটা গাছের বেড়ার মধ্যে দিয়ে ঢুকবে।
বেড়াটার পাশে পাশে ওরা চলল। এক জায়গায় এসে দেখল প্রবেশদ্বার মত। ঐ কাটাগাছের কাটা ছেটে ফেলে লাঠির মত ব্যবহার করা হয়েছে।
ফ্রান্সিস ঘরগুলোর দিকে তাকাল। কিন্তু জনপ্রাণী দেখল না। ও একটু অবাকই হল। এমন সময় একটা ঘরের সামনে বারান্দা মত জায়গায় একজন বৃদ্ধ এসে বসল। হাতে একটা মাটির হাঁড়ি। হাঁড়িটা রেখে তার ভেতর একটা নল মত ঢোকাল। তামাক টানতে লাগল। হাঁ করে ধোঁয়া ওড়াতে লাগল।
-চলো। ঐ লোকটার কাছেই খোঁজ নেওয়া যাক। প্রবেশদ্বারের কাছের ডালগুলো সরিয়ে ওরা ভেতরে ঢুকল। বারান্দায় সেই বৃদ্ধের কাছাকাছি এসেছে হঠাৎ একদল লোক সেই ঘরটা থেকে বেরিয়ে এল। গায়ের রং হলদেটে। বেঁটে। মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা। হাতে ছুঁচোলোমুখ বর্শা। মুখে শব্দ করছে–বুবুবুম্।
ফ্রান্সিস হকচকিয়ে গেল। ফ্রান্সিস পিছন ফিরে বলল– দরজার দিকে পালাও। তখনই কয়েকটা বর্শা ওদের দিকে উড়ে এল। ফ্রান্সিস কোনমতে পাশ কাটাল। কোন বর্শাই ওদের গায়ে লাগল না। শাঙ্কো বলে উঠল–পালাতে গেলে মরব। ফ্রান্সিসও বলল–চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো।
যোদ্ধারা দ্রুত ওদের ঘিরে ফেলল। বর্শাগুলো মাটি থেকে কুড়িয়ে নিল। লোকগুলোর পরনে শুকনো লম্বা ঘাসের ঘাঘরা মত। ওরা ফ্রান্সিসের গায়ে বর্শার খোঁচা দিতে দিতে ঘরটার দিকে যেতে ইঙ্গিত করল।
ফ্রান্সিসরা আস্তে আস্তে পাথরের বারান্দামত জায়গাটায় উঠে এল। যোদ্ধাদের মধ্যে একজন এগিয়ে গিয়ে বৃদ্ধকে কিছু বলল। বৃদ্ধ একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে চিৎকার দিন করে কী বলে উঠল। তারপর ফ্রান্সিসদের আঙুল দেখিয়ে বলে উঠল–পিতালি।
ফ্রান্সিসরা কথাটার কোন অর্থই বুঝতে পারল না। তবে এটুকু বুঝল বৃদ্ধ ওদের সর্দার। সে তাদের অভিযুক্ত করেছে। ফ্রান্সিস পৌতুগীজ ভাষায় বলল–আমরা বিদেশি ভাইকিং। এখানে খোঁজখবর নিতে এসেছি যে আমরা আমাদের দেশ থেকে কতদূরে আছি। বৃদ্ধ এবার ভাঙা ভাঙা পোতুগীজ ভাষায় বলল–না–বন্দী।
–কী করবে? শাঙ্কো মৃদুস্বরে বলল।
–আবার বন্দী দশা মেনে নিতে হবে। ফ্রান্সিসও মৃদুস্বরে বলল। ওদের ঘিরেছিল যারা এবার বর্শা দিয়ে তারা খোঁচা দিয়ে দিয়ে হাঁটতে ইঙ্গিত করল। কয়েকজন যোদ্ধা ওদের বাড়িটার পেছনদিকে নিয়ে চলল। পেছনে আসতে দেখা গেল একটা ঘরের দরজা। সেই শুকনো গাছের। দরজা বুনো শুকনো লতাগাছে বাঁধা। একজন যোদ্ধা গিয়ে লতা খুলল। বর্শার খোঁচা দিয়ে দিয়ে ফ্রান্সিসদের ঢুকিয়ে দেওয়া হল। বাইরের আলো থেকে অন্ধকারঘরে ঢুকে ফ্রান্সিস স্পষ্ট কিছু দেখতে পারছিল না। অন্ধকার একটু সয়ে আসতে দেখল ঘরটা বেশ বড়। ছাদ লম্বা লম্বা শুকানো ঘাসের। তার ওপর পাথর চাপানো। একপাশে একটা মাটির জালায় জল রাখা। ঘরটা বড় দেখেই বুঝল অনেক বন্দী রাখার ব্যবস্থা। এখানে কত জন আর বন্দী হয়।
পাথরের মেঝেয় লম্বা লম্বা শুকনো ঘাস পাতা। ফ্রান্সিস একটুক্ষণ বসে থেকে শুয়ে পড়ল। শাঙ্কো সিনাত্রা বসে পড়ল।
–আবার বন্দী হলাম। শাঙ্কো বলল।
–হ্যাঁ। এবার পালানোর কথাটা ভাবতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–পারবে পালাতে? সিনাত্রা বলল।
–অবশ্য পারব। তবে উপায়টা ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে। সর্দারের হাবভাব যা বুঝলাম এমনিতে আমাদের মুক্তি দেবে না। ফ্রান্সিস বলল। শাঙ্কো বলল–সর্দার আমাদের দেখিয়ে বলল–পিতালি। কথাটার অর্থ কি?
–শত্রু। ফ্রান্সিস বলল।
–আমরা শত্রু হলাম কী করে। শাঙ্কো বলল।
তার মানে এদের শত্রু আছে। বোধহয় আমাদের সেই শত্রুই ভেবেছে। ফ্রান্সিস বলল।
–কিছুই বুঝতে পারছি না। সিনাত্রা বলল।
মনে হয় এরা শত্রুর আক্রমনের আশঙ্কা করছে। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিসের কথা শেষ হতে না হতে দূরের পাহাড়টার দিক থেকে অনেক মানুষের চিৎকার শব্দ ভেসে এল। ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে বুনো গমের ক্ষেত দেখা যাচ্ছিল।
একটু পরেই দেখা গেল সেই গম ক্ষেত মাড়িয়ে বর্শাহাতে একদল যোদ্ধা ছুটে আসছে। এখানকার যোদ্ধারাও ততক্ষণ ধ্বনি তুলেছে–বু-উ-উ-উ-ম্। তারাও বর্শাহাতে লড়াই করার জন্যে তৈরী হল।
গমক্ষেত পার হয়ে ঐযোদ্ধার দল আসতেই এখানকার যোদ্ধার দল ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। গম ক্ষেত তছনছ করে শুরু হল দু’দলের লড়াই। দু’দলই বর্শা দিয়ে লড়াই করছে। তুমুল লড়াই চলল। গমক্ষেত ভরে উঠল আর্তচিৎকার আর গোঙানিতে। পাহাড়ের দিক থেকে আগত যোদ্ধাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা গেল। কাঠের গরাদের ফাঁক দিয়ে লড়াই দেখতে দেখতে ফ্রান্সিস মন্তব্য করল–পাহাড়ের দিক থেকে যারা এসেছে ওরা হেরে যাবে। ওরা সংখ্যায় কম।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। এদিকের যোদ্ধাদের হাঁটে হয় আহত হতে লাগল নয় তো মরতে লাগল। ওরা পিছু হটতে লাগল। কিন্তু যারা বেঁচে রইল গমক্ষেতের দিক দিয়ে পাহাড়ের দিকে পালাতে লাগল। এরা পিছু ধাওয়া করল। আরোও মরল। জীবিতরা কোনরকমে পালাল।
বিজয়ী এরা বর্শা উঁচুতে তুলে ধ্বনি তুলল–বু-উ-উ-উ-ম্। ফ্রান্সিস বলল–থাক –নতুন কারো কাছে আর বন্দী হয়ে থাকতে হবে না। এরা আমাদের নিয়ে কী করে দেখা যাক।
যযাদ্ধারা ফিরে এল। যুদ্ধজয়ের আনন্দে উল্লাস চলল। হ্যারি মৃদুস্বরে বলল–এরা তো জিতল। কিন্তু আমরা যেই তিমিরে সেই তিমিরে। আমাদের কপালে মুক্তি নেই।
–একেবারে হতাশ হয়ো না। একটা না একটা উপায় হবেই। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল।
রাতে প্রহরীরা ফ্রান্সিসদের খেতে দিল। গোল রুটি আর সামুদ্রিক মাছের ঝোলমত। মাছও ভাজা নয় আগুনে পোড়ানো। ফ্রান্সিসরা ক্ষুধার্ত ছিল। পোড়া মাছ রুটি পেট পুরেই খেল।
এদিকে বন্দী শত্রুদের জনা দশেককে নিয়ে আসা হল। সর্দারের হুকুমে তাদের ফ্রান্সিসদের কয়েদ ঘরেই ঢুকিয়ে দেওয়া হল। ওদের খেতেও দেওয়া হল। ঘরটা বড় বলেই ফ্রান্সিসদের খুব একটা অসুবিধা হল না। সবাই কোনরকমে শুতে পারল।
রাত বাড়ল। ফ্রান্সিস তখনও ঘুমোয় নি। পালানোর উপায় ভাবছে। শত্রুদের কয়েকজনকে ফ্রান্সিস কাছে ডাকল। লোকটি এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস দেখল লোকটির মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা নয়। ছড়ানো কাঁধ পর্যন্ত। গালে হলুদ সাদা উল্কি আঁকা। ফ্রান্সিস বলল–তোমরা পিতলি? লোকটি মাথা ওঠানামা করল। ফ্রান্সিস বলল ভাই-সর্দার আমাদের সন্দেহ করেছে তোমাদের সঙ্গে যোগ আছে। অথচ আমরা বিদেশী ভাইকিং। এখানকার কিছুই চিনি না আমরা। লোকটা বোধহয় আন্দাজে কিছু বুঝল। কিছু বললও। ফ্রান্সিস সে কথার কিছুই বুঝল না। তবে এটা বুঝল যে এরা অত্যন্ত ভয়ে কাতর হয়ে পড়েছে। বুঝল না সর্দার এদের নিয়ে কী করবে?
পরদিন ফ্রান্সিস সবে সকালের খাবার খেয়েছে। সর্দার এল। এখন আর সর্দার তামাক টানছে না। কয়েদঘরের দরজার কাছে এসে সর্দার দাঁড়াল। তারপর পিতলিদের দিকে তাকিয়ে বলল–পিতলি। তারপর একনাগাড়ে কিছু বলল। ফ্রান্সিস লক্ষ করল পিতলিদের মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেছে। ও বুঝল পিতলিদের কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে। হয়তো মেরেই ফেলা হবে। তাই কাঠের গরাদের কাছে মুখ নিয়ে বলল
–পিতালিদের নিয়ে কী করবে?
–শাস্তি–হত্যা। সর্দার বলল।
–পিতলিরা আপনাদের শত্রু ঠিকই। তবে বন্দীদের হত্যা করা উচিত নয়। এরা তো অসহায়। ফ্রান্সিস বলল।
সর্দার মাথা নেড়ে বলল-না-হত্যা।
–আমাদের বন্দী করে রেখেছেন কেন? আমাদের মুক্তি দিন। ফ্রান্সিস বলল।
–পিতলির বন্ধু–তোমরা–পরে-হত্যা। সর্দার বলল।
–আমরা বিদেশী। জাহাজ চড়ে এসেছি। পিতলিদের নামও শুনেনি কখনো। বন্ধুত্ব তো দূরের কথা। হ্যারি বলল।
–আদেশ–হত্যা। সর্দার একই ভঙ্গীতে বলল। ফ্রান্সিস বুঝল এই সর্দার কোন অনুরোধই শুনবে না। একরোখা মানুষ। যে কোন সময় ওদের মেরে ফেলতে পারে। তবুও ফ্রান্সিস বোঝাবার চেষ্টা করল। বলল–আমরা বিদেশী। আমাদের হত্যা করে আপনার কী লাভ?
–সিদ্ধান্ত হত্যা। কথাটা বলে সর্দার আর দাঁড়াল না। চলে গেল।
–ফ্রান্সিস–অবস্থা যা বুঝছি এই সর্দার একগুঁযে। আমাদের কোনো কথাই শুনবে না। হয়তো পিতলিদের সঙ্গে আমাদেরও হত্যা করবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে পালানো যায় তার উপায় ভাবো। হ্যারি বলল।
–দেখি। তবে একটু সুলক্ষণ আছে। প্রহরী মাত্র একজন। পালাতে হলে একেবারের চেষ্টাতেই পালাতে হবে। না পারলে বিপদের আশঙ্কা বাড়বে। ফ্রান্সিস বলল।
–সেই চেষ্টাই দেখ।
সেদিন রাতের খাওয়া সেরে ফ্রান্সিস জেগে বসে আছে। নানা চিন্তা মাথায়। ফিরতে দেরি হচ্ছে। মারিয়া বন্ধুরা জাহাজে নিশ্চয়ই দুশ্চিন্তায় পড়েছে। এদিকে পালাবার উপায়ও ভেবে পাচ্ছে না।
কয়েদঘরের কাঠের গরাদের বাইরে তাকাল। ফুটফুটে জ্যোৎস্না পড়েছে গম ক্ষেতে। প্রহরীকে দেখল। একটা বর্শায় ভর দিয়ে সে একটা পাথরের ওপর বসে আছে।
এই সময় শাঙ্কো আস্তে আস্তে ওর কাছে এল। ফিফিস্ করে ডাকল–ফ্রান্সিস? ফ্রান্সিস চোখ বুজে শুয়ে ছিল। চোখ মেলে তাকাল। শাঙ্কো ফিস্ ফিস্ করে বলল। কাঠের গরাদ দেখলাম লোহার মত শক্ত। ওটা কাটতে সময় লাগবে। কিন্তু গরাদে বাঁধা বুনো লতাগাছ কাটা যাবে। ফ্রান্সিস আস্তে উঠে বসল। ফিসফিস করে বলল– পরীক্ষা করে দেখেছো?
–হ্যাঁ। তখন প্রহরীটি খেতে গিয়েছিল। শাঙ্কো বলল।
–কিন্তু একরাতের মধ্যেই কাটতে হবে। পারবে? ফ্রান্সিস বলল।
–পারবো। আমি দুটো লতার বাঁধন কেটেছি। বেশি কাটিনি। খাবার দিতে এসে প্রহরীদের সন্দেহ হতে পারে। শাঙ্কো বলল।
তাহলে কাল রাতে প্রহরীরা খাবার দেওয়ার পর কাজে লেগো। ভোর হওয়ার আগেই পালাতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
পরের দিন। বেশ রাত তখন। ফ্রান্সিস ফিসফিস করে বলল–সজাগ থেকো। ঘুমিয়ে পড়ো না। কিন্তু ঘুমের ভান করে থেকো। পিতালি বন্দীরা ফ্রান্সিসের নির্দেশ বুঝল না। ওরা ঘুমিয়ে পড়ল।
একসময় ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে কাঠের গরাদের কাছে গেল। চাঁদের আলোয় দেখল–প্রহরী একটা পাথরে বসে আছে। হাতের বর্শাটায় ভর রেখে। বোঝাই যাচ্ছে তন্দ্রাচ্ছন্ন। ফ্রান্সিস ফিফিস করে ডাকল–শাঙ্কো।
শাঙ্কো তৈরীই ছিল। ও সঙ্গে সঙ্গে হামাগুড়ি দিয়ে দরজার কাছে গেল। বুকের পোশাকের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ছোরাটা বার করল। তারপর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বুনো লতার বাঁধন কাটাতে লাগল। একটু শব্দ হতে লাগল। কিন্তু তাতে প্রহরীর তন্দ্রাভাব কাটল না। একইভাবে ঝিমুতে লাগল। একটার পর একটা লতার বাঁধন কাটতে লাগল শাঙ্কো। ফ্রান্সিস একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রহরীটির দিকে। প্রহরীটির কোন নড়াচড়া নেই। গমের ক্ষেতের ওপর দিয়ে মুক্ত হাওয়া জোরে বইছে। আরামে প্রহরীটি বেশ তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে।
কাঠের ধাঁচায় বাঁধা চার পাঁচটা কাঠের গরাদ শাঙ্কো খুলে ফেলল। তারপর দ্রুত বেরিয়ে এসে প্রহরীটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। দু’জনেই মাটির ওপর পড়ে গেল। প্রহরীটি কোন শব্দ করার আগে বুনো লতার ফাঁস প্রহরীটির মুখ চেপে বেঁধে দিল। প্রহরীটির মুখ দিয়ে কোঁ কোঁ শব্দ বেরিয়ে আসছিল। শাঙ্কো ওর গালে বিরাশি সিক্কা ওজনের এক চড় কষালো। শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। শাঙ্কো দ্রুত হাত দুটো লতা দিয়ে বেঁধে দিল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বলে উঠল–পালাও। জেগেই ছিল। শাঙ্কোর কথা কানে যেতেই হ্যারি দ্রুত কয়েদঘর থেকে বেরিয়ে এল। ফ্রান্সিস চাপা গলায় বলল–গম ক্ষেত পার হয়ে পাহাড়ের দিকে। ফ্রান্সিসের এই দিক নির্দেশের কারণ ছিল। কারণ সামনের দিকে কাটাগাছের বেড়া। দরজাও ছোট।
সবাই গমক্ষেতের দিকে ছুটল। ওদিকে পিতালির কয়েকজন দেখল কয়েদ ঘরের দরজা খোলা। ফান্সিসরা গমক্ষেত দিয়ে পাথড়ের দিকে ছুটেছে। ওরা অন্য বন্ধুদের ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দিল। তারপর সবাই ফ্রান্সিসদের পিছু পিছু ছুটল।
গমের গাছে ফ্রান্সিসদের বুক পর্যন্ত ঢাকা পড়ে গেছে। ওরা প্রানপণে ছুটছে। পাহাড়টার দিকে। চাঁদের আলোয় চারদিক বেশ ভালোই দেখা যাচ্ছে।
গমের ক্ষেত শেষ। শুরু হল পাথর ছড়ানো মাটি।
সবাই যখন পাহাড়টার নিচে পৌঁছাল তখন ওরা ভীষণ হাঁপাচ্ছে। পিতলিরাও পৌঁছল তখন। ফ্রান্সিস বলল–দাঁড়াও। সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস একজন পিতালিকে জিঞ্জেস করল–সমুদ্র কোন দিকে? সেও হাঁপাচ্ছে তখন। সে মাথা নাড়ল। ফ্রান্সিসের কথাটা বুঝল না। ফ্রান্সিস এবার হাত দিয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের ইঙ্গি ত করল। এবার লোকটা বুঝল। হাত তুলে পূর্বদিক দেখাল। একটা বনভূমির ওপারটা দেখাল।
ফ্রান্সিস বলে উঠল–পূর্বদিকে ছোটো। কিছুটা ছুটে গিয়ে বনভূমিতে ঢুকল। যাহোক গাছের আড়াল পেল। দূরে সর্দারের এলাকা থেকে খুব অস্পষ্ট হৈহল্লার শব্দ ভেসে এল। ফ্রান্সিসরা এখন নিরাপদ।
ঘন বনভূমি। গায়ে গায়ে গাছগাছালির জটলা। সেই গাছ গাছালির মধ্যে দিয়ে ফ্রান্সিসরা ছুটল। ঠিক ছুটতে পারছিল না। পায়ের নিচে মাটি জলে ভেজা। পেছল। সাবধানে গাছের গুঁড়িতে পা রেখে রেখে ছুটতে হচ্ছিল। যে কোনসময় পিছলে পড়ে যাওয়ার সমস্যা। কাজেই ফ্রান্সিসদের ছোটার বেগ কমে আসছিল।
একসময় বনভূমি শেষ। সামনেই সমুদ্র। তখন সূর্য উঠছে। পূব আকাশে কমলা রঙের জোয়ার। সূর্য উঠল। সকালের নরম আলোর মধ্যে দিয়ে সমুদ্রের ধার ঘেঁষে ওরা ছুটল।
মুখ হাঁ করে হাঁপাচ্ছে ওরা। কিছুদূর যেতেই দেখল তীরভূমির কাছে ওদের জাহাজ নোনাঙর করা আছে। তিনজনেই আনন্দে ধ্বনি তুলল–ও–হো–হো। জাহাজ থেকেও ধ্বনি উঠল ও–হো–হো।
নৌকা তীরের বালিয়াড়িতে তোলা। ফ্রান্সিসরা দ্রুতহাতে নৌকা টেনে নিয়ে জলে ভাসাল। ফ্রান্সিস বৈঠা তুলে নিল। নৌকা জাহাজের দিকে চলল। নৌকা জাহাজের গায়ে লাগল। দড়ির মই খোলা হল। ফ্রান্সিসরা একে একে জাহাজে উঠে এল।
তখনই দেখা গেল সেই সর্দারের যোদ্ধারা বর্শা উঁচিয়ে তীরভূমির বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে ফ্রান্সিসদের জাহাজের দিকে ছুটে আসছে।
ওরা সংখ্যায় তিরিশ চল্লিশজন। তীরে জলের কাছে এসে ওরা দাঁড়াল। জাহাজ বেশ কিছুটা দূরে। ওখান থেকেই কয়েকজন বর্শা ছুড়ল। কিন্তু বর্শা গুলো জলে পড়ল। ওরা হতাশ চোখে ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে রইল। শাঙ্কো চেঁচিয়ে বলল– ফ্রান্সিস-লড়াই।
–না। আমরা চলে যাব। তারপর ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–নোঙর তোল। জাহাজ মাঝ সমুদ্রে চালাও। ঘর ঘর শব্দে নোঙর তোলা হল। একবার ঝাঁকুনি খেয়ে জাহাজ চলল মাঝ সমুদ্রের দিকে। হ্যারি বেরিয়ে এল। বলল- এবার কী করবে?
–ডাঙা খুঁজবো। দেখি–কবে ডাঙার দেখা মেলে। তারপর বলল-নজরদার পেড্রোকে ডেকে নিয়ে এসো। পেড্রোকে আনা হল। ফ্রান্সিস বলল-পেড্রো– ভালোভাবে নজর রাখো। ডাঙার দেখা পাও কিনা।
জাহাজ চলল। পেড্রোও মাস্তুলের ওপর থেকে নজর রাখল কোনদিকে ডাঙার দেখা পায় কিনা।
জাহাজ চলেছে। দিন যায় রাত যায়। ডাঙার দেখা নেই। পেড্রো তীক্ষ্ম নজর রেখে চলেছে।
সেদিন গভীর রাত। আমাবস্যার রাত। চারিদিক ঘন অন্ধকার। আকাশে উজ্জ্বল তারার ভিড়। চাঁদও নেই। ক্ষীণ আলোয় যাহোক চারিদিক খুব অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
কেবিনঘরে ডেকএর ওপরেও কয়েকজন ভাইকিং ঘুমিয়ে আছে। সমুদ্রের ফুর ফুরে হাওয়ায় তাদের ঘুম বেশ গভীর। রাতে খাওয়ার পর একটু তন্দ্রা মত এসছিল। সেটা কাটিয়ে উঠলেও রাত একটু বাড়তে পেড্রো নিজের আসনে একেবারে ঘুমিয়ে পড়ল। কিছুতেই জেগে থাকতে পারল না। ফ্রান্সিস ওকে বার বার সাবধান করে দিয়েছে। বিশেষ করে রাতে এবং অন্ধকার রাতে ও যেন বেশি সজাগ থাকে। অন্য কোন জাহাজ বিশেষ করে জলদস্যুদের জাহাজ যেন ওদের জাহাজ দখল করতে না পারে। পেড্রো সেইসব ভুলে গেল সেই রাতেই। কাজেই লক্ষ্য করল না একটা জাহাজ ওদের জাহাজের দিকে দ্রুত আসছে। জাহাজটাও বড় নয়। কাছে আসতেই জাহাজের মাস্তুলের উড়তে থাকা সাদা পতাকা নামিয়ে ফেলা হল। উড়ল কালো পতকা। মাঝখানে মড়ার মাথা আর হাড়ের ঢ্যাঁড়া আঁকা। বোঝাই গেল জলদস্যুদের জাহাজ।
পেড্রো তখন গভীর ঘুমে। ও আর বন্ধুদের সজাগ করতে পারল না। জাহাজটা ফ্রান্সিসদের জাহাজের গায়ে এসে লাগল। ফ্রান্সিসদের জাহাজটা একটু ঝাঁকুনি খেল। কেবিনঘরে কয়েকজনের ঘুম ভেঙে গেল। কিন্তু সমুদ্রের ঢেউ ভেঙে পড়ে জাহাজের গায়ে। তখন একটু ঝাঁকুনি লাগেই। ওরা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল।
একদল জলদস্যু খোলা তরোয়াল হাতে ফ্রান্সিসদের জাহাজের ডেকএ উঠে এল। যারা ডেকএ ঘুমিয়ে ছিল তাদের গায়ে তরোয়ালের খোঁচা দিয়ে ঘুম ভাঙাল। ঘুম ভেঙে ওরা উঠে দেখল খোলা তরোয়াল হাতে জলদস্যুদের দল দাঁড়িয়ে। ওরা ভীত হল। আবার জলদস্যুদের পাল্লায় পড়লাম। আবার জাহাজের কয়েদঘরে বন্দীর জীবন। একজন বলশালী জলদস্যু এগিয়ে এল। স্পেনীয় ভাষায় চাপাগলায় বলল–হুঁ শব্দটি করবে না। এখানেই বসে থাকো।
এবার কিছু জলদস্যু এখানে পাহারায় রইল। বাকিরা সিঁড়ি দিয়ে নিচের কেবিনঘরের দিকে। দু’জন অস্ত্রঘরের সামনে খোলা তরোয়াল হাতে পাহারা দিতে লাগল। বাকিরা কেবিনঘরে ঢুকে ঢুকে তরোয়ালের খোঁচা দিয়ে ভাইকিংদের ঘুম ভাঙাতে লাগল সিনাত্রার একটু আগেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। দরজা দিয়ে জলদস্যুদের ঢুকতে দেখেই ও বিপদ আঁচ করল। ও বিছানা থেকে গড়িয়ে এক কোনায় পড়ল। জলদস্যুরা বন্ধুদের ঘুম ভাঙিয়ে বন্দী করে নিয়ে চলে যেতে সিনাত্রা একটুক্ষণ অপেক্ষা করল। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ কানে আসছে। জলদস্যুদের নজর এড়ানো গেছে।
ও কেবিনঘর থেকে বেরিয়ে ছুটল অস্ত্রঘরের দিকে। অস্ত্রঘরের সামনেই দেখল দু’জন জলদস্যু খোলা তরোয়াল হাতে পাহারাত। এরা জলদস্যু হলেও লড়াইয়ের কায়দা কানুন ভালোই জানে।
সিনাত্রা ফিরে এল। সিঁড়ি দিয়ে ডেকএ উঠে এল। দেখল বন্ধুদের সব ডেকএ বসিয়ে রেখেছে। একজন জলদস্যু ওকে তরোবারি দেখিয়ে বসতে ইঙ্গিত করল। সিনাত্রা কোন আপত্তি না করে বন্ধুদের সঙ্গে বসে পড়ল।
ওদিকে নজরদার পেড্রো মাস্তুলের মাথায় ওর আসনে ঘুমিয়ে ছিল। একজন জলদস্যু সেখান থেকে উঠে পেড্রোর পিঠে তরোয়ালের খোঁচা দিল। ঘুম ভেঙে পেড্রো লাফিয়ে উঠল। বুঝল বিপদ যা হবার হয়ে গেছে। এখন জলদস্যুদের পাল্লায় পড়েছে। ওরা যা বলবে মেনে নিতে হবে। পেড্রো জলদস্যুদের পিছনে মাস্তুলের থেকে নেমে এল। বন্ধুদের সঙ্গে বসে পড়ল।
চারজন জলদস্যু ফ্রান্সিস আর মারিয়ার কেবিনঘরের দরজার কাছে এল। দরজায় ধাক্কা দিল না। ধাক্কা দিলে ভেতরের লোক সাবধান হয়ে যেতে পারে। আস্তে আস্তে দরজায় টোকা দিল। মারিয়ার ঘুম ভেঙে গেল। ও আর ফ্রান্সিসকে ডাকল না। ভাবল হ্যারি এসেছে। মারিয়া দরজা খুলতেই খোলা তরোয়াল হাতে চারজন জলদস্যু লাফিয়ে ঘরে ঢুকল। ফ্রান্সিসের তখন ঘুম ভেঙে গেছে। ও বিছানার তলা থেকে তরোয়াল বের করবে বলে হাত বাড়াল। মারিয়া ছুটে এসে ওর হাত চেপে ধরল। চেঁচিয়ে বললনা। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল।
একজন জলদস্যু তরোয়াল ঘুরিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিস কিছু বলল না। মারিয়ার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে দরজার দিকে চলল। মারিয়াও পেছনে পেছনে চলল। ফ্রান্সিস ভাবল পেড্রোর গাফিলতিতে জলদস্যুদের হাতে বন্দী হতে হল।
ডেক এ উঠে দেখল বন্ধুরা সার বেঁধে বসে আছে। কোন কথা না বলে মারিয়াকে সঙ্গে নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে বসল।
ভোর হল। সমুদ্রে আকাশে জাহাজ দুটোয় রোদ ছড়াল। ফ্রান্সিসের রাত জাগা চোখ জ্বলে উঠল। জাহাজ জলে ভাসতে লাগল। জলদস্যুরা ততক্ষণ দুটো জাহাজের পালই নামিয়ে দিয়েছে। দুটো জাহাজই গায়ে গায়ে লেগে আছে।
হ্যারি ফ্রান্সিসের পাশে এসে বসল। বলল–আবার বন্দী হলাম।
–পেড্রোর নির্বুদ্ধিতা। বন্দী জীবন মেনে নিতেই হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–এদের হাত থেকে পালানো সম্ভব? হ্যারি বলল।
–সব দেখি টেখি। তারপর ভাববো। ফ্রান্সিস বলল।
–এদের সর্দারের সঙ্গে কথা বলতে হবে। হ্যারি বলল।
–হ্যাঁ কথা তো হবেই। জানতে হবে ওরা আমাদের বন্দী করে কী চায়? ফ্রান্সিস বলল।
আরে কী চাইবে। আমাদের কাছে মূল্যবান কিছু আছে কিনা সেসবের খোঁজ করবে। যা পারে লুঠ করবে। হ্যারি বলল।
–সেটাই আটকাতে হবে। অবশ্য মারিয়া সোনার চাকতি গুলো সাবধানেই রেখেছে। মনে হয়না ওরা খুঁজে পাবে। ফ্রান্সিস বলল।
–দেখা যাক। এরা কী করে। হ্যারি বলল।
কয়েকজন জলদস্যু সকালে খাবার নিয়ে এল। কাগজে প্যাচানোপোড়া রুটি আনাজ। খেতে খেতে ফ্রান্সিস একজন জলদস্যুকে জিজ্ঞেস করল তোমাদের সর্দার আসবে না? –সময় হলেই আসবে। জলদস্যুটি বলল।
সকালের খাবার খাওয়া শেষ হল। ফ্রান্সিস জলদস্যুদের সর্দারের জন্যে অধীর আগ আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল। দু’চোখে হাতে চাপা দিয়ে ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল।
কিছু পরে হ্যারির কথা শুনল–ফ্রান্সিস–দেখ–দেখনারী সর্দার। দেখল। জলদস্যুদের জাহাজ থেকে এক নারী জলদস্যু লাফ দিয়ে ওদের ডেক এ উঠে এল। মাথায় সোনালি চুল। গায়ে আঁটোসাটো পুরুষালি পোষাক। নারী জলদস্যুদের কথা ফ্রান্সিসরা শুনছে। কিন্তু কোনদিন চোখে দেখেনি।
দুস্যরানি ফ্রান্সিসদের দিকে এগিয়ে এল। ফ্রান্সিসদের দেখে হাসছে। কী কারণে ফ্রান্সিস বুঝল না। দস্যুরানি ফ্রান্সিসদের সামনে এসে দাঁড়াল। গলা চড়িয়ে বলল– তোমাদের দলপতি কে? ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। বলল–আমি।
–তোমরা তো দেখছি বিদেশি। দস্যুরানি স্পেনীয় ভাষায় বলল।
–হ্যাঁ–আমরা ভাইকিং। ফ্রান্সিস বলল।
–এখানে এসেছ কেন? দস্যুরানি বলল।
–আমরা দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াই। ফ্রান্সিস বলল।
–কেন? দস্যুরানি একটু অবাক হয়েই জানতে চাইল।
–ভালো লাগে তাই। ফ্রান্সিস সহজ ভঙ্গীতে বলল।
মনে হয় তোমাদের এই ঘুরে বেড়ানোর পিছনে কোন উদ্দেশ্য আছে। দস্যুরানি বলল।
–ঠিক উদ্দেশ্য কিছু নেই। তবে একটা কাজ আমরা করি, কোন গুপ্ত ধনসম্পদের খোঁজ পেলে সেটা খুঁজে বার করি। ফ্রান্সিস বলল।
–ও–তাই বলো। তাহলে তোমরা তো যথেষ্ট ধনী। দস্যুরানি একটু ঠাট্টার স্বরেই বলল।
না। কারণ সেই গুপ্তধনের আসল মালিককে আমরা তা দিয়ে দি। ফ্রান্সিস বলল।
বদলে তো কিছু পাও। দস্যুরানি বলল। –
-একটা স্বর্ণমুদ্রাও নিই না। ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল।
–আশ্চর্য! তোমাদের কথায় বিশ্বাস কি? তোমাদের জাহাজ তল্লাশি হবে। দস্যুরানি বলল।
–আমাদের কোন আপত্তি নেই। ফ্রান্সিস বলল।
–আপত্তি হলেও শুনেছে কে? তোমরা তো এখন বন্দী। দস্যুরানি বলল।
–সেটাই জানতে চাইছি? আমাদের বন্দী করা হয়েছে কেন? ফ্রান্সিস বলল।
–পিতুজা বন্দরের নাম শুনেছো? দস্যুরানি বলল।
–না। ফ্রান্সিস মাথা নাড়ল।
–ওখানে প্রতি মাসে ক্রীতদাস কেনাবেচার হাট বসে। দস্যুরানি বলল।
–হ্যাঁ–সেরকম হাট দেখেছি। সে হাটে আমাদের একবার বিক্রি করা হয়েছিল। ফ্রান্সিস বলল।
আমিও তোমাদের বিক্রি করব। যুরোপীয় ক্রীতদাস। ভালো দাম পাব। দস্যুরানি একটু বাঁকা হেসে বলল।
–এটা অন্যায় জুলুম। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল। দস্যুরানি হেসে উঠল। কোন কথা বলল না। এতক্ষণে মারিয়াকে দেখল। দস্যুরানির চোখে মুখে উৎসুক ফুটে উঠল। বলল–এ কে?
–আমাদের দেশের রাজকুমারী। হ্যারি বলল।
–তা এখানে কেন? দস্যুরানি বেশ অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল।
উনি আমাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ান। হ্যারি বলল।
–ব্বা! মজার ব্যাপার। রানি আবার হাসল তারপর আবার গলা চড়িয়ে বলল শোন–আমাদের জাহাজের ডেকএ গিয়ে তোমাদের থাকতে হবে। কড়া পাহারায়। আমাদের জাহাজ ছোট। অত কেবিনঘর নেই। কয়েদঘরও নেই।
রোদ ঝড় বৃষ্টি–শাঙ্কো বলতে গেল। দস্যুরানি ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল হা– তার মধ্যেই থাকতে হবে।
–আমার একটা কথা ছিল। ফ্রান্সিস বলল।
–আমাদের রাজকুমারী অত কষ্ট করে ওখানে থাকতে পারবে না। ফ্রান্সিস বলল।
–থাকতে থাকতে অভ্যেস হয়ে যাবে। দস্যুরানি হেসে বলল।
–না–ফ্রান্সিস চিৎকার করে বলে উঠল–না। উনি আমাদের জাহাজে থাকবেন। চড়া গলায় ফ্রান্সিসের একথা শুনে দস্যুরানি একটু চুপ করে থেকে কী ভেবে বলল বেশ তাই থাকবে। রাজকুমারীকে ফেলে তো তোমরা পালাতে পারবে না। এদিক থেকে এটা ভালোই হবে। কথাটা শেষ করে জলদস্যুদের দিকে তাকিয়ে বলল–এদের আমাদের জাহাজে নিয়ে চল। আমাদের জাহাজের ডেকএ নিয়ে চল্। এরা ওখানেই থাকবে।
দস্যুরানি অদ্ভুত দক্ষতায় ফ্রান্সিসদের জাহাজ থেকে নিজেদের জাহাজের ডেক উঠে গেল। দস্যুরানি চলাফেরায় পুরুষালি ভাব। দেখে হ্যারি মৃদুস্বরে মন্তব্য করল
দেখেছো ফ্রান্সিস চলাফেরায় দস্যুরানি কেমন তৎপর। হ্যারি বলল।
জলদস্যুদের ওপর সর্দারি করা সোজা কাজ নয়। ফ্রান্সিস মন্তব্য করল।
জলদস্যুরা দল বেঁধে এগিয়ে এল। তরোয়াল দেখিয়ে ইশারা করল ওদের জাহাজে ওঠার জন্যে। ফ্রান্সিসরা একে একে জলদস্যুদের জাহাজে উঠতে লাগল।
সিনাত্রা একজন জলদস্যুকে বলল–ভাই–আমি রাজকুমারীকে কেবিনঘরে পৌঁছে দিয়ে আসছি। জলদস্যু মাথা নেড়ে বলল–না।
–আরে ভাই আমি পালাবো না। রাজকুমারীকে পৌঁছে দিয়ে এক্ষুণি উঠে আসছি। সিনাত্রা বলল।
–বেশ যাও। কিন্তু পালাবার চেষ্টা করবো না। জলদস্যু বলল।
–কোথায় পালাবো। এ তো মাঝ সমুদ্র। সিনাত্রা হাত ঘুরিয়ে চারিদিক দেখিয়ে বলল।
–আমাদের দলরানি খুব রাগী। রেগে গেলে সঙ্গে সঙ্গে বুকে ছুরি বসিয়ে দেবে। জলদস্যু বলল।
-না–না। এত তাড়াতাড়ি আমি মরতে রাজি নই। আমি যাব আসবো। সিনাত্রা, বলল। তারপর মারিয়ার কাছে এসে বলল-রাজকুমারী–চলুন আপনাকে আপনার কেবিনঘরে পৌঁছে দিয়ে আসি।
না। আমি তোমাদের সঙ্গেই যাব। মারিয়া বলল।
–পাগলামি করবেন না। ফ্রান্সিস এতে রাজি হবে না। ওই তো আপনাকে আমাদের জাহাজে থাকার ব্যবস্থা করেছে। খোলা ডেক-এ আপনি থাকতে পারবেন না। সিনাত্রা বলল।
–না–ফ্রান্সিসকে ডাকো। মারিয়া বলল। তখন সিনাত্রা চাপা গলায় বলল– অন্য কারণ আছে। মারিয়া সিনাত্রার মুখের দিকে একবার তাকাল। তারপর আর কোন কথা বলল না। সিঁড়ি ঘরের দিকে চলল। পেছনে সিনাত্রা।
নীচে নেমে মারিয়া নিজের কেবিনঘরে ঢুকে গেল। সিনাত্রা দ্রুতপায়ে রান্না ঘরে এল। সেই ঘরের টেবিলে রাখা চকমকি পাথর আর লোহার টুকরোটা নিয়ে কোমরে গুজল। তারপর উপরে ডেকএ উঠে এল। দেখল সেই জলদস্যুটি তরোয়াল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
–দেখ–ভাই ফিরে এসেছি কিনা। সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে পালাই নি। সিনাত্রা বলল। জলদস্যুটি শুকনো হাসল। বলল-রানি ইরিনার হুকুমে জাহাজ মাঝ সমুদ্র দিয়ে যাবে। জলে ঝাঁপিয়ে পড়লেও ডাঙ্গা খুঁজে পাবে না। হাঙরের মুখে পড়ে জীবন শেষ হবে। এবার আমাদের জাহাজে চলো।
সিনাত্রা আর কোন কথা বলল না। শান্তভাবে জলদস্যুদের জাহাজে উঠে এল। বন্ধুরা সব ডেকএ বসে আছে। সিনাত্রা এবার একজন জলদস্যুর কাছে গেল–বলল–ভাই বন্দী তো হয়েছি। তার মানে একঘেয়ে জীবন। দুটো কাঠের টুকরো দিতে পারো?
কাঠের টুকরো কী করবে? জলদস্যুটি জানতে চাইল।
–কাঠ ঠুকে ঠুকে একটু গান বাজনা করব। সিনাত্রা বলল।
যত সব পাগলামি। জলদস্যুটি বলল।
–বেশ পাগলামি না হয় হল। কাঠের টুকরো দাও। সিনাত্রা বলল।
–এখন পাহারা দিচ্ছি। এখন পারব না। সন্ধ্যেবেলায় নতুন জলদস্যু আসবে তখন দেবো। জলদস্যুটি বলল।
–বেশ তাই দিও। দেবে কিন্তু। জাহাজে তো কাঠের অভাব নেই। সিনাত্রা বলল।
–হা-হা দেবো। জলদস্যুটি ঘাড় নেড়ে বলল।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হল। সিনাত্রা সাগ্রহে বসে আছে কখন জলদস্যুটি কাঠের টুকরো নিয়ে আসে। জলদস্যুটি কথা রাখল। দুটো কাঠের টুকরো এনে দিল। সিনাত্রা কাঠের টুকরো পেয়ে খুব খুশি। ফ্রান্সিস হ্যারি অবাক। সিনাত্রা কাঠের টুকরো নিয়ে পর কী করবে? হ্যারি বিস্ময় চাপতে না পেরে বলল–এই দুটো কাঠের টুকরো নিয়ে কী করবে?
–গান বাজনা করবো। সিনাত্রা হেসে বলল।
–গান বাজনা? তোমাকে তো কোনদিন গান গাইতে দেখিনি। হ্যারি বলল।
–আনন্দ-আনন্দ। ওটাই আসল। সুর গলায় থাকুক না থাকুক। এই এক ঘেয়ে বন্দী জীবন তো কাটাতে হবে। সিনাত্রা একই ভাবে হেসে বলল।
রাতের খাওয়া শেষ হল। কম পোড়া রুটি আর সামুদ্রিক মাছের ঝোল। খাওয়া সেরে অনেকেই শুয়ে পড়ল।
সিনাত্রা কাঠের টুকরো টক্ টক্ শব্দ বাজিয়ে গান ধরল। ওদের দেশের সমুদ্রের তীরের জেলেপাড়া থেকে জেলেরা নৌকা চড়ে মাছ ধরতে যায় যখন তখন যে গলায় গায় সেই গান। সুন্দর সুরেলা গলায় সিনাত্রা গান গাইতে লাগল। তালে তালে টক টক্ শব্দে কাঠের টুকরো বাজাতে লাগল। ফ্রান্সিস আর বন্ধুরা অবাক। সিনাত্রা এত সুন্দর গান করে? সিনাত্রা এত ভালো গান গায় ওরা কোনদিনও জানতে পারেনি। সিনাত্রা গান গেয়ে চলে। মাতৃভূমির গান। বন্ধুদের অনেকের চোখেই জল দেখা দিল। সিনাত্রা আপন মনে গেয়ে চলেছে তখন।
রাত বাড়ে। সিনাত্রা নতুন গান ধরে। ওর চোখে ঘুম নেই। জলদস্যু পাহারাদাররাও ওর গান শোনে। ওদেরও ভালো লাগে।
গভীর রাত পর্যন্ত সিনাত্রা গান গাইল। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল।
সিনাত্রা প্রতি রাতেই অনেকক্ষণ পর্যন্ত গান করে। বন্ধুদের ভালো লাগে। কেউ আপত্তি করে না। সিনাত্রা সারা জাহাজ ঘুরে ঘুরে গান করে। পাহারাদাররাও আপত্তি করে না।
একরাতে মাস্তুলের মাথায় উঠে গেল। নজরদারদের জায়গায় বসে গান গাইল। আর একদিন পাল খাটানোর কাঠের কাঠামোর ওপর বসে গান গাইল। সেই কাঠের টক্ টক শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গান। এই ভাবে জাহাজের যেখানে সেখানে বসে সিনাত্রা গান গায় আর টক্ টক্ শব্দে কাঠ বাজায় তালে তালে।
জাহাজ চলছে। ফ্রান্সিসের চিন্তা। পিতুজা বন্দর কতদূর? ওদের ভাগ্যেই বা কী আছে।
দুদিন দস্যুরানি এসেও সিনাত্রার গান শুনল। শুনে বোধহয় খুশি হল। কিছু বলল না।
টক্ টক্ শব্দ আর গানের সঙ্গে জলদস্যুরা অভ্যস্ত হয়ে গেল।
একদিন গভীর রাতে পাল খাটাবার কাঠের কাঠামোয় বসে গান গাওয়া শেষ করে সিনাত্রা ফ্রান্সিসের কাছে এল। ফ্রান্সিস তখনও ঘুমোয়নি। গান শুনছিল আর ভাবছিল কী ভাবে এই বন্দী দশা থেকে পালানো যায়। ফ্রান্সিসকে একটু ঠেলে জিজ্ঞেস করল –আমার গান কেমন লাগছে। ফ্রান্সিস একটু হেসে বলল- খুব ভালো। তুমি এত ভালো গান কর এতদিন জানতাম না। একদিন মারিয়াকে গান শুনিয়ে এসো। এক ঘেয়ে জীবন ওর ভাল লাগবে।
নিশ্চয়ই শোনাবো। তারপর চারিদিকে তাকাল। দেখল দু’জন পাহারাদার ডেক-এর কোনায় বসে আছে। ও ফিস্ ফিস্ করে বলল–ফ্রান্সিস আমার টক্ টক্ শব্দটা বোধহয় তোমাদের কানে সয়ে এসেছে।
–হ্যাঁ-হ্যাঁ। ফ্রান্সিস ঘাড় নাড়ল।
–তাহলে পাহাদারদের কানেও সয়ে গেছে। সিনাত্রা বলল।
–হ্যাঁ-হ্যাঁ। ফ্রান্সিস হেসে বলল।
–যদি চমকি পাথর ঠুকে আগুন জ্বালাতে পারি? সিনাত্রা বলল।
–পাথর লোহা পাবে কোথায়? ফান্সিস বলল।
–আমার কোমরে গোঁজা। সিনাত্রা বলল।
ফ্রান্সিস দ্রুত উঠে বসল। আগের মতই ফি ফিস করে বলল–কিন্তু শব্দ হবে যে।
কাঠের টুকরোর শব্দই ভাববে পাহারাদারেরা। সিনাত্রা বলল।
–তাই তুমি কাঠের শব্দ করে গান গাও। ফ্রান্সিস একটু অবাক হয়েই বলল।
–হ্যাঁ। আগেই সব ভেবে এই শব্দ করছি। সিনাত্রা বলল। ফ্রান্সিস চাপা উল্লাসে বলে উঠল–সবাস সিনাত্রা। তাহলে দেরি নয়। কাল রাতেই আগুন লাগাও। এখন গাঢ় অন্ধকার রাত চলছে।
পরেদিন রাতের খাবার খেয়ে সবাই ডেক এর এখানে ওখানে শুয়ে বসে রইল। ফ্রান্সিস চাপা স্বরে ডাকল–হ্যারি। হ্যারি এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলল রাত গভীর হলেই সিনাত্রা জাহাজের পালে আগুন লাগাবে।
–বলল কি? ও পারবে? হ্যারি চমকে উঠে বলল।
-হা পারবে। চমকি পাথর লোহা ওর কাছে আছে। পাহারাদাররা ভাববে কাঠের টুকরোর শব্দ। ওরা শব্দের পার্থক্য ধরতে পারবে না। ফ্রান্সিস বলল।
-সাবাস্ সিনাত্রা। হ্যারি চাপাস্বরে উল্লাস প্রকাশ করল।
এবার সবাইকে গিয়ে বলল সবাই যেন জেগে থাকে। পালে আগুন লাগলে সবাই যেন জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সাঁতরে আমাদের জাহাজে ওঠে। তারপর শাঙ্কো যেন জলদস্যুদের জাহাজের সঙ্গে বাঁধা দড়িটা কেটে দেয়। তারমধ্যে সবাই যেন অস্ত্রঘর থেকে তরোয়াল নিয়ে এসে ডেকএ দাঁড়িয়ে পড়ে। জলদস্যুরা আগুন নেভাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়বে। তবু যদি আমাদের জাহাজে দল বেঁধে উঠে আসেলড়াই হবে। যাও সবাইকে বলো। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে নির্দেশ দিল।
হ্যারি আস্তে আস্তে ডেকএর ওপরে গড়িয়ে গড়িয়ে এক এক বন্ধুর কাছে গেল। চাপাস্বরে বলে এল–এই জাহাজের পালে আগুন লাগবে। সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমাদের জাহাজে গিয়ে উঠবে। সবাই ঘুমিয়ে থাকার ভান করবে। কিন্তু ঘুমুবে না কেউ।
বন্ধুরা সবাই পালাবার জন্যে তৈরী হল।
রাতের খাওয়া সেরে সবাই শুয়ে পড়ল। রাত গভীর হল। সেই তারার অস্পষ্ট আলো চারদিকে।
— রাত একটু গম্ভীর হল। তখন অন্ধকার রাত। আকাশে উজ্জ্বল তারার মেলা। সেই তারার অস্পষ্ট আলো চারদিকে।
রাত আরো একটু গম্ভীর হল। সিনাত্রা যথারীতি কাঠের টুকরো টক্ টক্ বাজিয়ে গান গেয়ে চলল। ডেক বসে কিছুক্ষণ গাইল। তারপর পালের কাঠের কাঠামোয় উঠে গাইতে লাগল। পাহারাদাররা জানে সিনাত্রা কখনও ডেকএ বসে কখনও হালের কাছে গিয়ে কখনও মাস্তুলের মাথায় কখনও পালখাটাবার কাঠের কাঠামোয় বসে গান গায়। এই রাতেও দেখল পালখাটাবার কাঠের কাঠামোতে বসে গান গাইছে। গান শুনতে শুনতে তিনজন পাহারাদার জলদস্যু ঝিমুতে লাগল। সিনাত্রার গান শুনতে ওদের ভালোই লাগে।
এবার সিনাত্রা কোমরে গোঁজা চমকি পাথর বের করল। চকমকি পাথরে লোহার টুকরো ঠুকে গান গাইতে লাগল। টক্ টক্ শব্দ চলল। পাহারাদাররা শব্দের পার্থক্য বুঝতে পারল না। সিনাত্রা গাইতে লাগল–
সাগরে চলো ভাই।
সাগর আমাদের মা।
অন্য কেউ নাই
চলো সাগরে যাই।
পালের গায়ে চকমকি পাথর ঠেকিয়ে লোহার টুকরো ঠুকতে লাগল তালে তালে ঠক্ ঠক্।
আগুনের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠে পালে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে আগুন লেগে গেল। সিনাত্রা দ্রুত ক্রমকি ঠুকে আরোও দুটো পালে আগুন লাগাল। তিনটে পালেই আগুন লেগে গেল। সমুদ্রের জোর হাওয়ায় তিনটে পালই দাউ দাউ করে জ্বলে– উঠল। মুহূর্তে অন্য পালগুলোতেও আগুন ছড়াল।
আগুন দেখে তিন পাহারাদার জলদস্যু ছুটে এল। ওরা বুঝে উঠতে পারল না কী করে আগুন লাগল। ভাইকিংরা ততক্ষণে উঠে পড়েছে। ফ্রান্সিস চিৎকার করে বলল–পালাও। তার আগেই সিনাত্রা চমকি পাথর কোমরে গুঁজে অন্ধকার সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে শাঙ্কো ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। দু’জনেই সাঁতরে চলল নিজেদের জাহাজের দিকে।
পাহারাদারদের চিৎকার চেঁচামেচিতে কিছু জলদস্যু ডেক উঠে এল। সমুদ্র থেকে জল তুলে আগুনে ছিটতে লাগল। কিন্তু আগুন নিভল না। বরং আগুন লেগে গেল কাঠের কাঠামোয়। ওরা ফ্রান্সিসদের বাধা দেবে কি আগুন নেভেতেই হিমসিম খাচ্ছে।
দস্যুরানি ইরিনাও ডেক উঠে এল। দেখল ডেক ফঁকা। একজন বন্দীও নেই। মাথার ওপর পালগুলো পুড়ে ছাই। কাঠামোর কাঠ জ্বলছে। মাস্তুলের দড়িতে আগুন লেগেছে। আগুনের আভায় চারিদিক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ইরিনা চেঁচিয়ে বলল ওদের জাহাজ আক্রমন কর। কাউকে পালাতে দিবি না। কয়েকজন জলদস্যু বলল, আগে আমাদের জাহাজতো আগুনের হাত থেকে বাঁচাই। পরে দেখা যাবে। ইরিনা। এবার বুঝল–এখন লড়াই করতে গেলে সমস্ত জাহাজটাই পুড়ে যাবে। সব জলদস্যু ডেক উঠে এল। সমুদ্র থেকে জল তুলে জল ছিটানোচলল। কিন্তু সবটা আগুন নিভল না। বরং মাস্তুলেও আগুন লেগে গেল।
ওদিকে শাঙ্কো আর সিনাত্রা দড়ি দড়া ধরে নিজেদের জাহাজে উঠে পড়েছে। শাঙ্কো এক ছুটে জাহাজের মাথার কাছে এসে গেল। দেখল জলদস্যুদের জাহাজ থেকে আগুনের ফুলকি ওদের জাহাজেও উড়ে আসছে। এক্ষুণি জাহাজটা সরিয়ে না আনলে ওদের জাহাজের পালেও আগুন লাগতে পারে। ও-ছুটে জলদস্যুর জাহাজের সঙ্গে বাঁধা দড়ির কাছে এল। জামার তলা থেকে ছোরা বের করল। দ্রুত দড়ি কাটতে লাগল। সিনাত্রা শাঙ্কোর কাছে এল। শাঙ্কো দড়ি কাটতে কাটতে বলল–তরোয়াল নিয়ে এসো জলদস্যুরা আক্রমন করতে এলে লড়তে হবে। সিনাত্রা দ্রুত ছুটল অস্ত্রাগারের দিকে। দু’জনেই হাপাচ্ছে তখন।
দড়ি কেটে গেল। ফ্রান্সিসদের জাহাজ যেন একটা ধাক্কা খেয়ে বেশ দূরে সরে এল। এবার নিশ্চিন্ত। আগুনের ফুলকি থেকে আগুন লাগার কোন সম্ভবনা রইল না।
ততক্ষণে ফ্রান্সিসরা ওদের জাহাজে উঠে এসেছে। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল– দাঁড় ঘরে যাও। পাল তুলে দাও। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দূরে চলে যেতে হবে। জনা কয়েক ভাইকিং বন্ধু দাঁড়ঘরে চলে গেল। কয়েকজন পাল খাটাবার কাঠামোতে উঠে পড়ল। পাল খুলে দিল। পালে জোর হাওয়া লাগল। ওদের জাহাজ বেশ দূরে চলে এল। তখনও জলদস্যুদের জ্বলন্ত জাহাজটা দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে আর দেখা গেল না। তখন পূব আকাশে কমলা রং ছড়িয়ে সূর্য উঠল। ফ্রান্সিস স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল।
মারিয়ার ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো। ডেকএ অনেক মানুষের পায়ের শব্দ শুনে ডেক এ উঠে এল। দেখল বন্ধুরা ডেক-এ ছোটাছুটি করছে। যাক-ওরা অক্ষত ফিরে এসছে।
ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল–কী করে পালালে?
জলদস্যুদের জাহাজে আগুন লাগিয়ে। ঐ দেখো। ফ্রান্সিস হেসে বলল। মারিয়া দূরে জলদস্যুদের জলন্ত জাহাজটা দেখল। বলল–আগুন লাগালে কী করে?
–সিনাত্রার বুদ্ধি। ফ্রান্সিস বলল। তারপর ঘটনাটা বলল।
–তাহলে সিনাত্রাই তোমাদের বাঁচিয়েছে বলো। মারিয়া হেসে বলল।
–ঠিক তাই। ফ্রান্সিস হেসে বলল।
ফ্রান্সিসদের জাহাজ চলল। চারিদিকে অনন্ত জলরাশি। ডাঙার দেখা নেই।
নজরদার পেড্রো মাস্তুলের ওপর নিজের জায়গায় উঠতে যাবে ফ্রান্সিস এগিয়ে এল। বলল–পেড্রো–আর আমাদের বিপদ বাড়িও না। বিশেষ করে রাতে ঘুমিয়ে পড়ো না। দিনে তো আমরা চারিদিক দেখি টেখি। বিপদ হয় রাতে। তখন তোমার নজরই আমাদের ভরসা। দয়া করে একটু সজাগ থেকো। পেড্রো মাথা নিচু করে বলল–আর ভুল হবে না।
–দেখ–যতটা সাবধান থাকা যায়। এবার নিজের জায়গায় যাও। ফ্রান্সিস বলল। পেড্রো মাস্তুলের দড়ি ধরে ধরে উঠতে লাগল।
ফ্রান্সিসদের জাহাজ চলতে লাগল। জাহাজ চালক ফ্লেজার আন্দাজে জাহাজ চালাচ্ছে। জাহাজ কোথায় চলছে কেউ জানে না। চারিদিকে জল। বোঝার উপায় নেই।
দিন যায়। রাত যায়। ফ্রান্সিসদের জাহাজ চলছে। এর মধ্যে ঝড় হয়েছিল। কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় নি। ভাইকিংরা সাহসের সঙ্গে ঝড়ের মোকাবিলা করল।
ফ্রান্সিসদের জাহাজ চলেছে। কুলকিনারহীন সমুদ্র। ফ্রান্সিস মাঝে মাঝেই জাহাজচালক ফ্লেজারের কাছে আসে। জানতে চায় ফ্লেজার দিক্ ঠিক রাখতে পারছে কিনা। ফ্লেজার বলে–কতটা আন্দাজেই চালাচ্ছি। কবে কখন ডাঙার দেখা মিলবে কে জানে।
ফ্রান্সিস চিন্তায় পড়ে। এ কোথায় চলেছি? ভাইকিং বন্ধুদের মনেও প্রশ্ন কতদূর কোথায় চলেছি আমরা? শুধু হ্যারি ফ্রান্সিসকে সান্ত্বনা দেয় কিছু ভেবো না। ডাঙার দেখা পাবো। ফ্রান্সিস কিছু বলে না। বোঝে বন্ধুরা যদি জানে যে ও অধৈর্য হয়ে পড়েছে তাহলে ওদের মনও ভেঙে যাবে। তাই বন্ধুরা এসব নিয়ে ওকে প্রশ্ন করলে। ফ্রান্সিস বলে–ধৈর্য হারিও না। জাহাজে খাদ্য আর জলের অভাব পড়ে নি। আরও কিছুদিনের নামে আমরা নিশ্চিন্ত। তোমাদের তো সমুদ্রযাত্রার আগেই বলেছি–নানা সমস্যায় পড়তে পারি। তার মধ্যেই আমাদের অভিযান চালাতে হবে।
মারিয়াও দিনে দিনে অধৈর্য হয়ে উঠছে। বলে–আর নয়। এবার দেশে ফিরে চলো।
–না। অভিযান চলবে। অতটা ভেঙে পড়ো না। একেবারে হতাশ হয়ে পড়ার কিছু ঘটেনি। ফ্রান্সিস বলল।
ঘটেনি কিন্তু ঘটতে কতক্ষণ। মারিয়া রাগ করে বলে।
–তাহলে এক কাজ করি। সামনে যে বন্দর পাবো সেখানে অসহিষ্ণু বন্ধুর সঙ্গে তুমিও নেমে যাও। জাহাজ জোগাড় করে দেব। দেশে চলে যাও। কথাটা শুনে মারিয়াও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ফ্রান্সিস মারিয়ার পিঠে হাত রেখে বলল–কান্নাকাটি করে আমার মন দূর্বল করে দিও না। মারিয়ার কান্না থামল। চুপ করে রইল। কোন কথা বলল না।
ওদিকে নজরদার পেড্রো শুধু সকালে কয়েক ঘন্টা ঘুমোয়। সারারাত মাস্তুলের মাথায় বসে নজর রাখে। ডাঙার দেখা পেতেই হবে।
সেদিন দুপুরে পেড্রো পশ্চিমদিকে একটা পাহাড় মত দেখল। চিৎকার করে বলে উঠল–ভাইসব–পশ্চিমদিকে–ডাঙা।
কেবিনঘরে ডেকএ শুয়ে থাকা ভাইকিং বন্ধুরা ছুটে জাহাজের রেলিঙের ধারে এসে জড়ো হল। সবাই পশ্চিমদিকে তাকিয়ে পাহাড় দেখল। ফ্রান্সিস মারিয়াকে নিয়ে ডেক-এ উঠে এল। সবুজ পাহাড় দেখল। ফ্লেজারের কাছে এল। বলল–ওদিকেই জাহাজ চালাও। নেমে দেখবো কোথায় এলাম। বন্দর নয়। তবে এখানে জাহাজ। নোঙর করা আছে। জাহাজটায় লোক নেই দেখল।
ফ্লেজার হুইল ঘোরাল। জাহাজ আস্তে আস্তে তীরভূমির কাছে এল। কিন্তু তীরের কাছে জল গভীর নয় বলে ফ্লেজার জাহাজ ভেড়াতে পারল না।
হ্যারি ফ্রান্সিসের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।
বলল–ফ্রান্সিস কী করবে?
–এটা বড় বন্দর নয়। তবে কিছু ঘরদোর আছে দেখছি। শুকনো পাতাঘাস ছাওয়া বাড়ি। তীরে কিছু মাছধরার নৌকা দেখছি। তার মানে জেলেদের বসতি। ওদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তবেই জানতে পারবো যে এটা কোন দ্বীপ না দেশের অংশ। ফ্রান্সিস বলল।
–এখনই খোঁজখবর করতে যাবে? হ্যারি জানতে চাইল।
-হ্যাঁ। বেশি দেরি করা চলবে না। শাঙ্কো আর সিনাত্রাকে ডাকো। ফ্রান্সিস বলল। হ্যারি ওদেরকে ডেকে আনল। ফ্রান্সিস বলল–তোমরা তৈরী হয়ে এসো। তরোয়াল নিও না।
–তীরে নামবে? শাঙ্কো জানতে চাইল।
–হ্যাঁ। আমি তৈরী হয়ে আসছি। ফ্রান্সিস চলে গেল। তিনজন তৈরি হয়ে দড়ির মই বেঁধে একটা নৌকায় নামল। জাহাজের গা থেকে দড়ির বাঁধন খুলে ফ্রান্সিস নৌকা ভাসাল। ও দাঁড় বাইতে লাগল।
আস্তে আস্তে নৌকা তীরে ভিড়ল। নৌকাটা তীরের বালিয়াড়িতে তুলতে তুলতে ফ্রান্সিস বলল–বাড়িগুলোয় কোন লোকজন দেখছিনা। কোথায় গেল সব?
নৌকা রেখে তিনজন বাড়িগুলোর দিকে চলল। বাড়িগুলোর কাছে এসে দেখল বাড়িগুলোর দরজা গাছের ডাল কেটে তৈরী। দরজা বন্ধ। জনমানব শূন্য ফ্রান্সিস। একটু অবাকই হল। বন্ধ দরজায় দরজায় ঘুরতে ঘুরতে একটা ঘরের দরজা খোলা দেখল। ফ্রান্সিস ভেতরে উঁকি দিল। দেখল দুটো বাচ্চা কোলে নিয়ে একটা বুড়ি বসে আছে। পরনে মোটা কাপড়ের ময়লা পোশাক। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–এই জায়গার নাম কী? বুড়ি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। বুঝল– বুড়ি হয় কালা নয়তো ওর কথা বুঝতেই পারেনি।
অন্য ঘরগুলোর দিকে গেল ওরা। আর একটা ঘরের দরজা খোলা। ফ্রান্সিস বলল–শাঙ্কো দেখোত। শাঙ্কো ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। দেখল একজন বৃদ্ধ। পরনে মোটা কাপড়ের পোশাক। বৃদ্ধ একটা বাচ্চা ছেলে কোলে নিয়ে বসে আছে। আর একটা বাচ্চা মেয়ে মেঝেয় বালির ওপর খেলা করছে।
শাঙ্কো বৃদ্ধটির সামনে গেল। জোরে বলল–এই জায়গার নাম কী? বৃদ্ধ চুপ। এবার ফ্রান্সিস এগিয়ে এল। বেশ গলা চড়িয়ে বার কয়েক বলল–এই জায়গার নাম কী? এবার যেন বৃদ্ধটি বুঝল। ভাঙা স্পেনীয় ভাষায় বলল–তিয়েরা।
–এখানকার রাজাকে? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল। বৃদ্ধ চুপ। ফ্রান্সিস অঙ্গভঙ্গী করে রাজা বোঝাল। এবার বৃদ্ধটি শ্লেষ্মাজড়িত গলায় বলল–রাজা–, আসারিয়া।
–এখানকার লোকেরা কোথায়? সিনাত্রা জিজ্ঞেস করল? এবার কয়েকবার প্রশ্নটা করতে হল। বৃদ্ধটি আঙ্গুল তুলে সবুজ পাহাড়ের দিকটা দেখাল। বলল– তিয়েরা–মেলা। ফ্রান্সিস শাঙ্কোদের দিকে তাকাল। বলল–ঐ পাহাড়ের দিকেই বোধহয় রাজধানী তিয়েরা। ওখানে মেলাটেলা চলছে। সবাই সেই মেলাতে গেছে।
কী করবে? শাঙ্কো বলল।
–চলো-আমরাও মেলায় যাব। ফ্রান্সিস বলল।
–আবার না কয়েদ ঘরে ঢুকতে হয়। শাঙ্কো বলল।
-সেই সমস্যা তো আছেই। কিন্তু সবাই তো ঐ মেলাতেই গেছে। ওখানে না গেলে জানবো কী করে কোথায় এলাম। ফ্রান্সিস বলল।
–কিন্তু রাস্তা কোথায়? সিনাত্রা বলল।
–এখানকার লোকেরা যখন গেছে তখন রাস্তামত নিশ্চয়ই কিছু আছে। দেরি করো না। চল। ফ্রান্সিস বলল।
তিনজনে ঘরের বাইরে এল। বাড়িঘর ছাড়িয়ে আসতেই দেখল সেই পাহাড়ের দিকে একটা বালিভর্তি রাস্তা চলে গেছে। ফ্রান্সিস বলল–পাহাড়ের নিচে দেখ। ঘন বন। এরা ওখান থেকে গাছপালা এনে এখানে বাড়িঘর তৈরী করেছে। এই রাস্তায় ওদের যাতায়াত আছে। সত্যি বালিয়াড়িতে একটা রাস্তামত দেখা গেল। তিনজন পাহাড় বন জঙ্গলের দিকে চলল।
বেশ কিছুদূর যেতেই দূর থেকে লোকজনের কোলাহল শোনা গেল। কাছাকাছি আসতে বাড়িঘর দেখা গেল। কিছু বাড়িঘর পাথরের। তার মধ্যে একটা বড় পাথরের লম্বাটে বাড়ি দেখা গেল। শাঙ্কো বলল–ঐ বাড়িটা বোধহয় রাজবাড়ি। ওরকম বাড়ি আর একটাও দেখা যাচ্ছে না।
বাড়িগুলোর কাছাকাছি আসতে দেখল জায়গাটার মাঝখানে একটা বড় বট গাছ। নিচেটা পাথর দিয়ে বাঁধানো। ওটাকে ঘিরে ভিড়। বটগাছের বিরাট ঝুড়ি নেমেছে। জায়গাটা প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে এই বিকেলেই। গাছের সামনে একটা পাথরের বড় বেদী। বেদীটাকে ঘিরে মানুষের ভিড়। বটগাছের গায়ে একটা পাথরের দেবমূর্তি গাঁথা। গাছের নিচে পাতা ফুল ছড়ানো। বোধহয় দেবপূজা চলছে। একজন পুরোহিত দেবী মূর্তির সামনে বসে আছে। মোটা কাপড়ের পোশাক পরা নারী পুরুষ বেদী ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। উচ্চস্বরে কী বলছে। একজন একটা ফাঁপা কাটাগাছের কান্ডে কাঠের ডান্ডা দিয়ে ঘা মারছে। বুম্ বুম্ শব্দ হচ্ছে।
এতক্ষণে ফ্রান্সিসরা লক্ষ্য করল জনতার একপাশে একদল সৈন্য দাঁড়িয়ে আছে। ঢোলা হাতা মোটা হলদে কাপড়ের পোশাক পরা। কোমরে সাদা কাপড়ের ফেট্টি। তাতে তরোয়াল ঝোলানো। ওদের মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল।
ফ্রান্সিসরা বেদীর কাছাকাছি যেতেই ওদের ওপর সৈন্যদের নজর পড়ল। শাঙ্কো বলল–ফ্রান্সিস সৈন্যরা–বোধহয় বিপদে পড়লাম।
একজন লম্বা মত সৈন্য ফ্রান্সিসের কাছে এগিয়ে এল। বোঝা গেল সে সৈন্যদের এই– দলপতি। ফ্রান্সিসদের সে স্পেনীয় ভাষায় জিজ্ঞেস করল–তোমরা কে?
–আমরা বিদেশী ভাইকিং। ফ্রান্সিস বলল?
–এখানে কী করে এলে? দলপতি জিজ্ঞেস করল।
জাহাজে চড়ে। ফ্রান্সিস বলল।
–এখানে এসেছো কেন? দলপতি প্রশ্ন করল।
–এই মেলা উৎসবে যোগ দিতে। আর একটি কারণ আছে। এখানে জানতে এসেছি এই রাজত্বের নাম আর রাজার নাম। ফ্রান্সিস বলল।
–কেন? দলপতি জানতে চাইল।
–এখনও সবকিছু জানতে পারিনি। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমরা যে সবুজ রাজার চর নও তার প্রমান কী? দলপতি বলল।
–সবুজ রাজার নাম আমরা জীবনে শুনি নি। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। তোমাদের কথা বিশ্বাস করলাম। আমাদের রাজা আসারিয়ার কাছে চলো। উনি জ্ঞানী পুরুষ অনেক ভাষা জানেন। হয়তো তোমাদের সাহায্য করতে পারবেন। যদি জানা যায় যে তোমরা সবুজ রাজার চর তাহলে রাজার সামনেই তোমাদের মেরে ফেলা হবে। দলপতি চলল।
–বেশ। আমরা নির্ভয়। কারণ চরবৃত্তির মত হীন কাজ আমরা করি না। ফ্রান্সিস বলল।
–আচ্ছা। এসো আমাদের সঙ্গে। দলপতি বলল। এই বলে দলপতি রাজবাড়ির দিকে চলল। দলপতির পেছনে পেছনে ফ্রান্সিসরা রাজবাড়ির সামনে এল। পাথরের বাড়ি। পাথরের গায়ে কুঁদে কুঁদে ফুল লতাপাতার নকশা।
দরজার সামনে খোলা তরোয়াল হাতে দু’জন প্রহরী। সর্দারকে দেখে মাথা একটু নুইয়ে দরজা খুলে দিল। ওরা অবাক হয়ে দেখল ফ্রান্সিসদের। এরা কোথা থেকে এল? ফ্রান্সিস একটা কথা বুঝল–এই সর্দারই সেনাপতির সন্মান পাচ্ছে।
একটা ঘরে ঢুকল সবাই। মাঝখানে একটা কালো পাথরের টেবিল মতো। চারপাশে পাথরের আসন। একটা শুধু কাঠের হাতলওয়ালা আসন। বোধহয় রাজা আসারিয়ার আসন। এটা বোধহয় রাজার মন্ত্রণাকক্ষ। সেনাপতি রাজ বাড়ির অন্দরে চলে গেল। একটু পরেই ফিরে এল। আস্তে বলল–রাজা আসারিয়া আসছেন।
ফ্রান্সিসরা অপেক্ষা করতে লাগল।
কিছুক্ষণ পরে রাজা আসারিয়া ঘরে ঢুকল। ফ্রান্সিসরা উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাল। রাজা হাতলওয়ালা আসনে বসলেন। ফ্রান্সিসদের ব্যবহারে খুশি হলেন। রাজা প্রায় ফ্রান্সিসের সমবাসী। রাজার মুখে অল্প কালো দাড়ি গোঁফ। বেশ বুদ্ধিদীপ্ত চোখ মুখ। পরনে হলুদ পাতলা কাপড়ের পোশাক। বললেন-বসো। ফ্রান্সিসরা বসল। রাজা বলল–তোমাদের কথা শুনলাম। য়ুরোপ এখান থেকে বেশ দূর। যদি দিনরাত জাহাজ চালাও তবুও চারমাস আগে য়ুরোপ পৌঁছাতে পারবে না।
–আমরা কোনদিকে যাবো? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–উত্তর পূর্ব মুখে। রাজা বললেন।
আপনার পরামর্শের জন্যে ধন্যবাদ। ফ্রান্সিস বলল।
–আমাদের তিয়েরা রাজ্য কেমন দেখলে? রাজা একটু হেসে বললেন।
–মাত্র এসেছি। সব কিছু তো দেখিনি। শাঙ্কো বলল।
–আজ রাতে এখানে সূর্য দেবের পূজোর উৎসব। দুদিন চলবে। তোমরা দেখে। যেতে পারো। রাজা বললেন।
-হ্যাঁ। সন্ধে হয়ে এল। কোন সরাইখানায় থাকবো ভাবছি। ফ্রান্সিস বলল।
–তা কেন? তোমরা আমার অতিথিআবাসে থাকবে। পূজো দেখবে উৎসব। দেখবে। ইচ্ছে করলে কালও থাকতে পারো। ফ্রান্সিস অবাক হয়ে গেল। বেশির ভাগ রাজাই তো ওদের ধরে কয়েদঘরে ঢুকিয়েছে। এই রাজা আসারিয়া অন্য রকম মনে হচ্ছে।
–আপনার আমন্ত্রন আমরা নিশ্চয়ই রাখবো। ফ্রান্সিস বলল।
–আমি খুশি হলাম। তোমাদের জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা করতাম। কিন্তু একটা ব্যাপার নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি। রাজা বললেন।
–যদি কিছু না মনে করেন মানে–কারণটা জানতে পারি? ফ্রান্সিস বলল।
নিশ্চয়ই। আমার রাজত্বের পশ্চিমদিকে সবুজ রাজার রাজত্ব। রাজা বললেন।
সবুজ রাজা? ফ্রান্সিস কথাটার অর্থ বুঝতে পারল না।
উনি নিজে আর তার সৈন্যরা সবুজ পোশাক পরে। আর আমরা হলুদ পোশাক পরি। রাজা বললেন।
-ও। সবুজ রাজা বোধহয় আপনার শত্রুপক্ষ। ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–হ্যাঁ। রাজা মাথা ওঠানামা করলেন।
–তবু তাকে সম্মান দিয়ে আপনি কথা বললেন। ফ্রান্সিস বলল।
–শত্রুপক্ষ হলেও তিনি রাজা। তার সম্মান প্রাপ্য। রাজা বললেন।
ফ্রান্সিস এবারও একটু অবাক হল।
যাক গে। তোমরা থাকবে উৎসব দেখবে। রাজা বললেন।
নিশ্চয়ই থাকবো। ফ্রান্সিস বলল।
এবার রাজা আসারিয়া সেনাপতির দিকে তাকালেন। বললেন–এদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করুন। রাজা চলে গেলেন।
সেনাপতি ফ্রান্সিসদের পেছনে আসতে ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিসরা চলল।
বাইরে এসে পাশের একটা ঘরে ঢুকল সবাই। এই ঘরটাও পাথরের। দেয়াল কুঁদে নকশা আঁকা। ঘরের মধ্যে মেঝেয় ঢালাও শুকনো ঘাসপাতার বিছানা। ওপরে মোটা কাপড়ের পরিষ্কার ঢাকা।
–এটাই অতিথি ঘর। অতিথি যাতে খুশিমত বাইরে বেরোতে পারেন তার জন্যে এই ঘরের কোন দরজা নেই। একটা পাথরের পাটা আছে শুধু। রাতের উৎসবে বটগাছের নিচে ঐ বেদীতে নাচগান হবে। আপনারা অবশ্যই দেখবেন। সেনাপতি বললেন।
ফ্রান্সিসরা কিছু বলল না।
–একজন রক্ষী রেখে যাচ্ছি। ওকে যা বলবেন ও তাই করবে। আপনাদের সুবিধে অসুবিধের কথাও ওকেই বলবেন। সেনাপতি বলল। তারপর চলে গেল।
একটু পরে একজন রক্ষী এল। কিন্তু তার হাতে বর্শা তরোয়াল কিছু নেই। ফ্রান্সিস হেসে বলল–শাঙ্কো, এই প্রথম বোধহয় কোন প্রহরী ছাড়া ঘরে থাকছি। বরাবর তো তরোয়াল-বর্শা উঁচিয়ে রাখা প্রহরীদেরই দরজার সামনে দেখেছি। শাঙ্কোও হেসে বলল–তা যা বলেছো। এত আদর-যত্ন আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল। ফ্রান্সিস আর। কিছু বলল না। বিছানায় বসে পড়ল। তারপর শুয়ে পড়ল। জোরে শ্বাস ছেড়ে বলল-একটু আরাম করে নেওয়া যাক। দেখাদেখি শাঙ্কোও শুয়ে পড়ল। শুধু সিনেত্রা শুয়ে পড়ল না। বসে রইল। রক্ষী ঘর দুটোয় মশাল জ্বেলে দিয়ে গেল। তারপর ঘরের কোনা থেকে একটা বড় মাটির হাঁড়িতে জল ভরে নিয়ে এল। কাঠের একটা গ্লাস রাখাই ছিল। ফ্রান্সিস উঠে গিয়ে জল খেয়ে এল।
রাত হল। বাইরে বটতলায় বোধহয় নাচগানের আসর বসার তোড়জোড় চলছে। লোকজনের হৈ-হট্টগোল এখন অনেকটা কম।
ফ্রান্সিসরা রাতের খাবার একটু আগেই খেয়ে নিল। রক্ষীটিই খাবার এনে দিল। বেশ মোটা গোল রুটি। একটু পোড়া হলেও খেতে ভালো। সামুদ্রিক মাছের ঝোল আর কী সব সজির ঝোল। খুবই সুস্বাদু খাবার। ফ্রান্সিসরা পেট পুরে খেল।
এবার নাচগানের আসরে যাওয়া।
ফ্রান্সিসরা তৈরি হয়ে ঘরের বাইরে এল। রক্ষী ওদের আসরের দিকে নিয়ে চলল।
বেদী ঘিরে অনেক লোক জড়ো হয়েছে। বেশি হৈ-চৈ হচ্ছে না। সবাই গভীর আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখা গেল বেদীর সামনেই দুটো কাঠের আসনে রাজা আসারিয়া ও রানি বসে আছেন।
ফ্রান্সিসরা একপাশে দাঁড়াল। তখনই দেখল পশ্চিমমুখো রাস্তার দুপাশে রাজার সৈন্যরা দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের আলো উজ্জ্বল। সেই আলোয় দেখল সেনাপতি ওখানে পায়চারী করছে। ফ্রান্সিস বুঝল এসব আত্মরক্ষার আয়োজন কেন। সবুজ রাজার দেশ ওদিকেই। শত্রুরাজা যে কোন সময় আক্রমণ করতে পারে। তাই অতন্দ্র পাহারার ব্যবস্থা। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে শাঙ্কো আর সিনাত্রাকে বলল সেকথা। সিনাত্রা বলল–যদি আক্রমণ হয় আর সবুজ রাজা জিতে যায় তাহলে আমাদের। কপালে ভোগান্তি আছে। শাঙ্কোও মাথা নেড়ে কথাটা সমর্থন করল।
অল্পক্ষণের মধ্যেই বুম্-বুম্ শব্দে সেই ফঁপা গাছের কান্ডটা বাজানো শুরু হল। রাজা আসারিয়া হাত তুলে ইঙ্গিত করলেন। একদল যুবক-যুবতী বেদীর ওপরে উঠে এল। রংদার পোশাক পরেছে সবাই। হাতে রুমাল। রুমাল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাচ, সুরেলা গলার গান। কিছু সময়ের মধ্যে নাচগান জমে গেল। দর্শকদের মধ্যে হর্ষ-উল্লাস। নাচগান চলল।
একটু সময়ের জন্যে নাচগান থামল। আবার বুমবুম বাদ্যি। আবার নাচগান শুরু হল। ফ্রান্সিসদের ভালোই লাগছিল।
ফ্রান্সিস বলল–সিনাত্রা তুমিও এই আসরে একটা গান গাও।
–পাগল হয়েছে। এরা আমার গানের কী বুঝবে? সিনাত্রা হেসে বলল।
–গান বোঝার দরকার নেই। সুরই ভালো লাগবে সবারই। শাঙ্কো বলল।
–না-না। সিনাত্রা মাথা নাড়ল।
–আসলে আমার ইচ্ছে রাজাকে খুশি করা। এই আসরে তোমার গান একটা বৈচিত্র্য আনবে। আমি অনুরোধ করছি তুমি এখানে একটা গান গাও। ফ্রান্সিস বলল।
–কিন্তু সিনাত্রা বলতে গিয়ে থামল।
–আমি ব্যবস্থা করছি। শাঙ্কো কী বল? ফ্রান্সিস বলল।
নিশ্চয়ই গাইবে। এত ভাল গায় ও। জানতামই না। শাঙ্কো বলল।
ফ্রান্সিস রক্ষীকে বলল–রাজা আসারিয়াকে গিয়ে বলো যে একজন ভাইকিং গান গাইতে চায়। উনি যেন অনুমতি দেন। রক্ষীটি চলে গেল কিছু পরে একজন লোককে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এল। লোকটার পোশাক-টোশাক দেখে বোঝা গেল লোকটি মাতব্বর গোছের কেউ। লোকটি হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এল। বললে–কে গান গাইবেন? আসুন। রাজার হুকুম। ফ্রান্সিস সিনাত্রাকে এগিয়ে দিল। সিনাত্রা আর আপত্তি করল না। বেদীর দিকে এগিয়ে গেল মাতব্বরের সঙ্গে।
নাচগান থামতে মাতব্বরটি বেদীতে উঠে এল। চেঁচিয়ে বলল–একজন বিদেশী ভাইকিং এখানে এসেছে। সে একটি গান গাইবে। মাতব্বরটি দেশীয় ভাষায় বলল ফ্রান্সিস আন্দাজে বুঝল।
সিনাত্রা মঞ্চে উঠল। তারপর গান শুরু করল–
সাগরে চলো ভাই
সাগর আমাদের মা
অন্য কেউ নাই
চলো সাগর যাই।
মুহূর্তে গান জমে উঠল। কেউই গানের মানে বুঝল না। কিন্তু সুর আর সিনাত্রার সুন্দর গলা শুনে শ্রোতারা মুগ্ধ হল। গান শেষ হল। শ্রোতাদের মধ্যে হর্ষ ধ্বনি শোনা গেল। আবার যদি গাইতে বলে এই ভেবে সিনাত্রা দ্রুত বেদী থেকে নেমে এল।
রাজা আসারিয়া ইশারায় সিনাত্রাকে কাছে ডাকল। সিনাত্রা এগিয়ে গেল। রাজা সিনাত্রার পিঠ চাপড়ালেন। রানিও হেসে কিছু বললেন। ফ্রান্সিস বুঝল সিনাত্রার গান শুনে দু’জনে খুশি হয়েছেন। সিনাত্রা ফ্রান্সিসদের কাছে এসে দাঁড়াল।
আবার বাদ্যি বেজে উঠল। এবার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নানারঙের পোশাক পরে বেদীতে উঠে নাচতে গাইতে লাগল। আসর জমে উঠল।
হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে দিয়ে সেনাপতি রাজারানির আসনের কাছে এল। রাজা রানিকে কিছু বলল। রাজা রানি দ্রুত রাজবাড়ির দিকে চলে গেলেন। ফ্রান্সিসরা বুঝল নিশ্চয়ই কোন বিপদ ঘটেছে।
সেই মাতব্বরটি ততক্ষণে মঞ্চে উঠে এসে নাচ গান থামিয়ে দিল। চিৎকার করে বলে উঠল–সাবধান–সবুজ রাজা আমাদের দেশ অক্রমন করেছে। সবাই যে যার বাড়ির দিকে যাও।
দর্শকদের মধ্যে চিৎকার চাঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। সবাই যে যার বাড়ির দিকে। ছুটল। বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হল। কিছু দর্শক ভিড়ের চাপে মাটিতে পড়ে গেল। আহত হল। ফ্রান্সিস বলল–লড়াই শুরু হবে। চলো অতিথি শালায় ফিরে যাই।
অতিথিশালায় ওরা ফিরে আসছে তখনই চাঁদের আলোয় দেখল পশ্চিমদিকের রাস্তায় লড়াই শুরু হয়েছে। তরোয়ালের ঠোকাঠুকি আর্তনাদ গোঙানি শোনা যাচ্ছে।
ফ্রান্সিসরা অতিথিশালায় ঢুকল। হ্যারিও ওদের পেছনে পেছনে গেল। বিছানায় বসতে বসতে শাঙ্কো বলল–ফ্রান্সিস এখন কী করবে?
–এখনই বাইরের রাস্তায় গেলে বিপদে পড়বো। যা বুঝতে পারছি এখন বটতলার কাছাকাছি লড়াই চলছে। নিরস্ত্র অবস্থায় ওদিকে গেলে মারা যেতে পারি। এখানেই অপেক্ষা করি। দেখি লড়াইয়ে কারা জেতে। ফ্রান্সিস বলল।
বাইরে তুমুল লড়াই চলছে তখন। ফ্রান্সিসরা চুপ করে বসে রইল। বাইরে চিৎকার আর্তনাদ গোঙানি চলল।
প্রায় ঘন্টাখানেক লড়াই চলল। আস্তে আস্তে চারিদিক শান্ত হয়ে এল। দ্বারী ঘরে ঢুকে একটু দূরে বসে ছিল। ফ্রান্সিসরা দ্বারীকে বলল–দেখ তো ভাই লড়াই থামল কিনা। দ্বারী দরজার কাছে গেল। চারিদিক ভালো করে দেখে ফিরে এল। মাথা নেড়ে বলল–আমরা হেরে গেছি। সবুজ রাজার সৈন্যরা দুটো বাড়িতে আগুন লাগিয়েছে। তখন সত্যি মানুষদের ভয়ার্ত চিৎকার ছোটাছুটির শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
তুমি ভাই পালিয়ে যাও। ফ্রান্সিস বলল।
–না। সেনাপতি আপনাদের দেখাশুনোর জন্যে রেখে গেছেন। আমি হুকুম মানবো। ফ্রান্সিস আর কিছুই বলল না। ফ্রান্সিসরা ঘুমের আশা ছাড়ল। তিনজনে সারারাত জেগে রইল।
তখন রাত শেষ হয়ে এসেছে। চারদিক শান্ত। তার মধ্যে মাঝে মাঝে সবুজ রাজার সৈন্যদের জয়ধ্বনি শোনা যাচ্ছে।
ভোর হল। হঠাৎ বাইরে পদশব্দ শোনা গেল। ফ্রান্সিস ভাবল–আবার বন্দী জীবন শুরু হবে। হয়তো সবুজ রাজার সৈন্যরা আসছে। ফ্রান্সিসের অনুমানই ঠিক হল। রাজা আসারিয়া ঘরে ঢুকলেন। পেছনে পাঁচজন খোলা তরোয়াল হাতে সবুজ পোশাক পরা সবুজ রাজার সৈন্য। রাজাকে ওরা ঠেলে ঘরে ঢুকিয়ে দিল। তারপর দু’জন যোদ্ধা খোলা তরোয়াল হাতে দরজার সামনে দাঁড়াল। একজন যোদ্ধা ফ্রান্সিসদের দেখে একটু অবাকই হল। বলল–তোমরা কে?
–আমরা বিদেশী ভাইকিং। সিনাত্রা বলল।
–ঠিক আছে। সকালে তোমাদের রাজার কাছে নিয়ে যাওয়া হবে।
–বেশ। সিনাত্রা বলল। যোদ্ধাটি চলে গেল।
ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। বলল–মান্যবর রাজা আপনি এখানে বসুন। রাজা দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসল। রাজারমুখ শুকনো। মাথার চুল উসূকোখুসকো। বোঝাই যাচ্ছে সারারাত ঘুমোন নি। ফ্রান্সিস বলল–আপনি ভাল আছেন তো?
–শরীর ঠিক আছে। কিন্তু হেরে গেলাম। মন ভালো নেই। রাজা বললেন।
–রানি কোথায়? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
—অন্দর মহলে—নজর বন্দী। রাজা বললেন।
–সেনাপতি? ফ্রান্সিস বলল।
–জীবিত সৈন্যদের নিয়ে আমি তাকে পালাতে বলেছি। আমি আর রক্তপাত চাইনি। রাজা বললেন।
–কিন্তু এই অতিথিশালায় আপনাকে বন্দী করল কেন? শাঙ্কো বলল। রাজা ম্লান হেসে বললেন–আমার রাজত্বে কয়েদঘর নেই। আমি মানুষের সততায় বিশ্বাস করি। ফ্রান্সিস রাজার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ করল। এমন একজন উদার মনের মানুষ আজ অসহায়।
–আপনি হেরে গেলন কেন? ফ্রান্সিস বলল।
–আমার সৈন্যরা শেষ পর্যন্ত লড়াই করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি আর মৃত্যু চাইনি। ওদের হার স্বীকার করতে বলেছি। আর বলেছি সেনাপতির সঙ্গে পালিয়ে যাও। সবুজ রাজাকে তো জানি। ওঁর মতো নৃশংস রাজা কাউকে বেঁচে থাকতে দিতে পারেন না। এই নিয়ে সবুজ রাজা চারবার আমার রাজত্ব আক্রমন করল। আমার বীর সৈন্যদের কাছে তিনবার হেরে ফিরে গেছেন। এবার আর ফেরাতে পারলাম না। একটু থেমে রাজা বলতে লাগলেন–আমার সৈন্য সংখ্যা কম ছিল। গতবছর এখানে অনাবৃষ্টি হয়ে গেছে। আমার অনেক বীর সৈন্য মারা গেছে। আসার সময় সমুদ্রতীরে একটা জাহাজ বোধহয় দেখেছো।
–হ্যাঁ। কিন্তু তাতে কোন লোক ছিল না। ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ। জাহাজটা ওখানকার জেলেরাই দেখাশোনা করে। এই জাহাজে করে বিদেশ থেকে খাদ্য আনিয়েছিলাম। তাতে সবাইকে বাঁচাতে পারিনি। শুনলে অবাক হবে সবুজ রাজার দেশেও দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। তিনি তাঁর বহু প্রজাকে আমার রাজত্বে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। আমি সেই ক্ষুধার্ত প্রজাদের ঠেলে ঐ রাজত্বে পাঠিয়ে দিইনি। বরং ওদের আশ্রয় দিয়েছি–খাদ্য দিয়েছি। একটু থেমে বললেন–ঐ যে বললাম আমার অনেক বীর সৈন্য সেই-দুভিক্ষে মারা গিয়েছিল। সবুজ রাজা জানতেন সেটা। বুদ্ধি করে তাই এবার আমাদের দেশ আক্রমন করলেন। কম সৈন্য নিয়ে লড়াই করে এবার আমরা হেরে গেলাম। আমার সৈন্যরা প্রানপণ লড়াই করেছে। আমি ওদের লড়াই চালাতে দিইনি। রাজা থামলেন।
বাকি সৈন্যদের নিয়ে সেনাপতি কোথায় গেছেন? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করলেন।
–ঐ উত্তরের পাহাড়ের দিকে। ঐদিকে কোথাও আশ্রয় নিয়েছে বোধহয়। রাজা বললেন।
–ঠিকআছে। ওখানে যাবো। সেনাপতি আর সৈন্যদের খুঁজে বার করব। ফ্রান্সিস বলল।
কিন্তু এখান থেকে পালাবে কী করে? রাজা বললেন।
–এখান থেকে অনেক কঠিন পাহারার মোকাবিলা করেছি আমরা আর পালিয়েছি। এই ঘরের তো দরজাই নেই। ফ্রান্সিস বলল।
–দেখো চেষ্টা করে। রাজা একটু হতাশার সুরেই বললেন।
–আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন আপনাকে মুক্ত করবই। ফ্রান্সিস বলল।
রাজা আসারিয়া আর কিছু বললেন না।
সকালের খাবার দিয়ে গেল প্রহরীর একজন। রুটি আর আনাজপাতির ঝোল। এটা রাজার খাদ্য নয়। বন্দীর খাদ্য। কিন্তু রাজা নিঃশব্দে খেলেন। অন্য খাবার চাইলেন না।
একটু পরে একজন বেশ মোটা লোক এল। তার কোমরে তরোয়াল ঝুলছে। গায়ে সবুজ ঢোলা হাতা জামা। প্রহরীরা একটু মাথা নুইয়ে সম্মান জানাল। বোঝা গেল লোকটি সেনাপতি।
ঘরে ঢুকে সেনাপতি, বলল–সবাই চলুন। রাজ দরবারে।
রাজাকে নিয়ে ফ্রান্সিসের ঘরে থেকে বেরিয়ে এল। প্রহরীদের পাহারায় রাজবাড়ির সামনে এল সবাই। বড় দরজাটা দিয়ে ঢুকল। দুটো ঘর পেরিয়ে রাজসভাকক্ষ। দুটো কাঠের আসন পাতা। তাতে গাঢ় লাল রঙের মোটা কাপড় পাতা। আসনে সবুজ রাজা বসা। দুপাশের আসনের একটায় সেনাপতি গিয়ে বসল। অন্যটা একজন বৃদ্ধ বসে। তিনি বোধহয় মন্ত্রী। সবুজ রাজার ঝকঝকে সবুজ রাজপোশাক। সন্দেহ নেই। কাপড়টা বেশ দামি। একটু ভারি গলায় রাজা বলল–এসো–আমাদের প্রিয় বন্ধু রাজা আসারিয়া। রাজা আসারিয়া কোন কথা বললেন না। চুপ করে দাঁড়ালেন। সবুজ রাজা তাকে বসতেও দিল না।
সবুজ রাজা মন্ত্রীর দিকে তাকাল। বলল–মন্ত্রী মশাই বলুন তো রাজা আসারিয়া কী শাস্তি দেওয়া যায়।
–ফাঁসি দিন। মন্ত্রী মৃদু স্বরে বলল।
–ওটা তো অল্পক্ষণের শাস্তি। আমি চাই একটু কষ্ট ভোগ করে মরুক। বেশ তরোয়াল দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বর্শা দিয়ে শরীরটা এফেঁড় ওফোঁড় করে কথাটা শেষ না করে সবুজ রাজা হা হা করে হেসে উঠল। ফ্রান্সিস ভাবল রাজা আসারিয়া ঠিকই বলেছিলেন সবুজ রাজা নৃশংস। রাজা আসারিয়া কোন কথা বললেন না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
যাক গে–যে কথা বলছিলাম। তোমার এক পূর্বপুরুষ রাজা সামেনা জলদস্যু ছিল। তাই কিনা? সবুজ রাজা বলল।
–হ্যাঁ। উনি আমাদের বংশের কলঙ্ক। রাজা বললেন।
সে যাক। কিন্তু জলদস্যুতা করে প্রচুর ধনসম্পদের মালিক হয়েছিল। জনশ্রুতি বলে সে এই রাজ্যেরই পাতালঘরে তার ধন সম্পদ গোপনে সে রেখে গেছে। সবুজ রাজা বলল।
-হ্যাঁ আমরাও শুনেছি। রাজা আসারিয়া বলল।
–সেই ধনসম্পদ কোথায় আছে? সবুজ রাজা প্রশ্ন করলেন।
–আমি জানি না। রাজা আসারিয়া বললেন।
–তুমি খোঁজখবর করনি? সবুজ রাজা জানতে চাইল।
–না। প্রয়োজন মনে করিনি। রাজা বললেন।
–কেন? সবুজ রাজা একটু ক্রুদ্ধ হয়েই বলল।
-ওটা অভিশাপ্ত ধনসম্পদ। নিরীহ জাহাজযাত্রীদের জাহাজ লুঠ করে আনা ধন সম্পদের প্রতি আমার কোন লোভ নেই। রাজা আসারিয়া দৃঢ়স্বরে বললেন।
কিন্তু আমার আছে। তোমার রাজত্ব এই জন্যেই বারবারজয় করার চেষ্টা করেছি। এবার জয়ী হয়েছি। এখন এই রাজ্য আমার। আমি এখন এই রাজ্যের রাজা। তোমার সিংহাসনে বসেআছি। আমি সেই গুপ্ত ধনসম্পদউদ্ধার করতে চাই। সবুজ রাজা বলল।
-বেশ। চেষ্টা করুন। রাজা আসারিয়া বললেন।
–কিন্তু তোমার সাহায্য চাই। সবুজ রাজা বলল।
–আমি আপনাকে কীভাবে সাহায্য করব? কারণ আমি সেই ধনসম্পদ সম্বন্ধে নিজেই কিছু জানি না। রাজা আসারিয়া বললেন।
–অসম্ভব। নিশ্চয়ই জানো। সবুজ রাজা গলায় জোর দিয়ে বলল।
বললাম তো জানি না। শুধু জানি একটা পাতাল ঘর আছে।
–কোথায় সেই পাতাল ঘর? সবুজ রাজা প্রশ্ন ছুঁড়ল।
–আমি কিছুই জানি না। রাজা আসারিয়া মাথা নেড়ে বললেন।
তুমি আমার কাছে সত্য কথাটা সুকোচ্ছো।
তরোয়াল আর বর্শার খোঁচা খেলে সব সত্যি কথা বেরিয়ে আসবে। সবুজ রাজা বলল।
রাজা আসারিয়া কোন কথা বললেন। সবুজ রাজা সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠল–এখনও সত্যি কথাটা বলল।
এখন তো এই রাজ্য আপনার। সন্ধান করুন সেই গুপ্ত ধন ভান্ডারের। সবুজ রাজা আবার চেঁচিয়ে বলে উঠল-হা হা। সারা রাজ্য আমি তোলপাড় করে ফেলবো। ঐ ধনভান্ডার আমার চাই।
শাঙ্কো চাপা গলায় বলল–ফ্রান্সিস চেষ্টা করবে? ফ্রান্সিস বলল–এই জঘন্য চরিত্রের লোকটার জন্য আমি এক আঙ্গুলও নাড়বো না। জাহান্নামে যাক। ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো দেশীয় ভাষায় কথা বলছিল। সবুজ রাজা এবার ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে বলল–কী বলাবলি করছিলে তোমরা?
-বলছিলাম–আপনি মহান রাজা। ফ্রান্সিস বলল।
-রসিকতা? সবুজ রাজা হো হো করে হেসে উঠল। হঠাৎ মুখ গম্ভীর করে বলল –জানো–এই মূহুর্তে তোমার মুণ্ডু নামিয়ে দিতে পারি।
–আমি নিরস্ত্র। কাজেই–ফ্রান্সিস আর কথাটা শেষ করল না।
–যদি তোমাকে তরোয়াল দেওয়া হয়। সবুজ রাজা বলল।
–তাহলে মুণ্ডু বাঁচাবার শেষ চেষ্টা করতাম। ফ্রান্সিস বলল। শাঙ্কো মৃদুস্বরে ডাকল–ফ্রান্সিস। কিন্তু ফ্রান্সিস সবুজ রাজাকে সহ্য করতে পারছিল না। এবার সবুজ রাজা বলল–তোমরা বিদেশী?
–হ্যাঁ–আমরা ভাইকিং। শাঙ্কো বলল।
–এখানে কী করে এলে? সবুজ জিজ্ঞেস করল।
জাহাজে চড়ে। ফ্রান্সিস বলল।
–শুনেছি তোমরা সমুদ্রে জলদসুতা কর। সবুজ রাজা বলল।
–একথাটা অনেক জায়গায় অনেকবার শুনেছি আমরা। কথাটা গায়ে মাখি না। শাঙ্কো বলল।
–তোমাদের ফাঁসিতে লটকালে কেমন হবে? সবুজ রাজা একটু হেসে বলল।
–আপনি জয়ী রাজা। আমাদের নিয়ে যা খুশি করতে পারেন। কিন্তু জানতে চাইছি আমরা কী অপরাধে অপরাধী? ফ্রান্সিস বলল।
রাজা আসারিয়ার হয়ে আমার সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই করেছো তোমরা। সবুজ রাজা বলল।
–আমরা অতিথিশালায় ছিলাম। একমুহূর্তের জন্যেও ঘর ছেড়ে বেরোয় নি। ফ্রান্সিস বলল।
মিথ্যে কথা। সবুজ রাজা গলায় জোর দিয়ে বলল।
–আপনার সেনাপতিকে জিজ্ঞেস করুন। উনি আমাদের লড়াইয়ের সময় দেখেছেন কিনা। ফান্সিস বলল। সবুজ রাজা সেনাপতির দিকে তাকাল। সেনাপতি উঠে দাঁড়িয়ে বললনা মান্যবর রাজা–আমি ওদের লড়াই করতে দেখিনি।
যাকগে–তোমাদের কালকেই ফাঁসি দেওয়া হবে।
কারণটা জানতে চাইছি। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল।
-তোমাদের সাহস তো কম নয়। আমার মুখের ওপর কথা বলছো। বেশ গলা চড়িয়ে রাজা বলল। শাঙ্কো আবার মৃদুস্বরে ডাকল–ফ্রান্সিস। ফ্রান্সিস চুপ করে রইল। এবার রাজা সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল রাজা আসারিয়া আর এই তিন জনকে হত্যার আদেশ দিলাম।
–রানির প্রতি কী সাজা হল? রাজা আসারিয়া বললেন।
–রানি অন্তঃপুরে বন্দিনী হয়ে থাকবে। কথাটা বলে রাজা গট গট করে চলে গেল।
চার পাঁচজন সৈন্য এগিয়ে এল। ফ্রান্সিসদের পাহারা দিয়ে অতিথিশালায় নিয়ে এল। ঘরের বাইরে দু’জন প্রহরী দাঁড়াল। ঘরে ঢুকে ফ্রান্সিস দেখল রক্ষী শুয়ে গোঙাচ্ছে। শাঙ্কো ওর কাছে এল। বলল–কী হয়েছে তোমার?
–পালিয়ে ছিলাম। কিন্তু সবুজ রাজার সৈন্যদের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিলাম। আমাকে মেরেছে। তবে একেবারে মেরে ফেলেনি। রক্ষী আস্তে আস্তে গোঙাতে লাগল। রাজা আর ফ্রান্সিসরা বিছানায় বসল।
–কী দেখলে বাইরে? শাঙ্কো জানতে চাইল।
সাংঘাতিক ব্যাপার। সবুজ রাজার সৈন্যদের অত্যাচার চরমে উঠছে। স্ত্রীলোক শিশুরা–কেউ বাদ যাচ্ছে না। নির্বিবাদে সবাইকে হত্যা করছে। যারা কোনরকম বেঁচেছে তারা উত্তরে জঙ্গলে পালিয়ে গেছে। সবুজ রাজার সৈন্যরা এখন হত্যা করার জন্যে মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে। কপাল জোরে আমি ছুটে পালিয়ে এসেছি। রক্ষী বলল।
সবুজ রাজার মত ওর সৈন্যরাও নৃশংস। রাজা আসারিয়া মৃদুস্বরে বললেন। শাঙ্কো ভাবল সুযোগ পেলে এই প্রহরীদের হত্যা করবে।
ফাঁসির কথা শুনে সিনাত্রা খুবই ভেঙে পড়ল। একটু কাঁদো কাদো গলায় বলল ফ্রান্সিস– আমাদের বাঁচার কোন উপায় নেই।
–কিছু ভেবো না। অত হতাশ হয়ে পড়লে কোন কাজই হয় না। শাঙ্কো বলল।
–আমরা ফাঁসির হাত থেকে বাঁচবো? সিনাত্রার কণ্ঠে সংশয়।
-শোন সিনাত্রা–ফ্রান্সিস বলল–মনে জোর রাখো। শুধু শরীরের জোরে সব কাজ হয় না। পালানোর ছক আমার কষা হয়ে গেছে। শুধু নরহত্যা আমি চাই না। সেটাই করতে হবে। বাধ্য হয়ে। রাজা আসারিয়া ফ্রান্সিসের কথা শুনলেন। আস্তে বললেন–তাহলে আমরা বাঁচবো?
–হ্যাঁ মান্যবর রাজা। ঠিক সময়ের জন্যে অপেক্ষা করুন। তবে সব কাজ। আমাদের যতদ্রুত সম্ভব সারতে হবে। সবুজ রাজা আমাদের ফাঁসির আদেশ দিয়েছে। কালকেই কাজেই আজ রাতেই পালাতে হবে ফ্রান্সিস বলল। রাজা ফ্রান্সিসের কথা। ঠিক বুঝলেন না। তবে আর কোন কথা বললেন না।
রাত হল। একটু রাতে ফ্রান্সিসদের খাবার এল। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলল–কেউ। ঘুমবে না। মান্যবর রাজা আপনিও ঘুমুবেন না।
-বেশ। রাজা মৃদুস্বরে বললেন।
একসময়ে ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। খোলা দরজার কাছে গিয়ে বলল–একবার ঘরে এসো তো?
–কেন? কী হল? প্রহরীটি জিজ্ঞেস করল।
–মশালগুলো নিভিয়ে দিয়ে যাও। ফ্রান্সিস বলল।
–কেন? বেশ তো আলো পাচ্ছো। প্রহরীটি বলল।
আলো চোখে লাগছে। ঘুম আসছে না। ফ্রান্সিস বলল।
-বেশ। যেমনটি চাও। প্রহরটি বলল। তারপর তরোয়াল কোমরে খুঁজে ঘরের মধ্যে ঢুকল। উঁচু হয়ে হাত বাড়িয়ে মশাল দুটো নিভিয়ে দিল। ফ্রান্সিস চাপা স্বরে ডাকলশাঙ্কো। শাঙ্কো এক লাফে উঠে দাঁড়াল। বুকের কাছে পোশাকের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ছোরাটা বের করল। তারপর অন্ধকারে নিশানা ঠিক করে প্রহরীটির বুকে ছোরা বিঁধিয়ে দিল। প্রহরীটির মুখ থেকে কোন শব্দই বেরুলো না। ও বিছানার ওপর। পড়ে যাচ্ছিল। শাঙ্কো ওকে চেপে ধরে বিছানার ওপর আস্তে শুয়ে দিল। কোন কোন শব্দ হল না।
ততক্ষণে ফ্রান্সিস বাইরে চলে এসেছে। অন্য প্রহরীটি কিছু বোঝার আগেই ফ্রান্সিস ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রহরীটি চিৎ হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। হাত থেকে তরোয়াল ছিটকে গেল। ফ্রান্সিস নিচু হয়ে দ্রুত তরোয়াল তুলে প্রহরিটির বুকে বসিয়ে দিল। একটা মৃদু ও’ শব্দ ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এল। দু’একবার এপাশ ওপাশ করে প্রহরীটি স্থির হয়ে গেল।
শাঙ্কো চাপাস্বরে বলল–বাইরের আলোটা? ফ্রান্সিস বলল–ওটা থাক। নইলে সৈন্যদের সন্দেহ হবে। মান্যবর রাজা সিনাত্রা–বাইরে আসুন সব। ঐ জঙ্গলের দিকে ছুটুন সবাই।
বাইরে চাঁদের আলো অনুজ্জ্বল। তবে আবছা সবকিছু দেখা যাচ্ছে।
রাজবাড়ির আড়ালে আড়ালে ফ্রান্সিসের পেছনে পেছনে ছুটল সবাই। রাজ বাড়ির আড়াল ছাড়িয়ে রাস্তায় নামল সবাই। এইভাবে পালানো যাবে রাজা আসারিয়া ভাবতেও পারেন নি। সেটাই ঘটল। রাজা মনে মনে ফ্রান্সিসের বুদ্ধির প্রশংসা করলেন।
রাস্তার ডানদিকেই বনভূমির শুরু। সবাই রাস্তা পার হয়ে বনের মধ্যে ঢুকে পড়ল। এতক্ষণে আড়াল পাওয়া গেল। দূরে রাজবাড়ির কাছে হৈ হল্লা ডাকাডাকি শোনা গেল। ওরা বুঝেছে বন্দীরা পালিয়েছে। তাদের সঙ্গে রাজাও পালিয়েছেন।
বনে ছাড়া ছাড়া গাছ। ছুটতে সুবিধে হচ্ছিল। গুঁড়িতে পা রেখে ঘন ঝোঁপঝাড় ঠেলে সরিয়ে চলল সবাই।
এবার ফ্রান্সিস থামল। সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল। কম বেশি সবাই হাঁপাচ্ছে তখন। ফ্রান্সিস হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–মান্যবর রাজা এখানে বা পাহাড়ে কোথাও আশ্রয় নেবার মত জায়গা আছে?
–আছে। মনে হয় সেনাপতি বাকি সৈন্যদের নিয়ে সেখানেই আশ্রয় নিয়েছে। রাজা বললেন।
-কোথায় সেটা? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
—একটা বড় ঘর এই বনে তৈরী করিয়েছিলাম। আমার ঈশ্বরচিন্তার ঘর। মাঝে মাঝে রাজবাড়ি ছেড়ে এখানে এসে থাকি। ঈশরের ধ্যান করি। কিছুদিন থেকে আবার রাজবাড়িতে ফিরে যাই। রাজা বললেন।
–ঘরটা খুঁজে পাবেন? ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ। কেন জানি না সেই ঘরের চারপাশের গাছগুলো মরে গেছে। সেই জায়গাটা দেখলেই বুঝতে পারবো। রাজা বললেন।
–তাহলে চলুন। খুঁজে দেখা যাক। ফ্রান্সিস বলল।
সবাই চলল এবার। রাজা হাত তুলে ডানদিক দেখালেন। ডানদিকে চলল সবাই।
হঠাৎ দেখা গেল কিছু মরা গাছ। তখনই অস্পষ্ট দেখা গেল একটা বড় টানা ঘর।
সবাই ঘরটার দরজার কাছে এল। ঘরে ঢোকার দরজাটা হাঁ করে খোলা। সবাই ঘরটায় ঢুকল। অন্ধকার ভাবটা চোখে সয়ে আসতে দেখা গেল ঘরের একপাশে একটা বড় বিছানা আর কয়েকটা কাঠের আসন। ঘরে কেউ নেই।
-বোঝা যাচ্ছে সেনাপতি এখানে আশ্রয় নেন নি। ফ্রান্সিস বলল। ফ্রান্সিস চারদিকে তাকাতে তাকাতে বলল–সেনাপতি ঠিক কাজই করেছেন। এখানে আশ্রয় নিলে সহজেই ধরা পড়তেন। সবুজ রাজা নিশ্চয়ই সেনাপতি ও সৈন্যদের খোঁজে এখানে তার সৈন্য পাঠাবে। এই বাড়িটার চারপাশে মরা গাছের বন। সহজেই ঘরটা নজরে পড়ত। এখন সেনাপতি অন্যত্র কোথাও আশ্রয় নিয়েছেন সেটা আপনি বুঝতে পারছেন? ফ্রান্সিস রাজা আসিরিয়াকে জিজ্ঞেস করল।
–না। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। রাজা মাথা নেড়ে বললেন।
যাক গে। রাত আর বেশি বাকি নেই। এখানেই বাকি রাতটা কাটাই। কাল সকালে সেনাপতির খোঁজ করবো। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিস একটা চেয়ারে বসতে বসতে বলল–সবাই যতটা পারো ঘুমিয়ে নাও। রক্ষীকে বলল–তোমার শরীর ভালো নেই। তুমি বিছানায় শোও। রাজাকে বলল বিছানা বড়। আপনিও বিছানায় শোন। পরিশ্রান্ত রাজা বিছানায় শুয়ে পড়লেন। রক্ষীও শুয়ে পড়ল। শাঙ্কো আর সিনাত্রা চেয়ার-টেবিলে বসল। একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ল। ওরা এভাবে ঘুমুতে অভ্যস্ত। ফ্রান্সিসও একটা চেয়ার বসল। চোখ বন্ধ করল। কিন্তু ঘুমোল না।
পাখির কিচিমিচির ডাকে ঘুম ভাঙল সকলের। ফ্রান্সিস বলল–এখনই চলো সব। সেনাপতি আর সৈন্যদের খুঁজে বার করতে হবে। ফ্রান্সিস রাজাকে জিজ্ঞেস করল– আচ্ছা ঐ দুটো পাহাড়ের কোথাও গুহাটুহা আছে?
–আমি ঠিক বলতে পারছি না। রাজা বললেন।
–ঠিক আছে। চলুন খুঁজে দেখি। ফ্রান্সিস বলল।
সবাই বনের মধ্যে দিয়ে উত্তরমুখো চলল। কিছু পরেই বন শেষ। সামনে দুটো পাহাড়। ডানদিকের পাহাড়টা সবুজ ঘাসে ঢাকা। বাঁদিকের পাহাড়টার অন্যরূপ। পাহাড়টায় গাছ নেই, ঘাস নেই। রুক্ষ ধূসর রঙের পাহাড়। দুটো পাহাড়ের বৈপরীত্য লক্ষ্য করল ফ্রান্সিস। বুঝল গুহা থাকলে বাঁদিকের রুক্ষ পাহাড়টাতেই আছে। ডানদিকের পাহাড়ে গুহাটুহা থাকার সম্ভাবনা কম।
ও বাঁদিকের পাহাড়টার দিকে চলল। কিছুদূর যেতেই সামনে দুই পাহাড়ের মাঝখানে উপত্যকামত। ফ্রান্সিসের পেছনে পেছনে উপত্যকটায় নামল সবাই। চারদিকে তাকিয়ে সবাই গুহামুখ খুঁজতে লাগল। কিন্তু কোন গুহামুখ দেখল না।
–মান্যবর রাজা–ফ্রান্সিস রাজাকে বলল–আপনি জোর গলায় সেনাপতিকে ডাকুন। রাজা দুই হাতের তালু গোল করে ডাকলেন
–সেনাপতি–কোথায় আছেন? পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হল–
-এন-এন-এন। কিছুক্ষণ রাজা অপেক্ষা করলেন। পরে আবার ডাকলেন। প্রতিধ্বনিত হল এন-এন-এন। কিন্তু সেনাপতির কোন সাড়া পাওয়া গেল না।
–চলুন–পাহাড়ের ওপাশে যাই। ফ্রান্সিস বলল। সবাই পাহাড়টা ঘুরে ওপাশে গেল। রাজা আবার ডাকলেন। কিন্তু সেনাপতির কোন সাড়া নেই।
আরো কিছুটা গিয়ে এবার ফ্রান্সিস ডাকল
–সেনাপতি মান্যবর রাজা এসেছেন। বারকয়েক ডাকতে ফ্রান্সিস লক্ষ্য করল কিছুটা উঁচুতে একটা পাথরের চাই নড়ছে। ফ্রান্সিস বলে উঠল–ঐখানে গুহা আছে। চলুন।
সবাই পাথরের ওপর পা রেখে রেখে সেই পাথরের চাইটার সামনে এল। ততক্ষণে পাথরের চাইটা অনেকটা সরে গেছে। গুহার মুখ দিয়ে সেনাপতি বেরিয়ে এল। সঙ্গে দুজন সৈন্যও বেরিয়ে এল।
সেনাপতি এগিয়ে এসে বলল–আসুন মান্যবর রাজা–আমরা। এই গুহাতেই আশ্রয় নিয়েছি! শুনলাম আপনি বন্দী হয়েছিলেন।
–হ্যাঁ। তারপর ফ্রান্সিসদের দেখিয়ে বললেন–এদের জন্যে পালিয়ে আসতে পেরেছি।
সবাই গুহার মধ্যে ঢুকল। কয়েকজন সৈন্য মিলে পাথরের চাইটা দিয়ে গুহামুখ আটকে দিল। অবশ্য একেবারে বন্ধ করে দিল না। কিছুটা ফাঁক রাখল বাতাস চলাচলের জন্যে।
গুহার মধ্যে মশাল জ্বলছে। মশালের আলোয় দেখা গেল বেশ কিছু সৈন্য গুহার পাথুরে মেঝেয় শুয়ে বসে আছে। গুহার মাঝখানে তরোয়াল-বর্শা স্কুপ করে রাখা। একপাশে রান্নার জায়গা।
একটা মোটা কাপড় গুহার মেঝেয় দেয়াল ঘেঁষে পাতা ছিল। সেনাপতি রাজাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে বসাল। রাজা চুপ করে বসে রইলেন।
ফ্রান্সিসরাও বসল। ফ্রান্সিস পাথুরে মেঝেয় শুয়ে পড়ল। শুনল রাজা আর সেনাপতির মধ্যে কথাবার্তা চলছে। সেনাপতি বলল–মান্যবর আপনার শরীর ভালোতো?
–হ্যাঁ শরীর ভালো। কিন্তু মন ভালো নেই। কী করে সবুজ রাজার দখল থেকে রাজ্য উদ্ধার করবো তাই ভাবছি। রাজা বললেন। কথাটা শুনে ফ্রান্সিস উঠে বসল। আস্তে আস্তে রাজার কাছে গেল। বলল–মান্যবর, আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনার জাহাজ সমুদ্রের যে ঘাটে আছে আমার বন্ধু সেখানে যাবে। আমাদের জাহাজ থেকে আমার সব বন্ধুদের এখানে নিয়ে আসবে। আমরা কৌশলে লড়াই করবো যাতে অল্প সৈন্য নিয়েও যুদ্ধে জেতা যায়।
–আমি তো কোন আশা দেখছি না। রাজা বললেন।
–নিরাশ হবেন না। আমি ফ্রান্সিস–প্রতিজ্ঞা করছি আপনার রাজত্ব আপনাকে ফিরিয়ে দেব। রাজা কিছু বললেন না।
ফ্রান্সিস শাঙ্কোদের কাছে ফিরে এল। বলল-শাঙ্কো সিনাত্রা–আমি স্থির করেছি এই মহানুভব রাজা আসারিয়ার হয়ে আমরা লড়াই করবো। শাঙ্কো তুমি আজকেই সন্ধ্যেবেলা সমুদ্রতীরে যাও। কাল রাতে বন্ধুদের নিয়ে এখানে চলে এসো।
–একটা কথা ফ্রান্সিস-শাঙ্কো বলল–সেনাপতির যে সৈন্যদের দেখছি তারা তো সংখ্যায় বেশি নয়। আমাদের বন্ধুরা এসে যোগ দিলেও সংখ্যাটা তো তেমন বাড়বে না।
-সবুজ রাজার সৈন্যদের ওপর আমরা চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালাবো। বুদ্ধি করে ওদের হার মানাবো। সামনা সামনি লড়াইতে যাবো না। ফ্রান্সিস বলল।
–এটা মন্দ বলোনি। ওভাবেই লড়াই চালাতে হবে। শাঙ্কো বলল।
সকালের খাবার দেওয়া হল। গাছের লম্বাটে পাতার ওপর পোড়া রুটি আর আনাজের ঝোল। ক্ষুধার্ত ফ্রান্সিসরা পেট পুরে খেল। রাজা আসারিয়া এমন খাবারে অভ্যস্ত নয়। তবু বিনা দ্বিধায় খেলেন।
সারাদিন কাটল। গতরাতে ভালো ঘুম হয় নি। ফ্রান্সিসরা দুপুরে ঘুমিয়ে নিল।
সন্ধ্যের পরে পরেই যা রান্না হয়েছিল শাঙ্কো সেইটুকুই খেয়ে নিল। কিছুক্ষণ ছোরাটা পাথরে ঘষে ধার করল।
একটু রাত হতেই গুহা থেকে বেরিয়ে এল। রাজা আসারিয়া বলে দিয়েছিলেন বনের মধ্যে দিয়ে দক্ষিণমুখো গেলেই সমুদ্রতীরে যাওয়ার রাস্তাটা পাওয়া যাবে। শাঙ্কো অন্ধকার বনের মধ্যে ঢুকে পড়ল। দিক ঠিক করে চলল।
যেতে যেতে রাত শেষ হয়ে এল। ভোর হবার কিছু আগে শাঙ্কো সমুদ্রের ধারে পৌঁছল। দেখল ওদের জাহাজের পাশেই রাজার জাহাজটা নোঙর ফেলে আছে।
সমুদ্রতীরের বালিয়াড়িতে তুলে রাখা নৌকোটা টেনে নিয়ে জলে ভাসাল। দাঁড় টেনে চলল। অস্পষ্ট চাঁদের আলো। শাঙ্কো আস্তে আস্তে নৌকোটা জাহাজের গায়ে ভেড়াল। দড়ি দিয়ে নৌকোটা বাঁধল। তারপর হালের দড়িদড়া ধরে জাহাজের ডেক এ উঠে এল।
কয়েকজন বন্ধু ডেক-এ ঘুমিয়ে ছিল। তাদের মধ্যে বিস্কো ছিল। শাঙ্কো ঠেলা দিয়ে বিস্কোর ঘুম ভাঙাল। বিস্কো ধড়ফড় করে উঠে বসল। আবছা আলোয় শাঙ্কোকে চিনে ফেলে গলা চড়িয়ে বলে উঠল–আরে শাঙ্কো। চারদিকে তাকিয়ে বলল–ফ্রান্সিস, সিনাত্রা? বিস্কোর কথা শুনে অন্যদেরও ঘুম ভেঙে গেছে তখন। ওরাও ফ্রান্সিসদের কথা জিজ্ঞেস করল।
–ফ্রান্সিস সিনাত্রা ভালো আছে। এখন হ্যারিকে ডাকো। কথা আছে। শাঙ্কো কথাটা বলে ক্লান্ত দেহে ডেক-এ বসে পড়ল। বিস্কো ছুটল হ্যারিকে ডাকতে।
একটু পরেই হ্যারি ছুটতে ছুটতে এল। বলল শাঙ্কো।
–সব বলছি। শাঙ্কো হাতের চেটো তুলে বলল। ততক্ষণে মারিয়াও ছুটে এসেছে। অন্য বন্ধুরা আসতে লাগল।
তখন শাঙ্কো সব ঘটনা বলল। তারপর বলল–
–তোমরা সন্ধ্যেবেলা সবাই তৈরী হয়ে নেবে। একটু রাতে অন্ধকারে আমরা সেই পাহাড়ে যাবো। বনের মধ্যে দিয়ে।
–আবার লড়াই হবে? মারিয়া মৃদুস্বরে বলল।
–হ্যাঁ। সবুজ রাজা নৃশংস। তাকে তাড়াতেই হবে। শুনলেন তো সবুজ রাজা আমাদের ফাঁসি দিতে চেয়েছে। রাজা আসারিয়া একজন উদার মনের রাজা। তাঁকে নির্মম ভাবে হত্যা করতে চেয়েছিল। আমরা এসব পরিকল্পনা বানচাল করে দিয়েছি। শাঙ্কো বলল।
ভাইকিং বন্ধুদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। শুয়ে বসে দিন কাটানো ওদের ধাঁতে নেই। লড়াইয়ের মধ্যে থাকতেই ওরা ভালবাসে। বীর জাতির এটাই লক্ষণ।
সন্ধ্যের পরই খেয়ে নিল সবাই। একটু রাত হতেই সবাই তরোয়াল কোমরে খুঁজে বেরিয়ে ডেক উঠে এল।
দু’টো নৌকাতে চড়ে দফায় দফায় ওরা সমুদ্রতীরে উঠল। তারপর রাস্তা ধরে চলল। হাঁটতে হাঁটতে শাঙ্কো চাপা স্বরে বলল-এই রাস্তাটা তাড়াতাড়ি পার হতে হবে। পা চালাও। সবাই দ্রুত হাঁটতে লাগল। চাঁদের আলো উজ্জ্বল নয়। তবে চার পাশ মোটামুটি দেখা যাচ্ছিল।
এবার রাস্তার ধারেই বনভূমির শুরু হল। শাঙ্কোর পিছনে পিছনে সবাই বনের মধ্যে ঢুকে পড়ল। অন্ধকার বনের মধ্যে দিয়ে চলা শুরু হল।
এক সময়ে ওরা রাজা আসারিয়ার সেই ঘরের কাছে এল। এবার ঘর পার হয়ে উত্তর মুখে পাহাড়ের দিকে চলল। পাহাড়ের তলায় যখন পৌঁছল তখনও ভোর হয়নি। সবাই কম বেশি হাঁপাচ্ছে তখন।
গুহামুখের কাছে পৌঁছাল সবাই। গুহামুখের পাথরের চাইয়ের ফাঁকে মুখ রেখে শাঙ্কো বেশ জোরেই ডাকল–ফ্রান্সিস? নানা চিন্তায় ফ্রান্সিসের ঘুম প্রায় হয়-ই নি। প্রথম ডাকটাই ওর কানে গেল। ও উঠে পড়ল। কয়েকজন সৈন্যকে ঠেলা দিয়ে তুলল। ওদের নিয়ে গুহামুখে পাথরের চাই সরাল। ভাইকিং বন্ধুরা একে একে গুহার মধ্যে ঢুকল।
রাজা আসারিয়া সারারাত ঘুমোন নি। জেগে বসে ছিলেন। তাঁরও চিন্তার শেষ নেই। তিনি ভাইকিংদের ঢুকতে দেখলেন। একটু আশ্বস্ত হলেন। যোদ্ধার সংখ্যা বাড়ল। সবুজ রাজাকে হার স্বীকার করাতেই হবে। নিজেকে রানিকে মুক্ত করতে হবে।
সকাল হল। রাজার সৈন্যরা ভাইকিংরা গুহার পাথুরে মেঝেয় শুয়ে বসে আছে।
ফ্রান্সিস ঘুম ভেঙে দেখল রক্ষীটি নেই। রক্ষীটি ওর কাছেই শুয়ে ছিল। ও রাজাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল–রক্ষীটি কোথায়? ও তো অসুস্থ ছিল।
শেষ রাতে পালিয়েছে। অবশ্য তাকে দোষ দেওয়া যায় না। কী করে খবর পেয়েছে ওর একমাত্র ছেলেকে সবুজ রাজার সৈন্যরা হত্যা করেছে। রাজা বললেন।
সকালের খাবার খাওয়ার পর ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব, আমি আর শাঙ্কো সবুজ রাজার সৈন্যদের কাছে ধরা দেবো। তোমরা আমাদের পেছনে পেছনে বনের শেষে এসে গাছের আড়ালে অপেক্ষা করবে। সবুজ রাজার কিছু সৈন্য যাতে বনের মধ্যে ঢোকে আমি সেই ব্যবস্থা করবো। তারা সংখ্যায় কম হবে। তোমরা এ বনের আড়াল পাবে। সেই সৈন্যদের হারাতে হবে। জোর লড়াই চালাবে। তারপর রাজবাড়ি আক্রমণ করবে। সবাই উঠে তৈরি হয়ে নাও।
ফ্রান্সিসের কথা শেষ হতে রাজার সৈন্যরা ভাইকিং বন্ধুরা উঠে দাঁড়াল। তৈরি হয়ে কোমরে তরোয়াল গুঁজে নিল। ফ্রান্সিস রাজাকে বলল–মান্যবর আপনি এখানেই থাকুন। রাজা উঠে দাঁড়িয়ে বললেননা। বিপদের মুখে তোমরা যাচ্ছে। আমিও যাবো।
বেশ চলুন। কিন্তু সঙ্গে তরোয়াল নিন। আপনাকেও হয়তো লড়তে হতে পারে। ফ্রান্সিস বলল। রাজা তার তরোয়ালটা কোমরের খাপে ভরে নিলেন।
এবার সবাই আস্তে আস্তে গুহা থেকে বেরিয়ে এল। প্রায় অন্ধকার বনের মধ্যে দিয়ে চলল সবাই।
বনের শেষ প্রান্তে পৌঁছল সবাই। ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে নিয়ে বন থেকে বেরোতে যাবে তখন হ্যারি মৃদুস্বরে বলল–শুনলাম সবুজ রাজা নৃশংস। তোমাদের কোন বিপদ–তরোয়াল নাও।
–কিছছু ভেবো না। আমার ছক কষা হয়ে গেছে। জয় আমাদের হবেই। ফ্রান্সিস হ্যারিকে আশ্বস্ত করল। তরোয়াল ছাড়াই দুজনে চলল।
দুজনে বন থেকে বেরিয়ে রাস্তায় উঠল। চলল রাজবাড়ির দিকে। এ সময়ই সবুজ রাজাকে রাজসভায় পাওয়া যাবে।
রাজবাড়ির কাছাকাছি আসতেই সবুজ রাজার কয়েকজন প্রহরী ওদের দেখতে পেল। ওরা ছুটে এসে ওদের দুজনকে ঘিরে ধরল। ফ্রান্সিস দুহাত তুলে বলে উঠল আমরা নিরস্ত্র। তরোয়াল চালিও না। আমাদের সবুজ রাজার কাছে নিয়ে চল। রাজার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।
-কী কথা? একজন প্রহরী জিজ্ঞেস করল।
–সেটা রাজাকেই বলবো। নিয়ে চলো। ফ্রান্সিস বলল।
সবুজ রাজা কাঠের সিংহাসনে বসে আছে। সভাকক্ষে খুব ভিড় নেই। একপাশে কয়েকজন প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে। তরোয়াল কোষবদ্ধ। লড়াইয়ে জিতে গেছে। কাজেই ওরা নিশ্চিন্ত।
বন্দী ফ্রান্সিস আর শাঙ্কোকে দেখে সবুজ রাজা হেসে উঠল। বলল–ধরা পড়েছো তাহলে? ফ্রান্সিসরা কোন কথা বলল না।
–এবার আর তোমাদের রেহাই নেই। ফাঁসিতে লটকাবোই। আমার দুজন সৈন্যকে তোমরা হত্যা করে পালিয়েছো। রাজা বলল।
–আমরা হত্যা না করলে ওরা আমাদের হত্যা করতো। আপনার সৈন্যরা। আপনার মতই। বন্দী-টন্দী বোঝে না। সোজা মেরে ফেলে। ফ্রান্সিস বলল।
–এই দোষারোপের জন্যে এক্ষুণি তোমাকে মেরে ফেলতে পারি, তা জানো? সবুজ রাজা বেশ রেগেই বলল।
–তার আগে একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর দিতে এসেছি। ফ্রান্সিস বলল।
–কী খবর? সবুজ রাজা সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল।
–রাজা আসিরিয়া তার সেনাপতি সৈন্যদের নিয়ে কোথায় আশ্রয় নিয়েছে তা, আমরা দেখেছি। ফ্রান্সিস বলল। সবুজ রাজা বেশ চমকে উঠল। বলল–কোথায়?
তার আগে বলুন সেটা জানালে আমাদের মুক্তি দেবেন। ফ্রান্সিস বলল।
–সে পরে দেখা যাবে। সবুজ রাজা বলল।
–তাহলে আমরাও সে সংবাদ দেব না। ফ্রান্সিস বলল।
–চাবুক মেরে খবর বের করবো। সবুজ রাজা গলা চড়িয়ে বলল।
শাঙ্কো মৃদুস্বরে ডাকলো–ফ্রান্সিস? ফ্রান্সিস একটু ভাবলো। বলল
–ঠিক আছে। বলছি। ঐ বনের মধ্যে রাজা আসিরিয়ার একটা ঘর আছে।
–ঘর? বনের মধ্যে? সবুজ রাজা বলল।
–হ্যাঁ। সেই ঘরে রাজা আসিরিয়া সেনাপতি আর সৈন্যদের নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। ফ্রান্সিস বলল।
বলো কি। সবুজ রাজা সেনাপতির দিকে তাকাল। সেনাপতি সঙ্গে সঙ্গে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল–আমি সৈন্য নিয়ে এক্ষুণি যাচ্ছি।
–বেশি সৈন্য নিয়ে যাবেন না। এখানে রাজবাড়িতেও তো সৈন্য রাখতে হবে। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল।
–সেনাপতি বেশ রেগে গেল। বলল–তুমি লড়াইয়ের কী বোঝ?
–তা ঠিক। ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল। শাঙ্কো মৃদু হাসল। সেনাপতি বলছে ফ্রান্সিস লড়াইয়ের কিছু বোঝে না। সেনাপতি ছুটে চলে গেল।
তখনই কয়েকজন প্রহরী সেই রক্ষীটিকে নিয়ে এল। তার পোশাক ঘেঁড়া। সারা গায়ে পিঠে চাবুকের দাগ। পিঠটা যেন ফুলে উঠেছে। গায়ে পিঠে জমাট রক্ত। ফ্রান্সিস আর তাকিয়ে দেখতে পারল না। মাথা নিচু করল।
–অ্যাই? কী হয়েছে তোর? সবুজ রাজা ব্যঙ্গ করে বলল।
রক্ষীটি গোঙাতে গোঙাতে বলল–আপনার-সৈন্যরা–আমার একমাত্র ছেলেটাকে।
–মেরে ফেলেছে? সবুজ রাজা গলা চড়িয়ে বলল।
রক্ষী মাথা ওঠানামা করল। ফ্রান্সিস স্থির থাকতে পারল না। বলে উঠল–এ ভাবে মেরে ফেলা–হ্যাঁ সবুজ রাজা চিৎকার করে উঠল–চো। ফ্রান্সিস তবু বলল–ছেলেটাকে মারা হল। একেও বিনা দোষে এভাবে চাবুক
–তাহলে একে মেরে ফেলি। সবুজ রাজা কথাটা বলেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। কোমর থেকে তরোয়াল কোষমুক্ত করল। চেঁচিয়ে বলল–তবে এটাও মরুক। মুহূর্তে তরোয়াল ঢুকিয়ে দিল রক্ষীটির বুকে।
ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলে উঠল–শাঙ্কো। শাঙ্কো তৈরিই ছিল। জামার তলা থেকে দ্রুতহাতে ছোরাটা বের করল। প্রহরীরা রাজসভার লোকেরা কিছু বোঝার আগেই সবুজ রাজার ওপর শাঙ্কো ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমূল ছোরা বিধিয়ে দিল সবুজ রাজার বুকে। সবুজ রাজা উল্টে পড়ল সিংহাসনের ওপর। তারপর সিংহাসনসুষ্ঠু উল্টে পড়ল মেঝেয়। তার হাত থেকে তরোয়াল ছিটকে গেল। ফ্রান্সিস একলাফে ছুটে গিয়ে তরোয়ালটা তুলে নিল। ওদিকে রক্ষীটিও মেঝেয় পড়ে মারা গেছে।
এতক্ষণে প্রহরীরা সচকিত হল। তরোয়াল কোষমুক্ত করে দুজন প্রহরী শাঙ্কোর দিকে ছুটে এল। ফ্রান্সিস এক ছুটে শাঙ্কোকে আড়াল করে দাঁড়াল। একজন প্রহরী ফ্রান্সিসের তরোয়ালের মার ঠেকাতে গিয়ে বাঁদিকে ঝুঁকে পড়ল। ফ্রান্সিস এই সুযোগ ছাড়ল না। প্রচন্ড জোরে তরোয়ালের ঘা মারল প্রহরীটির ডান কাঁধে। প্রহরীটি তরোয়াল ফেলে বা হাতে ডান কাধ চেপে ধরল। শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে তরোয়ালটা মেঝে থেকে তুলে নিল। বাঁ হাতে ছোরা আর ডানহাতে তরোয়াল নিয়ে শাঙ্কো প্রহরীদের সঙ্গে লড়াই চালাল।
অল্পক্ষণের মধ্যেই প্রহরীরা হার স্বীকার করল। ফ্রান্সিসদের নিপুণ তরোয়াল চালানো দেখে ওরা অবাক হয়ে গেল।
তখনই রাজবাড়ির বাইরে চিৎকার হৈহৈ শোনা গেল। একটু পরেই রাজবাড়ির দ্বারদেশে ধ্বনি উঠল– ও–হো–হো। ফ্রান্সিস আর শাঙ্কোও ধ্বনি তুলল–ও—হো-হো।
দল বেঁধে খোলা তরোয়াল হাতে ভাইকিং বন্ধুরা রাজসভায় ঢুকে পড়ল। সঙ্গে রাজা আসিরিয়ার সৈন্যরাও ঢুকল। ফ্রান্সিস বুঝল ওদের জয় হয়েছে।
হ্যারি ছুটে এসে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল। ওর চোখে জল। ফ্রান্সিস হাঁপাতে হাঁপাতে মৃদুস্বরে বলল–এই কেঁদো না। রাজা আসিরিয়া কোথায়?
–আসছেন। উনিও লড়াইয়ে পটু। হ্যারি বলল।
সিনাত্রা গড়িয়ে পড়া সিংহাসনের কাছে গেল। টেনে তুলে ওটা ভালোভাবে পেতে দিল। শাঙ্কোও ওকে সাহায্য করল।
কিছুপরে রাজা আসিরিয়া ঢুকলেন। তার পেছনে সেনাপতি। রাজা আসিরিয়া সবুজ রাজাকে মেঝেয় পড়ে থাকতে দেখে ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে বললেন–উনি কি মারা গেছেন?
হ্যাঁ। তার প্রাপ্য শাস্তি পেয়েছে। মৃত সবুজ রাজার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রাজা সিংহাসনে বসলেন। এবার ফ্রান্সিকে বললেন-তোমাদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তোমাদের জন্যে আমি শুধু জীবনই ফিরে পেলাম না আমার রাজত্বও ফিরে পেলাম। তারপর হেসে বললেন
–আমার কাছে তো তোমাদের কিছু প্রাপ্য হয়।
–আমরা কিছুই চাই না। ফ্রান্সিস মাথা নাড়ল।
–কিছু না? রাজা বললেন।
–না-কিছু না। শুধু একটা ব্যাপারে আপনার সাহায্য চাই। ফ্রান্সিস বলল।
–সেটা কী? রাজা সাগ্রহে বলে উঠলেন।
–সেটা কালকে এখানে এসে বলবো। আমরা সবাই ক্লান্ত। আজকে আর কোনো কথা নয়। আপনিও অন্দরমহলে যান। রানিমা নিশ্চয়ই খুব দুশ্চিন্তায় আছেন। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক-ঠিক। রাজা সঙ্গে সঙ্গে সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন। অন্দরমহলের দিকে চললেন।
ফ্রান্সিসরা অতিথিশালায় ফিরে এল। একজন রক্ষী এসে বলল–আপনাদের দেখাশোনা করতে সেনাপতি পাঠালেন।
–ঠিক আছে। তুমি এখানেই থাকো। শাঙ্কো বলল। ফ্রান্সিসের সেই মৃত রক্ষীর কথা মনে পড়ল। ওর মনটা খারাপ হয়ে গেল।
ফ্রান্সিসরা অতিথিশালায় শুয়ে বসে বিশ্রাম করতে লাগল। দুপুরের খাওয়ার পরও বিশ্রাম নেওয়া চলল।
সন্ধ্যেবেলা কয়েকজন বন্ধু তিয়ের নগর দেখতে বেরুলো। ওরা ফিরে এসে বলল–কী আর দেখবো। মৃতদেহ ছড়িয়ে আছে। সৎকার চলছে। আগুনে পোড়া বাড়িঘর। কান্নাকাটি। শাঙ্কো বলল–দুদিন আগেও কত বড় উৎসব হয়ে গেল এখানে। নাচ গান। সিনাত্রাও সেই আসরে গান গেয়েছে। আজ তো শ্মশানের মতই অবস্থা।
রাতে খাওয়ার পর ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। হ্যারি কাছে এল। বলল–ফ্রান্সিস?
–হুঁ। বলো। ফ্রান্সিস ওর দিকে তাকালো।
–কালকে জাহাজে ফিরলে হয় না? হ্যারি বলল।
–না। একটা কাজ বাকি আছে। ফ্রান্সিস বলল।
–কী কাজ? হ্যারি বলল।
কালকে রাজসভায় রাজাকে বলবো। শুনো। ফ্রান্সিস বলল।
–বুঝেছি। হ্যারি বলল।
–কী বুঝেছো? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–কোন গুপ্ত ধনভান্ডারের খবর পেয়েছে। তাই কিনা? হ্যারি বলল।
ফ্রান্সিস হেসে বলল–এই জন্যেই তোমাকে এত ভালো লাগে। ঠিক ধরেছো।
–আজ রাত হয়েছে। তুমি ক্লান্ত। ঘুমিয়ে পড়ো। কালকে সব শুনবো। হ্যারি বলল। তারপর শুয়ে পড়ল।
পরদিন সকালের খাবার খেয়ে ফ্রান্সিস আর হ্যারি রাজসভায় এল।
রাজা আসিরিয়া কাঠের সিংহাসনে বসে ছিলেন। প্রজাদের মধ্যে কয়েকজন রাজাকে সবুজ রাজার অত্যাচারের কথা বলছিল। রাজা তাদের সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি রাজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। রাজা ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বললেন–
–তুমি কিছু বলবে বলেছিলে।
–হ্যাঁ–আপনার পূর্বপুরুষ কোন রাজা তার ধনসম্পদ এই রাজত্বের কোথাও গোপনে রেখে গেছেন। এ ব্যাপারে আপনি কী জানেন? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।
–কিছুই জানি না। শুনেছি আমাদের পূর্বপুরুষ রাজা সার্মেনো অনেক ধনসম্পদ পাতালঘরে গোপনে রেখে গেছেন। রাজা বললেন।
–সেই পাতালঘর কোথায়? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–জানি না। রাজা মাথা নেড়ে বললেন।
–আপনি সেই ধনসম্পদের খোঁজ করেন নি? ফ্রান্সিস বলল।
না। কারণ সেই ধনসম্পদ রাজা সার্মেনো জলদস্যুতা করে সঞ্চয় করেছিলেন। নিরীহ জাহাজযাত্রীদের রক্তে ভেজা সেই ধনসম্পদের ওপর আমার কোন লোভ নেই। রাজা বললেন।
–কেউ কি ধনভান্ডার খুঁজেছিল? ফ্রান্সিস প্রশ্ন করল।
-হ্যাঁ তিনজন খুঁজতে সমুদ্রতীরের পাহাড়টায় গিয়েছিল। কিন্তু তারা জীবিত অবস্থায় ফেরেনি। রাজা বললেন।
–তাদের মৃতদেহও পাওয়া যায়নি? ফ্রান্সিস বলল।
–না। রাজা মাথা নেড়ে বললেন।
–তারা সমুদ্রতীরের পাহাড়ের দিকে গিয়ে খুঁজেছিল কেন? ফ্রান্সিস বলল।
–আমি তাদের বলেছিলাম অতীতের রাজবাড়ি ছিল ঐ পাহাড়ের কাছে। রাজা বললেন।
–ঠিক আছে। আমরা খুঁজে দেখতে চাই। আমাদের অনুমতি দিন। ফ্রান্সিস বলল।
–কিন্তু তিনজন ফেরেনি। তারপরেও তোমরা–রাজা বলতে গেলেন।
ফ্রান্সিস বাধা দিয়ে বলল–বেশ কিছু গুপ্ত ধনভান্ডার আমি বুদ্ধি খাটিয়ে উদ্ধার করেছি। আশা করছি এই ধনভান্ডারও উদ্ধার করতে পারবো।
–বেশ। কথাটা বলে রাজা আসিরিয়া সেনাপতির দিকে তাকালেন। সেনাপতি পাশে রাখা কাঠের আসনের দিকে হাত বাড়াল। একটা ছোটো চৌকোনো চামড়া মেশানো কাগজ তুলে ফ্রান্সিসকে দিল। ফ্রান্সিস দেখল কাগজের মাঝখানে একটা শীলমোহর। নিচে স্পেনীয় ভাষায় লেখা–অনুমতিপত্র।
–এটা আপনার অনুমতির শীলমোহর? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
-হ্যাঁ। এই অনুমতিপত্র নিয়ে আমার রাজ্যের যে কোন জায়গায় তোমরা অবাধে যেতে পারবে। এমনকি রাজঅন্তঃপুরেও যেতে পারবে। রাজা বললেন।
–এই শীলমোহর কি আপনিই প্রচলিত করেছেন? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
-না। শুনেছি পূর্বপুরুষ রাজা সার্মেনো এই শীলমোহর ব্যবহার করতেন। তখন থেকেই এই শীলমোহরের ব্যবহার চলে আসছে। এই শীলমোহর আমার সিংহাসনেও আছে। রাজা বললেন। রাজা আসনের ওপরের কাপড়ের ঢাকনা সরালেন। দেখা গেল সিংহাসনের মাথায় এই শীলমোহর কাঠ কুঁদে তোলা আছে। এখানকার সব আসনেই। তাছাড়া অন্দরমহলের প্রত্যেক পাথরের দেয়ালে এই শীলমোহর কুঁদে ভোলা আছে। রাজা বললেন।
–আমি শীলমোহরের নকশাগুলো দেখতে চাই। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমাকে তো অনুমতিপত্র দেওয়াই হয়েছে। যাও। রাজা বললেন।
–তাহলে অন্দরমহলে একটু খবর পাঠান যে আমরা যাবো। ফ্রান্সিস বলল।
রাজা একজন প্রহরীকে ডাকলেন। স্থানীয় ভাষায় কিছু বললেন। প্রহরীটি চলে গেল।
কিছুপরে প্রহরীটি ফিরে এল। ফ্রান্সিসদের আসতে ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিস আর হ্যারি অন্দরমহলে ঢুকল। এঘর ওঘর ঘুরে ঘুরে দেখল। সব পাথরের দেয়ালেই শীলমোহর কুঁদে তোলা। দেয়ালে ফুলপাতার নকশার মধ্যে ঐ শীলমোহরের নকশা।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি রাজসভায় ফিরে এল।
-দেখলে? রাজা জিজ্ঞেস করলেন।
-হ্যাঁ। ঐ শিলমোহরগুলো ভেঙে দেখা যায় কিনা সেটা পরে ভেবে দেখবো। এখনও আরো কিছু দেখার আছে। কাজেই আগেই দেয়াল ভাঙতে যাবো না। ফ্রান্সিস বলল।
ওগুলো ভাঙতে গেলে সমস্ত দেয়ালই হয়তো ভেঙে পড়বে। রাজা বললেন।
—সাবধানে। হিসেব করে ভাঙতে হবে। তবে ওসব ভাঙার মধ্যে এখন যাচ্ছি না। বললাম না–আরো কিছু দেখতে হবে। ভাবতে হবে। এবার আমরা যাচ্ছি। ফ্রান্সিস বলল। তারপর দু’জনে রাজসভা থেকে বেরিয়ে এল।
দু’জনে অতিথিশালায় এল। বন্ধুরা জানতে চাইল ওরা দু’জনে রাজা আসিরিয়ার সঙ্গে কী নিয়ে কথা বলল। ফ্রান্সিস সব কথা বলল।
–তাহলে আবার অভিযান কর। শাঙ্কো খুশির স্বরে বলল।
-হ্যাঁ। ফ্রান্সিস মাথা ওঠানামা করল। তারপর বলল–সবাই দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবে। তারপর সমুদ্রতীরে পাহাড়ী এলাকায় যাবো। কারণ ওখানেই কোথাও পুরোনো রাজবাড়ি ছিল। ঐ এলাকাটা ভালো করে খুঁজতে হবে।
দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই তৈরি হল। ফ্রান্সিস বলল–সবাই তরোয়াল নিয়ে নাও। বলা যায় না সবুজ রাজার সেনাপতি হঠাৎ আক্রমণ করতে পারে।
সবাই তরোয়াল কোমরে গুঁজে চলল। তিয়ারার লোকজন ফ্রান্সিসদের বেশ ঔৎসুক্যের সঙ্গেই দেখল কোথায় চলেছে ওরা? আবার লড়াই করতে যাচ্ছে নাকি?
পাহাড়ী এলাকায় পৌঁছল সবাই। দেখল সমুদ্রের ধারেই কয়েকটা ছোট পাহাড়। মাঝখানের পাহাড়টাই সবচেয়ে উঁচু। ফ্রান্সিস স্থির করল পাহাড়ের মাথায় উঠতে হবে। তাহলেই চারদিক ভালো দেখা যাবে। ঐসব পাহাড়ের মধ্যেই নিচে কোথাও পাতালঘর থাকলে তার হদিশও পাওয়া যাবে।
এবারে পাহাড়ে ওঠা। মাঝখানে উঁচু পাহাড়টাকেই বেছে নিল ফ্রান্সিস। শাঙ্কো সিনাত্রা বিস্কোকে নিয়ে ফ্রান্সিস পাহাড়টায় উঠতে লাগল। এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথরের চাইয়ে পা রেখে রেখে ওরা পাহাড়টার চূড়ার কাছাকাছি এল। দেখা গেল চূড়ার কাছাকাছি কোনো পাথরের চাই নেই। তবে পাথরের খাঁজ রয়েছে। সেইসব খাঁজেই পায়ের ওপর ভর রেখে রেখে চূড়োয় উঠতে হবে।
–তোমরা থাকো। আমি একা উঠে সব দেখছি। ফ্রান্সিস বলল। তারপর পাথরের খাঁজে খাঁজে দেহের ভর রেখে রেখে চুড়োয় উঠে এল। চারদিকে তাকিয়ে অন্য ছোট পাহাড়গুলো দেখল। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দেখল সমুদ্রের বিশাল বিশাল ঢেউ পাহাড়টার গোড়ায় আছড়ে পড়ছে। আট-দশ হাত উঁচু পর্যন্ত জল ছিটকে উঠছে। চোখ ফিরিয়ে আনতে তখনই দেখল কাছেই একটা গহুর নিচের দিকে নেমে গেছে। গহ্বরের গা খুব এবড়ো খেবড়ো নয়। কিছুটা বা মসৃণ। যেন কেটে করা হয়েছে।
— ফ্রান্সিস গহ্বরের ভেতরে তাকাল। অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ও ভাবল এই গহুরটা নিশ্চয়ই পাথর কেটে করা হয়েছে। নিশ্চয়ই এই গহ্বরে কিছু আছে। হয়তো পাতালঘরটাই আছে।
ও চূড়ো থেকে নেমে এল। বন্ধুদের কাছে এসে বলল,
–সবকিছু দেখলাম। একটা গহ্বরও দেখলাম। কালকে ঐ গহ্বরে নামবো। শক্ত দড়ি আর মশাল চকমকি পাথর লোহার টুকরো আনতে হবে। এখন নেমে চলল।
সবাই পাহাড়ের চাইয়ের ওপর পা রেখে রেখে নেমে এল।
–তোমার কি মনে হয় ওখানে কোন পাতালঘর আছে? হ্যারি জিজ্ঞেস করল।
–গহ্বরে না নেমে বলতে পারছি না। তবে এখানেই তো পুরোনো রাজবাড়ি ছিল। কাজেই গহ্বরটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিছু একটা নিশ্চয়ই আছে ওখানে। ফ্রান্সিস বলল।
পরদিন দুপুরের খাবার খেয়ে ফ্রান্সিসরা আবার পাহাড়ী এলাকায় এলো। শাঙ্কোদের নিয়ে ফ্রান্সিস পাহাড়টায় উঠল। চূড়োর কাছাকাছি এসে শাঙ্কো সঙ্গে আনা দড়িটার একটা মাথা একটা বড় পাথরের চাইয়ের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধল। অন্য মাথাটা ফ্রান্সিসের হাতে দিল। ফ্রান্সিস দড়ির মাথাটা কোমরে বাঁধল। সিনাত্ৰা চকমকি ঠুকে একটা মশাল জ্বালিয়ে দিল।
মশালটা বাঁ হাতে নিয়ে ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে গহ্বরে নামতে লাগল। ওপর থেকে শাঙ্কোরা দড়ি ছাড়ছিল। গহ্বরে মশালের আলো পড়ল। চারপাশের পাথুরে প্রায় মসৃণ দেয়াল দেখা যেতে লাগল।
একসময় ফ্রান্সিসের পায়ে পাথরের মেঝে ঠেকল। ও দেখল একটা ঘর। মশালের আলো ফেলে ফেলে ঘরটার চারদিকে দেখতে লাগল। শুধুই একটা ঘর। তার জানালা দরজা নেই। তবে দেখে মনে হল এই ঘরটা ব্যবহৃত হত। এই ঘরটা কয়েদঘর হবার সম্ভাবনাই বেশি। ফ্রান্সিস বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল যদি শীলমোহরের নকশা কোথাও খোদাই করা থাকে। না। সেরকম কোন নকশা কুঁদে তোলা নেই। আর কিছু দেখার নেই।
ফ্রান্সিস দড়িতে দুটো হ্যাঁচকা টান দিল। ওপর থেকে শাঙ্কোরা দড়ি টানতে লাগল। আস্তে আস্তে ফ্রান্সিস ওপরে উঠে এল। চূড়ো থেকে নেমে আসতে হ্যারি বলল–কিছু দেখলে?
-একটা পুরোনো ঘর। বোধহয় কয়েদঘর ছিল। ফ্রান্সিস বলল।
–কোন চিহ্নটিহ্ন কিছু পেলে? হ্যারি জানতে চাইল।
–না। সেরকম কিছু নেই। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে ওটা পাতালঘর নয়। হ্যারি বলল।
–তাই তো মনে হল। তবে পাহাড়গুলো খুঁজে দেখতে হবে। এরকম কোন ঘর পাওয়া যায় কিনা। গহুর গুহা সবই দেখতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
ওরা পাহাড়ী এলাকায় ঘুরে বেড়াল। কিন্তু কোন গহুর বা গুহা পেল না। ফ্রান্সিস। বলল–চলো সমুদ্রের দিক থেকে দেখি। সমুদ্রের দিকে গেল সবাই। সমুদ্রের জলের বড় বড় ঢেউ পাহাড়ের গায়ে আছড়ে পড়ছে। জল ছিটকে উঠেছে। তার মধ্যে দিয়েই ওরা পাহাড়ের ধার দিয়ে চলল।
বিকেলের ম্লান আলোয় হঠাৎ একটা গুহামুখ নজরে পড়ল। সমুদ্রের জলের বড় বড় ঢেউ সেই গুহামুখে আছড়ে পড়ছে। একদিকে ঢেউয়ের ছিটকানো জল অন্যদিকে পায়ের নীচে শ্যাওলাধরা পিছল পাথর। তার মধ্যে দিয়ে হেঁটে ওরা গুহামুখে এসে দাঁড়াল।
গুহামুখ দিয়ে বিকেলের নিস্তেজ আলোয় যতদূর দেখা গেল বোঝা গেল গুহাই। অন্য কিছু দেখা গেল না। গুহার ভেতরটা অন্ধকার।
ভেতরে ঢুকে গুহাটা দেখতে হয়। ফ্রান্সিস বলল।
সন্ধ্যে হতে বেশি দেরি নেই। এখন একটা অজানা অচেনা গুহায় ঢুকবো? হ্যারি বলল।
উপায় নেই। মারিয়া ওরা নিশ্চয় ভাবছে। তাই দেরি করতে চাই না। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ চলো। হ্যারি বলল।
সবাই গুহার মধ্যে ঢুকল। কিছুটা এগোতেই দেখা গেল একটা লম্বাটে পুকুর মত। জল কতটা গভীর বোঝা গেল না। পুকুরটার ওপারে অন্ধকার গুহা।
–সিনাত্রা–একটা মশাল জ্বালো। ফ্রান্সিস বলল।
সিনাত্ৰা চকমকি পাথর ঠুকে একটা মশাল জ্বালাল। ফ্রান্সিস জ্বলন্ত মশালটা কয়েকবার দুলিয়ে দুলিয়ে পুকুরটার ওপারে ছুঁড়ে ফেলল। এবার মশালের আলোয় ওপারটা দেখা গেল। টানা গুহা চলে গেছে। ফ্রান্সিস বলে উঠল-জলে নেমে ওদিকটা দেখে আসি। কতটা দূরে গেছে গুহাটা।
-কিন্তু আলো পড়ে গেছে। এখন ফিরে চল। কালকে না হয়–হ্যারি বলতে গেল।
-না-না। এই ধনসম্পদ উদ্ধারের কাজটা তাড়াতাড়ি সারতে হবে। ফ্রান্সিস বলল। তারপর জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। সাঁতরে কিছুটা যেতেই দেখলে আছামত কী একটা চোখের সামনে দিয়ে সরে গেল। এবার অস্পষ্ট দেখল একটা বিরাট পানা জল কেটে বেরিয়ে গেল। হাঙর! দেখল অতিকায় হাঙর একটু দূরে মোড় ঘুরল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বন্ধুদের দিকে যত দ্রুত সম্ভব সাঁতরে চলল। তীরের পাথরে পা রেখে শরীরের এক ঝটকা ওপরে উঠে এল। ও হাঁপাচ্ছে তখন। হ্যারি শাঙ্কো এগিয়ে এল। হ্যারি বলল–কী হয়েছে?
–একটা অতিকায় হাঙর। বীভৎস। হাঁপাতে হাঁপাতে ফ্রান্সিস বলল। এই কথা শুনে এক ভাইকিং বন্ধু জলের কাছে গিয়ে মুখ বাড়াল। জলে হাঙরের লেজটা ভেসে উঠেই প্রচন্ড জোরে আছড়ে পড়ল বন্ধুটির ওপর। মুহূর্তে বন্ধুটি ছিটকে জলে পড়ে গেল। জল আলোড়িত হল। জলে ঢেউ উঠল। পরক্ষণেই আর কোন শব্দ নেই।
ফ্রান্সিস দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে গলা চড়িয়ে বলে উঠল–সবাই জলের ধার থেকে সরে এসো। ভয়ঙ্কর হাঙর। সবাই দ্রুত সরে এলো।
–এই হাঙরটা না মেরে ওপারে যাওয়া যাবে না। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল।
বন্ধুর এই আকস্মিক মৃত্যুতে সবারই মন খারাপ হয়ে গেল। ফ্রান্সিস আবার গলা চড়িয়ে বলল–আমাদের এক বন্ধুকে এই ভয়ঙ্কর হাঙর মেরে ফেলেছে। আমি এটাকে নিকেশ করবোই। কাল দুপুরে আবার আসবো আমরা। এখন ফেরা যাক।
সারা রাস্তা কেউ কোন কথা বলল না। কারো মন ভালো নেই।
সন্ধের সময় সবাই অতিথিশালায় ফিরে এলো।
পরদিন সকালে হ্যারিকে নিয়ে ফ্রান্সিস রাজসভায় গেল। তখন বিচার চলছিল। বিচার শেষ হতে রাজা ফ্রান্সিসদের কাছে ডাকলেন।
–পাতালঘরের হদিশ করতে পারলে? রাজা জিজ্ঞেস করলেন।
–এখনও পারিনি। তবে দুতিনটি জায়গা এখনও দেখা বাকি। তারপর ফ্রান্সিস গতকালের ঘটনা সব বলল। রাজা আসিরিয়া মাথা নেড়ে দুঃখপ্রকাশ করলেন।
–মান্যবর রাজা আমাদের দশ-পনেরোটা বর্শা চাই। ফ্রান্সিস বলল।
বর্শা নিয়ে কী করবে? রাজা বললেন।
–এই ভয়ঙ্কর হাঙরটা হত্যা করবো। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমাদের কোন বিপদ না হয়। রাজা আশঙ্কা প্রকাশ করলেন।
–না। আমরা সাবধানে কাজ সারবো। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে। প্রহরীকে পাঠাচ্ছি। ও বর্শা দিয়ে আসবে। রাজা বললেন।
ফ্রান্সিসরা অতিথিশালায় ফিরে এল।
ফ্রান্সিসের নির্দেশে সবাই তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল। প্রহরী বর্শা দিয়ে গেছে। সবাই বর্শা হাতে নিল। শুধু ফ্রান্সিস একটা তরোয়াল কোমরে গুঁজে নিল।
সবাই চলল সেই পাহাড়ের দিকে। উজ্জ্বল রোদের দিন।
ফ্রান্সিসরা যখন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে তিয়েরাবাসীরা ওদের দেখে পরস্পর বলাবলি করতে লাগল সবুজ রাজা তো হেরে গেছে তবে ওরা কাদের সঙ্গে লড়াই করতে যাচ্ছে?
ফ্রান্সিসরা পাহাড়ী এলাকায় পৌঁছল। সমুদ্রের ঢেউয়ের ঝাপ্টা পার হয়ে ওরা গুহামুখে এল। তারপর গুহায় ঢুকে সেই লম্বাটে পুকুরের সামনে এল। ফ্রান্সিসের নির্দেশে একটু দূরে দাঁড়াল সবাই। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব–একটা ভয়ঙ্কর হাঙরের সঙ্গে লড়াই আজ। বন্ধুর নির্মম মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবার দিন আজ। একটু থেমে বলল–প্রথমে আমি একা জলে নামছি। হ্যারি চমকে উঠে ফ্রান্সিসের হাত চেপে ধরল। বলল–পাগল হয়েছে। নিশ্চিত মৃত্যু।
–উপায় নেই। যখন সবাই মিলে বর্শা চালাবে তখন জল রক্তে লাল হয়ে যাবে। তখন নিশানা ঠিক রেখে আক্রমণ করা যাবে না। এখন আমি পরিষ্কার জলে হাঙরটাকে দেখতে পাবো। আজকে রোদও উজ্জ্বল। ঠিক ওটার ফুসফুসে বোয়াল ঢুকিয়ে দিতে পারব। তারপর সবাই মিলে আক্রমণ। তুমি নিশ্চিন্ত হও। হাঙরের সঙ্গে এর আগেও লড়েছি। আমি ওদের মতিগতি বুঝি। আক্রমণের ফন্দীফিকির জানি। ঠিক ঘায়েল করবো ওকে। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিস তরোয়াল কোমর থেকে খুলে দাঁতে চেপে ধরল। তারপর আস্তে আস্তে জলে নামল। বন্ধুরা সবিস্ময়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল।
ফ্রান্সিস হাত পা নেড়ে জলে শব্দ করল। তারপর ডুব দিল। দেখল একটু দূরে হাঙরের মুখটা। সত্যিই বীভৎস। মুখে গায়ে কালচে শ্যাওলা জমে গেছে। সাত আট হাত দূরে একটা বড় পাক খেয়ে হাঙরটা একটু দূরে চলে গেল। অভিজ্ঞ ফ্রান্সিস বুঝল এবার হাঙরটা আক্রমণ করবে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ও হাতে পায়ে জল ঠেলে নিচে চলে এল। তখনই হাঙরটা ছুটে ওর মাথার কাছে এল। হাঙরের বিরাট পেটটা দেখল ফ্রান্সিস। ফ্রান্সিস দাঁতে চেপে ধরা তরোয়ালটা খুলে হাতে নিল। এইবার হাঙরটা এসে ওকে আক্রমন করতে উদ্যত হল। ফ্রান্সিস তৈরী ছিল। হাঙরের বুকের ফুসফুস লক্ষ্য করে ফ্রান্সিস ওর তরোয়াল বিঁধিয়ে দিল। যতটা জোরে সম্ভব। রক্ত বেরিয়ে এল। হাঙরটা বোধহয় এরকম আক্রমন আশঙ্কা করেনি। ওটা পাক খেয়ে সরে গেল।
ফ্রান্সিস আর এক মূহুর্ত দেরি করল না। ডুব সাঁতার দিয়ে দ্রুত পারের দিকে চলে এল। তারপর পারে উঠে শুয়ে পড়ে হাঁপাতে লাগল। তোমার কিছু হয় নি তো? হ্যারি ছুটে এসে জিজ্ঞেস করল। ফ্রান্সিস হাঁপাতে হাঁপাতে মাথা নাড়ল। বলল–ঠিক ফুসফুসে তরোয়াল বিধিয়েছি। এখন বর্শা দিয়ে ওটাকে মারতে হবে। সবাই তৈরী হও।
সবাই বর্শা হাতে জলের ধারে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস উঠে বলল–খুব কাছে যেও না। লেজের ঝাঁপটায় ফেলে দেবে। আর বর্শা হাত ছাড়া করোনা। কারণ অনবরত বর্শার ঘা মেরে যেতে হবে।
পাখনা দিয়ে জল কেটে আহত হাঙরটা পারের দিকে এগিয়ে এল। সবাই বর্শার ঘা মারল হাঙরটার পিঠে। দু’একটা বর্শা একেবারে গেঁথে গেল হাঙরটার পিঠে। যেগুলো খুলে আনা গেল না। পুকুরের জল রক্তে লাল হয়ে উঠল। হাঙরটা একটু– দূরে সরে গেল।
ফ্রান্সিস পার ধরে জলে নামল। জলে হাত পা নেড়ে শব্দ করে দ্রুত পারে উঠে। এল। হাঙরটা ছুটে এল। পার থেকে ভাইকিংরা দ্রুত বর্শার ঘা মারল হাঙরটার পিঠে। হাঙরটা চিৎ হয়ে গেল। এবার ওটার বুকে বর্শা বিধিয়ে দিতে লাগল।
পুকুরটার জল লাল হয়ে গেল। জল তোলপাড় করে হাঙরটা ডুবে গেল।
সবাই পারের কাছে দাঁড়াল। বসে পড়ল কেউ কেউ।
-হাঙরটা কি করছে? শাঙ্কো ফ্রান্সিসকে জিজ্ঞেস করল।
বুঝতে পারছি না। জলে নেমে দেখতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–ভুলে যেও না হাঙরটা আহত। ক্ষেপে আছে। হ্যারি বলল।
ঝুঁকি নিতেই হবে। ফ্রান্সিস বলল।
সবাই বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বসে রইল।
এবার ফ্রান্সিস জলে নামল। ডুব দিল। জল রক্তে লাল। ভালো দেখা যাচ্ছে না। একটু অপেক্ষা করে ডুব সাঁতার দিয়ে এগিয়ে গেল। তখনই অস্পষ্ট দেখল ক্ষত বিক্ষত হাঙরের বিরাট দেহটা পাথরের মেঝেয় পড়ে আছে। অনড়। তখনও সারা গা পেট থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। ফ্রান্সিস বুঝল হাঙরটা মারা গেছে। ও জলের ওপর ভেসে উঠল। হেসে বলে উঠল–একেবারে খতম। বন্ধুরা ধ্বনি তুলল–ও-হো–
ফ্রান্সিস পারে উঠে এল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–এখনও বেলা আছে। আর দেরি করবো না। এই জলাটা পার হয়ে ওপারে যাবো। তার আগে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নাও।
হাত পা ছড়িয়ে বসল সবাই। বিশ্রাম করতে লাগল। ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল রাজা আসিরিয়া বলেছিলেন না তিনজন পাতালঘরের খোঁজে বেরিয়ে জীবিত ফেরেনি। ওরা এই পুকুরের জল পর্যন্ত এসেছিল। হয়তো এটা পার হতে গিয়েছিল। হাঙরটা ওদের মেরে ফেলেছে।
— কিছুক্ষণ পর ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। একটু গলা চড়িয়ে বলল–সবার যাবার– দরকার নেই। আমি শাঙ্কো আর সিনাত্ৰা যাব।
–না ফ্রান্সিস হ্যারি বলল–আবার ওখানে যদি কোন বিপদে পড়। আমরা সবাই একসঙ্গে যাব। বন্ধুরাও অনেকে বলে উঠল–ফ্রান্সিস আমরাও যাব।
বেশ চলো। ফ্রান্সিস বলল। তারপর সিনাত্রাকে বলল–তিনটে মশাল জ্বালো। আমরা তিনজন জ্বলন্ত মশাল নিয়ে যাবো।
সিনাত্রা তিনটে মশাল জ্বালল। তিনটে মশাল হাতে নিয়ে তিনজনে জলে নামল। বাকি বন্ধুরাও জলে নামল। তিনজনে বাঁহাতে মশাল জলের ওপর তুলে ডান হাতে সাঁতরে চলল ওপারের দিকে। বন্ধুরাও সাঁতরে চলল। বন্ধ গুহার শেষ প্রান্ত এসে দেখা গেল একটা পাথরের চাঁই। — ফ্রান্সিস মশালের আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল পাথরের চাঁইটার ডানপাশে হাতখানেক ফাঁকা। পিছু ফিরে ফ্রান্সিস বন্ধুদের দিকে তাকাল। বলল–এই পাথরের চাইটা সরাতে হবে। সবাই হাত লাগাও। ফ্রান্সিস মশাল ধরে রইল। শাঙ্কো আর সিনাত্রা সেই ফাঁকটায় হাত গলিয়ে টানল। বেশ ভারি পাথরের চাই। ওরা দুজনে কিছুক্ষণ টানল। ছেড়ে হাঁপাতে লাগল। আরো দু’জন বন্ধু এগিয়ে এল। চলল পাথরের চাঁইটা ধরে টানা।
একসময় পাথরের চাইটা আস্তে আস্তে সরে এল। এবার কয়েকজন মিলে পাথরের চাই অনেকটা সরিয়ে আনল। ফ্রান্সিস মশালের আলো ফেলে দেখল একটা মসৃণ কালো পাথরের দরজা। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–পাথরের চাইটা আরো সরাও। চাইটা সবটা সরানো হতেই মশালের আলোয় ফ্রান্সিস দেখল-দরজাটায় একটা মস্তবড় লোহার কড়া ঝুলছে। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–বাকি দুটো মশাল নিয়ে এসো। শাঙ্কো আর সিনাত্রা মশাল নিয়ে এগিয়ে এল। তখনই দেখা গেল গোল কড়াটার মাঝখানে কীসের চিহ্ন। একনজর দেখেই ফ্রান্সিস চেঁচিয়ে উঠল–হ্যারি এটাই পাতালঘর। ফ্রান্সিসের কথা গুহায় প্রতিধ্বনিত হল। হ্যারি এগিয়ে এসে পাথরের দরজার গায়ে কুঁদে-তোলা শীলমোহর দেখে বলে উঠল–এটাই তো রাজা আসিরিয়ার শীলমোহর।
-হ্যাঁ। রাজা আসিরিয়ার পূর্বপুরুষ রাজা সার্মেননা প্রচলিত শীলমোহর। এবার এই দরজা খুলতে হবে। সবাই হাত লাগাও।
চার-পাঁচজন বন্ধু এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস মশাল ধরে রইল। কিছুক্ষণ কড়া ধরে টানলে ওরা। ছেড়ে দিয়ে হাঁপাতে লাগল। এবার আরো চার-পাঁচজন মিলে টানল। দরজার ডানদিকে সঁক দেখা গেল। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলে উঠল–সবাই তাড়াতাড়ি সরে এসো। বিষাক্ত বাতাস বেরোতে পারে।
সবাই দ্রুত সরে এল। দরজার সেই ফাঁক লক্ষ্য করে ফ্রান্সিস মশালটা ছুঁড়ে দিল। দপ্ করে আগুন জ্বলে উঠে ভেতরেও আগুন ছড়িয়ে গেল। দরজার ফাঁক দিয়ে আগুন ধোঁয়া বেরিয়ে আসতে লাগল। সবাই দূরে সরে গিয়েছিল। কাজেই আগুন ওদের, কোন ক্ষতি করতে পারল না।
ভেতরে আগুন নিভল। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে দরজার ফাঁকের কাছে গেল। চোখ কুঁচকে ভেতরে তাকাল। একটা ঘরমত দেখা যাচ্ছে। অস্পষ্ট দেখা গেল ঘরের মাঝখানে একটা সিংহাসন। সিংহাসনের ওপর কিছু আছে।
ফ্রান্সিস মুখ ফিরিয়ে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল–ভেতরে একটা ঘরমত দেখা যাচ্ছে। এখন দরজা সবটা খুলতে হবে। হাত লাগাও।
লোহার বড় কড়াটা ধরে আবার টানটানি শুরু হল। একসময় দরজা সবটা খুলে গেল। শাঙ্কোর হাত থেকে মশাল নিয়ে ফ্রান্সিস ঘরটায় ঢুকে পড়ল।
এক আশ্চর্য দৃশ্য। সোনার মোটা পাতে মোড়া একটা সিংহাসন ঠিকঘরের মাঝখানটায়। তার ওপর বসা অবস্থায় একনরকঙ্কাল। হাত দুটো হাতলে রাখা।
সবাই ঘরটায় ঢুকে পড়েছে তখন। দেখা গেল ঘরটার দেয়ালগুলো মসৃণ পাথরের। তাতে নানা রঙের মূল্যবান হীরে মনিমানিক্য গাঁথা। সোনার সিংহাসনের গায়ে ফুল লতাপাতার কারুকাজ। সবাই অবাক হয়ে চারদিক তাকিয়ে দেখতে লাগল।
ফ্রান্সিস কত গুপ্তধন খুঁজে উদ্ধার করেছে। সেই ফ্রান্সিসও এই দৃশ্য দেখে অবাক হল। বুঝল নরকঙ্কালটি রাজা সামেনোর। সবাই ধ্বনি তুলতে ভুলে গেল। কিন্তু হ্যারি উল্লাসধ্বনি তুলল–ও-হো-হো। এবার সবাই আনন্দে গলা। মেলাল। গুহার গায়ে সেই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হল।
এবার ফেরার পালা। কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে ফ্রান্সিস পাথরের দরজাটা বন্ধ করে দিল।
জলে সাঁতার কেটে সবাই পারে এসে উঠল। তারপর গুহা থেকে বেরিয়ে এল। সবাই রাজবাড়ির দিকে চলল। হ্যারি ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল–এখন রাজাকে পাতালঘর আবিষ্কারের কথা বলবে না?
না। এখনই সব জানাবো না। কাল সকালে রাজসভায় বলবো। জানাজানি হয়ে গেলে অরক্ষিত গুহাটা দেখতে রাতেই লোকজন ছুটবে। আজ রাতটা চুপ করে থাকবো। কালকে রাজাকে বলবো আর সুরক্ষিত রাখতেও বলবো। আজ রাতটুকু বিশ্রাম। ঘুম। ফ্রান্সিস বলল।
পরের দিন সকালে ফ্রান্সিস হ্যারিকে নিয়ে রাজসভায় গেল।
আজকে কোন বিচার চলছিল না। রাজা আসিরিয়া ফ্রান্সিসকে কাছে আসতে ইঙ্গিত করলেন। ফ্রান্সিস এগিয়ে এল।
–পাতালঘর বোধহয় খুঁজে বের করতে পারো নি। রাজা বললেন।
না। খুঁজে পেয়েছি। ফ্রান্সিস বলল।
–বলো কি। রাজা অবাক।
এবার ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে সমস্ত ঘটনা বলল। রাজা আসিরিয়া সব শুনে কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারলেন না। পরে বললেন,
-তোমরা বেশ চিন্তা করে কষ্ট করে আমাদের পূর্বপুরুষ রাজা সার্মেনোর সম্পদ উদ্ধার করেছে। শত্রুর হাত থেকে আমার রাজ্য উদ্ধার করে দিয়েছে। কী বলে যে আমি কৃতজ্ঞতা জানাবো।
-না মান্যবর রাজা। গুপ্ত ধনসম্পদ উদ্ধার করতে আমরা ভালোবাসি। তাই বুদ্ধি খাটিয়ে উদ্ধার করেছি। সবুজ রাজার সঙ্গে লড়াইয়ে আপনাকে সাহায্য করেছি, আপনি একজন মহানুভব রাজা বলে। কিন্তু দুঃখ এই যে আপনার সব প্রজাদের রক্ষা করতে পারিনি। ফ্রান্সিস বলল।
-চেষ্টা তো করেছে। সেটাই বা কম কী। রাজা বললেন।
এবার তাহলে সমুদ্রতীরে ফিরে যাচ্ছি। ফ্রান্সিস বলল।
-কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষ রাজা সার্মেনো জলদস্যুতা করে সম্পদ সঞ্চয় করেছিলেন। আগেই বলেছি সেই ধনসম্পদের প্রতি আমার কোন লোভ নেই। চাইলে তোমাদের সব দিয়ে দিতে পারি। রাজা বললেন।
আমরা তো কিছুই নেবো না। তাই বলি ঐ সোনার সিংহাসন, মণিরত্ন বিক্রি করে যে অর্থ পাবেন তাই দিয়ে আপনার প্রজাদের মঙ্গল করুন। প্রজাদের জন্যে অনেক কিছুই করতে পারেন আপনি। ফ্রান্সিস বলল।
রাজা মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর মাথা তুলে বললেন–ঠিক আছে। তোমার কথাই আমি মেনে নিলাম। প্রজাদের দুঃখদৈন্য দূর করতে এই মূল্যবান সম্পদ কাজে লাগাবো। তোমাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি অতিথিশালায় ফিরে এল। ফ্রান্সিস বন্ধুদের সব বলল। তারপর বলল-দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে আমরা সমুদ্রতীরের দিকে যাত্রা করবো। সবাই তৈরী হয়ে নাও।
দুপুরে খাওয়াদাওয়া সারল ওরা। তারপর রাস্তায় নেমে এল। বালিভরা রাস্তা দিয়ে চলল সমুদ্রতীরের দিকে। যেতে যেতে দেখল তিয়েরাবাসীরা দলে দলে ছুটেছে সমুদ্রের ধারের পাহাড়ী এলাকার দিকে। পাতালঘর আবিষ্কারের কথা এখন বোধহয় তারা জেনে গেছে।
–এত লোক যাচ্ছে রাজা নিশ্চয়ই গুহাটা পাহারার ব্যবস্থা করেছেন। হরি বলল।
নিশ্চয়ই। সিংহাসনে বসা নরকঙ্কাল–এটা কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার। ফ্রান্সিস বলল।
–অদ্ভুত বলে অদ্ভুত। আমি তো ভীষণ চমকে উঠেছিলাম। হ্যারি বলল।
বন্ধুদের নিয়ে ফ্রান্সিস যখন সমুদ্রতীরে পৌঁছল তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। বালিয়াড়িতে দুটো নৌকোই তোলা ছিল। নৌকোয় চড়ে দফায় দফায় ফ্রান্সিসরা জাহাজে উঠতে লাগল।
জাহাজে ছিল মারিয়া, ভেন আর এক অসুস্থ বন্ধু। তিনজনেই রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়েছিল। ফ্রান্সিস হেসে বলল–মারিয়া এবারও আমার হাত খালি। মারিয়া হেসে বলল–তোমরা অক্ষত শরীরে ফিরে এসেছো এটাই আমার কাছে অনেক। ফ্রান্সিস অসুস্থ বন্ধুটিকে জিজ্ঞেস করল-কেমন আছো?
ওদের বদ্যি ভেন বলল–ও এখন সুস্থ। তোমাদের সঙ্গে যেতে পারল না। খুবই দুঃখ ওর।
–পরের বার নিয়ে যাবো। আমরাও দুঃখ পেয়েছি। এক বন্ধুকে হারিয়েছি। ফ্রান্সিস বলল।
ওদিকে শাঙ্কো তখন হাত পা নেড়ে মারিয়াকে পাতালঘর আবিষ্কারের কথা বলছে।