লিলির ঘুম ভাঙলো সকাল দশটায়
তার সারা গায়ে রোদ। সে কোথায় ঘুমুচ্ছে? ছাদে? লিলি ধড়মড় করে উঠে বসল। টেনশনের সময় তার সব এলোমেলো হয়ে যায়। তার আজ এসএসসি পরীক্ষা না? জেনারেল ব্যাংক। কী সর্বনাশ, কেউ তাকে ডেকে দেয় নি কেন? প্রায় লাফিয়ে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে মনে হলো–এসএসসি পরীক্ষার ঝামেলা অনেক আগে শেষ হয়েছে। এবং সে ছাদে ঘুমুচ্ছে না, নিজের ঘরে নিজের বিছানাতেই ঘুমুচ্ছিল।
স্বাতী এবং সে দুজনই ঘুমুচ্ছিল। স্বাতী নেই। সে কি চলে গেছে নাকি?
লিলি বারান্দায় এসে দেখে ফরিদা বারান্দার রেলিংয়ে ভেজা কাপড় মেলে দিচ্ছেন। তাঁর মুখ ভাবলেশহীন। লিলিকে দেখেও তিনি কিছু বললেন না।
স্বাতী কোথায় মা?
চলে গেছে।
কখন চলে গেল?
সকালে চলে গেছে। তুই ঘুমুচ্ছিলি বলে ডাকে নি।
আজ কী বার মা?
জানি না কী বার।
কী সর্বনাশ! আজ তো বৃহস্পতিবার এগারোটার সময় টিউটোরিয়াল আছে। তাড়াতাড়ি নাশতা দাও মা।
ফরিদার ভেতর কোনো তাড়া দেখা গেল না। তিনি যেমন ভেজা কাপড় মেলছিলেন ঠিক তেমনি মেলতে থাকলেন। লিলি অতি দ্রুত হাত-মুখ ধুয়ে নিচে নেমে এলো। রুটি-ভাজি-টবিলে থাকবে। খেয়ে চলে গেলেই হবে।
বুয়া খুব তাড়াতাড়ি চা দাও।
আটার রুটি শক্ত চামড়ার মতো হয়ে আছে। ছেড়া যাচ্ছে না। ভাজিতে আভা কোনো লবণ নেই। লবণ সম্ভবত দেয়াই হয় নি। ফরিদা খাবারঘরে ঢুকলেন।
লিলি বলল, স্বাতী কি সকালে কিছু খেয়ে গিয়েছে মা?
চা খেয়েছে।
তুমি কিছু খেয়েছ?
হাতের কাজই শেষ হয় নি। খাব কি?
ফরিদা বসলেন। নাশতা খাওয়ার ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ দেখা গেল না। লিলি বলল, বৃহস্পতিবারের ক্লাসটায় আমি রোজ লেট করি। আজও লেট হবে।
ফরিদা বললেন, তোর বাবা বলেছে তোকে ইউনিভার্সিটিতে না যেতে।
কখন বলল?
অফিসে যাবার আগে বলে গেল।
লিলি অবাক হয়ে বলল, ইউনিভার্সিটিতে যাব না কেন?
তোর বাবা খুব রাগারাগি করছিল। তুই না-কি কাল রাতে ছাদে সিগারেট খাচ্ছিলি। তোর বাবা দেখেছে। তুই আর ঐ মেয়ে শুয়ে শুয়ে সমানে সিগারেট টানছিস।
লিলির হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। রুটি এবং ভাজি গলায় আটকে যাবার মতো হলো।
তোর বাবা তোকে কিছু বলে নি, আমার সঙ্গে রাগারাগি। মাথায় রক্ত উঠে গেছে, ধাক্কা দিয়ে আমাকে ফেলে দিল।
তোমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলল কেন? তুমি কী করেছ?
রাগলে কি আর মাথার ঠিক থাকে? কে কি করে এসব মনে থাকে না। সামনে থাকে রাগ গিয়ে পড়ে তার ওপর।
স্বাতীকে বাবা কিছু বলেনি তো?
উহুঁ। আল্লাহর কাছে হাজার শুকুর বাইরের মেয়ের সামনে ইজ্জত রক্ষা হয়ে তুই সিগারেট খাচ্ছিলি কেন?
মজা করার জন্য খেয়েছি মা।
বাথরুমে দরজা বন্ধ করে খেলেই হতো। এখন কী যন্ত্রণার মধ্যে ফেলেছিস। দেখ তো!”
আমার ইউনিভার্সিটি তো যাওয়া তাহলে বন্ধ?
হুঁ।
আমি কী করব? দিনরাত ঘরে বসে থাকব?
ফরিদা হাই তুলতে তুলতে বললেন, তোর বাবা বলছিল তাড়াতাড়ি বিয়ের ব্যবস্থা করবে।
মতির মা বুয়া চা দিয়ে গেছে। লিলির চা খেতে ইচ্ছা করছে না। ফরিদা বললেন, তুই ঝুমুকে আজ আবার একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবি? ওর ঠোঁট ফুলে কি হয়েছে। মুখটা হাঁসের মতো হয়ে গেছে। বলেই ফরিদা হাসতে শুরু করলেন।
লিলি, একদৃষ্টিতে মাকে দেখছে। কী অদ্ভুত মহিলা! তার এক মেয়ের ইউনিভার্সিটিতে পড়া বন্ধ হয়ে গেছে, তাতে কোনো বিকার নেই। যেন এটাই স্বাভাবিক। ঝুমুর ঠোঁট ফুলে হাঁসের মতো হয়ে গেছে এটাই তাঁকে বেশি আকৃষ্ট করছে।
চা ঠাণ্ডা হচ্ছে তো, খেয়ে ফেল।
খেতে ইচ্ছা করছে না।
না খেলে তোর বড় চাচাকে দিয়ে আয়। চা চেয়েছিল দিতে ভুলে গেছি।
লিলি কাপ হাতে উঠে গেল। আজহার উদ্দিন খাঁ খবরের কাগজ পড়ছিলেন। লিলিকে ঢুকতে দেখে কাগজ ভাঁজ করে রাখলেন। চোখের চশমা খুলে ফেলে গম্ভীর গলায় বললেন, লিলি তুই নাকি কাল সারারাত ছাদে ধূমপান করেছিস?
লিলি চুপ করে রইল।
.
সকালে নিয়ামত আমাকে বলল। এই ঘটনা বিশ্বাস করা কঠিন। আমি তাকে নিয়ে ছাদে গেলাম। নয়টা সিগারেটের টুকরো পেয়েছি। তোর কিছু বলার আছে লিলি?
না।
বোস এখানে। অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ বলে যে কথা আছে সেটাই হয়েছে। অসৎ সঙ্গে তোর সর্বনাশ হয়েছে। তুই এটা বুঝতে পারছিস না। মেয়েটার নাম কী?
কোন মেয়েটার?
তোকে যে ট্রেনিং দিচ্ছে। সিগারেট মদ এসব ধরচ্ছে।
মদের কথা আসছে কেন চাচা?
একটা যখন এসেছে অন্যটাও আসবে। কানের সাথেই মাথা আসে। কান আর মাথা তো আলাদা না। মেয়েটার নাম কী?এ
স্বাতী।
ওর সঙ্গ বিষবৎ পরিত্যাগ করবি। অসৎ সঙ্গ পরিত্যাগ করা যদিও খুব কঠিন। মন্দ জিনিসের আকর্ষণী ক্ষমতা থাকে প্রবল।
চাচা আমার কি তাহলে ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া বন্ধ?
হ্যাঁ বন্ধ। তবে সাময়িকভাবে বন্ধ। তোর বাবাকে বলেছি দ্রুত তোর বিয়ের ব্যবস্থা করতে। বিয়ে হয়ে যাক। তারপর তোর স্বামী যদি মনে করে তোর পড়াশোনা করা উচিত তাহলে আবার যাবি। তখন আর আমাদের কোনো দায়িত্ব থাকবে না।
লিলি তাকিয়ে আছে। আজহার উদ্দিন খা আবার চশমা খুলে চোখে পরলেন। খবরের কাগজের ভাঁজ খুলতে খুলতে বললেন, অনেকক্ষণ আগে চা চেয়েছিলাম। চা দিচ্ছে না। ব্যাপার কী খোঁজ নিয়ে আয় তো।
চা আপনাকে দিয়েছি। আপনার সামনেই আছে।
ও আচ্ছা, থ্যাংকস। জানালার পাল্লাটা একটু খুলে দিয়ে যা। ডান দিকেরটা।
লিলি চাচার ঘর থেকে বের হলো। সে এখন কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে। তাতে লাভ কী হবে?
বারান্দায় ঝুমু বসে আছে। লিলি তাকে দেখে আঁতকে উঠল। তার ঠোঁট অনেকখানি ফুলেছে। ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে, ঠিকই খানিকটা হাঁসের মতো লাগছে।
ব্যথা করছে ঝুমু?”
হুঁ।
চল যাই, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। জামা পাল্টানোর দরকার নেই। স্যান্ডেল পরে আয়। ব্যথা কি খুব বেশি করছে?
হুঁ।
চা-নাশতা কিছু খেয়েছিস?
না।
যে অবস্থা–এই অবস্থায় কিছু খাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। তোকে দেখে তো আমারই ভয় লাগছে।
ডাক্তার সাহেব ঠোঁট ড্রেসিং করে দিলেন। এন্টিবায়োটিক ইনজেকশনের কোর্স শুরু করতে বললেন। সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ভয়ের কিছু নেই, মুখের চামড়া খুব সেনসেটিভ তো অল্পতেই ফুলে যায়।
রিকশায় ফেরার পথে ঝুমু বলল, আপা কাল রাতে তুমি সিগারেট খেয়েছিলে, তাই না?
হুঁ।
যা কাণ্ড সকালে হয়েছে। বাবা মার সঙ্গে রাগারাগি করল। ধাক্কা দিয়ে সিঁড়িতে ফেলে দিল, মা গড়াতে গড়াতে নিচে পড়েছে, শাড়িটাড়ি উল্টে বিশ্রী অবস্থা। পরনের শাড়ি একেবারে উঠে গিয়েছিল।
বলিস কি!
আমাদের স্যার, কাজের বুয়া–সবাই দেখেছে। কি, যা লজ্জা পেয়েছে।
লজ্জা পাবারই তো কথা।
ঝুমু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সিপারট খেয়েছ ভালো করেছ। বাবার সামনে খেলে আরও ভালো হতো।
.
বাসার সামনে দুবোন রিকশা থেকে নামল। লিলি বলল, ঝুমু তুই বাসায় চলে যা। আমি যাব না। আমি ইউনিভার্সিটিতে যাব।
বাবা তোমাকে ইউনিভার্সিটিতে যেতে নিষেধ করেছে।
করুক।
দুটোর আগে ফিরে আসব। বাবা দুটোর সময় ফিরবে।
দেখি, তোর ব্যথা কি একটু কমেছে?
হুঁ।
মাকে বলিস আমি ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছি।
বই-খাতা কিছু নেবে না?
না।
দুটোর আগে চলে এসো, নয়তো মা আবার মার খাবে।
চলে আসব।
লিলি ক্লাসে পৌঁছল আর তাদের টিউটোরিয়াল শেষ হলো। স্যার বললেন, Young Lady you are too early for the next class.
লিলি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসল। আজ আর কোনো ক্লাস নেই। সে কি করবে বুঝতে পারছে না। স্বাতী তার টিউটোরিয়াল গ্রুপের না। সে অন্য গ্রুপে। সে কি আজ ইউনিভার্সটিতে এসেছে? বহস্পতিবারে তার কি ক্লাস আছে? মনে পড়ছে না। লিলি কমন রুমের দিকে এগুলো। কমন রুমের দরজায় নীপা দাঁড়িয়ে আছে। নীপা বিচিত্র সব সাজসজ্জা করে। আজ রঙচঙ্গা আলখাল্লার মতো কি একটা পরে এসেছে। নীপা বলল, এই লিলি, বাজারে একটা গুজব শোনা যাচ্ছে তোর জিগরি দোস স্বাতী না-কি পঞ্চাশ বছরের এক ম্যারিডম্যানকে বিয়ে করে বসে আছে। তার আগের স্ত্রী না-কি বিষটিষ খেয়ে হাসপাতালে দাখিল হয়েছে। ভদ্রলোকের বড় মেয়ে। জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে।
জানি না।
জানিস ঠিকই। বলবি না।
লিলি কমনরুমে ঢুকতে গিয়েও ঢুকল না। স্বাতী এসেছে কি-না জানার জন্য কমনরুমে যেতে চাচ্ছিল। নীপার সঙ্গে দেখা হওয়ায় বোঝা গেল স্বাতী কমনরুমে নেই। স্বাতী কমনরুমে থাকবে আর নীপা কমনরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে এসব কথা বলবে তা হয় না। নীপা বলল, চলে যাচ্ছিস না-কি?
হুঁ।
আমাকে এক কাপ চা খাওয়া না লিলি। টাকা ছাড়া চলে এসেছি। চা খেতে পারছি না। খাওয়াবি এক কাপ চা?
লিলি নিতান্ত অনিচ্ছায় নীপাকে চা খাওয়াতে নিয়ে গেল। যতক্ষণ চা খাবে ততক্ষণ নীপা আজেবাজে কথা বলবে। এক মুহূর্তের জন্যও থামবে না।
নীপা গলা নিচু করে বলল, তোর বান্ধবী না-কি পেট বাধিয়ে ফেলেছে? বিয়ে না করে গতিও ছিল না। তুই জানিস কিছু?
না।
জানিস ঠিকই। বলবি না। তবে এইসব খবর চাপা থাকে না। একসময় সবাই জানবে।
জানুক।
স্বাতীদের টিউটোরিয়াল গ্রুপের সবাই অবশ্যি জেনে গেছে। কী হয়েছে শুনবি?
না।
আহ্ শোন না। শুনতে অসুবিধা কি? টিউটোরিয়াল ক্লাসের মাঝখানে স্বাতী হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। স্যারকে বলল, স্যার আমার শরীর খারাপ লাগছে। বলেই প্রায় ছুটতে ছুটতে বের হয়ে গেল। সোজা বাথরুমের দিকে। বাথরুমের বেসিনে হড়হড় করে বমি।
নীপার হাত থেকে উদ্ধার পেয়ে লিলি খানিকক্ষণ একা একা ঘুরে বেড়ালো। বাসায় যেতে ইচ্ছা করছে না। একা একা ঘুরতেও ভালো লাগেছ না। ইউনিভার্সিটি ফাঁকা হয়ে আসছে। তবে মাঠে প্রচুর ছেলেমেয়ে আছে। এরা সন্ধ্যা পর্যন্ত আড্ডা দেবে। আডডা নানান ভঙ্গিমায় চলছে। কোথাও দল বেঁধে, কোথাও জোড়ায় জোড়ায়। স্বাতী থাকলে এদের দেখিয়ে মজার মজার কথা বলত–
যখন দেখবি একটা মেয়ে দুজন ছেলের সঙ্গে গল্প করছে, তখন বুঝবি প্রেমের ডেভেলপিং স্টেজ চলছে। একটা ছেলে হচ্ছে ক্যাটালিস্ট। এই স্টেজে তৃতীয় ব্যক্তি লাগে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তৃতীয় ব্যক্তির মাধ্যমে কথাবার্তা চলে।
যখন দেখবি দুজন গল্প করছে, দুজন হাসিখুশি, তখন বুঝবি প্রাথমিক স্তর তারা। অতিক্রম করে এসেছে। প্রেম শুরু হয়ে গেছে।
যখন দেখবি দুজন আছে কিন্তু কেউ কোনো কথা বলছে না, মুখ গম্ভীর করে বসে আছে, তখন বুঝবি প্রেম পেকে গেছে। পেকে টসটস করছে। খসে মাটিতে পড়ল বলে।
লিলির খুব একা একা লাগেছ। স্বাতীদের বাসায় একটা টেলিফোন করে দেখবে। ইউনিভার্সিটি থেকে টেলিফোন করার নিয়ম-কানুনও স্বাতী তাকে শিখিয়ে দিয়েছে।
করবি কি শোন, যে-কোনো একটা অফিসে ঢুকে যাবি। অফিসের কেরানিকে বলবি স্যার একটা টেলিফোন করব। ওদের তো কেউ স্যার বলে না–স্যার শুনে খুশি হয়ে যাবে। নিজেই টেলিফোনের তালা খুলে দেবে। আর তা যদি না হয় তাহলে কোনো ইয়াং টিচারের কাছে যাবি। তাঁর দিকে তাকিয়ে মোটামুটি রহস্যময় ভঙ্গি করে হাসতে থাকবি। হাসবি, চোখ নামিয়ে নিবি। আবার চোখ তুলে হাসবি। আবার চোখ নামিয়ে নিবি। স্যার তখন বলবে, কী খবর তোমার? তুই বলবি, স্যার, বাসায় একটা টেলিফোন করব। আর দেখতে হবে না। স্যার টেলিফোনের ব্যবস্থা করে দেবে।
লিলি স্বাতীকে টেলিফোন করাই ঠিক করল। স্বাতীরশেখানো পদ্ধতিতে কেরানিকে স্যার বলে চট করে টেলিফোন পেয়ে গেল।
স্বাতী খুশি খুশি গলায় বলল, লিলি তুই? ঘুম ভেঙেছে?”
হ্যাঁ।
তুই যে এমন কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমুতে পারিস তা তো জানতাম না। সকালে চলে আসার সময় তোর ঘুম ভাঙানোর এত চেষ্টা করলাম। তুই এখন করছিস কী?
টেলিফোন করছি।
সেটা বুঝতে পারছি। তুই কি আজ সারাদিন বাসায় থাকবি?
না। এখন আমি ইউনিভার্সিটিতে।
সে কি! তুই ক্লাস করছিস। তুই ক্লাসে যাবি জানতে পারলে আমিও চলে আসতাম। আমার অবশ্যি শরীর খারাপ করেছে।
বমি করছিস?
বমি করব কেন শুধু শুধু? প্রচণ্ড মাথা ধরেছে।
তোর নামে আজেবাজে সব কথা শোনা যাচ্ছে।
কে বলছে, নীপা? ওয়ান ডে আই উইল স্টিচ হার লিপস। বস্তা সেলাই করার উঁচ দিয়ে ওর ঠোঁট সেলাই করে দেব। নো কিডিং।
টেলিফোন রেখে দিচ্ছি স্বাতী।
পাগল, টেলিফোন রাখবি কেন? আমি তো কথাই শুরু করি নি।
লিলি টেলিফোন নামিয়ে রাখল। তার আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ভালো লাগছে না। কিছু ভালো রাগছে না। রিকশা নিয়ে সারাদিন শহরে ঘুরলে কেমন হয়? রাত আটটার আগে আজ সে বাসায় ফিরবে না। বাসার সবাই দুশ্চিন্তায় আধমরা হয়ে যাক। সবচেয়ে ভালো হয় বাসায় ফিরে না গেলে। কয়েক দিন যদি কোথাও পালিয়ে থাকা যেত।
ইউনিভার্সিটি এখন প্রায় ফাঁকা। দারোয়ান ক্লাসরুমে তালাচাবি দিচ্ছে। করিডোর ফাঁকা। লিলি সিঁড়ি দিয়ে নামছে–আবারও নীপার সঙ্গে দেখা। এখন নীপার চোখে সানগ্লাস। চুলগুলোকে এর মধ্যেই কিছু করেছে কিনা কে জানে। তাকে অন্য রকম লাগছে। নীপা চাপা গলায় বলল, বোরকাওয়ালি এখন কোথায় জানিস?
লিলি কিছু বলল না। বোরকাওয়ালি হলো তাদের ক্লাসের নূরজাহান বেগম। ক্লাসের একমাত্র মেয়ে যে বোরকা দিয়ে শরীর ঢেকে আসে। বোরকার ফাঁক দিয়ে সুন্দর দুটি চোখ ছাড়া এই মেয়ের আর কিছুই দেখা যায় না। মেয়েদের কমনরুমেও বোরকাওয়ালি গা থেকে বোরকা খোলে না।
নীপা লিলির কানের কাছে মুখ এনে বলল, ববারকাওয়ালি এখন বোরকার নিচে খ্যামটা নাচ দিচ্ছে। বিশ্বাস না হয় ৬১১ নম্বর রুমে যা। ওরা ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। ওর গায়ে এখন বোরকা কেন, কিছুই নেই। কে জানে কি করছে।
লিলি বলল, যা ইচ্ছা করুক।
প্লিজ, আয় একটু। তোর দেখা থাকলে আমার সুবিধা। আমার কথা কেউ বিশ্বাস করে না। শনিবার ক্লাসে এসে তুই যখন বলবি তখন সবাই বিশ্বাস করবে।
নীপা শোন, আমার কিছু দেখারও ইচ্ছা নেই, বলারও ইচ্ছা নেই। যার যা ইচ্ছা করুক।
লিলি রিকশা নিল।
রিকশায় উঠে রিকশাওয়ালাকে বলা যায় না আমি বিশেষ কোথাও যাব না। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরব। অথচ লিলির কোনো গন্তব্য নেইঐআকাশের অবস্থা ভালো না। মেঘ জমতে শুরু করেছে। মেঘের ধরনধারণজলো না। বৃষ্টি শুধু না, ঝড় হবারও কথা। হোক, প্রচণ্ড ঝড়, সব লণ্ডভণ্ড করে দিক
আপা, যাইবেন কই?
কলাবাগান।
বাসস্ট্যান্ড?
বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে একটু ভেতরে।
দশ টাকা দেবেন।
চলো, দশ টাকাই দেব।
লিলি কলাবাগান যাচ্ছে কেন? কলাবাগান যাবার তার কোনো ইচ্ছা নেই। কলাবাগান বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে একটু ভেতরে গেলেই হাসনাত সাহেবের বাড়ি। ঐ বাড়িতে যাবার জন্য সে রিকশা নেয় নি। তার পরেও সে কলাবাগানের কথা কেন বলল? সবচেয়ে ভালো হতো আগামসি লেনে চলে গেলে। লিলির দুনম্বর দাদিজান আগামসি লেনে থাকেন। লিলিকে দেখলে অসম্ভব খুশি হবেন। রাত আটটা পর্যন্ত আগামসি লেনে থাকা যায়। একবারে রাতে খেয়ে-টেয়ে বাসায় ফেরা।
রিকশাওয়ালা প্রাণপণে রিকশা টানছে। তার মনের ইচ্ছা মনে হয় যাত্রীকে বৃষ্টি নামার আগে আগে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়া। কারণ একটু পরপর সে আকাশে মেঘের অবস্থা দেখতে চেষ্টা করছে।
কোথাও যাবার কথা বলে রিকশায় ওঠার বেশ কিছুক্ষণ পর যদি গন্তব্যস্থল বদল করা হয় তখন রিকশাওয়ালারা খুবই বিরক্ত হয়। তারা ভদ্রতার ধার ধারে না। ভদ্রলোকের মতো তারা তাদের বিরক্তি লুকিয়ে রাখে না। প্রকাশ করে। লিলি ঠিক করল প্রথম সে কলাবাগানেই যাবে। সেখান থেকে আরেকটা রিকশা নিয়ে আগামসি লেন।
লিলির রিকশাওয়ালাকে বৃষ্টি ধরে ফেলেছে। বৃষ্টি নেমেছে হুড়মুড় করে। রিকশাওয়ালা বিরক্ত মুখে পিছন ফিরে বলল, পর্দা লাগব আফা?”
না।
ভিজতাছেন তো।
একটু ভিজলে অসুবিধা হবে না।
লিলি একটু না, অনেকখানি ভিজল। ভেজা শাড়ি শরীরের সঙ্গে লেপ্টে কি অবস্থা হয়েছে। সিনেমার নায়িকারাও এ-রকম করে বৃষ্টিতে ভিজে নাচগান করে না। শাড়িটা সুতির হলেও গায়ের সঙ্গে এতটা লেপ্টা তো না। লিলির পরনে জর্জেটের শাড়ি। জর্জেট বৃষ্টি পছন্দ করে।
গলির ভেতর রিকশাওয়ালা রিকশা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি শুরু হয়েছে দশ মিনিট হয় নি, এর মধ্যেই গলিতে গলিতে হাঁটুর কাছাকাছি পানি। কোত্থেকে এল এত পানি?
রিকশাওয়ালা বলল, আফা কোন বাড়ি?
লিলি ভয়ে ভয়ে বলল, ভাই শুনুন, আপনি কি আগামসি লেনে যাবেন?
কই?
আগামসি লেন?”
এইটা মিরপুরের রিকশা। পুরান ঢাকায় যাব।
লিলিকে নেমে যেতে হবে। অন্য একটা রিকশা নিতে হবে, কিংবা কোনো দোকানের সামনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে। সবাই মহা আনন্দ নিয়ে ভেজা জর্জেটের শাড়ির ভেতর দিয়ে লিলিকে দেখবে।
লিলি বলল, বায়ের ঐ বাড়িটা। লোহার গেটওয়ালা বাড়ি।
গেটের ভেতর রিকশা ঢুকল না। রিকশাওয়ালাকে দশ টাকার জায়গায় পনেরো টাকা দিয়ে লিলি লোহার গেট খুলে ঢুকে পড়ল। দরজায় হাত রাখতেই ফুটফুটে আট/নবছরের একটা মেয়ে দরজা খুলে বের হয়ে বলল, আপনি কাকে চান?
এটা কি হাসনাত সাহেবের বাসা?
হ্যাঁ। আমি উনার মেয়ে।
বাবা বাসায় নেই?
না, এসে পড়বে। আপনি ভিজে একেবারে কি হয়েছেন। ইশ। আসুন ভেতরে আসুন।
বাড়িতে কি তুমি একা?
হুঁ।
বলো কি, এতবড় একটা বাড়িতে তুমি একা? ভয় লাগছে না?
লাগছে। আপনি ভেতরে আসুন।
পা যে কাদায় মাখামাখি, এই পা নিয়ে ঢুকব?”
ঢুকে পড়ুন। বাথরুমে পা ধুয়ে ফেলবেন। আপনার তো শাড়ি বদলাতে হবে। ঘরে শুকনা শাড়ি আছে।
তোমার নাম কী?
জাহিন।
বাহ্, খুব সুন্দর নাম তো।
জাহিন নামের অর্থ হলো বিচক্ষণ।
কোন ক্লাসে পড়ো?
ক্লাস ফোর।
এই যে তুমি অজানা অচেনা একটা মানুষকে ঘরে ঢুকালে আমি একটা খারাপ লোকও তো হতে পারতাম।
জহিন হাসিমুখে বলল, আপনাকে আমি চিনি। বাবার যার সঙ্গে বিয়ের কথা হয়েছিল স্বাতী আন্টি আপনি উনার বন্ধু। আপনার নাম লিলি। স্বাতী আন্টি আপনার ছবি আমাকে দেখিয়েছে। দেখেই তুমি চিনে ফেললে?”
হুঁ। আমার স্মৃতিশক্তি খুব ভালো। আমি সব সময় পরীক্ষায় ফার্স্ট হই, আপনি জানেন?
না, জানি না তো।
স্বাতী আন্টি আমার কোনো কথা আপনাকে বলে নি
না।
আশ্চর্য তো! পরীর মতো বাচ্চা মেয়েটি খুবই অবাক হলো।
বাথরুমের দরজা খোলা, লিলি হাত-মুখ ধুচ্ছে। খোলা দরজার ধারে জাহিন দাঁড়িয়ে আছে।
শুকনা শাড়ি আপনার জন্য নিয়ে আসি?
না, লাগবে না। যতটুকু ভিজেছে শুকিয়ে যাবে। ভেজা কাপড় মানুষের গায়ে খুব তাড়াতাড়ি শুকায়।
কেন?
মানুষের গা তো গরম। এইজন্য।
আপনাকে কি আমি আন্টি ডাকব?
হ্যাঁ, ডাকো।
শুনতে পারছেন ঝড় হচ্ছে।
তাই তো দেখছি।
আপনি না এলে আমি ভয়েই মরে যেতাম।
তোমার মতো একটা বাচ্চা মেয়েকে একা রেখে তোমার বাবা যে চলে গেলেন, খুবই অন্যায় করেছেন। তোমার বাবা আসুন আমি তার সঙ্গে কঠিন ঝগড়া করব।
লিলি বাথরুম থেকে বের হয়েছে। আসলেই ঝড় হচ্ছে। প্রচণ্ড ঝড়। কালবোশেখি। বছরের প্রথম কালবোশেখি।
জাহিন বলল, আমাদের বাড়িটা ভেঙে পড়ে যাবে না তো আন্টি?
না, ভাঙবে না।
টিনের চালে শব্দ হচ্ছে। শব্দটা বৃষ্টির নয়। অন্যরকম। লিলি বলল, জাহিন শিলাবৃষ্টি হচ্ছে। শিল কুড়াবে?
তাহলে মাথায় একটা তোয়ালে জড়িয়ে আসো, আমরা শিল কুড়াব।
হুঁ।
বিপুল উৎসাহে লিলি শিল কুড়াচ্ছে। বাগানে ছোটাছুটি করছে। তার সঙ্গে আছে জাহিন। কাদায়-পানিতে দুজনই মাখামাখি। দুজনেরই উৎসাহের সীমা নেই। লিলির নিজের বাড়ির কথা মনে নেই, সে যে সম্পূর্ণ অচেনা একটা বাড়িতে কিশোরীদের মতো ছোটাছুটি করছে তাও মনে নেই। তার মনে হচ্ছে এত আনন্দ সে তার সারা জীবনে পায় নি। আম, গাছের ডালে মটমট শব্দ হচ্ছে-ডাল ভাঙছে বোধহয়। লিলি চেঁচিয়ে বলল, জাহিন ঘরে আয়, আয়। মেয়েটিকে সে তুই তুই করে বলছে। তা-ই তার কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। দুজন ছুটে যাবার সময় একটা গর্তের ভেতর পড়ে গেল। যেখান অনেকখানি পানি। জাহিন এবং লিলি দুজই হি হি করে হাসছে। জাহিন কিছু ময়লা পানি খেয়েও ফেলেছে।
ভেজা শাড়ি লিলিকে শেষ পর্যন্ত পাল্টাতে হলো। কাদায় মাখামাখি হওয়া নোংরা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে থাকা যায় না। জাহিন শাড়ি এনে দিল। পুরনো শাড়ি। জাহিনের মার শাড়ি। এমন একজনের যে বেঁচে নেই কিন্তু শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে তার শরীরের গন্ধের কিছুটা হয়তো থেকে গেছে। লিলির অস্বস্তির সীমা রইল না।
.
ঝড়-বৃষ্টি থেমে গেছে। ইচ্ছে করলে লিলি চলে যেতে পারে। সেই ইচ্ছা করার উপায় নেই, মেয়েটি একা। বাবা যে এখনও ফিরছে না তা নিয়ে তার মাথা ব্যথাও নেই। মনে হচ্ছে সে নতুন পরিস্থিতিতে ভালোই আছে। বাবা একবারে না এলেই যেন ভালো। তাহলে নতুন আন্টিকে নিয়ে আরও অনেক মজা করা যায়।
লিলি বলল, ঠাণ্ডায় শরীর কাঁপছে। জাহিন, চা খেতে হবে।
জাহিন বলল, আন্টি আমি চা বানাতে পারি না।
তোকে চা বানাতে হবে না। আমি বানাব কোথায় চা কোথায় চিনি–এইসব দেখিয়ে দিলেই হবে।
এইসবও তো আমি জানি না।
আচ্ছা ঠিক আছে, আমরা খুঁজে বের করব।
আমিও চা খাব আন্টি।
ঠিক আছে। আমাকে রান্নাঘর দেখিয়ে দে।
রান্নাঘর দেখিয়ে দেবার আগেই হাসনাত এসে পড়ল। লিলিকে দেখে সে যতটা চমকালো তার চেয়ে বেশি বোধ করল স্বস্তি।
তুমি কখন এসেছ?
অনেকক্ষণ, ঝড়ের আগে।
বাঁচা গেছে। আমি কি যে দুশ্চিন্তা করছিলাম। জাহিনকে একা বাসায় ফেলে গেছি, শুরু হলো ঝড় বৃষ্টি।
একা ফেলে গেলেন কীভাবে?
আধ ঘণ্টার জন্য গিয়েছিলাম। সেটাও ঠিক হয় নি। উপায় ছিল না। আধ ঘণ্টার জন্য গিয়ে এই যে আটকা পড়লাম, আর বের হতে পারি না। ঝড়ে আটকা পড়ি নি, ঝড় কোনো ব্যাপারই না। অন্য ঝামেলায় আটকা পড়েছি।
লিলি খানিকটা বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, আপনি আমাকে দেখে অবাক হন নি?
হয়েছি। তবে তেমন অবাক হই নি। তুমি আসবে সেটা ধরেই নিয়েছিলাম। স্বাতী দূত পাঠাবে। তুমি ছাড়া তার আর দূত কোথায়?
জাহিন বলল, বাবা আন্টি চা খাবে। আমিও খাব।
হাসনাত ব্যস্ত হয়ে বলল, চা বানিয়ে নিয়ে আসছি। তোমরা বসো। লিলি বলল, আমাকে জিনিসপত্র দেখিয়ে দিন আমি বানিয়ে আনছি।
না না, তুমি অতিথি। তুমি বসো। তুমি হলে ফরেন এ্যামবাসেডার। আমি ফরেন এ্যামবাসেডারকে দিয়ে চা বানাব, তা হয় না।
লিলি স্বস্তিবোধ করছে। হাসনাত সাহেব সহজ-স্বাভাবিক আচরণ করছেন। একজন সহজ হলে অন্যজনের সহজ হওয়া সমস্যা হয় না। লিলি বলল, আপনি চা বানানোর সময় আমরা দুজন যদি পাশে দাঁড়িয়ে দেখি তাহলে কি কোনো অসুবিধা আছে?
না অসুবিধা নেই। ভালো কথা, লিলি তুমি মনে হয় দুপুরে খাও নি।
দুপুরে খাই নি যে বুঝলেন কী করে?
আর্টিস্টের প্রধান কাজ হচ্ছে দেখা। একজন আর্টিস্ট যদি ক্ষুধার্ত মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে না পারে সে ক্ষুধার্ত, তাহলে সে কোনো বেড আর্টিস্টই না।
আপনার ধারণা আপনি বড় আটিস্ট?
হাসনাত হাসতে হাসতে বলল, আমার সে-রকমই ধারণা। তবে অন্যদের ধারণা অবশ্যি তা না। লিলি শোনো, ঘরে খাবার কিছু নেই। পাউরুটি আছে টোস্ট করে দিতে পারি। ডিম আছে পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে ভেজে দিতে পারি। দেব?
দিন।
তুমি স্বাতীর হয়ে যেসব কথা বলতে এসেছ, তা কি জাহিনের সামনে বলতে পারবে নাকি তাকে দূরে সরিয়ে দেব?
ও বেচারি একা একা কোথায় বসে থাকবে?
ওকে গল্পের বই পড়তে পাঠিয়ে দেব। গল্পের বই ধরিয়ে দিলে ওর আর কিছুই লাগে না। আধ ঘণ্টার জন্য যে গিয়েছিলাম, জাহিনের হাতে গল্পের বই ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিলাম।
আপনার মেয়েটি খুব ভালো।
মেয়ে সম্পর্কে আমার নিজেরও তাই ধারণা। ও তার মার মতো হয়েছে। স্বভাব-চরিত্র অবিকল তার মার মতো। অন্যকে নিজের করতে তার পাঁচ মিনিট লাগে। তবে তার মা সুন্দর ছিল না। তার চেহারাটা সাদামাটা ছিল। নাক-মুখ ছিল ভোতা ভোতা। জাহিনের ফিচারস খুব শার্প। ওর চোখ যদি একটু বড় হতো তাহলে সতেরো/আঠারো বছর বয়সে সে সেরা রূপসীদের একজন হতো—তোমাকে ছাড়িয়ে যেত–
আপনারা আর্টিস্টরা মানুষের চেহারা খুব খুঁটিয়ে দেখেন, তাই না?
সবাই দেখে না। আমি দেখি। আমি পোর্ট্রেটের কাজ বেশি করি, আমাকে দেখতে হয়।
লিলি বেশ আগ্রহ নিয়েই হাসনাতের কাণ্ডকারখানা দেখছে। ভদ্রলোক বেশ নিপুণ ভঙ্গিতে ডিম ফেটলেন। চাকু দিয়ে পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ কুচিকুচি করে কাটলেন। লবণ মিশিয়ে ফুটন্ত তেলে ডিম ভাজলেন। ডিম কড়াইয়ে লেগে গেল না, গোলাপি হয়ে ফুলে উঠল।
হাসনাত বলল, লিলি ঘরে মাখন আছে। রুটিতে মাখন লাগিয়ে দেব?
দিন।
রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তো খেতে পারবে না। আমার স্টুডিওতে চলে যাও। জাহিন দেখিয়ে দেবে। জাহিন শোনো, তুমি উনাকে আমার স্টুডিওতে নিয়ে যাও। তারপর তুমি গল্পের বই নিয়ে বসে।
জাহিন গম্ভীর গলায় বলল, তোমরা গোপন কথা বলবে?
গোপন কথা বলব না। এমন কিছু কথা যা ছোটদের শুনতে ভালো লাগবে না।
আমার সব কথাই শুনতে ভালো লাগে।
ভালো লাগলেও শোনা যাবে না।
স্টুডিও বিশাল কিছু না। মাঝারি আকৃতির ঘর। ঘরে জানালা বন্ধ বলে গুমোট গুমোট ভাব। কড়া তাৰ্পিন তেলের গন্ধ। ঘরময় রঙের বাটি। বেতের চেয়ার কয়েকটা আছে। চেয়ারের ধুলার আস্তর দেখে মনে হয় চেয়ারগুলো ব্যবহ্বর হয় না। এক কোনায় ক্যাম্প খাটে মশারি খাটানো। ঘুপচি ঘরের ক্যাম্প খাটে কে ঘুমায়?
লিলি চেয়ারে বসেছে। তার হাতে চায়ের কাপ। হাসনাত বসেছে মেঝের কার্পেটে। অনেকটা পদ্মাসনের ভঙ্গিতে। বন্ধ জানালা খুলে দেয়ায় গুমোট ভাবটা নেই। বাইরের ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। হাসনাতের হাতে সিগারেট। সে সিগারেটে টান দিয়ে বলল, স্বাতী তোমাকে তার ছবিটার জন্য পাঠিয়েছে, তাই তো?
হ্যাঁ।
ওর মনে ভয় ঢুকে গেছে আমি এই ছবি সবাইকে দেখিয়ে বেড়াব। তাই না?
হুঁ।
তুমি ওকে বুঝিয়ে বলবে যে, এ জাতীয় কাজ আমি কখনই করব না। আর্টিস্ট হিসেবে আমি পিকাসো না, কিন্তু মানুষ হিসেবে বড়। তুমি বরং এক কাজ করো আমি ছবিটা ভালোমতো র্যাপ করে দিচ্ছি। নিয়ে যাও, ওকে দিয়ে দেবে। তবে বড় ছবি নিতে তোমার হয়তো কষ্ট হবে।
কষ্ট হবে না। আমি নিতে পারব।
স্বাতী তোমার খুব ভালো বন্ধু, তাই না?
হ্যাঁ। আমার একজনই বন্ধু। আপনি বোধহয় ওর ওপর খুব রেগে আছেন।
আমি তার ওপর মোটেই রেগে নেই। আমার একটা ক্ষীণ সন্দেহ সব সময়ই ছিল যে, এই জাতীয় কিছু সে করে বসবে।
এ রকম সন্দেহ হবার কারণ কি?
হুট করে আসা আবেগ হুট করেই চলে যায়। স্বাতী বুদ্ধিমতী মেয়ে, সে শেষ মুহূর্তে হলেও ব্যাপারটা ধরতে পেরেছে। বোকা মেয়েগুলো ধরতে পারে না। স্বাতী না হয়ে অন্য কোনো মেয়ে হলে কি করত জানো? বিয়ে করে ফেলত তারপর নানান অশান্তি। আমি আমার মেয়েটাকে নিয়ে পড়তাম বিপদে।
বিয়ে ভেঙে গিয়ে আপনার জন্যও ভালো হয়েছে।
হ্যাঁ, আমার জন্য ভালো হয়েছে। আসলে একা থাকতে থাকতে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। নতুন করে সংসার শুরু করা আমার জন্য কষ্টকর হতো। আমার বিয়েতে রাজি হবার প্রধান কারণ কিন্তু আমার মেয়ে। ওর একজন মাদার ফিগার দরকার। মায়ের জন্য মেয়েটার ভেতর তৃষ্ণা জন্মেছে। যে-ই এ বাড়িতে আসে মেয়েটা তার মধ্যেই তার মাকে খোঁজে।
স্বাতীর কাছে এই ব্যাপারটা কখনও বলেছেন?
বলেছি। এও বলেছি জাহিন যে তার মাকে খোঁজে তাই না, আমি নিজেও তার ভেতর আমার স্ত্রীকে খুঁজছি। এখন বুঝতে না পারলেও একদিন বুঝবে। তখন সে কষ্ট পাবে।
ও বুঝতে চায় নি?
না, বুঝতে চায় নি। তোমাদের মতো বয়েসী মেয়েদের সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে অন্যের যুক্তি ছোট করে দেখা। এই সময়ের মেয়েদের নিজেদের ওপর আস্থা থাকে খুব বেশি।
এটা কি খারাপ?
খারাপ না, ভালো। তবে শুধু নিজেদের ওপর আস্থা থাকবে অন্যদের ওপর থাকবে না এটা খারাপ। তুমি কি আরেক কাপ চা খাবে লিলি?
জি-না, সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে আমি এখন যাব। আপনি ছবিটা দেবেন বলেছিলেন দিয়ে দিন।
তুমিও দেখি আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারছ না।
আমি পারছি।
তাহলে ছবিটা সঙ্গে নেয়ার জন্য এত ব্যস্ত কেন?
স্বাতী খুব মানসিক চাপের ভেতর আছে। ছবিটা পেলে চাপ থেকে মুক্ত হবে। ও খুব খুশি হবে।
ছবিটা দিয়ে তাকে খুশি করতে চাচ্ছ?
জি।
দিচ্ছি, ছবি দিয়ে দিচ্ছি। তুমি না এলেও তার ছবি আমি তাকে দিয়ে দিতাম। ছবিটা হয়েছে খুব সুন্দর। দেখতে চাও?
জি-না।
দেখতে পারো। নগ্নতা তো কোনো লজ্জার বিষয় হতে পারে না। লজ্জার বিষয় হলে প্রকৃতি আমাদের কাপড় পরিয়ে পৃথিবীতে পাঠাত। আমরা নগ্ন হয়ে পৃথিবীতে এসেছি। নগ্নতার জন্য লজ্জিত হবার বা অস্বস্তিবোধ করার আমি কোনো কারণ দেখি না।
লিলি নিচু গলায় বলল, আমি ছবিটা দেখতে চাচ্ছি না।
লজ্জা পাচ্ছ যখন আমার সামনে দেখার দরকার নেই কিন্তু স্বাতীর কাছ থেকে একবার দেখে নিও।
ওকে কি কিছু বলতে হবে?
ওকে শুধু বলব, ছবিটা যেন নষ্ট না করে। একদিন সে বুড়ো হয়ে যাবে। দাঁত পড়বে, চুলে পাক ধরবে, তখন যদি ছবিটা দেখে তীব্র আনন্দ পাবে। লোকে বলে যৌবন ধরে রাখা যায় না–এটা ঠিক না। আমি তার যৌবন ধরে রেখেছি। আলোর একটা খেলা ছবিটাতে আছে। এত সুন্দর কাজ আমি খুব কম করেছি। চলো তোমাকে রিকশায় তুলে দিয়ে আসি। এ-রকম বিশাল ছবি সঙ্গে করে নিয়ে যেতে অস্বস্তি লাগবে না তো?
না।
তুমি বললে স্বাতীদের বাড়ির গেট পর্যন্ত আমি ছবিটা পৌঁছে দিতে পারি। আমি গেট থেকে বিদায় নেব। গেট থেকে বাড়ি পর্যন্ত তুমি নিয়ে গেলে।
না না, আপনি থাকুন। জাহিনের সঙ্গে গল্প করুন। আপনার মেয়েটা অসম্ভব ভালো।
আগে একবার বলেছ।
আবারও বললাম। একটা মিথ্যা একবারের বেশি দুবার বলা যায় না। সত্য কথা অসংখ্যবার বলা যায়।
.
স্বাতী লিলিকে দেখে আকাশ থেকে পড়ল। ভর সন্ধ্যায় রিকশায় পাঁচ ফুট বাই চার ফুট ছবি নিয়ে লিলি একা একা উপস্থিত হবে এটা ভাবাই যায় না। লিলির মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। হাত দিয়ে ছবি সামলাতে তার মনে হয় কষ্টও হয়েছে।
লিলি বলল, নে তোর ছবি।
স্বাতী বলল, থ্যাংকস, থ্যাংকস, মেনি থ্যাংকস। থ্যাংকস ছাড়া আর কি চাস বল?
আর কিছু চাই না।
চাইতে হবে। কিছু-একটা চাইতে হবে। তোর মুখটুখ শুকিয়ে কি হয়ে গেছে খুব ঝামেলা গেছে, তাই না।
ঝামেলা হয় নি।
চাইতেই দিয়ে দিল?
হুঁ।
আয়, ঘরে এসে বোস। তোকে দেখে মনে হচ্ছে খুব টেনশনে আছিস।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে আমি বাসায় চলে যাব।
পাগল হয়েছিস? তোকে আমি এখন ছাড়ব নাকি? গল্প শুনব না? তোর কোনো ভয় নেই, আমি তোকে গাড়ি করে বাসায় পৌঁছে দেব। আয়।
লিলির নিজেকে যন্ত্রের মতো লাগছে। বাড়ির কথা তার এতক্ষণ মনে হয় নি। এখন মনে হচ্ছে। বাড়িতে কোন নাটক হচ্ছে কে জানে। সে বাড়িতে পা দেয়ামাত্র নাটক কোন দিকে মোড় নেবে তাও জানে না।
স্বাতী বলল, এ রকম মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন আয়।
লিলি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে রওনা হলো। স্বাতীর হাতে ফ্রেম করা ছবি। বিশাল দেখালেও তেমন ওজন নেই। নাজমুল সাহেব বসার ঘরের সোফায় বার্নিশ দিচ্ছিলেন। তার নাকে রুমাল বাঁধা। তিনি বললেন, লিলি সন্ধ্যাবেলা কোত্থেকে?
স্বাতী বলল, ও আমার জন্য একটা গিফট নিয়ে এসেছে বাবা। একটা পেইন্টিং। আমার জন্মদিনের উপহার। জন্মদিনে আসতে পারে নি। আজ উপহার নিয়ে এসেছে।
এত বড় পেইন্টিং?
হুঁ, বিশাল। এখন তোমরা দেখতে পাবে না। কোনো এক শুভক্ষণে শুভ উদ্বোধন হবে।
লিলি মা কি আজ থাকবে আমাদের বাসায়?
লিলি বলল, জি না চাচা।
থেকে যাও মা। থেকে যাও। হইচই করো। গল্পগুজব করো। বসয়সটাই তো হইচইয়ের। গল্পগুজবের। কিছুদিন পর হইচই করতেও ভাল লাগবে না। গল্পগুজব করতেও ভালো লাগবে না। সময় কাটবে রান্নাঘরে। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কবিতা আছে না–
রাধার পর খাওয়া
খাওয়ার পর রাধা
এই টুকুতেই জীবনখানি বাঁধা।
স্বাতী বলল, তোমাকে কবিতা আবৃত্তি করতে হবে না বাবা। তুমি বার্নিশ চালিয়ে যাও। আমরা অনেকক্ষণ গল্প করব। তারপর তুমি তোমার গাড়িটা ধার দেবে আমি লিলিকে পৌঁছে দেব।
স্বাতী ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল। ব্যস্ত ভঙ্গিতে ছবির ওপর ভাজ করে রাখা কাগজ সরাতে লাগল। খুশি খুশি গলায় বলল, তুই একটু দূরে গিয়ে দাঁড়া লিলি। দূর থেকে দেখ কত সুন্দর ছবি। একটু দূরে না দাঁড়ালে বুঝতে পারবি না। ঘরে আলো কম। আরেকটু আলো থাকলে ভালো হতো। তুই দরজার কাছে যা লিলি। দরজার কাছ থেকে দেখ।
লিলি দেখছে।
সে নড়তে পারছে না। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। নগ্ন মেয়েটিকে দেখতে মোটেই অস্বাভাবিক লাগছে না। মনে হচ্ছে এটাই স্বাভাবিক। খোলা জানালার আলো এসে মেয়েটির পিঠে পড়ছে। বই পড়তে পড়তে একটু আগে মনে হয় মেয়েটি একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেছে। মধ্যাহ্নের সেই দীর্ঘনিশ্বাস আটকে আছে ছবির ভেতর।
স্বাতী মুগ্ধ গলায় বলল, ছবি দেখে বুঝতে পারছিস আমি কত সুন্দর?
লিলি জবাব দিল না। সে এখনও চোখ ফেরাতে পারছে না।
কি রে, ছবিটা কেমন তাতো বলছিস না।
সুন্দর!
শুধু সুন্দর? আর কোনো বিশেষণ ব্যবহার করবি না?”
লিলি মুগ্ধ গলায় বলল, ছবিটা উনার কাছ থেকে আনা ঠিক হয় নি। উনি ছবিটা খুব মমতা দিয়ে একেঁছেন।
স্বাতী বলল, তুই কি চাস তোর এ-রকম একটা ছবি আঁকা হোক?
চুপ কর।
আচ্ছা যা চুপ করলাম। যদিও তোর চোখে তার ছায়া দেখতে পাচ্ছি। তোর মন বলছে, আহারে আমার যদি এ-রকম একটা ছবি থাকত। বুঝলি লিলি, মানুষের পুরো জীবনটাই হলো এক গাদা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অপূর্ণ তৃষ্ণার সমষ্টি। A collection of unfulfilled desires. অধিকাংশ তৃষ্ণা মেটানো কিন্তু কঠিন না। মেটানো যায়। সাহসের অভাবে আমরা মিটাতে পারি না।
বেশি বেশি সাহস কি ভালো?
সাহস হলো মানুষের প্রধান কিছু গুণের একটি।
স্বাতী আমি বাসায় যাব। আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আয়। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমি একা একা বাসায় যেতে পারব না।
দেব, বাসায় পৌঁছে দেব। এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? তুই আরাম করে একটু বোস। গুছিয়ে বলত শুনি ছবির ব্যাপারটা ওকে কিভাবে বলেছিস।
সাধারণভাবে বলেছি। তোরা দুজনে মিলে কি অনেকক্ষণ গল্প করেছিস?
হ্যাঁ।
মানুষটাকে ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে না?”
হ্যাঁ।
ইন্টারেস্টিং কেন মনে হয়েছে বলত?
জানি না। আমি তোর মতো এত বিচার বিশ্লেষণ করি না।
স্বাতী গম্ভীর গলায় বলল, লোকটাকে ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে কারণ তার মধ্যে একটা গৃহী ভাব আছে। অধিকাংশ পুরুষমানুষের মুখের দিকে তাকালে মনে হয় এদের মন পড়ে আছে বাইরে। হাসনাতের বেলায় উল্টোটা মনে হয়। ওকে বিয়ে করলে জীবনটা ইন্টারেস্টিং হতো।
তা হলে বিয়ে করলি না কেন?
স্বাতী জবাব দিল না। হাসতে লাগল। হাসি থামিয়ে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, বুধবার বিয়ে হবার কথা মঙ্গলবার রাতে হঠাৎ মনে হলো আসলে আমাকে ও ভালোবাসে না। ও আমার মধ্যে অন্য কাউকে খুঁজছে প্রবলভাবেই খুঁজছে। ওকে বিয়ে করলে সুখী একটা পরিবার তৈরি হতো। এর বেশি কিছু না।
লিলি বলল, সুখী পরিবার তুই চাস না? স্বাতী লিলির দিকে ঝুঁকে এসে বলল, আমাদের পরিবারটা দেখে তোর মনে হয় না, কি সুখী একটা পরিবার? মনে হয় কি-না বল?
হয়।
বাবাকে দেখে মনে হয়, বাবা মার জন্য কত ব্যস্ত। মাকে দেখে মনে হয় স্বামী অন্তঃপ্রাণ। স্বামী কী খেয়ে খুশি হবে এই ভেবে এটা রাধছে, ওটা রাঁধছে। তার ডায়াবেটিস বেড়ে যাবে এইজন্য চা খেতে দিচ্ছে না। আসলে পুরোটাই ভান।
ভান?
অবশ্যই ভান। এক ধরনের প্রতারণা। ভালোবাসা ভালোবাসা খেলা।
বুঝলি কী করে খেলা?
বোঝা যায়। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। যে জন্য বাবা দিনরাত নিজের কাজ নিয়ে থাকে। এই ফার্নিচারের বার্নিশ ঘষছে, ঐ করাত নিয়ে কাঠ কাটছে। মা আছে রান্নাঘরে। অথচ কথা বলার সময় একজনের জন্য অন্যজনের কী গভীর মিথ্যা মমতা!
মিথ্যা মনে করছিস কেন? মমতা তো সত্যিও হতে পারে।
আমি জানি সত্যি না। তারা খেলছে পাতানো খেলা। পৃথিবীটাই পাতানো খেলার জায়গা। এই খেলা তুই হয়ত খেলবি। আমি খেলব না।
লিলি বলল, তোর দার্শনিক কথাবার্তা শুনতে আমার এখন ভালো লাগছে না। আমি বাসায় যাব।
চল তোকে দিয়ে আসি। ও আচ্ছা, তোকে বলতে ভুলে গেছি। এর মধ্যে কতবার যে তোর খোঁজে তোর বাবা টেলিফোন করেছেন। তুই নেই বলার পরেও বিশ্বাস করেন নি। একবার নিজে এসে দেখে গেছেন। তুই কি বাসায় কাউকে না। বলে এসেছিস?
হুঁ।
তাহলে তো বাসায় গেলে আজ সর্বনাশ হয়ে যাবে।
হুঁ।
তোর বাবা তোকে কিমা বানিয়ে ফেলবে।
লিলি ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তার হাত কাঁপতে শুরু করেছে।
.
লিলি বাসায় পৌঁছল রাত দশটার একটু আগে। স্বাতী তাকে গাড়ি করে পৌঁছে দিয়েছে। সে বাড়ির সামনে নামে নি, লন্ড্রির সামনে নেমে হেঁটে হেঁটে বাসায় গিয়েছে। বাড়ির সদর দরজা খোলা, প্রতিটি বাতি জ্বলছে। বাড়িতে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেছে তা আলো দেখলে বোঝা যায়। ভয়ঙ্কর কিছু ঘটলে মানুষ যেখামে যত বাতি আছে জ্বেলে দেয়।
লিলি ভয়ে ভয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। তাকে প্রথমে দেখল মতির মা। সে একগোছা বাসন-কোসন নিয়ে কলঘরের দিকে যাচ্ছিল। লিবিকে দেখেই–ও আফাগো বলে বিকট চিৎকার দিল। হাত থেকে সম্ভবত ইচ্ছে করেই সব বাসন কোসন ফেলে দিল। ঝনঝন শব্দ হলো। দোতলা থেকে রুমু ঝুমু একসঙ্গে নিচে নামছে।
বড় চাচা তার ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসেছেন।
তিনি বললেন, কোথায় লিলি, আয় দেখি আমার ঘরে আয়।
লিলি ঝুমুর দিকে তাকিয়ে বলল, মা কোথায় রে?
ঝুমু বলল, মার বিকেল থেকে বুকে ব্যথা হচ্ছে। মা শুয়ে আছে। মার ধারণা তুমি আর ফিরে আসবে না।
বাবা! বাবা কোথায়?
বাবা তোমাকে খুঁজতে গেছে।
কোথায় খুঁজতে গেছে?
কোথায় আর খুঁজবে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। আর ছোট চাচা গো, হাসপাতালে।
ঝুমু বলল, আমার এতক্ষণ ভয় লাগে নি। এখন ভয় লাগছে। ভয়ে হাত-পা কাঁপছে আপা।
কেন?
মনে হচ্ছ বাবা ফিরে এসে তোমাকে খুনটুন করে ফেলবে।
বড় চাচা বারান্দা থেকে আবারও ডাকলেন, লিলি কোথায়? লিলি বলল, চাচা আপনি ঘরে যান। আমি আসছি।
তাড়াতাড়ি আয়।
লিলি মার ঘরে গেল। সব ঘরের বাতি জ্বলছে। শুধু এই ঘরের বাতি নেভানো। লিলি দরজা থেকে ডাকল–মা।
ফরিদা বুকে তীব্র ব্যথা নিয়ে অনেক কষ্টে পাশ ফিরলেন। চাপা গলায় বললেন, বাতি জ্বালা।
লিলি বাতি জ্বালাল। মায়ের দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। একদিন মানুষটা কেমন হয়ে গেছে। যেন একজন মরা মানুষ। তিনি বললেন, তুই ভা.. খেয়েছিস?
লিলির খুবই অবাক লাগছে। তাকে দেখে তার মার প্রথম যে কথাটা মনে হলো। তা হচ্ছে, সে ভাত খেয়েছে কিনা। সব মা কি এ-রকম? না শুধু তার মা? ফরিদ। বললেন, তুই আলুভাজি পছন্দ করিস, তোর জন্য আলুভাজি করেছি।
তোমার কি বুকে ব্যথা খুব বেশি মা?
হ্যাঁ।
হাত বুলিয়ে দেব?
দে।
নেয়ামত সাহেব বাড়ি ফিরলেন রাত এগারোটার দিকে। লিলি তার ঘরে শুয়ে ছিল। ঝুমু দৌড়ে এসে খবর দিল। ভয়ে কাঠ হয়ে লিলি অপেক্ষা করছে কখন তা ডাক পড়ে। তার ডাক পড়ছে না।
ঝুমু কিছুক্ষণ পর আবার এসে জানালো, বাবা বারান্দায় বসে কাঁদছে।
হ্যাঁ, কান্নার শব্দ লিলি শুনছে। কী বিশ্রী শব্দ করে কান্না!
কান্না থামার পরেও নিয়ামত সাহেব তার মেয়েকে কাছে ডাকলেন না। তিনি এক বৈঠকে এক শ রাকাত নামাজ মানত করেছিলেন। তিনি মানত আদায় করতে জলচৌকিতে উঠে বসলেন।
শুধু নামাজ না, দুটি খাসিও মানত করা হয়েছিল। জাহেদুর রহমান রাতেই আমিনবাজার থেকে খাসি কিনে এনেছে। খাসি দুটি ব্যা ব্যা করেই যাচ্ছে।
লিলিদের যেখানে যত আত্মীয়স্বজন ছিল সবাই আসতে শুরু করেছে। সবার কাছেই খবর গিয়েছে লিলিকে পাওয়া যাচ্ছে না। এমদাদিয়া মাদ্রাসার এক হাফেজ সাহেবকে সন্ধ্যাবেলায় খবর দিয়ে আনা হয়েছিল কোরান খতম করার জন্য। তিনি সাত পারা পর্যন্ত পড়ে ফেলেছেন। এখন অষ্টম পারা শুরু করেছেন। বাড়িতে হইচই! কোনো কিছুই তাঁকে বিচলিত করছে না। তিনি একমনে কোরান পাঠ করে যাচ্ছে।