Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সোনার মেডেল || Shirshendu Mukhopadhyay

সোনার মেডেল || Shirshendu Mukhopadhyay

বিকেলের দিকে বাবু মিত্তির

বিকেলের দিকে বাবু মিত্তির চিঠিটা পেলেন। তাঁর দরোয়ান রাম পহলওয়ান এই সময়টায় রোজ তাঁকে এক গেলাস ঘোলের নোনতা শরবত খাওয়ায়। শরবতের সঙ্গে চিঠিটাও সে দিয়ে গিয়েছিল।

বাবু মিত্তির সব কাজই নিখুঁতভাবে করতে ভালবাসেন। সাবধানে ছোট কাঁচি দিয়ে খামের মুখটা কেটে চিঠিটা বের করলেন। দামি সাদা কাগজে টাইপ করা রোমান হরফে গীতার একটা শ্লোকের খণ্ডাংশ, “বাসাংসি জীণানি যথা বিহায়–ডেল্টা।“

শরবতটা আর খাওয়া হল না। তিনি উঠলেন। বাবু মিত্তির আজকাল সব কাজই করেন খুব ধীর গতিতে। খেতে, পোশাক পরতে, চলাফেরা করতে তাঁর অনেকটা সময় লাগে। কেউ বিশ্বাসই করবে না যৌবনকালে এই বাবু মিত্তিরের চলাফেরা ছিল বাঘের মতো, বিদ্যুতের মতো, সাপের মতো। সাহেবরা তাঁর নামই দিয়েছিল কোব্রা।’

বক্সার বাবু মিত্তির অলিম্পিকে গিয়েছিলেন। লাইট হেভিওয়েটে সোনার মেডেলটা জেতার দুর্দমনীয় বাসনা ছিল। প্রথম তিন লড়াইতে প্রতিটিতে তাঁর প্রতিপক্ষ এক বা দুই রাউন্ডে নক আউট হয়ে যায়। চার নম্বর লড়াইয়ের আগে পেটের অসহ্য যন্ত্রণায় তিনি রিং-এ নামতে পারেননি। নামতে পারলে, ভারতের দীর্ঘদিনের একটা বদনাম ঘুচত।

কিন্তু পেটের ব্যথাটা কেন হয়েছিল সে বিষয়ে বাবু মিত্তির খুব নিশ্চিত নন। সাবোটাজ? ষড়যন্ত্র? এ ছাড়া আর কীই বা হবে? অলিম্পিক ভিলেজে ভারতীয় শিবিরে তাঁর তেমন শত্ৰু কি কেউ ছিল? বোধ হয় না। তবে এ-কথা ঠিক যে, ভাল ব্যবহারের জন্য বাবু মিত্তিরের মোটেই সুনাম ছিল না। রাগী, রগচটা, মারকুট্টা, স্পষ্টবক্তা, দুর্মুখ বাবু মিত্তিরকে কেউ পছন্দ করত না, সবাই এড়িয়ে চলত। কিন্তু তা বলে খাবারে গণ্ডগোল ঘটাবে এমন কেউ ছিল না। রহস্যটা আজও বাবু মিত্তিরের কাছে রহস্যই থেকে গেল। অলিম্পিক ভিলেজে খেলোয়াড়দের খাবারদাবারের ব্যাপারে খুবই সতর্কতা থাকে। তবু কী করে যেন বাবু মিত্তিরের খাবারে মৃদু কোনও বিষ মেশানো হয়েছিল। কোন খাবারটিতে বিষটা ছিল, তা তিনি জানেন না, অনেক ভেবেছেন।

বাবু মিত্তির খুব ধীরে-ধীরে পোশাক পরলেন। আজকাল ধুতি আর কামিজ ছাড়া বিশেষ কোনও পোশাকই নেই তাঁর। পোশাক পরে পায়ে চটিটা গলিয়ে ধীরে-ধীরে দোতলা থেকে নেমে গ্যারাজ থেকে পুরনো অস্টিন গাড়িটা বের করলেন। গাড়ি আজও তিনি নিজেই চালান।

গাড়ি ছাড়বার আগে একবার নিজের বাড়িটার দিকে ফিরে চাইলেন তিনি। প্রকাণ্ড তিনতলা বাড়ি। অন্তত পনেরোটা শোওয়ার ঘর, দুটি বৈঠকখানা, একটা নাচঘর, দুটো ডাইনিং হল আছে। বাবু মিত্তির মারা গেলে এ বাড়ি বেওয়ারিশ হয়ে যাবে। তাঁর কোনও উত্তরাধিকারী নেই, থাকলেও যে কোথায় আছে তা তিনি জানেন না।

মরবার যে আর খুব বেশি দেরি নেই, তা বাবু মিত্তির জানেন। যে-চিঠিটা তিনি এইমাত্র পেলেন, সেটি ফাঁকা তাওয়াজ বা রসিকতা নয়।

যৌবনকালে বড়ই দুর্দান্ত মানুষ ছিলেন তিনি। প্রচণ্ড গুণ্ডামি করে বেড়াতেন। খুন না করলেও জখম করেছেন বিস্তর। সাহস ছিল, প্রচণ্ড রাগ ছিল। কিন্তু একটা গণ্ডগোলে পড়ে গিয়েছিলেন একবার। মুষ্টিযুদ্ধ ছেড়ে তখন তিনি সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু পৃথিবী-ভ্রমণের জন্য যথেষ্ট টাকা বা বিদেশি মুদ্রা তাঁর ছিল না। খুব কষ্ট করে এবং আইন ও আন্তজাতিক নিয়মকানুনকে ফাঁকি দিয়েও তিনি দেশে-দেশে ঘুরতেন।

আর্জেন্টিনায় সেবার একটা লোকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়ে যায়। বাবু মিত্তিরের চমৎকার পেটানো চেহারা, তেজ ও সাহস দেখে সেই লোকটা বলে, তোমাকে উপযুক্ত কাজ দিতে পারি। যথেষ্ট টাকা পাবে। কিন্তু খুব সাবধান, বেইমানি কোরো না।

অর্থাভাব এবং অনিশ্চয়তায় জেরবার বাবু মিত্তির লোকটার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। সেই লোকটাই ছিল ডেল্টা নামে ছোট একটি টেররিস্ট সংগঠনের নায়ক। তবে তাদের কোনও বিশেষ মতাদর্শ ছিল না। টাকা পেলে তারা নেতা, ভি আই পি বা বাণিজ্যিক সংস্থার কর্ণধারদের খুন করত। সোনা, অস্ত্র, নেশার জিনিস চোরাপথে চালান দিত।

এই সংগঠনে বছরখানেক ছিলেন বাবু মিত্তির। ওই এক বছরে গোটা দক্ষিণ আমেরিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ চষে বেড়িয়েছেন ডেল্টার বিভিন্ন কাজে। প্রচুর টাকাও পেয়েছিলেন। কিন্তু মেক্সিকোর এক অভিজাত নৈশভোজের নাচের আসরে একজন ইউরোপিয়ান শিল্পপতিকে খুন করার চুক্তি কার্যকর করতে গিয়ে বাবু মিত্তিরের সঙ্গী রাউল নিরাপত্তারক্ষীদের গুলিতে মারা যায়, এবং বাবু মিত্তির পালান।

পালানোর একটা সুযোগ কিছুদিন যাবৎ খুঁজছিলেন তিনি। ডেল্টার হয়ে কয়েকটা খুনের ঘটনায় তাঁকে অংশ নিতে হয়েছে। সমাজবিরোধী আরও নানা পাপ কাজ করতে হচ্ছে। এ-জীবন ঠিক তাঁর পছন্দ হচ্ছে বা। তিনি ভেবেছিলেন, কলকাতায় চলে গেলে ডেল্টা আর কিছু করতে পারবে না। অত লম্বা হাত বা বড় সংগঠন তাদের নেই যে, ভারতবর্ষে ধাওয়া করবে।

প্রচুর বিদেশি টাকা নিয়ে প্রথম আফ্রিকায় আর তারপর সোজা কলকাতায় চলে আসেন তিনি। বিশ্বভ্রমণের সাধ তখন মিটে গেছে।

একটু বয়সও হচ্ছে। তিনি বিয়ে করে সংসারে মন দিলেন।

কিন্তু সংসারে মন দিলেও নিজের চড়া মেজাজ এবং উগ্র কথাবার্তার দরুন সংসারে খুব অশান্তি ছিল। একটি ছেলে হয়েছিল বাবু মিত্তিরের। তার নাম রেখেছিলেন সর্বকালের সেরা একজন মুষ্টিযোদ্ধার নামানুসারে, রকি মিত্র। ইচ্ছে ছিল ছেলেকে বক্সার বানাবেন। এমন বক্সার যে, একদিন বিশ্বচ্যাম্পিয়ান হবে।

কিন্তু বাবু মিত্তিরের সেই সাধ পূর্ণ হয়নি। খুব শিশুকাল থেকেই বক্সিং-এ তালিম দিতে গিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন, ছেলেটা তার মায়ের স্বভাব এবং চরিত্র পেয়েছে। রকির মা শান্ত, নিরীহ, গম্ভীর এবং একটু

জেদি। রকিও তাই। রকি গান গায়, ছবি আঁকে। বক্সিংও করে, তবে তেমন রোখ নিয়ে নয়।

দশ বারো বছর বয়সেই রকিকে তিনি কম্পিটিশনে নামাতেন। রকি কখনও জিতত, কখনও হেরে যেত। হারত অন্যমনস্কতার দরুন। খুব রেগে গিয়ে ছেলেকে বেদম মারতেন তিনি।

ঠিক যোনো বছর বয়সে রকির মা মারা যান। মায়ের শ্রাদ্ধ করার পরদিনই রকি বাড়ি থেকে চলে যায়। শুধু একটা চিঠি রেখে যায় বাবার নামে। চিঠিতে লেখা ছিল, “আমাকে খুঁজে লাভ নেই। আমি চিরতরে চলে যাচ্ছি।”

বাবু মিত্তির অবশ্য খুঁজতে কসুর করেননি। লাভ হয়নি তাতে।

ছেলে নিরুদ্দেশ, স্ত্রী মৃতা। বাবু মিত্তির যখন সম্পূর্ণ একা হয়ে গেলেন তখনই ধীরে-ধীরে তাঁর শরীরে নানা ব্যাধি এসে বাসা বাঁধে। বক্সারদের মাঝে-মাঝে যে রোগটা হয় সেই পারকিনসন্স ডিজিজও তাঁকে কিছুটা কাহিল করেছে। বারবার মাথায় প্রতিপক্ষের জোরালো ঘুসি লাগলে মস্তিষ্কের সূক্ষ্ম কোষ আর স্নায়ুর ক্ষতি হতেই পারে।

এখন সঙ্গী বলতে পহলওয়ান দরোয়ান, পরিচারক রাখাল, আর তাঁর একটি কুকুর। অবশ্য তাঁর কিছু ছাত্রও তাঁর কাছে রোজই আসে। তিনি আজও তাঁদের বক্সিংয়ের কলাকৌশল শেখান।

বাবু মিত্রের টাকার অভাব নেই। মেক্সিকো থেকে পালিয়ে এসেই তিনি একটা ইলেকট্রনিক্সের ব্যবসা করে প্রচুর বড়লোক হয়ে যান। কিছুদিন হল ফলাও ব্যবসাটা বিক্রি করে দিয়েছেন। আর পয়সা করে লাভ নেই। খাবে কে?

রকি নিরুদ্দেশ হওয়ার পর দশ বছর কেটেছে। সে কোনও চিঠি বা খবর দেয়নি। রকির মুখটাই তাঁর আর ভাল মনে নেই।

সাবধানে গাড়ি চালিয়ে তিনি তাঁর উকিল বন্ধু গজপতির বাড়িতে এসে হাজির হলেন। গজপতি এখনও কোর্ট থেকে ফেরেননি। ভৃত্য তাঁকে নিয়ে খাতির করে বাইরের ঘরে বসাল। বাবু মিত্তির খুবই অন্যমনস্ক হয়ে চুপ করে বসে রইলেন।

গজপতি ব্যস্ত উকিল। ফিরতে মাঝে-মাঝে রাত হয়ে যায়। কিন্তু সেজন্য বাবু মিত্তির ধৈর্যহারা হলেন না। বসেই রইলেন।

গজপতি এলেন সন্ধে সাতটারও পর। “আরে মিত্তির যে! কী খবর?” বাবু মিত্তির বিনা ভূমিকায় বললেন, “গজপতি, আমার কি উইল করা দরকার?”

গজপতি অবাক হয়ে বলেন, “উইল! হঠাৎ উইলের কথা কেন?”

“আমি হয়তো আর বেশিদিন বাঁচব না।”

“কেন, যমরাজা কি কোনও পেয়াদার হাতে নোটিস পাঠিয়েছে?”

একটুও না-হেসে বাবু মিত্তির বললেন, “পাঠিয়েছে।”

“তা হলে যমের বাড়ি যাওয়ার জন্য প্লেনের টিকিট কিনে ফেলেছ?”

“একরকম তাই।”

“বলি, কোনও রোগটোগ হয়েছে নাকি? টার্মিনাল ডিজিজ? ক্যানসার বা হার্ট?”

“না। ইনিয়ে-বিনিয়ে মরা আমার ভাগ্যে নেই। আমি মরব দুম করে।”

গজপতি বসলেন। তারপর মৃদু একটু হেসে বললেন, “খুলে বলো।”

বাবু মিত্তির খুলে বললেন না। বলে লাভও নেই। শুধু বললেন, “আমার আয়ু সত্যিই আর নেই। মরতে আপত্তিই বা কী? কার জন্য বাঁচব? শুধু বিষয়সম্পত্তি নিয়ে একটা উদ্বেগ আছে। আমি মরার পর এগুলো পাঁচ ভূতে লুটে খাবে।”

“তোমার বয়স তো পঞ্চান্নছাপ্পান্নর বেশি নয় হে মিত্তির। এখনই। মরবে কেন?”

“মরতে বয়স লাগে না। ওসব কথা থাক। আমি চাই আমার টাকা-পয়সা, বিষয়-আশয় আমার ছেলেটা এসে ভোগ করুক। কিন্তু সে বেঁচে আছে কি না তা জানি না, যদি বেঁচে থেকে থাকে তবে হয়তো দুঃখ কষ্টেই আছে। আমি চাই সম্পত্তিটার এমন একটা বন্দোবস্ত করে যেতে, যাতে সে কোনওদিন ফিরে এলে ভোগদখল করতে পারে।”

গজপতি সামান্য চিন্তিত হয়ে বলেন, “উইল করতে পারো। তবে

উইল না করলেও আইনত ছেলেই পাবে। যেটা সবচেয়ে বড় দরকার তা হল রকির খোঁজ।”

“অনেক খুঁজেছি।”

“পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দিতে পারো।”

বাবু মিত্তির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “কোনও পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে বাদ রাখিনি। নিরুদ্দেশ হওয়ার পর টানা এক বছর প্রায় প্রতি রবিবার সব কাগজে বিজ্ঞাপন বেরোত।”

“সেটা আমি জানি। তবু বলছি, এখন আবার বিজ্ঞাপন দাও। সে হয়তো এতদিনে অভিমান ভুলেছে। রাগও কমেছে। দেখই না দিয়ে।”

“তুমি যখন বলছ, দেব। কিন্তু ধরো, যদি হঠাৎ আজ কিংবা কাল–আমার মৃত্যু হয় তা হলে কী হবে?”

গজপতি অবাক হয়ে বলেন, “আজ বা কাল! কেন, মরার এত তাড়া কিসের হে? এত তাড়াহুড়োর তো কিছু নেই। দু-চারদিন সবুর করে তারপর না হয় মরবে।”

বাবু তাঁর পকেট থেকে চিঠিটা বের করে নিঃশব্দে গজপতির হাতে দিলেন।

গজপতি চিঠিটায় চোখ বুলিয়ে একটু ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “এটার মানে কী? কিছু তো বুঝতে পারছি না।”

রোমান হরফে লেখা গীতার একটা শ্লোক।

“বাসাংসি জীনি যথা বিহায়–ডেল্টা! শ্লোকটার মানে তো জানি। মানুষ যেমন জীর্ণ বাস পরিত্যাগ করে…। তা বেশ তো, জীর্ণ বাস ত্যাগ করতে কেউ তোমাকে উপদেশ দিচ্ছে। কিন্তু সেই উপদেশ তুমি নিতে যাচ্ছ কেন?”

চিঠিটা ফেরত নিয়ে পকেটে ভরে বাবু মিত্তির বললেন, “তুমি চিঠিটার আসল অর্থ জানো না।”

“ডেল্টা কথাটার অর্থ কী?”

“ব-দ্বীপ।”

“সে তো বাচ্চা ছেলেও জানে। কিন্তু এখানে কী অর্থে প্রয়োগ হয়েছে? চিঠিটা দিলই বা কে?”

“সবটা তোমাকে বলা যাবে না। আমার একটা বিশ্রী অতীত আছে। খুব ভয়ঙ্কর সেই অতীত। ডেল্টা একটা আন্তর্জাতিক সংগঠন। আগে ছোট ছিল। এখন বিশাল আকার নিয়েছে।”

গজপতি হঠাৎ চিন্তিত মুখে বললেন, “ডেল্টা! ডেল্টা! দাঁড়াও, বোধ হয় ‘টাইম’ ম্যাগাজিনে একটা খবর পড়েছি, তাতে এ নামটা যেন ছিল!”

“ঠিকই ধরেছ, টাইম ম্যাগাজিন আমিও পড়ি। কিছুদিন আগে ডেল্টার গুপ্তঘাতকেরা নিউ ইয়র্কে একজনকে দিনে-দুপুরে মারে।”

গজপতি উদ্বেগের সঙ্গে বলেন, “এরাও কি তারাই?”

“তারাই। আমি একসময়ে ওদের মেম্বার ছিলাম। পালিয়ে এসেছিলাম। আজও ওরা প্রতিশোধের কথা ভোলেনি।”

গজপতি অবাক হয়ে বাবুর দিকে চেয়ে বলেন, “কিন্তু সংস্কৃত শ্লোক ওরা কোথায় পেল?”

বাবু মিত্তির মলিন একটু হাসলেন, “গীতা একটি আন্তজাতিক গ্রন্থ। সবাই খোঁজ রাখে। আমি ভারতীয় বলেই ওরা গীতা থেকে লাগসই একটা শ্লোকের কিছুটা তুলে দিয়েছে। অর্থ পরিষ্কার। আমাকে জীর্ণ বাসটি ত্যাগ করতে হবে। অর্থাৎ

“অর্থাৎ মৃত্যু?”

“এবার তোমার মাথা খেলছে।”

“ব্যাপারটা কি সত্যিই সিরিয়াস মিত্তির?”

“আমি ডেল্টাকে যতদূর চিনি, তাতে এই পরোয়ানাকে অমোঘ বলে ধরে নিতে পারো। আমাকে ওরা মারবেই। সেটা কবে বা কখন তার কিছু ঠিক নেই। আমার মনে হয়; ওরা দেরি করবে না। আমি একা মানুষ, অসুস্থ, নিজেকে রক্ষা করার মতো ক্ষমতা আমার নেই। ওদের কাজটা খুবই সহজ হবে।”

গজপতি একটু ভাবলেন। বাবু মিত্তির ধৈর্য হারিয়ে বললেন, “কী ভাবছ গজপতি? ভাববার সময় কিন্তু নেই।”

গজপতি বললেন, “না ভেবে পরামর্শ দেওয়া যায় নাকি?”

“তা হলে চটপট ভাবো। আমার যে সময় নেই।”

গজপতি ভ্রু কুঁচকে বললেন, “তোমার ওই চিঠিটাকে যদি সিরিয়াস বলে ধরেও নিই তা হলে অনুমান করতে পারি যে, ওরা তোমাকে খুন করতে বিদেশ থেকেই খুনি পাঠাবে। তাতে তো একটু সময় লাগার কথা। বিদেশ থেকে যে খুনটা করতে আসবে তাকে তো আগে এ-দেশের ঘাঁতঘোঁত জানতে হবে, নিজেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করে তবেই তো সে খুনটা করবে, নাকি?”

বাবু মিত্তির মাথা নেড়ে বললেন, “তা নয়। আগে এ-দেশে ওদের অর্গানাইজেশন ছিল না। আজকাল হয়েছে।”

“কী করে বুঝলে?”

“খুব সোজা। যেসব দেশে বহু ছেলে-ছোঁকরা বেকার বসে থাকে, যাদের ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই তারা রুজি-রোজগারের ধান্দায় যে-কোনও কাজে নামতে রাজি হয়ে যায়। আমি যখন ডেল্টায় ছিলাম তখন দেখেছি, অনুন্নত এবং গরিব দেশগুলোয় কত তাড়াতাড়ি অগানাইজেশনকে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। আজকাল অপরাধও একটা ভাল জীবিকা।”

“তা হলে তুমি বলতে চাও ওরা এ-দেশেরই কাউকে এ কাজে লাগাবে?”

“সেটাই স্বাভাবিক।”

“তুমি কি জানো যে, ভারতবর্ষে ওদের অর্গানাইজেশন আছে?”

বাবু মিত্তির ম্লান হেসে বললেন, “তুমি ব্যস্ত উকিল, তাই বেশি খবর রাখো না। আমি কিন্তু বেকার মানুষ, হাতে অঢেল সময় বলে প্রচুর দেশি-বিদেশি ম্যাগাজিন পড়ি। ডেল্টা গত দু বছরে দিল্লি, বোম্বাই আর কলকাতায় ছড়িয়ে পড়েছে।”

এবার গজপতি খুবই উদ্বিগ্ন মুখে বাবুর দিকে চেয়ে থেকে বললেন, “তা হলে আপাতত তুমি বাড়িটা ছেড়ে কিছুদিন গা-ঢাকা দাও।”

বাবু মিত্তির মাথা নেড়ে বললেন, “লাভ নেই। ওদের যতদূর জানি এ চিঠি দেওয়ার আগে থেকেই ওরা আমাকে স্পট করেছে এবং নজরে রেখেছে। এই যে আমি তোমার কাছে এসেছি, ফেরার পথে হয়তো একটা মস্ত ট্রাক আমাকে গাড়িসমেত পিষে দিয়ে যাবে। কিংবা ডেল্টার লোক হয়তো আমার বাড়িতে কোনও অছিলায় ঢুকে আমার জলের কুঁজোয় সায়ানাইড মিশিয়ে দিয়ে যাবে। ইট উইল নট বি এ হিরোইক ডেথ ফর মি।”

গজপতি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, “গুলিটুলি করবে না বলছ?”

“গুলিতে শব্দ হয়। খুনের প্রমাণ থাকে। ডেল্টা অত কাঁচা কাজ করে না। আজকাল তারা খুব স্কিলফুল কিলার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাফিয়াদেরও পিছনে ফেলে দিচ্ছে। শোনো, আমার মৃত্যু নিয়ে দুশ্চিন্তা কোরো না। ওটা ঘটবেই। আমি শুধু বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে তোমার পরামর্শ চাই।”

গজপতি বিষণ্ণ মুখে বলেন, “বিষয়-সম্পত্তির বিলিব্যবস্থা করতেও তো একটু সময় চাই। তুমি যা বলছ, তাতে তো সময় একদম নেই। আচ্ছা, একটা কাজ করলে কেমন হয়?”

“কী কাজ?”

“কিছুদিনের জন্য যদি একজন বডিগার্ড রাখো?”

“কী লাভ? আমি যাকে বডিগার্ড রাখব তাকেও বিপদে ফেলে দেওয়া হবে। বাধা দিলে খুনি কি তাকেও ছাড়বে ভাবছ?”

“বডিগার্ডদের তো সেই ঝুঁকি নিতেই হবে। নইলে আর বডিগার্ড কিসের?”

“আমি কাউকে বিপন্ন করতে চাই না। বডিগার্ডের সাধ্যও নেই ডেল্টার খুনির হাত থেকে আমাকে রক্ষা করবে।”

গজপতি হতাশ গলায় বলেন, “তুমি চিরকালের গোঁয়ারগোবিন্দ, সবাই জানে। কিন্তু একটা কথা বুঝবার চেষ্টা করো। যদি ডেল্টার হুমকিটা সত্যিকারের হয় তা হলেও তোমার বিষয়-সম্পত্তির বিলিব্যবস্থার জন্য কিছু সময় দরকার। বডিগার্ড রাখলে হয়তো তোমার খুনি চট করে এগোবে না, একটু ভাববে। এবং নতুন ফন্দি আঁটবে। সেই ফাঁকে তুমি কিছু সময় পেয়েও যেতে পারো। আর একটা কথা হল, সবসময়েই এক জোড়ার চেয়ে দু জোড়া চোখ ভাল। তোমার গার্ড যদি একজন ইয়ংম্যান হয় তা হলে তার রিফ্লেক্স বা রি-অ্যাকশন তোমার চেয়েও অনেক বেশি ভাল হবে।”

বাবু মিত্তির কথাটা ভাবলেন। তাঁর নাম ছিল কোব্রা। সেই যৌবনের দিনে তাঁর চকিত রিফ্লেক্স, দুরন্ত গতি, দুর্দমনীয় শক্তি প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করে দিত। আজ সেই বাবু মিত্তিরকেই কিনা বডিগার্ডের ওপর নির্ভর করতে হবে? বাবু মিত্তিরের শরীর বা মস্তিষ্ক সবই গেছে বটে, কিন্তু অহঙ্কারটুকু এখনও আছে। প্রস্তাবটা তাঁর অহঙ্কারে আঘাত করছিল।

সেটা অনুমান করেই বোধ হয় গজপতি খুব নরম গলায় বললেন, “বডিগার্ড থাকলে তোমার তো একজন সঙ্গীও হবে। সারাদিন তো বাড়িতে চুপচাপ বসে থাকো, একজন সঙ্গী থাকলে তো একা লাগবে না। একটু কথাবার্তা বলতে পারবে, মাথাটা হালকা হবে।”

বাবু মিত্তির গম্ভীর মুখে বললেন, “আমি একাই ভাল থাকি। তুমি

তো জানোই, কথাবার্তা আমি পছন্দ করি না।”

“জানি। তুমি একটু অদ্ভুত লোক। কিন্তু পরিস্থিতি বিচার করে তোমার বডিগার্ড রাখতে রাজি হওয়া উচিত।”

বাবু মিত্তির ভ্রু কুঁচকে বললেন, “আচ্ছা, তুমি কোনও বেকার যুবককে এই ফাঁকে কিছু রোজগার করিয়ে দিতে চাইছ না তো! তোমার তো আবার পরোপকার করে বেড়ানোর অভ্যাস আছে।”

গজপতি খুব হাঃ হাঃ করে হাসলেন। তারপর বললেন, “অনুমানটা খুব ভুল হয়নি তোমার। আমার হাতে সত্যিই একটা ছেলে আছে। কিছুদিন মিলিটারিতে কাজ করে এসেছে। খুব সৎ ছেলে। খুব সাহসী আর বিশ্বাসী। দায়িত্বজ্ঞানও ভালই আছে। সবচেয়ে বড় কথা বাঙালির ছেলে হয়েও এ-ছেলেটি অ্যাডভেঞ্চার ভালবাসে।”

ভ্রূ কুঁচকে বাবু বললেন, “বেতন কত নেবে? বেশি হলে দরকার নেই।”

গজপতি মাথা নেড়ে বললেন, “তুমি বড্ড কেপ্পন লোক হে। যেখানে প্রাণ নিয়ে টানাটানি সেখানে পয়সা নিয়ে ভাবছ। তবে ভয়ের কারণ নেই। এ ছেলেটির পয়সার ভাবনা নেই। প্রাণগোপাল রায়ের নাম শুনেছ? হাওড়ায় বিরাট লোহার কারখানা। কোটিপতি মানুষ। পলাশ তারই ছোট ছেলে। সে তোমাকে পাহারা দেবে বিনা পারিশ্রমিকে। তার খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা রাখলেই হবে।”

বাবু মিত্তির উঠে পড়লেন। বললেন, “কাছারিঘরে বোধ হয় তোমার মক্কেলরা জুটতে শুরু করেছে। আমি আর তোমার সময় নষ্ট করব না, তোমার সুবিধেমতো ছেলেটাকে পাঠিয়ে দিয়ো। শুধু বলে দিয়ে যেন বেশি বকবক না করে।”

“তাই হবে। সে বেশি কথার মানুষ নয়। আর শোনো, তোমার ছেলের খোঁজে আমিই কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে দিচ্ছি। বিল তোমাকে পাঠিয়ে দেব।”

“লাভ আছে কিছু?”

“চেষ্টার ত্রুটি রাখতে নেই।”

Pages: 1 2 3 4 5 6
Pages ( 1 of 6 ): 1 23 ... 6পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress