Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

এখানকার ট্রেন ঢিমে হলেও, বেশি যে লেট করছে না এটাই ভাগ্যি। গাড়ি বদল করার ব্যাপার যেখানে থাকে, সেখানে লেট করলে অনেক সময় ভারী মুশকিল হয়।

ভরতপুর স্টেশনে এসে আমরা প্রথম ময়ূর দেখলাম। প্ল্যাটফর্মের উলটা দিকে তিনটে ময়ূর দিব্যি লাইনের উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফেলুদা বলল, কলকাতায় যেমন কাক-চড়ুই দেখিস সর্বত্র, এখানে তেমনি দেখবি ময়ূর আর টিয়া।

লোকজন যা দেখা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে –পাগড়ি আর গালাপাট্টার সাইজ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এরা সবাই রাজস্থানি। এদের পরনে খাটো ধুতি হাঁটু অবধি তোলা, আর এক পাশে বোতামওয়ালা জামা। এ ছাড়া পায়ে আছে ভারী নাগরা, আর অনেকের হাতেই একটা করে লাঠি।

বান্দিকুই স্টেশনের রিফ্রেশমেন্ট রুমে বসে রুটি আর মাংসের ঝোল খেতে খেতে লালমোহনবাবু বললেন, এই যে সব লোক দেখছেন, এদের মধ্যে এক-আধটা ডাকাত থাকার সম্ভাবনা কিন্তু খুব বেশি। আরাবল্লী পাহাড় হল গিয়ে ডাকাতদের আস্তানা, জানেন তো? আর এ সব ডাকাত কী রকম পাওয়ারফুল হয়, সেটা নিশ্চয়ই আপনাকে বলে দিতে হবে না। জানালার লোহার শিক দু হাতে দু দিকে টেনে ফাঁক করে জেলখানা থেকে পালায় মশাই এরা।

ফেলুদা বলল, জানি। আর কারুর উপর খেপে গেলে এরা কীভাবে শাস্তি দেয় বলুন তো?

উঁহু। ওইখানেই তো মজা। সে লোক যেখানেই থাকুক না কেন, তাকে খুঁজে বের করে তলোয়ার দিয়ে নাকটা কেটে ছেড়ে দেয়।

লালমোহনবাবুর হাতের মাংসের টুকরোটা আর মুখে পোরা হল না।

নাক কেটে?

তই তো শুনেছি। এ যে সেই পৌরাণিক যুগের সাজার মতো মনে হচ্ছে মশাই। কী সাংঘাতিক!

মাঝরাত্তিরে মাড়ওয়ারের ট্রেনে ওঠার সময় অন্ধকারে একটু হাঁচোড় প্যাচোড় করতে হলেও, জায়গা পেতে অসুবিধা হল না। রাত্রে ঘুমও হল ভাল। সকালে ঘুম থেকে উঠে চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে একটা পাহাড়ের মাথায় একটা পুরনো কেল্লা দেখতে পেলাম। তার এক মিনিটের মধ্যেই গাড়ি কিষণগড় স্টেশনে এসে থামল। ফেলুদা বলল, জায়গার নামে গড় আছে দেখলেই বুঝবি কাছাকাছির মধ্যে কোথাও এ রকম একটা পাহাড়ের উপর একটা কেল্লা আছে।

কিষণগড় স্টেশনে প্ল্যাটফর্মে নেমে চা খেলাম। এখানকার চায়ের ভাঁড়গুলো দেখলাম। বাংলাদেশের ভাঁড়ের চেয়ে অনেক বেশি বড় আর মজবুত। চায়ের স্বাদও একটু অন্য রকম। ফেলুদা বলল যে, উটের দুধ দিয়ে তৈরি। সেটা শুনেই বোধহয় লালমোহনবাবু পর পর দু ভাঁড় চা খেলেন।

চা খেয়ে প্ল্যাটফর্মের কালে চট করে দাঁতটা মেজে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়ে গাড়িতে ফিরে এসে দেখি, বিরাট পাগড়ি মাথায় একটা রাজস্থানি লোক নাক অবধি চাদরে ঢেকে বেঞ্চির উপর পা তুলে হাঁটুর উপর থুতনি ভর করে লালমোহনবাবুর বেঞ্চির একটা পাশ দখল করে বসে আছে। চাদরের ফাঁক দিয়ে ভেতরের জামার রংটা দেখলাম, টকটকে লাল।

লালমোহনবাবু কামরায় ঢুকে তাকে দেখেই সটান নিজের জায়গা ছেড়ে আমাদের বেঞ্চির একটা কোণে বসে পড়লেন। ফেলুদা তোরা আরাম করে বোস বলে একেবারে সেই রাজস্থানিটার পাশেই বসে পড়ল।

আমি লোকটার পাগড়িটা লক্ষ করছিলাম; কত অজস্র প্যাঁচ আছে। ওই পাগড়িতে সেটা ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না। লালমোহনবাবু চাপা গলায় ফেলুদাকে উদ্দেশ করে বলল, পাওয়ারফুল সাস্‌পিশাস্‌। এ রকম চাষাভুষোর মতো পোশাক অথচ দিব্যি প্রথম শ্রেণীতে উঠে বসে আছে। কত হিরে-জহরত আছে ওই পুটলিটার মধ্যে কে জানে!

পুঁটলিটা পাশেই রাখা ছিল। ফেলুদা খালি একটু হাসল, মুখে কিছু বলল না। গাড়ি ছেড়ে দিল। ফেলুদা তার ঝোলার ভিতর থেকে রাজস্থানের বইটা বার করে নিল। আমি নিউম্যানের ব্র্যাড্‌শ টাইম-টেবিলটা খুলে সামনে কী কী স্টেশন পড়বে দেখতে লাগলাম। অদ্ভুত নাম এখানকার সব স্টেশনের–গালোটা, তিলাওনিয়া, মাক্রেরা, ভেসানা, সেন্দ্ৰা। কোথেকে এল এ সব নাম কে জানে। ফেলুদা বলে জায়গার নামের মধ্যে নাকি অনেক ইতিহাস লুকোনো থাকে। কিন্তু সে সব ইতিহাস খুঁজে বার করবে কে?

গাড়ি ঘটার ঘটর করে চলেছে, আমি রাজকাহিনীর শিলাদিত্য বাপ্লাদিত্যের কথা ভাবছি, এমন সময় বুঝতে পারলাম আমার শার্টের পাশটায় একটা টান পড়ছে। পাশ ফিরে দেখি লালমাহনবাবুর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। চোখাচোখি হতেই তিনি ঢোক গিলে শুকনো গলায় ফিস ফিস করে বললেন, ব্লাড।

ব্লাড? লোকটা বলে কী?

তারপর তার দৃষ্টি ঘুরে গেল সামনের রাজস্থানি লোকটার দিকে। লোকটা মাথা পিছন দিকে হেলিয়ে মুখ হাঁ করে ঘুমিয়ে আছে। এবার তার বেঞ্চির উপরে তোলা পা দুটোর দিকে চোখ গেল। দেখলাম, বুড়ো আঙুলের পাশটা ছাল উঠে রক্ত জমে রয়েছে। তারপর বুঝলাম এতক্ষণ কাপড়ে যেগুলোকে মাটির দাগ বলে মনে হচ্ছিল, সেগুলো আসলে শুকনো লালচে রক্ত।

ফেলুদার দিকে চেয়ে দেখি, ও দিব্যি একমনে বই পড়ে চলেছে।

লালমোহনবাবুর পক্ষে বোধহয় ফেলুদার নিশ্চিন্ত ভাবটা সহ্য হল না। তিনি হঠাৎ সেই শুকনো গলাতেই বলে উঠলেন, মিস্টার মিটার, সাস্‌পিশাস্‌ ব্লাড-মার্কস অন আওয়ার নিউ কো-প্যাসেঞ্জার।

ফেলুদা বই থেকে চোখ তুলে একবার ঘুমন্ত লোকটার দিকে দেখে নিয়ে বলল, প্রব্যাবলি কজড বাই বাগ্‌স।

রক্তের কারণ ছারপোকা হতে পারে জেনে জটায়ু কেমন জানি মুষড়ে পড়লেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর ভয় যে কাটল না সেটা তার জড়োসড়ো ভাব আর বার বার ভুরু কুঁচকে আড়চাখে ঘুমন্ত লোকটার দিকে চাওয়া থেকে বুঝতে পারছিলাম।

দুপুর আড়াইটার সময় গাড়ি মাড়ওয়ার জংশনে পৌঁছাল। খাওয়াটা স্টেশনের রিফ্রেশমেন্ট রুমে সেরে ঘণ্টাখানেক প্লাটফর্মে পায়চারি করে সাড়ে তিনটেয় যোধপুরের গাড়িতে ওঠার সময় আর সেই লাল জামা-পরা লোকটাকে দেখতে পেলাম না।

আড়াই ঘণ্টার জার্নির মধ্যে ঘন ঘন। উটের দল চোখে পড়ায় লালমাহনবাবু বার বার উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলেন। যোধপুরে পৌঁছালাম ছটা বেজে দশ মিনিটে। ট্রেনটি কুড়ি মিনিট লেট করেছে। কলকাতা হলে এতক্ষণে সূর্য ডুবে যেত, কিন্তু এ দিকটা পশ্চিমে বলে এখনও দিব্যি রোদ রয়েছে।

আমাদের বুকিং ছিল সার্কিট হাউসে। লালমোহনবাবু বললেন তিনি নিউ বম্বে লিজে থাকছেন। ‘কাল সকাল সকাল এসে পড়ব, একসঙ্গে ফোর্টে যাওয়া যাবে’ বলে ভদ্রলোক টাঙ্গার লাইনের দিকে এগিয়ে গেলেন।

আমরা একটা ট্যাক্সি নিয়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে পড়লাম। শুনলাম সার্কিট হাউসটা খুব কাছেই। যেতে যেতে বাড়ির ফাঁক দিয়ে ফাঁক দিয়ে লক্ষ করছিলাম একটা বিরাট পাথরের পাঁচিল–প্রায় একটা দোতলা বাড়ির সমান উঁচু। ফেলুদা বলল, এককালে পুরো যোধপুর শহরটাই নাকি ওই পাঁচিলটা দিয়ে ঘেরা ছিল। ওটার সাত জায়গায় নাকি সাতটা ফটক আছে। বাইরে থেকে সৈন্য আক্রমণ করতে আসছে জানলে ওই ফটকগুলো বন্ধ করে দেওয়া হত।

আরেকটা রাস্তার মোড় ঘুরতেই ফেলুদা বলল, ওই দ্যাখ বাঁদিকে।

চেয়ে দেখি শহরের বাড়ির মাথার উপর দিয়ে দূরে দেখা যাচ্ছে বিরাট থমথমে এক কেল্লা। বুঝলাম ওটাই হল বিখ্যাত যোধপুর ফোর্ট। আমি জানতাম এখানকার রাজারা মোগলদের হয়ে লড়াই করেছে।

কখন কেল্লাটা কাছ থেকে দেখতে পাব সেটা ভাবতে ভাবতেই সার্কিট হাউসে পৌঁছে গেলাম। গেটের ভিতর দিয়ে ঢুকে একটা বাগানের পাশ দিয়ে গিয়ে একটা পোর্টিকের তলায় আমাদের ট্যাক্সি দাঁড়াল। মালপত্তর নামিয়ে ট্যাক্সির ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে আমরা ভিতরে ঢুকলাম। একজন ভদ্রলোক এগিয়ে এসে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন আমরা কলকাতা থেকে আসছি কি না। আর ফেলুদার নাম মিস্টার মিটার কি না। ফেলুদা হ্যাঁ বলতে ভদ্রলোক বললেন—আপনাদের জন্য একতলায় একটা ডাবল রুম বুক করা আছে। খাতায় নাম সই করার সময় আমাদের নামের কয়েক লাইন উপরেই পর পর দুটো নাম চোখে পড়ল–ডক্টর এইচ বি হাজরা আর মাস্টার এম ধর।

সার্কিট হাউসের প্ল্যানটা খুব সহজ। ঢুকেই একটা বড় খোলা জায়গা, বা দিকে রিসেপশন কাউন্টার আর ম্যানেজারের ঘর, সামনে দোতলার সিঁড়ি, ডাইনে আর বাঁয়ে দু দিকে লম্বা বারান্দার পাশে পর পর লাইন করে ঘন্ধু। বারান্দায় বেতের চেয়ার পাতা রয়েছে। একজন বেয়ারা এসে আমাদের মাল তুলে নিল, আমরা তার পিছন পিছন ডানদিকের বারান্দা দিয়ে রওনা দিলাম। তিন নম্বর ঘরের দিকে। একজন সরু গোঁফাওয়ালা মাঝবয়সী ভদ্রলোক একটা বেতের চেয়ারে বসে, একজন মাড়ওয়ারি টুপি পরা ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন; আমরা তাঁর পাশ দিয়ে যাবার সময় পরিষ্কার বাংলায় বললেন, বাঙালি মনে হচ্ছে? ফেলুদা হেসে হ্যাঁ বলল। আমরা তিন নম্বর ঘরে গিয়ে ঢুকলাম।

বেশ বড় ঘর। দুটো পাশাপাশি খাট, তাতে আবার মশারির ব্যবস্থা রয়েছে। এক পাশে একটা দুজন-বসার আর দুটো একজন-বসার সোফা, আর একটা গোল টেবিলের উপর একটা অ্যাশ-ষ্ট্রে। এ ছাড়া ড্রেসিং টেবিল, আলমারি আর খাটের পাশে দুটো ছাট টেবিলে জলের ফ্লাস্ক, গেলাস আর বেড-সাইড ল্যাম্প।। ঘরের সঙ্গে লাগা বাথরুমের দরজাটা বাঁ দিকে।

ফেলুদা বেয়ারাকে চা আনতে বলে পাখাটা খুলে দিয়ে সোফায় বসে বলল, খাতায় নাম দুটো দেখলি?

আমি বললাম, হ্যাঁ। কিন্তু ওই চাড়া-দেওয়া গোঁফওয়ালা লোকটা আশা করি ডক্টর হাজরা নন।

কেন? হলে ক্ষতি কী?

ক্ষতি যে কী সেটা অবিশ্যি আমি চট করে ভেবে বলতে পারলাম না। ফেলুদা আমার ইতস্তত ভাব দেখে বলল, তোর আসলে লোকটাকে দেখে ভাল লাগেনি। তুই মনে মনে চাইছিস যে ডক্টর হাজরা লোকটা খুব শাস্তশিষ্ট হাসিখুশি অমায়িক হন—এই তো?

ফেলুদা ঠিকই ধরেছে। এ লোকটাকে দেখলে বেশ সেয়ানা বলেই মনে হয়। তা ছাড়া বোধহয় বেশ লম্বা। আর জাঁদরেল। ডাক্তার বলতে যা বোঝায় তা মোটেই নয়।

ফেলুদা একটা সিগারেট শেষ করতে না করতেই চা এসে গেল, আর বেয়ারা ঘর থেকে বেরোতে না বেরোতেই দরজায় টোকা পড়ল। ফেলুদা ভীষণ বিলিতি কায়দায় বলে উঠল, কাম ইন! পদ ফাঁক করে ভেতরে ঢুকলেন মিলিটারি গোঁফ।

ডিসটর্ব করছি না তো?

মোটেই না। বসুন। চা খাবেন?

নাঃ। এই অল্পক্ষিণ অাগেই খেয়েছি। আর ফ্র্যাংকলি স্পিকিং-চা-টা এখানে তেমন সুবিধের নয়। শুধু এখানে বলছি কেন, ভারতবর্ষ হল খাস চায়ের দেশ, অথচ কটা হাটেলে কটা ডাকবাংলোয় কটা সার্কিট হাউসে ভাল চা খেয়েছেন আপনি বলুন তো? অথচ বাইরে যান, বিদেশে যান–অ্যালবেনিয়ার মতো জায়গায় গিয়ে ভাল চা খেয়েছি জানেন? ফাস্ট ক্লাস দাৰ্জিলিং টি। আর ইওরোপের অন্য বড় শহরে তো কথাই নেই। একমাত্র খারাপ যেটা লাগে সেটা হল কাপড়ের থলিতে চায়ের পাতার ব্যাপারটা—যাকে টি-বাগস বলে। কাপে থাকবে গরম জল, আর একটা সুতো বাঁধা কাপড়ের থলিতে থাকবে চায়ের পাতা। সেইটে জলে ডুবিয়ে লিকার তৈরি করে নিতে হবে আপনাকে। তারপর তাতে আপনি দুধ দিন কি লেবু, কচলে দিন সেটা আপনার রুচি। লেমন টি-টাই আমি বেশি প্রেফার করি। তবে তার জন্যে চাই ভাল লিকার। এখানকার চা খুব অর্ডিনারি।

আপনার তো অনেক দেশ-টেশ ঘোরা আছে বুঝি? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

ওইটেই তো করেছি। সারা জীবন ধরে, ভদ্রলোক বললেন। আমি হলাম। ষাকে বলে গ্লোব-ট্রটার। তার সঙ্গে আবার শিকারের শখও আছে। সেটা অবিশ্যি আফ্রিকা থাকতেই হয়েছিল; আমার নাম মন্দার বোস।

গ্লোব-ট্রটার উমেশ ভট্টচার্যের নাম শুনেছি, কিন্তু এঁর নাম তো শুনিনি। ভদ্রলোক যেন আমার মনের কথাটা আন্দাজ করেই বললেন, অবিশ্যি আমার নাম আপনাদের শোনার কথা নয়। যখন প্রথম বেরিয়েছিলাম, তখন কাগজে নাম-টাম বেরিয়েছিল। তারপর এই ছত্রিশ বছর পরে মাস তিনেক হল সবে দেশে ফিরেছি।

সে অনুপাতে আপনার বাংলার উপর দখলটা তো ভালই আছে বলতে হবে।

দেখুন মশাই, সেটা এনটায়ারলি আপনার নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছের ওপর নির্ভর করে। আপনি যদি বিদেশে বাংলা ভুলবেন বলে ইচ্ছে করেন, তা হলে তিন মাসে ভুলে যেতে পারেন। আর তা যদি ইচ্ছে না করেন, তা হলে ত্রিশ বছরেও ভোলবার কোনও চান্স নেই। অবিশ্যি আমি আবার বাঙালির সঙ্গও পেয়েছি। যথেষ্ট। কিনিয়াতে একবার হাতির দাঁতের ব্যবসা শুরু করেছিলাম, তখন আমার সঙ্গে একটি বাঙালি ছিলেন। আমরা এক সঙ্গে ছিলাম। প্রায় সাত বচ্ছর।

সার্কিট হাউসে আপনি ছাড়া আর কেউ বাঙালি আছেন কি?

এটা অনেকবার লক্ষ করেছি, কাজে কথায় সময় নষ্ট করার লোক ফেলুদা নয়!

ভদ্রলোক বললেন, আছে। বইকী। সেটাই তো আশ্চর্য লাগছে আমার। আসলে কলকাতায় বাঙালিদের আর সোয়াস্তি নেই সেটা বেশ বুঝতে পারছি। তাই সুযোগ পেলেই এদিকে ওদিকে গিয়ে ঘুরে আসছে। অবিশ্যি দিস ম্যান হ্যাঁজ কাম উইথ এ পরিপাস্। ভদ্রলোক সাইকলজিস্ট। তবে গোলমেলে ব্যাপার বলে মনে হয়। সঙ্গে একটি ছেলে আছে। বছর আষ্টেকের, সে নাকি জাতিস্মর; পূর্বজন্মে রাজস্থানে কোন কেল্লার কাছে নাকি জন্মেছিল। ভদ্রলোক ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে সেই কেল্লা খুঁজে বেড়াচ্ছেন। ডাক্তারটি বুজরুক না ছেলেটি ধাপ্পা দিচ্ছে বোঝা শক্ত। এমনিতেও ছেলেটির হাবভাব সাস্‌পিশাস্‌। কারুর সঙ্গে ভাল করে কথা বলে না। কিছু জিজ্ঞেস করলে জবাব দেয় না। ভেরি ফিশি। অনেক তো দেখলুম ভণ্ডামি এই ত্ৰিশ বছরে, আবার এখানে এসেও যে সেই একই জিনিস দেখতে হবে তা ভাবিনি।

আপনি কি এখানেও ট্রটিং করতে এসেছেন নাকি?

ভদ্রলোক হেসে সোফা ছেড়ে উঠে পড়ে বললেন, টু টেল ইউ দ্য ট্রুথ–নিজের দেশটা ভাল করে দেখাই হয়নি এখনও। বাই দ্য ওয়ে—আপনার পরিচয়টা তো পাওয়া গেল না!

ফেলুদা নিজের আর আমার পরিচয় দিয়ে বলল, আমি আবার আমার দেশের বাইরে কোথাওই যাইনি।

আই সি। ওয়েল–সাড়ে আটটা নাগাদ যদি ডাইনিং রুমে আসেন তো আব্বার দেখা হবে। আমার আবার আর্লি টু বেড, আলি টু রাইজ…

ভদ্রলোকের সঙ্গে আমরাও দুজনে বাইরের বারান্দায় এলাম। এসে দেখলাম, গেট দিয়ে একটা ট্যাক্সি ঢুকছে। সেটা এসে সার্কিট হাউসের সামনে থামল, আর সেটা থেকে নামল একটি বছর চল্লিশের মাঝারি হাইটের ভদ্রলোক আর একটা রোগ ফরসা বাচ্চা ছেলে। বোঝাই গেল যে, এরাই হচ্ছে ডক্টর হেমাঙ্গ হাজরা এবং জাতিস্মর শ্ৰীমান মুকুল ধর।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress